নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চলো আমরা পাখিদের কাছ থেকে ইউক্লিডের নতুন পাঠ নেই জীবনানন্দের পাঠ নেই নিউটনের আপেল গাছটি থেকে।

জসীম অসীম

লেখা হলো কেতকীফুল। ভালোবাসি তাই।

জসীম অসীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

লেখক ও কথক শান্তনু কায়সার

০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:১৭


শান্তনু কায়সারের (১৯৫০-২০১৭) সঙ্গে আমার প্রথম সরাসরি পরিচয় হয় ১৯৯৬ সালে। কুমিল্লায়। একটি অনুষ্ঠানে। আমি তখন কুমিল্লারই সংবাদপত্র 'সাপ্তাহিক আমোদ' এ কর্মরত। ওই পত্রিকাটি তখনো অফসেট ছাপায় আসেনি। হ্যান্ড কম্পোজে টাইপে মুদ্রিত কুমিল্লার নিয়মিত সাপ্তাহিক একটি সংবাদপত্র।
প্রথম পরিচয়ের দিনই শান্তনু কায়সারকে আমি 'ট্রটস্কি' বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। আজ ভাবতেও অবাক লাগে এই ভেবে যে, ১৯৯২ সালেই ঢাকায় আমি 'রাশিয়ান কমিউনিস্ট বিপ্লব' নিয়ে লেখাপড়ায় ভীষণতর মগ্ন হয়েছিলাম। কিন্তু মেক্সিকোতে পালিয়ে গিয়েও কেন ট্রটস্কিকে মাথায় হাতুড়ির আঘাত নিয়ে মরতে হয়েছিলো, শান্তনু কায়সার সেদিন তার চমৎকার ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। আর তার সঙ্গে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছিলো ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের শেষদিকে। তখন তিনি কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বাংলাদেশের কুখ্যাত রাজাকার কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়াসহ সারাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জামাত-শিবির যেভাবে অগ্নিসংযোগ করেছে, তা দেখে, তা থেকেও তোমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
শান্তনু কায়সার শুধুমাত্র একজন লেখকই ছিলেন না, ছিলেন একজন ধ্রুপদী কথকও। দীর্ঘ সময়ব্যাপী অনেক অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা বলতে পারতেন। এই সময়ের 'পুরাণ' তিনি শত ভঙ্গিমায় ব্যাখ্যা করে আমাদের শুনিয়েছেন। আমি তার লেখন বা লেখালেখির চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভাষণ বা কথনেরই অধিকমাত্রায় রসভোগী একজন মানুষ।
আমরা জানি যে, অদ্বৈত মল্লবর্মণের 'তিতাস একটি নদীর নাম' একটি মহৎ রচনা। কিন্তু এর স্বপক্ষে যিনি একটি আন্দোলন সৃষ্টি করেছিলেন, তিনি শান্তনু কায়সার।
চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটক, যিনি অদ্বৈত মল্লবর্মণের 'তিতাস একটি নদীর নাম' নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন, তিনি অনেক কথাই বলেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি' উপন্যাস নিয়েও এবং এই দুই ঔপন্যাসিকের এই দুই উপন্যাস নিয়েও পার্থক্যের কথা বলেছেন। এমন অবস্থার মধ্যে বিভিন্ন সময়ে শান্তনু কায়সারকেও পড়তে হয়েছিলো। 'অদ্বৈত মল্লবর্মণ' আর 'তিতাস একটি নদীর নাম' নিয়ে এক জীবনে শান্তনু কায়সারকেও অনেক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিলো। অবশ্য এ ক্ষেত্রে তিনিও প্রায়ই ঋত্বিক ঘটকের সমান্তরাল জবাবই দিয়েছেন যে, অদ্বৈত নিজেই 'মালো' বা জেলে পাড়ার সন্তান ... ইত্যাদি।
আমি নিজেও শান্তনু কায়সারকে এই 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসের 'অতিবর্ণন' নিয়ে কথা বললে তিনি বলেন, এটা না অতিবর্ণন, না অতিরঞ্জন, না কোনো মনোরঞ্জন। বরং অদ্বৈতের এই বর্ণনা প্রবণতার যোগসূত্র বুঝতে হবে। 'যাও তিলক, তামুক খাও গিয়া। দাঁড়টা দেও আমার হাতে।' এমন ভাষার একটি সুদৃঢ় ইতিবৃত্ত রয়েছে। তার ভাষা প্রয়োগের কুশলতাও বুঝতে হবে। চরিত্রের সংলাপেও অদ্বৈত দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
আমি শান্তুনু কায়সারকে বিভিন্ন সময়ে বারবার বলেছিলাম অদ্বৈতের মতো প্রগতিশীল লোক 'তিতাস একটি নদীর নাম' এ ধর্মের অনুসঙ্গকে এতো বেশি, এতো ব্যাপকমাত্রায় উপস্থাপনের কারণ কী! তিনি বলেছিলেন, এ না হলে মালো পাড়ার বা তিতাস জনপদের মানস চিত্রায়নও অসম্ভব ছিলো। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বাংলা সাহিত্যের চর্যাপদ, মনসামঙ্গল, শ্র্রীকৃষ্ণকীর্তনসহ আরও সাহিত্যের বাকপ্রতিমা বা চিত্রকল্প টেনে উদাহরণ দেন।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাস জনপদের সার্থক রূপকার। যা যেমন, তেমনটাই তিনি তুলে ধরেছেন। মতাদর্শ কোথাও বলপূর্বক আরোপ করেননি।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের 'তিতাস একটি নদীর নাম' এর চেয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি' বারবারই আমার কাছে আরও বেশি শক্তিশালী উপন্যাস মনে হয়েছে। অনেক কারণেই। কুবের যে 'গরিবের মধ্যে গরিব, ছোটলোকের মধ্যে আরো বেশি ছোটলোক' উপন্যাস শেষ হয়ে গেলেও আমি এটা শেষ পর্যন্ত তিলে তিলে উপলব্ধি করেছি। 'ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে। এখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।' এসব ভাষা একদা আমার মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিলো। শান্তনু কায়সার এ প্রসঙ্গে একবার আমাকে বলেন, তুমি এই দুই উপন্যাসের পাঠের ক্ষেত্রেও দুই রকম মনোযোগী হয়ে থাকতে পারো। তাছাড়া তিতাসের ভাষাকেও তোমাকে ধারণায় রাখতে হবে। আমি অবশ্য এটা তার কাছে স্বীকার করেছিলাম যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি' পড়ার সময় আমি হয়তো বাংলার নদীমাতৃক জীবনের অধিক 'কুবের ও কপিলা'র নিষিদ্ধ সম্পর্কের মধ্যেই বেশি মনোযোগ নিবদ্ধ করেছিলাম। কারণ ব্যক্তি জীবনে আমি নিজেও ফ্রয়েডীয়-মার্ক্সসীয় মতাদর্শে অধিক মাত্রায় বিজড়িত। অথচ ঋত্বিক কুমার ঘটক এক সাক্ষাৎকারে অদ্বৈতকে এমনই এক মহান শিল্পী হিসেবে অভিহিত করেছেন যে, আমি সত্যিই অবাক হয়েছি এই ভেবে যে, 'তিতাস একটি নদীর নাম' আজ অবধি হয়তো আমার সিরিয়াস পাঠই হয়নি। অথবা তা পাঠের জন্য অবশ্যই আমাকে সহযোগী পাঠ নিতে হবে।
প্রাবন্ধিক-গবেষক শান্তনু কায়সার কবিতা দিয়েই সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিলেন। আমি তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রাবন্ধিক গদ্যের বা গবেষণার বিচ্ছিন্ন ও অনিয়মিত একজন পাঠক। পাঠাগারে তার রচিত 'বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মশাররফ হোসেন অথবা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, এমনকি অদ্বৈত মল্লবর্মণ'ও বিচ্ছিন্নভাবে ও অনিয়মিতভাবে পড়েছি আমি। তার 'জীবনানন্দ দাশ গবেষণা' পড়েছি 'শৈলী'সহ বিভিন্ন সংবাদপত্রের সাহিত্য সাময়িকীতে। তবে চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় এর প্রথম চলচ্চিত্র 'পথের পাঁচালী' যেমন তার এতো ছবি, এতো লেখা কিংবা এতো আঁকা থাকার পরও তার ব্যক্তি জীবনের সঙ্গেই জড়িয়ে গিয়েছিলো, তেমনিভাবে অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনী রচনার সঙ্গে সঙ্গেই শান্তনু কায়সারও ওই 'অদ্বৈত মল্লবর্মণ' এবং 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসের সঙ্গে নিজেও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। শেষ বয়সে সত্যজিৎ রায়কে 'পথের পাঁচালী' দিয়ে মূল্যায়ন করতে গেলে সত্যজিৎ কিছুটা রাগ করে বলতেন, এটা আমার প্রথম ছবি। এতে কিছু কারিগরী ত্রুটিও রয়েছে। তাছাড়া এর চেয়েও অনেক ভালো ছবি আমি তৈরি করেছি ... ইত্যাদি। কিন্তু শান্তনু কায়সার অদ্বৈতকেন্দ্রিক চর্চা নিয়ে তার পুরো একটি জীবনই পার করেছেন। অদ্বৈতের কাজ নিয়ে তার পরিচয় কেউ প্রদান করলে তিনি কখনো রাগ-অভিমান কিছুই করতেন না। বরং গৌরববোধই করতেন। গত শতকের নব্বইয়ের প্রথমদিকে ঢাকায় প্রায় তিন বছরব্যাপী আমার নাট্যচর্চার কারণে শান্তনু কায়সারের নাম আমি প্রথম শুনেছিলাম নাট্যব্যক্তিত্ব হিসেবেই।
বাংলা একাডেমীর 'ভাষাশহীদ গ্রন্থমালা' সিরিজে তিনি লিখেছিলেন 'কাব্যনাটক'। আমার সহপাঠি বন্ধু আবিদ হোসেনের বাসায় প্রথম ওই গ্রন্থের সন্ধান পাই। আবিদের কাছে ওই গ্রন্থটি চাইলে আবিদ বলে এই গ্রন্থটি আমাদের 'বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে'র পাঠ্য পড়ায় কাজে দেবে এবং দামও অল্প। তাছাড়া এ গ্রন্থটি বারবার পাঠযোগ্য। তাই তুমি এটি কিনেই পড়ো। পাঠ করলাম 'কাব্যনাটক'। ওই হলো আমার প্রথম শান্তনু কায়সার পাঠ। কুমিল্লায় তিনি অধ্যাপনাকালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেক জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা করেন। দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর আলোচনায় অথবা 'চার্বাক' এর কিছু নিয়মিত অনুষ্ঠানে তিনি অসংখ্য কথার মুক্তো ছড়িয়েছেন। তখন আমি একজন সংবাদকর্মী ছিলাম বলে প্রায়ই তিনি কিভাবে প্রশাসনিক ষড়যন্ত্রের শিকার হতেন, সুযোগ পেলে আমার সঙ্গে আলাদাভাবে সেই গল্প করতেন। আবার তার ওই নির্দেশও থাকতো যে, এ নিয়ে যেন কোথাও কোনো লেখালেখি না করি অথবা সংবাদ প্রকাশ না করি। একজন সাহিত্যিকের চাকুরিক্ষেত্রও যে নির্বিঘœ নয়, তিনি আমাকে ওই ধারণাই দিতেন। আমি 'কুমিল্লার কাগজ' পত্রিকায় কাজ করাকালীন সময়ে তিনি কখনো ওই পত্রিকার অফিসে আসতেন। কখনো তার অফিসে যেতাম অথবা তার সরকারি বাসভবনে। তিনি ছিলেন তখন কুমিল্লা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ।
প্রাবন্ধিক-গবেষক শান্তনু কায়সার আমাকে বিভিন্ন সময়ে বারবার বলেছেন, কাজ করলে 'সাউন্ড' হবেই। এটা তিনি শিল্প-সাহিত্যের প্রসঙ্গেই বলতেন। বাংলাদেশের অন্যতম প্রথিতযশা এই সাহিত্য সমালোচক শান্তনু কায়সার বাংলাদেশের প্রগতিশীল সাহিত্য চর্চা ও সাহিত্য আন্দোলনে ছিলেন এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তিনি ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন। পেশাগত জীবনে দীর্ঘদিন অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে মহৎ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, অদ্বৈত মল্লবর্মণ পুরষ্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কারসহ বিভিন্ন স্বীকৃতি ও সম্মাননায়ও ভূষিত হয়েছিলেন। তার এসব পুরষ্কারপ্রাপ্তিতে কোনো কোনো সংবর্ধনা সভায় কখনো কখনো আমি সংবাদ সংগ্রহ, অনুষ্ঠানের ছবি তোলা অথবা ওসব অনুষ্ঠানে তাকে নিবেদন করে কবিতা পাঠের আসরেও উপস্থিত থেকেছি। শুধু রচনায় বা বচনেই নয়, জীবনযাপনেও তিনি বরাবর প্রগতিশীল মানসিকতা লালন করতেন।
সর্বশেষ তিনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অতিথি শিক্ষক হিসেবে এক বছরেরও বেশি সময় কর্মরত ছিলেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক নাম আব্দুর রাজ্জাক হলেও দেশ বিদেশে তিনি 'শান্তুনু কায়সার' নামেই ব্যাপকভাবে পরিচিত। অসম্ভব স্পষ্টভাষী মানুষ ছিলেন এই শান্তনু কায়সার। তার বক্তৃতা শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো। তিনি যখন ২০০৫ সালে 'কুমিল্লার কাগজ' পুরষ্কার পান, তখনই তার অধিক সান্নিধ্য লাভ করি আমি। সে সময়ে তার সঙ্গে প্রায় দিনই বেশ সময় নিয়ে আড্ডা হয় কুমিল্লা শহরের পুরাতন চৌধুরীপাড়ার 'ইন্ডাষ্ট্রিয়েল প্রেস' এ। স্কুল জীবনেরও গল্প করতেন। ছিলেন 'লাকসাম রেলওয়ে স্কুলে'র ছাত্র। আমাকে একবার বলেছিলেন, পারলে একবার দেখে এসো আমার সেই স্কুল। আমি অবশ্য তার বলার আগেই সে স্কুল দেখেছিলাম। বেশ ঐতিহ্যবাহী স্কুল। লেখক জীবনের প্রথম দিকে তিনি অন্যের নামে লেখা ছাপানোর কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি বেশিদিন চেপে রাখতে পারেননি।
আমাদের সঙ্গে পথে দেখা হলে অথবা কোনো আসরে আড্ডায় যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখাতেন। কোথাও একটু বসলেই সাহিত্যিক শওকত ওসমানসহ আরও অনেকের কথা বলতেন। অভিনেতা উত্তম কুমার এবং কখনো বা কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ সুবীর চক্রবর্তী এবং আরও অনেকের কথা বলতেন। সর্বশেষ আবার যোগসূত্র বের করে বুঝাতেন কার প্রসঙ্গ তিনি তার আলোচনায় কেন এনেছেন। বিশেষ দুইটি কারণে লেখালেখির ক্ষেত্রে তিনি তার নিজস্ব নাম 'আবদুর রাজ্জাক' ব্যবহার করেননি। তখন আব্দুর রাজ্জাক নামে একজন সাংবাদিক ছিলেন, যিনি আদমজী পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেই আবদুর রাজ্জাকের 'কন্যাকুমারী' ছিলো আদমজী পুরস্কার পাওয়া উপন্যাস। শান্তনু কায়সারের নিজের ভাষায় 'সেই আবদুর রাজ্জাক তখন খুব সক্রিয় লেখকও ছিলেন এবং তাকে তখনকার সবাই চিনতো।' তাই শান্তনু কায়সার মনে করলেন তার 'আবদুর রাজ্জাক' নাম পাঠককে আবারো চেনানো খুবই কঠিন একটি কাজ। তার লেখক নাম পরিবর্তনের আরেকটি কারণ হলো হিন্দু পুরাণের প্রতি তার অধিকতর দুর্বলতা। তাই তিনি এই 'শান্তনু' নামটায় আকৃষ্ট হলেন। সঙ্গে মুসলিম পরিচয় হিসেবে 'কায়সার' নামটিও যুক্ত করে দিলেন। তার এ নামের কারণে কিছু লোকের কাছে তিনি আজীবন আমরণই ইতি-নেতি দুইভাবেই আলোচিত বা সমালোচিতও হতেন।
গোটা বাংলাদেশেই শান্তনু কায়সারের একটি বিরোধী গোষ্ঠী সক্রিয় ছিলো। কারা তারা? কী তাদের পরিচয়? কেন তারা এই মহান লেখক-কথকের বিরোধীতায় অবতীর্ণ হতেন? এর উত্তরও তিনি সময়ে সময়ে তার বিভিন্ন লেখনে- কথনে প্রদান করে গেছেন। কুমিল্লায় রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী মানসী সাধু যেমন তাকে দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করতেন, কেউ বা আবার তার চরম অপপ্রচারেও অধিক আগ্রহী ছিলেন। কখনো বা লেখাতেও। ১৯৯৬ সাল থেকেই আমি এসব ঘটনা অনেক দেখে এসেছি। এমনকি ঢাকাতেও।
১৯৯৮ সালে ঢাকার ১৮০ ফকিরাপুলের একটি সাহিত্যনুষ্ঠানে যোগ দিলাম আমি। ওখানে গিয়েও একাধিকজনকে দেখেছিলাম শান্তনু কায়সারের বিরোধীতায় অবতীর্ণ হতে। অনুষ্ঠানটি চলছিলো ট্রেড লিংক ইন্টারন্যাশনালের অফিস কক্ষেই।
তবে শান্তনু কায়সারের বিভিন্ন লেখার বিরোধীতার ওই ধারাটি ছিলো খুবই দুর্বল এবং তাদের বিরোধীতার কারণ ছিলো তার স্বচ্ছ অবস্থান অথবা বিদ্রোহ। শান্তনু কায়সার স্পষ্টই প্রতিক্রিয়াশীলদের বিপক্ষে অবস্থান নিতেন। তিনি বলতেনও যে, প্রতিক্রিয়াশীলরা কখনোই শিল্পী নয়। ওরা যে কোনো প্রথার আজ্ঞাবহ দাসমাত্র। সুতরাং যার জীবন সৃষ্টিশীল নয়, যে জীবন প্রগতির বিপক্ষে, ওই শক্তি তার কর্মের বিরোধীতা করে শান্তনু কায়সারের অবস্থানকেই বরং আরও স্বচ্ছ করে দেয়। কারণ মূর্খেরা যেমন না বুঝেই গর্ব করে, তেমনি না বুঝেই বিরোধীতাও করে।
শান্তনু কায়সারের অনেক প্রবন্ধ পাঠে এবং ভাষণে ও ভাষণের সমীকরণে আমি এই বৈজ্ঞানিক সত্যকেই দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি করেছি। কোনো অলৌলিক 'ফ্লেবার' দিয়ে কোনোদিনও তিনি তার লেখন-কথন শেষ করেননি। আর যখন লিখতেন অথবা বলতেন, তখন মনে হতো তিনি যেন সিরাজ-উ-দ্দৌলা'র বা মোহনলালের কোনো প্রতিবেশি অথবা যেন তিনি ঢাকার প্যারীদাস রোডের এক স্থায়ী কোনো বাসিন্দা। নির্ধারিত-অনির্ধারিত যে কোনো বিষয়েই অগাধ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তিনি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'খোয়াবনামা' নিয়ে বলতে বলতে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে এসে কী নিখুঁত পরিসমাপ্তি টানতেন, অবিশ্বাস্য গাঁথুনি বা কম্পোজিশন।
কাব্যের আত্মা যেমন রীতি বা স্টাইল, তেমনি তার লেখন বা কথন প্রকাশভঙ্গিতেও সেরকম একটি স্টাইল ছিলো। 'স্টাইল ইজ দ্যা ম্যান': এ কথা প্রমাণ করেছিলেন শান্তনু কায়সার। তার পুরো জীবন জুড়েই।
এক জীবনে এতো তথ্য, এতো তত্ত্ব এবং এতো জ্ঞান অর্জন সহজসাধ্য কোনো ঘটনা নয়। আমি বছর বছর ধরে বারবার বিমোহিত হয়ে হয়েই শ্রবণ করেছি তার 'কথন'। একজন 'কথক' বিমল করের সরস গল্প ব্যাখ্যা করছেন, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের থ্রিলার বর্ণনা করছেন, উৎস সন্ধান করছেন শিবরাম চক্রর্বতী কোথায় পেয়েছিলেন তার গল্পের এমন হাস্যরস! সে তো অবাক করার বিষয়ই। তবে তিনি কখনো কখনো ছিলেন আক্রমণাত্বকও। শৈল্পিক আক্রমণ। বেগম রোকেয়া কেন নিজের বয়স ১৮ হওয়ার পরও ৪৫ বছর বয়সী পতির পতিব্রতার ভান করতেন, অবলীলায় কারণ ব্যাখ্যা করতেন। পরীক্ষানিরীক্ষার নামে 'গল্পহীন গল্প লেখক'দেরও খোঁচা দিতেন বরাবর। তার দার্শনিক মতাদর্শ মওলানা মওদুদীর অনুসারিদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণেরই শুধু কারণ হয়নি, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের রক্তশূন্য করে ফেলারও কারণ হতো। তিনি প্রায়ই বলতেন, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে মওলানা মওদুদীর ধর্মীয় দল জামাতী ইসলামীর ভাত নেই। অথচ মুক্তিযুদ্ধের রক্তে স্নাত বাংলাদেশে ‘জামাত-শিবির’ সিংহাসনের স্বপ্ন দেখে। তবে তিনি আমাদের বর্তমান সভ্যতা ও সংস্কৃতির নেতিবাচক দিক দেখে আশঙ্কা বা আতঙ্কও বোধ করতেন। বলতেন, এমন ভাবে এগিয়ে গেলে এই সভ্যতা হবে পারমাণবিক বোমার চেয়েও ভয়ঙ্কর। যে সভ্যতা মানুষকে এতো বেশি জটিল আর শৃঙ্খলিত করেছে, সেই সভ্যতার সন্তানগণ কিভাবে সৃষ্টি করবেন স্বার্থবুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠে মহৎ কোনো সাহিত্য অথবা শিল্প? শিল্প বা সংস্কৃতি তো বদ্ধপুকুরের জল নয়। তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন, মহাভারত হাজার বছরের পুরনো। কিন্তু এখনো টিকে আছে কোন কারণে? ছাব্বিশ হাজার শ্লোক রয়েছে তাতে। সেটা কি সহজ কোনো ঘটনা? এই মহাভারত বা রামায়ণে অলঙ্কার, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস কী নেই? গার্হস্থ্য জীবনের জন্যই রামায়ণের এমন জনপ্রিয়তা। আমাদের সাহিত্যে গার্হস্থ্য জীবনও স্বার্থবুদ্ধির চাপে পড়ে কেজো হয়ে যায়। আমাদের মন মুক্ত রাখার ব্যবস্থা থাকে না বলে আমাদের চেতনাও পরাধীন থাকে এবং সৃষ্টিও অধিক মাত্রায় নষ্ট হয়ে যায় এবং সাহিত্য হয়ে যায় কখনো কখনো স্রেফ জার্নাল।
১৯৯৬ সালের একটি ঘটনা। আমাদের এক নিকটাত্মীয় গুরুজন প্রায়ই মাস্টারদা সূর্যসেনকে 'সন্ত্রাসী' বলে আখ্যায়িত করতেন। আমি অনেক ব্যাখ্যা দিলাম সূর্যসেন দেশের জন্য যে আত্মদান করে গেছেন। পরে আমি আমার বাসার দরজার মাথায় সূর্য সেনের একটি বড় পোস্টার লাগিয়ে দিলাম। বললাম, ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারী সূর্য সেন এই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্যই আত্মদান করে গেছেন। দীর্ঘ চার বছর আমরা ওই নিকটাত্মীয়ের প্রতিবেশি হয়ে ভাড়াবাড়িতে বসবাস করছিলাম। আর সেই পোস্টার দরজার উপরে টানানোই ছিলো। ফলে ওই নিকটাত্মীয় আমার দরজার নিচে দিয়ে আর আমাদের বাসায় প্রবেশ করতেন না। একদিন আমি এই ঘটনা শান্তনু কায়সারকে বললাম। তিনি আমার সাহসের প্রশংসা করলেও আশঙ্কাও বোধ করলেন এই বলে যে, 'আমাদের বন্ধনমুক্ত চলার জন্য, বলার জন্য, লেখার জন্য এই মাটির পরিবেশ অনুকূলও নয়। উপগ্রহের সহায়তায় গত শতকের নব্বই দশকের শুরু থেকে একদিকে যেমন আকাশ সংস্কৃতির চরম বিকাশ হচ্ছে, অন্যদিকে ধর্মীয় উন্মাদনাও ক্রমাগত গ্রাস করছে গোটা পৃথিবীকেই। পান-বিড়ি-সিগারেট-পার্লারের দোকান ভীষণতর বাড়ছে, কমছে সৃজনশীল গ্রন্থ প্রকাশকের সংখ্যা। অথবা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কোনো কোনো বাল্ব কোম্পানীর মালিকের চিন্তা থেকে খুব বেশি পার্থক্য নেই অনেক সৃজনশীল গ্রন্থের প্রকাশকের চিন্তারও। অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাস 'তিতাস একটি নদীর নাম' স্বত:স্ফূর্তভাবে না পড়ছে এ কালের যুবক, না দেখছে এ নিয়ে ১৯৭৩ সালে এখানেই তৈরি হওয়া ঋত্বিক কুমার ঘটকের সেই ছবিও। শ্রেয়োবাদ, নন্দনবাদ, ওয়ার্ডওয়ার্থ- কোলরিজ এবং শেলি-র আনন্দবাদ নিয়ে তাদের তেমন আগ্রহই নেই। তারা না দেখছে বার্নার্ড শ'র নাটক এবং না পড়ছে কার্ল মার্কসের কবিতা। না শুনছে ভারতীয় সিনেমার প্রথম সুপারস্টার নায়ক গায়ক কে এল সায়গলের গান, না পড়ছে মেঘনাদবধকাব্য এবং না শিখছে বা মানছে নরেশ বিশ্বাস নির্দেশিত শত সহস্র বাংলা শব্দের প্রমিত উচ্চারণের নির্দেশাবলী। যারা মানছে, করছে, বলছে, তাদের সংখ্যা অনেক অনেক অল্প। তবে জৈব প্রয়োজনে সাড়া দেওয়া ওই স্রোতের বিপক্ষে মানস আয়োজনে সাড়া দেওয়া প্রজন্ম তবু বিজয়ী হবে এ জন্য যে, তারা লক্ষ্যভ্রষ্ট নয়। নীরদচন্দ্র বাঙালিকে আত্মঘাতী বললেও বাঙালিমাত্রই আত্মঘাতী নয়। তাই কখনো চিনুয়া আচেবে'র উপন্যাসের মতো এখানেও রচিত হবে মহৎ মহৎ অমর সব গাথা। ভস্মের ভেতর থেকেই হবে ফিনিক্স পাখির উত্থান। জীবন যেখানে যতো বেশি প্রতিকূল, মানুষের সৃষ্টি সেখানে ততো বেশিই অনুকূল। তবে আমাদের স্বাধীনতার মতো বিনা রক্তপাতে অসাম্প্রদায়িকতাও প্রতিষ্ঠিত হবে না এই মাটিতে। এই মাটিতে চর্যাপদকর্তারা কোনোদিনও জাতপাতের বিচার করেননি। আমরা কেন তাদের উত্তরসূরী হয়ে ওসবের তোয়াক্কা করবো? ... ঠিক এভাবেই কথা লিখতে ও বলতে থাকতেন প্রিয় শান্তনু কায়সার। আমাদের অতি প্রিয়, অতি শ্রদ্ধেয় লেখক ও কথক শান্তনু কায়সার।

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:৪৮

রাজীব নুর বলেছেন: এটা কি ধরনের লেখা? আলোচনা?

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:৫৯

জসীম অসীম বলেছেন: এটা স্মৃতিকথা। কোনো বিশুদ্ধ প্রবন্ধ নয়। শুভ কামনা।

২| ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:১২

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: খুব প্রিয় লেখক ছিলেন।
তাকে চেনার ভাগ্য হয়নি। শুধু লেখা পড়েছি।
খুব ভাল লিখেছেন।

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:১৫

জসীম অসীম বলেছেন: আমারও প্রিয় একজন লেখক ছিলেন। এখন তো আর তিনি নেই। চলার পথে, অনুষ্ঠানে অনেকবারই দেখা হয়েছে। তার সঙ্গে অনেক আড্ডাতেও ছিলাম। তিনি সত্যিই ভালো লিখেছেন। আমাদের বায়ুমণ্ডলে এবং মহাশূন্যেও তার সৃষ্টির স্পর্শ ছড়িয়ে যাক। অনেক ধন্যবাদ।

৩| ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ৮:৪৭

কোলড বলেছেন: This write up does justify your comment " my failure as an author". Trust a commie bastard justifying the assassination of Trotsky and I guess this Shantonu Kaiser is one of them.

I thought I was the only one who called masterda (sic)Surya Sen a terrorist! No?

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:৩৬

জসীম অসীম বলেছেন: This opinion is opaque. Unclear. Surya Sen was a hero. Autonomous hero. Is not it?

৪| ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:৪৮

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন: সুন্দর লেখা। প‌ড়ে খুব ভা‌লো লাগ‌লো। শুভ কামনা জান‌বেন।

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:২১

জসীম অসীম বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের ভালো লাগা থেকেই আরও ভালো লেখার প্রেরণা খুঁজে নেবো।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.