নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইতিহাসের পাঠশালায়

আসিফ আযহার

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আসিফ আযহার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-১৪ | রোমান সাম্রাজ্যের ধর্ম: শাসকপূজা বনাম একত্ববাদ

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:৩৬


প্রায় ৫০০ বছরের রোমান প্রজাতন্ত্রের ইতিহাস যেন লাগাতার যুদ্ধ-সংঘাত ও লাগামহীন নৃশংসতার ইতিহাস। বহুমাত্রিক শ্রেণি সংঘর্ষ ও ক্ষমতার দ্বন্দে ভরপুর রোমান প্রজাতন্ত্রের ইতিহাস যেন রক্তের কালিতে লেখা। প্লেবিয়ান-প্যাট্রেসিয়ান সংঘাত, বণিক-প্যাট্রেসিয়ান সংঘাত, কখনও প্যাট্রেসিয়ানদের বিরুদ্ধে বণিক ও প্রলেতারিয়ানদের মিলিত সংঘাত, আবার কখনও প্রলেতারিয়ানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বণিক ও প্যাট্রেসিয়ানদের সংঘাত, বিদ্রোহী ক্রীতদাসদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রলেতারিয়ান, বণিক ও প্যাট্রসিয়ানদের সম্মিলিত যুদ্ধ - এতসব সংঘাত ও সংঘর্ষ পৃথিবীকে এতবেশী রক্তাক্ত করেছিল যে পৃথিবী যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। মানবতা যেন গুমরে কেঁদে মরছিলো। সবচেয়ে সস্তা হয়ে পড়েছিলো মানুষের রক্ত ও জীবন। স্বার্থের কারণে মানুষের জীবন দেওয়া সমাজ জীবনের স্বাভাবিক অংশে পরিণত হয়েছিলো।

শ্রেণি সংঘর্ষকে ছাপিয়ে গিয়েছিল সেনানায়কদের ক্ষমতার উচ্চাভিলাষ বাস্তবায়নের জন্য বেঁধে যাওয়া গৃহযুদ্ধ। পম্পেই, জুলিয়াস সিজার, মার্ক এন্টনি, ক্লিওপেট্রা একে একে সকলেই নির্মম পরিণতি বরণ করেছিলেন। নৃশংসতা ও নির্মমতায় ভরপুর রোমান প্রজাতন্ত্রের বিশাল অধ্যায় জুড়ে মহত্ত্ব ও মানবতার কোন ছিটাফোঁটাও ছিলো না। ছিলো শুধু ক্ষমতা, অর্থ, ভোগবিলাস ও শোষণ-লুণ্ঠনের নারকীয় লালসা। কার চেয়ে কে বেশি প্রজাদের শোষণ করবে, কার চেয়ে কে বেশি ক্রীতদাসের মালিক হবে, প্রচন্ড ভোগবাদী জাগতিক স্বার্থ চর্চায় কে কার চেয়ে এগিয়ে যাবে এটা নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা লেগে গিয়েছিল। কোন দয়া নেই, মায়া নেই, করুণা ও সহানুভূতি নেই। সর্বত্রই মানবতার প্রচন্ড হাহাকার। মানুষের প্রতি দয়া বা মানুষের জন্য ত্যাগ ছিলো হাস্যকর ধারণা। পৃথিবী যেন ছিলো এক হৃদয়হীন পাষাণপুরী। ক্রীতদাস, প্রজা ও গরীবের জীবন যে কতটা নারকীয় হয়ে উঠেছিলো, শোষক শ্রেণির ভোগবিলাসের খোরাক যোগাতে গিয়ে - তার খবর কেউ রাখত না।

দাস মালিকদের বিশাল আয়তনের কৃষি খামার ল্যাটিফান্ডিয়ায় সারাদিন পশুর মতো খাটতো অসংখ্য ক্রীতদাস। এছাড়াও বণিকদের জাহাজ ও কলকারখানায় পশুর মতো খাটতো ক্রীতদাসেরা। রাষ্ট্রের মালিকানাধীন ক্রীতদাসেরাও দিন রাত বেগার খাটতো। প্রজাদের চলাফেরার স্বাধীনতা থাকলেও ক্রীতদাসদের তা ছিলো না। তাদের বিয়ে ও সন্তান নেওয়ারও সুযোগ ছিলো না। হালের পশুর অবস্থাও তাদের চেয়ে উন্নত ছিলো। রোমান সাম্রাজ্য তার ভোগের সমস্ত বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলো ক্রীতদাসদের মাথায়।

কৃষি উৎপাদনের বেশির ভাগই হতো ল্যাটিফান্ডিয়ায়। তাই প্রজা বলতে যারা ছিলো তারা কৃষি কাজে তেমন একটা থাকতো না, বরং সেনাবাহিনীতে কিংবা বেকার অবস্থায় থাকতো। উৎপাদনে শ্রমের চাহিদা দাস শোষণ থেকে মিটে যাওয়ায় জমিতে প্রজা বসানোর দরকার পড়ত না। তাই দেশের মানুষের একমাত্র সুযোগ ছিলো সেনাবাহিনীতে অংশ নিয়ে পরদেশে দখল করে লুণ্ঠনের বখরা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা। পরদেশ দখলেও দাস মালিকদের লাভের ভাগটা থাকতো বড়। সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বও ছিলো তাদের হাতে।


চিত্র: অগনিত ক্রীতদাসের জীবনের বিনিময়ে রচিত হয়েছিল রোমান স্থাপত্যের গৌরব

সামাজিক সম্পদের আসল অংশটাই দাস মালিকদের হাতে থাকায় প্রজাতন্ত্রের রাজনৈতিক অধিকার প্রজাসাধারণের কোন কাজে লাগেনি। রোমান প্রজাতন্ত্রে কখনোই কৃষকদের জমির অধিকার স্বীকার করা হয়নি। গ্রেকাস ভাইদের আইন ও ভূমি মালিকানা সংকারের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি। গ্রিক গণতন্ত্রেরও একই অবস্থা। এটি ছিলো দাস মালিকদের নিজেদের গণতন্ত্র। প্রজাতন্ত্র ও গণতন্ত্র উভয় ব্যবস্থায়ই উৎপাদনের মূল কারিগর ক্রীতদাসকে দ্বীপদী পশু হিসেবে গণ্য করা হতো। গ্রিক গণতন্ত্র ও রোমান প্রজাতন্ত্রের ভিত্তিই ছিলো দাস শোষণ।

ইতিহাসে দেখা যায় টলেমিদের মিসর কিংবা সেলুসিডদের সিরিয়ার রাজতন্ত্রী শোষণ ব্যবস্থা রোমান প্রজাতন্ত্রের চেয়ে কম রক্তপাতময় ছিলো। তাহলে গণতন্ত্রই হোক আর প্রজাতন্ত্রই হোক, রাজতন্ত্রের সাথে তার তফাৎ ছিলো উনিশ আর বিশের তফাৎ। গণতন্ত্র-প্রজাতন্ত্র-রাজতন্ত্র সবই ছিলো নিষ্ঠুর দাস নিপীড়ক সমাজ ব্যবস্থা। এসব ব্যবস্থায় ক্রীতদাসের নিজেকে মানুষ বলে দাবী করাটাও ছিলো অপরাধ। অন্যদিকে গণতন্ত্র-প্রজাতন্ত্রের ধারক বাহক শ্রেণি ও সামন্ততন্ত্রী রাজ-রাজড়ারা নিজেদেরকে দেবতা বা প্রভু বলে দাবী করতো। শোষক শ্রেণি তাদের স্বরচিত ধর্মের ছড়ি ঘোরাতো ক্রীতদাস ও প্রজাসাধারণের ওপর।

এসব ধর্মে খোদা ও প্রভুর জায়গায় ছিলেন শাসক নিজেই। মানুষকে শোষণ করা, মানুষকে অত্যাচার করা ও লাগামহীন বিলাসিতা করার সমস্ত অধিকার ও বৈধতা শাসক শ্রেণি নিজেদের বানানো ধর্মীয় বিধান থেকে আদায় করে নিতেন। খোদা যা খুশি করতে পারেন। তাকে ঠেকাবার কেউ নেই। অতএব রাজা যেহেতু খোদা বা দেবতা শ্রেণীর লোক তাকে ঠেকাবার কেউ নেই। তাহলে সেই সকল মানুষ যারা ক্রীতদাস, যারা প্রজা, শোষকের তরবারির নিজে যাদের জীবন পরিণত হয় যন্ত্রণাময় বিভীষিকায় তাদের জীবনে এ ধর্ম আরেকটি বিভীষিকা ছাড়া আর কী হতে পারে?


চিত্র: রোমান প্রজাতন্ত্রের প্রতীক ঈগল

গ্রিকো-রোমান প্যাগান ধর্মে শাসকের দৈব মর্যাদায় বিশ্বাস ছিলো ধর্মের অনিবার্য অংশ। মিসরীয় ফারাও বা মেসোপটেমিয়ার শাসকদেরকে দেবতা হিসেবে যেভাবে পূঁজা করা হতো সেভাবেই গ্রিকো-রোমান-মেসিডোনিয়ান শাসকদেরকেও দেবতূল্য জ্ঞান করা হতো। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁকে আলেকজান্দ্রিয়ায় সমাহিত করে দেবতার মর্যাদা দেওয়া হয়। ফারাওদের মতোই টলেমিদের আমলেও মিসরে শাসকপূঁজা খুবই ব্যাপকতা লাভ করেছিল।

প্রথম টলেমি ও তাঁর রাণী প্রথম বেরেনিসকে ত্রাণকারী দেব-দেবী হিসেবে পূঁজা করা হতো। তাদের মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় টলেমি আরও একধাপ এগিয়ে জীবিত অবস্থায়ই রাজা-রাণীকে পূঁজা করার প্রথা রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রচলন করেন। দ্বিতীয় টলেমি ফিলাডেলফাস ও তাঁর রাণী দ্বিতীয় আরসিনো জীবিত অবস্থায়ই দেবতার মর্যাদা আদায় করেছিলেন। এই ধর্ম-ব্যবস্থা পরবর্তী রাজা রাণীরাও চালু রেখেছিলেন।

এটা চালু ছিলো ক্লিওপেট্রার সময় পর্যন্ত। সে যুগের বিভিন্ন সরকারি দলিল ও আবেদনপত্রে দেখা যায় ক্লিওপেট্রার পিতা দ্বাদশ টলেমি আউলেটসকে ‘আমাদের খোদা ও ত্রাণকর্তা রাজা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ৫২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার নাগরিকরা আউলেটস ও তাঁর সন্তানদের নামে একটি মন্দির উৎসর্গ করেন। এতে রাণী হওয়ার আগেই ক্লিওপেট্রা দেবী বনে যান।

খ্রিস্টপূর্ব ৪২ সালের ১ জানুয়ারি রোমান সিনেট জুলিয়াস সিজারকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেবতা বলে ঘোষণা করে। এরপর অক্টেভিয়ানও নিজেকে ‘দেবতা জুলিয়াসের পুত্র’ বলে ঘোষণা করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪২-৪১ সালের শীতকালে ইফেসাসে (বর্তমান তুরস্কের পশ্চিমাঞ্চলের সমুদ্র বন্দর) মার্ক এন্টনিকেও দেবতার মর্যাদা দেওয়া হয়। ইফেসাসে প্রাপ্ত একটি শিলালিপিতে তাঁকে যুদ্ধের দেবতা মারস ও প্রেমের দেবী ভেনাসের পুত্র এবং মানবজাতির ত্রাণকর্তা বলে উল্লেখ করা হয়।

ক্লিওপেট্রা ও এন্টনির বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ককেও দৈব ব্যাপার বলে গণ্য করা হতো। মিসরীয়রা বিশ্বাস করতো ক্লিওপেট্রা ছিলেন দেবী আইসিসের প্রতিরূপ। দেবী আইসিস ক্লিওপেট্রার রূপ ধরে নাকি পৃথিবীতে এসেছিলেন! মিসরীয়দের বিশ্বাস ছিলো রাজারা দেবতা অসিরিসের অবতার। দেবতা অসিরিসের সাথে দেবী আইসিসের বিয়ের পার্থিব প্রতিফলন ছিলো এন্টনি ও ক্লিওপেট্রার সম্পর্ক।

খ্রিস্টপূর্ব ২৭ সালে রোমান সিনেট অগাস্টাস সিজারকে ‘অগাস্টাস’ অর্থাৎ ‘পবিত্রব্যক্তি’ উপাধী প্রদান করে। ইতিহাসে তিনি এই নামেই পরিচিত। প্যাগান ধর্মে শেখানো হতো শাসকই খোদার প্রতিভূ। শাসকপূঁজারি এসব ধর্মের যুক্তি ছিলো শোষিতদের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। দাস বিদ্রোহ ছিলো ধর্ম-বিরোধী কাজ। তাই দাস-বিদ্রোহ কোন ধর্মীয় অনুপ্রেরণা প্রসূত ছিলো না; ছিলো ধর্ম-বিরোধী। দাসদের কোন ধর্মীয় অধিকার ছিলো না। দাস বিদ্রোহের ক্ষেত্রে ধর্ম ছিল অন্যতম বাধা।


চিত্র: রোমের কলোসিয়াম প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম

অন্যদিকে প্রাচ্যের সেমেটিক নবিদের প্রচারিত একত্ববাদ ছিলো ধর্মের আদলে রাজদ্রোহের প্রতীক। শাসকপূঁজারি ধর্মের বিপরীতে একত্ববাদ শুধুমাত্র একজন প্রভুর উপাসনার কথা বলে। ইব্রাহিম ও মুসা রাজদ্রোহী হয়েছিলেন একত্ববাদ প্রচারের কারণেই। শাসকের দৈব মর্যাদাকে অস্বীকার করে একত্ববাদ স্বীকৃতি দিয়েছে শুধুমাত্র একজন প্রভুর দৈব মর্যাদাকে। একত্ববাদ বলে আসল খোদা একজন এবং তিনি অদৃশ্য; তিনি মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেমেটিক নবিরা এই ধর্মীয় বিশ্বাসে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে শাসকপূঁজারি ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। এই বিদ্রোহ কখনও রাজনৈতিক বিদ্রোহে রূপ নিয়েছে; আবার বিভিন্ন সময়ে তা পরাজিত ও পরাধীন রাজনৈতিক জীবনে সান্তনার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

এই নবি আগমণের ধারাবাহিকতায়ই আবির্ভাব ঘটেছিলো যিসাসের। রোমান সাম্রাজ্য তখন গৃহযুদ্ধের সংকট কাটিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে নিয়ে অখন্ড রূপ ধারণ করেছে। রোমের সম্রাট এই অখন্ড সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্তায় পরিণত হন। গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত জনজীবনে দেখা দিয়েছে হাহাকার আর স্থবিরতা। প্রবল পরাক্রমশালী নব্য রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিটি বিদ্রোহই শেষ হচ্ছিল ব্যর্থতা ও পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। তাই অখন্ড সাম্রাজ্যজুড়ে পরাজিত প্রজাজীবনে সান্তনা ও আশার প্রতীক হিসেবে একত্ববাদী প্রাচ্য ধর্মই যে একটি শক্তিশালী অবলম্বন হিসেবে দেখা দেবে সে সম্ভাবনা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। রোমান সাম্রাজ্যের অখন্ডতার ফলেই প্রাচ্যের খ্রিস্টধর্ম একসময় পাশ্চাত্যেও ছড়িয়ে পড়তে পেরেছিলো।

অগাস্টাস সিজার বিজয়গর্বে বলেছিলেন, তিনি চিরকালের মতো শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু তিনি জানতেন না এটা ছিলো কবরখানার শান্তি। সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা ধ্বংসের কিনারায় এসে পৌছে গিয়েছিল। শুধুমাত্র মিসরের অর্থনৈতিক জীবন কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলো। তা ছাড়া সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশগুলির অর্থনৈতিক জীবন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌছেছিলো। বাণিজ্য প্রায় বন্ধ; বিক্রেতা আছে ক্রেতা নেই। কারিগরদের অবস্থা শোচনীয়। প্রাচ্যের প্রজাদের ওপর বাড়িয়ে দেয়া হয় করের বোঝা। এর ওপর রাজপ্রভুদের জন্য বাধ্যতামূলক শ্রমের চাপে তারা বিপর্যস্ত।

স্বচ্ছল জীবন ছিলো শুধু ধনবান রোমান দাস মালিকদের। গৃহযুদ্ধের সময় লুটের মাল হাত করে তারা প্রভুত ধনের মালিক হয়। আগে শুধু অভিজাত প্যাট্রেসিয়ানরাই দাস-মালিক হতো। এখন শুধু অভিজাত প্যাট্টেসিয়ানরাই নয়, বণিকরাও প্রচুর পরিমাণে দাস ও জমির মালিক হয়ে গিয়েছে। গৃহযুদ্ধের সময়কার লুণ্ঠনের অর্থ মালিকরা খরচ করছিলো বিলাসিতায়। কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ ছিলো অনিশ্চিত। ধন তারা খরচ করছিলো ঠিকই কিন্তু সঞ্চয়ের নতুন পথ খোলা ছিলো না। কোন দেশ আর বাকি ছিলো না যা রোমান দাস মালিকদের লুণ্ঠনে উজাড় হয়নি।


চিত্র: আগুনে পুড়ছে রোম

প্রথম শতকের সম্রাটরা আর্থ-রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়নের চেষ্টা করেছিলেন। আগেকার সিনেটের কনসালরা তাদের ১ বছরের মেয়াদ শেষে প্রোকনসাল হয়ে যেকোনো বিজিত রোমান দেশের গভর্নর হয়ে বসতেন। সেখানে তারা স্বৈরশাসনের মাধ্যমে ব্যাপক লুণ্ঠন চালিয়ে নিজের ধনভান্ডার সমৃদ্ধ করতে পারতেন। সংস্কারের সময় এদেরকে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। স্বৈরশাসনের পরিবর্তে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হয়। প্রদেশের শাসকের নাম হয় প্রকুরেটার। প্রকুরেটারকে শাসন সংক্রান্ত বিবরণ রোমের সদর দপ্তরে পাঠাতে হতো। প্রজাদের অভিযোগে প্রকুরেটারকে অপসারণের ব্যবস্থাও রাখা হয়। প্রজাদের উপর দুটি কর আরোপ করা হয়। পোলকর ও ভূমিকর। বিজিত দেশসমূহের প্রজাদেরকে রাষ্ট্রের নাগরিকত্ত্বও দেয়া হয়।

কিন্তু এসব সংস্কার সাম্রাজ্যকে উদ্ধার করতে পারলো না। শোষণের মাত্রা কমেনি। ক্রীতদাসদের অবস্থা আগের মতই রইল। শতবর্ষব্যাপী গৃহযুদ্ধের ধকল সইতে হলো ক্রীতদাস ও প্রজাদেরকেই। ইতিহাসের একটি আমোঘ সত্য হলো শাসকদের যুদ্ধের ধকল ভোগ করতে হয় জনগণকেই। সেই সময়ে সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। রোমের অধিবাসী ছিলো প্রায় পাঁচ লক্ষ। এদের মধ্যে বেকার প্রলেতারিয়ানদের সংখ্যাই ছিলো দুই থেকে তিন লক্ষ। সম্রাটের পক্ষ থেকে এদের মধ্যে বিনামূল্যে রুটি বিতরণের ব্যবস্থা করা হয় এবং নানা ধরনের বিনোদনের মাধ্যমে তাদেরকে শান্ত রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বিদ্রোহ থেকে তাদেরকে নিবৃত্ত করা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। রুটি ও বিনোদনের মাধ্যমে তাদেরকে কোনমতে শৃঙ্খলায় রাখা সম্ভব হলেও দাস এবং বিজিত দেশের প্রজাদের শান্ত রাখা খুবই মুশকিল হয়ে পড়েছিলো।

রোমান ঐতিহাসিকরা বলেন যিসাসের জন্মের পরের প্রথম শতকেও খন্ড বিদ্রোহ কিছুদিন পরপরই দেখা দিয়েছে। বিদ্রোহ সামলাতে শাসকরা নৃশংস পদ্ধতির আশ্রয় নেন। কঠোর আইনের দ্বারা দাসদেরকে শায়েস্তা করা হয়। একজন ক্রীতদাস বিদ্রোহ করলে মালিকের ঘরে যত ক্রীতদাস রয়েছে তাদের সবাইকেই ফাঁসি দেওয়ার আইন করা হয়। এই জল্লাদের আইনেও দাসদেরকে মুখ বুজে দুঃসহ শোষণ ও অত্যাচার মেনে নিতে বাধ্য করা যায়নি। অন্যদিকে ইতালির বাইরে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে প্রজারা সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করতো। শতবর্ষী গৃহযুদ্ধের খরচের চাপে তাদের অর্থনৈতিক জীবনের মেরুদন্ড ভেঙে গিয়েছিল। যুদ্ধ শেষ হলেও তাদের অবস্থার বিন্দুমাত্র উন্নয়ন হয়নি।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:৫৪

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর লেখা। বেশ গোছানো।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.