নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইতিহাসের পাঠশালায়

আসিফ আযহার

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আসিফ আযহার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-২১ | মধ্যযুগের সূর্য বাইজানটিয়াম

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:১৪


বাইজানটিয়াম! সভ্যতার ইতিহাসের এক অনন্য বিস্ময়! পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের আকাশে যখন সভ্যতার সূর্য অস্তমিত, তখনও তা বাইজানটিয়ামের আকাশে সগৌরবে বিদ্যমান। রোমের আকাশে যখন ঘোর অমানিশা, বাইজানটিয়ামের আকাশে তখনও মধ্যদুপুর। রোম যখন সমস্ত গৌরব হারিয়ে ডুবতে বসেছে, বাইজানটিয়াম তখনও বয়ে নিয়ে চলেছে রোমান সভ্যতার ঐশ্বর্য্যের উত্তরাধিকার। বাইজানটিয়ামের এ যাত্রা এগিয়ে চলেছে বহু শতাব্দী ধরে। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনেরও হাজার বছর পর অবধি এ যাত্রা এগিয়ে চলেছিল। অবশেষে ইতিহাসের চিরন্তন নিয়মের পথ ধরে একদিন বাইজানটিয়ামেরও পতন ঘটে। ১৪৫৩ সালে তুরস্কের উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধিপতি সুলতান ফাতিহ মাহমুদের বাইজানটিয়াম বিজয়ের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে বাইজেন্টাইন সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাসের।

আর এ সমাপ্তির মধ্য দিয়েই সূচনা হয় সভ্যতার ইতিহাসের আধুনিক অধ্যায়ের। তাই বাইজানটিয়ামের উত্থান ও পতনের মধ্যবর্তী সময় সমগ্র সভ্যতার ইতিহাসেরই একটি পর্বের প্রতিনিধিত্ব করে। এ পর্বটি হল সভ্যতার ইতিহাসের মধ্যযুগ। রোমের পতনের মধ্য দিয়ে যে মধ্যযুগের সূচনা হয় তার সমাপ্তি ঘটে বাইজানটিয়ামের পতনের মধ্য দিয়ে।

বাইজানটিয়াম তার গৌরবের ইতিহাসের মধ্যে ধারণ করে রেখেছে সমগ্র মধ্যযুগকে। ইউরোপের প্রাচীন সভ্যতাগুলোর সমস্ত সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্য্য যখন বিলীন হয়ে গিয়েছে, বাইজানটিয়াম তখনও ইউরোপের দূর সীমানায় একাকী নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে জানান দিচ্ছিল হারিয়ে যাওয়া সেই সমৃদ্ধির ইতিহাসের কথা। পাশ্চাত্যের দূর সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা বাইজানটিয়াম মনে করিয়ে দিত পাশ্চাত্য সভ্যতার সেই সব সোনালী দিনের কথা।

বহু ঝড় ঝাপটা ঠেকিয়ে দিয়ে সুদীর্ঘ কাল পর্যন্ত টিকে গিয়েছিল এই সমৃদ্ধ নগরী। এমনকি সপ্তম শতকের ইসলামি খিলাফতের সেই বিশাল উত্থান- যা বিপুল তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এশিয়া-আফ্রিকার বিশাল জনপদ, তা-ও এসে থমকে গিয়েছিল বাইজানটিয়ামের সুউচ্চ দেওয়ালে। ইসলামের যে বিজয়ের ইতিহাস বিপুল বেগে এগিয়ে চলেছিল, আশ্চর্যজনকভাবে তার হাত থেকেও বাইজানটিয়াম বেঁচে গিয়েছিল বহু দিন ধরে।

বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য অথবা বাইজানটিয়াম শব্দটি মধ্যযুগীয় গ্রিকভাষী রোমানদের সাম্রাজ্যের সাধারণ নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই সাম্রাজ্যের অপর নাম হচ্ছে পূর্বাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্য বা পূর্ব-রোমান সাম্রাজ্য। অবশ্য পশ্চিমাঞ্চলীয় রোমান সম্রাজ্যের পতনের পরবর্তীতে এ সাম্রাজকে কেবল রোমান সাম্রাজ্য নামেও অভিহিত করা হতো। পশ্চিমাঞ্চলীয় রোমান সম্রাজ্যের পতন হয়েছিল ৪৭৬ সালে আর বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল ১৪৫৩ সালে।

অখণ্ড রোমান সাম্রাজ্য স্থায়ীভাবে দুটি আলাদা সাম্রাজ্যে বিভক্ত হয়েছিল ৩৯৫ সালে। সেবছর অখণ্ড রোমান সাম্রাজ্যের অধিপতি সম্রাট থিওডোসিয়াসের মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্রের মধ্যে বিশাল রোমান সাম্রাজ্য পূর্ব ও পশ্চিম- এ দুটি অংশে স্থায়ীভাবে বিভক্ত হয়ে যায়। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের আওতাধীন ছিল পশ্চিম ইউরোপের বিশাল এলাকা। অন্যদিকে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের আওতাধীন ছিল পূর্ব ইউরোপ, এশিয়ার মাইনর, মিসর, সিরিয়া (শাম), ফিলিস্তিন প্রভৃতি অঞ্চল।

বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে অনেকে গ্রিকদের সাম্রাজ্য নামেও অভিহিত করতো। কারণ এ অঞ্চলে গ্রিক সংস্কৃতির আধিপত্যই সবচেয়ে প্রকট রূপ ধারণ করেছিল। একই সাথে সেখানে গ্রিক সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জনগোষ্ঠী এবং মধ্যযুগীয় গ্রিক প্রথার বিস্তার ঘটেছিল। এ সভ্যতার যা কিছু সাংস্কৃতিক অগ্রগতি হয়েছে তার সিংহভাগ এসেছে গ্রিস থেকে, রোম থেকে নয়।

গ্রিক প্রভাবের পাশাপাশি প্রাচ্যদেশীয় সংস্কৃতির প্রভাবও গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে বাইজানটিয়ামে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক ও শিল্পচেতনার যা কিছু সংমিশ্রণ ঘটেছে তা হয়েছে এই বাইজানটিয়ামকে ঘিরেই। তবু শেষ বিচারে সাম্রাজ্যটিকে রোমান সম্রাজ্য নামেই অভিহিত করা যায় এবং এর সম্রাটদেরকে প্রাচীন রোমান সম্রাটদেরই অবিচ্ছিন্ন উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মোহনায়, ইউরোপ আর এশিয়ার মিলনক্ষেত্রে অবস্থিত বসফরাস প্রণালির তীরে ‘গোল্ডেন হর্ন’ বন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন গ্রিক শহর বাইজানটিয়াম। এ শহরকে প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেন রোমান সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ান। তাঁর রাজত্বকাল ছিল ২৮৪ সাল থেকে ৩০৫ সাল পর্যন্ত। ডায়োক্লেটিয়ান সম্রাট হওয়ার পর দেখলেন যে, বিশাল রোমান সাম্রাজ্যকে কেবল রোম থেকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়।


চিত্র: শিল্পীর তুলিতে কনস্টানটিনোপল

তাই তিনি বিশাল রোমান সাম্রাজ্যকে সহজে শাসন করার জন্য এর দুটি অংশে দুটি রাজধানী স্থাপনের উদ্যোগ নিলেন। ২৮৫ সালে তিনি তাঁর সাম্রাজ্যকে প্রশাসনিকভাবে দুই অংশে বিভক্ত করলেন এবং দুই অংশের জন্য দুটি রাজধানী চালু করলেন। সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশের রাজধানী থাকল রোম আর পূর্বাংশের জন্য নতুন রাজধানী হল বাইজানটিয়াম। এভাবে ডায়োক্লেটিয়ান রোমান সাম্রাজ্যকে দুটি কেন্দ্রে বিভক্ত করেছিলেন। ডায়োক্লেটিয়ানের পরে রোমান সাম্রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ করে বাইজানটিয়ামে এর মূল রাজধানী স্থাপন করেছিলেন সম্রাট কনস্টানটাইন।

ডায়োক্লেটিয়ানের সময় থেকে রোমান সাম্রাজ্যে গৃহযু্দ্ধ চলছিল। ডায়োক্লেটিয়ানের পরবর্তীতে চলমান রোমান গৃহযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে পুরো সাম্রাজ্যকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছিলেন সম্রাট কনস্টানটাইন। তিনি কনস্টানটাইন দ্য গ্রেট নামে পরিচিত। তাঁর রাজত্বকাল ছিল ৩০৬ থেকে ৩৩৭ সাল পর্যন্ত। ৩২৪ সালে তিনি পুরো রোমান সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েছিলেন এবং গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে এক নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়েছিলেন। ৩২৪ সালের বিজয়ের পর কনস্টানটাইন বাইজানটিয়াম নগরীকে নতুন করে সমৃদ্ধ করার উদ্যোগ নেন। ফলে এ শহর এক বিশাল সমৃদ্ধ নগরীতে পরিণত হয়।


চিত্র: কালের সাক্ষী হয়ে আছে বাইজেন্টাইন সীমানা প্রাচীর

কনস্টানটাইন এ শহরকে রোমের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে গড়ে তোলেছিলেন। এমনকি কনস্টানটাইন বাইজানটিয়াম নগরীকে রোমান সাম্রাজ্যের মূল রাজধানী বানিয়ে নিয়েছিলেন এবং নিজেও সেখানে চলে এসেছিলেন। ৩৩০ সালের ১১ মে তিনি রোম থেকে তাঁর রাজদরবার সরিয়ে আনেন বাইজানটিয়ামে এবং এর নামকরণ করেন ‘নোভা রোমা’ অর্থাৎ ‘নতুন রোম’।

কিন্তু অচিরেই তাঁর নামে এর নামকরণ হয়ে যায় কনস্টানটিনোপল। ১৪৫৩ সাল তুর্কিরা কনস্টানটিনোপলের নাম দিয়েছিলো ইসলামপোল, পরবর্তীতে সেটির উচ্চারণ বদলে হয় ইস্তাম্বুল। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইস্তাম্বুল ভূমিকম্পপ্রবণ। তবুও বহু শতাব্দী ধরে ভূমিকম্প সত্ত্বেও এ শহরের অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন এখনও অটুটভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। মধ্যযুগের ইউরোপীয় শিল্প-সাহিত্যে এ নগরী খুবই প্রাসঙ্গিক ছিল।

বাইজানটিয়াম ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য সম্পর্কে আরও জানার পূর্বে সম্রাট কনস্টানটাইন সম্বন্ধেও কিছু তথ্য জেনে নেওয়া দরকার। সম্রাট কনস্টানটাইন ছিলেন রোমান সম্রাট প্রথম কনস্টানটিয়াসের পুত্র। ব্রিটেন সফরে গিয়ে কনস্টানটিয়াস মারা গেলে সেখানকার রোমান সৈন্যরা তাৎক্ষণিকভাবে কনস্টানটাইনকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে। তিনি ৬ বছর ব্রিটেন ও গল শাসন করেন। অন্যদিকে রোমে চলতে থাকে রোমান সিংহাসনের আরেক দাবিদার ম্যাক্সেনটিয়াসের শাসন ।


চিত্র: কনস্টানটাইন দেখলেন আকাশের গায়ে ক্রুশ চিহ্ন

৩১২ সালে মিলভিয়ান সেতুর যুদ্ধে ম্যাক্সেনটিয়াসকে পরাজিত ও নিহত করেন কনস্টানটাইন। গল্পে আছে, যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে তিনি আকাশে মেঘের গায়ে ক্রুশ চিহ্ন দেখতে পান; তার তলায় লেখা আছে- ‘এই চিহ্ন অনুসরণ করে জয়লাভ করো’। এই ঘটনাটি তাকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হতে অনুপ্রাণিত করে। গৃহযুদ্ধে তিনি খ্রিষ্টানদের সাহায্য ও সমর্থন পেয়েছিলেন। এর ফলে তিনি ধর্মীয় সহনশীলতার নীতি প্রবর্তন করেছিলেন এবং খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের উপর নির্যাতন নিষিদ্ধ করেছিলেন।

মিলভিয়ান সেতুর যুদ্ধে বিজয়ের পর পশ্চিম ইউরোপে কনস্টানটাইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্ত তখনও রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাইজানটিয়াম তখন ছিল তাঁর প্রতিদ্বন্ধী সমাট লিসিনিয়াসের রাজধানী। ৩২৪ সালে তিনি পূর্ব-রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট লিসিনিয়াসকে পরাজিত করে পুরো সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হন ।

এর এক বছর পর তিনি নিকাইয়া শহরে (বর্তমান তুরস্কের ইনজির) খ্রিষ্টান গীর্জাসমূহের এক সম্মেলন আয়োজন করেছিলেন যা খ্রিষ্টধর্মের ইতিাসের সাতটি বিখ্যাত সম্মেলনের প্রথম সম্মেলন ছিল। ৩৩০ সালে কনস্টানটাইন তাঁর অখণ্ড সাম্রাজ্যের রাজধানী পৌত্তলিক রোম থেকে সরিয়ে নতুন শহর বাইজানটিয়ামে নিয়ে আসেন। এরপর এ নগরীর নাম হয়ে যায় কনস্টানটিনোপল।


চিত্র: সম্রাট কনস্টানটাইনের জননী সেইন্ট হেলেনা

রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন ছিলেন খুবই দূরদর্শী সম্রাট। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বর্বর আক্রমণের মুখে ক্ষয়িষ্ণু রোমান সাম্রাজ্যের পতনের আর বেশি দেরি নাই। তাই এ সভ্যতাকে বাঁচানোর উপায় তিনি খুজে পেলেন রাজধানী দূরে কোথাও সরিয়ে নেওয়ার মধ্যে যেখানে বর্বর আক্রমণের ঝুঁকি কম। এভাবে যখন তিনি রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী রোম থেকে কনস্টানটিনোপলে স্থানন্তর করেন তখন তিনি শুধু ক্ষমতার কেন্দ্রেরই পরিবর্তন ঘটাননি, রোমের পতনের পরও রোমান সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার পথ দেখালেন।

কনস্টানটিনোপল নগরীটি সূদীর্ঘকাল ধরে অজেয় থেকে যাওয়ার কারণ এর প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষার সুবিধা। এশিয়া মাইনর থেকে কোন প্রাচ্যবাসী শত্রুপক্ষ যদি অগ্রসর হতে চায় কনস্টানটিনোপলের দিকে তবে তাদের অতিক্রম করতে হবে ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগর। এ ক্ষেত্রে কনস্টানটিনোপলের পক্ষে শত্রুপক্ষের জাহাজ প্রতিহত করার জন্য ছিল সুবিধাজনক অবস্থান। এছাড়াও শহরটি ছিল দেয়াল ও দূর্গ দ্বারা সুরক্ষিত।


চিত্র: রোমান সাম্রাজ্যের বিভক্তি

৩৩৭ সালে কনস্টানটাইনের মৃত্যুর পর রোমান সাম্রাজ্যের অধিপতি হন ২য় কনস্টানটিয়াস (৩৩৭-৩৬১)। এর পরের উল্লেখযোগ্য সম্রাট ভ্যালেন্স (৩৬৪-৩৭৮)। ভ্যালেন্স এর পর আসেন ১ম থিওডোসিয়াস (৩৭৮-৩৯৫)। অখণ্ড রোমান সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট থিওডোসিয়াস ৩৯৫ সালে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর দুই পুত্র হনোরিয়াস ও আর্কাডিয়াসের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ করে দেন।

পশ্চিমাংশ পান হনোরিয়াস। তাঁর রাজধানী মিলান। পূর্বাংশ পান আর্কাডিয়াস। তাঁর রাজধানী কনস্টানটিনোপল। যেহেতু বাইজানটিয়াম দুর্গকে কেন্দ্র করে এই নগরী গড়ে উঠেছিল তাই সাম্রাজ্যের পূর্বাংশের নাম হয়ে যায় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য। বাইজেন্টাইন সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের সময়ে এই সাম্রাজ্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল। তাঁর শাসনকাল ছিল ৫২৭ সাল থেকে ৫৬৫ সাল পর্যন্ত।

সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের বিখ্যাত সেনাপতি নার্সেস ও বেলিসারিয়াস এই সাম্রাজ্যকে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। এশিয়া মাইনর, বলকান উপদ্বীপ, ফিলিস্তিন, মিশর, উত্তর আফ্রিকা, স্পেনের দক্ষিণাঞ্চল এবং ইতালির অংশবিশেষ পর্যন্ত তারা এই সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। জাস্টিনিয়ানের মৃত্যুর কয়েক বছর পর বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসে।

৩৩০ সাল থেকে ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত কনস্টানটিনোপল নগরী গ্রিক ও রোমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক-বাহক ছিল। অন্যদিকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পশ্চিম ইউরোপজুড়ে বর্বর আক্রমণের মুখে ব্যাপকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল রোমান জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতি। এর ফলে রোম নগরী প্রাচীন সভ্যতার অর্জনগুলোকে ভালোভাবে সংরক্ষণ করে রাখতে পারেনি।

বরং প্রাচীন রোমান জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতিকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল কনস্টানটিনোপল। প্রাচীন ও আধুনিক সভ্যতার এক যোগসূত্র বলা যায় এ নগরীকে। ১৪৫৩ সালে উসমানীয় তুর্কীদের হাতে পতনের পর কনস্টানটিনোপলের যেসব পন্ডিতরা রোমে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারাই রোমান জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতিকে নতুনভাবে জগিয়ে তোলেছিলেন। এর নামই রেনেসাঁ।

বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাস জটিল। এক হাজার বছরের শাসনের মধ্যে ৬৫ বার এখানে বিদ্রোহ হয়েছে আর ৬০ জনেরও বেশি সম্রাটকে রাজ্যত্যাগ করে পালাতে হয়ছে। সপ্তম শতাব্দীতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য সব দিক দিয়ে এক গ্রিক রাজতন্ত্রে পরিণত হয়। সরকারি ভাষা হিসেবে লাতিনকে স্থানচ্যুত করে গ্রিক ভাষা। শিক্ষিত ও দক্ষ এক আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্র ও ধর্মের সর্বময় কর্তায় পরিণত হন সম্রাট।

একই রাজার হাতে রাষ্ট্র ও ধর্মের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব তোলে দেওয়ার ঘটনা ইতিহাসে যে কয়বার দেখা গিয়েছে তাঁর মধ্যে সপ্তম শতকের বাইজেন্টাইন সম্রাটদের কথা উল্লেখযোগ্য। মিসরের ফারাওরা, চীনের সম্রাটগণ, রোমের সিজার, আমেরিকার ইনকা জাতির রাজারা, মুসলিম খলিফাগণ- এরা সবাই অনেকসময় একাধারে রাষ্ট্র ও ধর্মের সর্বোচ্চ কর্তারূপে দেখা দিয়েছেন অথবা দেবাত্মা (মুসলিমরা ছাড়া) বলে গৃহীত হয়েছেন।

বাইজেন্টাইন সম্রাটরাও এই ধারার এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। অদ্ভূত বিপরীত ভাবের লীলাভূমি ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য। একদিকে জনসাধারণের মধ্যে ধর্মের প্রতি প্রগাঢ় নিষ্ঠা, দৈনন্দিন জীবনে ধর্মের অনুশাসনের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ; অপরদিকে উচ্ছৃঙ্খল বিলাসিতা, বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা। সভ্যতার চিরায়ত চেহারাকে তেমন বদলাতে পারেনি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপুষ্ট খ্রিষ্টধর্ম! বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে খ্রিষ্ট ধর্মের নিজস্ব ধারা ছিল, যার মূলে ছিল খ্রিষ্টান অর্থডক্স চার্চ।

বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনা হলো সেইন্ট সোফিয়া গীর্জা। সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান প্রাচীন কনস্টানটাইন গীর্জার স্থলে এ স্থাপনাটি নির্মাণ করেছিলেন। এটি এখন হাজিয়া সোফিয়া নামে পরিচিত। ৫৩২ সালে সম্রাট জাস্টিনিয়ান কনস্টানটিনোপলের অধিবাসীদের জন্য এ গীর্জাটি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এরকম দামী স্থাপনা আগে কখনো নির্মিত হয়নি। জাস্টিনিয়ান চেয়েছিলেন এমন একটি দামী স্থাপনা নির্মাণ করতে যেরকম আগে কখনো নির্মিত হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না৷


চিত্র: সেইন্ট সোফিয়া গীর্জা

গীর্জাটি নির্মাণে কাজ করেছিল ১০ হাজার কর্মী৷ অন্তত এক হাজার বছর ধরে এটিই ছিল খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় চার্চ৷ এটি মূলত অর্থোডক্স গীর্জা হিসেবেই মহাকালের বুকে যাত্রা শুরু করেছিল। দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী পার হওয়ার পর ১২০৪ সালে এটিকে ক্যাথলিক গীর্জাতে রূপান্তরিত করা হয়। মাত্র কয়েক দশক পরেই ১২৬১ সালে আবার উড়ল এখানে অর্থোডক্সদের নিশান। কিন্তু দুশ বছর পেরোবার আগেই আবার এটি বেদখল হল। ১৪৫৩ সালে উসমানীয় তুর্কিরা এসে দখল করে নিল বাইজেন্টাইন রাজধানী কনস্টানটিনোপল। ফলে চিরতরে পতন ঘটল ঐতিহাসিক বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের।

কনস্টানটিনোপলের পতনের পর পূর্ব ইউরোপে শুরু হল অটোমান (উসমানীয়) শাসন। তুর্কিদের বিজয়ের পর সেইন্ট সোফিয়া গীর্জা রাজকীয় মসজিদে পরিণত হয়। তখন এর নতুন নামকরণ হয় ‘ইম্পিরিয়াল মসজিদ’। ১৯৩১ সাল পর্যন্ত এটি মসজিদ ছিল। ১৯৩৫ সালে এটি জাদুঘরে পরিণত হয়। আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ১৯৩৫ সালে হাজিয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে পরিবর্তিত করেন৷ ১৯৮৫ সালে হাজিয়া সোফিয়া ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনার তালিকায় স্থান পায়৷


চিত্র: বাইজেন্টাইন সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান

বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অর্থনীতি ছিল সামন্ততান্ত্রিক, তবে তা মিসরীয় সামন্ততন্ত্রের মত নয়। প্রজাদের অবস্থা ছিল ক্রীতদাস ও স্বাধীন কৃষকের মাঝামাঝি অবস্থা। সম্রাটের জমির ওপর করের হার এত বেশি ছিল যে চাষীদের জমি বন্দোবস্ত পাওয়ার উপায় ছিল না। তাই তারা ভূস্বামীদের জমিতে ভূমিদাস হিসেবে কাজ করত। বিনিময়ে পেত নিজের পরিবার জন্য খাদ্যশস্য চাষের এক টুকরো জমি।

এ জমির ফসলেরও একটি বড় অংশ ভূস্বামীকে দিতে হত। শোষণ মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে বারবার প্রজাবিদ্রোহ ঘটেছে। অর্থাৎ এ সাম্রাজ্যেরও সমৃদ্ধির মূলে ছিল শোষণের বিভীষিকা। শোষণের অপর নামই ছিল সমৃদ্ধি। কৃষি ছাড়াও সাম্রাজ্যের সম্পদের বড় উৎস ছিল শিল্প আর বাণিজ্য। এন্টিয়ক, দামেশক, সলোনিকা প্রভৃতি শহরগুলো সাম্রাজ্যের বড়ো শিল্পকেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত ছিলো।

ইউরোপ-এশিয়ার বাণিজ্যিক বিনিময়ের মূল কেন্দ্র ছিল কনস্টানটিনোপল। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য শুধু তার নিজের উৎপন্ন দ্রব্যই বিক্রি করেনি, আরও বিক্রি করেছে এদেশের পণ্য ওদেশে। ফলে মুনাফার পয়সায় ফুলে ফেঁপে ওঠা বাণিজ্য নগরী কনস্টানটিনোপল যে সমৃদ্ধিতে সারা দুনিয়াকে ছাড়িয়ে যাবে এতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।


চিত্র: বাইজেন্টাইন সৈন্য

এতেও বিস্ময়ের কিছু ছিল না যে উন্মত্ত বিলাসীতায় গা ভাসাবে এ নগরীর ফুলে ফেঁপে ওঠা ধনী নাগরিকের দল। প্রবাদ প্রতীম বিলাসীতায় গা ভাসাবেন বাইজেন্টাইন সম্রাট এটিই ছিল অনিবার্য সত্য। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, এক যুগের বাইজেন্টাইন সম্রাটরা ফুলের পাপড়ি মাড়িয়ে সোনার থালায় খাবার খেতে বসতেন!

রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে ইসলামি খিলাফতের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যই ছিল তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সভ্যতা। এ সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করার শক্তি ছিল একমাত্র পারস্য সাম্রাজ্যের। এ সাম্রাজ্যকে সাসানিদ সাম্রাজ্যও বলা হতো। পারসিকরা তাদের সাম্রাজ্যকে ‘এরানশাহ’ অর্থাৎ ‘ইরানীয় সাম্রাজ্য’ বলেও ডাকত।

খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে আরব উপদ্বীপের দুই দিকে ছিল এই দুই বিরাট রাষ্ট্রশক্তি- একটি পারস্য সাম্রাজ্য এবং অপরটি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য। এ দুটি সাম্রাজ্যই ছিল তখনকার দুনিয়ার সেরা দুটি শক্তি। আরব উপদ্বীপের পূর্ব দিকে পারস্য উপসাগরের দুই তীরে বিস্তৃত ছিল পারস্য সাম্রাজ্য। বর্তমান আফগানিস্তান থেকে শুরু করে ইয়েমেন পর্যন্ত এই সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। তখনকার এশিয়ার সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য এবং প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারক-বাহক ছিল পারস্য সাম্রাজ্য।


চিত্র: বাইজেন্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস

অপরদিকে আরব উপদ্বীপের পশ্চিম দিকে অবস্থিত লোহিত সাগরের তীরবর্তী এলাকা থেকে শুরু করে কৃষ্ণসাগরের উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য। আরবরা এটিকে রোম সাম্রাজ্যরূপে অভিহিত করত। এই দুটি বিশাল সাম্রাজ্যের সীমান্ত বর্তমান ইরাকের দজলা-ফোরাত তীরে একত্রিত হয়েছিল। ইসলামি খিলাফতের উত্থানের পরে মুসলমানরা এ দুই সাম্রাজ্যের সাথেই যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল।

কনস্টানটিনোপলকেন্দ্রিক বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশকেই ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনে রোম সাম্রাজ্য নামে অভিহিত করা হয়েছে। কুরআনে এই সাম্রাজ্যের সম্রাটদেরকে কায়সার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গিবনের বর্ণনা অনুযায়ী এই সাম্রাজ্যটি ছিল তদানীন্তন পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সুসভ্য এবং সম্রাট কায়সার সাম্রাজ্যের সর্বেসর্বা হওয়ার পাশাপাশি খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় প্রধানরূপেও বিবেচিত হতেন।

ইতিহাসের চিরায়ত নিয়মের পথ ধরে অতীতের গ্রিক-পারস্য যুদ্ধের মতো বাইজেন্টাইন ও পারস্য সাম্রাজ্যও পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল বারবার। পারস্য সম্রাট (শাহানশাহ) তৃতীয় খসরু ৬০২ সালে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে এক দীর্ঘ যুদ্ধ শুরু করেন। ৬১০ সালে ফ্ল্যাভিয়াস হিরাক্লিয়াস অগাস্টাস বাইজানটিয়ামের সিংহাসনে বসেন। এই নতুন সম্রাট পারসিকদের হামলা প্রতিহত করতে পারলেন না।


চিত্র: পারস্য সম্রাট তৃতীয় খসরু ও তাঁর রাণী

আগ্রাসী পারসিকরা ইরাক ও সিরিয়া অধিকার করে এশিয়া-মাইনরে ঢুকে পড়ে। ৬১৯ সাল নাগাদ পারসিকরা এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ এবং মিসর দখল করতে সক্ষম হয়। এর পরবর্তীতে নাটকীয়ভাবে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। শেষ পর্যন্ত বাইজেন্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস পারসিকদের গতিরোধ করতে সমর্থ হন এবং ৬২২ থেকে ৬২৭ সালের মধ্যেই পারসিকেরা তাদের পুরনো সীমান্তে ফেরত যেতে বাধ্য হয়।

বাইজেন্টাইন-পারস্যের এ যুদ্ধের ইতিহাসের সাথে অনিবার্যভাবে এসে যায় ঐতিহাসিক নগরী জেরুজালেমের কথা। এসে যায় ইহুদি-খ্রিষ্টান ইতিহাসের প্রাসঙ্গিকতাও। ৬১৪ সালে পারসিকদের হাতে পতন ঘটেছিল ঐতিহাসিক নগরী জেরুজালেমের। এ অভিযানে তারা বড় সহযোগী হিসেবে পেয়ে গিয়েছিল ইহুদিদেরকে। সেই যে ৭০ সালে সম্রাট টিটাসের দ্বারা ইহুদিরা বিতাড়িত হয়েছিল জেরুজালেম থেকে, তার ৫৪৪ বছর পরে তারা এই প্রথম বিজয়ী পারসিকদের সাথে জেরুজালেমে প্রবেশের সুযোগ পায়।

প্যাগান ধর্মবিশ্বাসী সম্রাট টিটাস তাদের জেরুজালেমে প্রবেশে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন তা পরবর্তীতে বাইজেন্টাইন খ্রিষ্টান সম্রাটরাও কার্যকর রেখেছিলেন। ফলে এতদিন পরে তারা এই প্রথম জেরুজালেমে প্রবেশের সুযোগ পায়। পারসিকদের সহযোগিতায় ইহুদীরা সেখানে পাঁচ বছরের মতো নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ইহুদী সেনারা জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খ্রিষ্টানদের উপর বড় ধরণের হত্যাযজ্ঞ চালালে পারস্য সম্রাট খসরু ইহুদী সেনাদেরকে জেরুজালেমের বাইরে থাকার নির্দেশ দেন।

যে অল্প সময় ইহুদীরা জেরুজালেমে ছিল সেই সময়টিতে তারা রোমানদের হাতে ধ্বংসিত সোলায়মানের ধর্মগৃহের ধ্বংসস্তুপ পরিস্কারের কাজে হাত দিয়েছিল। এটি ছিল সোলায়মানের ধর্মগৃহ পুনর্নিমাণের তৃতীয় প্রচেষ্টা। পারসিকরা চলে যাওয়ার পর বাইজেন্টাইন সেনাদের হামলায় জেরুজালেমের বাইরে অবস্থান নেয়া ইহুদী সেনাবাহিনী পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। জেরুজালেমে আবার বাইজেন্টাইন শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইহুদিদের মত খ্রিষ্টানদের একটি অংশও পারসিকদের হাতে জেরুজালেমের পতনে খুশি হয়েছিল। এরা হল নেস্টোরিয়ান খ্রিষ্টান সম্প্রদায়। তারা আরিয়ানদের মতই খ্রিষ্টধর্মের রাষ্ট্রীয় ধারা বহির্ভূত মতবাদে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে রোমান ক্যাথলিক ও বাইজেন্টাইন অর্থডক্স উভয় ধারার চার্চের কাছে অবাঞ্ছিত ও অপাংতেয় ছিল। ক্যাথলিক ও অর্থডক্স উভয় প্রকার খ্রিষ্টানদের কাছে তারা ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিল।

নেস্টোরিয়ানরা যিসাসের দৈব ও মানবীয় উভয় প্রকার সত্ত্বায় বিশ্বাস করত; কিন্তু সত্ত্বা দুটিকে আলাদাভাবে দেখত। তারা দুই সত্ত্বার বিচ্ছিন্নতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করত। নেস্টোরিয়াস (৩৮৬-৪৫১ সাল) ছিলেন কনস্টানটিনোপলের আর্চবিশপ ও প্যাট্রিয়ার্ক। ৪২৮ থেকে ৪৩১ সাল পর্যন্ত তিনি প্যাট্রিয়ার্ক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর মতবাদের মূল বিষয়বস্তু ছিল: The nature of Christ is divided equally between His divine nature and His human nature, but the two are distinct and separate.

নেস্টোরিয়াসের এ মতবাদ অন্যান্য ধর্মনেতারা (মূলত ধর্মব্যবসায়ী) মেনে নেননি। আলেকজান্দ্রিয়ার প্যাট্রিয়ার্ক সিরিল (যিনি ইহুদি গণহত্যার জন্য কুখ্যাত) সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছিলেন। অবশেষে ৪৩১ সালে ইফেসাসের প্রথম কাউন্সিলে নেস্টোরিয়াসের মতবাদকে ধর্মবিরোধী বলে আখ্যা দেয়া হয়। মূলত মানুষের দৈব সত্ত্বায় সন্দেহবাদী এ মতবাদ ছিল ধর্মব্যবসায়ী যাজকদের দৈবসত্ত্বার ওপরই একটি আঘাত।

তাই সবাই মিলে আরিয়ান মতবাদের মত এটিকেও প্রতিহত করে। যাই হোক, এ মতবাদ শেষ পর্যন্ত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে বিস্তৃতি না পেলেও পূর্বদিকের সাসানিদ সাম্রাজ্যে যথেষ্ট বিস্তৃতি পেয়েছিল। আরব উপদ্বীপেও এ মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে। আরিয়ান, নেস্টোরিয়ান প্রভৃতি গোষ্ঠি কখোনোই বৃহৎ ধারার খ্রিষ্টানদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এরা ক্যাথলিক ও অর্থডক্স চার্চের ঘোষিত বিধান মতে ছিল ধর্মবিরোধী। তাই প্রচলিত খ্রিষ্টধর্ম থেকে তারা ছিল বহিস্কৃত। শুধু ভিন্ন ধারার খ্রিষ্টান বলেই নয়, নেস্টোরিয়ানদের মুখের ভাষাও গ্রিক ছিল না।


চিত্র: বাইজেন্টাইন মুদ্রা

তদুপরি তারা ছিল প্রাচ্যবাসী। প্রতীচ্যের বিবেচনায় তাই তারা ছিল অনভিজাত ও নিকৃষ্ট। এসব কারনে পারস্যের নেস্টোরিয়ানরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছিল। এ প্রবণতা তাদেরকে পরিচালিত করে পারসিকদের বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য আক্রমণের সময় সহায়ক শক্তির ভূমিকায় নামতে। প্রচলিত ধারার খ্রিষ্টানদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে জেরুজালেম দখল করে সেখানকার প্রচলিত গীর্জার অপমান করা ছিল তাদের সেই প্রতিশোধপরায়ণতার অংশ।

বাইজেন্টাইন-পারস্য যুদ্ধের সময়ে পারসিকরা যেসব বাইজেন্টাইন অঞ্চল দখল করেছিল সেসব অঞ্চলে খ্রিষ্টধর্মের নিদর্শনগুলো ব্যাপক ধ্বংসের মুখে পড়েছিল। বিজয়ী ইরানীরা খ্রিষ্টান জনগণের ওপর ভয়াবহ গণহ্ত্যা চালিয়েছিল। তারা জেরুজালেম দখলের পর ৬৫ হাজার খ্রিষ্টানকে হত্যা করে। আরও ৩৫ হাজার খ্রিষ্টানকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

জেরুজালেমে যিসাসের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে যে গীর্জা ছিল তা ভস্মীভূত করা হয় এবং সেখান থেকে খ্রিষ্টধর্মের সব কয়টি নিদর্শন ভূলুণ্ঠিত করা হয়। এমনকি খ্রিষ্টানদের মহাপবিত্র ধর্মীয় নিদর্শন ট্রু ক্রস তোলে নিয়ে তদানীন্তন পারস্যের রাজধানী মাদায়েনে পৌঁছে দেয়া হয় যা সম্পর্কে খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস ছিল যে, এ কাষ্ঠখণ্ডটিতেই যিসাসকে কে ঝুলানো হয়েছিল! অবশ্য পরবর্তিতে সম্রাট হিরাক্লিয়াস পারসিকদের পরাস্ত করে যিসাসের অনেক স্মৃতিচিহ্ন পুনরুদ্ধার করেন।


চিত্র: সাসানিদ সৈন্য

পারসিকরা এশিয়া মাইনরের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ এবং মিসর দখলের পরবর্তী সময়ে যুদ্ধের মোড় ঘুরতে থাকে। বাইজেন্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস নাটকীয়ভাবে পারসিকদের গতিরোধ করতে সমর্থ হন এবং ৬২২ থেকে ৬২৭ সালের মধ্যে পারসিকদেরকে তাদের পুরনো সীমান্তে ফিরে যেতে বাধ্য করেন। ৬১৯ সাল পর্যন্ত বাইজেন্টাইনরা কেবলই পরাজিত হয়েছিল।

এমনকি তখন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের টিকে থাকাই হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিল। কেবল পারসিকরাই নয়, মারাত্মক ভীতির কারণ হিসেবে আরও বিদ্যমান ছিল অ্যাভারস আর লম্বার্ডরা। অ্যাভারসরা কনস্টানটিনোপলের দেয়াল পর্যন্ত এসে গিয়েছিল। বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াস গীর্জাসমূহের স্বর্ণ, রৌপ্যগুলো গলিয়ে মুদ্রা বানিয়ে তাঁর বাহিনীদের খরচ মেটানোর আদেশ দিলেন।

এগুলোও যখন অপর্যাপ্ত মনে হলো তখন ব্রোঞ্জের মূর্তিগুলো গলিয়ে মূদ্রা বানানো হলো। বহু গভর্নর হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। এসব কারণে তাঁর সাম্রাজ্য ছিল পতনের মুখে। আগের বাইজেন্টাইনের অধীনস্ত রাষ্ট্র যেমন, মেসোপটেমিয়া, সিলিসিয়া, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মিসর, আর্মেনিয়া তখন পারসিকদের অধীনস্ত হয়ে গিয়েছিল। সকলেই মনে করছিল যে, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এই বার ধ্বংস হয়ে যাবে!


চিত্র: যুদ্ধরত পারসিক সৈন্য

শেষ পর্যন্ত ৬২৭ সালের ডিসেম্বরে বাইজেন্টাইন আর পারসিকদের মাঝে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধ শুর হয় নিনেভাতে। বাইজেন্টাইনরা আশাতীতভাবে এ যুদ্ধে পারসিকদেরকে পরাজিত করে। ফলে সম্রাট হেরাক্লিয়াস বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সকল হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন। ৬২৯ সালে জেরুজালেমে ট্রু ক্রস পুনরায় স্থাপন করা হয়। পারসিকরা বাইজেন্টাইনদের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল ফলে তাদেরকে নিজেদের দখল করা অংশগুলো থেকে পিঁছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।

দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা এ যুদ্ধের ধকল সইতে না পেরে এবং প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার ফলে বাইজেন্টাইন-পারস্য উভয় সাম্রাজ্য বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। এরই মধ্যে ঘটে ইতিহাস চমকে দেয়া এক আকস্মিক মুসলিম উত্থান। আরব উপদ্বীপের যে ভূখন্ডে এতদিন কোন উল্লেখযোগ্য সভ্যতার গন্ধই পাওয়া যায়নি এবং যে অঞ্চল এতটাই উপেক্ষিত ছিল যে, কেউ এটিকে দখলেরও প্রয়োজন মনে করেনি সে অঞ্চল থেকেই মাথা তুলে দাঁড়ায় এক নতুন শক্তিশালী রাষ্ট্র- ইসলামি খিলাফত।

এই রাষ্ট্রটি প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে এক বিশাল সাম্রাজ্যের আকার ধারণ করে। ৬৩২ সালে আরব উপদ্বীপের মদিনা থেকে যে খিলাফতের সূচনা হয় তা কয়েক বছরের মধ্যেই বাইজেন্টাইন ও পারসিকদের কাছ থেকে তাদের বিভিন্ন এলাকা জয় করে নেয়। ৬২০ এর দশকের শেষনাগাদ ইসলামের নবী আরব উপদ্বীপের এক তৃতীয়াংশ আরবকে তাঁর শাসনাধীনে একতাবদ্ধ করেছিলেন। তাঁর সময় প্রথম মুসলিম-বাইজেন্টাইন সংঘর্ষ হয়।

হিরাক্লিয়াসের সাথে পারসিক সেনাপতি শাহরবারাজের চুক্তিতে শর্ত ছিল যে, পারস্যের সেনারা ৬২৯ সালের মধ্যে বাইজেন্টাইন প্রদেশগুলো থেকে তাদের অবস্থান প্রত্যাহার করবে। এর কয়েকমাস পর আরব মুসলমান ও বাইজেন্টাইন সেনারা মুতার যুদ্ধে পরস্পরের মুখোমুখি হয়। ৬৩২ সালে ইসলামের নবী মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর আবু বকর তাঁর উত্তরসুরী হন। এ সময় বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দেখা দিলে রিদ্দার যুদ্ধে তা দমন করা হয়। ফলে সমগ্র আরব উপদ্বীপে মুসলিম খিলাফতের অবস্থান সুসংহত হয়।

৬৩০ এর দশকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ সিরিয়া-ফিলিস্তিন ও মিশর মুসলমানদের পদানত হয়। মুসলমানরা বাইজেন্টাইনদের হাত থেকে পুরো উত্তর আফ্রিকাও দখল করে নেয়। উমাইয়া খিলাফতের সময়ে মুসলমানরা এশিয়া মাইনরেও অভিযান চালায়। উমাইয়াদের সময়ে বাইজেন্টাইন রাজধানী কনস্টানটিনোপলেও দুই বার অভিযান চালানো হয়। ৭১৮ সালে উমাইয়াদের কনস্টানটিনোপল অবরোধ ব্যর্থ হওয়ার পর পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়।

এ সময় এশিয়া মাইনরের পূর্বদিকে তোরোস পর্বতমালা একটি সীমানা হিসেবে পরিগণিত হতো। আব্বাসীয় খিলাফতের অধীনে দূত বিনিময় ও বিভিন্ন মেয়াদী চুক্তির মাধ্যমে সম্পর্ক আরো স্বাভাবিক হয়ে আসে। কিন্তু প্রায়ই বার্ষিক হামলা ও পাল্টা হামলার মাধ্যমে সংঘর্ষ লেগেই থাকত। দশম শতকে এসব হামলায় আব্বাসীয় সরকার বা স্থানীয় শাসক উভয়েই উৎসাহ দেয়।

মুসলমানরা সাগরপথেও অভিযান চালাত। ৬৫০ এর দশক থেকে ভূমধ্যসাগরীয় বিভিন্ন দ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চলে মুসলিম আক্রমণ শুরু হয়েছিল। পাল্টা আক্রমণও শুরু হয়েছিল। পরবর্তী কয়েক শতক ধরে সমগ্র ভূমধ্যসাগর বাইজেন্টাইন ও মুসলমান নৌবাহিনীর যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। নবম ও দশম শতাব্দীতে ক্রিট, মাল্টা ও সিসিলিতে মুসলমান অভিযান সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। একই সাথে মুসলমান নৌবহর ফ্রান্স, ডালমেশিয়া ও এমনকি কনস্টান্টিনোপলের শহরতলীতেও পৌঁছে গিয়েছিল।

মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে বাইজেন্টাইনরা প্রথমদিকে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিত এবং খোলা মাঠে যুদ্ধ এড়িয়ে চলত। তারা সুরক্ষিত দূর্গে অবস্থান নিত। ৭৪০ সালের পর থেকে তারা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। কিন্তু এ সময় আব্বাসীয়রাও এশিয়া মাইনরে ভয়াবহ আক্রমণে সক্ষম ছিল। ৮৬১ সালের পর থেকে আব্বাসীয়দের অভ্যন্তরীণ পতন শুরু হয়। আব্বাসীয়রা বিরোধ-বিভাজনে লিপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে তখন মেসিডোনীয় রাজবংশের অধীনে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের শক্তিবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। ফলে স্রোত উল্টো দিকে ঘুরে যায়।


চিত্র: উমাইয়া সৈন্য

৯২০ থেকে ৯৭৬ সালের মধ্যে বাইজেন্টাইনরা মুসলমাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম হয় এবং উত্তর সিরিয়া ও বৃহত্তর আর্মেনিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়। এর পরবর্তীতে ফাতেমী খিলাফতের সাথে সীমান্তবর্তী সংঘর্ষের মধ্যেই বাইজেন্টাইন-আরব যুদ্ধ সীমাবদ্ধ ছিল। ১০৬০ সালে সেলজুক তুর্কিদের উত্থানের আগ পর্যন্ত এই সীমানা স্থির হয়েই ছিল। ১২০৪ সালে ক্রুসেডারদের হাতে একবার ধ্বংসিত হয় কনস্টানটিনোপল। পরে অবশ্য ১২৬১ সালে আবার মুক্ত হয় কনস্টানটিনোপল।

১৩০০ সালের দিকে উসমান নামের এক তুর্কি নেতা কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে এশিয়া মাইনরে একটি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তার অনুসারী এবং উত্তরাধিকারীরা অটোমান বা উসমানীয় হিসাবে পরিচিত। তারা ক্রমশ এশিয়া মাইনরে রাজ্য বিস্তার করতে থাকে এবং ১৩৪৫ সালে তারা বাইজেন্টাইন সম্রাট জন ক্যানটাকুজেনকে সাহায্য করতে এশিয়া পেরিয়ে ইউরোপে যায়।


চিত্র: উসমানীয় সুলতান মাহমুদ ফাতিহ

সে সময়য় ইউরোপে গৃহযুদ্ধ চলছিল। ইউরোপে পা রাখার সাথে সাথেই অটোমান বা উসমানীয় তুর্কিরা দ্রুত তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে থাকে। ১৪০০ সাল নাগাদ কয়েকটি অভিযানের পর তারা ম্যাসিডোনিয়া, সার্বিয়া এবং বুলগেরিয়া জয় করে। তারা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে সংকুচিত করতে করতে কনস্টানটিনোপলের চৌহদ্দিতে নিয়ে আসে। তখন এর আয়তন ছিল আজকের তুরস্কের আয়তনের সমান।

কনস্টানটিনোপলকে কিছুকালের জন্য রক্ষা করেন মোঙ্গল বীর তৈমুর লং। তিনি ছিলেন চেঙ্গিস খানের বংশধর। ১৪০২ সালে তিনি অধিকাংশ উসমানীয় সাম্রাজ্য তছনছ করে দেন। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরও উসমানীয় সাম্রাজ্যে গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে। কিন্তু শীঘ্রই দুর্দান্ত ও অদম্য সুলতান মাহমুদ ফাতিহ বিজয়ীর বেশে আবির্ভুত হন। মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি কনস্টানটিনোপল জয় করে সমগ্র সভ্যতার ইতিহাসকে ঘুরিয়ে দেন।

১৪৫১ সালে উসমানীয় সাম্রাজের সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলতান মাহমুদ ফাতিহ। এর আগে একবার তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন মাত্র বারো বছর বয়সে। কিন্তু তাঁর অল্প বয়স রাজ্য পরিচালনায় সমস্যা সৃষ্টি করবে ভেবে তাকে কিছুদিন পরেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে একুশ বছর বয়সে পুনরায় তিনি সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন। এর দু’বছর পর ১৪৫৩ সালে তিনি দেড় লাখ সৈন্য নিয়ে কনস্টানটিনোপল অবরোধ করেন।

ভৌগলিক দিক থেকে কনস্টানটিনোপল ছিল পৃথিবীর সবচয়ে সুরক্ষিত শহর। কনস্টানটিনোপল নগরীর তিন দিকে জল, একদিকে স্থল। পশ্চিমে বসফরাস প্রণালী, দক্ষিণে গোল্ডেন হর্ন ও উত্তরে মারমারা উপসাগর। গোটা নগরীর চারপাশে ছিল একাধিক দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও সার্বক্ষণিক সশস্ত্র প্রহরা। এসব কারণে কনস্টানটিনোপল ছিল এক অজেয় দুর্গ। এ শহর জয়ের জন্য সুলতান মাহমুদ ফাতিহ তৎকালীন বিশ্বের সর্বাধুনিক রণপ্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন।

সে সময়য়ের সবচেয়ে দূর পাল্লার কামান তিনিই তৈরি করেছিলেন। তবুও তাঁর নৌবহর সবুধাজনক জায়গায় পৌঁছাতে না পারায় যুদ্ধ জয়ের কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল না। নৌপথে বিজয়ের জন্য উসমানীয় নৌবহরের গোল্ডেন হর্নে প্রবেশ করা ছিল অপরিহার্য। কিন্তু গোল্ডেন হর্নের মুখ শিকল দ্বারা বন্ধ করা দেওয়া হয়েছিল এবং বাইজেন্টাইন রণতরীগুলো সেখানে অবস্থান নিয়ে গোলা নিক্ষেপ করছিল।

প্রায় দুই সপ্তাহ অবিরত যুদ্ধের পরও নৌপথে বিজয়ের কোন লক্ষণ দেখা গেল না। অবশেষে সুলতান মাহমুদ ফাতিহ এমন এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যা পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসে এক বিরল ও বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে অমর হয়ে আছে। গিবনের মত ঐতিহাসিকও একে ‘মিরাকল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুলতান মাহমুদ ফাতিহ তাঁর সৈন্যদের আদেশ দিলেন উসমানীয় রণতরীগুলো ডাঙ্গায় তোলে দশ মাইল পথ অতিক্রম করে গোল্ডেন হর্নে নামাতে হবে।

এই দীর্ঘ পথ পুরোটাই ছিল পাহাড়ী উঁচুনিচু ভূমি। এর উপর দিয়ে সত্তরটি রণতরী টেনে নেয়া ছিল এককথায় অসম্ভব। কিন্তু সুলতান মাহমুদ ফাতিহ এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। পুরো পথে কাঠের পাঠাতন বিছানো হল। তাতে চর্বি মাখিয়ে পিচ্ছিল করা হল এবং এর উপর দিয়ে রণতরীগুলো টেনে নিয়ে যাওয়া হল। এভাবে টিলা ও পাহাড়ের উপর দিয়ে রাতের অন্ধকারের মধ্যে সত্তরটি রণতরী তিনি গোল্ডেন হর্নে প্রবেশ করাতে সক্ষম হলেন।

বাইজেন্টাইন সৈন্যরা কনস্টানটিনোপলের প্রাচীর থেকে বসফরাসের পশ্চিম তীরে মশালের দৌড়াদৌড়ি লক্ষ্য করে। কিন্তু অন্ধকারের কারণে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। অবশেষে ভোরের আলো যখন ফুটল তখন প্রহরারত বাইজেন্টাইন নৌ সেনারা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দেখল যে, উসমানীয় রণতরীগুলো মৃত্যুদূতের মতো তাদের পিছন দিক থেকে ধেয়ে আসছে। এই ঘটনা ত্থেকে একটি প্রবাদ তৈরি হল: যখন পানির জাহাজ ডাঙ্গায় চলবে তখন বুঝবে কনস্টানটিনোপলের পতন আসন্ন।


চিত্র: ১৪৫৩ সালের কনস্টানটিনোপল অবরোধ

চূড়ান্ত আক্রমণের আগে সুলতান মাহমুদ ফাতিহ বাইজেন্টাইন সম্রাটকে আত্মসমর্পণের বার্তা পাঠালেন এবং নগরবাসীর জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিলেন, কিন্তু সম্রাট তা গ্রহণ করলেন না। এবার সুলতান চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি নিলেন। আক্রমণের দিনটি ছিল ১৪৫৩ সালের ২৯ মে । ভোরের আলো ঠিকমত ফোটার আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

তুর্কি স্থলবাহিনী তিনদিক থেকে স্থলভাগে এবং তুর্কি নৌবাহিনী নৌপথে আক্রমণ চালায়। দ্বিপ্রহর পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে ভীষণ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলতে থাকে। কিন্তু বাইজেন্টাইন বাহিনীর অসাধারণ বীরত্বে একটি সৈন্যও শহরে প্রবেশ করতে পারেনি। বাইজেন্টাইন সম্রাট একাদশ কনস্টানটাইনের সৈন্যসংখ্যা ছিল ৮ হাজার। তা সত্ত্বেও তারা দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং তুর্কিরা নগর প্রাচীরের উপর আরোহণের আগ পর্যন্ত তাদের প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়।

অবশেষে সুলতান মাহমুদ ফাতিহ তাঁর বিশেষ বাহিনী ইয়ানাচারী বাহিনীকে সাথে করে সেইন্ট রোমান্স এর ফটকের দিকে অগ্রসর হন। ইয়ানাচারী বাহিনীর প্রধান আগা হাসান তার ত্রিশ জন বীর সঙ্গীকে সাথে নিয়ে প্রাচীরের উপর আরোহণ করেন। হাসান ও তাঁর আঠারো সাথীকে প্রাচীর থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়। অবশিষ্ট বারোজন প্রাচীরের উপর দৃঢ় অবস্থান করতে সক্ষম হন। তারপর উসমানীয় বাহিনীর অন্যান্য দলও একের পর এক প্রাচীরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়। এরা কনস্টানটিনোপলের প্রাচীরে চন্দ্রখচিত লাল পতাকা উড়িয়ে দেয়।


চিত্র: সুলতান মাহমুদ নির্মিত দূর পাল্লার কামান

বাইজেন্টাইন সম্রাট একাদশ কনস্টানটাইন এতক্ষণ বীরত্বের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করছিলেন। কিন্তু শেষ মূহুর্তে পরাজয়ের মুখোমুখি হয়ে তিনি জীবন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। খোলা তলোয়ার হাতে উসমানীয় সেনাবাহিনীর উন্মত্ত তরঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করে সত্যিকার সৈনিকের মত বীরত্বের সাথে লড়তে লড়তে নিহত হলেন শেষ বাইজেন্টাইন সম্রাট একাদশ কনস্টানটাইন। তাঁর মৃত্যতে ১১২৩ বছরের পুরনো বাইজেন্টাইন সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটল।

কনস্টানটিনোপল বিজয়ের পর তুর্কিরা শহরটির নাম দেয়া হয় ইসলামপোল; পরে এর হয়ে যায় ইস্তাম্বুল। ইস্তাম্বুলকে বানানো হয় উসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী। সুলতান মাহমুদ ফাতেহের নামের সাথে ফাতিহ শব্দটি জুড়ে দেয়া হয়েছে এ বিজয়ের পরে। আরবি শব্দ ‘ফাতিহ’ অর্থ বিজয়। ১৪৫৩ সালে টানা ৫৭ দিন অবরোধের মধ্য দিয়ে কনস্টানটিনোপোল বিজয়ের কহিনী নিয়ে আধুনিক তুরস্কে ‘ফাতিহ ১৪৫৩’ নামে খুবি ব্যয়বহুল এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। কনস্টানটিনোপলের পতনকে মধ্যযুগের অবসান হিসাবে ধরা করা হয়। কনস্টানটিনোপলের পতনের পর সেখানকার অনেক পন্ডিত পশ্চিমে পালিয়ে যান, তারা শিক্ষা বিস্তারে উৎসাহ জোগান এবং উচ্চতর জ্ঞানচর্চা করেন যা রেনেসাঁ বলে পরিচিত।

বর্তমানে যে সমস্ত দেশসমূহ সে সময়য়কার বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল সেগুলো হলো- আলবেনিয়া, আলজেরিয়া, আর্মেনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সাইপ্রাস, মিশর, ফ্রান্স, জর্জিয়া, গ্রিস, সিরিয়া, ইরান, লিবিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, ইসরাইল, দক্ষিণ ইতালি, জর্ডান, কসোভো, মেসিডোনিয়া, মাল্টা, মন্টেনিগ্রো, মরক্কো, পর্তুগাল, রোমানিয়া, স্যান মারিনো, সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া, স্পেন, তিউনিশিয়া, তুরস্ক, ইউক্রেন এবং ভ্যাটিকান সিটি।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880

বি.দ্র: রকমারিসহ বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটে লেখকের সবগুলো বই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে লেখকের নামে সার্চ দিলেই যথেষ্ট।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.