![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শামস ই তাব্রিজি ২
মৌলানা জালালুদ্দিন রুমি
অনুবাদ ও অর্থ
১
সেইসব প্রকাশকারী রাত্রিতে আমি অভিভূত হলাম
অন্যের অর্ধচন্দ্র হলো আমার পূর্ণচন্দ্র
যে রাতে প্রেমিক আমাদের মাঝে থাকে
সেই রাত সহস্র মধ্যাহ্ন-এর ন্যায় প্রকাশকারী হয় |
২
আমাদের চারপাশের দুর্বল কার্যকারণ হার মানে
কারণ আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি যেদিনকে প্রথম কারণ প্রকাশ করবে
একজন দরিদ্র যাকে দারিদ্র পরিহার করে না |
অন্যের পরিশ্রম সে গর্বের সাথে নিজে করে |
৩
ঈশ্বর না করুন ওই সব প্রতিক আমার জোব্বার ভেতর থাকে
প্রতিটি শহরে সে মুকুট আমি পরি |
সেই মুকুটের মুক্তগুলি যা উভয় দুনিয়াকে ছাপিয়ে যায়
তা আমার হৃদয়সাগরের মাঝে ডুবে থাকে |
৪
এই দুনিয়ায় আমাদের পুনরুত্থান হয়
যতদিন পর্যন্ত না অন্যান্য দিন ও বিচার দিনের চিন্তা মুছে যায়
এবং ঈশ্বরের অনন্ত কৃপা পাওয়ার উপযুক্ত হয়
অন্য সমস্ত কিছুর কৃপাকে পরিত্যাগ করে |
শামস ই তাব্রিজের মত সমস্ত দুনিয়া
এক ছাতার ছায়ায় অবস্থান করে |
এই কবিতার অর্থ অত্যন্ত সুগভীর | আমি সেটা বলার চেষ্টা করছি | কবিতাটি চারটি ভাগে বিভক্ত | প্রথম ভাগে কবি বলছেন এক রত্রির কথা যা প্রকাশকারী| এই রাত্রিতে অন্যে যেখানে অর্ধচন্দ্র দেখছে সেখানে কবি পূর্ণচন্দ্র দেখছেন | তাছাড়া এই রাত্রিতে কবির প্রেমিকা কবির সাথে আছেন| তাই রাত্রি কবির কাছে সহস্র মধ্যাহ্ন-এর ন্যায় প্রকাশকারী | সাধারনভাবে এই হলো কবিতাটির মানে | সাধারণ দৃষ্টিতে এটি হলো একটি প্রেমের কবিতা | মোটামাথার ইউরোপীয়রা এই অর্থই করেছে | প্রেমিকের কাছে প্রেমিকা উপস্থিত হলে সমস্ত রাত্রিই প্রকাশশীল হয়ে যায় | এসব তো বোঝাই যায় |
কিন্তু যেটা বোঝা যায় না তাহলো কিভাবে এক রাত্রিতে একই চাঁদকে দুরকম দেখায় | “ অন্যের অর্ধচন্দ্র হলো আমার পূর্ণচন্দ্র” : এটা কিভাবে সম্ভব হয় ? চাঁদ হয় অর্ধ হয় নয়তো পূর্ণ হয় | কিন্তু বিভিন্ন লোকের কাছে বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয় না | সমস্ত লোকের কাছে একই রকম দেখায় | কিন্তু কবি বলেছেন যে এই রাতে “ অন্যের অর্ধচন্দ্র হলো আমার পূর্ণচন্দ্র” | তাহলে এটা নিশ্চই কোনো সাধারণ রাত নয় | অপিতু কোনো বিশেষ রাত | আমার মতে এই রাত হলো মানুষের মনের অজ্ঞানতার অন্ধকার | চাঁদ হলো এখানে জ্ঞান তথা আল্লা |চাঁদের আলো হলো আল্লার জ্ঞানের আলো | কারণ এভাবে ধরলেই দেখা যায় যে অন্যের মনে অজ্ঞানতার আঁধার বেশি , সেখানে আল্লার আলো অর্ধেকটা আসছে , অতএব চন্দ্রমা হলো অর্ধ | কিন্তু কবির মনে অজ্ঞানতার আঁধার আর নেই তাই সেখানে চাঁদের সমস্ত আলো আসছে | তাই চাঁদ হলো পূর্ণ | এভাবেই “ অন্যের অর্ধচন্দ্র হলো আমার পূর্ণচন্দ্র” |
শেষের দুটো লাইন বলছে যে যখন প্রেমিকা কবির সাথে থাকে তখন সমস্ত রাত হাজার দুপুরের মত উজ্জ্বল হয় | এখানে প্রেমিকা আমাদের রক্তমাংসের প্রেমিকা নয় কারণ সেই রকমের প্রেমিকার উপস্থিতিতে কোনো রাত সহস্র দুপুরের মত উজ্জ্বল হয় না | অন্তত চর্মচক্ষুতে তা দেখা যায় না | সুতরাং এখানে প্রেমিকা হলো সুফিদের প্রেমিকা আল্লা| যদি মনে আল্লা উপস্থিত থাকে তাহলে অজ্ঞানতার অন্ধকার থাকে না | মনের আকাশ সহস্র দুপুরের মত উজ্জ্বল হয়ে যায় | তবে কবি বলেছেন “সেই রাত সহস্র মধ্যাহ্ন-এর মত প্রকাশকারী হয় |” এখানে আল্লার জ্যোতি এত তীব্র যে চোখে অন্ধকার লেগে যায় | তাই কবি বলেছেন রাত এবং প্রকাশের কথা | এই রাত হলো জ্যোতির কারণে জ্ঞান চক্ষুর অন্ধকার | অজ্ঞানতার অন্ধকার নয় | সে অন্ধকার তো নেই | চলে গিয়েছে | এ হলো জ্যোতির অন্ধকার | দুই অন্ধকার এক নয়| অনেকটা গীতায় কৃষ্ণের বিশ্বরূপের বর্ণনার মত : যবে কোটি কোটি সূর্য গগনে কিরণ দেয় .... ( দিবি সুর্যসহস্রস্য ভবেত যুগপত্থিতা .....) ইত্যাদি | এখানেই একটা জিনিস দেখার আছে | প্রথম দুই লাইনে বলা অন্ধকার হলো অজ্ঞানতার অন্ধকার আর শেষ দুলাইনে বলা অন্ধকার হলো আল্লার জ্যোতির ফলে জ্ঞানচক্ষুর অন্ধকার | দুই অন্ধকার এক নয় | নির্ভেজাল আধ্যাত্মিক একটি কবিতাকে রোমান্টিক ইউরোপীয়রা প্রেমের কবিতা বলে প্রচার করেছে |
দ্বিতীয় ভাগে কবি বলেছেন যে আমাদের চারপাশের যে ঘটনা ঘটে চলেছে তাদের মধ্যে যে কার্যকারণ সম্বন্ধ দার্শনিকরা নির্ণয় করেছেন তা অত্যন্ত দুর্বল | কারণ সেই কার্যকারণ সম্পর্কগুলি চিরস্থায়ী নয় | জগত নিতান্তই ক্ষনস্থায়ী | তা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে | আজকে যে কার্যের যে কারণ আছে , কালকে সেই কার্যের অন্য কারণ হচ্ছে | এই দুদিনের পরিবর্তনশীল জগতে কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক সলিড নয় | শুধুমাত্র আল্লা হলো প্রথম কারণ | সেই প্রথম কারণ আল্লা জগতের নিয়মকে নিয়ন্ত্রণ করছেন | কবি আল্লার সেই ভাঙাগড়ার খেলা দেখে চলেছেন | এই হলো প্রথম দুই লাইনের অর্থ |
শেষের দুই লাইনে কবি বলেছেন এমন এক মানুষের কথা যে দারিদ্রে কাতর হয় না | সে অন্যের দুঃখ দারিদ্র্যকে অনায়াসে আপন করে নেয়| এই দুই লাইনের সাথে আগের দুই লাইনের সম্পর্ক কি ? আমার মনে হয় নিত্য পরিবর্তনশীল জগতে এই ধরনের মানুষই সুখে থাকে যে দারিদ্র্যে কাতর হয় না | এই কথাটাই হয়ত কবি বলতে চেয়েছেন |
তৃতীয় ভাগে কবি কতগুলি প্রতীকের কথা বলেছেন | প্রতীকগুলি অজ্ঞানতার চিহ্ন | অন্য অনেকে , যাদের জ্ঞান নেই , অনেক প্রতিক চিহ্ন ধারণ করে | এটা সব ধর্মেই দেখা যায় |কিন্তু এইসব চিহ্নধারীদের কোনো জ্ঞান নেই | অর্থাত তারা মুর্খ |কবি মুর্খ নন | তিনি জ্ঞানী | তাই তিনি প্রতিক পূজার হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছেন |এই অর্থ পাওয়া যায় পরের তিনটি লাইনে |পরের তিনটি লাইন একসাথে যুক্ত | এখানে একটা মুকুটের কথা বলা হয়েছে | মুকুটের মুক্তগুলি কবির হৃদয়ের সমুদ্রে ডুবে আছে | এখানে মুখ্যার্থ বাধিত কারণ রক্তমাংসের হৃদয়ের সমুদ্র হয় না | অতএব লক্ষ্যার্থ ধরতে হবে | হৃদয় বলতে জ্ঞানকেও বোঝায় | জ্ঞানের সমুদ্র বলে কথা আছে | তাহলে দাড়ালো কবির জ্ঞান সমুদ্রের মুক্তগুলি দিয়ে মুকুট তৈরী হয়েছে | এখানে মুক্ত কেমন ? মুক্তগুলি দুটি জগতকে ছাপিয়ে যায় অর্থাত জগতের শ্রেষ্ঠ জ্ঞান | অর্থাত জ্ঞান সমুদ্রের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানগুলি দিয়ে জ্ঞানের মুকুট কবি মাথায় পরিধান করেন | অর্থাত কবির কাছে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান আছে , এটাই কবি বলতে চান | শেষ তিনটি লাইনই প্রথম লাইনটিকে ব্যাখ্যা করেছে | যার কাছে উভয় জগতের শ্রেষ্ঠ জ্ঞান আছে সে কেন মিথ্যা প্রতিক পুজো করবে বা ধারণ করবে ?
চতুর্থ ভাগে কবি বলেছেন কেন আমাদের পুনরুত্থান হয় ? আমাদের পুনরুত্থান হয় কারণ আমরা বিচার দিনের এবং অন্যান্য দৈনন্দিন সাংসারিক কামনা বাসনা দ্বারা জর্জরিত | “বিচার দিনে আমরা পুনরুত্থিত হব” এই কামনা বাসনাই পুনরুত্থানের হেতু | (হিন্দু ধর্মের পুনর্জন্মের সাথে মিল আছে |) এই হলো প্রথম লাইন দুটির অর্থ | পরের লাইন দুটিতে কবি বলেছেন যে আল্লার কৃপা কিভাবে পাওয়া যায় ? সমস্ত জাগতিক বস্তুর কৃপা পরিত্যাগ করলে আল্লার কৃপা পাওয়া যায় | এখানেও হিন্দু ধর্মের সাথে কিছু মিল পাওয়া যায় যেখানে গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছিলেন : “সর্বধর্ম পরিত্যাজ্যং মামেকং শরণং ব্রজ |” অর্থাত সমস্ত জাগতিক ধর্ম ছেড়ে এক আমার শরণে এস | আজকের জাগতিক ভোগী মুসলিমরা কি ভাববেন তা জানি না |
শেষ দুটি লাইনের অর্থ অত্যন্ত গভীর | “শামস এ তাব্রিজের মত সমস্ত দুনিয়া একই ছাতার ছায়ায় আশ্রয় নেয়” | প্রতিটি মানুষই এখানে এক একটি দুনিয়া বা জগত |মানুষের শরীরে কোনো দুনিয়া চর্মচক্ষুতে দেখা যায় না | তাই মুখ্যার্থ বাধিত | অতএব লক্ষ্যার্থ ধরতে হবে | এই দুনিয়া মানুষের মনে আছে | অর্থাত মানুষের মনোজগতের কথা বলা হয়েছে | ছাতাটি হলো আল্লা | যখন যাবতীয় জাগতিক কামনা বাসনা বিসর্জন দিয়ে আল্লার কৃপা মানুষ পায় তখন তার মনোজগত আল্লার ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেয় | এই লাইন দুটি আগের দুটি লাইনের সাথে কার্যকারণ সম্পর্কে যুক্ত | আগের লাইন অনুযায়ী যখন মানুষ আল্লার কৃপা পায় তখনই তাদের মনোজগত আল্লার ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেয় | অর্থাত মন আল্লায় লীন হয়ে যায় |
রুমির কবিতাগুলি যত অনুবাদ আর ব্যাখ্যা করছি ততই অবাক হয়ে যাচ্ছি | এই আধ্যাত্মিক ব্যাপারগুলি ইউরোপীয়দের অনুবাদে কখনো পড়েছি বলে মনে পড়ে না | ওমর খৈয়ামের রুবাইয়ের অনুবাদ করার ইচ্ছা আছে | মনে হয় সেখানেও এই রকম আধ্যাত্মিক বিষয় পাওয়া যাবে |
২| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:০৬
সত্যান্বেসী বলেছেন: ধন্যবাদ উদাসীন চৌধুরী আসলে আমি চাই যে শামস ই তাব্রিজি সাধারণ বাঙালি বাংলা ভাষায় পড়ুক | সেই জন্যই আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা |
©somewhere in net ltd.
১|
১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:৩০
উদাসীন চৌধুরী বলেছেন: ফারসীতে আরো উত্তম রুপে বর্ণনা করা হয়েছে। আসলে অনুবাদে মূল লিখা ফুটে উঠেনা। একটু চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাবো যে, মাওলানা রুমী যখন এ সকল কবিতা রচনা করছেন, তখন ইউরোপীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। আপনাকে ধন্যবাদ সুন্দর অনুবাদের জন্য।