নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমাদের একটি পোষা কুকুরের নাছোড়বান্দা স্মৃতি

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০৫

হিংস্র কুকুরের জন্য আমাদের এলাকায় আমাদের বাড়িটা অনেকের কাছেই কুখ্যাত ছিল। কুকুরের ভয়ে শুধু সাধারণ মানুষই নয়, কী ভিক্ষুক মহিলা-পুরুষ, কী অতিথি, প্রায় সব্বাই অতিষ্ঠ ছিল।
আমাদের বাড়ির সব কুকুরের মধ্যে যেটা সেরা ছিল, সেটাকে আমাদের বাড়ির লোক আঞ্চলিক ভাষায় ‘বেডাকুত্তা’ বললেও আমরা এর এক নাম দিয়েছিলাম-‘সেনাপতি’।
‘সেনাপতি’ ছিল লিঙ্গে পুরুষ, রঙে লাল এবং উচ্চতায় প্রায় সোয়া তিনফুট ।
সেই সেনাপতি, তারঁ মা এবং আরও দুই-তিনটা কুকুর নিয়ে প্রায়ই সারা বাড়িতে ঘুরঘুর করতো।
আমাদের সঙ্গে কেউ শত্রুতা করলে আমরা সেনাপতিকে ইশারা করে বলতাম, যা বন্ধু যা, শালাদের এক্কেবারে সরিষার ফুল দেখিয়েই তবে বাড়িতে আয়। শালারা কয়েকদিন ধরেই বেশি বেশি ছক্কাপাঞ্জা করে...।’
তারপর ‘জ্বি-হুকুম জাহাঁপনা’ ভঙ্গিতে বাহিনীসহ তাড়া করতো সেনাপতি। আমাদের তখনকার ক্ষণিকের শত্রুরা যারা ছিলো অবশ্যই শিশু-কিশোর বয়সী, এ অবস্থায় তারা পালাতে বাধ্য হতো।

ঠেলার নাম বাবাজী। না পালিয়ে যাবে কোথায়? অবশ্য এতে আমাদের পোষা কুকুরদের বীরত্ব প্রকাশ পেলেও আমাদের সম্মানের যে মান কমতো, তা সে বয়সে একবারও চিন্তা করে দেখতাম না। মেঘনাদবধ কাব্যেও পরে পড়েছি ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’।
সেনাপতির কথা আমি লিখে শেষ করতে পারবো না। সে যদি মানুষ হতো, আমার মনে হয় তাঁর জন্য অনেক স্বর্ণপদকেরও ব্যবস্থা হতো। বিশেষ করে আমাদের বাড়ির মানুষের আস্থা সে ভীষণভাবেই অর্জন করেছিল। অবশ্য একদিন রাতে তখন আমাদের ঘর থেকে থ্রী-ব্যান্ড একটি রেডিও ও বাবার হাতের দামী একটি ঘড়িসহ আরও অনেক বস্ত্রাদি সিঁধেল চোর চুরি করেছিল। কিন্তু তাতেও বিভিন্ন কারণে চোরের বীরত্ব প্রকাশিত হয়নি। কারণ মা বলতেন, চুরির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বাড়িভেদী বিভীষণই। সুতরাং এ নিয়ে আর সেনাপতিকে দোষ দেয়া যায় কিভাবে।
সেনাপতি আমাদের কৈশোর জুড়ে ছিল বন্ধুর মতো। খেলাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায়ই আমরা অন্যবাড়ির ছেলেদের মেরে নিজেদের বাড়ির সীমানায় পা রেখে ‘আ-তু...আ-তু...’ শব্দগুলো চিৎকারের মাত্রায় উচ্চারণ করা মাত্রই সেনাপতি কোথা থেকে যেন হাজির হয়ে যেত এবং...। সেনাপতির বীরত্ব পুরোপুরি প্রকাশ পাওয়ার পর চোরের ভয়ে অতিষ্ঠ আমাদের বাড়ির মানুষ রাতের বেলা নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর সুযোগ পেয়েছিল। কারণ সেনাপতির যখন বীর হয় হয় বয়স, তখনই সে অনেক চোরের থোঁতামুখ ভোঁতা করে বাড়ির মানুষের আস্থা অর্জন করেছিল।

সেনাপতির কথা লিখে শেষ হবে না। অনায়াসেই তাঁকে নিয়ে একটি উপন্যাস লেখা যায়। সেনাপতি মানুষ হলে তাঁর জীবন নিয়ে হয়তো গবেষণাও হতে পারতো। কিন্তু যেহেতু সে প্রাণি হিসেবে একটি কুকুর, সুতরাং এ আগ্রহ আর কে দেখাবে? আমি লেখালেখি করে বলেই তার কথা আজও মনে রেখেছি।
আমাদের পুরো বাড়িতেই দিনে তো বটেই, অন্ধকার রাতেও সেনাপতির জোর টহল ছিল। শরীরের ও বুদ্ধির ক্ষমতা ছিল তাঁর অনেক, তবে পারতপক্ষে সে এসবের অপব্যবহার করতো না। কখনো কখনো শিয়ালের আস্তানাতেও হানা দিত সে। প্রতিশোধ নিতো ক্রুদ্ধ শিয়ালের প্রতি। কারণ সেনাপতির ছোটবেলায় তার অনেক সহোদর-সহোদরাকে শিয়াল ক্ষতম করেছিল। বড় হয়েও সেনাপতি সেসব ভুলতে পারেনি। অনেক প্রাকৃতিক ঝড়ের সঙ্গে শিয়ালের ছোবল থেকেও সংগ্রাম করে বাঁচতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক যে ঘটনা, প্রায়ই কোনো কোনো মানুষকে একেবারেই বিনা অপরাধেই হামলা করে বসতো সেনাপতি। মা বলতেন, রাতের বেলা যারা চুরি-ডাকাতি করে, তাঁদের অনেকেই আবার দিনে সাধুর রূপে ঘুরে বেড়ায়। হয়তো সেটা বুঝতে পেরেও সেনাপতি এমন করে। অথবা লোকটাকে হয়তো কোনো কারণেই সে পছন্দ করতে পারছে না-এমনটাও হতে পারে।
প্রায় বিনা বেতনেই নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করতো সে। বাড়িতে নতুন কোনো লোক এলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতো। হয়তো তা সে করতো তার গোয়েন্দাগিরির দক্ষতা দেখাতে কিংবা লোকচোখের অন্তরালের খবর জানতো বলেই। আমার তো মনে হয় শক্তিশালী কিছু জালিয়াতচক্রের খবরও জানতো সে। মানুষ হলে হয়তো খুলে বলতে পারতো বিশ্বস্ত কোনো লোকের কাছে।
সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি থাকার পরও তাঁর তেমন মূল্যায়ন হতো না শুধু সে মানুষ ছিল না বলেই। মানুষ হয়ে জন্ম নিলে সেনাপতি অবশ্যই বীর কোনো সৈনিক হতে পারতো। কিন্তু সেসব তেমন কারো নজর কাড়তো না। হয়তো আমি খুব ছোট ছিলাম বলেই এবং তখন আমার জগৎটা খুব সীমাবদ্ধ ছিল বলেই অথবা লেখালেখি করেছি বলেই সেনাপতিকে নিয়ে এতো ভাবনা ছিল আমার।
আমি দেখতাম আমাদের সেই সেনাপতির চোখ সবসময়ই জ্বলজ্বল করতো। যেন সে পৃথিবীর যাবতীয় অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে কী যেন এক স্বর্ণসম্পদ উদ্ধার করতে চায়। অবশ্য শুধু চাওয়াই নয়, কখনো কখনো গুরুত্বর্পূণ ভূমিকাও রাখতো সে। তাই অনেক অদ্ভুত তবে সৈনিকী নজির স্থাপন করতে বারবার দেখেছি মনে পড়ে। আমাদের বাড়ির মোশারফদের ঘর থেকে একবার এক মহিলা ভিক্ষা করতে এসে কী যেন চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল। সে সময়ে মোশারফের মা কী এক কাজে দূরে ছিলেন। কিন্তু সেনাপতির নজর এড়ায়নি সেসব। ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘেউ করে সেই চোর মহিলার পিঠে। সবাই আমরা দৌড়ে এসে তাঁকে উদ্ধার করেছিলাম। এই ঘটনার পর সেই মহিলা আর কোনোদিনই এই কুকুরের ভয়ে আমাদের বাড়িতে ভিক্ষা করতেও আসেনি। আক্কেল সেলামী আর কাকে বলে।
আমার এক মামা ছিলেন মেম্বার। তাঁর বড় ছেলের নাম ছিল হুমায়ুন কবির। এলাকার লোক তাঁকে যথেষ্ট সমীহ করতেন। মামাতো ভাই এই কবির ছিলেন ভয়ানক দুরন্ত প্রকৃতির। তাই এতো ভেবেচিন্তে হাঁটাচলা করতেন না। কিন্তু আমাদের বাড়ির কুকুরের উপদ্রবের কথা কবির ভাই জানতেন, কিন্তু এতোটা জানতেন না। তাই আমাদের বাড়ির প্রবেশ মুখে এসেই কবির ভাই এক প্রকার ধরাই খেলেন।
সেনাপতি ঘুমাচ্ছিল বাড়ির প্রবেশমুখে। তখন সময়টা ঠিক দুপুরটা পার হয়ে বিকেল আসে আসে ভাব। আমি আমাদের ঘরের জানালার পাশের একটি টেবিলে বসে কী যেন পড়ছিলাম। মা তখন ঘুমাচ্ছিলেন। হঠাৎই মামাতো ভাই কবিরের চিৎকারের শব্দ শোনা গেল। ঘুমন্ত সেনাপতির লেজে অল্পের জন্য পা পড়েনি কবির ভাইয়ের। তবে পড়তেই পারতো। আর কোথায় যাবেন কবির ভাই? চিৎকার করে দৌড়ে পালালেন।
(চলবে)।

রচনা: সেপ্টেম্বর ১৯৯৩,
পশ্চিম চানপুর,
কুমিল্লা।

[সংশোধিত]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.