নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইতিহাসের পাঠশালায়

আসিফ আযহার

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আসিফ আযহার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের পাঠশালায়: ৬ষ্ঠ অধ্যায়: আর্য সভ্যতার হেলেনিয় ও হেলেনিস্টিক অধ্যায়

২৭ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১০:২৪



ভারতবর্ষে যেমন ঋকবেদ ইউরোপে তেমনি ইলিয়াড আর ওডিসি সবচেয়ে পুরনো কাব্য। তবে ঋকবেদে যেভাবে গরু দখল নিয়ে যুদ্ধ বাধতে দেখা যায় এবং গরু দখলকে সবচেয়ে বীরত্বের কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে তার সাথে ইলিয়াড ও ওডিসির মিল নই। সেগুলোতে যুদ্ধের পটভূমি ছিল ভিন্ন। গোড়াতেই এগুলো কোথাও লেখা হয় নি। মুখে মুখে গান করে চারন কবিরা গ্রিক বীরদের এই সব বীরত্বের কাহিনী শুনিয়ে বেড়াত। হোমার নামে একজন চারণ কবিই এই দুটি কাব্যের রচয়িতা। কিন্তু হোমার আসলে কে ছিলেন তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারা যায় না। তিনি কোন দেশের কোন শহরে বাস করতেন তা নিয়ে পন্ডিতদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে।

হোমারের রচিত এ দুটি মহাকাব্য ছাড়াও হেসিয়ড নামে আরেকজন কবির রচিত ‘ওয়ার্কস এন্ড ডেইজ’। এবং ‘বার্থ অব দি গডস’ নামে দুটি কাব্যও ছিল। এ সবই ৭০০ খ্রিস্টপুর্বাব্দের আগের রচনা। অর্থাৎ সেই সময়ের ভারতবর্ষের বৈদিক সমাজে জন্মান্তরবাদ চালু হচ্ছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের নিনেভা শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওটা অ্যাসিরিয় সাম্রাজ্যের কাছে পতন ঘটছে ইহুদিদের ইসরাইল রাজ্যের।

মহাকাব্য গুলোতে গ্রিক সভ্যতার আদি পর্বের যে ছবি পাওয়া যায়, তা থেকে মোটামোটিভাবে জানা যায় যে, পশুপালন আর শিকার চালু থাকলেও, খাবার জোগাড়ের প্রধান উপায় ছিল চাষবাস। যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্যে অপর পক্ষের যারা বন্দী হতো, জমিজমায় বা ব্যবসাবাণিজ্যে তাদের খাটিয়ে নেওয়া থেকেই শুরু হয়েছিল ক্রীতদাস প্রথা। মহাকাব্য গুলির এই যুগকে বলা হয় বীরদের যুগ। প্রধান দুটি মহাকাব্যের রচয়িতা হোমারের নামে এই যুগকে হোমারীয় যুগ ও বলা হয়। গ্রিকদের বিশাল দেবতা ডিয়োকেলিয়ানের পুত্র হেলেনের বংশধর তারা। পুরাকালের ন্যায়পরায়ন রাজা ছিলেন ডিয়োকেলিয়ান। হেলেনের বংশধর বলে গ্রিকরা নিজেদের বলতো হেলেনিয়। এজন্যই গ্রিক সভ্যতা হেলেনিয় সভ্যতা নামে পরিচিত।



হোমারীয় যুগে গ্রিকদের ধর্ম ছিল সরল। গ্রিক দেবতারা ছিলেন মানুষের মতই। বৈদিক দেবতাদের মত তারা আকাশে বাস করতেন না। বরং গ্রিকদের বিশ্বাস ছিল দেবতারা বাস করতেন উত্তর গ্রিসের অলিম্পাস পাহাড়ের চূড়ায়। হোমারীয় যুগের শেষ দিকে অলিম্পিক প্রতিযোগিতার প্রচলন হয়। প্রথম অলিম্পিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় ৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। অলিম্পাস পাহাড়ের পাদদেশে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। দেবরাজ জিউসের সম্মানে এই খেলার আয়োজন হত। অলিম্পিক ছিল সমগ্র গ্রিসের অধিবাসীদের সাংস্কৃতিক বন্ধনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম।

সময়ের বিবর্তনে একসময় গ্রিসে ভেঙ্গে পড়তে থাকে হোমারীয় যুগের গ্রাম সম্প্রদায়। ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাদের দিকে এক একটি অঞ্চল ঘিরে গড়ে উঠতে থাকে নগর রাষ্ট্র সমূহ। যেমন মূল ভূখন্ডে ছিল এথেন্স, থিবস ও মেগারা; পেলোপনেসাস অঞ্চলে ছিল স্পার্টা এবং করিন্থ; এশিয়া মাইনরের তীরে ছিল মিলেটাস ইত্যাদি। এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় ছিল স্পার্টা ও এথেন্স। এদেরকে একত্রে বলা হয় হেলেনিয় সভ্যতা।

৫৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে স্পার্টা গ্রিসের মধ্যে সব চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এটি ছিল মূলত একটি সামরিক নগররাষ্ট্র। অন্যদিকে উত্তরের প্রতিবেশী এথেন্স নগররাষ্ট্রটি গড়ে উঠেছিল স¤পূর্ণ ভিন্ন চিরত্র নিয়ে। রাজতন্ত্রের জায়গায় ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পৃথিবীতে প্রথম নিয়ে আসল এথেন্সবাসীরা। অবশ্য সেমেটিক নবীদের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্য ও মিশরে রাজতন্ত্র বিরোধী ধর্মীয় অনুশাসনমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিন্নধর্মী দৃষ্টান্ত এরও আগে দেখা গিয়েছে। তবে নবীদের অনুশাসনের কার্যকারিতা দেখা যায় তাদের জাতিসমূহের পরাধীনতা থেকে উত্তরণের কালপর্বে, বিদ্রোহী ও যাযাবর অবস্থায় এবং স্রষ্টার বিধান দিয়ে সমাজ চালানো নবীদের পক্ষে লোকজনের অবাধ্যতার কারণে অনেক সময় খুবই কঠিন হয়ে যেত। দাউদের জেরুজালেম বিজয়ের পরে নবী শাসিত ইহুদিদের মাঝেও রাজতন্ত্রী ব্যবস্থা স্থায়ী হয়ে যায়। স্থায়ী ভাবে অন্য ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রথম দেখা গেল এথেন্সে। এগুলো হল অভিজাততন্ত্র, গণতন্ত্র ইত্যাদি। তবে এসব ব্যবস্থায় শোষিত ও দাসশ্রেণি আগের অবস্থায়ই থেকে যায়।

হাম্মুরাব্বির পরে পৃথিবীতে মানবরচিত আইন প্রবর্তনের বড় ঘটনাও প্রথম ঘটে এথেন্সে। ৬২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ড্রাকো নামে একজন অভিজাত একটি আইন সংকলন তৈরি করেন এথেন্সে। ড্রাকোর আইন খুবই কঠোর ছিল। তাই বলা হত, এ আইন কালির বদলে রক্ত দিয়ে লেখা হয়েছে। সামান্য বাঁধা কপি চুরির অপরাধেও মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান ছিল এতে।

গ্রিস যখন ধীরে ধীরে মাথা তোলে দাঁড়াচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে তখন মেসোপটোমীয় সভ্যতার শেষ ধাপ ক্যালদীয় সাম্রাজ্য কেড়ে নিচ্ছে পারসীয়রা। ৫৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য সম্রাট সাইরাস দখল করে নেন ক্যালদীয় সামাজ্য। পারসীয়রা গ্রিসের উত্থানকে ভাল চোখে দেখল না। পাশ্চাত্যের সাথে প্রাচ্যের কোন বড় সংঘাতের প্রথম দৃষ্টান্ত হল গ্রিকদের সাথে পারসীয়দের যুদ্ধ। পারস্য সাম্রাজ্যের পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরের উপকূলে যেসব গ্রিক শহর গড়ে উঠেছিল তারা পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনতা থেকে নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করল। এই বিদ্রোহে এথেন্স তাদের সাহায্য করেছিল। তাই পারস্য সম্রাট দারায়ুস সিদ্ধান্ত নিলেন গ্রিস আক্রমণ করার। তাঁর সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৫২১ থেকে ৪৮৫ সাল পর্যন্ত। এই সম্রাট দারায়ুসের সাথে ভারতীয়দের ইতিহাসের একটি যোগসূত্র আছে। তা হল ভারতের অধিবাসীদের জন্য হিন্দু নামটি সম্রাট দারায়ুসের নৌ সেনাদের দেয়া। সম্রাটের নৌ অধ্যক্ষ সাইলাস পারস্য সামাজ্যকে পশ্চিম ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত করার উদ্দেশ্যে নৌ বাহিনী নিয়ে এগিয়ে এসে সিন্ধু নদের পথে ঢুকে পড়েন এবং এর অববাহিকা অঞ্চল দখল করতে করতে এগিয়ে যান। এ সময় পারসীয় নৌ সেনাদের মুখে সিন্ধু নামটি বিকৃত উচ্চারণে হয়ে যায় হিন্দু এবং এই নদ অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দারা তাদের কাছে পরিচিতি পায় হিন্দু নামে। এ ঘটনার সময়কাল ছিল ৫০০ খ্রিস্টপুর্বাব্দের দিকে। ভারতবর্ষে তখন বুদ্ধের আগমন ঘটেছিল। সিন্দু নদ হতে পুর্ব ইউরোপ পর্যন্ত তখন পারস্য সামাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল। এই সময়ে সম্রাট দারায়ুস তাঁর রাজ্যের অন্যদিকে গ্রিস দখলের জন্য তাঁর জামাতার নেতৃত্বে অন্য আরেকটি নৌ বহর পাঠালেন। কিন্তু ঝড়ের কবলে পড়ে সব জাহাজ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তিনি ফিরে এলেন।

৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট দারায়ুস নিজেই সেনাবাহিনী সজ্জিত করলেন গ্রিসের উল্টো দিকে তুরস্কের উপকূলে। তারপর গ্রিসের সব শহরে দ্রুত পাঠিয়ে দিলেন। ভয়ে ও আতংকে গ্রিসের অধিকাংশ নগর রাষ্ট্র অধীনতার স্বীকৃতি স্বরূপ তাদের শহরের মাটি ও পানি তুলে দিল দূতদের হাতে। কিন্তু স্পার্টা ও এথেন্স অধীনতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দূতদের ফেলে দিল পানির কুয়ার নিচে। তাই সম্রাট দারায়ুস ৬০০ জাহাজ বোঝাই করে ২০০০০ সৈন্য নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে নামলেন গ্রিসের উপকূলে। এথেন্স থেকে ২৬ মাইল দূরে ম্যারাথনের সমতল ভূমিতে স্থাপন করলেন সৈন্য শিবির। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এথেন্সের ১০০০০ সৈন্য এগিয়ে এল মিলটাইডিসের নেতৃত্বে। ম্যারাথনের মাঠে তাদের মরণপন প্রতিরোধ যুদ্ধের মুখে পারসীয়রা নির্মমভাবে পরাজিত হল। এই আনন্দ সংবাদ পৌঁছে দেয়ার জন্য ফিডিপাইডিস নামক একজন এথেন্সবাসী ম্যারাথন থেকে এক দৌড়ে ছুটে যান এথেন্সে। সংবাদটি জানিয়েই তিনি মুখ থুবড়ে পড়ে মারা যান। তাঁর সম্মানেই প্রতিবার অলিম্পিকে এখন ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।

দারায়ুসের এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চাইলেন তার ছেলে সম্রাট জারেক্সেস। ওল্ড টেস্টামেন্টে এই জারেক্সেস সম্পর্কে বলা হয়েছে, “ইনি সেই জারেক্সেস যিনি ভারত থেকে ইথিওপিয়া দেশ পর্যন্ত একশ সাতাশটা বিভাগের উপর রাজত্ব করতেন” (ইষ্টের পুস্তক-১:২) । ৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রায় দেড় লক্ষ সৈন্য নিয়ে তিনি স্থলপথ ঘুরে রওনা দিলেন গ্রিসের উদ্দেশ্যে। তারা থার্মোপিলির সংকীর্ণ পথে বাঁধা দিতে আসা ৭০০০ গ্রিক সৈন্যকে পর্যদুস্থ করে এগিয়ে গেল এথেন্সের দিকে। এথেন্সে যখন তারা প্রবেশ করল তখন আর কাউকে খুঁজে পেল না। এথেন্সবাসীরা তখন জাহাজে চড়ে আশ্রয় নিয়েছে সেলামিস উপসাগরে। এথেন্সের পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে উঠে পারসীয়রা দেখতে পেল এথেন্সবাসীদের। জারেক্সেস সেই পাহাড়ে তাবু খাঁটিয়ে বসলেন তাঁর বিরাট নৌ বহর কিভাবে এথেন্সবাসীদের ধ্বংশ করে তা দেখার জন্য। কিন্তু সেখানে বসে তিনি আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, গ্রিকদের কৌশলের কাছে হেরে গিয়ে বিশাল পারসীয় নৌ বহর লন্ডভন্ড হয়ে গেল। হতভম্ব জারেক্সেস বাকী নৌবহর ও সৈন্য সামন্ত নিয়ে ফিরে গেলেন নিজের দেশে।

সেলামিস উপসাগরে পারসীয়দের এই পরাজয় সমগ্র সভ্যতার ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। যদি সেদিন পারসীয়রা জিততে পারত তাহলে গ্রিক বা রোমান সভ্যতার কোন অস্তিত্ব ইতিহাসে থাকত না। এমনকি পশ্চিমা সভ্যতা বলেও কোন কিছু থাকত না। প্রাচ্য আর ইউরোপ নৃতাত্ত্বিকভাবে একাকার হয়ে যেত। গ্রিক সভ্যতার ইতিহাসে এর পরপরই শুরু হল সোনালী যুগ, যা চলতে থাকে ৪৩০ খ্রিষ্টপুর্বাব্দ পর্যন্ত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ থেকে ৪৩০ - এই ৫০ বছরেই গ্রিক সভ্যতা জ্ঞান-চিন্তা চর্চা, চিকিৎসা, সঙ্গীত, স্থাপত্য, শিল্পকলা, সাহিত্য-দর্শনে উন্নতির চূড়ায় পৌঁছে যায়। জ্ঞান বিজ্ঞান, চিন্তা-চেতনায়



এথেন্স সারা পৃথিবীকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এ যুগে এসেছেন পেরিক্লিসের মত রাষ্ট্রনায়ক, তাঁর বন্ধু হেরোডোটাসের মত ইতিহাসবিদ। নাটকে সৃষ্টি হয় কমেডি, ট্রাজেডি, প্রভৃতি ধারা। এস্ফিথিয়েটারে হত অভিনয়। এস্কাইলাসের বন্দি প্রমিথিউস, সফোক্লিসের ইদিপাস, আন্তিগোনে এ যুগেরই নাটক। এ যুগেই জন্ম হয় মহান দার্শনিক সক্রেটিসের। এনাক্সিগোরাস তখন এথেন্সে বসে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে ঢেলে সাজাচ্ছেন। এ যুগের প্রভাব আজও আমাদের জীবনে রয়ে গেছে। তবে এ কথা ভুললে চলবে না এতসব গৌরবের আসল কারিগর হল এথেন্সের সেই সব ক্রীতদাস ও শ্রমজীবী মানুষেরা যাদের কথা হারিয়ে গেছে ইতিহাসের অন্তরালে। তারাই তিলে তিলে শ্রম দিয়ে নির্মাণ করেছে গৌরবময় এ সভ্যতা। দাস শোষনই ছিল এথেন্সের সমৃদ্ধির ভিত্তি। তাই গৌরবের সমস্ত কৃতিত্ব দিতে হবে তাদেরকেই।

অন্যদিকে অবকাশ ভোগী শ্রেণিকে এ জন্যও কৃতিত্বের কিছুটা দিতে হবে যে, তারা রোমানদের মত অযথা দাস নিপীড়নের পৈশাচিক কান্ড কারখানা করেনি। রোমানদের মত তারা দাসদের গ্লাডিয়েটর হতে বাধ্য করেনি বা দাসদের গলায় চাকা পরিয়েও রাখেনি। বরং অবসরে তারা এক্রোপলিসে বসে থিয়েটার দেখতো। ক্রীতদাসদেরও তারা পড়ালেখা শিখাতো ছোট বাচ্চাদের শিক্ষকতার কাজ করিয়ে নেয়ার জন্য। সময় এবং সম্পদকে শুধু বিকৃত রুচি আর স্থুল প্রবৃত্তির পেছনে ব্যয় না করে সৃষ্টিশীলতা ও শিল্পের পেছনে তারা কিছুটা হলেও ব্যয় করত।

এথেন্সের গৌরব প্রতিবেশী নগর রাষ্ট্রগুলো ভাল চোখে নিল না। ফলে উন্নতির চরমে পৌঁছেও এক সময় দুর্যোগ নেমে আসে এথেন্সে। স্পার্টার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পেলোপনেসিয় লিগ ও এথেন্সের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ডেলিয়ান লিগের অন্তর্ভূক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বেঁধে যায় যুদ্ধ। ইতিহাসে এই যুদ্ধকে পেলোপনেসীয় যুদ্ধ বলা হয়। এই যুদ্ধে চুড়ান্তভাবে পতন ঘটে এথেন্সের। যুদ্ধ শুরুর দু’বছরের মাথায় মহামারি প্লেগরোগে আক্রান্ত হল এথেন্স। এ রোগ এতই ছোঁয়াচে ও ভয়ংকর যে নিমিষেই একটি জনপদকে নিশ্চিহৃ করে দিতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ৪২৯ খ্রিস্টাব্দে মারা গেলেন এথেন্সের দীর্ঘ দিনের কর্ণধার পেরিক্লিস। ৩৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্স চলে যায় স্পার্টার অধীনে। ততদিনে সবগুলো শহর যুদ্ধের ধকল সইতে না পেরে চূড়ান্তভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছে।

গ্রিক সভ্যতা যখন এই আত্মঘাতী যুদ্ধ ভেঙে পড়ছে, গ্রিসের উত্তর দিকের একটি দেশ তখন মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। এর নাম মেসিডোনিয়া। হেলেনিয় জ্ঞান বিজ্ঞানের ছোঁয়া লেগেছিল এই ভূখন্ডে। তাই ইতিহাসে এর পরিচয় হয় হেলেনিস্টিক সভ্যতা নামে। এই ভূখন্ডের রাজা ছিলেন দ্বিতীয় ফিলিপ। তিনি ৩৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই ভূখন্ডে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করেন। ৩৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে স্পার্টা ছাড়া অন্য সব গ্রিক নগররাষ্ট্র মেসিডোনের অধিকারে চলে আসে। পারস্য ছিল রাজা ফিলিপের প্রধান প্রতিপক্ষ। পারস্য বিজয়ের জন্য তিনি সমগ্র গ্রিক শক্তিকে একত্র করার চেষ্টা করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি গ্রিক নগররাষ্ট্র গুলোকে নিয়ে হেলেনিক লিগ নামে একটি মৈত্রী জোট গঠন করলেন।

প্রাচ্য ভূমি দখলের পাশ্চাত্য পরিকল্পনার বড় ঘটনা এটাই ইতিহাসে প্রথম। আর প্রাচ্য বিজয়ের এই প্রথম পরিকল্পনা হয়েছিল সংঘবদ্ধ বা জোটবদ্ধভাবে। আজ এতদিন পরেও তৃতীয় বিশ্বে পাশ্চাত্য দখলদারির অভিযান হয় জোটবদ্ধভাবে। ইঙ্গ-মার্কিন জোট, ন্যাটো জোট প্রভৃতি জোটের নেতৃত্বে তৃতীয় বিশ্বে দখলদারি অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। তবে এসব ক্ষেত্রে তাদের প্রতিপক্ষ পারস্য সাম্রাজ্যের মত কোন রাজকীয় শক্তি নয় বরং অনেক ক্ষেত্রেই তা বেসরকারিভাবে সংগঠিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি। পাশ্চাত্যের আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র সমূহের বিরুদ্ধে ইসলামী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান, বিশ্ব সভ্যতায় সেমেটিক ধর্মীয় ধারার শক্তিশালী প্রভাব কিভাবে আজকের দিনেও কার্যকর তা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

রাজা ফিলিপ প্রাচ্য আক্রমণের যে পরিকল্পনা করেছিলেন তা বাস্তবায়নের আগেই তিনি মারা পড়লেন আততায়ীর হাতে। এটা খ্রিষ্টপূর্র্ব ৩৩৬ সালের ঘটনা। এর পরে সিংহাসনে বসলেন তার ২০ বছর বয়সী পুত্র আলেকজান্ডার। পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন পুরণে আলেকজান্ডার পারস্য সম্রাট জারেক্সেসের মত ব্যর্থ হন নি। প্রাচ্যের ওপর পাশ্চাত্যের বিজয় ইতিহাস তিনিই সর্বপ্রথম নিশ্চিত করেছিলেন। ইতিহাসে আলেকজান্ডারের গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ তিনিই পাশ্চাত্যের প্রথম মানুষ যিনি প্রাচ্য জুড়ে তার সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করতে পেরেছিলেন।

এতদিন পর্যন্ত লোকে জেনেছে শুধু মিসরীয়, ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরীয়, ক্যালদীয় ও পারস্য সাম্রাজ্যের কথা। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিসরে ছড়িয়ে ছিল শুধু এসব সাম্রাজ্যের দাপটের কথা। আলেকজান্ডার এসব সাম্রাজ্যের পাশাপাশি ইতিহাসে প্রথম যুক্ত করলেন ইউরোপের মেসিডোনিয় সাম্রাজ্যের কথা। তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা এ তিন মহাদেশ জুড়ে।

আলেকজান্ডার প্রথমেই দৃষ্টি দিলেন তার পিতার রেখে যাওয়া প্রতিপক্ষ পারস্য সাম্রাজ্যের দিকে। ততদিনে পারস্য সাম্রাজ্যের বয়স ২০০ বছরেরও বেশি। সেই সময় পর্যন্ত সভ্যতার ইতিহাসে এ সাম্রাজ্য ছিল আয়তনে সবচেয়ে বড়। এ বিশাল সাম্রাজ্যকে দখল করার জন্য পশ্চিম দিক থেকে এগিয়ে এলেন আলেকজান্ডার। ৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হেলেসপন্ট অতিক্রম করে এসে পারস্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন আলেকজান্ডার। একের পর এক পারস্য শহর জয় করে এগিয়ে যেতে লাগলেন মিসরের দিকে। পারস্য শহর ব্যাবিলন, সুসা, পার্সেপোলিস, ইকতেবানা, জেরুজালেম সবই চলে এল আলেকজান্ডারের হাতে।

৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য রাজ তৃতীয় দারায়ুস নিহত হলে আলেকজান্ডার সমগ্র পারস্য সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। এখানেই শেষ নয়। পারস্য থেকে বিপুল ধনরত্ন নিয়ে তিনি অগ্রসর হলেন ভারতের দিকে। আফগানিস্তান বিজয় করে তিনি খাইবার গিরিপথ অতিক্রম করে ঢুকলেন ভারতবর্ষে। সিন্ধুর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত করলেন তার সাম্রাজ্য। এই ভারতে এসেই আলেকজান্ডার তার সেনাপতিকে বলেছিলেন, “সত্যিই সেলুকাস! কী বিচিত্র এ দেশ।” কথিত আছে ভারতের কাঁঠাল খেয়ে আলেকজান্ডারের সৈন্যরা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ইতোমধ্যে মেসিডোনিয়া থেকে তাদের বেরিয়ে আসার দশ বছর পেরিয়ে গেছে। তাই আলেকজান্ডার আর না এগিয়ে ক্লান্ত সৈন্যদের নিয়ে রওনা দিলেন স্বদেশের পথে। এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় ব্যাবিলনে পৌছে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন আলেকজান্ডার। এটা ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ঘটনা।



কথিত আছে আলেকজান্ডার বলতেন, মৃত্যুর পরে তার হাত দুটি যেন কফিনের দু পাশে ঝুলিয়ে দেয়া হয় যাতে পৃথিবীর মানুষ দেখতে পায় দুনিয়া বিজয়ী বীর নিঃস্ব অবস্থায় পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন। গল্পে আছে, আলেকজান্ডার নাকি পৃথিবীর মানচিত্র দেখে হতাশ হয়ে বলেছিলেন- “হায়! দখল করার মত কোন দেশই আর অবশিষ্ট নেই।”
আলেকজান্ডার ছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটলের ছাত্র। তার বাবা ফিলিপ ছেলেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা দার্শনিকের কাছে পড়িয়েছিলেন। তাই আলেকজান্ডার জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি খুবই উৎসাহী ছিলেন। তিনি ছিলেন জ্ঞান ও শিল্পের পৃষ্টপোষক। তবে আলেকজান্ডার যুদ্ধের ময়দানে খুবই নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিতেন। থিবস অধিকার করে শুধু তার বীরত্বকে প্রদর্শন করার জন্য ৭০০০ মানুষকে হত্যা করেছিলেন। এটাই ইতিহাসের এক অদ্ভুত সত্য। যে যত বড় হত্যাকারি ইতিহাসে সে ততো বড় বীর। বিজ্ঞানের পৃষ্টপোষকতাও করতেন তারাই।

অ্যাসিরীয় সম্রাট আসুরবানিপালের (৬৬৮-৬৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মতই আলেকজান্ডার যুদ্ধক্ষেত্রে পরিচয় দিতেন চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতার। কিন্তু গড়ে তুলেছিলেন পৃথিবীর সেরা লাইব্রেরি। এ লাইব্রেরি তিনি স্থাপন করেছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ায়। পুরনো সভ্যতা মিসরের নীল নদের মোহনায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন আলেকজান্দ্রিয়া শহর। এছাড়াও সিরিয়ায় এন্টিয়ক নামে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নগর তিনি গড়ে তোলেছিলেন। আলেকজান্ডার আলেকজান্দ্রিয়াকে তাঁর রাজধানী বানাতে চেয়েছিলেন। এখানে স্থাপন করেছিলেন লাইব্রেরি। তাঁর লাইব্রেরিতে প্রায় পাঁচ লক্ষ বই ছিল। আসুরবানিপালের নিনেভার লাইব্রেরির পরে এটা সভ্যতার ইতিহাসের দ্বিতীয় বড় লাইব্রেরি। শুধু লাইব্রেরি নয় এটা ছিল একাধারে বিশ্ববিদ্যালয়, মিউজিয়াম, শিক্ষাকেন্দ্র, গবেষণা ও জ্ঞান চর্চার জায়গা।

আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য তাঁর সেনাপতিদের মাঝে ভাগ হয়ে যায়। আলেকজান্দ্রিয়া কেন্দ্রিক আফ্রিকান অংশটি নেন টলেমি, গ্রিস ও মেসিডোনিয়াকে নিয়ে ইউরোপীয় অংশটি নেন এন্টিগোনাস আর মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে এশীয় অংশটি নেন সেলুকাস। সেলুকাস রাজধানী করেন এন্টিয়ককে, টলেমি করেন আলেকজান্দ্রিয়াকে। টলেমির সময়ে আলেকজান্দ্রিয়া জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার চর্চায় সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়। আলেকজান্দ্রিয়া যেন হয়ে ওঠে নতুন এথেন্স। বিভিন্ন দেশের বড় বড় পন্ডিতদের স্কলারশিপ দিয়ে টলেমি আলেকজান্দ্রিয়ায় নিয়ে যান। আজকে আমরা বিদ্যালয়ে যে জ্যামিতি পড়ি, তার প্রায় পুরোটাই টলেমির সময়ে আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে বসে আবিষ্কার করেন গণিতবিদ ইউক্লিড। জ্যামিতির ওপর রচিত ইউক্লিডের ‘এলিমেন্টস’ বইটি ছিল তের খন্ডে সমাপ্ত। বিদ্যালয়ে যে জ্যামিতি শিখানো হয় তার অধিকাংশই নেওয়া হয় ‘এলিমেন্টস’ এর প্রথম ছয় খন্ড থেকে। ইউরোপে মধ্যযুগে বাইবেলের পর সবেচেয়ে জনপ্রিয় ছিল এই বইটি।

শুধু আলেকজান্দ্রিয়া নয়, আলেকজান্ডারের সাথে আরেকটি শহরের ইতিহাসের যোগসূত্রও আলোচনার দাবী রাখে। সেই শহরের নাম জেরুজালেম। ইতিহাসের সেই অমর জেরুজালেম! আলেকজান্ডার মিসর ও জেরুজালেম দখল করেন ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। ৩৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিসর ছেড়ে অগ্রসর হন পুর্ব দিকে। আলেকজান্ডার যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই শাসন ক্ষমতায় বসিয়েছেন মেসিডোনীয় বা গ্রিকদের। এদের সাথে স্থানীয়দের রক্তের মিশ্রণ ঘটে যায়। বর্তমান আফগানিস্তানের কটা চুলের অধিকারিরা এ সংমিশ্রনের সাক্ষ্য বহন করছে। তাদের শরীরে বয়ে চলেছে গ্রিক ও মেসিডোনীয়দের রক্ত। জাতিতে জাতিতে এই মিশ্রণ পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর এবং তাই হওয়া উচিত আরও বেশি পরিমাণে। কারণ জাতীয় সংকীর্ণতা ও দম্ভ পৃথিবীতে শুধু বিপর্যয় ও মানবতার অবমাননাই ঘটিয়েছে। এর সবচেয়ে ঘৃণ্য নিদর্শন ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণবাদ ও ইষ্রার ইহুদি জাতির বিশুদ্ধতার বিধান। ইষ্রার নগরী জেরুজালেমেও আলেকজান্ডার স্বদেশী শাসক বসান। সেখানে নিশ্চিত ভাবেই বিজয়ীদের সাথে স্থানীয় ইহুদিদের রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছে। ইষ্রার ইহুদি জাতির বিশুদ্ধতার বিধান মিলিয়ে গিয়েছে হওয়ায় ।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থি, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।


মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১০:৩৬

নতুন বলেছেন: চমতকার বিষয় +

একটু বেশি বড় হয়ে গেছে। বেশি বড় হলে পড়তে ভয় হয় :)

২| ২৭ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ১০:৪০

সাইফুল মনোয়ার নিশাদ বলেছেন: পড়লাম ভাল লাগল

৩| ০৩ রা আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৪

ইমরান আশফাক বলেছেন: আর্য্য সভ্যতা শেষ, এখন পরবর্তী সভ্যতায় যাওয়া যাক।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.