![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ইতালি, যা ইউরোপের দক্ষিণে অবস্থিত, তার ইতিহাস এবং সভ্যতার জন্য এক বিশেষ স্থান অধিকার করে। প্রাচীন ইতালি শুধুমাত্র রোমান সভ্যতার জন্য বিখ্যাত নয়, বরং এটি অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার আদিন ভূমি, যেমন ইট্রাসকান, গ্রিক, এবং সেমিটিক সভ্যতার মিশ্রণের ক্ষেত্র। প্রাচীন ইতালির সভ্যতা তার সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিজ্ঞান এবং রাজনৈতিক কাঠামো দিয়ে পৃথিবীকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ দিয়েছে। এরই মধ্যে রোমান সাম্রাজ্য সবচেয়ে বড় এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।
প্রাচীন ইতালির সূচনা: সভ্যতার প্রথম আভাস
প্রাচীন ইতালির ইতিহাসের শুরু খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ বছর আগে, যখন বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং জাতি ইতালির ভূখণ্ডে বসবাস শুরু করেছিল। তখন এই অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণ মূলত কৃষি, পশুপালন, মৎস্য শিকার এবং হস্তশিল্পে দক্ষ ছিল। যদিও ইতালির ইতিহাসের প্রথম পরিচিত সভ্যতা ছিল ইট্রাসকান সভ্যতা, এর আগে থেকেই বিভিন্ন প্রাক-ইতালিয়ান জনগণ বসবাস করত।
ইট্রাসকান সভ্যতা (Etruscan Civilization)
ইট্রাসকান সভ্যতা খ্রিষ্টপূর্ব ৮ম শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৮ শতাব্দী পর্যন্ত ইতালির মধ্যাঞ্চল, বিশেষ করে বর্তমান তুসকানি অঞ্চলে বিকশিত হয়েছিল। ইট্রাসকানরা উন্নত নগর সভ্যতা গড়ে তুলেছিল এবং তারা কৃষি, কারুশিল্প এবং সোনার কাজের জন্য পরিচিত ছিল। তাদের স্থাপত্য এবং সমাধি গঠন অত্যন্ত উন্নত ছিল, এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইট্রাসকানরা অতি সূক্ষ্ম কাচের কাজ, তাম্র-যুগের মূর্তি, এবং প্রাচীন ভাস্কর্য তৈরি করেছিল, যা প্রমাণ করে তাদের শৈল্পিক দক্ষতা।
গ্রিকদের প্রভাব
গ্রিকরা প্রাচীন ইতালির দক্ষিণ উপকূলে কলোনি প্রতিষ্ঠা করেছিল, এবং তাদের সভ্যতা ইতালির সাংস্কৃতিক বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। গ্রিকরা স্থাপত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, এবং সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। তাদের আর্ট এবং মূর্তি শিল্প ইতালির স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মিশে গিয়েছিল, এবং গ্রিক ভাষা এবং সাহিত্য ইতালির অনেক অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়েছিল। এমনকি গ্রিক দেবতাদেরও ইতালির প্রাচীন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে স্থান পেয়েছিল।
রোমান সভ্যতার উত্থান
রোমান সভ্যতা প্রাচীন ইতালির সবচেয়ে পরিচিত ও প্রভাবশালী সভ্যতা। এটি খ্রিষ্টপূর্ব ৮ম শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টাব্দ ৫ম শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। রোমানরা প্রথমে একটি ক্ষুদ্র গ্রাম্য রাজ্য হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা একটি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে, যা প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল।
রোমান প্রজাতন্ত্র
রোমান সভ্যতার প্রথম পর্যায় ছিল রোমান প্রজাতন্ত্র (Roman Republic), যা ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময়কালে রোমানরা একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে, যেখানে জনগণের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রের প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিত। রোমান সেনাবাহিনী ছিল অত্যন্ত প্রশিক্ষিত এবং সংগঠিত, যা রোমান প্রজাতন্ত্রের বিস্তারকে সম্ভব করেছিল। রোমান সেনাবাহিনী দখল করেছিল ইটালি, পরবর্তীতে সমগ্র ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং অন্যান্য বহু অঞ্চল।
রোমান সাম্রাজ্য
রোমান প্রজাতন্ত্রের পতনের পর রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সবচেয়ে বিখ্যাত শাসক ছিলেন সম্রাট অগাস্টাস। রোমান সাম্রাজ্য ছিল এক বৃহৎ সাম্রাজ্য, যা ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা এবং পশ্চিম এশিয়া জুড়ে বিস্তৃত ছিল। রোমান সাম্রাজ্য পেরেছিল মহান স্থাপত্য, রাস্তাঘাট নির্মাণ, জল সরবরাহ ব্যবস্থা, এবং আইন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। রোমানদের তৈরি রাস্তা, যা "রোমান রোড" নামে পরিচিত, আজও অনেক স্থানে অবস্থিত। তাদের তৈরি অ্যাকুয়েডাক্ট (জল সরবরাহ ব্যবস্থা) এবং কলিজিয়াম (গ্ল্যাডিয়েটর যুদ্ধের জন্য নির্মিত স্টেডিয়াম) রোমান সভ্যতার চিরকালীন ঐতিহ্য।
রোমান ধর্ম ও সংস্কৃতি
রোমানদের ধর্ম ছিল মূলত পলিথেইস্টিক, যেখানে তারা বিভিন্ন দেবতাকে পূজা করত। তাদের প্রধান দেবতাদের মধ্যে ছিল জিউস (Zeus), পন্ডোর (Poseidon), জিউনো (Juno) এবং মার্স (Mars)। রোমানদের মধ্যে ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ শিল্পকলা, যাদের মধ্যে মূর্তি, চিত্রকলা, অঙ্গন এবং ভাস্কর্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা গ্রিকদের মতো সাহিত্যেও উন্নতি অর্জন করেছিল, এবং রোমান সাহিত্য, যেমন ভার্জিলিয়াসের "এনিড" এবং হোরেসের কবিতা, এখনো বিশ্ব সাহিত্য হিসাবে সমাদৃত।
রোমান স্থাপত্য ও প্রযুক্তি
রোমান স্থাপত্যে আর্ক (Arch), ডোম (Dome) এবং ভল্ট (Vault) ব্যবহার ছিল অত্যন্ত পরিচিত। এই প্রযুক্তি তাদের বিশাল মন্দির, প্রাসাদ এবং রাস্তাঘাট নির্মাণে ব্যবহৃত হতো। রোমানরা প্রথম "কনক্রিট" তৈরি করে, যা তাদের স্থাপত্যকে আরও শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল করে তোলে। তাদের নির্মিত অ্যাকুয়েডাক্ট, কলিজিয়াম, ফোরাম, থিয়েটার ইত্যাদি আজও রোমান সভ্যতার অসীম কীর্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
পতন এবং উত্তরাধিকার
রোমান সাম্রাজ্য খ্রিষ্টাব্দ ৫ম শতাব্দীতে ধীরে ধীরে পতিত হয়। বারবার আক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ অশান্তির কারণে রোমান সাম্রাজ্যের পশ্চিমাংশের পতন ঘটে। তবে, রোমান সভ্যতা তার আইন, স্থাপত্য, এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হিসাবে ইউরোপের ইতিহাসে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে।
উপসংহার
প্রাচীন ইতালি একটি বৈচিত্র্যময় এবং ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল ছিল, যা পৃথিবীকে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, এবং বৈজ্ঞানিক অবদান দিয়েছে। রোমান সভ্যতা, যা বিশ্ব ইতিহাসে এক অনন্য স্থান অধিকার করে, আজও আমাদের জীবনধারা, আইন, ভাষা এবং প্রযুক্তিতে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। ইতালির প্রাচীন সভ্যতা শুধু এক সময়ের ইতিহাসের অংশ নয়, বরং আধুনিক সভ্যতারও একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।
©somewhere in net ltd.