![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পেরু, দক্ষিণ আমেরিকার একটি বিশেষ ভূখণ্ড, তার প্রাচীন ইতিহাস ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে অত্যন্ত পরিচিত। প্রাচীন পেরুতে একাধিক সভ্যতার উত্থান হয়েছিল, যা আজও পৃথিবীজুড়ে গবেষণা, আর্কিওলজিক্যাল সাইট এবং বিশ্বজনীন ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। এই অঞ্চলের সভ্যতাগুলোর মধ্যে ইনকা সভ্যতা অন্যতম, কিন্তু এর আগে আরও অনেক প্রাচীন সভ্যতা ছিল, যারা পেরুর সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকে প্রভাবিত করেছিল।
পেরুর প্রাচীন সভ্যতার সূচনা
পেরুর প্রাচীন ইতিহাসের শুরুর দিকে, আন্দিজ পর্বতমালার অঞ্চলে বাস করা মানুষদের মধ্যে এক সমৃদ্ধ কৃষি, হস্তশিল্প এবং ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে ওঠে। এই অঞ্চলের পুরাতন সভ্যতাগুলোর মধ্যে মোচে, নাস্কা, মোচে, টিওয়ানাকু, ও ইনকা সভ্যতার নাম উল্লেখযোগ্য।
মোচে সভ্যতা (Moche Civilization)
প্রথম আলোচনার মধ্যে আসে মোচে সভ্যতা, যা খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০-র দিকে আধিপত্য বিস্তার করে। মোচে সভ্যতা ছিল কৃষিভিত্তিক, তারা ঘোড়া চাষ, মৎস্য শিকার ও শিল্পকর্মের জন্য পরিচিত ছিল। তাদের শিল্পকর্ম ছিল অত্যন্ত উন্নত, বিশেষত মৃৎশিল্প এবং সোনার গয়নার জন্য তারা বিখ্যাত ছিল। মোচে সভ্যতার অধীনে পেরুর উপকূলীয় অঞ্চলে অনেক সুন্দর মন্দির, প্রত্নবস্তু, এবং সমাধি খুঁজে পাওয়া গেছে। মোচে জনগণ তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে বিশেষ গুরুত্ব দিতো, এবং তারা দেবতার পুতুল এবং মূর্তি তৈরি করতো।
নাস্কা সভ্যতা (Nazca Civilization)
নাস্কা সভ্যতা খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিষ্টাব্দ ৬৫০ পর্যন্ত প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। এই সভ্যতা মূলত পেরুর দক্ষিণ উপকূলে ছিল। নাস্কা সভ্যতা তার বিশাল এবং রহস্যময় "নাস্কা লাইনস" (Nazca Lines) এর জন্য বিখ্যাত, যা পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান বড় আকারের চিত্র এবং অঙ্কন। এছাড়াও, তারা বিশেষত তন্তু ও বোনা পণ্য, কাঁথা এবং অলঙ্কার তৈরিতে দক্ষ ছিল।
ইনকা সভ্যতা: শাসনের সাম্রাজ্য
এটি ছিল পেরুর ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে প্রভাবশালী সভ্যতা, যা প্রায় ১৫ম শতাব্দী পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ইনকা সভ্যতার উত্থান শুরু হয় ১২শ শতাব্দীর দিকে, এবং ১৫শ শতাব্দীতে পেরুর বেশিরভাগ অংশ তারা একত্রিত করে এক বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করে। ইনকাদের রাজধানী ছিল কুসকো, যা বর্তমান পেরুর দক্ষিণে অবস্থিত।
ইনকা সভ্যতা তাদের জ্ঞানের জন্য পরিচিত ছিল। তারা এক উন্নত পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদন, পানি সেচ ব্যবস্থা, এবং রাস্তা নির্মাণ করেছিল। ইনকাদের তৈরি কস্টাল রোড নেটওয়ার্ক ছিল ব্যাপক এবং তারা বিভিন্ন সেতু ও সড়ক তৈরিতে পারদর্শী ছিল। ইনকা সাম্রাজ্যের গভর্নমেন্ট ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত, যেখানে "মিত আত্তা" নামক এক কর্মপদ্ধতি ছিল, যার মাধ্যমে জনগণকে নির্দিষ্ট সময়ে রাষ্ট্রের জন্য কাজ করতে বাধ্য করা হতো।
ইনকা ধর্ম
ইনকা ধর্ম ছিল প্রকৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শনকারী। তারা সূর্য দেবতা ইন্টির (Inti) পুজো করত, যাকে তারা সর্বোচ্চ দেবতা হিসেবে মানত। সূর্য ও চন্দ্রের পূজার পাশাপাশি তারা অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান যেমন, পাহাড়, নদী, বৃক্ষ, ইত্যাদিরও পূজা করত। তারা বিশ্বাস করত যে, শাসকদের মধ্যে ঈশ্বরের আবির্ভাব ঘটে এবং তাদের শাসনব্যবস্থা ঈশ্বরের নির্দেশ অনুযায়ী চলে।
পেরুর ভাষা ও সাহিত্য
প্রাচীন পেরুর ভাষাগুলির মধ্যে কেচুয়া এবং আইমারা ছিল প্রধান। কেচুয়া ভাষার ব্যবহার ইনকাদের অধীনে ব্যাপক ছিল এবং তা আজও পেরুর এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন পেরুর সাহিত্য ছিল মৌখিক, যেখানে কেচুয়া ভাষায় নানা রূপকথা, গল্প, এবং ইতিহাস পাঠ করা হত।
পেরুর শিল্প ও স্থাপত্য
পেরুর প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে শিল্প ও স্থাপত্য অত্যন্ত উন্নত ছিল। ইনকা সভ্যতার স্থাপত্যকলার মধ্যে ইঞ্চুকো (Inca stone) দিয়ে তৈরি বিশাল মন্দির, প্রাসাদ, এবং দুর্গগুলো ছিল বিশেষভাবে পরিচিত। তাদের নির্মিত পাথরের কাজ এত সূক্ষ্ম ছিল যে, কোনও আঠালো বা সিমেন্ট ছাড়া শুধু পাথরের গঠনেই সেগুলি স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল।
পেরুর পতন
ইনকা সভ্যতা পেরুর ইতিহাসের চূড়ান্ত শিখর হতে পারে, কিন্তু ১৫৩২ সালে স্প্যানিশ বিজয়ী ফ্রান্সিস্কো পিজারো এবং তার সৈন্যরা ইনকা সাম্রাজ্য আক্রমণ করে এবং তা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে। পিজারোর আক্রমণে ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপা বন্দী হন এবং পরবর্তীতে তাকে হত্যা করা হয়। এর ফলে পেরুতে স্প্যানিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পেরু ধীরে ধীরে ইউরোপীয় উপনিবেশে পরিণত হয়।
উপসংহার
প্রাচীন পেরু ছিল একটি সমৃদ্ধ সভ্যতা, যা বিশ্ব ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে। এর সংস্কৃতি, শিল্প, ধর্ম এবং রাজনৈতিক কাঠামো বর্তমান পেরু ও দক্ষিণ আমেরিকার অন্য অঞ্চলের সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলেছে। পেরুর প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্য ও তাদের অবদান আজও ইতিহাসের একটি চিরকালীন অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
©somewhere in net ltd.