নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

(গল্প) মনীষা দাশের আশ্চর্যজনক বিয়ে

১৮ ই অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৫:৩২

মনীষা দাশের বিয়ের দিনই ইমরুলের মা মৃত্যুবরণ করেন। কেন? এর কোনো উপযুক্ত ব্যাখ্যা নেই। ইমরুল মনীষার শিক্ষক । প্রাইভেট টিচার।
শিশু মনীষা যুবতী হয়েছে এখন। তার মধ্যে এসেছে অনেক পরিবর্তনও। আগে মেয়েটির সুন্দরী মাকে দেবীর মতো ভালো লাগতো ইমরুলের। আর এখন যুবতী মনীষাকেই। মেয়েটির নাম মনীষা দাশ। তার মায়ের চুল এখন অল্প করে পাকতে শুরু করেছে। আগে মা-ই সন্ধ্যায় উলুধ্বনি দিতেন। এখন কখনো কখনো মনীষাই এ কাজটি করে।
মনীষাকে পড়ায় ইমরুল সেই তার শিশু-বয়স থেকেই। ইমরুল তখনই কৈশোর পার হওয়া যুবক। এখন তো পরিপূর্ণই সুঠাম এক যুবক। তাই মনীষার বিষয়ে তার চিন্তায়ও নানা পরিবর্তন আসে।
কিন্তু মনীষা হিন্দু, ইমরুল মুসলিম। এ জন্য ওদের কোনো মানসিক বা মানবিক পরিবর্তনে কিংবা পারস্পরিক প্রেমবোধ তৈরি হওয়ায় কিছু যায় আসে না। ইমরুল শিক্ষক, মনীষা ছাত্রী। তা ছাড়া এটা বাংলাদেশ, হিন্দু-মুসলিমে বিয়ে হয়ে যাওয়া খুব বেশি সহজতর কিছুও নয়, ঝামেলা নিঃসন্দেহে কিছু আছেই।
অথচ সমস্যা কিন্তু হলোই। কারণ ইমরুলের মনীষাকে ভালো লেগেই যায়। তাই যতই দিন যায় ইমরুলের কষ্ট বাড়তেই থাকে। অথচ কী আশ্চর্য এই তো মাত্র দশ-বারো বছর আগেই মেয়েটি একটি শিশুমাত্র ছিল, পড়তো প্রাইমারী স্কুলে।
মনীষাকে ভালোবেসেও বা কী হবে ইমরুলের ? ধরা যাক মনীষা কি ইমরুলকে ভালোবাসে ? যদি না-ই বাসে, তাহলে এ নিয়ে আর ভেবে তো কোনো লাভও নেই। কিন্তু সমস্যাটা আরও বিরাট আকার ধারণ করলো, যখন বুঝতে পারা গেল মনীষা তার এই মুসলিম শিক্ষক ইমরুলকেই পাগলের মতো ভালোবাসে।
কিন্তু মনীষা জগতে এত যুবক থাকতে কেন শুধু এই শিক্ষক, আবার যিনি কী না ধর্মে মুসলিম স¤প্রদায়ভুক্ত, তাকেই ভালোবাসে? তার অনেক কারণের একটি হলো এই শিক্ষক মহাশয় ভিন্ন, আর কোনো যুবককে, এমনকি নিজের আত্মীয় স্বজনের মধ্যেও কোনো যুবককে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ পায়নি মনীষা। মনীষা যে বালিকা বিদ্যালয়ে পড়তো, তার বাইরে অবাধ কোনো বিচরণও তার ছিল না।
কিন্তু তাদের উভয়ের ভালো লাগার বিষয়ে কেউ কাউকে পরিষ্কারভাবে বলতে পারে না। একজন ভাবে তিনি তো আমার শিক্ষক, কীভাবে বলি। অন্যজন ভাবেন, সে তো আমার ছাত্রী...। কিন্তু এই কথাটা তারা উভয়েই বুঝে গিয়েছেন যে তারা পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসেন।
রাতের বেলা ইমরুল যখন পড়াতে আসে মনীষাকে, মনীষার মা তখন রান্নাবান্না শেষ করে অন্যরুমে বিছানায় শুয়ে টি.ভি দেখে। বিছানায় যাওয়ার আগে ইমরুলের জন্য গরুর এক গ্লাস গরম দুধ, কিছু সন্দেশ কিংবা বিস্কুট এবং জল দিয়ে যায়।
ছোট বেলার মনীষা ইমরুলের বেতের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতো। যুবতী মনীষা অনেক বেশি স্বাধীন এবং বাকপটু হয়ে যায়। তাই ইমরুল কখনো বিস্কুট না খেলে মনীষা বলে, বিস্কুটটা খান স্যার, ও-তে ভিটামিন আছে। ইমরুল চোখ লাল করে। কারণ সে শিক্ষক। শিক্ষকের তো একটি কর্তব্য আছে। মনীষা হাসে। সেই লাল চোখকে ভয় পায় না মনীষা। বলে, স্যার ও-তে ক্যালসিয়ামও আছে। ইমরুল তার চোখজোড়া আরও লাল করে। মনীষা মৃদু হাসে। মৃদুকণ্ঠে বলে, স্যার ‘টাইটানিক’ ছবিটা দেখেছেন। আমার বান্ধবী আফরিনা দেখেছে। সবার মুখেই এখন এই ছবির গল্প। ইমরুল মনীষার এই প্রশ্নের উত্তর দেয় না।
মনীষারা দুই বোন। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। একমাত্র ভাই ভারতের আগরতলায় মামার বাসায় থেকে পড়ে। আর তার বাবার রয়েছে কুমিল্লা শহরে নিজস্ব একটি দোকান । ফিরতে ফিরতে রাত বাজে প্রায় এগারোটা। তার আগেই ইমরুলের পড়ানো শেষ হয়। তারপর হাঁটতে হাঁটতে নিজের বাসায় চলে আসে।
সেদিন ঘটলো এক অঘটন। রাত প্রায় ন’টা। পড়ছিল মনীষা। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। তিনবার সে তার মাকে ডাক দিলো। মা, মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দিয়ে যাও। মা তখন সারাদিনের রান্নাবান্নার ক্লান্তি শেষে টিভি দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। ইমরুল মনীষাকে বললো, বৌদি মনে হয় ঘুমিয়েছেন । তুমি গিয়ে জ্বালিয়ে নিয়ে আসো। মনীষার মাকে বৌদি ডাকেন ইমরুল। মনীষা বললো, অন্ধকারে যেতে পারবো না আমি, ভয় লাগে। ইমরুল রেগে বলে, তবে কি আমি যাবো? মনীষা বলে, আপনার কাছে দেয়াশলাই রাখতে পারেন না? ইমরুল ক্ষেপে যায়। আমি কি সিগারেট খাই? মনীষা বলে, অন্ধকার থেকে বাঁচতে তো একটা দেয়াশলাই রাখতেই পারেন। ইমরুল বলে, তুমি যাও, মোমবাতিটা জ্বালিয়ে আনো। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়। দরজা-জানালা বন্ধ। বাইরে শীত। অন্ধকারেই উঠে দাঁড়ায় মনীষা। বলে, যেখানে আছেন, সেখানেই থাকেন, আমি যাচ্ছি। তারপরও এসে ইমরুলের সঙ্গে ধাক্কা খায় মনীষা। তার বুক গিয়ে লাগে ইমরুলের নাকে। সঙ্গে সঙ্গেই মনীষাকেই জড়িয়ে ধরে ইমরুল। আলতো করে চুমুও খায়। হঠাৎ মনীষা চিৎকার করে ওঠে। মা-ওমা-তুমি মরলা নাকি! মেয়ের চিৎকার শুনে ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে মনীষার মা শোভনা দাশ। ততক্ষণে ইমরুল মনীষাকে ছেড়ে দেয় এবং ভয়ে কাঁপতে থাকে। মনীষা তার মাকে বলে, কারেন্ট গেলো, আর তোমার খবর নাই। শোভনা দাশ এক পলকেই মোমবাতি জ্বালিয়ে মনীষার পড়ার রুমে দেয়। তখনও ইমরুলের পা ঠক্ঠক্ করে কাঁপছে। মোমবাতির আলোয় মনীষাকে দেখে ইমরুল। দেখে মনীষার মুখে মৃদু এক রহস্যময় মুচকিভাবের হাসি। ততক্ষণে ইমরুল তার চাপা দীর্ঘশ্বাসটা ছাড়ে।
বাসায় ফিরতে ফিরতে আজ অন্যরকম অনুভূতি হয় ইমরুলের। হিন্দু-মুসলিমে এই ধর্মের বিভাজন, এই বাস্তবতাকে মানতে পারে না সে। তাহলে কি মনীষাকে ভালোবাসা ব্যর্থ হবে তার? মনীষা কি এই শোক সহ্য করতে পারবে? সাহিত্যিক শাহাদাত মান্টো-র মতো নাকি বিপর্যস্ত হয়ে যাবে ইমরুল। মান্টো-র কিছু লেখা পড়েছে সে। মান্টো ভারত-পাকিস্তান বিভাজন মেনে নেননি এবং তার শহরে ফিরেও যাননি পাকিস্তানের লাহোরে। থাকছিলেন ভারতের বোম্বে শহরেই। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি সেই মান্টো-র। উন্মাদনাগ্রস্ত মান্টো-কে লাহোরে নেওয়ার পর এক মানসিক হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার। তবে কি এই মান্টো-র উত্তরসূরী ইমরুলেরও ভয়ানক পরিণতি হবে? বাসায় যেতে যেতে মনীষাদের ঘরের কাছের নাগেশ্বর ফুলের গাছটির কথাও মনে পড়ে ইমরুলের। কী সুন্দর গাছ। এই গাছটিকে কিংবা মনীষাকে বিগত দশ বছর ধরে চিনে ইমরুল। কেমন করে ভুলে যাবে এসব? মনীষা বলে, আমাদের নাগেশ^র গাছে নাকি একটি নাগিনী সাপ থাকে। ইমরুল বলে, তুমি দেখেছো? মনীষা বলে, না-শুনেছি। ইমরুল বলে, ও-কথায় কান দিয়ো না। কথা বলার সময় আজকাল মনীষার চুলের বেণী দেখেও মুগ্ধ হয় ইমরুল। এমনটি তো হয়নি আগে। এখন হচ্ছে কেন? এসবের কোনো উত্তরই পায় না সে।
পরদিন মনীষার বাবার দোকানের সামনে দিয়েই কী এক কাজে যাচ্ছিল ইমরুল। হঠাৎ তাকে ডাক দিয়ে দোকানে নেন মনীষার বাবা দেবাশীষ দাশ। চা-নিমকি খাওয়ানোর পর ইমরুলকে দেবাশীস দাশ বলেন, স্যার এবার একটা বিয়েসাদী করেন। ইমরুল হঠাৎ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। বলে, বিয়ে করবো...তবে এখন নয়। আগে তো আর্থিক অবস্থাটা বদলাই। বোন আছে বিয়ের বাকি। মা অসুস্থ। আরও দুশ্চিন্তা রয়েছে। সুতরাং এখন এ বিষয়ে ভাবছি না। তাছাড়া কুমিল্লা শহরে ভাড়ায় থাকি আমরা, সারাক্ষণই বিভিন্ন চাপে থাকি। বাবারও বয়স হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত মানুষ। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ...। দেবাশীস দাশ প্রসঙ্গ বদলান। স্যার, একটি ভালো পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমাদের মনীষার জন্য। পুরনো ঢাকার কৈলাশ ঘোষ লেনে ছেলের বাড়ি। একদিন রাত দশটার দিকে দোকানে এলে আপনার সঙ্গে কথা বলবো। অনেক কথা আছে আপনার সাথে। আপনি তো মনীষাকে শিশু বয়স থেকেই জানেন। আচ্ছা, ঠিক আছে। বলেই দোকান থেকে চলে আসে ইমরুল। কিন্তু কথাটা শুনে হঠাৎ-ই যেন মাথায় বাজ পড়ে তার। কানে শুধু তার বাজতে থাকে ‘কৈলাশ ঘোষ লেন...কৈলাশ ঘোষ লেন... কৈলাশ ঘোষ লেন ...।
তারপর হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেয় ইমরুল মনীষাকে সে আর পড়াবে না। পড়ানোর দরকারও নেই। তাকে তো একদিন পড়ানো ছাড়তেই হবে। সুতরাং না হয় সেটা আগেই কোনো কারণ দেখিয়ে শুরু করে দিলো। মনীষাও তো একদিন ইমরুলকে ভুলে যাবেই। সুতরাং এ নিয়ে আর বেশি ভেবে কী লাভ? আসলে ওদের দু’জনের ভালো লাগাটাকে তো আর বেশিদিন ধরে বেশি দূর এগিয়েও নেয়া যাবে না। সুতরাং এ নিয়ে আর...। রাগে-ক্ষোভে এমনই চিন্তা করতে থাকে ইমরুল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই মনের টানে, চোখের টানে মনীষাদের বাড়ি পর্যন্ত না গিয়ে আর থাকতে পারে না সে। কুমিল্লা শৈলরানী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ছেড়ে এখন মনীষা শহরেরই একটি সরকারি মহিলা কলেজে পড়ে। লেখাপড়ায়ও ভীষণ ভালো। পরিশুদ্ধ গোল ফর্সা মুখশ্রী তার। তার কাছে এ মেয়ে এক পরীক্ষিত মেয়ে। তাকে পড়িয়ে এক স্বর্গীয় পরিতৃপ্তিও পায় ইমরুল। কিন্তু সেদিন ঘটল এক অন্য ঘটনা। মনীষার উচ্চতর গণিতের খাতায় ইমরুল লিখে দিলো এক লেখা : তোমার বাবা তোমার জন্য এক পাত্র দেখেছেন। পুরনো ঢাকার কৈলাশ ঘোষ লেনে ছেলের বাড়ি। মনীষা তার উত্তরে লিখলো : আমি এখন বিয়ে করবো না, লেখাপড়াই করবো। ইমরুল লিখলো : যদি জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়? মনীষা লিখলো : আপনি আমাকে বিয়ে করলে আমি পালাতেও রাজি। ইমরুল লিখলো : সেটা সম্ভব নয়। তাছাড়া শুধু ধর্মই বাধা নয়, আমি পালালে তোমার পরিবারে আমি একজন বিশ্বাসঘাতকই হবো। তোমাদের টাকায় বিগত দিনে কখনো কখনো ভাতের চাউলও আমরা কিনেছি। মনীষা লিখলো : সে টাকা আপনার ঋণের টাকা নয়, পারিশ্রমিক বা সম্মানীই ছিল। ইমরুল লিখলো : কিন্তু আমার পালানোর বাস্তবতা নেই। বিয়ের উপযুক্ত তিন-তিনটি বোন রয়েছে ঘরে। এইবার মনীষার চোখে জল দেখলো ইমরুল। জল চোখেই সে লিখলো : ছোটবেলায় যে পুকুরে ডুবেছিলাম, তখন মরে গেলেই ভালো হতো। বেঁচে থাকাই পাপ হয়েছে আমার। কথাগুলো এমনভাবেই লিখে মনীষা, যেন সে ইচ্ছে করেই পুকুরে ডুবেছিল এবং বেঁচে থেকেছে ইমরুলেরই জন্য। এমন সময় গ্লাস ভরা গরম দুধ আর মুড়ির মোয়া নিয়ে পড়ার রুমে ঢুকে মনীষার মা পরমাসুন্দরী দেবীতুল্য রমণী শোভনা দাশ। মনীষা হঠাৎ চোখের জল লুকিয়ে ফেলে। ইমরুল হঠাৎ তার বৌদিকে এক প্রশ্ন করে। বৌদি, আমি তো একজন মুসলিম ঘরের যুবক। আপনাদের মেয়েকে আমার কাছে পড়তে দিতে কোনো দ্বিধা কাজ করে না? কারণ আপনাদের মেয়ে তো এখন বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে। শোভনা দাশ মনীষার পড়ার ঘর ছেড়ে নিজের বিছানার কাছে একটি চেয়ার নিয়ে বসে। তারপর বলে, আপনি যখন মনীষাকে প্রথম পড়াতে আসলেন, তখন স্যার মনীষা কতটুকু ছিল? এখন হয়তো বড় হয়েছে, সে তো আপনার চোখের সামনেই। তাছাড়া আপনি যদি এমন খেটেখুটে না পড়াতেন, মনীষাও হয়তো এতদূর পড়তো না। তাছাড়া সবচেয়ে বড় বিষয় স্যার বিশ্বাস। বিশ্বাস না থাকলে ধর্ম থাকে না। আবার বিশ্বাস না থাকলে ধর্মেও সুফল দেয় না।
ইমরুল বলে, কিন্তু বৌদি কখনো কি কোনো হিন্দু অথবা আপনাদের আত্মীয়স্বজন, কেউ বলেনি কেন একজন মুসলিম ছেলে এসে আপনার মেয়েকে পড়ায়? শোভনা দাশ বলেন, বলেছে। কিন্তু আমরা তো আপনার কাছ থেকে শিক্ষাটা নিচ্ছি। আপনার ধর্ম তো এক্ষেত্রে বাধা নয়। একটা গল্প শুনবেন? তবে গল্প হলেও বাস্তব। তবে কথাটা কাউকে বলবেন না। আমার বাবার বাড়ি কিশোরগঞ্জের এক বিলের মাঝখানে। ওখানে এখনও আমার বড় দাদা থাকেন। এ শহরে থেকে ওই জায়গার কথা কল্পনাও করা যাবে না। ছোটবেলায় আমরা গরুর জন্য ঘাসও কাটতাম। একদিন বড় দাদার সঙ্গে নৌকায় করে বিলে যাচ্ছিলাম। দাদার হাতে বাঁশের লগি। তখন আমার বয়স মনে হয় দশ। হঠাৎ আমাদের এক প্রতিবেশী যুবক, সে কিন্তু হিন্দুই ছিলো, আমাকে দেখে চোখ টিপ মারে এবং ঠোঁটে শিষ বাজায়। এই না দেখে বড় দাদা গেলো ক্ষেপে। নৌকা ফিরিয়ে বাঁশের লগি দিয়ে মারলো তাকে বারি। তারপর যে সে দৌড়ে পালালো...। গল্পের এটুকু শুনেই মনীষা হাসতে হাসতে যেন প্রায় মরে আর কী। কারণ এ গল্প সে তার মায়ের মুখে আগে শুনেনি। রক্তপদ্মের অনেক গল্প শুনলেও এ গল্প কখনো শুনেনি মনীষা। তাই হাসি চেপে বললো, মা ছেলেটা বোধ হয় তোমাকে ভালোবাসতেই চেয়েছিল, কিন্তু মামার জন্য পারেনি। শোভনা দাশ মনীষাকে বলে, তুই থাম-কথাটা বলতে দে। মনীষা বলে, জানেন স্যার, বড় মামাদের এলাকায় অনেক কোড়া পাখি আছে। আর ডুুবুরি পাখি। ইমরুল বলে, তুমি থামো। বৌদি, গল্পটা বলেন। শোভনা দাশ বলতে শুরু করেন তার গল্প : বড় দাদা, মানে শ্যামলদা’র তিন মেয়ে সবাই জানে। কিন্তু ছোট মেয়ে শঙ্করী কোন ধর্মের, তা আমরা কেউ জানি না। কারণ তাকে আনা হয়েছিল আমাদের ওখানকার সবচেয়ে বড় পৌষমেলা থেকে পেয়ে। তার বাবা-মা আছেন কি-না জানি না। প্রায় চৌদ্দ বছর আগে দেড়-দুই বছর বয়সী অবস্থায় তাকে বড়দা’ পান। মেয়েটি তখন ‘মা-মা’ বলে খুব কাঁদছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও তার মা-বাবার খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারপর থেকেই বাবা-মায়ের স্নেহ দিয়ে বড়দা’র পরিবার তাকে লালন পালন করছে। বর্তমানে সে পড়ছে। কিন্তু তার কী জাত-ধর্ম, তাতো আমরা আজও জানি না। কারণ মেলায় তো বেশি মুসলমান পরিবারই আসে। সুতরাং ধর্ম দিয়েই মানুষের সব পরিচয় হয় না। মানুষের মনুষ্যত্বটাই হলো সবচেয়ে বড় কথা। মায়ের মুখে শোনা এই কথাগুলো মনীষার খুব পছন্দ হয়। কিন্তু এ নিয়ে আর কোনো কথাই বলে না সে।
দিন যায়-রাত যায়, ইমরুলের জন্য মনীষার আরও আকুলতা বাড়ে। তার এ আকুলতায় মাঝে মাঝে সে নিজেও বিরক্ত হয়। তাই সে তার এসব আকুলতা গোপন করেই রাখে। দিন দিন সে ইমরুলের প্রতি আরও দুর্বল হয়। কিন্তু এ কথা কাউকেই সে মুখ খুলে বলতে পারে না। এই অব্যক্ত ব্যথা আর সহ্য হয় না তার, তবু সহ্য করে যায়। করবে কী আর সে।
ইমরুল মনীষাকে কলেজের লেখাপড়ার বাইরেও কিছু বই পড়তে দেয়, যেমন মুক্তিযুদ্ধের গল্প। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের হিন্দুদের প্রতি পাকিস্তানী মিলিটারী যে কী নির্মম অত্যাচার করে, সেসব গল্প সে নিজের মুখে বর্ণনা করে, যদিও ওসব ঘটনা সে নিজেও প্রত্যক্ষ করেনি। পড়ানো শেষ হলেই মার্কিন সাংবাদিক লিয়ার লেভিনের গল্প করে, যিনি ছিলেন ‘মুক্তির গান’ প্রামাণ্য চিত্রের মূল চিত্রগ্রাহক। সেই শিশুকাল থেকেই মনীষার প্রতিটি জন্মদিনে ইমরুল তাকে বিভিন্ন বই উপহার দিয়েছিল। প্রথম দিয়েছিল কবি শামসুর রাহমানের ‘ধান ভানলে কুড়ো দেবো’ শীর্ষক ছড়ার বই। বইটিকে এখনও যতœ করে রেখেছে মনীষা। মনীষাদের এলাকায় দুর্গাপূজার সময় রাজনৈতিক সম্ভাব্য ভোটপ্রার্থীরাও আসে কোনো কোনো বছর। তাদের পদচারনায়, পূজামন্ডপ পরিদর্শন এবং অনুদানে শারদীয় দুর্গোৎসব সরগরম থাকলেও ইমরুল জানে ওসব রাজনীতিক মূলত হিন্দুদের ভালোবাসে না, ভোট-ভালোবাসাতেই আসে। তাই ওদের হঠাৎ হঠাৎ হিন্দুপ্রেম দেখে দেখে, ইমরুল যেন নিজের সঙ্গেই নিজে হাসে।
ইমরুল পড়ে খুব। রুডিয়ার্ড কিপলিং, খুশবন্ত সিং...। ইদানীং আরও পড়ে মনীষার মুখ। মনীষার অনিন্দ্যসুন্দর রাজ রাজ রাজেশ্বরী হাসি দেখে তার মনে হয়, চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাসের চেয়ে এ হাসির মূল্য কোনো অংশেই কম নয়। সে এখনও প্রতি দুপুরে পড়ে ডিকেন্সের ‘অলিভার টুইস্ট’ আর রাত হলে পড়ে মনীষার মুখ। কিন্তু তার এই ভালোবাসা যে নির্মম, এটা যে তাকে কোনোদিনও পরিত্রাণ দেবে না, এটা সে বুঝে। বুঝে মনীষার বাবা দোকানদার হলেও যথেষ্ট ব্যক্তিত্ববান। সকালে স্নান করে ধুতি পরে, পায়ে দিয়ে পাম্প সু ভাঁজ করা চাদর কাঁধে যখন সে দোকানে যায়, দেখে কেউ বুঝবে না এই লোক নিজের দোকানে যায়। মনে করবে যেন কলেজে যায় পড়াতে। কিন্তু চাকুরি তার কোনোদিনও ভালো লাগেনি। তাই ব্যবসা করে। মনীষার এই বাবা যদি ইমরুলের মনের দুর্বলতা একবিন্দুও বুঝে, এক সেকেন্ডের মধ্যেই তার পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিশ্চিত বদলে ফেলবে। এসব ইমরুল জানে।
মনীষার মা শোভনা দাশ ইমরুলকে স্নেহ করার আরেকটি কারণ হলো সে যখন তার ভরাট কণ্ঠে মনীষাকে রামায়ণ অথবা মহাভারতের বিভিন্ন বিষয়াদি ব্যাখ্যা করে পড়ায়, তখন তার তা ভালো লাগে। শোভনা দাশ একদিন বলেনও ইমরুলকে, আপনার মুখে মহাভারতের গল্প শুনতে খুব ভালো লাগে স্যার। আমার বাবার বাড়ির কাছের লক্ষীপুর হাটের ‘সৌন্দর্য জুয়েলার্সে’র সুধারঞ্জন কর্মকার রাত হলেই রামায়ণ-মহাভারত পড়তেন খুব সুর করে। আপনার কণ্ঠ যেন তার কণ্ঠের মতোই। সুধাবাবুর দোকানের ‘শাখা’ আমাদের ওখানে খুব বিখ্যাত ছিল। কিন্তু স্যার, আপনি তো মুসলিম, আমাদের ধর্মের এত বিষয় আপনি কিভাবে জানেন?
ইমরুল বলে, শুধুমাত্র পড়ে। পড়ে পৃথিবীর সব জানা যায়। বিচিত্রবীর্যের দুইপুত্রের মধ্যে বড় ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। কিন্তু তিনি ছিলেন অন্ধ। তাই তিনি রাজা হতে পারলেন না। কথার মাঝখানেই কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরের ‘মাতৃভান্ডার’ মিষ্টির দোকান থেকে আনা তিনটি মিষ্টি ইমরুলকে খেতে দেন শোভনা দাশ। সঙ্গে এক গ্লাস জল। বৌদি, হঠাৎ মিষ্টি যে! প্রশ্ন করে ইমরুল। মনীষার বিয়ের বিষয়ে কথা বলতে আমাদের এক আত্মীয় এসেছিলেন। আর কোনো প্রশ্ন করতে পারে না ইমরুল। মনীষা একবার ইমরুলের চোখের দিকে চায়। বুঝতে চেষ্টা করে কথাটি শুনে এখন ইমরুলের অনুভূতিটা ঠিক কী রকম।
ইমরুল কি মনীষাকে চিরতরে ভুলে যাবে? তা কি কখনো সম্ভব? মনীষাকে পাবে না সত্য, কিন্তু তাকে কোনোদিনও ভুলে যেতে পারবে না ইমরুল। তাদের উভয়ের বয়সের ব্যবধান দশ বছর। সেটা কোনো ব্যবধান নয়। ব্যবধান তৈরি করেছে ধর্ম। এই পৃথিবীতে সকলেরই ধর্ম রয়েছে, কিন্তু সব ধর্ম এক নয়। কেন ধর্মের কারণে মানুষে মানুষে মিলন হতে পারবে না? এই ভাবনায় ভাবনায় যেন অনেকটা পাগল হয়ে যায় ইমরুল।
অন্যদিকে বিয়ে না হলেও মনীষার বুকের ভিতর সোনালী অক্ষরে বেঁচে থাকবে ইমরুলের নাম। তাই সে এখনও ইমরুল ভিন্ন তার জীবনে কাউকেই আর ভাবতে পারে না। মনীষা ভাবে, এই পৃথিবীতে এই ইমরুল ব্যতিত আর কোনো পুরুষই আমাকে একবিন্দু শান্তি দিতে পারবে না। কিন্তু তার বাবার যেমন কঠোর স্বভাব, যদি এ কথা একটু জানতে পারে, মেয়েকে কেটে গোমতি নদীতে ভাসিয়ে দেবে, তবু এ বিয়ে মেনে নেবে না। এটা মনীষা বুঝে। তারপরও তার মনকে শান্ত করতে পারে না। তাই তার ইচ্ছে হয় চেতনানাশক ওষুধ কিংবা সিডাক্সিন খেয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়। কিন্তু সেটাও সম্ভব হয় না। তার বান্ধবী লাবনী তার মুখে এই সমস্যার কথা শুনে বলেছে, পালিয়ে বিয়ে করে ফেল। সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অথচ মনীষা এটা কখনোই করতে পারবে না। তার বাবা রাগে ক্ষোভে আত্মহত্যা করে ফেলবে। এমন অসংখ্য দুশ্চিন্তা মনীষাকে কিলবিল করে খেতে থাকে।
মনীষার বিয়ের প্রসঙ্গ আসার পরও ইমরুল কেন এ নিয়ে আর বেশিকিছু জানতে চায় না, এ নিয়ে খটকা লাগে মনীষার মা শোভনা দাশের। তাই নিজে থেকেই বলে, স্যার-শুনেছি ছেলেটা ভালো, ব্যবসায় খুব মনোযোগী। বাপের একমাত্র ছেলে। বড় এক দিদি রয়েছে, বিয়ে হয়েছে তার। ইমরুল বলে, দেখেন বৌদি, ভালো হলেই ভালো। বৌদি, আপনাদের ফ্রিজে ঠান্ডা পানি আছে? মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে আমার। মনীষা বলে, মা ফ্রিজের নিচের র‌্যাকে দেখো আছে ঠান্ডা জল। শোভনা পানি এনে ইমরুলকে দেন। ইমরুল ঢক্ ঢক্ করে পান করে। মনীষা বলে, স্যার কপালে মলম লাগাবেন? মাথাব্যথার ইন্ডিয়ান মলম আছে আমাদের ঘরে। মাথার যন্ত্রণায় দারুন উপকার করে। শোভনা দাশ বলেন, দিচ্ছি আমি মলমটা। ইমরুল বলে, বৌদি, আমি আজ আর পড়াবো না। বাসায় চলে যাই। গত রাতে ঘুম হয়নি আমার। শোভনা দাশ বলেন, স্যার, আপনি কি ঠিকভাবে যেতে পারবেন? নাকি শুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে যাবেন! ইমরুল বলে, যেতে পারবো আমি। একটু এগিয়ে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ মন্দিরের সামনে থেকেই রিকশা নিয়ে নেবো। আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না। পাশের বাসায় উচ্চকণ্ঠে বয়স্ক একজন লোক গীতা অথবা চৈতন্য চরিতামৃত পাঠ করছেন, সে দিকে কান যায় না ইমরুলের। রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ মন্দিরের সামনে এসে ইমরুল রিকশায় ওঠার পর মনীষা এবং শোভনা দাশ একসঙ্গে বলে ওঠে, সাবধানে যাবেন স্যার। ইমরুল একবার পেছন ফিরে দেখে। মনীষা বিমর্ষ, শোভনা দাশের পরনে লাল পাড় নীল তাঁতের শাড়ি। প্রসাদ এবং ধূপের গন্ধে রাধাকৃষ্ণ মন্দির এলাকা যেন মৌ মৌ করছে। বাসায় ফিরে শোভনা দাশ মেয়ের মুখের দিকে তাকায়, ঠিক যেন এ মুখ আগে দেখেননি শোভনা দাশ। মনীষার মুখের দিকে স্থির তাকিয়ে দেখেন। এমন সুন্দর চন্দ্রবদন-কার না দেখতে ভালো লাগে! কথাটা মনে মনে ভেবেই নিজের বুকটা হঠাৎ যেন ধক করে ওঠে শোভনা দাশের। মনীষা বলে, কী দেখছো মা,কী ভাবছো ? শোভনা দাশ বলেন, তোর স্যার কি কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেমটেম কিছু করে, জানিস কিছু? মনীষা বলে, তুমিও যেমন মা, এসব কথা আমি জানবো কিভাবে? এসব কথা কি স্যারের আমাকে বলার বিষয়? আমি জানি স্যারের বাবার শ্বাসতন্ত্রের অসুখের কথা। সেদিন বললেন, তার মায়ের কিডনির অসুখের কথা। সেদিন বললেন, তার মায়ের কিডনির অসুখে ডায়ালাইসিসের প্রয়োজনের কথা। এর বেশি কিছু আমি কিভাবে জানবো? বলেই মনীষা তার পোষা সাদা বিড়ালটাকে কোলে তুলে নেয়, যাকে সে ‘পুষি’ নামেই ডাকে। হঠাৎ শোভনা দাশ তার মেয়েকে টান দিয়ে ঠিক নিজের বুকের কাছে এনে বলেন, সত্যি করে বলবি মনীষা, তোর স্যার কি কখনো তোকে প্রেম নিবেদন করেছিল? মনীষা আকাশ থেকে পড়ার ভাব দেখিয়ে বলে, মা তোমার কি মাথাটা খারাপ হয়েছে? শোভনা বলেন, যে লোক নারী প্রেমের মোহ বিসর্জন দিতে পারে না, তার কিন্তু শিক্ষক হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই।
পর পর দুইদিন ধরে ইমরুল আর মনীষাকে পড়াতে আসে না। কেন, তার কারণ জানা যায়নি। মনীষা নির্বাক। ছোটবেলার পুতুলগুলো নিয়ে খেলতে বসে মনীষা। শোভনা দাশ জানেন, মনীষার মন খারাপ হলেই সে এসব পুতুল নিয়ে বসে। মনীষাকে তাই বলেন, তুই কি এখন শিশু আছিস মনি। পুতুল নিয়ে আর কতোদিন খেলবি? মনীষা বলে, তোমাদের কাছে তো আমি বুড়ি হয়ে গেছি। না হলে এত তাড়াতাড়ি পর করার ষড়যন্ত্র করতে? শোভনা বলেন, মা-রে, মেয়ে যেহেতু হয়েছিস...। মনীষা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠে। বলে, মা, আমার সারাটা জীবন আগুনে পুড়ে যাবে। আমাকে এখন বিয়ে দিয়ো না। পুরনো ঢাকার পুরনো ইট-বালুর কারাগারে আমি বন্দী থাকতে পারবো না। আমাকে পড়তে দাও। আমাকে আরও বড় হতে দাও। মেয়ের এমন আকস্মিক কান্নায় তার মা-ও তাকে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কেঁদে দেয়। মায়ের কান্নার সময় মনীষা লক্ষ্য করে তার মায়ের মুখের চামড়ায় একাধিক বলি রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। এ বলি রেখাগুলো দেখে মনীষার মন আরও খারাপ হয়। শোভনা বলেন, তোর বাবাকে আমি বারণ করতে পারবো না। বলছেন, ছেলেটা ভালো, শিক্ষিত, ব্যবসায় মনোযোগী। তাছাড়া এখন বিয়ের কথা তো প্রায় ঠিকই...তোর মামা ছেলের জন্য উপহার হিসেবে একটা দামী ব্র্যান্ডের গোল্ডেন ঘড়িও কিনে পাঠিয়েছেন। ঘড়ির চেইনটা সে রকমই গোল্ডেন। মনীষা বলে, আমার জীবনটা যদি গোল্ডেন না হয় মা। মনীষার মা বলেন, মা-তোর এখন যেমন রূপ, তিল-তিল সৌন্দর্য দিয়ে ভগবান তোকে গড়েছেন, দু’দিন পরে যদি তোর রূপ নষ্ট হয়, ভালো সম্বন্ধ আসবে না আর। তাছাড়া মেয়েদের বয়স বেশি হয়ে গেলে...। মনীষা বলে, মা কথা তো এমনভাবে বলছো, যেন মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছো না, দেবতাকে পূজার নৈবেদ্য অর্পণ করছো। শোভনা বলেন, এ কেমন কথা কস মা, রসকষহীন। মনীষা বলে, সারাদিন রসায়ন পড়তে পড়তে মুখ থেকে রসগোল্লার রস শুকিয়ে গেছে মা। শোভনা বলেন, শোন মা, তোর বান্ধবী মল্লিকা’র তো আরও অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে। ওর ছেলেটা এখন হাঁটতে পারে। মনীষা বলে, মা আমি শুনেছি, তোমাদের দেখা ছেলেটার বয়স নাকি বেয়াল্লিশ। আমার সঙ্গে বিশ বছরের পার্থক্য। শোভনা বলেন, ঠিক এত বেশি হবে না মা, এগুলো আমাদের শত্র“রা বলছে।
মা মেয়ের এমন আলাপের মধ্যেই হঠাৎ হাজির হয় ইমরুল। শোভনা দাশ বলেন, একটি খবরও দিলেন না স্যার, সেদিন শরীরটা কতো খারাপ নিয়েই না গেলেন। ইমরুলের মুখে হাসির রেশ। না, শরীর পরে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। আসতে পারিনি অন্য ঝামেলায়। মনীষা বলে, স্যার একটি টিয়ে পাখি খাঁচায় বন্দী থেকে ঠিক কতোদিন বাঁচতে পারে? মনীষার এই প্রশ্নটি ইমরুল না শোনার ভান করে। মনীষা আবার মুখ বাজায়। স্যার, আমার লাগানো ধুন্দুল গাছটায় ধুন্দুল ধরেছে। দেখবেন? ইমরুল বলে, এই রাতে? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এমন সময় দুইটি খোসা ছাড়ানো কলা, কয়েক টুকরো আখ, কয়েকটি আঙ্গুর, একটি কমলালেবু ও এক গ্লাস জল এনে দেন ইমরুলকে মনীষার মা। ঠিক তক্ষুনি এক চিৎকার ওঠে মনীষার কাকীর ঘরটায়। মনীষা আর তার মা একসঙ্গে দৌড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর মনীষা একা ফিরে এলে ইমরুল ঘটনার কারণ জানতে চায়। মনীষা বলে, কাকী হইলো এক পান খাউনি বুড়ি। টিভি-র দিকে হা কইরা জাঁতি দিয়া সুপারি কাটছিল। সুপারি না কাইটা আঙ্গুল কাটছে। বুঝুক ঠেলা। ইমরুল শুনে বলে, কী ভয়ানক...। মনীষা তখন এক মুহূর্তে দরজা বন্ধ করে দেয়। গায়ে তার নকশা করা চমৎকার একটি চাদর। বাইরে শেষ নভেম্বরের শীত। হঠাৎ ইমরুলের দুই পা জড়িয়ে ধরে মাটিতে বসে পড়ে মনীষা। ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। ফিসফিস করে বলতে থাকে, স্যার আমাকে খুন হতে দেবেন না আপনি। প্লিজ। চলেন পালিয়ে যাই। আমি না হয় মরে যাবো...। আমাকে বাঁচান আপনি। ইমরুল নির্বাক। শুধু দুই হাতের তালু দিয়ে একবার মনীষার দুই গালে ধরে। তারপর নিজের হাতে চোখের জল মুছে দেয়। একবার শুধু বলে, চেয়ারে বসো। খাতা-বই নাও। মনীষা বলে, স্যার, আপনি কি কোনো কামিনী ফুলের সুগন্ধ পাচ্ছেন? ইমরুল নিরুত্তর। স্যার, আকন্দ গাছে কি অপরাজিতার নীল ফুল ফোটে? স্যার, ইস্ত্রি দিয়ে কি আলপনা আঁকা যায়? কদমফুলে কি কইমাছের মতো কাঁটা থাকে? স্যার, পালকির ভিতর কি রক্তজবা ফুল ফোটে? কমলালেবুকে কেন সেদিন নারঙ্গী বলেছেন আপনি? স্যার, আমাদের চালতা গাছটায় একটা মৌচাক রয়েছে। আমার খুব ইচ্ছে হয় ওটাতে একটা শক্ত ঢিল ছুঁড়ি। স্যার, আপনি কি আমাকে বিয়ে করবেন? এতসব প্রশ্নের একটিরও উত্তর দেয় না ইমরুল। শুধু মনীষার কপালে হাত দিয়ে দেখে প্রচন্ড জ্বর মনীষার। জ্বরে একেবারে পুড়ে যাচ্ছে ওর শরীর। হঠাৎ আসা জ্বর। ইমরুল বলে, আজ তোমার আর পড়তে হবে না মনীষা। মনীষা বলে, স্যার-আমি যদি মরে যাই, আমার জন্য একটি স্মৃতিমন্দির বানাবেন? ইমরুল নিরুত্তর। মনীষা বলে, স্যার আমার কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছেন না কেন? । ইমরুল বলে, রাজশক্তি নেই আমার হাতে। বড়ই অক্ষম আমি। মনীষা বলে, আপনি আমার শিক্ষাগুরু, এই আপনার উত্তর, ইমরুল বলে, ধর্ম আর রাজনীতি কি জিনিস, জানো তুমি? খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যীশুকে কে ক্রুশে বিদ্ধ করে হত্যা করেছিল? ইহুদীরা। তাহলে এখন খ্রিস্টান আর ইহুদীরা কিভাবে বন্ধু হলো?
মনীষা বলে, আমি ওসব বুঝতে চাই না। ইমরুল বলে, তোমাদের বাড়িতে প্রথম যেদিন এসেছিলাম দশ বছর আগে, তখন বকুলগাছটা কতো ছোট ছিল। আর এখন? বিভিন্ন দিকে নৌকায়ও এখন ইঞ্জিন লেগেছে, এ কথা তো তোমার মা-ই সবসময় বলেন। অতি গতিতে দুর্গতি কিন্তু কমেনি। হিন্দু আর মুসলিম কখনো এক হবে না। মুসলিম বলবে, ওরা পৌত্তলিক। হিন্দু বলবে...। সুতরাং ধনীতে-গরীবে আত্মীয়তা হবে না কখনো, হলেও ভেঙ্গে যাবে। রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের পোস্টমাস্টার তাই আর কোনোদিনও ফেরে না সেই রতনের কাছে...। এভাবে ইমরুলের বলার সমান্তরালে মনীষার চোখের জল টপ টপ করে ঝরতে থাকলে ইমরুলের মুখ বন্ধ হয়। ইমরুল শুধু একবার বলে, পোড়াকপালী-তোর কান্না বন্ধ কর। মনীষা নিজেকে সামলে নিতেই কাকীর ঘর থেকে ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে আসে মনীষার মা। এসেই মনীষার কাকীর গল্প বলতে থাকে। গল্প শেষ হলে ইমরুল বলে, বৌদি, আমার মায়ের শরীর ভীষণ খারাপ। যে কোনো সময় মারাও যেতে পারেন। মা আমার বউ দেখতে পাগল হয়েছেন। কিন্তু আমি বোনদের বিয়ের আগেই সে রকম কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না। সুযোগ থাকলে দাদাকে নিয়ে একবার আমার মা-কে দেখে আসবেন। শোভনা দাশ বলেন, স্যার যদি আপনার বড় কোনো টাকা ধারের দরকার পড়ে, আমাকে বলবেন। আপনার দাদাকে বলে আমি কয়েক মাসের জন্য ধারের শর্তে হলেও নিয়ে দিতে পারবো। কোনো সংকোচ করবেন না। ইমরুল নিরুত্তর থাকে। যেন সে এ কথার জবাব খুঁজেই পায় না। শোভনা দাশ আবারও বলেন, স্যার আপনার মায়ের চিকিৎসাটা ঠিকভাবে করান। দশ-পনের হাজার টাকা পর্যন্ত গয়না বন্ধক রেখে আমি নিজেই আপনাকে দিতে পারবো। কোনো সংকোচ করবেন না। যখনই লাগে, বলবেন। আপনার মায়ের চিকিৎসাটা ঠিকভাবে করানো উচিত। ...।
কিন্তু ইমরুলের মায়ের আর বেশি চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। মনীষাকেও তার আর বেশিদিন পড়াতে হয়নি। মনীষার শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়েই যায়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, যেদিন বিয়ে হয় মনীষার, ঠিক সেদিনই মৃত্যু হয় ইমরুলের মায়েরও। তাই কেউ কারো পাশে, আনন্দে অথবা শোকের লগ্নেও উপস্থিত থাকতে পারেনি।
রচনা: ফেব্র“য়ারি, ২০০০ খ্রিস্টাব্দ, পশ্চিম চানপুর, কুমিল্লা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.