নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইতিহাসের পাঠশালায়

আসিফ আযহার

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আসিফ আযহার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-১৭ | সেইন্ট পল ও কনস্টানটাইন

২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:০৫


যিসাসের অন্তর্ধানের পর ইহুদি ও রোমান কর্তৃপক্ষের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য বহু খ্রিস্টান ফিলিস্তিন ছেড়ে সিরিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিল। এসব বিতাড়িত খ্রিস্টানদের প্রতি হঠাৎ সহানুভূতি তৈরি হয়ে যায় ইহুদি পন্ডিত সল (Paul) এর মনে। তিনি একাধারে ছিলেন ইহুদি শাস্ত্রজ্ঞ আবার গ্রিক দর্শনেও বিশেষজ্ঞ। খ্রিস্টানদের প্রতি করুণা তাঁর জীবন ও উপলদ্ধিতে নিয়ে আসে পরিবর্তন। যিসাসের বাণী তাকে মুগ্ধ করে। তাই ইহুদি ধর্ম ছেড়ে গ্রহণ করেন খ্রিস্টধর্ম। যিসাসের শিষ্য হিসেবে নিজের নাম পাল্টে রাখেন ‘পল’ (Saul).

তাই ইতিহাসে তিনি সেইন্ট পল নামে পরিচিত। সেইন্ট পল খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন যিসাসের অন্তর্ধানের পরে, আনুমানিক ৩৪ সালে। যিসাসের বাণী প্রচারের জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন। বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি সিরিয়া, মেসিডন, থেসালী, গ্রিস ইত্যাদি প্রভৃতি দেশ পরিভ্রমণ করেন। গ্রিক ভাষায় প্রথম বাইবেল রচনা করেন তিনি। বর্তমানে যে বাইবেল আমরা পাই তা সেইন্ট পলের লেখা গ্রিক বাইবেল থেকেই এসেছে।

মূল বাইবেলের কিছু অংশ ছিলো আরামীয় ভাষায় লেখা, আর বাকী অংশ ছিলো হিব্রু ভাষায় লেখা। সেইন্ট পল সেগুলোকে গ্রিক ভাষায় অনুবাদ করে ইউরোপীয়দের কাছে বাইবেলের বার্তা পৌঁছে দেন। সেইন্ট পলের অনুবাদের মাধ্যমেই ইউরোপীয়রা বাইবেল পড়ার সুযোগ পায়। ফলে তাদের জন্য খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করা সহজ হয়ে যায়। এজন্য আমরা বলতে পারি ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের প্রসারের পেছনে সেইন্ট পলের অবদানই সবচেয়ে বেশি। সেইন্ট পলের মতো আরেকজন বিখ্যাত খ্রিস্টধর্ম প্রচারক হলেন সেইন্ট সাইমন পিটার।


চিত্র: সেইন্ট পল

সেইন্ট পল এবং সেইন্ট পিটার খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। দুজনকেই জীবনদান করতে হয়েছিল। সেইন্ট পিটারকে যেখানে হত্যা করা হয়, বহুদিন পরে (রেনেসাঁর যুগে) সেখানে নির্মিত হয় বিখ্যাত সেইন্ট পিটার চার্চ। সেইন্ট পিটার আত্মদান করেছিলেন ৬৭ সালে। পরবর্তীতে পোপন্ত্রের উদ্ভবের পর সেইন্ট পিটারকে প্রথম পোপ বলে ঘোষণা করা হয়। তাঁর পোপ পদের মেয়াদকাল ধরা হয় ৩৩ থেকে ৬৭ সাল পর্যন্ত। খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে সেইন্ট পলের ভূমিকাটি বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছে। সেইন্ট পলই সর্বপ্রথম খ্রিস্টধর্মকে তত্ত্বীয়ভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপদানের উদ্যোগ নেন।

এ কাজটি তাঁর জন্য সহজ ছিলো এ কারণেই যে তিনি সেমেটিক ধর্মজগৎ সম্পর্কে যতোটা অভিজ্ঞ ছিলেন, পাশ্চাত্যের গ্রিকো-রোমান দর্শন সম্পর্কেও ততটা বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল বিনইয়ামিন গোত্রীয় এক ইহুদি পরিবারে। বড় হয়ে তিনি গ্রিক দর্শনে শিক্ষালাভ করেন। ফলে সেমেটিক ধর্মের জীবনচেতনা আর পাশ্চাত্য দর্শনের জীবনবোধ- দুটোর গভীরেই ছিলো তাঁর অবাধ বিচরণ । এজন্য তিনি পাশ্চাত্য জীবনপ্রবাহের গভীরে সেমেটিক ধর্মচেতনা স্থাপনে সক্ষম হন। যেভাবে গ্রিক দর্শনে জীবন সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নে আলোচনা হতো সেভাবে খ্রিস্টধর্মের আলোকে তিনি জীবন সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের ব্যাখ্যা দানে সচেষ্ট হন।

সে সময়ে পুরনো গ্রিক দর্শনের জগতে নানা সংকট দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ রোমান পন্ডিত তখন পুরনো এপিকিউরীয়বাদ ছেড়ে স্টোয়িকবাদে আশ্রয় নিচ্ছেন। কারণ এপিকিউরীয়বাদের গতানুগতিক চিন্তার সাথে বাস্তবের দূরত্ব দেখা দিচ্ছিল। কিছু কিছু রোমান পন্ডিতকে আকৃষ্ট করছিলো নব্য প্লেটোবাদ। এ মতবাদে আত্মার অবিনশ্বরতা ও পরকালের ধারণা ছিলো। এসব দর্শনে মানুষের আবেগ ও আশাবাদ প্রাধান্য পাচ্ছিল। কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যের জীবন ধারায় আরও গভীর আশাবাদ ও আবেগ নির্ভর জীবন দর্শনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল যা এসব দর্শনের সংকীর্ণতাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হবে।

খ্রিস্টমতবাদ এই দার্শনিক শূন্যতা পূরণে সক্ষম হয়। মানুষ পুরাতন সংকীর্ণ জীবনবোধ থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্মকে একটি শক্তিশালী অবলম্বন হিসেবে পেয়ে যায়। সংকীর্ণ গ্রিক দর্শন এবং ঝরাগ্রস্থ ইহুদি সংরক্ষণবাদ থেকে খ্রিস্টধর্ম যে অনেকগুণ এগিয়ে ছিলো তা খ্রিস্টধর্মের জোয়ার দেখেই বোঝা যায়। সেইন্ট পল খ্রিস্টধর্মকে অনেকদূর ব্যাখ্যা করেছিলেন। তবে এ নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে। কেউ কেউ দাবি করেন সেইন্ট পল খ্রিস্টধর্মে নিজস্ব ধারণা সংযুক্ত করেছেন এবং বাইবেল সংকলনের সময় সমাজের প্রচলিত সূত্র থেকে পাওয়া উপকরণ বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

এ প্রসঙ্গে একজন নিবেদিত খ্রিস্টান ও বিখ্যাত ইংরেজ কবি জন মিল্টন তাঁর অ্যারিওপ্যাজিটিকা নামক পুস্তিকার তৃতীয় অধ্যায়ে বলেন, ‘মুসা, দানিয়েল ও পল ছিলেন সে যুগের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী অর্থাৎ সমস্ত মিসরীয়, ক্যালদীয় ও গ্রিক বিদ্যায় সুপন্ডিত। সে যুগে লভ্য সব শ্রেষ্ঠ জ্ঞানে জ্ঞানী না হয়ে নিশ্চয়ই তাঁরা এতো বিখ্যাত হননি। বিশেষ করে সেইন্ট পল যিনি তিনজন গ্রিক কবি ও একজন গ্রিক ট্রাজেডি রচয়িতার বাক্য অবলীলায় পবিত্র গ্রন্থ বাইবেলে অনুপ্রবিষ্ট করান এবং তিনি তা মোটেও দোষের মনে করেননি ...।’

তবে সেইন্ট পল খ্রিস্টধর্মকে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে যিসাসকে কতটা অনুসরণ করেছিলেন আর কতটা ছিলো তাঁর নিজের সংযোজন সে ব্যাপারে আজ এতদিন পরে নিশ্চিত হওয়ার আর কোনো উপায় নেই। খ্রিস্টধর্মের উপর যিসাসের শিক্ষা হতে সরে আসার অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু সেটা সেইন্ট পলের কারণেই হয়েছে নাকি তাঁরও পূর্ববর্তী বা পরবর্তী কারও দ্বারা হয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। এর একটি বড় কারণ যিসাসের বাণী কোনো শক্তিশালী দলিলে সংরক্ষিত হয় নি; হয়েছে অনেকের মুখে মুখে। ফলে অনেক কিছুই বদলে গেছে ও নতুন সংযোজন ঘটেছে।

তাই সেইন্ট পলের সংযোজন কোনো বিচিত্র ঘটনা নয় এবং এটা না করলেও যে যিসাসের সকল বাণী অভিন্নরূপে পাওয়া যেতো- তা নয়। বাইবেলের ইনজিল অংশটিকে আমরা পাই যিসাসের সঙ্গী ও অনুসারীদের বক্তব্যের আকারে। তাই ইনজীল পুস্তকটি কোনো একক বক্তব্য বা বিবৃতির সংকলন নয়। এসব কারণে খ্রিস্টধর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও বার বার প্রচন্ড বিভক্তি দেখা দিয়েছে এবং অসংখ্য মত ও পথের জন্ম হয়েছে যার জটিলতা থেকে এ ধর্ম কখনোই মুক্ত হতে পারেনি। তবে এ সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এ ধর্ম মানুষকে অনেক ভরসা দিতে পেরেছিল।


চিত্র: প্রাচীন রোম

সেইন্ট পল প্রাথমিক খ্রিস্টধর্মের সাথে গ্রিকো-রোমান চিন্তা-চেতনার সমন্নয় ঘটান। ফলে গ্রিকো-রোমানদের জন্য খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করা অনেকটা সহজ হয়ে ওঠে এবং পৌত্তলিক সহ সব সম্প্রদায়ের লোকজন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। জেরুজালেম ও ফিলিস্তিনের প্রাথমিক ধারার খ্রিস্টানরা সেইন্ট পলের মতাদর্শ গ্রহণ করতে চায়নি। তাই তিনি ফিলিস্তিনের বাইরে গিয়ে অন্য ধর্মের মানুষের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হন এবং ব্যাপক সাড়া পান। এর ফলে খ্রিস্টধর্মীরা অনেকটা দু-অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একপক্ষ পুরনো ধারার খ্রিস্টান আর আরেকপক্ষ সেইন্ট পলের অনুসারী নবদীক্ষিত খ্রিস্টান। দ্বিতীয় শতকের দ্বিতীয় ভাগ পর্যন্ত এ বিভাজন স্থায়ী ছিলো। শেষ পর্যন্ত সেইন্ট পলের মতাদর্শই বিজয় লাভ করে। সেইন্ট পলের দ্বারা ব্যাখ্যাকৃত খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটায় অন্য অংশটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

বিখ্যাত খ্রিস্টধর্মগুরু বার্নাবাসও সেইন্ট পলকে সমর্থন করেছিলেন। সেইন্ট পলের হাতে পূর্ণতাপ্রাপ্ত খ্রিস্টধর্মকে Pauline Christianity বলেও উল্লেখ করা হয়। সেইন্ট পলের কর্মময় জীবনের একটি বড় অংশ কেটেছিলো রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী রোম নগরীতে। পরে ধর্মপ্রচারের জন্য সেখানে আসেন সেইন্ট পিটার। রোম নগরীর অধিবাসীদের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের প্রসারের পেছনে রয়েছে দুজনের অবদান। রোমান শাসকরা এ নগরীতে দুজনকেই হত্যা করেছিল। এজন্য এ নগরীর সাথে খ্রিস্টানদের ধর্মীয় আবেগ জড়িয়ে আছে। সেইন্ট পল ও সেইন্ট পিটারের সূত্রেই রোম নগরীর সাথে স্থাপিত হয় খ্রিস্টধর্মের আধ্যাত্মিক বন্ধন।

রোমের সাথে খ্রিস্টধর্মের এই ধর্মীয় পবিত্রতার বন্ধন জেরুজালেমকেও ছাড়িয়ে যায়। এটা সেমেটিক ধর্মের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। জেরুজালেম, হেবরন প্রভৃতি নগরী সেমেটিক ধর্মের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের বাহক। তাই এসব নগরী সেমেটিক ধর্মীয় ধারায় খুবই পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। জেরুজালেম সবসময়ই সেমেটিক ধর্মের প্রধান তীর্থকেন্দ্র ও পূণ্যভূমি হিসেবে বিবেচিত ছিলো। কিন্তু খ্রিস্টধর্মে রোম নগরী জেরুজালেমের চেয়েও বেশী ধর্মীয় গুরুত্ব অর্জন করেছে। এছাড়াও বাইজানটিয়াম নগরীর সাথেও খ্রিস্টধর্মের গভীর আধ্যাত্মিক বন্ধন স্থাপিত হয়েছিল। বর্তমান সময়ে রোমের ভ্যাটিকান হলো খ্রিস্টধর্মের সবচেয়ে পবিত্র জায়গা ও ধর্মীয় রাজধানী।

রোমের অধিবাসীদের মধ্যে প্রথমদিকে যারা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল তারা তাদের ধর্মসভা করত অত্যন্ত গোপনে। রোম নগরীতে নির্মাণ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় পাথর কেটে আনা হতো শহরতলী এলাকার শিলা পাহাড় থেকে। পাথর কেটে নেয়ায় শিলা পাহাড়ের গায়ে যে বিরাট বিরাট গর্ত সৃষ্টি হয় সেগুলোকে খ্রিস্টানরা তাদের গোপন সমাধি মন্দিরে পরিণত করে। রোমান সাম্রাট ডমিটিয়ান খ্রিস্টান নিধন শুরু করলে প্রাণে বেঁচে যাওয়া খ্রিস্টানরা এসব সমাধিগৃহে এসে আত্মগোপন করেছিল। শাসকশ্রেণির নিপীড়নের মুখে দীর্ঘ সময় জুড়ে রোম নগরীর অভ্যন্তরেই খ্রিস্টধর্মের টিকে থাকা ও প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে এসব সমাধি মন্দিরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। নিপীড়নের অবসানের পর রোমই হয়ে উঠেছিল খ্রিস্টধর্মের মূল কেন্দ্র। সেইন্ট পিটার রোমে একটি ছোট ধর্মমন্দির স্থাপন করেছিলেন। এখানেই তাকে হত্যা করা হয়েছিল। রেনেসাঁর যুগে এখানেই গড়ে উঠেছিল বিখ্যাত সেইন্ট পিটার চার্চ।

খ্রিস্টধর্মের দুঃসময়ের অবসান হয় চতুর্থ শতকের শুরুতে এসে। সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ানের (২৮৪-৩০৫ খ্রি.) শাসনের অবসানের পর এ দুঃসময়ের শেষ হয়। দুঃসময়ের দীর্ঘ যুগের একেবারে শেষ দিকে সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ানের সময়েই খ্রিস্টধর্ম সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। খ্রিস্টধর্মের প্রসার রোধে সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ান খ্রিস্টানদের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ চালান তা খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ। কিন্তু এ নিধনযজ্ঞ খ্রিস্টধর্মকে দমাতে পারল না। খ্রিস্টধর্ম এক প্রবল জোয়ার সৃষ্টি করে সারা রোমান সাম্রাজ্য জুড়ে। জোয়ারের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ক্রীতদাস ও সাধারণ দরিদ্র রোমানদের। এমনকি এ জোয়ারের স্রোত পৌঁছে যায় রোমান সিংহাসন পর্যন্ত। ডায়োক্লেটিয়ানের মৃত্যুর পরের বছর রোমান সিংহাসনের অধিকারী হন সাম্রাট কনস্টানটাইন (৩০৬-৩৩৭ খ্রি.)।

খ্রিস্টধর্মের গুরুত্ব প্রথম অনুভব করেছিলেন সম্রাট কনস্টানটাইন। কনস্টানটাইন এমন এক সময়ে সম্রাট হয়েছিলেন যখন গৃহযুদ্ধ আর বর্বর আক্রমণের চাপে সাম্রাজ্য ধ্বংসের মুখে। কনস্টানটাইন বুঝতে পেরেছিলেন এর ওপর আবার খ্রিস্টান প্রজাদের শত্রুতা সাম্রাজ্যের বিপদ আরও বাড়িয়ে তোলবে। তিনি দেখলেন এ অবস্থা চলতে থাকলে সাম্রাজ্যের পতনের আর বেশি দেরী নাই। তাই তিনি সাম্রাজ্যকে পতনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। এর প্রথমটি ছিলো গৃহশত্রু ম্যাক্সেনটিয়াসের বিরুদ্ধে অভিযান। মিলভিয়ান সেতুর যুদ্ধে তিনি ম্যাক্সেনটিয়াসকে পরাজিত করেন। দ্বিতীয় পদক্ষেপটি ছিলো তিনি খ্রিস্টধর্ম চর্চার ওপর আরোপিত সকল বিধিনিষেধ তুলে নিয়ে খ্রিস্টধর্মকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। আর শেষ পদক্ষেপটি ছিলো রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী তিনি দূরে সরিয়ে নিয়ে যান।


চিত্র: সম্রাট জননী সেইন্ট হেলেনা

কনস্টানটাইন বুঝতে পেরেছিলেন বর্ববদের হাতে রোমের পতনের আর বেশি দেরি নেই; রোমের পতন ঠেকানোর মতো সামর্থও আর রোমানদের নেই। তাই তিনি রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী সরিয়ে নিলেন বর্বরদের আক্রমণের আওতার একেবারে বাইরে। ৩৩০ সালে তিনি রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গেলেন এশিয়া ইউরোপের মোহনায়, দূরের বাইজানটিয়ামে। পরবর্তীতে, ৩৮০ সালে এ নগরীতেই সম্রাট থিওডোসিয়াস খ্রিস্টধর্মকে রাজধর্ম ঘোষণা করেছিলেন।

সম্রাট কনস্টানটাইন শুধু খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসেই নয়, বরং সমগ্র বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্রাট। কনস্টানটাইন রোমান সম্রাটদের মধ্যে সর্বপ্রথম খ্রিস্টধর্মকে স্বীকৃতি প্রদান করে ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব অধ্যায়ের সূচনা করেন। খ্রিস্টধর্মের প্রতি সম্রাট কনস্টানটাইনের এতটা সদয় হওয়ার পেছনে তাঁর মায়েরও একটি ভূমিকা ছিলো। কনস্টানটাইনের সম্রাট হওয়ার পূর্বেই খ্রিস্টধর্মের জোয়ারে প্রভাবিত হয়ে সম্রাট জননী দীক্ষিত হয়ে গিয়েছিলেন এ ধর্মে। ইতিহাসে তিনি সেইন্ট হেলেনা নামে পরিচিত।

খ্রিস্টধর্মীয় সূত্র দাবি করে সম্রাট জননী সেইন্ট হেলেনা জুডিয়ায় এসে যিসাসের কথিত ক্রশবিদ্ধ হওয়ার স্থানে গমন করেন এবং সেখানকার একটি বিশিষ্ট স্থান খনন করে ‘ট্রু ক্রস’ এর সন্ধান লাভ করেন। এরপর সেখানে এক রোমান প্রাসাদ নির্মাণ করে পবিত্র স্থানকে প্রাসাদের ছাদের অভ্যন্তরে নিয়ে আসেন। এভাবে যিসাসের স্মৃতিচিহ্ন সুরক্ষার ব্যবস্থা করে তিনি খ্রিস্টধর্মীদের কাছে অমর হয়ে আছেন। সম্রাট কনস্টানটাইনকে খ্রিস্টধর্মের প্রতি আগ্রহী করে তোলার পেছনে তাঁর মায়ের একটি প্রভাব ছিলো - একথা সহজেই অনুধাবন করা যায়। অতীতে মিসরের রানী তিয়ে যেভাবে তাঁর পুত্র ফারাও ইখনাটনের ধর্ম বিশ্বাসকে প্রভাবিত করেছিলেন সে রকম কনস্টানটাইনের জননী সেইন্ট হেলেনাও তাঁর পুত্রের ধর্ম বিশ্বাসকে প্রভাবিত করেছিলেন। দুটি ঘটনার মধ্যে রয়েছে অদ্ভূত মিল!

কনস্টানটাইন যখন সম্রাটের আসনে বসেন তখন রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে চরম সংকট ঘনিয়ে উঠেছিল। সংকটের অন্যতম কারণ ছিলো গৃহযুদ্ধ। সম্রাট কনস্টানটাইনকে গৃহযুদ্ধ দমনের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হয়েছিল। গৃহশত্রু ম্যাক্সেনটিয়াসের বিরুদ্ধে সম্রাট ৩১২ সালে মিলভিয়ান সেতুর যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। কথিত আছে, যুদ্ধ শুরুর আগ মুহুর্তে সম্রাট হঠাৎ আকাশের গায়ে একটি ক্রসের চিহ্ন দেখতে পান যার নিচে লেখা ছিলো ‘এই চিহ্ন অনুসরণ করে জয়লাভ কর’।

শুনা যায়, এরপর সম্রাট যুদ্ধে জয়লাভ করে খ্রিস্টধর্মের উপর থেকে রাষ্ট্রীয় বিধি নিষেধ তুলে নেন। আরেকটি বিবরণ অনুসারে জানা যায়, সম্রাট কনস্টানটাইন যুদ্ধের আগের রাতে হঠাৎ স্বপ্নে দেখেন যে তাকে ক্রুশ চিহ্ন অনুসরণ করে বিজয় লাভ করতে বলা হচ্ছে। পরের দিন সম্রাট তাঁর সৈন্যদেরকে তাদের বর্মের ওপর ক্রুশ চিহ্ন অঙ্কিত করার আদেশ দেন এবং তাঁর আদেশ পালন করে সৈন্যরা যুদ্ধে বিজয় অর্জন করে।

যুদ্ধ জয়ের পরের বছর সম্রাট খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রীয় বৈধতা প্রদান করেন। ৩১৩ সালে ইতালির মিলান শহর থেকে সম্রাট ঘোষণা দেন যে, এখন থেকে খ্রিস্টানরা স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতে পারবে। একই সাথে সম্রাট ক্রুশবিদ্ধ করে মৃত্যুদন্ড প্রদানের পুরনো প্রথা বাতিল করে দেন। সম্রাট রবিবারকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত খ্রিস্টান বিশ্বে রবিবার ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সম্রাট কনস্টানটাইনের এই বিখ্যাত ঘোষণা ‘Edict of Milan’ নামে পরিচিত।

এরপর একে একে রোমান সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী দেশগুলোতেও খ্রিস্টধর্মের স্বীকৃতি মিলতে থাকে। ৩১৪ সালে আর্মেনিয়ায় খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। ৩১৯ সালে জর্জিয়া এবং ৩২৫ সালে ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রধর্ম হয় খ্রিস্টধর্ম। আরও পরে, ৩৮০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রোমান সম্রাট ১ম থিওডোসিয়াস ‘Edict of Thessalonica’ ঘোষণার মাধ্যমে খ্রিস্টধর্মকে রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্মে পরিণত করেন।

‘Edict of Milan’ ঘোষিত হওয়ার পরে সর্বক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্মের প্রতীক ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়। তবে এক্ষেত্রে কিছুট ব্যতিক্রম ছিলো রোমান মুদ্রা। পরবর্তী আট বছর পর্যন্ত রোমান দেব-দেবীদের ছবি অঙ্কিত মুদ্রা প্রস্তুত করা হতো। কনস্টানটাইন চার্চ সংগঠনকে প্রচুর অর্থকড়ি দান করতে শুরু করেন এবং যাজকদের ওপর থেকে সকল কর মওকুফ করে দেন। তিনি প্রচুর ব্যাজিলিকা নির্মাণ করেন ও বহু খ্রিস্টানকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার আসনে বসান। এছাড়াও ডায়োক্লেটিয়ানের সময় খ্রিস্টানদের যেসব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তা ফেরত প্রদান করেন। কনস্টানটাইন সবচেয়ে বড় যে কাজটি শুরু করেছিলেন সেটি হলো কনস্টানটিনোপল নগরী নির্মাণ। ৩২৪ থেকে ৩৩০ সালের মধ্যে তিনি বসফরাসের তীরে নির্মাণ করেছিলেন বাইজানটিয়াম নগরী যা পরবর্তীতে তাঁর নামানুসারে কনস্টানটিনোপল নামে পরিচিত হয়।

কনস্টানটাইনের মাধ্যমে খ্রিস্টধর্ম দীর্ঘ তিন শতকের নিপীড়ন থেকে মুক্ত হয়ে প্রথমবারের মতো স্বীকৃতির দেখা পেলো। খ্রিস্টধর্ম তখন চিরদিনের জন্য রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন থেকে মুক্তি পায়। খ্রিস্টধর্ম পালনে আর কোনো রাষ্ট্রীয় বিধি নিষেধ রইল না। খ্রিস্টধর্মের এই সুদিনের সূচনা খ্রিস্টধর্মীদের জীবনে আনন্দের বার্তা নিয়ে এলো বটে, কিন্তু তা আরেকটি শূন্যতাকেই সঙ্গী করে নিয়ে এলো। রাষ্ট্রীয় চাপের মুখে এতদিন ধরে বেড়ে ওঠা খ্রিস্টধর্ম মুক্ত পরিস্থিতিতে এসে এক ধরণের সংকটের মুখে পড়ে। বাস্তব সামাজিক জীবন বিমুখতাই ছিলো খ্রিস্টধর্মের মূল শিক্ষা। মুক্ত পরিস্থিতিতে যখন বাস্তব সামাজিক জীবনে অংশগ্রহণের বিশাল সুযোগ এসে উপস্থিত হলো তখন এ শিক্ষা কোনো কাজে লাগল না।

দীর্ঘ সময়জুড়ে প্রতিকূল অবস্থায় (persicution) থাকতে থাকতে খ্রিস্টধর্ম বাস্তব জীবন থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। সামাজিক ও জাগতিক জীবন থেকে অতিমাত্রায় বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে সামাজিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণের কোনো ধারণা খ্রিস্টধর্মে গড়ে ওঠেনি। খ্রিস্টধর্ম গোড়া থেকেই ছিলো সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে উদাসীন। দাস সমাজের জীবন ব্যবস্থাকে পাল্টে দেয়ার শক্তি খ্রিস্টধর্মের ছিলো না। তাই খ্রিস্টধর্মে নতুন কোনো আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধারণা সৃষ্টি হয়নি। ফলে মুক্ত সময়ে সে খ্রিস্টধর্ম প্রচলিত আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার পাশাপাশি একটি আলাদা ধর্মীয় ব্যবস্থারূপে আত্মপ্রকাশ করে।

সমাজবিমুখ আধ্যাত্মবাদ নির্ভর খ্রিস্টধর্ম মুক্ত পরিস্থিতিতে এসে রোমান সাম্রাজ্যের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে নতুন কোনো পথের দিশা দিতে পারল না। সমাজ জীবন ও অর্থনীতির মধ্যে বৈষম্য ও অন্যায়ের যেসব শর্ত লুকিয়ে থাকে তা নিয়ে খ্রিস্টধর্ম কখনোই প্রশ্ন তুলেনি। বরং আধ্যাত্মিক সান্তনাকেই পুঁজি করে টিকে থেকেছে খ্রিস্টধর্ম; টিকে থেকেছে হতাশার অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া মানুষের সান্তনার শেষ অবলম্বন হিসেবে। মানুষ খ্রিস্টধর্মের আধ্যাত্মিক প্রেরণাকে আঁকড়ে ধরে যখন বেঁচে থাকতে চায় একমাত্র তখনই খ্রিস্টধর্মের মহত্বের দিকটি ফুটে ওঠে। এছাড়া অন্য কোনো দিকে খ্রিস্টধর্মের তেমন কোনো অবদান নেই।

দীর্ঘদিনের প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে টিকে থাকতে গিয়ে খ্রিস্টধর্ম এতদিনে পরিণত হয় জগৎ বিমুখ আশাবাদের এক আধ্যাত্মিক প্রতীকে। জাগতিক জীবনকে ভুলে থাকাই ছিলো এ ধর্মের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। কিন্তু সব মানুষের বেলায় জাগতিক জীবনকে ভুলে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আর খ্রিস্টধর্মের দুঃসময়ের অবসানের পর জাগতিক জীবনকে ভুলে থাকার কোনো প্রয়োজনও রইল না। এই পরিস্থিতিতে জাগতিক পথ বাদ দিয়ে আধ্যাত্মিক আশাবাদে নিমজ্জিত থাকার কোনো মানে ছিলো না। তাই এসময় থেকে খ্রিস্টধর্মের যাজকদের সংগঠন তথা চার্চ জাগতিক সুযোগ-সুবিধা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির দিকে আগ্রহী হয়ে উঠতে থাকে। প্রভাব প্রতিপত্তিকে কেন্দ্র করে খ্রিস্টধর্মের অভ্যন্তরে বিভাজন ও বিতর্কের জন্ম হয়। একসময় খ্রিস্টধর্মজগতের অভ্যন্তরে মতাদর্শিক বিভাজন ও বিতর্ক চরম আকার ধারণ করে। ফলে খ্রিস্টধর্ম বলতে আর একটি একক ধর্ম থাকেনি, আলাদা আলাদা কতগুলো ধর্মে পরিণত হয় এটি।

একেবারে গোঁড়ায় খ্রিস্টধমের্র অভ্যন্তরে যে শক্তিশালী উপধারার সৃষ্টি হয় সেটি হলো আরিয়ান মতবাদ (Arianism)। আরিয়ান বিতর্কের মূল বিষয় ছিলো খ্রিস্টধর্মের Holy Trinity অর্থাৎ পবিত্র ত্রিত্ব-র প্রশ্নে। ত্রিত্ব হলো পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা হিসেবে যীসাসকে ইশ্বর বা প্রভু মনে করার বিষয়টি। একই সাথে ইশ্বরকে পিতা, পুত্র ও পবিত্র সত্ত্বা হিসেবে ব্যাখ্যা করার ঘোর বিরোধী ছিলেন খ্রিস্টধর্মের গুরু আরিয়াস (জন্ম: ২৫৬ সাল, মৃত্যু: ৩৩৬ সাল)। তিনি ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার একজন প্রেসবাইটার। তাঁর মতবাদকে বলা হয় আরিয়ান মতবাদ। তাঁর মতে জাগতিক সত্ত্বার অধিকারী যিসাস ইশ্বর হতে পারেন না। এই মতবাদের মূল বিষয়বস্তু হলো: Jesus Christ is the Son of God, but is entirely distinct from and subordinate to the God the Father. The Son of God did not always exist, but was created by and is therefore distinct from God the Father.

এই বিতর্ক ক্রমে ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। অবশেষে এই সংকট মোচনের জন্য সম্রাট কনস্টানটাইন ৩২৫ সালে নিকাইয়া অঞ্চলে সমস্ত চার্চের ধর্মগুরুদের নিয়ে একটি সম্মেলন আহবান করেন। এ সম্মেলন ছিলো খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসের সাতটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মধ্যে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন (First Ecumenical Council)। কনস্টানটাইনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে আরিয়াসের দাবি গৃহীত হয়নি। ঐতিহাসিক এই সভায় চার্চসমূহ যিসাসকে ইশ্বর, ইশ্বরপুত্র ও পবিত্র আত্মা- এসব সত্ত্বায়ই প্রতিষ্ঠিত করে। নিকাইয়া সম্মেলনে খ্রিস্টধর্মের মূল ধারা একত্ববাদের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। এ বিচ্যুতি থেকে মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা থেকে পরবর্তীতে আরও ধারা-উপধারার জন্ম হয়।

সম্রাট কনস্টানটাইন খ্রিস্টধর্মের তত্ত্বীয় ও মতাদর্শিক সকল বিতর্কের অবসানের জন্য নিকাইয়া সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু এ সম্মেলন খ্রিস্টধর্মের আভ্যন্তরীণ বিতর্কের কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে পারল না। নিকাইয়া সম্মেলন Trinitarian Christianity অর্থাৎ ত্রিত্ববাদী খ্রিস্টধর্মকেই গ্রহণ করে। এ ধর্মীয় ব্যাখ্যা নিকাইয়ান ধর্মমত বা Nicene Creed নামেও পরিচিত। নিকাইয়া সম্মেলনের পরবর্তীতে খ্রিস্টধর্মকে মতাদর্শিক ও ধর্মীয় বিতর্কে আরও বেশী জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। এর বেশ পরবর্তীতে একসময় খ্রিস্টধর্মের বিভিন্ন ধারা নিপীড়িত মানুষের সান্তনার প্রতীক না হয়ে বিতর্ক ও বিরোধের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। তাই খ্রিস্টধর্মের অবদান ও অধঃপতন দুটিই অনিবার্য ঐতিহাসিক সত্য। খ্রিস্টধর্মের অবদান ও অধঃপতনকে বুঝতে হলে এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে। খ্রিস্টধর্মের গৌরব ও ব্যর্থতার আপেক্ষিক তুলনা খুবই দূরুহ কাজের একটি।


চিত্র: কনস্টানটাইন

কনস্টানটাইনের মৃত্যু-পরবর্তী সম্রাটদের মধ্যে ২য় কনস্টানটিয়াস (৩৩৭-৩৬১ খ্রি.) এবং সম্রাট ভ্যালেন্স (৩৬৪-৩৭৮ খ্রি.) ব্যক্তিগতভাবে আরিয়ান মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তারা খ্রিস্টধর্মের আরিয়ান বা অর্ধ-আরিয়ান সংস্করণকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। এ দুজনের মধ্যবর্তী আরেকজন সম্রাট জুলিয়ান দ্য অ্যাপোস্টেট খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করে পুরনো রোমান পৌত্তলিক ধর্মেই ফিরে যান। তিনি ছিলেন একজন নব্য-প্লেটোবাদী (Neo-platonic) দার্শনিক। তিনি পৌত্তলিক ধর্মের নব্য-প্লেটোবাদী ও অতীন্দ্রিয়বাদী সংস্করণকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি পুরনো রোমান মন্দিরগুলো আবার খুলে দেন। জুলিয়ান খ্রিস্টধর্মের সাংঠনিক পদ্ধতিকে একটি কার্যকর ব্যবস্থা মনে করতেন এবং এ ধর্মের সেবামূলক কাজকে জনপ্রিয়তা অর্জনের একটি ভাল পন্থা ভাবতেন। তাই তিনি পৌত্তলিক ধর্মাচারকে খ্রিস্টধর্মের অনুকরণে সংস্কার করতে উদ্যোগী হন।

তিনি পৌত্তলিক ধর্মে খ্রিস্টধর্মের বিশপ-শাসিত ধর্মীয় সংগঠনের (episcopal structure) অনুরূপ ধর্মীয় কাঠামো গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এবং পৌত্তলিক ধর্মাচারের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের অনুকরণে মানব সেবারও (public charity) প্রচলন ঘটান। তাঁর পূর্বে পৌত্তলিক ধর্মে মানবসেবার কোনো দৃষ্টান্ত বা ধারণা কখনও দেখা যায় না। জুলিয়ানের এসব প্রচেষ্টা খ্রিস্টধর্মকে নতুনভাবে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। কিন্তু সম্রাট জুলিয়ান প্রাচ্য অঞ্চলে এক সফরের সময় হঠাৎ মারা গেলে তাঁর সংক্ষিপ্ত শাসনামলের অবসান ঘটে এবং তাঁর ধর্ম সংস্কারও চিরতরে বিলুপ্তি লাভ করে। এরপরে ক্ষমতায় বসেন সম্রাট ভ্যালেন্স; ভ্যালেন্স- এর পর ১ম থিওডোসিয়াস (৩৭৯-৩৯৫ খ্রি.)।

কনস্টানটাইনের মতো সম্রাট থিওডোসিয়াসও খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে আছেন। তিনি সম্রাট ২য় কনস্টানটিয়াস (৩৩৭-৩৬১ খ্রি.) ও সম্রাট ভ্যালেন্স (৩৬৪-৩৭৮ খ্রি.) এর মতো আরিয়ান ভাবাপন্ন ছিলেন না; ছিলেন Trinitarian বা ত্রিত্ববাদী। ৩৮০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সম্রাট ১ম থিওডোসিয়াস থেসালনিকা থেকে Trinitarian Christianity অর্থাৎ ত্রিত্ববাদী খ্রিস্টধর্মকে রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম (official religion) বলে ঘোষণা করেন। এ ঘোষণা Edict of Thessalonica নামে পরিচিত। এ ঘোষণা ছিলো নিকাইয়ান ধর্মমতেরই (Nicene Creed) পুনরুচ্চারণ। এ ঘোষণা Nicene Creed অনুযায়ী ব্যাখ্যাকৃত Trinitarian doctrine অর্থাৎ ত্রিত্ববাদকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।

নিকাইয়ান ধর্মমত (Nicene Creed) খ্রিস্টধর্মজগতে আরেক দফা চূড়ান্ত ও স্থায়ী মতবাদরূপে গৃহীত হয় ৩৮১ সালে সম্রাট থিওডোসিয়াস কর্তৃক আয়োজিত খ্রিস্টধর্মের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (Second Ecumenical Council)। এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে। তাই এ সম্মেলনকে কনসস্টান্টিনোপলের প্রথম সম্মেলনও বলা হয়। এ সম্মেলনে আরিয়ান মতবাদকে ধর্মবিরোধী (heretic) আখ্যা দেওয়া হয়। সম্রাট থিওডোসিয়াস ঘোষণা দেন যে, যারা ‘Trinity’ এর মতো ‘faithful tradition’ এ বিশ্বাস করবে না তাদেরকে ধর্মদ্রোহী হিসেবে গণ্য করা হবে। শুধু তাই নয়, এ ঘোষণা অনুযায়ী ৩৮৫ সালে প্রথমবারের মতো Priscillian নামে একজন কথিত ধর্মদ্রোহীকে (heretic) শাস্তিও দেওয়া হয়।

কিন্তু এতসবের পরও চতুর্থ শতকের খ্রিস্টধর্মের অন্যতম জনপ্রিয় ধারা আরিয়ানিজম (Arianism) বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এ সম্পর্কে উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে: A popular doctrine of the 4th century was Arianism, the denial of the divinity of Christ, as propounded by Arius. Though this doctrine was condemned as heresy and eventually eliminated by the Roman Church it remained popular underground for some time. In the late 4th century Ulfilas, a Roman bishop and an Arian, was appointed as the first bishop to the Goths, the Germanic peoples in much of Europe at the borders of and within the Empire. Ulfilas spread Arian Christianity among the Goths firmly establishing the faith among many of the Germanic tribes, thus helping to keep them culturally distinct.

নিকাইয়া ও কনস্টানটিনোপলের সম্মেলন খ্রিস্টধর্মমতকে যে ব্যাখ্যার ওপর দাঁড় করায় তাকে সাধারণত Niceno-Constantinopolitan Creed বলা হয়। এ ধর্মমত অনুযায়ীই খ্রিস্টধর্মের মূল ধারা গড়ে ওঠে। ধর্মীয় ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্মজগতে এ ধারা অনুসরণ করা হলেও প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রশ্নে খ্রিস্টধর্মীয় চার্চ সংগঠন ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেনি।

খ্রিস্টধর্মে প্রচলিত রাষ্ট্রের বিকল্প কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার কোনো ধারণা কখনোই ছিলো না। কিন্তু রোমান সাম্রাজ্য ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্রমশ পতনের সাথে সাথে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে চার্চের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ভূমিকার আবেদন ক্রমেই জোরালো হতে থাকে। তাই খ্রিস্টধর্ম প্রচলিত রাষ্ট্র-ব্যবস্থার পাশাপাশি একটি আলাদা বিকল্প ধর্মীয়-প্রশাসনিক ব্যবস্থারূপে আত্মপ্রকাশ করে। রাষ্ট্র-ব্যবস্থার বিকল্প এই ধর্মীয়-প্রশাসনিক ব্যবস্থার নামই ছিলো চার্চ সংগঠন। ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের ইতিহাসের পুরো অধ্যায় জুড়ে দেখা যায় রাষ্ট্রের পাশাপাশি চার্চের অস্তিত্ব। মধ্যযুগীয় সমাজব্যস্থতার অন্যতম স্তম্ভ ছিলো এই চার্চ। মধ্যযুগীয় ইউরোপের সমাজের ওপর চার্চের নিয়ন্ত্রণ অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তাই বলা যায়, মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সমাজের শক্তিকেন্দ্র দুটি অংশে বিভক্ত ছিলো। একটি হলো রাষ্ট্র আর অন্যটি হলো চার্চ।

চার্চের উত্থান সম্পর্কে উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে: After its establishment, the Church adopted the same organisational boundaries as the Empire: geographical provinces, called dioceses, corresponding to imperial governmental territorial division. The bishops, who were located in major urban centres as per pre-legalisation tradition, thus oversaw each diocese. The bishop's location was his "seat", or "see". Among the sees, five came to hold special eminence: Rome, Constantinople, Jerusalem, Antioch and Alexandria. The prestige of most of these sees depended in part on their apostolic founders, from whom the bishops were therefore the spiritual successors. Though the bishop of Rome was still held to be the First among equals, Constantinople was second in precedence as the new capital of the empire.

যিসাস নিজে তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর অনুসারীদেরকে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ধর্মীয় সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে সুসজ্জিত করে যাননি। কারণ সেসময় তাঁর অনুসারিদের সংখ্যা ছিলো সীমিত। তিনি নিজেই সরাসরি তাদেরকে নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। সে সময়ে তাঁর ধর্মমতের মূল বিষয় ছিলো শুধু একটি শক্তিশালী চেতনা। এ চেতনার ভিত্তিতেই তাঁর অনুসারীরা পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত হয়েছিলেন। সংগঠিত ধর্মীয় সমাজ গড়ে উঠেছে আরও পরে। যখন যিসাসের শিষ্যদের দ্বারা এ ধর্মের প্রসার হতে থাকে তখন ক্রমশ সংঘবদ্ধ প্রার্থনারীতিকে কেন্দ্র করে এ ধর্মের অনুসারিদের মধ্যে একটি ধর্মীয় কাঠামো গড়ে উঠতে থাকে। এ সাংগঠনিক কাঠামো কী ধরণের হবে, সেটি ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার বিষয়। কিন্তু অন্যান্য সকল বিষয়ের মতোই যিসাস এ ব্যাপারেও তেমন কিছু বলে যাননি। তাই খ্রিস্টধর্মের পন্ডিত সেইন্টরাই সংঘবদ্ধ প্রার্থনা ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের ভেতর দিয়ে একটি ধর্মীয় সম্পর্কের কাঠামো গড়ে তোলেন।

ধর্মীয় প্রার্থনা ও আচার অনুষ্ঠান পালনের এ শৃঙ্খলার মধ্য থেকেই একসময় চার্চ সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। কনস্টানটাইনের হাতে খ্রিস্টধর্ম স্বীকৃতি পাওয়ার পর চার্চ সংগঠন চূড়ান্তভাবে আত্মপ্রকাশ করে। এর পরবতী দীর্ঘ ইতিহাসে চার্চের অনেক ভূমিকাই বিতর্কিত। এর কারণ ততদিনে চার্চের মানবিক আবেদন অনেকটাই ফুরিয়ে গিয়েছিল। খ্রিস্টধর্ম বিপ্লবী ধর্ম ছিলো না। তাই গোড়ার দিকে সমাজ জীবনকে এড়িয়ে চলার নীতিই গ্রহণ করেছিল খ্রিস্টধর্ম। কিন্তু এটা একসময় আর সম্ভব হলো না। খ্রিস্টধর্মের সামনে রাষ্ট্র উপস্থিত হয়েছিল প্রথমে এক দানবীয় শক্তিরূপে এবং পরে ত্রাণকর্তা হিসেবে। কনস্টানটাইনের হাতে স্বীকৃতিলাভের পর রাষ্ট্র খ্রিস্টধর্মের পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়।

শুরু হয় রাষ্ট্রের সমান্তরাল শক্তি হিসেবে চার্চের অগ্রযাত্রা। কিন্তু অগ্রযাত্রার ইতিহাসে গৌরবের তেমন কোনো উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ এ ধর্মের ওপর থেকে নিপীড়নের কালো মেঘ সরে যাওয়ায় এবং অনুসারীদের সংখ্যা অনেকগুণ বেড়ে যাওয়ায় এর আধ্যাত্মিক আশাবাদ নির্ভরতার স্থলে ক্রমেই জাগতিক প্রশ্নগুলো বড় হয়ে দেখা দিচ্ছিল। ফলে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার আবরণের মধ্যে এক ধরণের জাগতিকতা বিকশিত হয়। চার্চ পরিণত হয় সুযোগ-সুবিধা আদায়কারী প্রতিষ্ঠানে; সম্পদ ও কর্তৃত্বের আধার হয়ে ওঠে এটি। দুঃখ এবং যন্ত্রণার মধ্যে জীবন উৎসর্গের যে প্রেরণা মানুষ খ্রিস্টধর্মের কাছ থেকে পেয়েছিল মুক্ত পরিস্থিতিতে এসে সেই আত্মত্যাগের প্রেরণার প্রাসঙ্গিকতা অনেকটাই ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাই শুধু শুধু আধ্যাত্মিক আশাবাদের মধ্যে খ্রিস্টধর্মীরা পড়ে থাকবে না এটাই স্বাভাবিক।

প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টধর্মে জাগতিকতা ছিলো এক ধরনের পাপ। এ ধর্মে জাগতিকতার অনেক ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছে আধ্যাত্মিকতাকে। তাই সুসময়ের খ্রিস্টধর্মে জাগতিকতার অনুপ্রবেশ ঘটে আধ্যাত্মিকতার মোড়কেই। অর্থাৎ আধ্যাত্মবাদের আবরণের নিচে জাগতিক সুবিধার পথ প্রশস্থ হয়। এ ব্যাপারটি খ্রিস্টধর্মকে বৈপরীত্যের দিকে ঠেলে দেয়। খ্রিস্টধর্ম এবং চার্চের অভ্যন্তরে সুবিধাবাদ জন্ম নিতে থাকে। এভাবে খ্রিস্টধর্মের বিচ্যুতির দিকটি প্রকট হয়ে ওঠে এবং খ্রিস্টধর্ম ক্রমেই এক আচারস্বর্বস্ব মতবাদে পরিণত হতে থাকে। মধ্যযুগের শেষ দিকে খ্রিস্টধর্ম প্রচন্ড রক্ষণশীল ব্যবস্থায় পরিণত হয়।

দাস সমাজ ভেঙ্গে যে সামন্ত সমাজ জন্ম নিয়েছিল সে সামন্ত সমাজকেই পুরো মধ্যযুগ জুড়ে আঁকড়ে থেকেছিলো খ্রিস্টধর্ম। যে পৌরাণিক ধর্মীয় বিধান দ্বারা ক্রীতদাসরা মনুষ্যেতর জীব হিসেবে বন্দী হয়ে পড়েছিল, নতুন সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কের মধ্যে তাদেরকে মানুষ হিসেবে দৈব স্বীকৃতি প্রদানের মধ্যে দিয়ে সেই পৌরাণিক বিধান থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্ম যে সবচেয়ে বড় সহায়ক হয়ে উঠেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক শোষণ থেকে ভূমিদাসদের মুক্তির প্রশ্নে খ্রিস্টধর্ম বিন্দুমাত্রও মাথা ঘামায়নি। কারণ এটাকেই খ্রিস্টধর্ম চিরস্থায়ী ধরে নিয়েছিল এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজের মধ্যেই খ্রিস্টধর্ম নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছিল। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে রাষ্ট্রের পরেই ছিলো চার্চের অবস্থান।

সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপে চার্চের এতটা প্রভাবের মূলে রয়েছে রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার পতনের পর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে চার্চ সংগঠনের উত্থানের ঘটনা। দাস ব্যবস্থার পতন, বর্বর আক্রমণ ও আভ্যন্তরীণ সংকটে জর্জরিত রোমান সাম্রাজ্য যখন ভেঙ্গে পড়ছে তখন রাষ্ট্র ও প্রশাসনের বিকল্প হিসেবে চার্চকেই বেছে নেয়া হয়। চার্চকে বিশাল সুযোগ এনে দিয়েছিল আক্রমণকারী বর্বর গোষ্ঠীগুলো। রোমান সাম্রাজ্যকে তারা টুকরো টুকরো করে ভাগ করে নেয়। কিন্তু তাদের রাষ্ট্র ও প্রশাসন সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিলো না; কিন্তু তারা যাযাবর জীবন ছেড়ে সভ্য জীবনে প্রবেশ করতে ইচ্ছুক ছিলো। এজন্য তারা তাদের আদিম ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে দলে দলে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিল। তাই বর্বরদের ওপর চার্চের যথেষ্ঠ প্রভাব ছিলো।

বর্বর নেতারাও চার্চের হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব তোলে দিতে ইচ্ছুক ছিলেন। এভাবে প্রথমে রাষ্ট্রের বিকল্প ও পরে সমান্তরাল শক্তি হিসেবে চার্চের উত্থান ঘটে। ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির আধার হয়ে ওঠে চার্চ। ধর্ম ও রাজনীতি দুটিই লাভজনক ব্যাপারে পরিণত হয়। ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিকে কেন্দ্র করে চার্চের মধ্যে ভাঙন-বিরোধ-বিতর্ক ও বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে বারবার। বিভিন্ন দেশে আলাদা নতুন চার্চেরও জন্ম হয়েছে। বিভিন্ন চার্চের মধ্যে বিরোধ শুধু বিতর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং অসংখ্য রক্তাক্ত যুদ্ধ ডেকে এনেছে।

আগণিত মানুষের মৃত্যু এবং ধ্বংসের বিভীষিকায় বারবার ছেয়ে গিয়েছে ইউরোপ। চার্চের ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায় হলো ক্রসেড। ক্রসেড শুধু মুসলমানদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়নি। অর্থডক্স খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধেও পরিচালিত হয়েছে। ১২০৪ সালে ক্রসেডাররা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টানটিনোপলকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। বাইজেন্টাইন অর্থডক্স চার্চের সাথে রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিরোধের জের ধরেই ঘটেছিলো এটি। এসব ঘটনা মধ্যযুগের খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে অনেক বিতর্কের উপাদান রেখে গিয়েছে।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880


মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:০৫

রাজীব নুর বলেছেন: ইতিহাস বদলে যায়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.