নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

দিনলিপি: 1986-1991

২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০২


আলোকচিত্র: জসীম অসীম: 1996

19 মে 1986,
খয়রাবাদ, দেবিদ্বার, কুমিল্লা:

গ্রামের প্রকৃতি সুন্দর কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বড়ই অসুন্দর।
আমাদের বাড়িতেও কতো যে রাজনীতি।

বড় ভাই এখনও কুমিল্লা শহরে কোনো লজিং খুঁজে পাননি। তাই আজ আবারও শহরে গিয়েছেন লজিংয়ের খোঁজে। আর মা কেবল চান মিয়া নানাসহ নানাজনের কাছে সুদের টাকার খোঁজ করছেন। আমাদের তীব্র অভাব মেটাতে।

আব্বা আছেন চট্টগ্রামে। কতোদিন আব্বা বাড়িতে আসেন না!

আমাদের এতো অভাব! হয়তো কোনোদিনও দূর হবে না এই অভাব। ট্রয়ের যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পড়ে বুঝলাম, মানুষ কখনোই সুখে ছিলো না। কোনোদিনও না। ‘কাহিনী বিচিত্রা’ আমার প্রিয় একটি বই। এই বই পড়েও বুঝেছি, মানুষের ইতিহাস হলো তাঁর দুঃখেরই ইতিহাস।
=====================================
20 জুলাই 1986,
খয়রাবাদ, দেবিদ্বার, কুমিল্লা:

জরুরী দরকারে মা আমাকে কুমিল্লা শহরে বড় ভাইয়ের কাছে পাঠিয়েছিলেন। বড় ভাই এখন কুমিল্লা শহরের গোবিন্দপুরে থাকেন। 2 শত টাকার একটি মাটির ঘর ভাড়া নিয়েছেন।
আগামী 24 জুলাই বড় ভাইয়ের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। প্রথমে আমি কুমিল্লা শহরের টমছমব্রীজ থেকে গোবিন্দপুর চৌমুহনীতে যাই। পরে সেই চৌমুহনী থেকে আবার উত্তর দিকে গিয়ে আবারও একটু পশ্চিমে গেলে একটি মসজিদ ও পুকুরের দেখা মেলে। সেই মসজিদেরই সোজা দক্ষিণ দিকে কাজী আনিসুর রহমান শিবুদের ঘর। ওখানেই এখন থাকেন বড় ভাই আলী আশ্রাফ।
আর সব কিছু দেখে এসে বুঝলাম, এখানেও খুব সুখী নন তিনি। কোন রকমে শুধু তাঁর প্রাণ টিকিয়ে রাখেন...এই হলো কথা। ভাত খাওয়ার সময় আমাকে নিয়ে গেলেন দৌলতপুর সড়কের রেললাইন পার হয়ে আরেক ম্যাসে। ওই ম্যাসের তিনদিকেই ধানের জমি। পাশ দিয়েই একটু পর পর রেলগাড়ি চলে যায়। তারপর বিকেলে আবারও আমি বাড়িতে চলে আসি।
===============================
24 ডিসেম্বর 1986, খয়রাবাদ, দেবিদ্বার, কুমিল্লা:

বড় ভাই আলী আশ্রাফ সেকন্ড ডিভিশনে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছেন। কী যে ভালো লাগছে আমাদের সব্বার। তাঁর যদি এবার একটি ভালো চাকুরি হয়, তাহলে আমাদের এই অভাব অনেক অনেক কমে যাবে।
আব্বা বড়ই ক্লান্ত। আর তিনি একা একা আমাদের সংসারটা চালাতে পারছেন না। ‘হাতেম তাই: হাসনে বানুর পঞ্চম সওয়াল’ গল্প পড়ে খুবই মুগ্ধ হলাম। ‘হেক্টরের বীরত্ব’ গল্পটি ভীষণই কঠিন। গল্পের এতো জটিলতা আমার মাথায় ঢুকে না।
‘আবু হোসেনের গল্পে’র মতো একটি গল্প আমিও লিখতে চেষ্টা করছি। আমাদের অজিত স্যার বলেছেন এসব গল্প ফারসী ভাষার গল্প। বাংলায় শুধুমাত্র অনুবাদই হয়েছে।
==================================
21 জানুয়ারি 1987,
খয়রাবাদ, দেবিদ্বার, কুমিল্লা:

আমাদের বাড়িতে চলে অনেক রাজনীতি। ভিলেজ পলিটিক্স। আমি একটি উপন্যাসও লিখছি এই ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ নামে। লেখা শেষ হয়ে গেলেই এ বইটি ছেপে দেবেন নিমারবাড়ির জাহাঙ্গীর কাকা।
আর আমার লেখাপড়া হবেই বা কিভাবে? অনেক দুশ্চিন্তা আমার। প্রতিদিন বাজার করতে হয়। আরও কতো যে ঝামেলা থাকে।
মা আবারও বড় ভাই আলী আশ্রাফকে নিয়ে খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন। তাই মায়ের কথায় বড় ভাইয়ের খবর নিতে আবারো কুমিল্লা শহরে যাই। কুমিল্লা শহরের অশোকতলার লিয়াকত আলীর বাড়িতে। গিয়ে দেখি বড় ভাই অবস্থা আসলেই খুব খারাপ। আজ কয়েকদিন ধরে তাঁর আমাশয় হয়েছে। অবশ্য মিন্টুর আম্মার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে চিকিৎসা করে বড় ভাই এখন কিছুটা সুস্থ।
===============
11 ডিসেম্বর 1990, কুমিল্লা:

আজ মনটা তেমন ভালো ছিলো না। আমাদের গ্রামটা ছেড়ে আসতে আসতে এলাম অনেক দূরে। মনে হলে আগুন আমাকে ভীষণই পুড়ে।

সকালে ছিদ্দিক মামার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তারপর হাড়েশ্যার গ্রামের ফারুকের কাছ থেকে আমারই তৈরী ‘প্রভাত সাজেশন’ বিক্রির কিছু টাকা আনি।
===============
13 ডিসেম্বর 1990, কুমিল্লা:

আজ কুমিল্লা শহরের চকবাজারের সাহাপাড়ার অজিত সাহার মেয়ে তাপশী সাহার বিয়েতে যাই। আমার পরনে ছিলো তখন সবুজ দামী জ্যাকেটটি আমার। তাপশীর ছোট ভাই আশিষ আর ছোট বোন পলাশীকে পড়াই আমি। অজিত দাদার বউ বড়ই ভালো মানুষ। তিনি একজন পাগল করা সুন্দরীও বটে।
অজিত দাদার দারুন কপাল। কারণ তাঁর বউয়ের এমন রূপের চেয়েও তাঁর গুণই বরং বেশি। তাঁদের মেয়ে তাপশীর বিয়েতে আমি উপহার দেই ‘রূপকথার গল্প’ আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বলাকা’ কাব্যগ্রন্থটি।
পুরো বিয়েতেই এমন বই আর কেউ উপহার দেয়নি। তবে আমার ছাত্র আশিষ কিন্তু রূপকথার গল্পের বইটি দারুণ পছন্দ করেছে।
==============
18 ডিসেম্বর 1990, কুমিল্লা:

আজ কুমিল্লার দেবিদ্বারের জাফরগঞ্জ বাজার পার হয়ে অলুয়া গ্রামের শাহ আলমের সঙ্গে দেখা করি। তাঁর সঙ্গে কথা বলি বিভিন্ন বিষয়ে।
আগে আমি ভাবতাম ওঝাই সাপের বিষ ঝাড়ে এবং ভূত তাড়ায়। এখন দেখছি সেই ওঝাই হলো ভূত। কখনো বা সেই ওঝা হয়ে যায় টাকা। শুধুমাত্র টাকাই।
============
30 ডিসেম্বর 1990, কুমিল্লা:

আজ আমার শরীরও খারাপ এবং আব্বার শরীরও খুবই খারাপ। কিন্তু এ অবস্থায়ও কারো জন্য ওষুধ কেনার কোনো পয়সা নেই।
অন্যদিকে ঘরের আটা-চালও শেষ হয়ে গেছে। আর এমন অভাবের দিনেও গ্রামে থাকার সময়ে আমার মা সারা বাড়িতে গোলাপজল ছিটাতেন। শুধুমাত্র প্রেতাত্মার উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। তবে ওই গোলাপজল শুধুমাত্র বাজার থেকে কেনা গোলাপজলই ছিলো না। কুমিল্লার বুড়িচংয়ের রামপুরের গুণী এক মহিলা, আমরা যাকে ‘নানী’ বলতাম, তাঁরই পড়ানো বিশেষ গোলাপজল।
============
1 জানুয়ারি 1991, কুমিল্লা:

ঢেঁকি আজ শহরের মানুষের কাছে মেকি হয়ে গেছে। তাই শহরে কেউ আর ঢেঁকি ব্যবহার করে না? নাকি শহরের মানুষগুলোই মেকি হয়ে গেছে!
আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে একেবারেই কুমিল্লা শহরে চলে আসার আগে আমাদের ঢেঁকিটাও মা বিক্রি করে দিয়েছেন। তাহলে কি আমরাও এখন মেকি মানুষে রূপান্তরিত হচ্ছি!
অথচ ঢেঁকিতে ছাটা চালের ভাতের স্বাদই ছিলো আলাদা। এটা শুধু মানুষের মুখের কথাই নয়। একেবারেই সত্যি ঘটনা।
আজ আব্বা বেতন পেয়েছেন। বড় ভাইও বেতন পেয়েছেন। অনেক অনেক ভাতের চাল নিয়ে এসেছেন তাই। খাওয়ার সমস্যা দেখা দিলে আমাদের কারো মাথাই ঠিক থাকে না।

আজ সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ রচিত বিটিভি-র নাটক ‘অয়োময়’ এর একাদশ পর্ব দেখলাম আব্বার বন্ধু মনির কাকার বাসায়। মনির কাকা আমাদের তুলনায় অনেক অনেক ধনী। শহরে বাড়ি করেছেন।
ধনের দিকে হয়তো আমার আব্বার তেমন নজর ছিলো না। যেমনটা মনির কাকার। তাহলে কি ধনের দিকে আমার নজরও থাকবে না!
কারণ কুমিল্লা শহরের উত্তরদিকে ‘রত্নাবতী খেয়াঘাট’ দিয়ে নদী পার হয়ে অনেক অনেক দূরে হারিয়ে যাওয়ায় কেবলই ইচ্ছে হয় আমার। আর এমন ইচ্ছের জন্যই হয়তো শৈশবে ও কৈশোরে আমাদের গ্রামের বাড়ির ডাক্তার জ্যাঠা সাবেরুল ইসলামের কাছে আমি কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানীর নানা গল্প শুনতাম।
===========
9 জানুয়ারি 1991, কুমিল্লা:

হে আল্লাহ-আত্মসমর্পণ করেছি তোমার কাছে, দাও একটি নতুন জীবন। তুমি তো জানো প্রভু, তুমি-আমি মূলত একজনই হই। কারণ তোমার আত্মায় গড়া আমার জীবন।
তবুও কেনো তুমি বারবার ফিরিয়ে আমাকে দাও?
অাব্বার কাছে মহান সাধক মনোমোহন দত্তের গানের ব্যাখ্যা শুনে রীতিমত পাগলই হয়ে গেলাম। আব্বার ব্যাখ্যায় মনে হলো মনোমোহন দত্ত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকেও বড়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’-র চেয়ে শ্রেষ্ঠ লেখা কি আর কোনোদিনও এই পৃথিবীতে সত্যি লেখা হবে? আমি বিশ্বাস করি না।
কোনো কবিই আর এতো ভালো লিখতে পারবেন না কোনোদিনও। এমনকি কবিতা বা গান মুখস্থ করতে গিয়ে মলয়া-র গান বা মনোমোহন দত্তকে আমার কাছে খুবই কঠিন কবি মনে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়লে বুকের তপ্ত মরুও ভিজে নয়ন নদীর নীরে। রবীন্দ্রনাথ আসলে রাজা। বাস্তবে যেমন ছিলেন জমিদার, সাহিত্যেও তেমনি। যেন বনের পাখি। তাঁকে চিনতে আমার একটুও নেই বাকি।
আজ সকালে আমার ছাত্র আশিষকে নিয়ে কুমিল্লা জিলা স্কুলে গিয়েছিলাম। ওর আজ ভর্তি পরীক্ষা ছিলো। আর ওখানেই দেখা হলো আমাদের গ্রামের মেধাবী ছাত্র দোনারবাড়ির মতিন সাহেবের ছেলে কামাল ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি এখনও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অর্নাস পড়েন।
=============
11 জানুয়ারি 1991, কুমিল্লা:

আজ আমার মন খুবই ভালো।আজকে আমার চোখে হাজারো গোলাপ ফুল।
গত রাতে স্বপ্নে দেখি বাংলাদেশের সকল চাষার গোলা ভরা ধান। এ আনন্দ সত্যি পাগল করা। আর এরই মধ্যে দিনে দেখি ঘরে বোয়াল মাছ।
আব্বা তাঁর বন্ধু মনির কাকার সঙ্গে মিলে 190/- টাকায় বোয়াল মাছ এনেছেন।
============

12 জানুয়ারি 1991, কুমিল্লা:

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গল্প। নেই নেই তাঁর বিকল্প।
একসময় নানীর মুখে কতো মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতাম। আর আজ শুনেছি তেমন গল্প মোঙ্গল মেম্বার মামার মুখে।
মেম্বার মামা ও ছোট মামা জয়নাল আবেদীন আজ কুমিল্লা শহরে এসেছিলেন। দীর্ঘ সময় তাঁরা ছিলেন আমাদের বাসায়ও।
============
13 জানুয়ারি 1991,
কুমিল্লা:

ডাকতে ডাকতে মরি
তবু ডেকে যাই,
ডাকতে ডাকতে
যদি একদিন
তাঁকে বুকে পাই।
কাকে ?
আল্লাহকে।
বাংলাদেশ আল্লাহর পরম সৃষ্টি।
আল্লাহ ছাড়া মানুষের আর কে আছে ? মা সব সময় এ কথা বলেন। তবে মা কিন্তু নামাজ পড়েন খুবই কম।
আব্বা আবার নিয়মিতই নামাজ পড়তে মসজিদে যান।

আমিও একসময় নামাজ নিয়মিত আদায় করতাম। আর এখন হয়েছি মস্ত এক ফাঁকিবাজ। কবি হয়েছি বলেই! বালিতে যা হয়, পলিতে তা হয় না। ধার্মিক যা পারে, কবি কি তা পারে?
অথচ আমার সদাই মনে হয় উড়ে উড়ে সব গ্রহে চলে যাই। সব ধর্ম নিয়েই পড়ি। মন্দিরে যাই, গীর্জায় যাই। কিন্তু তা কি হয় ? ভয়। চতুর্দিকে ভয়। দামাল আমাদের গ্রামের মোল্লাদের ভয় না করেই আজ সকালবেলা পোনরা মেলায় যাবে বলে বাড়িতে চলে গেছে। হায়রে মেলা! কতো সাধের পোনরা মেলা আমার। অনেক বড় মেলা। ছোটবেলায় এ মেলা ছিলো অামার প্রাণ। অথচ এ মেলায় যাওয়ার কারণে আমাদের মাদ্রাসার হুজুর কষে মারতেন বেত এবং করতেন অনেক পরিহাস। পারলে যেন ভেতরেই ঢুকিয়ে দিতেন বাঁশ। কারণ হুজুররা ছিলেন ওই ইসলামের নামে অনেক অন্ধ বিশ্বাসেরও দাস। তাই তাঁরা বলতেনও, মুসলমানের সন্তান হয়ে তোরা হিন্দুদের ওই মেলায় কেনো চলে যাস ?
===============
14 জানুয়ারি 1991, কুমিল্লা:

সারারাত প্রভাতের অপেক্ষায় থাকি আমি। ক্রমাগত। তারপরও সুখের দিন চলে যায়। আমার মামাতো বোন আয়েশা পারভীন পারুকে তাঁর বাবা-মায়ের অমতে জোর করেই একদা বিয়ে দেয়া হয়েছিলো মামাতো ভাই জাকির হোসেনের সঙ্গে। পারভীনকে মামা-মামী ‘পারু’ বলেই ডাকে। কিন্তু ‘পারু’ কি সত্যিই সুখে আছে? অবশ্য ‘পারু’র বরের কিন্তু অর্থের অভাব নেই। সেই তুলনায় আমরা খুবই গরীব। ‘পারু’ তাঁর এ ভাগ্যের কারাগার থেকে বের হতে আর পারবে না। কোনোদিনও পারবে না। কারণ সে নিজ পায়েই দাঁড়াতে পারবে না কোনোদিন। তাছাড়া তাঁকে দেয়া হবে না সেই সুযোগও কক্ষনো।

‘পারু’কে আমরা পারভীন বলেই ডাকি। তাঁর মা খুবই রাগী একজন মামী ছিলেন আমার। এখন তিনি খুবই অসুস্থ।
পারু’র বাবা অহিদুর রহমান মামা আমাকে খুবই স্নেহ করেন। সেদিন তিনি আমাকে বলেন, কোনোদিন কারো ক্ষতি করলাম না ভাগ্নে। তাহলে আমার ওপর এতো বিপদ কেনো? আমি তাঁকে বললাম, মামা, মাদ্রাসা আর মসজিদও তো নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে। আমার এ কথা শুনে মামা বললেন, তুই অনেক বড় হবি রে ভাগ্নে।
আজ সকাল বেলা কুমিল্লা শহরের ইউসুফ স্কুল সড়কের গাজী লাইব্রেরী থেকে আমার ছাত্র আশিষের জন্য কিছু বই কিনে আনি। আজ যে কবিতাটি লিখি আমি, তার শিরোনাম ‘পাবদাখেকো পানকৌড়ি’।
============
15 জানুয়ারি 1991, কুমিল্লা:

ইরাককে হত্যার পরিকল্পনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সব দেখে শুনে মনে হয় আমি নিজেই সেই যুদ্ধে নামি। মার্কিনী এসব অত্যাচার নিঃশব্দে দেখার জন্য কেনো বেঁচে আছি ?
পত্রিকাগুলো বলছে, যুদ্ধ হলে ইরাকের ঐতিহ্যবাহী পুরাকীর্তি সব ধ্বংস হয়ে যাবে। হায়! কেবল রক্তক্ষরণই নয়। সামনে আমার পরীক্ষা। কী দেবো পরীক্ষা? সারাদিন ‘দৈনিক ইনকিলাব’ পত্রিকা নিয়েই পড়ে থাকি। এ বিষয়ে আলাপ করি ছিদ্দিক মামার সঙ্গেও। মুসলমান কি এই গ্রহ থেকে সত্যি সত্যিই বিনাশ হয়ে যাবে? এই দুনিয়ায় ইহুদীর বাচ্চাদের ‘খেল’ যে না বুঝেছে, সে রয়েছে তাঁর মায়ের গর্ভেই।
হ্যাঁ আমি হিন্দু-মুসলিম বুঝিনা এখন, মানুষই শুধু বুঝি। মানবতাই আমার লেখার সবচেয়ে বড় পুঁজি। কিন্তু আমেরিকার এ কোন মানবতা? তাঁর বিরুদ্ধে মনে মনে স্বপ্ন না বুনে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত। ভাবতে গেলে বন্যার মতো কান্না উথলে উঠে। ভুলেও কি আমেরিকা ফুলের মূল্য বুঝবে না?
হে আল্লাহ, এই পৃথিবীতে আমি একটু শান্তি দেখতে চাই। তাড়াও আমার হতাশা। দিনরাত ধরে বসে আছি ঘরে। কেনো? আমেরিকার গুণ, লাগানো শুধু আগুন? আর মানুষ খুন?
হায়! আজকের নির্ধারিত তারিখ পার হয়ে গেলেই ইরাকে প্রাণদানের খেলা মহা যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। আলুভর্তা হয়ে যাবে আমার প্রিয় রাষ্ট্রনায়ক বীর সাদ্দাম হোসেন। এ কথা ভাবলেই আমার রাগে ক্ষোভে ও দুঃখে হেঁট হয়ে যায় মাথা।
কেনো না মুসলমান রাষ্ট্রগুলোর আজ বড়ই দুর্দিন। আজকের এ সময়ে ওই আমেরিকাই শুভংকর। ওই আমেরিকাই ভয়াবহ ভয়ঙ্কর। ভয়ঙ্কর।
===========
16 জানুয়ারি 1991, কুমিল্লা:

গরীব মানুষকে সবই কিনে খেতে হয়। কারণ পৃথিবীর মালিক তো মূলত ওই ধনীরাই।
ঐ যে সমুদ্র, তাঁর জলের ফেনাও কেনা ছাড়া গেলা যায় না এখন। যেমন লবণ। আমেরিকার নাকি টাকার কোনো অভাবই নেই। মামা বলেন, আমেরিকা আর রাশিয়া: আকাশে আর মহাকাশে আছে আজ এই দুই জমিদার ভাসিয়া। কিন্তু আমি বলতে চাই জমিদার, তোমাদেরও আছে সামনে খারাপ দিন। কবর আছে অন্ধকার। শোধ করতে হবেই হবে সকল ঋণ।

আজ সকাল 11 টায় জাতিসংঘ নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলো। এখন কীভাবে ইরাকে আগুন লাগবে, তারই অপেক্ষা শুধু। হায় আমেরিকা, তুই আজ সাধু? সাধুর বেশে দেশে দেশে ধর্ষণ করিস শত পবিত্র বধূ।

মনে মনে আল্লাহকেই ডাকি। হায়াৎ বলতে সাদ্দামের আজ রাতটাই আছে বাকি।
যদি তুমি রক্ষার দিক না দেখাও, ইরাকের যে কত্তো হবে ক্ষতি!
এখন আমার মনে পড়ে আমাদের গ্রামের বাড়ির ফুলবাগানের কথা। সেখানে আমাদের অধিকাংশ ফুলই ছিলো সন্ধ্যামালতী। মালতী আজ ঝরে যাবে,
ইরাকের ক্ষতির চিন্তায় ঠিক নেই আমার মোটেও মতিগতি।
============
17 জানুয়ারি 1991, কুমিল্লা:

কবিগুরুর সুরে শান্তি খুঁজে পাই। আর কোথাও যেন এমন শান্তি নেই। তাই সারাদিনই তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ পড়ি। 1989 সালে প্রথম আমাকে এই ‘গীতাঞ্জলি’ই মুক্তির পথ দেখায়।

আজ ভোর 6টায় যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স, সৌদি আরব ও মিত্রবাহিনী (?) ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। এ যুদ্ধ ইরাক দখলের - ইরাক ভাঙ্গনের যুদ্ধ। এ পৃথিবী এখন আমার কাছে আহত প্রত্যাশার পৃথিবী। সবাই সাদ্দামের পক্ষে বললেও কিছু লোক বাংলাদেশেও তাঁর বিপক্ষে বলছে। সাদ্দামের শত্রুদের আমি মানবতার শত্রুই মনে করি।
আমি সাদ্দামকে মুসলিম বিশ্বের সূর্য মনে করি না। আমি মনে করি সাদ্দাম হোসেন আমেরিকাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর মতো এক বীর। আর সেই বীর তো একটু অস্থির হবেনই।
কিন্তু ভয় পাই আমি এটা ভেবে যে, সাদ্দাম ভালো সাঁতার জানলেও আটলান্টিক মহাসাগর পার হওয়া আমেরিকার মতো অত দক্ষ সাতারু সে নয়। তাই আমার এতো এতো ভয়। স্রোতের এ টানে কে শেষে বৈঠা ধরে রাখতে পারবে!
সারাদিনই যুদ্ধ নিয়ে আড্ডা দিয়ে সময় কাটে আমার। এমনকি পত্রিকায় যুদ্ধের খবর পড়তে পড়তে ভাত খাবার রুচিও চলে গেছে আমার।
=============
18 জানুয়ারি 1991, কুমিল্লা:

আমি মনে করি, এই পৃথিবীতে এখন আমেরিকা অর্থ্যাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো অন্ধকার এক দেশের নাম। যে শান্তির সদনে আগুনের ছোঁয়া লাগায়। আমেরিকান অর্থ্যাৎ মার্কিনী ও অন্যান্য বাহিনী আজ বাগদাদে তাদের ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালায়। আজ ইরাকের সন্ধ্যার আকাশ সন্ধ্যাতারার বদলে দখল করবে অসংখ্য বোমারু বিমান। ইরাকের মাটিকে তামা করে দেবে যৌথ বাহিনীর কামান।
===============
19 জানুয়ারি 1991, কুমিল্লা:

যুদ্ধ চলছে ভয়াবহ। যুদ্ধ না হলে যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর বাঁচবেই না, ঠিক এভাবেই যুদ্ধ করছে। পৃথিবীকে ভুলে গেলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট কুত্তার বাচ্চা বুশ যুদ্ধ খেলা ভুলবে না। কুত্তার বাচ্চা বুশ নিজেকে সবজান্তা মনে করে। অথচ সে সবজান্তা নয়, সে হলো সামরিক জান্তা।
ছিদ্দিক মামা বলেন, কুয়েত দখল বিষয় নয়, মানবতাও বিষয় নয়, বিষয় হলো তেল। মধ্যপ্রাচ্যের তেল। রক্ত দিয়ে তেল নেবে সে। রক্তের চেয়ে তেলের মূল্যই তার কাছে বেশি। কিন্তু সাদ্দাম বুশের পাছায় তেল মারে না বলেই বুশের এমন সুশীল প্রতিশোধ।
==============
20 জানুয়ারি 1991, কুমিল্লা:

পারভীন। আমার আদরের মামাতো বোন। আর মামা মামীর আদরের ‘পারু’।
পারুকে দেখলে এখনো আমি মনে মনে বলি, পারু তুমি আসো। আমার এ হৃদয়টাতে পদ্মাসনে বসো। একা করে এখনও কখনো দেখা পেলে তাঁর, আমার, খুবই খারাপ লাগে।
বিত্তবান স্বামী পেয়ে ‘পারু’ হয়তো আগের ‘পারু’ নেই। কিন্তু সত্যিই কি বদলে গেছে ‘পারু’?
না। ‘পারু’ বদলে যায়নি।
আজ ‘পারু’র মা মারা গেছেন। ‘পারু’র বাবা অহিদ মামা এমনিতেই এতোদিন একরকম সংসারত্যাগী মানুষ ছিলেন। এবারে তিনি সত্যি সত্যিই বাউল হয়ে যাবেন কিংবা যদি তা না হতে পারেন, তাহলে পুড়ে পুড়ে বোবা হয়ে যাবেনই। কারণ মামা মামীকে খুবই ভালোবাসতেন। ছোটবেলায় ‘পারু’ আমার খেলার সঙ্গী ছিল। তখন পারুর মা এই মামীই প্রায়ই আমাকে বলতো মেয়ের জামাই। তাঁর একমাত্র মেয়ের জামাই। শুনে আমি ভীষণই ঝগড়া করতাম। কান্নাও করতাম ঠিক। কিন্তু সেই কান্নাকাটি লজ্জায় পড়েই করতাম।
‘পারু’র মা এই মামীর স্নেহ কোনোদিনও ভুলে যাওয়ার নয়। এতো কড়া মামী আর একজনও ছিলেন না। অথচ তাঁর বুকের ভেতরটা ঠাসা ছিলো শুধুই আদর দিয়ে। আমাকে তিনি এক প্রশান্ত মহাসাগর স্নেহ করতেন। আমি জানি। তাঁর মনে কোনো দুঃখ থাকলে, আমার মায়ের কাছে এসে, আমার মায়ের হাতে ধরে খুবই কাঁদতে থাকতেন। এমনকি নানীর কাছেও তাঁর মনের দুঃখ খুলে বলতেন না। এক বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে ‘পারু’। তাঁদের খুবই আদরের সন্তান। একবার আমি তাঁদের সঙ্গেই ‘পারু’র মামার বাড়িতে গিয়েছিলাম। এলাহাবাদে। ছোটবেলায়।
মামী এতো আদর করে এতো বেশিই খাওয়ালেন, ভুলে যাওয়ার নয়। বললেন, আমার তো আর ছেলে হবে না। তুই- ই আমার ছেলে।
কিন্তু আমি খুবই নিষ্ঠুর ছিলাম। তার কোনো কথা কোনোদিনও রাখতে চেষ্টা করিনি আমি। এমনকি সে বার ‘পারু’র মামার বাড়িতে গিয়েই ‘পারু’র সঙ্গেই ঝগড়া লেগে তাঁর খেলার সব মার্বেল বাড়ির পূর্বদিকের পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। অহিদ মামা সেদিন বড় দুঃখ পেয়ে বলেছিলেন, এটা তুই কী করলি? আমার একমাত্র মেয়ের শখের জিনিস পুকুরে ফেলে দিলি? তখন এই মামীই মামাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, দেশে মনে হয় আর মার্বেল কিনতে পাওয়া যায় না? বাপ-মা ছেড়ে এই ছেলে এতো দূরে আমাদের সঙ্গে বেড়াতে এসেছে, আর তুমি তাঁকে ধমকাচ্ছো?...!
হায় মামী। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, বেহেস্তে আপনার আসন যেন হয়। জীবদ্দশায় আপনার মনের অনেক ইচ্ছাই পূরণ হয়নি। আল্লাহ যেন এখন আপনাকে কমপক্ষে বেহেস্থ নসীব করেন। আমিন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.