![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।
ছবি আঁকার প্রতিভা আমার কখনোই ছিল না। এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার আগে একটি খেলনা অনুবীক্ষণ যন্ত্র তৈরি করেছিলাম, কারণ তখন ভেবেছিলাম আমি বিজ্ঞানী হতে যাচ্ছি। এ খেলনা অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে পেঁয়াজ-রসুনের কোষ দেখতাম আমি। অনুবীক্ষণ যন্ত্রটির মধ্যে যে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটি ছিল, তা নিয়েছিলাম অন্য একটি খেলনা ক্যামেরা থেকে। এক সময় এ খেলনা অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে পেঁয়াজ-রসুনের কোষ দেখাটা কিছুটা কাজে এলো বিজ্ঞানের চিত্রমালা আঁকার ক্ষেত্রে।
কারণ একদিন আমাদের বিজ্ঞানের শিক্ষক মৃণাল চন্দ্র পালের ব্যবহারিক ক্লাশে চিত্র আঁকার ভুলের কারণে আমাকে ছাড়া প্রত্যেকেই কড়া বেত খেলো। আমি তখন খারাপ ছাত্র হয়ে গেছি প্রায়। নানা কারণেই। কিন্তু আমি নিজেই ঠিক বুঝতে পারলাম না, আমার চিত্রটা নির্ভুল হলো কেন! ক্লাশ শেষে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লো আমার ওপর। বিশেষ করে মেয়েরা। আমি বললাম, আমি নিজেও ঠিক জানিনা, আমার চিত্রটা কী কারণে সঠিক, আর তোমাদেরটা ভুল। তবে এটা জানি রাত জেগে আমি মনোযোগ দিয়ে চিত্রটা এঁকেছি। আঁকার আগে ভালোভাবে দেখেছি। পরে সবাই আমার খাতা দেখে চিত্রটা এঁকে বিরতির পর মৃণাল স্যারকে ভয়ে ভয়ে আবার দেখালো। মৃণাল স্যার বললেন, ঠিক আছে। তবে কারো কারো চিত্র তখন তিনি একটু আধটু ঠিক করেও দিলেন। সেদিন কেন যে মনে হলো, ছবি আঁকলে আমি কি খুব ভালো করতে পারবো?
অনেকটা সময় এভাবেই কেটে যায়। তার অনেক দিন পর প্রায় দু’দিন ব্যয় করে লালন ফকিরের একটি ছবি আঁকলাম। পেন্সিল দিয়ে। লালনের ছবিটি ছবি দেখে আঁকা হলেও লালন ফকিরের পাশ দিয়ে নতুনভাবে গোমতীর মতো একটি নদী এঁকে দিয়েছিলাম। ১৯৯০ সালে। ও ছবিটা দেখলে লালনকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হতো। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ছবিটা আমাদের বাসায় টানানো ছিল। তারই পাশে রবীন্দ্রনাথেরও আরেকটি ছবি।
১৯৮৭ সালে কুমিল্লা থেকে বাবার কাছে গিয়েছিলাম। চট্টগ্রামে। তখন একদিন একা একা বাটালি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দারুণভাবে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তার আগে এতো উঁঁচু থেকে পৃথিবীকে আর দেখিনি আমি। সেদিনের সে দেখাটা আমি আঁকতে চেয়েও পারিনি।
১৯৯২ সাল। আমার জীবনের সোনালী-রূপালী সুখের দিন। কারণ তখন ঢাকায় আমার প্রেমে পড়েছে রূপালি। আমিও তার প্রেমে পড়ে পৃথিবীকে লাল-নীল কতোভাবেই না দেখছি। তখন আমি ঢাকার বিভিন্ন গ্যালারিতে প্রায়ই চিত্র প্রদর্শনী দেখতে যেতাম। লাইব্রেরীতে চিত্রকলার বইপত্র পড়ছি। আর বাসায় বসে ছবির পর ছবি আঁকছি। একদিন রূপালি এসে বললো, তুমি ছবিও আঁকো ? আমি বললাম, পারি না। জলরঙ নিয়ে চেষ্টা করছি। রূপালিকে একের পর এক আঁকতে থাকলাম তখন। কিন্তু একটি মুখও রূপালির মুখ হচ্ছিল না। তাই রূপালিকে দেখাতে চাইনি আর। তখন রঙতুলিকে নিয়ন্ত্রণই করতে পারতাম না। উল্টো রঙতুলিই যেন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতো। তারপরও হয়ে যেতো কখনো কখনো নিজের কাছে ভালো লাগা একটি ছবি। এসব ছবিতে ব্যাকরণ ও রঙের অন্যরকম ব্যবহার দেখে অনেকেই ‘ছিঃ’ বলা শুরু করলো। তারপরও আমি শুধুই ভালোলাগার জন্য এঁকে গেলাম এসব ছবি। জানি না, আজ এত বছর পর রূপালি আর আগের মতো সুন্দরী রয়েছে কী না, অথবা বেঁচেও রয়েছে কী না। তবে রূপালির প্রেমে না পড়লে তখন আমি ছবি আঁকতাম কী না, ঠিক জানি না। আমার সেসব অভাবের দিনে রঙ কেনারও পয়সা থাকতো না। ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিন পিয়াস জলরঙ দিয়ে খুব সহায়তা করতো, যদিও সে অনেক অনুরোধ করে মা’র কাছ থেকে জলরঙ কেনার টাকার যোগাড় করতো। আমার ‘লাভ ফর গ্যাম্বলিং’ সে সময়ের আঁকা একটি ছবি। পরে আবার এ ছবিতে হাত লাগাতে হয়েছে। এ ছবির নারী চরিত্রটি আমার কাছে খুবই বেপরোয়া, ঠিক তখনকার ‘রূপালি’ চরিত্রের মতো।
আমাদের গ্রামের বাড়ির পূর্বপাশে ছিলো একটি জলাশয়। ওদিকটার প্রায় সব মাটিই এঁটেল মাটি। জলাশয়ের কাছেই বড় আপার বিয়ে হয়। আমি তখন খুব ছোট। প্রায়ই বেড়াতে যেতাম তাদের বাড়িতে। আর জলাশয়ের মাটি এনে গরু-ছাগল-পাখি বানাতাম। তারপর পুড়ে অথবা রোদে শুকিয়ে নিয়ে আসতাম বাড়িতে। আমার মা এগুলোতে রঙ দেয়ার কাজে সহায়তা করতেন। একটু বড় হয়েই কিছু বইয়ে শহীদ মিনারের অনেক ছবি দেখি। বাবা নিয়ে গেলেন কুমিল্লার বিখ্যাত প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন শালবন বিহার ও ওখানকার যাদুঘরে। তখন আমি খুবই ছোট। ওখানে পোড়ামাটির কাজ দেখে আমি খুব হতাশ হয়ে গেলাম। কারণ বাবা তখন বলেছিলেন, ওসব কাজ হাজার বছর আগেই নাকি তৈরি করা হয়েছিলো। তাহলে এ যুগে আর আমি কী-ই-বা তৈরি করবো। ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যগুলোকে বাবা আমাকে শিশুতোষ ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে আমি যখন ঢাকার পথে পথে ছবি তুলছি, তখনও কোনো ভাস্কর্যের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ভাস্কর্যের ছবি তুলেছি। ছবি তুলেছি পথিককে দিয়ে আমার নিজের, ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে। মূর্তি অথবা ভাস্কর্য যুগে যুগেই আমাকে পাগল করেছে। আমাদের আগের বাসায় একটি নারী ও পুরুষের শারীরিক মিলনের মূর্তি শোভা পেত। বাবা-মা কখনো বাঁধা দেননি। তবে বাবার কোনো কোনো বন্ধু এজন্য আমাকে অনেক অপমানও করেছেন।
১৯৯৯ সালে আমি যখন আমার তৃতীয় কবিতার সংকলন ‘তুমি এখন আকাশবাসী’ প্রকাশ করি, তখন তার প্রচ্ছদ করেছিলাম একটি নগ্ন নারীমূতির ছবি দিয়ে। বাবা ভয় দেখালেন, মৌলবাদীদের হামলায় পড়তে পারি বলে। হামলায় না পড়লেও তার জন্যে আমি তখন পথে পথে বকা শুনেছিলাম।
আমার ওপর বাবার আস্থা ছিল, কারণ বাবার নন-একাডেমিক ব্যাপক পড়াশোনা ছিলো। আমি যখন আকাশবাসীর প্রচ্ছদ করি, তার কিছুদিন আগে বাবা র্যঁদার ভাস্কর্য বিষয়েও একটি বই পড়েছিলেন। তার পরপরই পড়েছিলেন ফরাসী চিত্রশিল্পীদের কথা। ওসব বই পড়তেন না আমার বড় ভাই। চাকুরির জন্য তার হাতে তেমন সময়ও থাকতো না।
আমার বাবা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। কারণ তিনি যখন ১৯৮৯ সালে প্রথম আমাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের সাতমোড়ার মনোমোহন দত্তের গানের বই ‘মলয়া’ পড়তে দেন, তখন আমি ওসব গান নিয়ে দিনের পর দিন ধরে দার্শনিক চিন্তা শুরু করলাম। আবার একদিকে রয়েছে আঁকার নেশা, অন্যদিকে লেখারও নেশা।
বাবা বুঝলেন, আমার দ্বারা হয়তো আর কিছুই হবে না। পড়াশোনা আর চাকুরী তো নয়ই। যেমনটি বাবার হয়েছিলো। শেষমেষ বাবা চাকুরী করতে পেরেছিলেন, যেহেতু সংসার করে ফেলেছিলেন।
আমি ছবি আঁকার চেষ্টা বোধ হয় সেদিনই ছেড়ে দিলাম, যখন দেখলাম ফ্রসোয়া অগুস্ত রেনে র্যদা-র মতো শিল্পীও উন্মাদের মতো নেশা নিয়ে স্নানাহার ভুলে অনেক সময় দিনে চৌদ্দ ঘন্টাও অনুশীলন করেছেন। তার ব্রোঞ্জের যুগ, থিঙ্কার, বালজাক, এসব ছবি দেখে মাথা ঘুরে গেলো। মনে হলো, শিল্প করার নামে আমি যা করছি, তা এক প্রকার বদমাইশী ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ শিল্প করতে হলে পাগল হতে হবে। কাজের পাগল এবং মানুষকেও পাগলের মতো ভালোবাসতে হবে।
আঁকার নেশা কয়েকবারই জেগে উঠেছিলো আমার। ক্লাস এইটে পড়ার সময় ভাবলাম, আমার দ্বারা স্কাউটিং হতে পারে। ওই খাতে অনেকদিন সময়ও দিলাম। স্কাউট ওয়াদা মুখস্থ করলাম। লোকের সঙ্গে স্কাউটিংয়ের নিয়ম অনুসারে মজা করে বাম হাত মেলাতাম। আমরা একে অন্যকে দেখলে স্কাউটের ৭টি আইন মুখস্থ আছে কী না পরীক্ষা করতে বলতাম, ইববিঅজীহামিচিকনী। সালাম দিতাম বন্ধুদের তিন আঙ্গুল দ্বারা। পকেটে রাখতাম ছুরি। কিছুদিন পর দেখলাম আমার দ্বারা তাও হবে না। তবে সে সময়ে স্কাউট নিশানাগুলো বুঝানোর জন্য আমি আঁকার চর্চা শুরু করলাম। বেশির ভাগ চিত্রই ছিলো পাঠ্য জ্যামিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সেদিকে যাও, এদিকে যেও না, এদিকে যাও, খেয়াঘাট আছে, ক্যা¤প আছে, তিন কদম যাও, খবর আছে, খাবার পানি আছে, এসব প্যাট্রোল চিহ্ন বুঝাতে আমি অনেক দৃশ্য আঁকার কাজই করেছিলাম তখন। পরে বুঝলাম, আমার দ্বারা আকাঁও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ আমি খুবই অস্থির এবং দুরন্ত প্রকৃতির।
ঢাকায় নিয়মিত থাকার সময়ে আমি কিছু কিছু চিত্র প্রদর্শনী দেখেছি, যদিও ছবি তেমন বুঝিনি। তবে ছবি দেখে আনন্দ পেতাম খুব। আনন্দ পেতেই এক সময় কিছু নিসর্গচিত্র এঁকেছি। হারিয়ে গেছে। তেল রঙে আঁকিনি কখনো। জলরঙে আঁকার চেষ্টা ছিলো। রেখার ভাষা তেমন বুঝি না আমি আজও। বুঝতে চেষ্টাও করিনি সে রকম। ছবি-১৯৭১-এর মতো কিছু ছবিতে গল্প বলতে চেয়েছিলাম। ছবির রীতি বা ফর্ম নিয়ে কোনো পরীক্ষানিরীক্ষা করিনি। আধুনিক শিল্পকলা আন্দোলন স¤পর্কেও আমি তেমন অবহিত ছিলাম না। এখন ইন্টারনেটের যুগ। কিন্তু আগে
বিভিন্ন শিল্পীর কাজ পত্রিকায় দেখে সবটা বুঝতে পারতাম না। কখনো কখনো খুব সাধারণ একটি ছবিও খুব বেশিই ভালো লেগে যায় আমার। শিল্পী কনকচাঁপা চাকমার কাজ আমার ভালো লাগে। সংবাদ সাময়িকীতে ছাপা হওয়া তার ‘একটি মুহূর্ত এক্রোলিক অন ক্যানভাস’-‘উপজাতি’-এখনও মাথায় ভাসে।
শিল্পের চর্চা করতে গিয়ে শিল্পবোদ্ধাদের টানাটানিতে প্রথম প্রথম হাঁপিয়ে উঠতাম। মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্ব পড়ে ব¯ুসত্ত্বার দিকে যতটা এগিয়ে গিয়েছিলাম, পল ক্লী পড়ে বানরের তৈলাক্ত বাঁশে বেয়ে উপরে উঠার পরের পর্বের মতো ঠিক অনেকটা নেমেও গেলাম। পল ক্লী বুঝাতে চেয়েছেন একজন শিল্পীর অন্তসত্ত্বাকে কোনোভাবেই হেয় করে দেখার সুযোগ নেই।
পিকাসোর আঁকা ছবিগুলো লাইব্রেরীতে দেখে প্রথম প্রথম মাথা ঘুরে গেলো। আমি ইংরেজি ভালো জানি না। তাই বিদেশী লেখার ইংরেজি অনুবাদে মনে তেমন সাড়া জাগেনি। কিন্তু ছবি দেখে বুঝলাম, এ এমন মাধ্যম, যার অনুবাদের কোনো তোয়াক্কা নেই। শুধুমাত্র চোখ থাকলেই হলো । যেমনই চোখ হোক। যে সাধারণ চোখ চিত্রকর্মের ব্যাকরণ বুঝে না, সে চোখও চিত্র থেকে কিছুটা আনন্দ পেতে পারে। যে শিল্পীর রীতি বুঝে না, যে যায়নি কখনোই আর্ট স্কুলে, সেও একটি চিত্র দেখে থমকে দাঁড়াতে পারে, লেখার ক্ষেত্রে যা সম্ভব নয়। তাছাড়া শিল্পের ব্যাকরণও পরিবর্তনশীল। কোনোটা সাধারণ মানুষকে ভরসা করে এগোয়, কোনোটা আবার তাদের বাদ দিয়ে। সনাতন নিয়ম নয়। আজকের যুগের শিল্পের বিচার হওয়া উচিত যে কতো দৃষ্টিকোন থেকে, তা বলারই অপেক্ষাই রাখে না।
দূরের বস্তু ছোট দেখা যায়, এ তো ফটোগ্রাফিক গ্রামার। সনাতন কথা। আমার ছবিতে প্রায়ই এসব মানা হয়নি। আমি যখন তিনতলায় বসে ছবিতে রঙ লাগাই, তখন বিশ গজ দূরের বাসার একটি খুনী সুন্দরী মেয়ে আমার দিকে উঁকি মারে। তারপর আবার সে মেয়ে অবিবাহিতা। উড়নাটাও বারবার ইচ্ছে করে খসায়, আবার তুলে ধরে। আমি তখন কোলের কাছের রঙ লাগানো ভুলে গিয়ে, দূরের মেয়েটিকে বড় করে দেখে ছবির বদলে মনের মধ্যে রঙ লাগাতে থাকি।
আমার ছবিতে রঙের ব্যবহার এলোমেলো। রঙের যে অর্থ, তা অল্প হলেও বুঝি। কিন্তু রঙ আমার কাছে আপেক্ষিক। ভিখারীর চোখ আর রাজার চোখ একই বস্তুকে দু’ভাবে দু’রঙে দেখতে পারে। আপনার কাছে পয়সা আছে বলে আপনি এ বেলা দারুণ খাবার খেলেন, আরেকজন যে উপোসই থাকলো! সুতরাং রঙ কেনার কাগজ কেনার পয়সা না থাকার পরও যে আকাঁর নেশায় ভোগে, তার রঙ তো বিশেষজ্ঞের সঙ্গে মিলবে না।
ইতিহাস এবং ভবিষ্যৎ- এ দু’বিষয়েই আমার আঁকা ছিলো। একুশ শতকের নবাব সিরাজ, ছবিটা করা ছিলো জলরঙে। ১৯৯৪-এ এঁকেছিলাম। খোয়া গেছে। প্রথম বিয়ে ভাঙ্গনের সময়। আরও খোয়া গেছে ‘পতিতা’ সিরিজের কয়েকটি ছবি। ছবিগুলোতে আমি চিত্রকলার রেখা ও রংয়ের নির্ধারিত কোনো ব্যাকরণ মানিনি। ‘স্বাধীনতা তুমি...যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা’ (স্ব^াধীনতা তুমি/শামসুর রাহমান)।
রেখা আর রঙ। রেখা আর রঙ বিশ্বাসী বন্ধু, আবার সে বিশ্বাসঘাতকও। আমার রঙ-রেখা অধিকাংশ সময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমার ছবিতে কখনো কখনো রঙ রেখাকে নিয়মমত ব্যবহার করতে ইচ্ছে করেনি। অথচ তা ছিলো আমার জন্য খুবই ক্ষতিকর। কারণ যান্ত্রিক সমালোচনা-প্রয়োগবাদী সমালোচনা-ভাববাদী-রূপবাদী সমালোচক-সকলেই আমাকে শত্র“ মনে করতে পারেন। আমি ছবিকে দু’ভাবে বুঝি। ভালো লাগা অথবা মন্দ লাগা। রাজরানীর ছবি এঁকেও ভালো লাগে না। আবার ‘পতিতা’র ছবিটারও প্রেমে পড়ে গেলাম। এমনটি হতেই পারে।
আমি আঁকি। আঁকার জন্যই, অথবা আমার জন্যই। নন্দলাল বসুদের ছবিতে যেসব ব্যাকরণ দেখা যায়, তা আমি বুঝতেও চাই না। কারণ তা ডুবে ডুবে বুঝতে গেলেও সাধনা দরকার। আমি আসলে আমার আনন্দের প্রয়োজনে ছবি এঁকেছি। আমার মেধা বা প্রতিভা নেই। তাই দর্শককে তাক লাগিয়ে দেয়ার সাধনাও নেই। ১৫০০০ বছর আগের গুহাবাসীরা ফ্রান্স এলাকায় যে বল্গা হরিণের ছবি এঁকে গেছেন, তার ছবি দেখে আমি এ যুগেও হতবাক হয়ে যাই। সাধারণ ছবি। কিন্তু কতো অসাধারণ। ২০ হাজার বছরের পুরনো স্পেন দেশীয় গুহাচিত্রের বাইসনের বেলাও একই কথা খাটে।
বল্গা হরিণ অথবা বাইসনটিকে দেখলেই বুঝতে পারা যায়, সেটি কি হাসছে না কাঁদছে। রেখার কী অসাধারণ ব্যবহার। রেখা কাঁদে-রেখা হাসে-রেখা ভয় দেখায়।
যখন আমার আঁকার নেশাটা তীব্র ছিলো, তখন আমার তুলি কেনারও টাকা থাকতো না। আমরা আর্থিকভাবে খুবই গরীব ছিলাম। ছোট ভাই গিয়াস উদ্দিন পিয়াসের তুলি ঢাকায় নিয়ে যেতাম। তাও যখন হারিয়ে যেতো, তখন গাছের ডালই ভরসা হতো। মনে আছে, ছোটবেলায় একবার একটি ইঁদুর মেরে তার গায়ে রঙ মেখে সেটা দিয়ে আরেকটি ইঁদুরের ছবি এঁকেছিলাম। মা আমার আঁকার ঝোঁককে পছন্দ করলেও এ কাজটা পছন্দ করলেন না। বাড়ী থেকে বকে বের করে দিলেন। অথচ আঁকাটা দারুণ হয়েছিলো। কাঠবিড়ালী আঁকার জন্য শ্যাওড়া গাছ থেকে কাঠবিড়ালীর বাচ্চা চুরি করে আনার সময়ে কয়েকটি কামড় খেয়ে বাচ্চা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
আমার ছোট ভাই পিয়াস খুব ছোটবেলা থেকেই ভালো আঁকতে পারতো। মূর্ত ছবি। এখন আঁকা ছেড়ে দিয়েছে। সে যখন খুব বেশি আঁকাআঁকি করতো, নৈসর্গিক ছবি, তখন তাকে একদিন আমি কাছে বসিয়ে বললাম, যদিও রঙের অনেক ধারনা যুগের সঙ্গে পাল্টে গেছে, তবু শুদ্ধ রঙ, মিশ্র রঙ কথাটি বহাল আছে। বহাল থাকবে। কারণ হলদে-লাল-নীল এ তিনটি শুদ্ধ রঙের মিশ্রণে বহু রঙ হতে পারে। তাকে আমি বলেছিলাম, সব শিক্ষা আর রঙের ব্যবহার জেনে নিতে হবে প্রকৃতি থেকেই। সে প্রায়ই কুমিল্লার গোমতি নদীর কাছে চলে যেতো। তারপর আঁকতে থাকতো দারুণ দারুণ সব ছবি। সে মূর্ত ছবি আঁকলেও তার ছবিতে দেখতে পেতাম আমার মতো উল্টাপাল্টা যত্রতত্র রঙের ব্যবহার। আমিও এক সময় পাগলের মতো রঙ ব্যবহার করতাম। যেমনটা এখন আমার ছেলে পাঁচ বছরের অপূর্ব করে থাকে। হায়! ছবি আঁকার প্রতিভা আমার কখনোই ছিল না বলে কতোদিন আর ছবি আঁকি না আমি।
০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৩২
জসীম অসীম বলেছেন: ভ্রাতা মতামত ভালো লেগেছে । ধন্যবাদ। ভালো থাকুন। অনেক ভালো।
©somewhere in net ltd.
১|
০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:২৯
অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: আত্মকথন ভালো লাগলো ভ্রাতা ।
ভালো থাকবেন