নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইতিহাসের পাঠশালায়

আসিফ আযহার

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

আসিফ আযহার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসের পাঠশালায়: পর্ব-২৫ | ফ্রাংক জাতির উত্থান

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:০৮


প্রাচীন ফ্রাঙ্কিশ ইতিহাস তুলনামূলকভাবে অস্পষ্ট। আধুনিক পণ্ডিতদের ধারণা ফ্রাংকরা রাইন উপত্যকায় বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র জার্মানিক গোষ্ঠীর সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে উৎপত্তি লাভ করেছে। গ্যালো রোমান ইতিহাসবিদ গ্রেগরি (গ্রেগরি অভ ট্যুরস) জানান যে, ফ্রাংকরা মূলত পান্নোনিয়াতে বসবাস করত। তবে পরবর্তীতে তারা রাইন নদীর অববাহিকায় বসতি স্থাপন করে। এ অঞ্চলটি বর্তমান নেদারল্যান্ডের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। সে সময়য়ে এ অঞ্চলের অবস্থান ছিল যেমন রোমান সীমান্তের উত্তরে। রোমানরা এ অঞ্চলকে স্যালান্ড নামে ডাকত। সম্ভবত স্যালিয়ান্সদের থেকে এই নামটি এসেছিল।


চিত্র: পশ্চিম ইউরোপের মানচিত্রে ফ্রাংকদের অবস্থান

২৫০ সালের দিকে রোমান সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে ফ্রাংকদের একটি দল স্পেনের ট্যারাগোনা অঞ্চল পর্যন্ত অনুপ্রবেশ করে। এই অঞ্চলে প্রায় এক দশক ধরে তারা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর রোমান বাহিনী তাদেরকে পরাজিত করে এবং রোমান এলাকা থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করে। এর প্রায় চল্লিশ বছর পর শেল্ডট অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ফ্রাংকদের হাতে আসে এবং তারা ব্রিটিশ-রোমান জলপথের ওপর হস্তক্ষেপ শুরু করে। রোমান বাহিনী ফ্রাংকদেরকে শান্ত করে তবে এদেরকে বহিষ্কার করতে তারা ব্যর্থ হয়।


চিত্র: ফ্রাংক যোদ্ধা

৩৫৫ থেকে ৩৫৮ সালের মধ্যে রোমান সম্রাট জুলিয়ান রাইনের নদীপথে হস্তক্ষেপ থেকে ফ্রাংকদের শান্ত করেন। রোমানরা ফ্রাংকদেরকে বেলজিকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশে বসবাসের অনুমতি দেয়। এই সময় থেকে ফ্রাংকরা রোমান সাম্রাজ্যের ‘ফোয়েদেরাতি’ বা যুক্তরাষ্ট্রীয় অংশে পরিণত হয়। বেলজিকার সেই উল্লেখযোগ্য অংশটি আজকের দিনের ফ্ল্যান্ডার্স অঞ্চল এবং নেদারল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত। এ অঞ্চলটিতে আজও জার্মানিক ভাষাগোত্রের অন্যতম শাখা ডাচ ভাষা প্রচলিত। ফ্রাংকরা ছিলো প্রথম জার্মান গোষ্ঠী যারা রোমানদের এলাকায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছিল।


চিত্র: সভ্য জীবনে ফ্রাংক নারী-পুরুষ

ফ্রাংকরা তাদের এই ঘাঁটি এলাকা থেকে ধীরে ধীরে লয়ের উপত্যকার উত্তরের এবং ভিসিগথিক আকিতাইনের পূর্বদিকের রোমান গলের বেশিরভাগই জয় করে নেয়। প্রথমদিকে তারা মিত্র হিসেবে রোমানদের সীমান্ত রক্ষা করতে সাহায্য করেছিল। ৪০৬ সালে পূর্ব জার্মান গোষ্ঠীগুলো রাইন নদী অতিক্রম করে রোমান সাম্রাজ্যে বড় ধরণের আক্রমণ চালায়। তখন ফ্রাংকরা রোমানদের পক্ষ হয়ে এই আক্রমণকারিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল। লয়ের নদীর দক্ষিণে আক্রমণের প্রথম ধাক্কা তারা প্রতিহত করেছিল। প্যারিস অঞ্চলে রোমান নিয়ন্ত্রণ ৪৮৬ সাল পর্যন্ত বজায় ছিল।

মরোভিঞ্জিয়ান রাজবংশ (৪৮২-৭৫১ সাল)
----------------------------------------------
ফ্রাংকদের ইতিহাসে তাদের দুজন বিখ্যাত সর্দারের শাসনকালের কথা বিশেষ স্থান দখল করেছে। এ দুজনের একজন ফ্যারামন্ড। আনুমানিক ৪১৯ থেকে ৪২৭ সাল পর্যন্ত তাঁর শাসনকাল ছিল। অন্যজন ক্লদিয়ো। আনুমানিক ৪২৭ থেকে ৪৪৭ সাল পর্যন্ত তাঁর শাসনকাল ছিল। তবে এদের ব্যাপারে বাস্তব ইতিহাসের চেয়ে মিথই বেশি প্রচলিত ছিল। মরোভিঞ্জিয়ান বংশের সাথে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি কিছুটা অনিশ্চিত। ক্লদিয়োর পরবর্তী সময়ে ফ্রাংকরা দু’টি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়তে থাকে। একটি অংশ স্যালিয়ান ফ্রাংক আর অন্য অংশটি রিপুয়ারিয়ান ফ্রাংক।

গ্যালো রোমান ইতিহাসবিদ গ্রেগরির ভাষ্য অনুসারে ক্লদিয়ো ছিলেন প্রথম ফ্রাংক রাজা যিনি ক্যামারাকুম দখলের মধ্য দিয়ে গলদেশে বিজয় অভিযান শুরু করেন। রোমান সেনানায়ক এটিয়াস ৪২৮ সালে ক্লদিয়োকে পরাজিত করে রাইন অববাহিকার কিছু অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেছিলেন। এর পরবর্তীতে হুন আক্রমণের ফলে রাজনৈতিক সমীকরণ যায় বদলে। হুন আক্রমণের বিপদ রোমান ও ফ্রাংকদেরকে এক কাতারে নিয়ে আসে।


চিত্র: স্যালিয়ান ফ্রাংকদের রাজা মরোভিচ

৪৫১ সালে রোমান সেনানায়ক এটিয়াস হুনদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য জার্মান মিত্রদের সাহায্য কামনা করেন। স্যালিয়ান ফ্রাংকরা রোমানদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। রিপুয়ারিয়ান ফ্রাংকদের দুই অংশ দুই দিকে যোগ দেয়। রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে বসবাসকারি রিপুরিয়ান ফ্রাংকরা যোগ দেয় রোমান বাহিনীর সাথে। অন্যদিকে, রোমান সাম্রাজ্যের বাইরের অংশটি যোগ দেয় হুনদের সাথে।

এই সময়ে স্যালিয়ান ফ্রাংকদের রাজা ছিলেন মরোভিচ। মরোভিচ ক্লদিয়োর পুত্র ছিলেন কিনা তা নিশ্চিত নয়। তাঁর পরবর্তী বিখ্যাত ফ্রাংক রাজা হলেন ক্লভিস। ক্লভিস ফ্রাংক জাতিকে তাঁর একক নেতৃত্বের অধীনে নিয়ে আসেন এবং একটি শক্তিশালী রাজবংশের সূচনা ঘটান। ক্লভিস প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ মরোভিঞ্জিয়ান রাজবংশ নামে পরিচিত হয়।

স্যালিয়ান ফ্রাংকদের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন ক্লভিস। ক্লভিস গল এবং রাইনল্যান্ডের বিভিন্ন ফ্রাঙ্কিশ রাজ্যগুলোকে একত্রিত করার অভিযানে নামেন। রিপুয়ারিয়ান রাজা তাঁর হাতে নিহত ও পরাজিত হন। ক্লভিস ৪৮৬ সালে উত্তরাঞ্চলীয় গলের রোমান শাসক সায়াগ্রিয়াসকে পরাজিত করেন। এই বিজয় প্যারিস অঞ্চলে রোমান শাসনের সমাপ্তি ঘটায়। ৫০৭ সালে সংঘটিত ভৌলির যুদ্ধে ক্লভিস বার্গান্ডিয়ানদের সহায়তায় ভিসিগথদেরকে পরাজিত করেন এবং পূর্বদিকের পিরেনিজ পর্বতমালা পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করেন।


চিত্র: মরোভিঞ্জিয়ান যুগের পোশাক-পরিচ্ছদ

৪৯৩ সালে ক্লভিস বার্গান্ডিয়ান রাজকন্যা ক্লটিল্ডাকে বিয়ে করেন। ক্লটিল্ডা ছিলেন একজন অর্থডক্স-ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। ক্লটিল্ডার প্রভাবে ক্লভিস তাঁর অনুসারীদেরকে নিয়ে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। এর ফলে পোপ এবং অন্যান্য অর্থডক্স-ক্যাথলিক শাসকদের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। ক্লভিস পশ্চিম ইউরোপের একমাত্র অর্থডক্স-ক্যাথলিক শাসক হিসেবে পরিচিত হন। পোপতন্ত্রের সাথে ফ্রাংকদের মৈত্রী গড়ে ওঠে এবং ক্লভিসের প্রতি সাধারণ খ্রিষ্টানদের সমর্থন বাড়তে থাকে।

ধর্মীয় সমর্থন ক্লভিসের রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল। ভিসিগথ এবং বার্গান্ডিয়ান বিশপরাও ক্লভিসকে সমর্থন করতেন। সাধারণ রোমানরাও ক্লভিসকে সমর্থন করত। ক্লভিসকে অভিজাত রোমানদের পদবী ‘প্যাট্রিসিয়ান’ পদবী প্রদান করা হয়েছিল। এছাড়াও তাকে ‘কনসাল’ পদবীতেও ভূষিত করা হয়েছিল। এসব স্বীকৃতির ফলে ক্লভিস অধিকৃত গল অঞ্চলের অর্থডক্স-ক্যাথলিক যাজকরা তাকে বৈধ খ্রিষ্টান শাসক হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। আরিয়ান খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী ভিসিগথ, ভ্যান্ডাল ও লম্বার্ডদের সাথে অর্থডক্স-ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী রোমানদের যে ধর্মীয় দূরত্ব ছিল ফ্রাংকদের সাথে তাদের সে দূরত্ব রইল না।


চিত্র: খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত ফ্রাংক রাজা ক্লভিস

এসব কারণে ক্লভিস যখন আরিয়ান ধর্মাবলম্বী ভিসিগথ নেতা দ্বিতীয় এলারিকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন তখন ক্যাথলিক চার্চ তাকে পূর্ণ সহযোগিতা করে। ক্যাথলিক চার্চের চোখে ক্লভিস তখন আর একজন বর্বর জার্মান শাসক ছিলেন না; বরং ক্লভিসের বিজয়কে ক্যাথলিক চার্চ খ্রিষ্টধর্ম ও রোমান সভ্যতার সম্প্রসারণ হিসেবেই দেখেছিল। ক্লভিস তাঁর মৃত্যুর পূর্বে ব্রিটেন, সেপ্টিমানিয়া, প্রভাঁস প্রভৃতি অঞ্চলে ফ্রাংক শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

৫১১ সালে ক্লভিসের মৃত্যুর পর তাঁর রাজত্ব তাঁর চার পুত্রের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায় এবং পরবর্তী দেড় শতাব্দী ধরে তাঁর বংশধরদের মধ্যে রাজত্ব ভাগ হতে থাকে। ক্লভিসের ছেলেদের সময়ে ফ্রাংক রাজ্যগুলো আরও সম্প্রসারিত হতে থাকে। বর্তমান ফ্রান্সের বেশিরভাগ অংশ ছাড়াও রাইন নদীর পূর্বের আলেমান্নিয়া (আজকের দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানি) ফ্রাংক রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ৫৩১ সালে থুরিঞ্জিয়া পর্যন্ত ফ্রাংকদের রাজ্য বিস্তৃত হয়। তবে স্যাক্সনি অঞ্চল বিজয়ের বাকী থেকে যায়। কয়েক শতাব্দী পরে ক্যারোলেঞ্জিয়ান সম্রাট শার্লেমান এ অঞ্চল বিজয় করেছিলেন।


চিত্র: রোমান-ফ্রাংক যুদ্ধ

১ম ক্লটায়ের নামে একজন নেতা একবার পৃথক ফ্রাংক রাজ্যগুলিকে একত্রিত করেছিলেন। ৫৬১ সালে আবারও ফাঙ্কদের রাজত্ব তিনটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। এ তিনটি রাজ্য হল: নিউস্ট্রিয়া, অস্ট্রাসিয়া এবং বার্গান্ডি। প্রতিটি রাজ্যের প্রধান অফিসার ছিলেন প্রাসাদের মেয়র। অষ্টম শতাব্দী থেকে রাজ্য পরিচালনায় রাজার পরে মেয়ররাই প্রকৃত অর্থে ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। মরোভিঞ্জিয়ান অধিপতিরা তাদের পুত্রদের মধ্যে রাজ্য ভাগ করে দেওয়ার জার্মান রীতি বজায় রেখেছিলেন। ভূখণ্ড বন্টনের ব্যাপারটি সরলভাবে সম্পন্ন হতো না। প্রায়ই নেতৃস্থানীয় পরিবারসমূহের মধ্যে হত্যা এবং যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভূখন্ডের বিভাজন, পুনরেকত্রীকরণ এবং পুনর্বিভাজন সম্পন্ন হতো।
ক্লভিস যদিও একটি স্থিতিশীল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তবুও মরোভিঞ্জিয়ান যুগের দৈনন্দিন জীবন পুরোপুরি স্থিতিশীল ছিল না। প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য যুগ যুগ ধরে চলা পারিবারিক যুদ্ধের জার্মান রীতির কারণে অনেক সময় যথেষ্ট অরাজকতা সৃষ্টি হতো। ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাগ্রস্থ হতো এবং নাগরিক জীবন খুবই কঠিন হয়ে উঠত। গীর্জা এবং মঠের বাইরে লেখাপড়ার চর্চা হারিয়ে গিয়েছিল।

এসব কারণে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভিলাসমূহের উপর ভিত্তি করে স্থানীয়ভাবে বিচ্ছিন্ন সমাজ সৃষ্টি হচ্ছিল যা ছিল সামন্ততান্ত্রিক সমাজের লক্ষ্মণ। মুক্ত জার্মান কৃষকদের অধিকাংশই এ সময় ভূমিদাসে পরিণত হয়েছিল। মরোভিঞ্জিয়ানদের পতনের যুগে জার্মান অঞ্চলে পূর্ব-ইউরোপের স্লাভদের আক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপে শুরু হয় মুসলিম আক্রমণ।


চিত্র: ঘোড়ার পিঠে চার্লস মার্তেল

মরোভিঞ্জিয়ানদের শেষ উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন ডাগোবার্ট (৬২৯-৬৩৯ সাল)। তিনি তিনটি ফ্রাংক রাজ্যকে এককভাবে তাঁর অধীনে পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর রাজ্যগুলো আবারও বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। দক্ষিণ-পশ্চিমের রাজ্যটি প্রায় স্বাধীনভাবে চলতে থাকে। এ রাজ্যটির ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নেন প্রাসাদের মেয়র। রাজা হয়ে পড়েন মেয়রের হাতের পুতুল।

সপ্তম শতাব্দীর শেষ দিকে ‘পেপিন দি ইয়ং’ নামে এ রাজ্যের একজন মেয়র তিনটি ফ্রাংক রাজ্যের শাসনভার তাঁর নিজের হাতে তুলে নেন। ‘পেপিন দি ইয়ং’ এর পুত্র ছিলেন চার্লস মার্তেল (শাসনকাল: ৭১৪-৭৪১ সাল)। চার্লস মার্তেল ৭১৪ সালে সমগ্র ফ্রাংক ভূখন্ডের অধীশ্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তিনি বিচ্ছিন্ন ফ্রাংক রাজ্যগুলোকে ঘনিষ্ঠভাবে একত্রিত করেন এবং পূর্ব সীমান্তে স্লাভদের আক্রমণ প্রতিহত করেন।


চিত্র: চার্লস মার্তেলের অশ্বারোহী যোদ্ধারা

৭৩২ সালে চার্লস মার্তেল স্পেনীয় মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে বিজয় লাভ করেন। এ যুদ্ধ ‘ব্যাটল অভ ট্যুরস’ নামে পরিচিত। মূলত এ যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে ইউরোপে মুসলিম বিজয়ের সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধে মুসলিম সুলতান দ্বিতীয় আব্দুর রহমান নিহত হন। সুলতান দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে স্পেনের মুসলিমগণ ফ্রান্সে প্রবেশ করে বোর্দো পর্যন্ত দখল করেছিলো। মুসলিম বাহিনীর প্রধান শক্তি ছিল অশ্বারোহী বাহিনী।
অন্যদিকে ফ্রাংকদের প্রধান শক্তি ছিল পদাতিক বাহিনী। ফ্রাংক যোদ্ধারা ছিল পদাতিক যুদ্ধে অভ্যস্থ। তাদের পক্ষে অশ্বারোহী বাহিনীকে প্রতিহত করা সম্ভব ছিল না। তাই চার্লস মার্তেল অশ্বারোহী বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এজন্য তিনি চার্চের বিশাল ভূসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেন এবং অশ্বারোহী বাহিনী গড়ে তোলার পেছনে সে সম্পত্তি খরচ করেন। নবগঠিত অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে তিনি মুসলিম সুলতানকে পরাজিত করেন। এর মধ্যে স্পেনের মুসলিমরা গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাই চার্লস মার্তেল সহজেই ফ্রান্সের মুসলিম অধিকৃত অঞ্চলগুলি পুনর্দখল করে নিতে পেরেছিলেন।

৭৪১ সালে চার্লস মার্তেল মৃত্যুবরণ করেন। তিনি কখনও ‘রাজা’ উপাধী গ্রহণ করেননি। ‘মেয়র’ উপাধীই তার প্রিয় ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তাঁর পুত্র পেপিন দ্য শর্ট (মেয়র: ৭৪১-৭৫১ সাল, রাজা: ৭৫১-৭৬৪ সাল)। শুরুতে পিতার মতো তিনিও ‘প্রাসাদের মেয়র’ ছিলেন। ৭৫১ সালে তিনি পুতুল রাজা তৃতীয় চিলডারিককে অপসারণ করে নিজেকে রাজা ঘোষণা করেন। চার্লস মার্তেলের যোগ্য উত্তরসূরি পেপিন দ্য শর্ট একটি শক্তিশালী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে যান। এ রাজবংশটির নাম ক্যারোলিঞ্জিয়ান রাজবংশ। এ রাজবংশের গোঁড়ায় রয়েছেন চার্লস মার্তেল এবং এই বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন পেপিন দ্য শর্ট এর সুযোগ্য পুত্র সম্রাট শার্লামেন (শাসনকাল: ৭৬৮-৮১৪ সাল)।

ক্যারোলিঞ্জিয়ান রাজবংশ (৭৫১-১১২৪ সাল)
--------------------------------------------
৭৪১ সালে ফ্রাংক রাজপ্রাসাদের ইতিহাসখ্যাত ‘মেয়র’ চার্লস মার্তেলের মৃত্যুর পর প্রাসাদের মেয়র হন তাঁর সুযোগ্য পুত্র পেপিন দি শর্ট। ৭৪১ সাল থেকে ৭৫১ সাল পর্যন্ত তিনি ‘প্রাসাদের মেয়র’ হিসেবেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। সে সময়য়ে ফ্রাংক রাজ্যে সমন্তশ্রেণির অবস্থান ছিল খুবই শক্তিশালী। সংঘবদ্ধ সামন্তশ্রেণি নামেমাত্র মরোভিঞ্জিয়ান রাজা তৃতীয় চিলডারিককে আর সিংসাহনে দেখতে চাইছিল না।

সংঘবদ্ধ সামন্তশ্রেণির সমর্থন নিয়ে ৭৫১ সালে পেপিন দ্য শর্ট তৃতীয় চিলডারিককে অপসারণ করে নিজেকে ফ্রাংক রাজা ঘোষণা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ ইতিহাসে নতুন আরেকটি ফ্রাংক রাজবংশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। এ রাজবংশের নাম ক্যারোলিঞ্জিয়ান রাজবংশ। ৭৫১ সালে শেষ মরোভিঞ্জিয়ান রাজা তৃতীয় চিলডারিকের অপসারণ এবং পেপিন দ্য শর্ট এর সিংহাসনে আরোহনের মধ্য দিয়ে ক্যারোলিঞ্জিয়ান রাজবংশের সূচনা হয়।


চিত্র: তৃতীয় চিলডারিকের চুল কর্তনের দৃশ্য

পেপিন একজন নির্বাচিত রাজা ছিলেন। যদিও এটি খুব বেশি বার ঘটেনি, জার্মানদের প্রথমদিককার আইনে একটি সাধারণ নিয়ম ছিল যে, রাজা তাঁর নেতৃস্থানীয় পুরুষদের সমর্থনের উপর নির্ভর করতেন। যদি তাদের রাজা যুদ্ধের বেলায় নেতৃত্ব দিতে দুর্বলতার পরিচয় দিতেন তাহলে সেক্ষেত্রে এই নেতারা একজন নতুন রাজা নির্বাচনের অধিকার রাখতেন। পরবর্তীতে যদিও ফ্রান্সের সিংহাসন উত্তরাধিকারনির্ভর হয়ে যায় তবুও ‘হোলি রোমান সাম্রাজ্যে’র সম্রাটরা জার্মান ঐতিহ্যটি নষ্ট করতে ব্যর্থ হন এবং ১৮০৬ সালে সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি পর্যন্ত ঐতিহ্যটি টিকে ছিল।

পেপিন দ্য শর্ট বৈধ শাসক হিসেবে স্বয়ং পোপের স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন। ৭৫৪ সালে তিনি পোপ তৃতীয় স্টিফেনের সাথে একটি লম্বার্ড বিরোধী জোটে প্রবেশ করে তাঁর অবস্থানকে দৃঢ় করেন। পোপীয় সমর্থনটি তাঁর নতুন অবস্থানের বিরুদ্ধে যে কোন অভিযোগকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তৎকালীন লম্বার্ড রাজা পোপের অধিকৃত অঞ্চল দখল করে নিয়েছিলেন।


চিত্র: ফ্রাংক বীর রোলান্ড

পেপিন লম্বার্ডদের কাছ থেকে রোমের চারপাশের অঞ্চল উদ্ধার করে পোপের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন যা পোপীয় রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল। এই পোপীয় রাষ্ট্রের কেবল ভ্যাটিক্যান সিটি অংশটি আজও টিকে রয়েছে। পোপকে সহায়তার বিপরীতে পেপিন দ্য শর্ট ‘প্যাট্রিসিয়াস রোমানোরাম’ অর্থাৎ ‘রোমের রক্ষাকর্তা’ উপাধীটি লাভ করেছিলেন।

৭৬৮ সালে পেপিন দ্য শর্ট এর মৃত্যুর পর তাঁর রাজত্ব তাঁর দুই পুত্র চার্লস এবং কার্লোমানের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। ৭৭১ সালে কার্লোমানের মৃত্যুর পর পুরো সাম্রাজ্যই চার্লসের অধিকারভুক্ত হয়। একসময় চার্লসের নাম হয়ে যায় শার্লামেন; চার্লসের নামের সাথে তাঁর ভাইয়ের নাম যুক্ত হয়ে তাঁর নাম হয় শার্লামেন। ফ্রান্স এবং জার্মানির ইতিহাসে তিনি প্রায় পৌরাণিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।


চিত্র: যুদ্ধক্ষেত্রে রোলান্ড

৭৭২ সাল থেকে চার্লস স্যাক্সনদের এলাকা জয় করতে শুরু করেন। স্যাক্সনদের ভূখণ্ডকে ফ্রাংক রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করার জন্য তিনি এই অভিযান শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত স্যাক্সনদেরকে পরাজিত করে তাদের রাজ্য দখল করে নেন। ফ্রাংকদের অভিযানের সাথে খ্রিষ্টধর্মের প্রসারের একটি সম্পর্কও ছিল। ফ্রাংকরা ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ছিল। তাদের সামরিক অভিযানের সাথে সাথে বিজিতদেরকে খ্রিষ্টধর্মে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়াটিও চালু ছিল। ধর্মান্তরকরণের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে অনেকটাই অস্ত্রের জোরে।

আষ্টম শতকের মাঝামাঝি সময়ে স্যাক্সন ভূখন্ডে ক্যাথলিক ফ্রাংক মিশনারিরারা প্রবেশ করতে শুরু করেন। সেই সাথে আয়ারল্যান্ড থেকে আসা মিশনানারিদের দল এবং ইংল্যান্ড থেকে আসা এংলো-স্যাক্সন মিশনারিরাও ধর্ম প্রচারের জন্য স্যাক্সন ভূখন্ডে প্রবেশ করেন। এই তৎপরতা স্যাক্সনদের সাথে সংঘাত আরও বাড়িয়ে দেয়। স্যাক্সনরা ফ্রাংক অভিযান এবং মিশনারি তৎপরতা- দুটোই প্রতিহত করতে চেষ্টা করত।


চিত্র: ফ্রাংক রাজা চার্লস (শার্লামেন)

চার্লসের প্রধান স্যাক্সন প্রতিপক্ষ ভিডুকিন্ড ৭৮৫ সালে একটি শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হন। কিন্তু অন্যান্য স্যাক্সন নেতারা প্রতিরোধ অব্যাহত রাখেন। ৭৮৭ সালে ভার্ডেন বিজয়ের পর চার্লস হাজার হাজার পৌত্তলিক স্যাক্সন বন্দীদেরকে পাইকারিভাবে হত্যার আদেশ দেন। কয়েকটি বিদ্রোহের পর অবশেষে ৮০৪ সালে স্যাক্সনরা চিরতরে পরাজিত হয়। এর ফলে ফ্রাংক রাজ্য পূর্বদিকের এলব নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। অতীতে রোমানরা এলব নদী পর্যন্ত বিজয়ের চেষ্টা একবারই করেছিল এবং ৯ সালের টিউটোবার্গ ফরেস্টের যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এ চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।

স্যাক্সনদেরকে আরও কার্যকরভাবে খ্রিষ্টীয়করণের জন্য চার্লস বেশ কয়েকটি বিশপ এলাকা প্রতিষ্ঠা করেন যার মধ্যে ব্রেমেন, মুনস্টার, প্যাডারবর্ন এবং ওসনাব্রুক প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। স্যাক্সন ভূখণ্ড বিজয়ের পাশাপাশি চার্লস লম্বার্ডদের এলাকাও জয় করে নিয়েছিলেন। ৭৭৩-৭৪ সালে তিনি লম্বার্ডদেরকে পরাজিত করেন। এভাবে উত্তর ইতালিতেও তিনি তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ভ্যাটিকানে অনুদান প্রদান এবং পোপতন্ত্রকে রক্ষার শপথ নবায়ন করেন।


চিত্র: শার্লামেনের সৈন্যদের হাতে বন্দী ট্যাসিলো

৭৮৮ সালে বাভারিয়ার ডিউক ট্যাসিলো চার্লসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এ বিদ্রোহ চূর্ণ করা হয় এবং বাভারিয়াকে চার্লসের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটি কেবল রাজকোষকে সমৃদ্ধই করেনি, একই সাথে অ্যাজিলোফিংদের (ট্যাসিলোদের পরিবার) ক্ষমতা ও প্রভাবকে অনেকাংশেই খর্ব করে দেয়।

এ পরিবারটি ছিলো ফ্রাংকদের মধ্যে আরেকটি নেতৃস্থানীয় পরিবার এবং এরা ছিল চার্লসের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। ৭৯৬ সাল নাগাদ চার্লস ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আজকের অস্ট্রিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া পর্যন্ত তাঁর রাজ্য বিস্তৃত করেন। দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের পিরেনিজ পর্বতমালা থেকে শুরু হয়ে বর্তমান ফ্রান্সের প্রায় পুরোটাসহ এবং ফ্রান্সের পূর্বদিকে বর্তমান জার্মানির অধিকাংশ এলাকাসহ উত্তর ইতালি ও বর্তমান অস্ট্রিয়া পর্যন্ত চার্লসের রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল।

ফ্রান্সের কেবল ব্রিটানি অঞ্চলটি কখনো ফ্রাংকদের দখলে আসেনি। উত্তর স্পেনের একটি অঞ্চল ৭৯৫ সালের পর থেকে চার্লসের রাজ্যের সাথে যুক্ত হয়। চার্লস একটি সাম্রাজ্য গড়ে তোলার পর্যায়ে উন্নীত হতে পেরেছিলেন।


চিত্র: শার্লামেনের মাথায় পবিত্র রোমান সম্রাটের মুকুট

লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880

বি.দ্র: রকমারিসহ বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটে লেখকের সবগুলো বই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে লেখকের নামে সার্চ দিলেই যথেষ্ট।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১২:০৯

রাজীব নুর বলেছেন: নতুন বছরের শুভেচ্ছা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.