নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

(গল্প) মেলিটারীভাবী:

৩০ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:১২



চেয়ারম্যানের পুত্রবধূ আজ তার শিশু কন্যাকে নিয়ে অন্যঘরে শুয়েছে। শ্বশুর আজ বাড়ি ফিরবেন না এবং এরই মধ্যে শ্বাশুড়ির সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়েছে চেয়ারম্যানের পুত্রবধূ শেফালির।
শেফালি অবশ্য এই ঘরেই থাকে, যখন তার স্বামী ইব্রাহিম বাড়িতে থাকে। ইব্রাহিম সেনাবাহিনীর চাকুরি করেন এবং এখন আছেন বান্দরবানে। ছোটবেলা থেকেই ইব্রাহিম ছিলেন দুঃসাহসি। পরে এই দুঃসাহসি পেশা বেছে নিয়েছেন নিজেই। এখন তার চেয়েও দুঃসাহসি কাজ করছেন যেন বিয়ে- সংসার করেই। কারণ মা আর বউয়ের রেষারেষিতে চাকুরি করাই কঠিন। ইব্রাহিম বউ-বাচ্চাকে সঙ্গে রাখতে পারছেন না কিংবা চাচ্ছেন না। অন্যদিকে তার মায়ের প্রায় কোনো নির্দেশই মানতে চায় না তার স্ত্রী শেফালি। তাই মাসে মাসে টাকা পাঠালেও বাড়িতে বউ- শ্বাশুড়ির যুদ্ধ ঠিক লেগেই থাকে।
শেফালি ও তার শ্বাশুড়ি পিয়ারা বেগম দিনের শুরুতে ঝগড়া শুরু করেছিল শেফালিদের গ্রাম রূপাতালির ‘হাইক্কা চোরা’র প্রসঙ্গ ধরে। হাইক্কা চোরা এখন বেঁচে না থাকলেও রূপাতলি ও তার আশপাশের গ্রামের মানুষের মুখে মুখে এখনও তার চুরির বিভিন্ন গল্প শোনা যায়। কালীগঞ্জের ইব্রাহিমের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়া প্রশ্ন করে জানতে চান বউমার বাড়ি কোথায়? ইব্রাহিমের মা জবাব দেন, রূপাতলি গ্রামে হাইক্কা চোরার বাড়ির পেছনের বাড়ি। এই হাইক্কা চোরার নামে বাড়ির পরিচয় দেওয়াতেই শেফালি ক্ষেপে যায়।

হাইক্কা চোরার ভাতিজা আবদুল মজিদ এখন কছিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এই মজিদ মাষ্টারের বাড়ির পেছনের বাড়ি বললেই শেফালিদের বাড়িকে চিনে মানুষ। অথচ শ্বাশুড়ি এই হাইক্কা চোরার নাম ধরে পরিচয় দেওয়াতেই দিনের শুরুটা নষ্ট হয়ে গেল। শেফালি বলে, আম্মা আপনি আর কতোদিন হাইক্কা চোরার নাম নিয়া আমারে অপমান করবেন? শ্বাশুড়ি পিয়ারা বেগম বলেন, বউ রাগ করো ক্যান? তোমার মজিদ মাষ্টারকে দুই-তিন গ্রামের মানুষও ভালো করে চিনে না। অথচ হাইক্কা চোরার নাম জানে বিশ গ্রামের মানুষ। শেফালি বলে, তাহলে তো মানুষে চেনার জন্য ভালো কাম ছাইড়া চুরি করনেরই দরকার। বউয়ের এমন কথায় দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ার কাছে লজ্জা পান শ্বাশুড়ি।
পরে তাকে পুকুর থেকে ধরা মাছ কাটতে বললে শেফালি সেই মাছ আর বটি এক ঘন্টা ফেলে রাখে। পিয়ারা বেগম আবারও বললে শেফালি এবার মাছ কাটে ঠিকই কিন্তু মাছের উচ্ছিষ্ট ফেলে রাখে আরও ঘন্টাখানেক সময়। এ নিয়ে বউ- শ্বাশুড়ির ঝগড়া বেড়েই চলে। কছিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে শেফালি। তখনই তার বিয়ে হয় এবং বন্ধ হয়ে লেখাপড়াও। শ্বাশুড়ি প্রায়ই বলেন, মেট্রিকও পাশ না, তারপরেও এমন। বিএ. এম এ পাশ করলে কী যে করতো মেয়ে।
শেফালি জবাব দেয়, আপনার মেট্রিক ফেল ছেলের জন্য কোন দেশ থেকে বিএ, এম এ পাশ করা পাত্রী আনতেন? এমন সব বিষয় নিয়ে বউ-শ্বাশুড়ির দূরত্ব বাড়তেই থাকে। অন্যদিকে চেয়ারম্যান তার চেয়ারম্যানগিরি ও ব্যবসা নিয়ে পড়ে থাকেন। তাছাড়া তিনি তার পুত্রবধূকে ধমক দিয়ে কোনো কথাও বলতে পারেন না। এ নিয়েও চেয়ারম্যান আর তার স্ত্রীর সঙ্গে মাঝে মধ্যে ঝগড়া হয়। তবু পুত্রবধূ শেফালিকে কটূ কথা বলা সম্ভব হয় না তার। ইউনিয়নের এত লোকের বিচার করেন, কিন্তু নিজের পুত্রবধূ বেফাঁস অনেক কথা বললেও কষে একটি ধমক দিতে পারেন না।
ইব্রাহিম ও শেফালি দম্পতির এক সন্তানের সংসার তারপরও মন্দ চলছিলো না। কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো, যখন ইব্রাহিম তার চাকুরি নিয়ে যত ব্যস্ত থাকলো, তার সিকিভাগও সংসারকে সময় দিতে পারলো না। শ্বাশুড়ির অপমানকে শেফালি তেমন গায়ে মাখলো না। কিন্তু ইব্রাহিমকে সে একেবারেই যেন পাচ্ছে না। শিশুকন্যাটি বেড়ে উঠছে একপ্রকার পিতৃস্নেহ ছাড়াই। ইব্রাহিম বাড়িতে এলেও বউয়ের জন্য কিছু বইপত্র নিয়ে আসেন। স্কুলের লেখাপড়া বন্ধ হয়েছে ঠিকই, তবু যেন বইপত্র পড়ে স্ত্রী পৃথিবীকে জানতে পারে। অথচ বাস্তবে তেমন সময়ই হয় না শেফালির চাকরবাকর বাড়িতে থাকলেও নিজের অনেক কাজ নিজেকেই করতে হয়। কাজ শেষে সারাদিনের ক্লান্তির পর সন্ধ্যা হতেই ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে। বই পড়বে আর কখন?
এলাকায় বিদ্যুৎও নেই। রাত হলেই মনে হয় গহীন রাত। এর মধ্যে একাকীত্ব। ইব্রাহিম একবার এক রাতে শেফালিকে বুঝাচ্ছিলেন হারামি রেডক্লিফ বাংলার কী ক্ষতি করেছিলেন। বুঝানো শেষ হওয়ার আগেই শেফালি ঘুমিয়ে অচেতন হয়ে পড়ে।
বাড়ির সবদিকেই ধানক্ষেত। ওখানে শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক ওঠে। শেফালির খবরও নেই। আরেকদিন এমন রাতের বেলা মেজর রফিকের গল্প বলার সময়ও শেফালি ঘুমিয়ে পড়েছে। ইব্রাহিম বুঝতে পারে তার স্ত্রীর খাটাখাটুনি খুব বেশিই হচ্ছে। ইব্রাহিমদের বাড়িতে থেকে ঐ গ্রামেরই একটি কলেজে পড়ে তার মামাতো ভাই মাহিদুল ইসলাম।
মাহিদুলের মা নেই। বাবা খুররমও অসুস্থ। বাড়িতে আছেন তার বড় ভাই ও ভাবী। ভাবী জেসমিন তার শ্বশুরের যত্নে সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকেন। এ ক্ষেত্রে ইব্রাহিমের স্ত্রী শেফালিকেই তার উগ্র মনে হয়। মিলিটারীর চাকুরি করেও ইব্রাহিমের অত তেজ নেই, যত তেজ তার শেফালি ভাবীর। প্রতিবেশি অনেক লোকই শেফালিকে তাই ‘মেলিটারী ভাবী’ বলেও ডাকে। গ্রামের লোক মিলিটারীকেই মূলত বলে মেলিটারী। সেই থেকেই এই নাম।
এক সময় পুরো এলাকাতেই শেফালির এ ‘মেলিটারী ভাবী’ নামটি ছড়িয়ে পড়ে। শুনে ইব্রাহিমও হাসেন। বলেন, মিলিটারীর চাকুরি করেও আমি মিলিটারী হতে পারলাম না। তুমি হয়ে গেলে মিলিটারী? শুনে শেফালি হাসে। বলে, ওটা আমি আমার রাগী স্বভাবের জন্য হইনি। হয়েছি মিলিটারীর বউ বলেই।
ইব্রাহিমের একমাত্র বোন পাপড়ি পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। তাকে তার পড়াশোনার জটিল অংশ বুঝিয়ে দেয় মাহিদুল। মাহিদুলের লেখাপড়া শেষ হলে যদি চাকুরিবাকুরি করে, তখন তার সঙ্গে পাপড়ির বিয়ে দেয়া যায় কী না, এ নিয়েও অনেকে হিসেবনিকেষ করে। একসময় এ কথা চেয়ারম্যানের কানেও যায়। চেয়ারম্যান বলেন, সময় হোক, ভেবে দেখা যাবে। ছেলেটা আগে দাঁড়াক।
কিন্তু এই ছেলে জীবনে দাঁড়াবে কি? সে তো সেনাবাহিনীর পুণ্যরক্তের সঙ্গেই মনে মনে বেঈমানী করে বসে আছে। তার বড় ভাই সমতুল্য সৈনিক ইব্রাহিমের স্ত্রীর দিকেই চোখ পড়েছে তার। এ কথা স্বয়ং মেলিটারী ভাবী শেফালিও এখনো বুঝতে পারেনি। এরই মধ্যে ইব্রাহিম স্ত্রীর কাছে ব্যস্ততায় চিঠিও লিখছে কম।
ইব্রাহিমের শিশুকন্যা নাফিজাকে সঙ্গ দেয়ার নামে ‘মেলিটারী ভাবী’র খুব কাছে চলে যায় মাহিদুল। কখনো তাকে নিজের পয়সায় খেলনা কিনেও দেয়। এটাকে কেউ সন্দেহের চোখেও দেখে না।
কিন্তু ইব্রাহিমের ছোটবোন পাপড়ি মাহিদুলকে একটি প্রেমের চিঠি লিখে বসলে মাহিদুলকে অপমানের স্বরে বলে, প্রেমের বয়স হয়েছে তোমার? আগে মন দিয়ে লেখাপড়া করো। মাথা থেকে ভূত তাড়াও। তারপর যা হওয়ার হবে। লজ্জায় সে খুব কাঁদে। নিজেকেই তার খুব অপরাধী মনে হয়।
শিশু নাফিজার প্রতি মাহিদুলের দায়িত্ববোধ দেখে তার প্রতি সবার কৃতজ্ঞতা বাড়ে। একদিন রাতে নাফিজার উঠলো ভীষণ জ্বর। সঙ্গে সঙ্গেই সাইকেল আর টর্চলাইট নিয়ে গঞ্জের দিকে ছুটে গেল মাহিদুল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওষুধ নিয়ে ফিরলো। সেই কৃতজ্ঞতায় ‘মেলিটারী ভাবী’ আজ রাতের জন্য মাহিদুল ভাইকে তার টু-ব্যান্ড রেডিওটা বাজাতে দিয়েছে। এই রেডিও বাজাতে পাওয়া মাহিদুলের কাছে পূর্ণিমার চাঁদের থেকেও বেশি। সারা বাড়িতে দুইটি রেডিও আছে। একটি চেয়ারম্যানের থ্রি-ব্যান্ড রেডিও, অন্যটি টু-ব্যান্ড ‘মেলিটারী ভাবী’র। এই দুই জিনিসে যেন হাত দেওয়ার অধিকার কারোরই নেই। এক বাড়িতে দুই দুইটি রেডিও থাকা কম গর্বের কথা নয়।
তাছাড়া গঞ্জের দোকানে চেয়ারম্যানের একটি ১৪ ইঞ্চি সাদাকালো টেলিভিশনও রয়েছে। কোনো ফুটবল ফাইনাল খেলার দিন কিংবা কোনো সিনেমা দেখানো হয় যেদিন, শত শত লোক জড় হয় দেখতে।
মাহিদুলের সুটকেসে ইদানিং তার মায়ের ছবির সঙ্গে আরেকটি ছবি যুক্ত হয়েছে, সেটা ‘মেলিটারী ভাবী’র ছবি। কিভাবে এ ছবি সংগ্রহ করেছে, কেউ জানে না। এমন কি তার সংগ্রহে যে শেফালির ছবি রয়েছে এটাও কেউ জানে না যখন সে একা থাকে, তখন সে এ ফর্সা নারীর সুন্দরী-স্বাস্থ্যবতী ছবিটা বের করে মনোযোগ দিয়ে দেখে। এ ছবি দেখলেই তার ঘুম আসেনা, দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে দেয় বিছানায়। অথচ সে আগে অনেক আদর্শবান ছিল।
এস এস সি পাশের যোগ্যতায় কোথাও চাকুরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় দেখলে দরখাস্ত করতো। এখন তার ‘মেলিটারী ভাবী’র চুড়ির ঝনঝন শব্দে আগুন ধরে যায় মগজে। ইদানিং আবার বিকেল বেলায় ‘মেলিটারী ভাবী’ সারা শরীরে সুগন্ধি লাগিয়ে ঘুরে। এমন গন্ধে মাহিদুল কামার্ত হয়ে পড়ে। সারাবাড়িতে জারুল গাছগুলো তাকে যেন তখন কবিতা লেখার আহবান জানায়।
কয়েকমাস হয়ে গেল ইব্রাহিম বাড়িতে আসছেন না। শুধু চিঠিপত্রই লিখছেন শেফালিকে। এদিকে স্বামীর অপেক্ষা করে করে শেফালি অনেকদিন নিজ গ্রাম রূপাতলিতেও যায়নি। নিজের জীবনটাকে তার এখন জীবন্ত এক আগ্নেয়গিরিই মনে হয়। কখনো কখনো মনে হয়। অনেকগুলো ক্রিমির ওষুধ একসঙ্গে খেয়ে মরে যায়। কিন্তু পারে না নিজ সন্তান নাফিজা এর এখন তার জীবনে যুক্ত হওয়া মাহিদুলের কারণে।
এই মাহিদুল বাজার থেকে এসে ময়দা, ডালডা, লবণ, দুধ, চিনির ব্যাগ রেখে তার শেফালি ভাবীর একটি চুমো না খেয়ে যাবে না। সামনে কেউ হাজির থাকলে পাওনা চুমোটা সে পরে কোনো এক সময়ে হলেও আদায় করে নেবে। এসব কথা শেফালি তার স্কুল জীবনের হিন্দু বান্ধবী সুষমার সঙ্গে ভাগাভাগি করলে সুষমা বলেছিল, শেফালি তুই পাপে জড়িয়ে তোর জীবনটা নষ্ট করিস না। খুবই কষ্ট পাবি। শেফালি মানেনি সুষমার সেই কথা। বরং লুকিয়ে লুকিয়ে প্রায়ই মাহিদুলের হাতে তুলে দেয় ঘিয়ের ভাজা মচমচে চিড়ার লাড্ডু, বিস্কুট ইত্যাদি।
এরই মধ্যে ইব্রাহিম বদলি হয়ে যান কক্সবাজার এরিয়ায়। বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে একদিন একটি চিঠি লিখেন ইব্রাহিম। এই চিঠির পর শেফালিকে লেখা কিছু কিছু চিঠি মেরে দেয় মাহিদুল। এতে স্বামী- স্ত্রীর দূরত্ব আরও বাড়ে। জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে বিডিআর-নৌবাহিনী- সেনাবাহিনীর-বিমানবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে চিঠি লিখেন ইব্রাহিম। সেই চিঠিতে রয়েছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে কুতুবদিয়া পর্যন্ত ভ্রমণের অনেক বৃত্তান্ত। কিন্তু এসব চিঠি হাতে পৌঁছে না শেফালির। মেরে দেয় মাহিদুল। আর ইব্রাহিমের বাবা চেয়ারম্যান ব্যস্ত তার রাজনীতি এবং ব্যবসা নিয়ে। গতকালেও তার সম্মানে একটি সংবর্ধনা সভা ছিল। এসব খবর তিনি কখন রাখবেন? তাছাড়া ইদানিং ডাক পিয়নের সঙ্গেও মাহিদুলের গলায় গলায় ভাব।
শেফালিকে একা পেলে আর ভাবী ডাকে না মাহিদুল। বলে, প্রিন্সেস শেফালি। নিজেকে পরিচয় দেয় প্রিন্স মাহিদুল। বারণ করে না শেফালি। অথচ এই শেফালি আবার নিয়মমাফিক প্রতিদিনই ফজর-জোহর-আসর-মাগরিব এবং এশার নামাজও পড়ে। আবার সে-ই মাহিদুলকে এমন প্রশ্রয় দিতে পারে, ভাবাও যায় না।

বিষয়টা প্রথমে কিছুটা টের পায় চেয়ারম্যান বাড়িতে বছর বছরব্যাপী থাকা কাজের লোক আবদুল মালেক। সে এটা শেফালির শ্বাশুড়ি পিয়ারা বেগমকে বললে পিয়ারা মালেকের ডান গালে একটি কষে থাপ্পড় দেয়। থাপ্পড় খেয়ে নিরবে কেঁদেছে আবদুল মালেক। কেঁদেছে এই জন্য যে, থাপ্পড় খাওয়ার জন্য তো নয়ই, বরং গত তিন বছর ধরে এ বাড়িতে অনেক অপরাধ করেও কখনো সে কারো হাতে মার খায়নি। বড়জোর বকা খেয়েছে। বরং আজ দেখা সত্য বলতে গিয়েই মার খেলো পিয়ারার, যাকে সে মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করে।

পরদিন পিয়ারা বেগমকে আবদুল মালেক বলেছে তিস্তায় পাঁচবার হামাদের বাড়ি নিছে। না হয় হামার মতো চ্যাংরা এহানে কাজ করি? তখন চোখ দুটি তার ভয়ানকই লাল।
তার কথার কোনো জবাব দেন না পিয়ারা বেগম। রংপুরের গঙ্গাচড়ার তিস্তাপাড়েই আবদুল মালেকের বাড়ি। বিষয়টাকে উড়িয়ে ফেলে দেন না পিয়ারা বেগম। রাতে স্বামীর কানে কথাটা দিতে গিয়ে তিনিও এক থাপ্পড় খান স্বামীর। স্বামী তাকে এভাবে কখনো মেরেছে, তার মনে পড়ে না।
স্বামী চেয়ারম্যান বলে তার অনেক দায়িত্ব মাথায়। এই এখন যেমন এলাকার কালীমন্দিরে কে বা কারা গত রাতে প্রতিমা ভাঙচুর করেছে, এ নিয়ে বসতে হবে। কথা বলতে হবে আবার পুলিশের সঙ্গেও। এ নিয়ে বসতে হবে। কথা বলতে হবে আবার পুলিশের সঙ্গেও। এ অবস্থায় এসব বাজে নালিশ ভালো লাগে! পুলিশ প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় এখনো কাউকে ধরতে পারেনি। তাই আছে উপজেলা প্রশাসনের চাপ। মন্দিরের পুরোহিত নিরঞ্জন চক্রবর্তী এ নিয়ে চেয়ারম্যান বাড়িতে দুইবার এসেছেন।
চেয়ারম্যান প্রথম যখন জানতে চান নিরঞ্জনের কাছে কয়টি প্রতিমা দুর্বত্তরা ভেঙেছে? নিরঞ্জন বলেন, একটি কালী প্রতিমা ও একটি সরস্বতী প্রতিমা ভাঙচুর করেছে ওরা। চেয়ারম্যান পুরোহিত নিরঞ্জনের কাছে জানতে চান কারা এবং কেন ভেঙেছে প্রতিমা? কী মনে হয় আপনার? নিরঞ্জন বলেছেন, আমি এর কোনো কারণও জানি না। শত্রুদেরও দেখিনি। তবু পূজা উদযাপন কমিটির বণিকবাবু ৪/৫ জনের নাম আমার কাছে দিয়েছেন।
আগে কখনো সিনেমা দেখতো না মাহিদুল। ইদানিং দেখে। দেখে আবার সেই গল্প শেফালি ভাবীর কাছে বলে। শেফালি ভাবী ওরফে ‘মেলিটারী ভাবী’ ও সেই সিনেমার গল্প উপভোগ করে। শেফালি ভাবী আরও উপভোগ করে সাপ-মইয়ের লুডু খেলা। আগে রাতে শ্বাশুড়ির সঙ্গেই খেলতো শেফালি। এখন সেখানে নতুন করে আগ্রহ প্রকাশ করে যুক্ত হয় মাহিদুল। পিয়ারা বেগম আতঙ্ক অনুভব করেন।
নিজের সন্তানের লেখাপড়ায় মন না বসাতেই সেনাবাহিনীর সৈনিকের চাকুরিতে নাম লেখায়। এ চাকুরিতে পিয়ারা বেগমের মন ছিলো না। মারা আর মরার এ পেশা কোনোদিনও ভালো লাগেনি তার। এখন পুত্রবধূর ভাব বুঝতে পারছেন না তিনি। নিরবে চোখের জল ফেলেন। আরও চোখের জল ফেলেন বিনা অপরাধে কাজের লোক আবদুল মালেককে থাপ্পড় মেরেছেন বলে।
এদিকে আবার দুইদিন পর কালীমন্দিরের পুরোহিত নিরঞ্জনের বাবা স্বর্গীয় নিত্যরঞ্জন চক্রবর্তীর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হবে। ওখানে চেয়ারম্যানের নিমন্ত্রণ রয়েছে। তার আগেই প্রতিমা ভাঙচুরের বিষয়ে কিছু একটা করা না গেলে চেয়ারম্যানেরও মুখ বাঁচবে না। স্বর্গীয় নিত্যরঞ্জন চক্রবর্তী বড় ভালো লোক ছিলেন। চেয়ারম্যানের নির্বাচনেও তার পক্ষে কাজ করেছিলেন। তার বিদেহী আত্মার সদগতি কামনায় দুর্বৃত্তদের ধরতে তাই চেয়ারম্যান থানার ওসির সঙ্গে কয়েকবার কথা বলেছেন, যদিও এখনো পর্যন্ত কাউকে সনাক্ত করা যায়নি।
এদিকে শেফালি আর মাহিদুলের মাখামাখি এবার পাপড়ির চোখেও পড়লো। পাপড়ি তবু কাউকে কিছু বললো না, যদি কেউ এর পেছনে আবার মাহিদুলের প্রতি পাপড়ির কোনো দুর্বলতা খুঁজে পায়, তাই।
এদিকে এসব কথা ধীরে ধীরে ‘মেলিটারী ভাবী’ শেফালির কানেও আসে। নিজ গ্রাম রূপাতলি থেকে তার এক কাকাতো বোন কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে তার কাছে। রাতে ঘুমের আগে সেই কাকাতো বোন দিলারা শেফালিকে বললো, তোমার আর মাহিদুলের কথা কিন্তু যেভাবেই হোক আমাদের রূপাতলি পর্যন্ত চলে গেছে। ‘মেলিটারী ভাবী’ শেফালি এ কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর দিলারাকে বলে, আমরা যা খাই তার কিছু অংশ শরীরে রেখে অদরকারী অংশ মলমূত্র করে বের করে দেই। কথার বেলাও এমনই। অদরকারী কথাগুলো কানে না নিলেই হলো।
দিলারা বললো, কিন্তু লোকে তো তোমাকে কলঙ্ক দিচ্ছে শেফালি আপা। তাছাড়া এমন ধনী-গুণি পরিবারে তোমার কিসের অভাব? শেফালি বললো, দিলারা তুইও গ্রামের মেয়ে। দেখেছিস নিশ্চয়ই দোয়েল কখনো গাছের ডালে বাসা গড়ে না। আরও ভালো ডাল পেলেও দোয়েল বাসা গড়ে গাছের ফোঁকরে। আমি ও তেমনি দোয়েল স্বভাবের মেয়ে। বাকিটা বুঝিয়ে বলতে পারবো না।
দিলারা ভাবতেও পারে না এই শেফালিই একদা তাকে রাতের বেলা পড়া দেখিয়ে দিতো। তখন শেফালির কন্ঠে জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতাটি কতো চমৎকার শোনাতো। দিলারার এখনো যেন কানে লেগে আছে। ‘হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে; ... দেখিবে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে।’ হায়! সেই শেফালি যেন আজ সত্যিই হারিয়ে গেছে। শেফালি আজ সত্যি সত্যিই যুদ্ধংদেহী ‘মেলিটারী ভাবী’।
যে শেফালি অর্জুন গাছের তলায় বসে আড্ডা দিতো, বর্ষায় গাছে উঠে পেড়ে আনতো কদম ফুল কিংবা অশ্বত্থ বটপাতা দিয়ে বানাতো একধরনের বাঁশি, তার ভিতরটা যেন আজ সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল ক্লিংকার, ফ্লাইক্র্যাশ, জিপসাম ও স্ল্যাগে পরিপূর্ণ।
এদিকে অনেকদিন অসুস্থ থেকে হঠাৎই মারা যান মাহিদুলের বাবা খুররম। এতে শোকের ছায়া সবাইকে ছুঁয়ে গেলেও শেফালিকে যেন একটু বেশিই ছুঁয়েছে। সে তার শ্বাশুড়িকে আবদার করে বসে এ উপলক্ষ্যে মাহিদুলের বাড়িতে যাওয়ার। কিন্তু শ্বাশুড়ি পিয়ারা বেগম অনুমতি দেননি। বলেছেন, নাফিজার কাশিটা বেড়েছে। এখন যাওয়ার দরকার নেই।
ওদিকে মাহিদুলদের বাড়ি থেকে এসেই তোমার শ্বশুর আবার ঢাকায় যাবেন। এ বছর হজ্জ করার নিয়ত আছে তার। মক্কা-মদিনায় যাওয়ার জন্য আমারও প্রাণটা জ্বলে। কিন্তু যাওয়ার উপায় নাই। নিজের পোলা নিলো আর্মির চাকরি। দেশের জন্য সময় দিয়ে ঘরের জন্য সময় নাই। আবার বলে কী না, মা আমরা হলাম দেশের অতন্দ্র প্রহরী।
ওদিকে দুর্গাবাড়িতে কয়েকদিন পরই নামযজ্ঞ উৎসব। তোমার শ্বশুর আবার ওখানে ব্যস্ত হবেন। তার পোলার মতো তারও ঘর দেখার সময় নাই। বিপীন বাবু আগেই নিমন্ত্রণ করেছেন। আবার আজ রাতেই গোরস্থানের জমি নিয়েও বসতে হবে সালিসে তাকে দত্তপাড়ার পশ্চিমবাড়িতে। আমার বালের চেয়ারম্যানগিরি। কার বালে যে তারে চেয়ারম্যান হইতে কইছিলো। দুনিয়ার যেন আর কোনো নেশা নাই।
শ্বাশুড়ির মুখে এত কথা শুনে একেবারেই চুপ হয়ে যায় ‘মেলিটারী ভাবী’ শেফালি। ঘরে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। তার কাছে মনে হয়, তার জ্বলজ্বলে নাকফুলটি যেন তাকে বলছে, আমি একজন জ্যোতিষরাজ। আমি বলে দিলাম, তুই আগামীতে অন্ধকারেই নিপতিত হবি। আর তখন হঠাৎই মন কেঁপে ওঠে শেফালির। তার কানে বাজে স্বামী ইব্রাহিমের কিছু কথা। ইব্রাহিম বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর চাকুরি অন্য সব চাকুরি থেকেই ব্যতিক্রম। সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই এ চাকুরি পেতে হয়। বয়স হতে হবে নির্ধারিত। উচ্চতা-ওজন-বুকের মাপ-শিক্ষাগত যোগ্যতা-স্বাস্থ্য পরীক্ষা-লিখিত পরীক্ষা এবং আরও কতোকিছু! আর নিয়মভঙ্গ করলেও মারাত্মক সাজা চাকুরি থেকে বরখাস্ত। তেমনিভাবে একজন নারীর জন্যও সংসার প্রতি মুহূর্তেই পরীক্ষাক্ষেত্র। নিয়মভঙ্গ করলেই...।
কেঁপে ওঠে ‘মেলিটারী ভাবী’ শেফালির মন ও শরীর। তবে কি সে আর মাহিদুলকে কোনো প্রশ্রয়ই দেবে না?
ঘর থেকে বের হয়ে আবার বাইরে যায় শেফালি। গিয়ে ঠিক সোনাইল গাছটির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। যেখানে এক সন্ধ্যায় প্রথম... মাহিদুলকে তাঁর আপন কোমল শরীরে হাত দিতে দিয়েছিল শেফালি। তখন গ্রীষ্মকাল। হলুদ রঙের ঝুলন্ত ফুলের লম্বা লম্বা ছড়ায় সেদিন গাছটি কেমন সুগন্ধে ভরে উঠেছিল।

মন্তব্য ১১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১১) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:১৬

আব্দুল্লাহ্ আল মামুন বলেছেন: ভালো লিখেছেন

৩০ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:৩১

জসীম অসীম বলেছেন: গল্পটি লেখা হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। পত্রিকায় প্রকাশের সময় তারিখ ছিল। তারিখটি এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না। আজকাল আমার লেখার ধরন পাল্টে গেছে। ওই সময়ের লেখায় এক ধরনের সরলতাও ছিল। কল্যাণ কামনা করছি নিরন্তর প্রিয় বন্ধু।

২| ৩০ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:১৭

রাজীব নুর বলেছেন: এক টানা লেখা পড়তে বিরক্ত লাগে।
আপনি বেশ কয়েকটা প্যারা -প্যারা করে দেন। দেখতে ভালো লাগবে। পড়েও আরাম পাওয়া যাবে।
আর ছবি দেখার নিচে না দিয়ে লেখার শুরুতে দেন।

৩০ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:৪৪

জসীম অসীম বলেছেন: রাজীব ভাই, লেখাটি অনেক আগের। হাত লাগালে লেখাই যাবে পাল্টে। আগের ভাবসম্পদ বা বিষয়ও বদলে যেতে পারে। একটানা লেখার যুগ অনেক যুগ আগেই শেষ হয়ে গেছে। তবু আমি লিখেছি। বিষয়টি সত্যিই বিরক্তিকর। স্মরণে রাখবো। অনেক সুন্দর পরামর্শের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। এখন থেকে প্যারা ভাগ করে করেই উপস্থাপন করবো। আর ছবি কিভাবে লেখার শুরুতে দেয়া যায়, তা হয়তো বুঝতেই পারছি না। কৌশলটি রপ্ত করতে চেষ্টা করবো। অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা। অব্যাহত শুভ কামনা।

৩| ৩০ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:৩৮

আব্দুল্লাহ্ আল মামুন বলেছেন: Click This Link

৪| ৩০ শে জুলাই, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০০

বাকপ্রবাস বলেছেন: আমি মুগ্ধ গল্পটা পড়‌ে খুবই ভাল

৩১ শে জুলাই, ২০১৮ ভোর ৪:২৪

জসীম অসীম বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। মুগ্ধ হওয়ার মতো লেখা আসলে আমি লিখতে পারি না। লেখালেখি তো খুব সহজসাধ্য ঘটনাও নয়। আর আপনি সেটা অবশ্যই ভালো জানেন। মতামত প্রদানের জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা।

৫| ৩০ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ১০:৪২

ঢাকার লোক বলেছেন: ভালো লিখেছেন !

৩১ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:০২

জসীম অসীম বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। ব্যস্ততার এ সময়ে দীর্ঘ লেখা পড়া নিশ্চিতই ক্লান্তিকর। তবু যে পড়েছেন এবং মতামত দিয়েছেন, তার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

৬| ৩১ শে জুলাই, ২০১৮ সকাল ১০:২০

রক বেনন বলেছেন: পুরোটাই পড়লাম। ভালো লিখেছেন তবে একটু ভেঙ্গে ভেঙ্গে লিখলে পড়তে আরো ভালো লাগতো।

৩১ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৪:৪২

জসীম অসীম বলেছেন: লেখাটি প্রায় ২০ বছর আগের। বদলানোরও সুযোগ নেই। অবশ্য বদলানোর ইচ্ছেও নেই। কিন্তু এই লেখার স্টাইল এই সময়-সমর্থিত নয়। তবে একটু ভেঙ্গে ভেঙ্গে লিখলে পড়তে আরো ভালো লাগতো। ভেঙ্গে ভেঙ্গে লেখাটাই আধুনিক রীতি, যেমনটি আপনি বলেছেন। আগামীতে বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় রাখবো। অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.