নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইতিহাসের পাঠশালায়

আসিফ আযহার

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আসিফ আযহার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের পাঠশালায়:পঞ্চম অধ্যায়:আর্যভাষী দেশে দেশে (২য় অংশ)

২৭ শে জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:০১



আর্যভাষীরা হিন্দুকুশ পর্বতমালা পেরিয়ে উপমহাদেশে প্রবেশ করে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। তারা প্রথমে এসে পৌঁছায় গান্ধার রাজ্যের তক্ষশিলায়, তক্ষশিলার অবস্থান বর্তমান পাকিস্তানে এবং গান্ধার রাজ্যের বর্তমান নাম আফগানিস্তানের কান্দাহার। সেই সময়ে আর্যরা ছিল নিরক্ষর কিন্তু ভারতভূমির অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলন ছিল লেখার। লেখ্য সংকেত লিপির সাহায্যে তারা লেখত। অথচ আর্যরা ভারতভূমির এই প্রাকৃতজনদের অভিহিত করল ‘অনার্য’ নামে যার আভিধানিক অর্থ অসভ্য ও অসুর এবং নিজেদের অভিহিত করল ‘আর্য’ নামে যার অর্থ সুসভ্য, শ্রেষ্ঠ। শিকারজীবী আর্যদের চেয়ে কৃষিজীবী অনার্যদের সমাজ ব্যবস্থাও ছিল উন্নত-যদিও তখনও রাষ্ট্র গড়ে ওঠেনি। রাষ্ট্র না থাকায় দাসতন্ত্র বা সামন্ততন্ত্রও গড়ে ওঠেনি। দাস শ্রম শোষণের ওপর ভিত্তি করে যে সমাজ গড়ে ওঠে তা দাসতন্ত্রী সমাজ, আর কৃষক প্রজাদের ফসলের ভাগ কেড়ে নেওয়ার যে অত্যাচারি ব্যবস্থা তার নাম সামন্ততন্ত্র। ভারতবর্ষের প্রাচীন অনার্য সমাজে তখনও এরকম ভাঙন সৃষ্টি হয় নি। শ্রেণি শোষণের উপযোগী অর্থনীতি তখনও যথেষ্ট বিকশিত হওয়ার বাকী। তাই কৃষিজীবী অনার্যদের মাঝে প্রচলিত ছিল এক ধরনের গুচ্ছগ্রাম ব্যবস্থা। একগুচ্ছ গ্রাম নিয়ে একেকটি স্বাধীন মানব বসতি গড়ে উঠত। এর নাম ছিল ‘জন’। আর জনের শাসক ছিলেন জনপতি। জনপতি নির্বাচিত হতেন জনের সকল সদস্যের সম্মতিতে। এসব জনপতিদের কেউ কেউ সাম্যবাদী নিয়ম ভঙ্গ করে সামন্ত হয়ে উঠতে চেয়েছেন, বাড়তি সুবিধা ও বিলাসীতার আশায়। কিন্তু জমিতে দাস খাটিয়ে কিংবা প্রজা বসিয়ে ফসলী কর আদায়ের মত উন্নত পর্যায়ে অর্থনীতি বিকশিত না হওয়ায় এসব স্বৈরাচারী জনপতিদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াত সৈন্যবল নিয়ে বিভিন্ন জনের গরু-ছাগল ডাকাতি করা। আর অনার্যদের সব কিছুর চেয়ে এই ব্যাপারটাই সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করল আর্যদের। আর্য জনপ্রতিদের মধ্যে যারা মুগুরভাজা শরীরের অধিকারি তারা হয়ে উঠলেন গরু মোষ ডাকাতির সর্দার।

ভারত ভূমিতে এসে কালক্রমে পশুপালনই হয়ে ওঠে আর্যদের প্রধান জীবিকা। অনার্যদের কাছ থেকে তারা অনেক কিছুই শেখে। তবে একটি ব্যাপারে তারা অবশ্যই অনার্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। এটা হল আধিপত্য ও শোষণকে চিরস্থায়ী করার কাজে ধর্মের ব্যবহার। অনার্য স্বৈরাচারী জনপতিরা একাধিপত্যকে চিরস্থায়ী করার কোন কৌশল আবিষ্কার করতে পারেনি। ফলে যখনই জন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে তাদেরকে গদি ছেড়ে পালাতে হয়েছে। অন্যদিকে আর্য জন পতিরা রাজত্বকে বিদ্রোহের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নিযুক্ত করলেন ঋষি নামক এক পরজীবী শ্রেণিকে। ততদিনে গরু-ছাগল ডাকাতি করে আর্য জনপতিরা ফুলে ফেঁপে হয়ে উঠেছেন ছোট ছোট সামন্ত বা রাজা। আর সামন্ততন্ত্রকে আধ্যাত্মিক কৌশলে নিরাপদে রাখার কাজে নিযুক্ত ভাঁড়াটে ঋষিরা নিজেরাই সৃষ্টি করলেন এক পাল দেবতা, যাদের বাস মর্তে নয়-স্বর্গ নামক এক কাল্পনিক জগতে। এরা অপরিমেয় ক্ষমতার অধিকারী। গোত্রাধিপতি থেকে যারা পরিণত হয়েছেন রাজায়, তাদের লাঠিয়াল ও বল্লমধারী বাহিনীর শক্তির সাথে এবার যুক্ত হল ঋষিদের সৃষ্টি এসব দেবতাদের শক্তি। রাজা সর্বদাই এসব দেবতাদের পছন্দের ব্যক্তি এবং দেবভক্তি আর রাজভক্তিতে কোন তফাৎ নেই। রাজভক্তিতে ঘাটতি থাকলে দেবতা অসন্তুষ্ট হন। মৃত্যুর পরে যেতে হবে দেবতাদের কাছেই। রাজদ্রোহী পাপীদের জন্য তখন ভয়ংকর শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন দেবতারা। ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে সাবলীল ভাষার ফুটিয়ে তুলেছেন পন্ডিত রাহুল সাংকৃতায়ন তাঁর ভোলগা থেকে গঙ্গা’ বইটিতে।

এ ভূখন্ডে কালক্রমে শোষণবাদী আর্য ধর্ম একটি আকার ধারন করতে থাকে। এ ধরনের ব্যাপারে সময় লাগে ঢের। ইতোমধ্যে আর্যরা ভারতবর্ষে আসার পরে পেরিয়ে গেছে প্রায় ৩০০ বছর। সমান্ততন্ত্র, তখন দানা বাঁধছে ভারতের মাটিতে। স্বয়ংসম্পূর্ণ গুচ্ছগ্রাম অর্থনীতি যাচ্ছে হারিয়ে। তার জায়গায় আসছে ছোট ছোট রাজা। ছোট ছোট রাজ্য। অনার্য জন এর জনপতিরা রাজা হয়ে উঠতে পারেননি স্থায়ী ভাবে। কিন্তু আর্য জনপতিরা পান্ডা পুরুত সমেত দস্তুরমত রাজা হয়ে উঠছেন। তাই ক্ষমতার বেলায় শক্তিশালী আর্য রাজাদের কাছে জনগুলো পরাজিত হতে লাগল। এমনকি আর্য গোত্রপতি-রাজারাও পরষ্পরের সাথে লিপ্ত হত যুদ্ধে! স্বার্থ জাত মানে না।

ক্ষমতার লড়াইয়ে যারা টিকে থাকল তাদের ব্যক্তিশাসনের ভিত মজবুত করার কাজে নিযুক্ত মুনি ঋষিরা নানা দৈব বিধি বিধান প্রবর্তন করে চলেছেন দেবতার নামে। এসব দৈব বিধি-বিধানই সংকলিত হয় ঋকবেদে। ততদিনে প্রাথমিক যুগের যেসব আর্য গোত্রপতি গরু, মোষ ও ছাগল ডাকাতির ঘটনায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন, তার পরিণত হয়েছেন কিংবদন্তিতে। যুদ্ধবিজয়ী এসব ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন প্রবাদপুরুষ। আরো কয়েক পা এগিয়ে ঋকবেদের রচয়িতা অতি উৎসাহী তিন ঋষি বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজ এদেরকে বানিয়ে ফেললেন দেবতা। এর হলেন ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, অগ্নি প্রভৃতি। এরা প্রত্যেকেই সুদুর অতীতে ছিলেন মর্ত্যরে মানুষ এবং বিখ্যাত গরুচোর। স্বয়ং ইন্দ্র, যিনি স্বর্গ দেবতাদের রাজা তাঁর সকল সুকর্ম-কুকর্মের মধ্যে প্রধানতম কাজটি ছিল গরু চুরি। (দিনেশচন্দ্র সেন; বৃহৎ বঙ্গ, প্রথম খন্ড, পৃষ্টা-২৪৪)। পশুপালন ভিত্তিক সেই সমাজে ধনসম্পদ বলতে এরা একমাত্র গরুকেই বুঝতো। এমন কি এদের ভাষায় যুদ্ধ আর গরুলাভের ইচ্ছা বোঝাতে একটাই শব্দ প্রচলিত ছিল।



ঋকবেদ রচনা শুরুর সময়কালে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। গঙ্গা-যমুনার সন্নিহিত উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রাচীন দেশ রোহিলাখন্ড ও মধ্যদোয়াব অঞ্চলের নাম তখন পঞ্চাল। পঞ্চালের রাজা দিবোদাসের রাজবেদী নিরাপদ রাখতে এগিয়ে এলেন তিন পরজীবী ঋষি। এরাই হলেন বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজ। পুরনো দিনের বিখ্যাত গরুচোরদেরকে তারা বানালেন পরম ক্ষমতাধর দেবতা। এমনকি এসব দেবতাদেরও একজন স্রষ্টার জন্ম দিলেন। তার নাম ঈশ্বর। তিনি দেবতাদেরও স্রষ্টা। দেবতারাও তার অনুগ্রহ প্রার্থী। তার বিধানই দেবতাদের বিধান। কী সেই বিধান? ঋষিরা জানিয়ে দিলেন রাজাকে দেবতারা পাঠিয়েছেন শাসন করতে। তার বিরুদ্ধাচরণ করলে দেবতারা ক্ষুদ্ধ হবেন, ঈশ্বরও ক্ষিপ্ত হবেন। আর ঈশ্বর ক্ষিপ্ত হলে নেমে আসবে বিপর্যয়। এই ঘোষণা দেওয়া হল যজ্ঞ করে, যার নাম অশ্বমেধ যজ্ঞ। এই ঘোষণার সাথে শুরু হলো ঋকবেদ নির্মাণের কাজ। তৈরি হয়ে গেল সামন্তবাদী শোষণের ভিত। গরু-মোষ হরণে পারদর্শী প্রাচীন আর্য গোত্রপতিরাই এ ব্যবস্থায় পরিণত হলেন বিখ্যাত দেবতায়। গরু-মেষ চুরিকে কেন্দ্র করে বেধে যাওয়া যুদ্ধে তাদের বিজয় ও বিক্রমই তাদের এনে দেয় এই গৌরব। ৪টি বর্ণের বিভাজন তখনও সৃষ্টি হয় নি। তবে ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণের-প্রাথমিক চেহারাটি দেখা দিচ্ছিল ধীরে ধীরে। এদের কর্মক্ষেত্রেও এসে গিয়েছিল বিভাজন। একজনের কাজ রাজপাট করা, দখল-লুণ্ঠন-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আর অন্যজনের কাজ ধর্মীয় যুক্তিতে রাজকৃত অন্যায়কে ঈশ্বরের বিধান বলে প্রচার করা। তবে এই প্রতারণাও খুব বেশি দিন চালিয়ে যাওয়া মুশকিল হয়ে উঠল। কারণ শ্রমজীবী মানুষের বুকের ওপর চেপে বসা দেবতাদের বিধানগুলো দিন দিন আরও দুঃসহ হয়ে উঠছিল। তাই মানুষ বিধানের জাল কেটে বেরিয়ে পড়তে চইছিল। অতএব শঙ্কিত রাজার রাজবেদী রক্ষার জন্য নতুন কৌশল জরুরি হয়ে উঠল। আর তা আবিষ্কার হয়ে গেল একসময়। এর নাম পূণর্জন্মবাদ। সৃষ্টি হল ব্রহ্মা। এসব ধারণা আবিষ্কার করলেন স্বয়ং রাজন। তবে ঘোষিত হল পুরোহিতের মুখ দিয়ে, শতশত গো-মহিষ বলি দিয়ে যাগযজ্ঞের আয়োজন করে। এসব ঘটনা ঘটল ঈশ্বর সৃষ্টি ও ঋকবেদ রচনার কয়েকশ বছর পরে।

পঞ্চালভূমির রাজা দিবোদাসের রাজবেদীকে নিরাপদ করার জন্য রাজ-উচ্ছিষ্টভোগী ঋষি বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজ যে ঢাল তৈরী করেছিলেন তা ৭০০ বছর ধরে নিরাপদে রেখেছে দিবোদাসের বংশধারার রাজত্বকে। কিন্তু এই ঢালে ফুটো দেখা দিল দিবোদাসের উত্তর পুরুষ রাজা প্রবাহনের বেলায়। তিন ঋষি সৃষ্ট দৈব অনুপান এতদিনে তেজ হারিয়েছে। দেবতারাই রাজাকে পাঠিয়েছেন শাসন করতে এই দৈব বিধান আর কাজ দিচ্ছিল না। শোষণে জর্জরিত প্রজা সাধারণের মনের খটকা ক্রমেই বাড়ছিল। কারণ তাদের শ্রমের ফসল গিয়ে উঠবে রাজার ঘরে আর রাজার ভোগ বিলাসের উপকরণ জুগিয়ে চলবে তারা-এমন দৈব বিধান তারা আর মেনে নিতে পারছিল না। দেবতা নামক অদৃশ্য সত্ত্বার নামে চালু করা এসব বিধানের প্রতি তাদের অবিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছিল। তাই রাজা প্রবাহন রাজত্বকে মজবুত অবলম্বন দেওয়ার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করলেন ব্রহ্মাকে। এর আগের ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি প্রভৃতি দেবতাদের কেউ দেখেনি। তাই লোকের মনে সন্দেহ তৈরি হচ্ছিল। এজন্য প্রবাহন সাকার দেবতাদের স্থলে নিরাকার ব্রহ্মের আমদানি করলেন, যাকে প্রত্যক্ষ দেখার কথাই উঠে না। ব্রহ্মের দর্শন পেতে হলে চাই সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়। আর সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয় লাভ করতে হলে চাই সাধনা। আর সাধনার যে ফিরিস্তি দেওয়া হল তাতে ছাপ্পান্ন পুরুষ ধরে সাধনা করেও মানুষ সফল হতে পারবে না, ভ্রমাচ্ছন্ন থেকে যাবে (রাহুল সাংকৃত্যায়ন: ভোগলা থেকে গঙ্গা, পৃষ্টা ১৩৮-১০৯,১১০)।

বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের নৌকা হাজার বছরও কাজ দেয়নি কিন্তু প্রবাহনের নৌকায় দু’হাজার বছর পরও পরধনভোগী রাজা ও সামন্তরা পার হতে পারবে। এর সাহায্যে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণ মিলিতভাবে ঐশ্বর্য ভোগ করতে পারবে। কিন্তু ব্রহ্মের চেয়েও বড় হল প্রবাহনের দ্বিতীয় আবিষ্কার (প্রাগুক্ত)। আবিষ্কারটি হল, মরে গিয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসা - অর্থাৎ পূণর্জন্মের ধারণা। এতদিনে বৈষম্য ও শোষণের পক্ষে খাটানো হয়েছিল শুধু মাত্র দৈব বিধানের যুক্তি। এবার আমদানী হল অনেকগুণ শক্তিশালী যুক্তির। ধনীদের ফূর্তি ও বিলাসীতার ফলে শোষিত গরীবের জীবনে যে দুঃখ ও দুর্দশা নেমে আসে তা ব্যাখ্যা করা হল পুর্বজন্মকৃত ফল হিসেবে। একদিকের ভোগ বিলাস আর অন্য দিকের দুঃখ দারিদ্রতাকে আগের জন্মের সুকর্ম-দুষ্কর্মের ফল হিসেবে দেখানো হল। শোষকের ধন শুধু দেব কৃপায় পাওয়া বস্তু নয় বরং পুর্ব জন্মের সুকর্ম ও দেব ভক্তির পুরষ্কার। আর গরীবের দুর্দশা পুর্বজন্মের পাপের শাস্তি। এভাবে দেবকৃপায় পাওয়া শোষণের অধিকারের যুক্তির স্থলে কাল্পনিক পুর্ব জীবনের সুকর্মের পুরষ্কার হিসেবে শোষণের অধিকার পাওয়ার যুক্তি একটি শক্তিশালী ভিত্তি এনে দিল সামন্তবাদী শোষণে। দরিদ্র প্রজারা পূণর্জন্মের আশায় সারা জীবনের তিক্ততা, কষ্ট এবং অন্যায়কে হাসিমুখে মেনে নিতে শিখল। ধন্য প্রবাহন! ধন্য তার যুক্তি! পুরোগামী ঋষিরাও যা পারেনি, ধর্মের অন্ন ভক্ষণকারি ব্রাহ্মণরাও যা পারেনি, অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে সেই কাজ সম্পন্ন করলেন প্রবাহন। আর্য ইতিহাসের এই কুৎসিত অধ্যায়, যা সম্পন্ন হয়েছিল আনুমানিক ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে সে সম্পর্কে প্রখ্যাত শেকড় সন্ধানী লেখক মাসুদুল হক বলেছেন:

“এবং এসে গেলেন ব্রহ্মা। এসে গেল পূণর্জন্মবাদ, তৈরি হয়ে গেল মানুষকে চিরকালের মত শৃঙ্খলিত করার, তার শ্রম-ডাকাতির জন্য মহাজালিয়াতিপূণর্, মহাপ্রতারণামূলক এবং কুৎসিত কদাকার দলিল। যদিও সাহিত্যের মানদন্ডে এটি-এই বেদ, তৎকালীন মানুষের এক অনন্য সাধারণ সৃষ্টি তথাপি সভ্যতার ইতিহাসে মানুষকে শৃঙ্খলিত করার, মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনা আর অবমাননার এই চিরকালীন দলিলের তুল্য দ্বিতীয়টি মেলা ভার।” - মৌলবাদ, পৃষ্টা-১৩৪।

দিবোদাস তিন ঋষি-বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র ও ভরদ্বাজকে দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপরে প্রভুত্ব করার যে ঢাল তৈরি করেন তার পাশাপাশি প্রবাহন তৈরি করলেন এক অভেদ্য নতুন ঢাল যার ভেদ্যতা নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনি। একমাত্র একজনই সেই ঢালের অভেদ্যতা ভেদ করার দুঃসাহস দেখালেন। তাঁর নাম গৌতম বুদ্ধ। তাঁর জন্ম ৫৬৬ খ্রিস্পুর্বাব্দে, মৃত্যু ৪৮৩ ক্রিষ্টপুর্বাব্দে। ৫১৪ খ্রিস্টপুর্বাব্দে ২৯ বছর বয়সে সেমেটিক নবীদের মত ধ্যান করতে চলে যান নির্জনে। ছয় বছর ধ্যানের পর হলেন বিশেষ জ্ঞান প্রাপ্ত। এর পর নামলেন নতুন ধর্ম প্রচারে। এই নতুন ধর্মে শোষিতরা দলে দলে দীক্ষা নিতে আসলেও ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের জন্য তা অস্তিত্বের হুমকি হয়ে দেখা দিল। ততদিনে ক্ষমতার দৌঁড়ে ক্ষত্রিয়কে ফেলে এগিয়ে গিয়েছেন ব্রাহ্মণ। রাজা প্রবাহনের পর ধীরে ধীরে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠা ব্রাহ্মণের কাছে অসহায় আত্মসমর্পনে বাধ্য হন ক্ষত্রিয় রাজা।

একসময়ের রাজ উচ্ছিষ্টভোগী ব্রাহ্মণ ধর্মের বাণীর জালে আটকে ফেলে ক্ষত্রিয় রাজাকে এবং নিজেই হয়ে ওঠে সর্বেসর্বা। কারণ তার হাতেই তো আছে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার দন্ড। তার মুখ নিঃসৃত বাণীই রাজার কাছে হয়ে ওঠে অলঙ্ঘনীয় বিধান। ব্রাহ্মণ পরিণত হয় অবতারে। ব্রাহ্মণ্যবাদের এই বসন্তের দিনে বুদ্ধের আগমণ। বুদ্ধের দর্শন হয়ে ওঠে এদের প্রাণের শত্র“। পরবর্তীতে মনু ও শংকরাচার্য বৌদ্ধধর্মীদের ওপর যে কঠোরতা আরোপ করেন তা আমরা দেখেছি। তবে ব্রাক্ষণ্যবাদ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলেও বেদের অনুশাসন পালনে বুদ্ধের সময়েও যথেষ্ট শিথিলতা দেখা যায়। মহাভারতের রচনাকাল ৪০০ খ্রিস্টপুর্বাব্দের দিকে। সে সময়ে বেদ নির্দেশিত বর্ণভেদ পালনে কঠোরতা দেখা যায় না। শোষিতের সম্পদ লুট করেই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় সন্তুষ্ট ছিল। বাড়তি ঘৃণা প্রদর্শনের প্রয়োজন এত বেশি ছিল না। তাই উচ্চ বর্ণের সাথে নিম্ন বর্ণের বেদ বিরোধী দৈহিক মিশ্রণে কোন ক্ষতি ছিল না। সেই সময়ের নিয়োগ প্রথা এর স্বাক্ষ্য দেয়। নিয়োগ প্রথায় সন্তান জন্ম দানে অক্ষম রমণীর ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় স্বামী বংশ রক্ষায় নিম্ন বর্ণের রমণীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করত। একে ব্যভিচার মনে করা হত না। খোদ মহাভারতের সৃষ্টিকর্তা মহা কবি ব্যাস দ্বৈপায়নের জন্ম শূদ্রা মায়ের গর্ভে এবং তিনি নিজেও নিম্নজাত মহিলার গর্ভের সন্তানের জনক। এমনকি তার বাবাও নিম্ন বর্ণের গর্ভজাত। তিন পুরুষের এই বিচ্যুতি দেখে বোঝা যায় বর্ণবাদ তখন শাস্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

ব্যাস দ্বৈপায়নের পিতা মহর্ষি পরাশর ছিলেন নিখাদ ব্রাহ্মণ। তারই ঔরসে খাঁটি শুদ্র ধীবর কন্যা সত্যাবতীর গর্ভজাত ব্যাস দ্বৈপায়ন লিখেছেন পৃথিবীর পাঁচটি মহাকাব্যের একটি। এর ২০০ বছর পরে ভারতীয় সমাজকে বর্ণবাদের লৌহশেকলে বাঁধতে চালু হল মনুর বিধান। আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টপুর্বাব্দের দিকে রচিত হয় মনুসংহিতা এবং বৈদিক সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে অমানবিক ও নিষ্ঠুর অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। নারকীয় উল্লাসে মনু শ্রমজীবী মানুষকে নিম্ন বর্ণে স্থান দিয়ে তাদের উপর চাপিয়ে দিলেন উচ্চ বর্ণের ঘৃণা-অত্যাচার-নিষ্ঠুরতা ও প্রভুত্বকে। এটা সমগ্র বৈদিক সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে কুৎসিত এবং জঘন্য দৃষ্টান্ত। মহাভারত সৃষ্টির দুই তিনশ বছর পরে মনু এ বিধান দেন। এর পরবর্তী সময়ে খ্রিষ্টপুর্ব ১৮৫ সালে ভারত ভূমিতে বৌদ্ধ নিধনযজ্ঞ শুরু করেন পুষ্যমিত্র শুঙ্গ। এরও দীর্ঘদিন পরে আবির্ভূত হন শংকরাচার্য। রাজকীয় ও নিজস্ব সৈন্যবাহিনী নিয়ে তার বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞ বৈদিক সভ্যতার ইতিহাসের পরবর্তী বড় নিষ্ঠুরতার ঘটনা। এর পরেও খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত উদয়নাচার্য, রামানুচার্য, বাচষ্পতি মিশ্র প্রমুখ ব্রাহ্মণাচার্যরা বৌদ্ধ নিধন ও ভারতভূমি থেকে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্তি ঘটানোর হেন কোন প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকেন। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর বর্ণনায় ব্রাহ্মণ্যবাদী হত্যাযজ্ঞ ও নিষ্ঠুরতার শিকার বৌদ্ধদের কথা পাওয়া যায়। বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদের এই সহিংসতা বন্ধ হয় ভারতবর্ষে মুসলিম আগমনের পরে। মুসলিম সামন্তরা ব্রাহ্মণদের হাত থেকে কেড়ে নিল ভারত ভূমির ক্ষমতা। সেই সাথে এ ভূখন্ডে প্রবেশ করল সেমেটিক ইসলাম ধর্ম। এই সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ আহত কেউটের মত শুধুই ফোঁস ফোঁস করেছে। ১৭৫৭ সালের পরে ভারতভূমি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাতে চলে গেলে আহত কেউটে সোজা হয়ে ফণা তোলে দাঁড়ায়। সাতশ বছর পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ছত্র ছায়ায় ব্রাহ্মণ্যবাদ আবার দানবিক মুর্তিতে আবির্ভূত হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী এখন বৌদ্ধরা নয় - মুসলিমরা। তাই ব্রিটিশের হাতে মুসলিম শাসকই হোক আর বিপ্লবীই হোক, পরাজিত হলে মনু শংকরাচার্যের উত্তরসূরিরা আনন্দে ভেসে যেত। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশের জয় কামনা করে কবি ঈম্বরচন্দ্র গুপ্ত বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে লিখলেন-

"যবনের যত বংশ একেবারে হবে ধ্বংশ
সাজিয়েছে কোম্পানীর সেনা
গরু জরু লবে কেড়ে চাপ দেড়ে যত নেড়ে
এই বেলা সামাল সামাল।"

এখানেই শেষ নয়। দিল্লীর যুদ্ধ কবিতায় লিখলেন:চিরকাল হয় যেন ব্রিটিশের জয়। আরও লিখলেন:

"ভারতের প্রিয়পুত্র হিন্দু সমুদয়
মুক্ত সুখে বল সবে ব্রিটিশের জয়।"

এছাড়াও ঝাঁসির রানী যবন মুসলমানদের মতই তার প্রভু ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অপরাধে তার ভাষায় হয়ে গেলেন ‘ঠোঁট কাটা-কাকী’।
ব্রিটিশের গোলামীর ইতিহাসে আরেকজনের পারদর্শীতাও আলোচিত হতে পারে। তিনি বঙ্কিমচন্দ্র। ১৮৫৭ সালের ২২ জুন ইংরেজ সৈন্যরা যখন সিপাহী বিদ্রোহীদের পরাজিত করে দিল্লী দখল করে সেই দিনটি ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের জন্য মহাআনন্দের। এই কদর্য আনন্দের প্রকাশ ঘটালেন তিনি সংবাদ ভাস্কর এ প্রকাশিত এর রচনায় বিপ্লবীদের পাপিষ্ট বলে অভিহিত করে এবং ইংরেজদের জয়ে আনন্দ নৃত্যের আহবান জানিয়ে।

ব্রাহ্মণ্যবাদ এভাবে পরিণত হয় সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাসে। ব্রিটিশ প্রভুর গোলামীতে তার কোন খুত ছিল না। ভারতীয় আর্য সভ্যতার সমগ্র ইতিহাসটাই এভাবে পরিণত হয়েছে সমগ্র মানব সভ্যতার ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ে যা বৈদিক প্রতারণা, ব্রাহ্মণ্যবাদ-বর্ণবাদ, মনুবাদ এবং নারী নির্যাতনের এক ঘৃণ্য দলিল ছাড়া আর কিছু নয়। এ সভ্যতা কলঙ্কের শীর্ষে পৌঁছে যায় বর্ণবাদী অনুশাসনে সভ্যতার আসল কারিগর শ্রমজীবী মানুষের পবিত্র দেহকে অস্পৃশ্য ঘোষণা দিয়ে; নারকীয় নৃশংসতায় সতীদাহের মত প্রথার প্রবর্তন করে; পুরুষতান্ত্রিক শৃঙ্খলে নারীর অধিকারকে বন্দী করে এবং সর্বোপরি নারী, অন্যধর্মী ও অন্ত্যজ হিন্দুসহ সমাজের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের অধিকার ও মর্যাদাকে শোষণ, ঘৃণা ও অত্যাচারের বেদীতে বলী দেয়ার মধ্য দিয়ে। মানবতার পরাজয়ের এক করুণ ইতিহাস হল এই বৈদিক ও আর্য সভ্যতা। রোমান গ্লাডিয়েটরদের কথা বাদ দিলে এই ভারতীয় আর্য সভ্যতার বিভিন্ন উপাদান - অস্পৃশ্যতা-বর্ণবাদ-নিরীহ মানুষকে দেবতার উদ্দেশ্য বলী দেয়া-সতী পোঁড়ানো-বিধবাকে বেশ্যা হতে বাধ্য করা - এসবই হবে সমগ্র সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য ও নারকীয় নির্দশন। মানুষের মর্যাদা ও মানবতার অবমাননার এত করুণ চিত্র, এত বড় সামাজিক পরিমন্ডলে আর কোথাও দেখা যায় না। আর্য ব্রাক্ষণ্যবাদ ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসে এই একবিংশ শতকেও গুজরাটের মুসলিম হত্যায় মেতে ওঠে সমান নৃশংসতায়। মানুষের খোলস ছেড়ে দানবের চেহারায় বেরিয়ে আসেন মনু-শংকরাচার্যের উত্তরসুরি গুজরাটের কসাই নরেন্দ্র মোদী।



মোটামোটিভাবে এসবই হল ভারতীয় বৈদিক আর্য সভ্যতার ইতিহাস। এ ইতিহাস গৌরবের নয়, কলঙ্কের। তবুও তা পড়তে হবে, জানতে হবে। জীবনকে কলঙ্কের ভারমুক্ত করার জন্যই তা প্রয়োজন। আগামী জীবনকে বর্ণবাদ, বৈষম্য ও শোষণমুক্ত করে গড়ে তোলার জন্যই এ ইতিহাসকে জানতে হবে। সেইসব শ্রমজীবী মহামানবেরা, যারা সভ্যতার আসল কারিগর, যাদের বুকের ওপর গড়ে ওঠেছে সভ্যতা; ইতিহাসের প্রতিটি ভাঁজে লুকিয়ে রয়েছে তাদের দুঃসহ জীবনের করুণ কাহিনী। তারা সভ্যতার পিলসুজ। মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে। উপরের সবাই আলো পায়, সেই আলোতে বাবুসাহেবরা খেলা করে। অথচ ইতিহাসে তারাই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত। বাবুদের ইতিহাস তাদের প্রতি সম্মান দেখানো দুরের কথা, করুণাও প্রদর্শন করে না। ইতিহাসের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা তাদের অসম্মান, লাঞ্ছনা ও অবমাননার কাহিনী জানতে হবে পড়তে হবে। জানতে হবে তাদের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সংগ্রামের কাহিনী যা এখনও শেষ হয়ে যায় নি। বাবুদের অত্যাচারও বন্ধ হয় নি। বাবুদের ভাঁড়াটে সশস্ত্র বাহিনী হামলে পড়ে ভারতের জঙ্গলে, শিকার করে নিয়ে আসে মাওবাদী বিদ্রোহীর লাশ। সৌখিন বাঘ শিকার-নয়, বাবুরা হিংস্র উল্লাসে মেতে উঠেন মাওবাদী শিকারে। এর নাম অপারেশন গ্রিন হান্ট, যা শুরু করেছে বাবুদের রাষ্ট্র। তাই বুঝতে হয় ইতিহাস এখনও বড়ই অসমাপ্ত। ইতিহাস সেদিনই সমাপ্ত হবে যেদিন শ্রমজীবী মানুষ তার নায্য অধিকার ফিরে পাবে। যেদিন মানুষ তার প্রাপ্য ফিরে পাবে এবং সেদিনই শুরু হবে মানুষের গৌরবের ইতিহাস। তার আগে কখনোই নয়।

সমগ্র মানব সভ্যতার ইতিহাসে গৌরবের চেয়ে কলঙ্কের নির্দশন অনেক বেশি। শোষণ আর অপচয়ের অপর নামই সভ্যতা। তবে এর বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের ইতিহাসটাও ক্ষুদ্র নয় মোটেও। সভ্যতার ইতিহাসে একদিকে যেমন খুঁজে পাওয়া যায় শোষণ আর কলঙ্ক অন্য দিকে তেমনই খুঁজে পাওয়া যাবে বিদ্রোহ-বিপ্লব-সংগ্রাম। তবে শোষকের ইতিহাসে তা স্থান পায় নি। তাই সেই সকল গৌরবের কাহিনীর অনেক কিছুই আমরা জানতে পারব না কখনোই। ভারতীয় বৈদিক আর্য সভ্যতার ইতিহাসে যেভাবে শোষণ ও কলঙ্ক ছড়িয়ে আছে তার বিপরীতে সংগ্রামের গৌরবময় অধ্যায়গুলো এতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে নি। কারণ সংগ্রাম আজ অবধি চুড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে পারে নি। তাই সংগ্রাম বারে বারে পরাজিত হয়ে হারিয়ে যায়। কিন্তু আবার ফিরে আসে।

সভ্যতা বিশ্বকে যতটা না আলোকিত করেছে তার চেয়ে ঢের বেশি নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার জন্ম দিয়েছে। সংগ্রাম যেহেতু চুড়ান্তভাবে বিজয়ী হতে পারে নি, তাই তা সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করে না। এ কারণে সকল ক্ষেত্রেই শোষক ও সুবিধাভোগী শ্রেণিই সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করছে। তবে শোষক শ্রেণির এ প্রতিনিধিত্ব আর্যদের অন্যান্য শাখা যথা পারসীয় ও দক্ষিণ ইউরোপীয়দের ক্ষেত্রে নিরংকুশ ভাবেই কলংকের নয়। দাস শোষণের কলংকে কলুষিত হলেও সেসব সভ্যতা মানব সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে অনেক ক্ষেত্রেই অবদান সৃষ্টি করতে পেরেছে। মধ্যপ্রাচ্যের সেমেটিক সভ্যতা গুলো এবং দক্ষিণ ইউরোপীয় আর্য নগর সভ্যতাগুলোর বেশ কিছু উদ্ভাবন আজও আমাদের কাজে লাগছে।

বর্ণমালা, ভাষা, সংখ্যা গণনা, ক্যালেন্ডার, গণিত, জ্যামিতি, স্থাপত্য, নগর পরিকল্পনা, দর্শন-চিন্তা, যন্ত্র কৌশল, আইন, সাহিত্য, জ্ঞান শাস্ত্র এবং সর্বোপরি শিল্প কলায় এসব সভ্যতা মানুষের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। পরিশ্রমের বোঝাটা শোষিত শ্রেণির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে যে অবকাশটা পাওয়া যায় তা বৈদিক ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা যেভাবে শুধু ষড়যন্ত্র ও নোংরা কৌশল উদ্ভাবনের পেছনে ব্যয় করেছে সেরকমভাবে না করে দক্ষিণ ইউরোপীয় আর্যরা কিছুটা হলেও সময়কে জ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন ও শিল্পকলার পেছনে ব্যায় করেছে। গ্রিসে জন্ম নিয়েছেন এস্কাইলাস, সফোক্লিসের মত ন্যাট্যকার, পিথাগোরাসের মত গণিতবিদ, সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটলের মত দার্শনিক, হেরোডোটাসের মত ইতিহাসবিদ, ফিদিয়াসের মত ভাস্কর এবং ডেমোক্রিটাসের মত প্রকৃতি বিজ্ঞানী। যদিও তারা দাস শোষণের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল তাদের সভ্যতা তবুও জ্যোতিবিজ্ঞান, চিকিৎসা, স্থাপত্যকলা, সঙ্গীত ক্রীড়া এসব ক্ষেত্রে গ্রিকরা দুনিয়ার সেরা ছিল। এমনকি এথেন্সের পেরিক্লিসের মত রাষ্ট্রনায়কও সেই যুগের ইতিহাসে বিরল।


লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থি, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:০৩

হাসান কালবৈশাখী বলেছেন: অনেক কিছু জানা গেল। আপনার সব লেখা পড়তে হবে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.