নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইতিহাসের পাঠশালায়

আসিফ আযহার

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আসিফ আযহার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-২২ | জার্মানদের উত্থান ও রোমের পতন

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:৩৬


প্রাচীন যুগের ইউরোপকে গ্রিক ও রোমানরা যেভাবে আলোকিত করে রেখেছিল সেভাবে অন্যান্য জাতির মানুষ পারেনি। প্রাচীন ইউরোপের ইতিহাসে তারা অনেকটাই আধারে থেকে গিয়েছে। যাযাবর চরিত্র ও অনুন্নত জীবনব্যবস্থার জন্য তারা ইতিহাসের আলোয় আসতে পারেনি। গ্রিক ও রোমানদের ইতিহাসে তারা সাধারণভাবে ‘বর্বর’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। ‘বর্বর’ শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘barbaros’ থেকে এসেছে। গ্রিকরা নিজেদের ভাষার সাথে মিল নেই এমন ভিন্নভাষী লোকদেরকে ‘barbaros’ নামে ডাকত। বর্বর বা ‘barbaros’ বলতে প্রধানত জার্মান ও শ্লাভ জাতিগোষ্ঠীগুলোকেই বোঝানো হতো। গ্রিক ও রোমানদের পরে ইউরোপের ইতিহাসে ব্যাপক প্রাসঙ্গিকতা লাভ করেছে বেশ কিছু জার্মান জাতিগোষ্ঠী। মধ্যযুগের সূচনা ঘটিয়েছে এরাই। জার্মানদের লাগাতার আক্রমণে রোমান সাম্রাজ্য তছনছ হয়ে গিয়েছিল।

এ আক্রমণ চলেছিল শত শত বছর ধরে। রোমান সম্রাটরা বহুদিন ধরে জার্মান আক্রমণ ঠেকিয়ে গেলেও একসময় তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাওয়ায় সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তিও দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। তাই একপর্যায়ে রোমানরা জার্মানদের হাতে পরাজিত হতে শুরু করে। পরাজয়ের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছার পর অবশেষে ৪৭৬ সালের এক ঐতিহাসিক দিনে জনৈক জার্মান সেনানায়ক ওডোয়েসারের মাথায় রোমান সম্রাটের মুকুট তোলে দেওয়ার মাধ্যমে হাজার বছরের রোমান শাসনের পতন ঘটে। এ ঘটনা থেকেই মধ্য যুগের সূচনা হয়। রোমান সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরে ইউরোপের বিশাল অঞ্চলজুড়ে ছিল বিভিন্ন অনুন্নত যাযাবর জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। এদেরকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

১. কেল্টিক জাতিগোষ্ঠীসমূহ
২. জার্মান জাতিগোষ্ঠীসমূহ
৩. বাল্টো-শ্লাভ জাতিগোষ্ঠীসমূহ


চিত্র: শিল্পীর তুলিতে একটি কেল্টিক বসতি

এ তিন ধারার জাতিগোষ্ঠীসমূহ সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে নানা বৈচিত্রময়তায় বিকশিত হয়েছে। কেল্টিকরা একসময় জার্মানদের দ্বারা আক্রান্ত হতে হতে জার্মানদের সাথেই মিশে গিয়েছিল। এ মিশ্রণের মধ্য দিয়েই উৎপত্তি লাভ করেছিল আইরিশ, স্কট, ওয়েল্সীয়, ব্রাইটন, গওলিস, কর্নিস প্রভৃতি জাতি। জার্মানদের অপর প্রতিবেশী বাল্টো-শ্লাভদের মধ্য থেকে যেসব জাতি উৎপত্তি লাভ করেছিল তাদের তালিকা আরও অনক বড়। বাল্টিকদের মধ্য থেকে উৎপত্তি লাভ করেছিল লিথুনিয়ান, লাটভিয়ান, প্রাচীন প্রুশিয়ান প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী। পশ্চিম শ্লাভদের মধ্য থেকে উৎপত্তি লাভ করেছিল পোলিশ, স্লোভাক, চেক, সার্বিয়ান প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী। দক্ষিণ শ্লাভদের মধ্য থেকে উৎপত্তি লাভ করেছিল মেসিডোনিয়ান, স্লোভেনিয়ান, বুলগেরিয়ান, বসনিয়ান, সার্বো-ক্রোয়েশিয়ান, পুরাতন চার্চ স্লাভোনিক প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী। পূর্ব শ্লাভদের মধ্য থেকে উৎপত্তি লাভ করেছিল রাশিয়ান, বাইলোরাশিয়ান, ইউক্রেনিয়ান প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী।


চিত্র: কেল্টিক যোদ্ধা

শ্লাভদের মতো জার্মান জাতিগোষ্ঠীগুলোকেও তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এদের তালিকাও অনেক বড়। পূর্ব জার্মানদের মধ্য থেকে উৎপত্তি লাভ করেছিল ভ্যান্ডাল, গথ, লম্বার্ড প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী। পশ্চিম জার্মানদের মধ্য থেকে উৎপত্তি লাভ করেছিল ফ্রাংক, বার্গান্ডিয়ান, থুরিঞ্জিয়ান, বাভারিয়ান, আলেমান্নি, এঙ্গল, স্যাক্সন, ডাচ, ফ্রিজিয়ান, ফ্লেমিশ, ঈদিশ প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী। উত্তর জার্মানদের মধ্য থেকে উৎপত্তি লাভ করেছিল জাট, ডেন, নরওয়েজিয়ান, নর্মান, আইসল্যান্ডার, সুইডিশ, ফারোজ প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠী। কেল্টিক, জার্মান ও বাল্টো-শ্লাভ জাতিগোষ্ঠীসমূহের একটি তালিকা নিচে দেওয়া হল।

Celtic Tribes: Irish, Welsh, Breton, Gaulish, Cornish, Scots/Scotish
Baltic Tribes: Latvian, Lithunian, Old Prussian

Slavic Tribes:
West Slavic Tribes: Czech, Polish, Slovak, Sarbian
South Slavic Tribes: Bosnian, Bulgarian, Slovenian, Macedonian, Serbo-Croatian, Old Church Slavonic
East Slavic Tribes: Russian, Ukranian, Byelorussian

Germanic Tribes:
East Germanic Tribes: Goths, Vandals, Lombards
West Germanic Tribes: Suevi, Frisian, Franks, Angles, Saxons, Yiddish, Alemanni, Bavarians, Afrikaans, Thuringians, Burgundians, Flemish Dutch
North Germanic Tribes: Jutes, Danes, Farose, Swedish, Icelanders, Norwegians/Normans

রোমান বীর জুলিয়াস সিজারের লেখা গ্রন্থ ‘কমেন্টারিজ’ এবং রোমান ঐতিহাসিক ট্যাসিটাসের লেখা গ্রন্থ ‘জার্মেনিয়া’ থেকে জার্মানদের প্রাথমিক ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। রোমান সাম্রাজ্যের বাইরে মধ্য ইউরোপের বিশাল ভূখণ্ডজুড়ে ছিল জার্মানদের বসবাস। জার্মানদের কাছে এ ভূখন্ডের বিভিন্ন অংশের আলাদা নাম থাকলেও রোমানরা এ অঞ্চলকে একত্রে ‘জার্মেনিয়া’ বলে ডাকত।

জার্মানদের এই বিশাল অঞ্চলটি ছিল তাদের প্রতিবেশী রোমান সাম্রাজ্য ও শ্লাভদের অঞ্চল দ্বারা বেষ্টিত। ফলে তারা তাদের অঞ্চল থেকে বিভিন্ন দিকে বেরিয়ে পড়তে চাইলেও প্রতিবেশীদের চাপে তারা মূলত এই ভূখন্ডের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। তবে বিভিন্ন সময়েই তারা রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে জার্মানদের অনুপ্রবেশের ঘটনা এ সাম্রাজ্যের সূচনালগ্ন থেকেই দেখা যায়।


চিত্র: প্রাচীন জার্মান জীবন

ট্যাসিটাস তাঁর বিবরণীতে প্রথম শতাব্দীতেই রোমান সাম্রাজ্যের সীমান্তে ‘বিধর্মী’ বর্বরদের আক্রমণের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর বর্ণনায় জার্মানরা ছিল “হিংস্র নীল চোখ, লালচে চুল ও বিশাল দেহের অধিকারী; আক্রমণের জন্য বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের জন্য এতটা বলবান নয়; সামান্য গরম ও তৃষ্ণা সহ্য করতে সক্ষম যদিও তারা জলবায়ু ও মাটির দিক থেকে ঠান্ডা ও ক্ষুধায় অভ্যস্থ।”

প্রথম শতাব্দীতে শ্লাভ জাতিগোষ্ঠীগুলো সম্মিলিতভাবে পূর্বদিক থেকে জার্মানদের এলাকায় অভিযান শুরু করে। শ্লাভদের ক্রমবর্ধমান আক্রমণের চাপে টিকতে না পেরে জার্মানরা রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে শুরু করে। তখন রোমান রিপাবলিক সদ্য বিলুপ্তি লাভ করেছে; তার স্থলে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে নব্য রোমান একনায়কতন্ত্র। রোমান সেনানায়ক অগাস্টাস সিজার নিজেকে আজীবনের জন্য সিনেটের কনসাল ঘোষণা করে কার্যত রোমান সিনেট অচল করে দেন এবং রিপাবলিকের স্থলে এক নতুন সাম্রাজ্যের সূচনা ঘটান। তাঁর সময়ে সাম্রাজ্যের সীমানায় জার্মানদের আক্রমণ শুরু হয়।

অগাস্টাস ইতালির সীমান্ত হতে জার্মানদের বিতাড়িত করতে সামরিক অভিযানে নামেন। কিন্তু তিনি পুরোপুরি সফল হতে পারেননি। তাঁর শাসনামলেই সংঘটিত হয় বিখ্যাত টিউটোবার্গ ফরেস্টের যুদ্ধ। রোমান ও জার্মানদের মধ্যে সংঘটিত এ যুদ্ধে তিনটি রোমান লিজিয়ন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। খ্রিষ্টীয় ৯ সালে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।


চিত্র: টিউটোবার্গ ফরেস্টের যুদ্ধ

এ যুদ্ধে রোমানদের পক্ষে সেনাপতি ছিলেন পাবলিয়াস ভ্যারাস। অন্যদিকে, জার্মানদের নেতৃত্ব দেন আর্মিনিয়াস। আর্মিনিয়াস রোমানদের সমর কৌশল ভালোভাবেই জানতেন। তিনি একসময় রোমান নাগরিক ছিলেন ও রোমান সমরবিদ্যা খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন। তাই তাঁর কৌশলের কাছে রোমানরা হেরে যায়। ইতিহাসবিদরা রোমানদের এ পরাজয়কে যুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি বলে অভিহিত করেছেন।

রোমান ইতিহাসবিদ সিউটোনিয়াস তাঁর ‘সিজারদের জীবনী’ গ্রন্থে বলেন, টিউটোবার্গ ফরেস্টের যুদ্ধে রোমানদের পরাজয়ের সংবাদ শুনে অগাস্টাস এতোবেশী বিচলিত হয়ে পড়েন যে, তিনি তাঁর প্রাসাদের দেয়ালে মাথা ঠুকতে ঠুকতে চিৎকার করতে থাকেন, “ভ্যারাস, আমার লিজিয়নগুলো ফিরিয়ে দাও”।

টিউটোবার্গ ফরেস্টের যুদ্ধের পরবর্তীতে রোমানরা কিছু অভিযানে সফল হলেও তারা আর কখনো রাইন নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত জার্মানদের এলাকা দখলের কথা ভাবতেও পারেনি। অগাস্টাস সাম্রাজ্যের সীমানা বরাবর উচু উচু প্রাচীর ও দূর্গ নির্মাণ করে সীমান্ত রক্ষার উদ্যোগ নেন। এসব দূর্গকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে মধ্যযুগে অনেকগুলো শহর গড়ে উঠেছিল।


চিত্র: একটি জার্মান অভিযাত্রী দল

প্রথম শতকে রোমান সম্রাটের উদ্যোগে নির্মিত সীমানা প্রাচীর ও দূর্গশ্রেণি জার্মানদের অভিযান পুরোপুরি ঠেকাতে পারেনি। পরবর্তী দু’শো বছর ধরে অনেক জার্মান ক্রমান্বয়ে রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ে এবং রোমানদের সাথে মিশে যায়। এদেরকে অনেক রোমান সম্রাট সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিয়েছিলেন এবং এদেরকে দিয়েই শত্রু জার্মান গোষ্ঠীগুলোকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলেন।
তৃতীয় শতকে রোমান সাম্রাজ্যে জার্মান আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এ সময় রোমান ভূখণ্ড দখলের প্রথম সফল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ভিসিগথরা। ভিসিগথরা ২৬৮ সালে রোমান সাম্রাজ্যের বলকান উপদ্বীপ অঞ্চলে আক্রমণ চালায়। পরবর্তী তিন বছর ধরে নানা জয়-পরাজয়ের পর তারা রোমান প্রদেশ ডেসিয়া ধরে রাখতে সমর্থ হয়। রোমান সম্রাট অরেলিয়ান বাধ্য হয়ে তাদের সাথে আপষ করেছিলেন। ভিসিগথরা সম্রাটের কাছ থেকে ডেসিয়া প্রদেশে বসবাসের অনুমতি লাভ করেছিল।


চিত্র: ডেসিয়ায় জার্মান দূর্গে রোমান আক্রমণ

৩৭৬ সাল পর্যন্ত তারা ডেসিয়াতে অবস্থান করেছিল। সেবছর তারা হুনদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ আশ্রয় পাওয়ার জন্য রোমান সম্রাটের অনুমতি নিয়ে দানিয়ুব নদী পার হয়ে দক্ষিণে বসবাস করতে চলে আসে। এর এক বছর পর ভিসিগথদের অঞ্চলে একটি দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে এবং সে সময়য় তারা রোমীয় গভর্নরদের নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হয়। ফলে তারা রোমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধ একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যা শেষ হয় ৩৭৮ সালের ৯ আগস্ট সংঘঠিত আদ্রিয়ানোপলের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। যুদ্ধে ভিসিগথ নেতা ফ্রিটিগার্ন বিজয় লাভ করেন। ফ্রিটিগার্ন বলকান অঞ্চলে ভিসিগথদের একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

৩৯৫ সালে ভিসিগথদের রাজা হন বিখ্যাত নেতা এলারিক। এর পরবর্তী ১৫ বছর ধরে মাঝে মাঝে এলারিকের সাথে রোমান সৈন্যবাহিনীর সংঘর্ষ হতো। ৪০৮ সালে পশ্চিম রোমান সম্রাট হনোরিয়াসের আদেশে সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে এক জঘণ্য জার্মান গণহত্যা সংঘটিত হয়। এ সময় এলারিক সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এলারিক রোমের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়ার পরও হনোরিয়াস সমঝোতার জন্য কাউকে পাঠাননি।

তাই এলারিক ৪১০ সালের ২৪ আগস্ট তারিখে শহরটি দখল করে নেন। এর পরবর্তীতে ভিসিগথরা ফ্রান্সের আকিতাইন অঞ্চল ও স্পেন দখল করে নিয়ে সেখানে ভিসিগথ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। ৪৭৫ সালে ভিসিগথ রাজা ইউরিক রোমান সরকারের কাছ থেকে ভিসিগথ রাজ্যের পূর্ণ স্বাধীনতা আদায় করেছিলেন।


চিত্র: আদ্রিয়ানোপলের যুদ্ধে রোমান সেনা

ভিসিগথদের মতোই রোমান সাম্রাজ্যে অন্যান্য যেসব জার্মান গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তাদের মধ্যে ফ্রাংক, আলেমান্নি, বার্গান্ডিয়ান, ভ্যান্ডাল, অস্ট্রোগথ প্রভৃতি গোষ্ঠী বিখ্যাত। পঞ্চম শতকজুড়ে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি এবং রাজনৈতিক সংহতির পতন ঘটতে থাকে। এ সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এবং বিভিন্ন এশীয় গোষ্ঠীর আক্রমণের চাপে জার্মান জাতির মানুষ এক দীর্ঘ ও বৈচিত্রপূর্ণ অভিযান শুরু করে যা তাদেরকে গ্রেট ব্রিটেন থেকে শুরু করে দক্ষিণ ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় এবং উত্তর আফ্রিকার ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত নিয়ে যায়।

এই মাইগ্রেশনের ফলে রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে জার্মানদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটে। এছাড়াও জার্মানদের এক গোষ্ঠীর এলাকায় আরেক গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশও ছিল সাধারণ ব্যাপার। এর ফলে তাদেরকে নিজেদের মধ্যেও প্রচুর সংঘাতে জড়াতে হয়। জার্মানদের এক গোষ্ঠীর কাছে আরেক গোষ্ঠী পরাজিত হলে পরাজিত গোষ্ঠী হয় বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ত অথবা বিজয়ী গোষ্ঠীর সাথে মিশে যেতো।


চিত্র: চতুর্থ শতকের গথ যোদ্ধা

উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, ডেনমার্কের জাটরা ডেনদের সাথে মিশে গিয়েছিলো। সুইডেনের গীটরা সুইডিশদের সাথে মিশে যায়। ইংল্যান্ডে এঙ্গল, স্যাক্সন এবং অন্যান্য গোষ্ঠী (বিশেষ করে জাটরা) একসাথে মিশে গিয়েছিল। সেই সাথে কিছু স্থানীয় লোকজনও এংলো-স্যাক্সনদের সাথে মিশে গিয়েছিলো। পরাজয়ের ফলে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সাথে মিশে যাওয়ার এ ব্যাপারটি বিভিন্ন শক্তিশালী জার্মান জাতি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গভীর ভূমিকা রেখেছে।

জার্মান গোষ্ঠীগুলো একসময় তাদের সুরক্ষার উপায় হিসাবে শক্তিশালী নেতার অধীনে স্থায়ী বসতি স্থাপনের চেষ্টা শুরু করে। পঞ্চম শতকে বিভিন্ন জার্মান গোষ্ঠীর স্থায়ী বসতি বিস্তৃত হতে থাকে। জার্মানদের বেশ কিছু গোষ্ঠী নিজেদের জন্য পর্যাপ্ত ভূমি দখলে সফল হয়েছিল। এদের মধ্যে ভিসিগথ, অস্ট্রগথ এবং লম্বার্ডরা ইতালিতে ঢুকে পড়েছিল। ভ্যান্ডাল, বার্গান্ডিয়ান, ফ্রাংক এবং ভিসিগথরা গলের বেশিরভাগ জয় করে নিয়েছিল। ভ্যান্ডাল এবং ভিসিগথরা স্পেনেও ঢুকে পড়ে। ভ্যান্ডালরা উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত এগিয়ে যায়। আলেমান্নীরা মধ্য রাইন এবং আল্পস অঞ্চলে তাদের শক্তি প্রতিষ্ঠা করে।


চিত্র: গথ আক্রমণের দৃশ্য

রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে বসতি স্থাপনকারি জার্মানদের মধ্যে ফ্রাংকরা ছিল প্রথম জার্মান গোষ্ঠী যারা রোমানদের এলাকায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছিল। ফ্রাংকরা রোমানদের মিত্র ছিল। রোমানরা ফ্রাংকদেরকে বেলজিকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশে বসবাসের অনুমতি দিয়েছিল। এই সময় থেকে ফ্রাংকরা রোমান সাম্রাজ্যের ‘ফোয়েদেরাতি’ বা যুক্তরাষ্ট্রীয় অংশে পরিণত হয়।

৪০৬ সালে পূর্ব জার্মান গোষ্ঠীগুলো রাইন নদী অতিক্রম করে রোমান সাম্রাজ্যে বড় ধরণের আক্রমণ চালায়। তখন ফ্রাংকরা রোমানদের পক্ষ হয়ে এই আক্রমণকারিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল। জার্মানদের মধ্যে ফ্রাংকরাই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। রোমানদের পতনের পর পশ্চিম ইউরোপের একমাত্র তারাই শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তোলেছিল।


চিত্র: অশ্বারোহী জার্মান যোদ্ধা

আলেমান্নিরা রোমান সাম্রাজ্যে অনুপ্রবেশ শুরু করে তৃতীয় শতকে। তারা ২৬৮ সালে উত্তর ইতালিতে ব্যাপক অভিযান শুরু করে। এ সময় রোমানরা ভিসিগথদের ব্যাপক আক্রমণের চাপেও বিপর্যস্ত ছিল। ৩৬৬ সালে তারা রাইন নদী অতিক্রম করে রোমান সাম্রাজ্যে আবারও আক্রমণ চালায়। ৫ম শতাব্দীর প্রথমদিকে আলেমান্নিরা রাইন নদী পার হয়ে আলসাস এবং সুইজারল্যান্ডের একটি বৃহৎ অংশ দখল করে এবং সেখানে বসতি গড়ে তোলে। তাদের এই রাজ্য ৪৯৬ সাল পর্যন্ত ঠিকেছিল। ৪৯৬ সালে তারা প্রভাবশালী জার্মান গোষ্ঠী ফ্রাংকদের কাছে পরাজিত হয়।
জার্মানদের চেয়েও বেপরোয়া ও দুধর্ষ আরেকটি জাতি ছিলো হুনরা। এরা ইউরোপীয় ছিল না; এরা ছিলো মধ্য এশিয়া থেকে আগত মঙ্গোলীয় গোষ্ঠী। চতুর্থ শতক থেকে এরা ইউরোপে ঢুকে পড়ে জার্মানদের এলাকায় আক্রমণ শুরু করে। ৪৩৭ সালে তাতার গোত্র হুনদের আক্রমণে রাইনের বার্গান্ডিয়ান রাজ্য ধ্বংস হয়। হুনরা বার্গান্ডিয়ান রাজ্যের রাজধানী ওয়ার্ম ধ্বংস করে। এ সময় রোমান সেনানায়ক এটিয়াস বার্গান্ডিয়ান উদ্বাস্তুদেরকে রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে পূনর্বাসিত করেন।

এর পরবর্তীতে তারা উত্তর ইতালি, পশ্চিম সুইজারল্যান্ড এবং পূর্ব ফ্রান্সজুড়ে বার্গান্ডিয়ান অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে। ৪৫১ সালে হুন নেতা আত্তিলার বিরুদ্ধে কেলনসের যুদ্ধে বার্গান্ডিয়ানরা অন্যান্য জার্মানদের নিয়ে গঠিত কনফেডারেশন ও এটিয়াসের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করে। এ যুদ্ধে আত্তিলা পরাজিত হন। ৫৫৪ সালে বার্গান্ডিয়ানরা ফ্রাংকদের কাছে পরাজিত হয়। বার্গান্ডিয়ান রাজ্যকে ফ্রাংকরা তাদের মরোভিঞ্জিয়ান রাজ্যের অংশে পরিণত করে।


চিত্র: কেলনসের যুদ্ধ

অস্ট্রোগথরা হুনদের বিরুদ্ধে গঠিত জার্মান জোটের অন্তর্ভূক্ত ছিল না। তারা হুনদের মিত্র ছিল। ৩৭০ সালের দিকে তারা হুনদের অধীনতায় চলে যায় এবং পরবর্তী কয়েক দশক ধরে হুনদের সাথে বলকান অঞ্চলে বসবাস করে। এ সময় ইউরোপের অন্য অনেকের মতো তারাও হুনদের ভ্যাসাল হয়ে যায়। ৪৫১ সালে কেলনসের যুদ্ধে তারা হুনদের ভ্যাসাল হিসেবে যুদ্ধ করে। হুন নেতা আত্তিলার মৃত্যুর পর হুন সাম্রাজ্য থেকে তারা স্বাধীন হয়। এরপর তারা পান্নোনিয়াতে বসতি স্থাপন করে। ৫ম শতকের শেষার্ধে তারা দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের এক উল্লেখযোগ্য অংশ দখলে নেয়। এ শতকের শেষ দিকে তারা ইতালিও দখল করে নিয়েছিল।

ফ্রাংক এবং ভিসিগথদের মতো আরেকটি প্রভাবশালী জার্মান গোষ্ঠী ছিলো ভ্যান্ডালরা। ৪০০ সালে হুনদের আক্রমণের চাপে ভ্যান্ডালরা তাদের জার্মান ও সারমাতিয়ান মিত্রদেরকেসহ পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। ভ্যান্ডালরা যখন রাইনের কাছে পৌঁছায় তখন তারা ফ্রাংকদের প্রতিরোধের মুখোমুখী হয়। ফ্র্যাঙ্করা রোমানদের কাছ থেকে পাওয়া উত্তর গ্যালিয়া অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত। ফ্র্যাঙ্কদের সাথে যুদ্ধে ভ্যান্ডালরা পরাজিত হয়।

তবে এরপর তারা অ্যালানদের সাহায্যে ফ্র্যাঙ্কদের পরাজিত করে এবং ৪০১ সালে ভ্যান্ডালরা গ্যালিয়া আক্রমণের জন্য রাইন অতিক্রম করে। তারা গ্যালিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে লুটপাট চালিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ৪০৯ সালের অক্টোবরে তারা স্পেনের পিরেনিজ পর্বতমালা অতিক্রম করে। সেখানে তারা রোমানদের কাছ থেকে গ্যালিসিয়া এবং আন্দালুসিয়া দখল করে নেয়। অন্যদিকে পর্তুগাল এবং কার্টেজেনার চারপাশের অঞ্চল পেয়েছিল অ্যালানরা।


চিত্র: হুন নেতা আত্তিলার যোদ্ধারা

৪৩৫ সালে রোমানরা ভ্যান্ডালদেরকে উত্তর আফ্রিকার কিছু অঞ্চল দান করে। ৪৩৯ সালে কার্থেজ ভ্যান্ডালদের পদানত হয়। এরপর ভ্যান্ডাল নেতা জেনসেরিক ভ্যান্ডাল ও অ্যালানদের জন্য একটি শক্তিশালী রাজ্য গড়ে তোলেন এবং সিসিলি, সার্ডিনিয়া, কর্সিকা ও বেলারিক দ্বীপপুঞ্জ দখল করেন। ৪৫৫ সালে ভান্ডালরা রোম নগরী দখল ও ধ্বংস করে এবং ৪৬৮ সালে তাদের বিরুদ্ধে পাঠানো একটি বিশাল বাইজেন্টাইন নৌবহর ধ্বংস করে। শেষ পর্যন্ত ৫৩৩ সালে বাইজেন্টাইনদের হাতে ভ্যান্ডাল রাজ্যের পতন ঘটে।

৪৫৫ সালে ভ্যান্ডালদের হাতে লুন্ঠিত হওয়ার পর ইতালিতে রোমান শাসন নামে মাত্র টিকে ছিল। রোমান সম্রাটরা নামে মাত্র ক্ষমতায় ছিলেন। সম্রাটরা তাদের অধীনস্ত রোমান ও জার্মান সেনানায়কদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। রোমান সম্রাট জুলিয়াস নেপোস ৪৭৫ সালে অরেস্টিস নামক একজন রোমান জেনারেলকে সামরিক ম্যাজিস্ট্রেট ও প্যাট্রিসিয়ানের পদে নিযুক্ত করেন এবং অরেস্টিস জার্মান ফোয়েদেরাতি (রোমের মিত্র ও ভাড়াটে জার্মান বাহিনী) এর প্রধান হন। যাই হোক, এর কিছু দিন পর অরেস্টিস উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠেন এবং সেবছরের শেষে ইতালি থেকে সম্রাট জুলিয়াস নেপোসকে উৎখাত করেন।


চিত্র: জার্মানদের হাতে লুণ্ঠিত রোম

এরপর অরেস্টিস তাঁর বালক ছেলে রেমুলাস অগাস্টুলাসকে নতুন সম্রাট ঘোষণা করেন। তবে সম্রাট জুলিয়াস নেপোস স্যালোনা, দালমাতিয়ায় তাঁর রাজদরবার পুনর্গঠিত করেন এবং ইতালির বাইরে রোমান সাম্রাজ্যের যেসব খন্ডিত অংশ টিকেছিল সেসব অংশের সমর্থন লাভ করেন। তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল তিনি পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য অর্থাৎ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সমর্থন লাভ করেছিলেন। বাইজেন্টাইন সম্রাট তাকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান অব্যাত রেখেছিলেন। বাইজেন্টাইন সম্রাট রেমুলাস অগাস্টুলাসকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান এবং তাকে ও তাঁর পিতাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিষিক্ত করেন।

এই সময়ে জার্মান ফেয়েদেরাতি অর্থাৎ রোমের মিত্র ও বেতনভোগী জার্মান সৈন্যরা রোমের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তারা ইতালিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইতালিতে তাদের নিজেদের কোন ভূমি ছিল না। ইতালিতে নিজেদের ভূখণ্ড লাভের জন্য সম্রাটের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়ার ব্যাপারে তারা অনেকদিন ধরে আশা পোষণ করে আসছিল। তারা অরেস্টিসের কাছে তাদের সে আশাবাদের কথা জানায় এবং রোমান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতার বিনিময়ে তারা নিজেদের জন্য ভূমি দাবি করে। কিন্তু অরেস্টিস তাদের সে দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তারা অরেস্টিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করে।

জার্মানরা তাদের বিদ্রোহে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য ফোয়েদেরাতিতে কর্মরত স্কিরিয়ান (একটি অখ্যাত জার্মান গোষ্ঠী) সেনানায়ক ওডোয়েসারকে আহ্বান জানায়। ওডোয়েসারের নেতৃত্বে তিনটি জার্মান গোষ্ঠীর (হিরুলিয়ান, রুজিয়ান ও স্কিরিয়ান) সৈন্যরা অরেস্টিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নামে। তারা প্লাসেন্টিয়ার যুদ্ধে অরেস্টিসকে পরাজিত ও হত্যা করে এবং অরেস্টিসের ভাই পউলাসকে রাভেন্নার বাইরে হত্যা করা হয়।


চিত্র: রোমান-জার্মান যুদ্ধ

জার্মান ফোয়েদেরাতির সৈন্যরা ওডোয়েসারকে ‘রেক্স ইতালিয়া’ (ইতালির রাজা) ঘোষণা করে। সেইসাথে ইতালির রোমান সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশও ওডোয়েসারকে রাজা হিসেবে মেনে নেয়। ৪৭৬ সালে ওডোয়েসার রাভেন্নার দিকে অগ্রসর হন। তিনি বালক সম্রাট রেমুলাস অগাস্টুলাসের নিয়ন্ত্রণ থেকে নগরীটি দখল করে নেন এবং রেমুলাসকে সিংহাসন ত্যাগে বাধ্য করেন। ৪৭৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে ওডোয়েসার রেমুলাস অগাস্টুলাসকে সিংহাসনচ্যুত করেছিলেন এবং এ দিন থেকেই মধ্যযুগের শুরু বলে ধরা হয়।

অ্যানোনিমাস ভ্যালেসিয়ানুসের বিবরণী থেকে জানা যায় ওডোয়েসার বালক রেমুলাসের বয়স ও সৌন্দর্য্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যান এবং তার সৌন্দর্য্যে আকৃষ্ট হয়ে তিনি তার প্রতি ইতিহাসের অন্যতম বিরল বদান্যতা প্রদর্শন করেন। তিনি রেমুলাসের জন্য পেনশনের ব্যাবস্থা করে দেন এবং তাকে ক্যাম্পানিয়ায় আত্মীয়দের সঙ্গে বসবাসের অনুমতি প্রদান করেন। ওডোয়েসারের ক্ষমতা দখলের ঘটনাকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসের সমাপ্তি বলে ধরা হয়; একই সাথে এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রাচীন যুগেরও সমাপ্তি ঘটে।


চিত্র: ঘোড়ায় টানা রথে জার্মান যোদ্ধা

যদিও ওডোয়েসারের অনুগত জার্মান ও রোমানরা তাকে তাদের ‘রাজা’ ঘোষণা দিয়েছিল এবং ইতালির প্রকৃত ক্ষমতা তাঁর হাতেই ছিল তবুও তিনি নিজেকে বিতাড়িত রোমান সম্রাট জুলিয়াস নেপোসের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করতেন এবং ৪৮০ সালে নেপোসের মৃত্যুর পর তিনি নিজেকে কন্সটান্টিনোপলের (বাইজেন্টাইন-পূর্ব রোমান) সম্রাট জেনোর প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করতেন।

ওডোয়েসার নিজের ক্ষেত্রে সাধারণত রোমান সম্মানসূচক উপাধী ‘প্যাট্রিসিয়ান’ ব্যবহার করতেন যদিও অনেক ঐতিহাসিক দলিলে তাকে রাজা (ল্যাটিন রেক্স) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘প্যাট্রিসিয়ান’ উপাধীটি তিনি লাভ করেছিলেন বাইজেন্টাইন সম্রাট জেনোর কাছ থেকে। তিনি কেবলমাত্র একবার নিজের জন্য ‘রেক্স’ (রাজা) শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন এবং আরেকবার এক অনুষ্ঠানে কনসাল বাসিলিয়াস তাঁর ক্ষেত্রে এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।

ওডোয়েসার ইতালি প্রশাসনিক ব্যবস্থার কিছু ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন। তিনি রোমান সিনেটর সমর্থন পেয়েছিলেন এবং তেমন কোন বাঁধা ছাড়াই তাঁর অনুগামীদের কাছে ভূমি বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর যোদ্ধাদের মধ্যে ৪৭৭-৭৮ সালে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল যে কারণে তারা কিছু সহিংসতা জড়িয়ে পড়েছিল। তবে তাঁর রাজত্বের পরবর্তী সময়ে এ ধরনের আর কোন ঝামেলা হয়নি। যদিও ওডোয়েসার ছিলেন একজন আরিয়ান খ্রিষ্টান, তিনি রোমান সাম্রাজ্যের অর্থডক্স এবং ট্রিনিটারিয়ান রাষ্ট্রীয় চার্চের কর্মকান্ডে খুব কমই হস্তক্ষেপ করেছিলেন।


চিত্র: উন্নত অস্ত্রসজ্জিত জার্মান যোদ্ধা

একপর্যায়ে ওডোয়েসারের অবস্থান যথেষ্ট শক্তিশালী হলে তাকে বাইজেন্টাইন সম্রাট জেনো একজন উদীয়মান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখতে শুরু করেন। ৪৮৪ সালে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সেনাপ্রধান ইলাস জেনোকে উৎখাত করার জন্য ওডোয়েসারের সাহায্য কামনা করেন। ওডোয়েসার জেনোর পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশগুলিতে আক্রমণ করেন। জেনো এর প্রতিক্রিয়াস্বরুপ তৎকালীন সময়ে বর্তমান অস্ট্রিয়া অঞ্চলের অধিবাসী জার্মান গোত্র রুগীয়দেরকে ইতালি আক্রমণের জন্য উস্কে দেন।

৪৮৭-৮৮ সালের শীতকালে ওডোয়েসার দানিয়ুব নদী পার হয়ে রুগীয়দেরকে তাদের নিজস্ব অঞ্চলে পরাজিত করেন। ওডোয়েসারকে ধ্বংস করার জন্য জেনো এবার অস্ট্রোগথদের সাথে সমঝোতায় আসলেন। তিনি অস্ট্রোগথ নেতা থিওডোরিক দ্য গ্রেটকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, যদি থিওডোরিক ইতালি দখল করে ওডোয়েসারকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে পারেন তাহলে তিনি ইতালীয় উপদ্বীপে অস্ট্রোগথদের শাসনকে স্বীকৃতি প্রদান করবেন। ৪৮৯ সালে থিওডোরিকের নেতৃত্বে অস্ট্রোগথরা জুলিয়ান আল্পস পাড়ি দিয়ে ইতালিতে প্রবেশ করে। ২৮ আগস্ট তারিখে ওডোয়েসার ইসানজোতে তাদের মুখোমুখি হন কিন্তু সফলতা লাভ করতে ব্যর্থ হন।


চিত্র: সভ্য জীবনে জার্মান নাগরিক

এরপর ওডোয়েসার ভেরোনার দিকে অগ্রসর হন। ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাঁর বাহিনী ভেরোনার উপকন্ঠে পৌঁছায়। তারা অবিলম্বে সেখানে একটি সুরক্ষিত দূর্গ স্থাপন করে। থিওডোরিক তাদেরকে অনুসরণ করে সেখানে পৌঁছান এবং তিন দিন পরে তাদেরকে আবারও পরাজিত করেন। ওডোয়েসার এবার রাভেন্নায় আশ্রয় নিলে থিওডেরিক মিডিওলেনামের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। সেখানে ওডোয়েসারের সেনাপতি তুফাসহ তাঁর অধিকাংশ সৈন্য অস্ট্রোগথদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ওডোয়েসার রাভেন্নায় তাঁর অবস্থান ধরে রাখেন।

পরবর্তী গ্রীষ্মে ভিসিগথ নেতা দ্বিতীয় এলারিক গথিক সংহতির ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তাঁর গথিক জাতিভাইদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। তিনি ওডোয়েসারের বিরুদ্ধে এক সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে দেন। ভিসিগথ বাহিনী ওডোয়েসারকে তাঁর অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করে। ৪৯০ সালের ১১ আগস্ট অ্যাডা নদীর কাছে দুই বাহিনীর সংঘর্ষ হয়।


চিত্র: জার্মান ক্রীতদাস

যুদ্ধে ওডোয়েসার পরাজিত হয়ে রাভেন্নায় ফিরে আসেন। থিওডোরিক তাঁর বাহিনী নিয়ে রাভেন্না অবরোধ করেন। কিন্তু জলাভূমি ও নদীমোহনা দ্বারা বেষ্টিত থাকার কারণে রাভেন্না সত্যিই দূর্ভেদ্য ছিল। পশ্চাৎভূমির সাথে নৌকাযোগে রাভেন্নার জলযোগাযোগ সম্ভব ছিল। কিন্তু অবরোধ অব্যাহত থাকায় রাভেন্না কয়েক মাসের মধ্যেই অচল হয়ে পড়ে।

এই পরিস্থিতিতে ওডোয়েসারকে বিজয়ের সকল আশা ছেড়ে দিতে হয়। ৪৯১ সালের ৯ জুলাই রাত ৯টায় রাভেন্নার বাইরে তাঁর সৈন্যদের একটি আক্রমণ শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। এ সংঘর্ষে তাঁর কমান্ডার ইন চীফ লিভিলিয়া নিহত হন এবং তাঁর বাহিনীর সেরা হেরুলিয়ান সৈন্যরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ৪৯২ সালের ২৯ আগস্ট তারিখে গথরা পর্যাপ্ত জাহাজ জোগাড় করে জলপথেও অবরোধ বসায়। এরপরও ৪৯৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যুদ্ধ প্রলম্বিত হয়। এদিন রাভেন্নার বিশপ জন এর মধ্যস্থতায় থিওডোরিক ও ওডোয়েসারের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়।

চুক্তি অনুযায়ী রাভেন্নাতে উভয়পক্ষের দখল ও যৌথশাসনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। এর ফলে কয়েক বছরের অবরোধের সমাপ্তি ঘটে। ৫ মার্চ তারিখে থিওডোরিক রাভেন্নায় প্রবেশ করেন। এর দশদিন পর এক যৌথভোজের অনুষ্ঠানে থিওডোরিক ওডোয়েসারকে হত্যা করেন। ইতোপূর্বে থিওডোরিক তাঁর কিছু অনুসারিদের মাধ্যমে ওডোয়েসারকে হত্যার একটি পরিকল্পনা করেছিলেন। পরিকল্পনা ছিল যখন ‘অ্যাড লরেন্টাম’ রাজপ্রাসাদে দুই রাজা একত্রে খেতে বসবেন তখন থিওডোরিকের সৈন্যরা ওডোয়েসারকে হত্যা করবে।


চিত্র: যুদ্ধক্ষেত্রে জার্মান যোদ্ধা

কিন্তু এই পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় থিওডোরিক নিজেই খাবারের সময় ওডোয়েসারকে হত্যা করেন। কথিত আছে, যখন পূর্বপরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসে তখন থিওডেরিক নিজেই তাঁর তলোয়ারটি টেনে বের করেন এবং ওডোয়েসারের কলারবোনে আঘাত করেন। হতবিহ্বল ওডোয়েসার তাঁর মৃত্যুর মুহুর্তে শুধু একটি প্রশ্নই করতে পেরেছিলেন। ওডোয়েসার তাঁর মৃত্যুর মুহুর্তে চিৎকার করে বলেছিলেন, “ঈশ্বর কোথায়?” থিওডোরিক এ প্রশ্নের জবাবে চিত্কার করে বলেছিলেন, “তুমি আমার বন্ধুদের সাথে যা করেছো আমিও তা-ই করেছি।”

থিওডোরিক ওডোয়েসারের কাছ থেকে ইতালির সিংহাসন দখল করার পর রোমের হারানো গৌরব সংরক্ষণের চেষ্টা করেন। তিনি ৫২৬ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ইতালির সিংহাসনের অধিকারি ছিলেন। রোমান সভ্যতার নিদর্শন সংরক্ষণ এবং প্রাসাদ ও রাস্তাঘাটের সংস্কারের মাধ্যমে এই অস্ট্রোগথ নেতা জার্মানদের মধ্যে এক ভিন্ন রকমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। সভ্যতা ধ্বংসকারি জার্মানদের পাশাপাশি ইতিহাসে সভ্যতা সংরক্ষণকারি জার্মানদেরও খুঁজে পাওয়া যায়। অস্ট্রোগথ নেতা থিওডোরিক এর অন্যতম উদাহরণ। অস্ট্রোগথদেরও ইতিহাস অন্যান্য জার্মান গোষ্ঠীগুলোর ইতিহাস থেকে কিছুটা ভিন্ন ধরণের।


চিত্র: সভ্য জীবনে অভ্যস্থ জার্মান নারী-পুরুষ

সমস্ত অস্ট্রোগথিক শাসকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক থিওডোরিক দ্য গ্রেটের জীবনের একটি অংশ কেটেছিলো কন্সটান্টিনোপলে। থিওডোরিক দ্য গ্রেট বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বন্ধু ও শত্রু দুই’ই ছিলেন। ৪৮৮ সাল থেকে তিনি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হন এবং বাইজেন্টাইন সম্রাট জেনোর সমর্থনপুষ্ঠ হয়ে ওডোয়েসারের হাত থেকে ইতালি উদ্ধার করেন। এরপর ইতালি, সিসিলি, দালমাতিয়া, গলের একটি বড় অংশ এবং প্রায় সমগ্র স্পেনে অস্ট্রোগথিক রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ষ্ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান কর্তৃক উৎখাত হওয়ার সময় পর্যন্ত এই অস্ট্রোগথ রাজ্য টিকে ছিল।

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880

বি.দ্র: রকমারিসহ বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটে লেখকের সবগুলো বই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে লেখকের নামে সার্চ দিলেই যথেষ্ট।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১:০৬

যোখার সারনায়েভ বলেছেন: এটাও রাখলাম প্রিয়তে।

২| ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৫৪

রাজীব নুর বলেছেন: চমৎকার পোষ্ট।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.