![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলাদেশে বসবাসকারী আদিবাসীদের ভাষা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে পৃথিবীর অন্যতম ৪টি ভাষা পরিবারের প্রায় ৩০টি ভাষা রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ ভাষা পৃথক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হলেও কয়েকটি ভাষা পরস্পর এতটা ঘনিষ্ঠ যে এগুলোকে উপ-ভাষিক বৈচিত্র্য বলা যায়। যেমন তঞ্চঙ্গা মূলত চাকমা ভাষাই উপভাষা। অনুরূপ রাখাইন মারমা ভাষার, লালং বা পাত্র গারো ভাষার এবং বিষ্ণুপ্রিয়ামনিপুরী এবং হাজং বাংলা ভাষার উপভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আর সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা সংখ্যা হচ্ছে ২৬টি। যদিও একটি ওয়েবসাইটে বাংলাসহ মোট ৩৭টি ভাষার নাম উলেখ করা হয়েছে। এখানে উলেখ্য যে উক্ত ওয়েব সাইটে আসামিজ, বার্মিজ, চিটাগানিয়ান, হাকা-চীন, রিয়াঙ, সিলেটি প্রভৃতিকে পৃথক পৃথক ভাষা হিসেবে দেখানো হয়েছে-যা গ্রহণযোগ্য নয়।
জর্জ গ্রিয়ারসনের “লিঙ্গুইজটিকস সার্ভে অব ইন্ডিয়া” প্রকাশিত হবার পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও এ অঞ্চলের আদিবাসী ভাষা নিয়ে উলেখযোগ্য কোন কাজ হয়নি। ফলে ভাষাগুলোর শ্রেণীকরণসহ ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয় এবং তুলনামূলক কোন আলোচনা হয়নি। সুগত চাকমা তাঁর এমফিল অভিসন্দর্ভে শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের উপভাষাগুলিকে প্রাথমিক শ্রেণীকরণের চেষ্টা করেছেন। এ ছাড়া বিগত প্রায় একশ বৎসরে ভাষাগুলোতে নানা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে; ফলে উলেখিত অনেক তথ্যের সঙ্গে মাঠ-গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের মিল নেই। আমরা এখানে বাংলাদেশে আদিবাসী ভাষাগুলোর একটি পরিচিতি দেবার চেষ্টা করেছি।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ভাষা-পরিবার ও পরিবারের ভাষাসমূহ
ভাষা-পরিবার
ভাষাসমূহঃ
১.ভাষা পরিবার: অস্ট্রো-এশিয়াটিক
১.১ মোন-খমের শাখা-
১.২ মুন্ডারি শাখা-
খাসিয়া, (লিঙ্গাম)
সাঁওতাল, মুণ্ডা ইত্যাদি।
২. ভাষা পরিবার: তিব্বতি-চীন
২.১ বোড়ো শাখা-
২.২ কুকি-চীন শাখা-
২.৩ সাক্-লুইশ শাখা-
২.৪ লোলো-বার্মিজ শাখা-
৩. ভাষা পরিবার: দ্রাবিড়
৪. ভাষা পরিবার: ইন্দো-ইউরোপিয়
মান্দি (গারো), ককবরক, কোচ, লালেং (পাত্র) পালিয়া, রাজবংশী ইত্যাদি।
মৈতেয়মণিপুরী, খুমি, বম, খেয়াং, পাংখো, লুসাই, ম্রো ইত্যাদি।
চাক, ঠার বা থেক
মারমা (রাখাইন) ইত্যাদি
কুঁড়ুখ ও আদি মালতো (বর্তমানে লুপ্ত)
বাংলা, চাকমা (তনচঙ্গা), বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, সাদরি, হাজং ইত্যাদি।
অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাসমূহ
পৃথিবীতে অস্ট্রো-এশিয়াটিক জাতির জনসংখ্যা কম হলেও বিতৃত এলাকা নিয়ে এদের বসবাস। বাংলাদেশে প্রচলিত অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাসমূহ আবার দুটি শাখায় বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে-মোন-খমের ও মুন্ডারি।
মোন-খমের শাখা: বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় একশটিরও অধিক ভাষা মোন-খমের শাখা-র অন্তর্ভূক্ত। এই ভাষাগুলি পূর্ব-ভারত থেকে ভিয়েতনাম মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া এবং ইউনান-চীন থেকে মালয়েশিয়া ও আন্দামান সাগরের নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশে এই শাখার ভাষার মধ্যে উলেখযোগ্য খাসিয়া বা খাসি ভাষা । খাসিয়া ভাষারই একটি উপভাষিক বৈচিত্র্য মনে করা হয় ‘লিঙ্গাম’কে।
খাসিয়া বা খাসি ভাষা: বাংলাদেশের সিলেটের সীমান্ত-সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাসকারী মঙ্গোলয়েড খাসিয়া জাতির ভাষা। বর্তমানে খাসিয়া জনসংখ্যা প্রায় ১২,২৮০ জন। ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্য মিলিয়ে প্রায় দশ লক্ষ লোক খাসি ভাষায় কথা বলে। খাসিয়া ভাষার সাথে বার্মার মোঁয়ে, পলং ভাষার এবং উপমহাদেশের তালাং, খেড়, সুক, আনাম, খামেন, চোয়েম, ক্ষং, লেমেত, ওয়া প্রভৃতি আদিবাসীদের ভাষার মিল লক্ষ করেছেন বিভিন্ন ভাষাবিজ্ঞানী। খাসি ভাষা মৌখিক ভাষা। এই ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তবে ১৮১২ সালে কৃষ্ণচন্দ্র পাল নামক একজন ধর্মযাজক সর্বপ্রথম বাংলা বর্ণমালায় ও খাসি ভাষায় নিউ টেস্টামেন্ট বাইবেল অনুবাদ করেন। ১৮৩৮ সালে পরে ওয়েলস মিশনারি দলের টমাস জোনস রোমান হরফে খাসিয়া ভাষা লেখার প্রচলন করেন। বর্তমানে খাসি ভাষা রোমান হরফেই লেখা হয়। খাসি ভাষার উপভাষা রয়েছে বেশ কয়েকটি।
মুন্ডারি শাখা: অধিকাংশ ভাষাতত্ত্ববিদ মুন্ডারি শাখাকে অস্ট্রিক ভাষা-গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত মনে করলেও এর ভিন্ন মতও রয়েছে। কোন এক জাতি সুদূর অতীতে হয়ত ভারতবর্ষে চলে আসে এবং তাদের আনা ভাষা পরবর্তীতে স্থানীয় অন্য কোন ভাষার প্রভাবে মুন্ডারী শাখার ভাষার সৃষ্টি করে। সাঁওতালি ভাষা মুন্ডারি শাখা ভুক্ত।
সাঁওতালি ভাষা: বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অর্থাৎ রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়া, রংপুর, ঠাকুরগাঁ প্রভৃতি অঞ্চলে দুই লক্ষাধিক সাঁওতাল বসবাস করে। তবে ভারত, বাংলাদেশ এবং নেপাল মিলিয়ে পৃথিবীতে ৫২ লক্ষ লোক সাঁওতালি ভাষায় কথা বলে। হাজার হাজার বছর ধরে বংশ পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসা এই সাঁওতালি ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তবে খ্রিস্টান মিশনারিদের হাতে সর্বপ্রথম সাঁওতালি ভাষার লিখিত রূপ দেওয়া হয় রোমান হরফে। ১৮৬৯ সালে ভারতের সাঁওতাল পরগনার লুথারিয়ান মিশনে স্থাপিত একটি ছাপাখানা থেকে প্রথম সাঁওতাল ভাষার ব্যাকরণ ও অন্যান্য বই প্রকাশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে রঘুনাথ মুর্মু ‘অলচিকি’ নামে সাঁওতালি বর্ণমালা তৈরি করে এবং তার সরকারি স্বীকৃতিও লাভ করে। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত দেশী শব্দগুলো প্রধানত সাঁওতালি ও মুন্ডা ভাষা থেকে আগত
মুণ্ডা ভাষা: বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ২১৩২ (১৯৯১ আদমশুমারি অনুযায়ী) জন মুণ্ডা বসবাস করে। ভারতে এদের সংখ্যা ৪ লক্ষ। মুণ্ডাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। মুণ্ডা ভাষা অস্টো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের মুণ্ডারি শাখার অন্তর্গত। প্রায় তিন-চার হাজার বছর আগে পিজিন ভাষা হিসেবে মুণ্ডা ভাষার প্রচলন হয়েছিল। বাংলা ভাষার কিছু রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য (ক্রিয়াপদের লিঙ্গহীনতা, শব্দদ্বৈত ইত্যাদি) মুণ্ডা ভাষাজাত বলে ভাষাবিজ্ঞানীগণ মনে করেন। রূপতাত্ত্বিক দিক থেকে ‘মুণ্ডা’ ভাষার কিছু বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করেছেন পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য- ‘আকৃতিগত দিক থেকে মুণ্ডা ভাষা প্রত্যয় যুক্ত হয়ে থাকে। ভারতীয় আর্য ভাষার মতো এই অস্তিত্ব বর্তমান। অর্ধব্যঞ্জন ধ্বনিও এই ভাষায় শ্রুত হয়। শব্দগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে দু অক্ষর বিশিষ্ট। ভাষার তিন বচন দুই লিঙ্গ। শব্দে গুরুত্ব আরোপের জন্য শব্দদ্বিত্বের প্রয়োগ বহুল প্রচলিত’। মুণ্ডা ভাষার কোন নিজস্ব হরফ নেই। এজন্য এদের কোন লিখিত সাহিত্য নেই। মুখে মুখে এই ভাষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকে আছে। যদিও বর্তমানে এ ভাষার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে।
চীনা-তিব্বতি ভাষাসমূহ
ভাষাবিজ্ঞানীরা চীনা-তিব্বতি পরিবারের ভাষাসমূহের বিচ্চৃতি মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণে বার্মা এবং বালিষ্টান থেকে পিকিং পর্যন্ত পূর্ব গোলার্ধের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল পর্যন্ত বলে উলেখ করেছেন। এই চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবার দুটি ভাগে বিভক্ত চীনা, এবং তিব্বতি-বর্মি। তিব্বতি-বর্মি আবার দুইটি ভাগে বিভক্ত-একটি টিবেটো-হিমালয়ান ও অপরটি আসাম-বার্মিজ। আসাম-বার্মিজ আবার কয়েকটি শাখায় বিভক্ত। যেমন বোডো, নাগা, কুিক-চীন, কাচিন, বার্মিজ ইত্যাদি।
বোডো শাখা: মান্দি বা গারো, ককবোরক (ত্রিপুরা), পাত্র, প্রভৃতি ভাষাসমূহ এই শাখার অন্তর্ভূক্ত।
মান্দি ভাষা: বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, মধুপুর গারো পাহাড় সংলগ্ন ও সিলেট অঞ্চলে মান্দিদের (গারো) বসবাস। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ধারক ও বাহক এই মান্দি জাতির স্বীকৃত ভাষার নাম ‘আচিক বা মান্দি ভাষা’। মান্দিদের মোট ১৩টি গোত্রের মধ্যে বাংলাদেশের ৭টি গোত্রের কথা জানা যায়। গোত্র ভেদে মান্দিদের আলাদা আলাদা উপভাষার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা না থাকলেও রোমান হরফ ব্যবহৃত হয় ব্যাপকভাবে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বসবাসরত গারোরা নিজ ভাষাতেই পড়াশুনা ও সাহিত্য রচনা করে থাকে।
লিঙ্গাম: লিঙ্গামরা নিজেদেরকে পৃথক জাতিসত্তার মানুষ দাবী করলেও গবেষকদের মতে এরা মূলত খাসি এবং গারোদের সম্মলিত একটি জাতি। ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাই উভয় দলের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে। যদিও এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা না করে মন্তব্য করা উচিত নয়। বাংলাদেশের নেত্রকোনা-ময়মনসিংহের গারো পাহাড় সংলগ্ন অঞ্চলেই প্রধানত লিঙ্গামদের বাস। তবে এদের সঠিক জনসংখ্যা বিষয়ে কোন তথ্য-পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। লিঙ্গাম ছাড়াও এদেরকে মিগাম, মারামস ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। ভারতের গারো পাহাড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম পাদদেশে বসবাসকারী লিঙ্গামদের মোট জনসংখ্যা ২৭,৪৭৮ (১৯৯১)। ভাষা পরিবার বিচারে এরা চীনা-তিববতি পরিবারের বোডো-গারো শাখাভুক্ত। তাছাড়া, খাসিরা তাদের মধ্যে যারা পশ্চিম দিকের পাহাড়ে বাস করে তাদের গধৎধসং বলে। কেননা প্রাচীন কালে সেখানে মারাম কিংডম ছিল, এ দিক দিয়ে খাসিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অনেক প্রাচীন।
ককবোরক ভাষা: ত্রিপুরা জাতির ভাষার নাম ককবোরক যার অর্থ মানুষের ভাষা। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসরত প্রায় দশ লক্ষ ত্রিপুরা ককবরক ভাষায় কথা বলে। মধ্যযুগে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী শাসিত পূর্ববঙ্গের এক বিশাল এলাকায় ককবরক ভাষা প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে ত্রিপুরাদের অবস্থান তৃতীয়। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে এদের জনসংখ্যা ৭৯৭৭২ জন। টিপরা এবং ত্রিপুরা উভয়ই মূলত একই জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশে ত্রিপুরারা মূলত রাঙামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি জেলায় বাস করে। এছাড়াও চট্টগ্রাম, কুমিলা ও সিলেট জেলায় বেশ কিছু সংখ্যক ত্রিপুরা বাস করেন। তবে বাংলাদেশের বাইরে ভারতের ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, আসাম, ও অরুণাচলে এরা বাস করে । ত্রিপুরারা তাদের ভাষাকে বলে ‘ককবোরক’। ককবোরক শব্দের অর্থ মানুষের ভাষা। এটি মূলত সিনো-টিবেটান পরিবারের ভোট-বর্মী শাখার বোডো দলভুক্ত। ত্রিপুরা জাতি মোট ৩৬টি দফায় বা গোত্রে বিভক্ত। বাংলাদেশে ১৬টি গোত্রের সন্ধান পাওয়া যায় যাদের মধ্যে উপভাষা ভেদ রয়েছে। অতীতে ককবোরক ভাষার নিজস্ব হরফ ছিল বলে লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে। বর্তমানে এর কোন অস্তিত্ব নেই। অনেক আগে থেকেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ককবোরক ভাষা বাংলা হরফেই লিখিত হয়ে আসছে। ককবোরক ভাষার ব্যাকরণ অনেক পুরাতন; প্রায় একশ বছর পূর্বেই এই ব্যাকরণ রচিত হয়।
কোচ ভাষা: কোচ সম্প্রদায়ের আদিম আবাসস্থল কোচবিহারে। তবে নাগপুর ও আসামেও তারা বাস করতো। বাংলাদেশে ঢাকার উত্তরে গাজীপুর জেলায় তারা প্রথম প্রবেশ করে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশের মধুপুর, গাজীপুর, কাপাসিয়া, কালিয়াকৈর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, এবং রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে কোচরা বাস করে। কোচ সম্প্রদায় কত বছর যাবৎ এ অঞ্চলে বসবাস করছে তা সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। কোচদের পৃথক ভাষা রয়েছে। কিন্তু তাদের ভাষার উদ্ভব সম্পর্কে কোন ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়নি। কোচদের ভাষা বাংলা ভাষা থেকে স্বতন্ত্র্য কোচ সম্প্রদায়ের নিজস্ব কোন লিপি নেই। ভাষিক গঠন ও কাঠামো দেখে মনে হয় চীনা-তিব্বতি পরিবারের ভোট-বর্মী শাখার বোড়ো দলভুক্ত। ১৯৫৯ সালে গবেষক রবিন্স বালিং এর এ বিষয় লেখা প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি গারো মতো কোচকেও চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের বোড়ো শাখাভুক্ত বলে উলেখ করেছেন।
পাত্র বা লালং: বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের অন্যতম অংশ হলো পাত্র। সিলেট জেলার সদর ও গোয়াইনঘাট থানাদ্বয়ের অন্তর্ভুক্ত ২৩ গ্রামে প্রায় ৪০২টি পরিবারের ২০৩৩ জন আদিবাসী পাত্র সম্প্রদায়ের বসবাস। কারো কারো মতে এদের সংখ্যা পাঁচ-ছয় হাজার হবে। পাত্র-রা নিজেদের ভাষার নাম লালং বলে এবং নিজেদের লালং জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। এদের ভাষার সঙ্গে গারোদের ভাষার মিল লক্ষ করা যায়।
ড. রতনলাল চক্রবর্তী ‘সিলেটের নিঃস্ব আদিবাসী পাত্র’ গ্রন্থে আদিবাসী পাত্র সম্প্রদায়ের আবাসস্থল হিসেবে সিলেট শহর হতে ১০-১১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব সীমানাকে চিহ্নিত করেছেন। সিলেট জেলার সদর উপজেলা ও গোয়াইনঘাট উপজেলার ১৬ থেকে ১৭টি গ্রামে প্রায় ৯০% পাত্রের বসবাস। এছাড়া সিলেট শহরের পাঠানটুলী নামক পাড়ায় এবং কিছু সংখ্যক পাত্র দেশ ত্যাগ করে ভারতে বসবাস করে । পাত্রদের বসবাস সিলেট অঞ্চল ছাড়া দেশের অন্য কোথাও যে নেই। পাত্র সমাজে সর্বমোট ১২টি গোত্র রয়েছে। আদিবাসী পাত্র কারা এ বিষয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। এরা কখনো পাত্র, কখনও পাত্তর, আবার কখনও পাথর ইত্যাদি নামে অভিহিত হয়েছে। কাঠ পুড়িয়ে অঙ্গারিক কয়লা বিক্রির মাধ্যমে জীবন-যাপন করতো বলেই তাদেরকে বলা হত পাথর। কালের বিবর্তনের ধারায় ও ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তনে এ পাথরই হয়েছে পাত্র (পাথর>পাতর>পাত্র)।
সিলেটে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিসত্তা পাত্রদের আলাদা সমাজ সংস্কৃতি ও ভাষা থাকলেও সে ভাষার কোন বর্ণমালা নেই। জাতিগত ভাবে পাত্ররা “বোড়া” জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত বলে পণ্ডিতরা অনুমান করে থাকেন। গ্রিয়ারসন সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত মনিপুরী, খাসি প্রভৃতি ভাষা ছাড়াও বৃহত্তর সিলেট তথা তৎকালীন আসাম অঞ্চলের কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতি উপভাষা সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন সেখানে পাত্রদের ভাষার উল্লেখ নেই। পাত্রদের ভাষার কোনো লিপি নেই। এমনকী লিখিত কোন নিদর্শনও নেই তাদের ভাষায়। নিজেদেরকে তারা লালং জাতি হিসেবেই গণ্য করে।
রাজবংশী : ভারতের কোচবিহার অঞ্চল থেকে আগত কোচ এবং পলিয়া জাতির মিশ্রণজাত সম্প্রদায় হচ্ছে রাজবংশী। হাচিসন ও ডালটনের লেখা থেকে জানা যায় ষোল শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কোচ রাজা হাজোরের বংশধরগণ ‘কোচ’ ত্যাগ করে ‘রাজবংশী’ গ্রহন করে। দৈহিক গঠনে এরা মঙ্গোলীয় হলেও এদের মধ্যে অস্টো-এশিয়াটিকের মিশ্রণ লক্ষ করা যায়। ভাষা বিচারে এরা বৃহত্তর বোড়ো ভাষা গোত্রভুক্ত হলেও বর্তমানে তা লুপ্ত হয়ে সেখানে বঙ্গকামরূপি> কামরূপি মিশ্রণ ঘটেছে ব্যাপক ভাবে। ফলে এ ভাষার আদিরূপ সম্পর্কে এখন জানা যায় না। যেহেতু তাদের ভাষায় কোন লিপি ছিল না সে কারণে সাহিত্য-নিদর্শন বা কোন প্রমানাদি নেই। ‘বোড়ো ভাষার উৎস জাত শব্দাবলী ও বোড়ো ভাষার অপভ্রংশ শব্দ পরিলক্ষিত হয়। এখনো তাদের ভাষায় বাংলা ক্রিয়া পদে ও বিশেষ্য পদের শেষে ও মাঝে ‘ঙ’, ‘ং’ এবং ‘ম’-এর উচ্চারণ ও ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এসব শব্দ রাজবংশীদের কথ্য ভাষায় বহুল প্রচলন রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ-পন্ডিতগণ-তাদের আদি ভাষাকে বোডো ভাষা বলে চিহ্নিত করেছেন। সুনীতিকুমার এবং ড. রফিকুল ইসলাম বাংলা ভাষায় বোড়ো প্রভাবের কথা উলেখ করেছেন। রাজবংশীরা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, রংপুর, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, পাবনা, বগুড়া, যশোর, ঢাকা প্রভৃতি জেলায় বাস করে। ধর্র্মীয় দিক থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় এদেরকে আদিবাসী রূপে পৃথক করে গণনা করা হয় না। তাই বাংলাদেশে এদের সঠিক জনসংখ্যা বিষয়ে কোন ধারণা নেই। সবমিলিয়ে ২০ হাজার বা তার বেশি হবে।
কুকি-চীন শাখা : এই শাখার ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে প্রচলিত আছে মৈতেয় মণিপুরী, লুসাই, বম, খেয়াং, খুমি, ম্রো, পাংখো ইত্যাদি।
মৈতেয় বা মণিপুরী : মঙ্গোলীয় নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের তিব্বত-বর্মি শাখার কুকি-চীন গোত্রভুক্ত জাতি হচ্ছে মনিপুরী। বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় মণিপুরী জাতির বসবাস। ময়মনসিংহ, কুমিলা এবং ঢাকায় এক সময় তাদের বসতি থাকলেও বর্তমানে নেই বললেই চলে।১৯৯১ সালের গণনায় দেখা যায় বাংলাদেশে এদের সংখ্যা ২৪,৯০২ এবং ভারতে ১২৭,০২১৬ জন। বার্মাতেও এদের বসবাস রয়েছে। ভাষাগত দিক থেকে মণিপুরী জাতি দুই ভাগে বিভক্ত। মৈতেয় মণিপুরী ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী। মৈতেয় মণিপুরীদের ভাষা হল মৈতেয় পুরনো একটি ভাষা। অন্য দিকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা ইন্দো-ইউরোপিয় পরিবারভুক্ত বাংলা ও অহমিয়া ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত। এই ভাষাভাষীরা তাদের ভাষা প্রাচীন দাবী করলেও এ বিষয়ে কোন প্রমাণ নেই । পূর্বে মণিপুরী ভাষার নিজস্ব হরফ ছিল। অধিকাংশের মতে মৈতেয় লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত। ভারতের মণিপুর রাজ্যে এই লিপির প্রথম প্রচলন হয় মহারাজ পাংখংবা-র ৩৩-১৫৪ খ্রিঃ। তখন মৈতেয় ভাষার বর্ণমালা ছিল মোট ১৮টি, পরবর্তীতে মহারাজ খাগেম্বা-র ১৫৯৬-১৬৫১ খ্রিঃ শাসনামলে আরো ৯টি বর্ণযুক্ত হয়ে মোট বর্ণ সংখ্যা হয় ২৭টি। কিন্তু সপ্তম শতকে এক ব্রোঞ্জ মুদ্রার উপর মৈতেয় বর্ণমালার প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার এটাই প্রমান করে যে মৈতেয় বর্ণমালার প্রচলন হয়েছিল অনেক আগে থেকেই।
মৈতেয় বর্ণমালার বয়স অনেক পুরোনো হলেও এই বর্ণমালায় রচিত কোন প্রাচীন পুস্তকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে দশম শতাব্দীতে সর্বপ্রথম মণিপুরী ভাষায় হাতে লেখা যে পুস্তক বের হয়েছিল তা ছিল বাংলা হরফের। মৈতেয় ভাষায় এবং বাংলা হরফে লিখিত দুটি প্রাচীনতম পুস্তক হল পুইরেইতন খুনথক এবং নুমিত কাপ্পা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা গরীবে নেওয়াজ এর সময়ে বৈষ্ণব ধর্ম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পর থেকে মৈতেয় মণিপুরী ভাষা বাংলা লিপিতেই নিয়মিত ভাবে লিখিত হয়ে আসছে। মণিপুরী লিপির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল যে, এগুলি মানুষের একেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নামানুযায়ী। যেমন: বাংলা ‘ক’ এর মণিপুরী প্রতিবর্ণ কোক, যার অর্থ মাথা, আবার বাংলা ‘স’-এর মনিপুর প্রতিবর্ণ হচ্ছে ‘সম’ যার অর্থ চুল। ভারতের মনিপুর রাজ্যের বাক-ভাষা হিসেবে মনিপুরী সরকারি ভাবে স্বীকৃত।
খুমি ভাষা : খুমিরা প্রধানত বাংলাদেশের পার্বত্য চট্রগ্রামের বান্দরবান জেলায় এবং মায়ানমারের আরাকান পার্বত্য অঞ্চল, চিন রাজ্য ওঞ্জ পশ্চিম মায়ানমারে বসবাস করে। বেশ কতগুলি বিশেষ পার্থক্যসূচক বৈশিষ্ট্যের সাহায্যে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসরত অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায় হতে খুমিদের সহজেই চিহ্নিত করা যায়। নৃতাত্ত্বিকভাবে খুমিরা আদি মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত বলে মনে করা হয়। মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর অন্যান্য জাতিসমূহের মত খুমিদেরও রয়েছে ফর্সা ত্বক, লম্বা-সরু কালো চুল, চওড়া ও চ্যাপ্টা নাক এবং মুখোমন্ডল, ছোট চোখ সর্বপরি খুব মোটা ও শক্ত পায়ের গোড়ালি। খুমি তিব্বত-বর্মি ভাষা পরিবারভূক্ত একটি ভাষা এবং তাদের ভাষায় নিজস্ব কোন লিপি নেই। আধুনিক সভ্যতার প্রভাবে অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এলেও বলা যায়, খুমিরা তাদের আদি ঐতিহ্য, লোকজ সংস্কৃতি, পার্থক্যসূচক ভাষিক বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং স্বকীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। ক্রম হ্রাসমান জনগোষ্ঠীর কারণে বর্তমানে খুমি ভাষা বিলুপ্তির পথে। গত দেড়শত বছরে বাংলাদেশে খুমি জনসংখ্যাঞ্জ অনেক কমে গেছে। এর ফলে খুমি ভাষা বিপন্ন প্রায় ঋভঢটভথণরণঢ। ১৯৯১ সালের বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত জনগণনায় দেখা যায় এদের সংখ্যা ১২৮১ জন।
ম্রো ভাষা : বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে ম্রো আদিবাসী দীর্ঘ দিন যাবত বসবাস করে আসছে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি মতে এই আদিবাসী গোষ্ঠীর জনসংখ্যা ২২১৭৮ জন। যদিও কারো কারো মতে এই সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার মত। ম্রোরা পার্বত্য চট্টগ্রামের শুধুমাত্র বান্দরবান জেলাতেই বসবাস করে। বান্দরবানের লামা, আলিকদম, থানছি, নাইখ্যাংছড়ি ও রুমা এলাকার প্রত্যন্ত বনাঞ্চলে এদের বাস। বাংলাদেশের বাইরে মায়ানমারের আকিয়াব জেলায়ও (সিত্তুই) এরা বসবাস করে। এথনোলগ রিপোর্টে দেখা যায় সেখানে তাদের সংখ্যা ২০,০০০ মতো। সব মিলিয়ে বার্মাও বাংলাদেশে ৪০ হাজার ম্রো বাস করে। ধর্ম বিশ্বাসে প্রকৃতি পূজারী হলেও এদের কেউ কেউ খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীও রয়েছ্।ে ‘তবে বর্তমানে নতুন ধর্ম “ক্রার্মা ধর্মে বিশ্বাসী অনেকেই। মেনলে ম্রো ক্রামা ধর্ম এবং ম্রো বর্ণমালার প্রবর্তক। ম্রোরা নিজেদেরকে বলে ‘মারুসা’। যদিও পার্বত্য অঞ্চলে তারা মুরং নামে পরিচিত। অন্য দিকে দেখা যাচ্ছে। আরাকানী ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমারা ত্রিপুরাদেরকেই ম্রং বলে। জনসংখ্যা এবং ভাষা বিচারে ম্রোরা সংখ্যালঘুদের মধ্যে সংখ্যা লঘু হওয়ায় এদের অধিকাংশই বহুভাষী। মাতৃভাষা ছাড়াও তারা বাংলা এবং মারমা জানে। জর্জ গ্রিয়ারসন তাঁর ীওঅ-এ- ম্রো ভাষাকে বর্মী দলের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এবং এ ভাষাকে একটি জটিল ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ভাষা গবেষক সুগত চাকমা জানাচ্ছেন ‘ম্রোদের ভাষা আমি ব্যক্তিগত ভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি। তাদের ক্রিয়াপদ ও বহুবচন গঠনে স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের ভাষার সাথে বর্মী ভাষার চেয়ে কুকি-চিন ভাষাগুলির অধিক মিল রয়েছে।
পাংখোয়া: বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে জনসংখ্যার দিক থেকে বলা যায় বিপন্ন রয়েছে যে কটি আদিবাসী তাদের মধ্যে পাংখোয়া অন্যতম। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি মতে এদের সংখ্যা ৩২২৭ জন। ভারতের মিজোরামেও কিছু সংখ্যক পাংখোয়া বাস করে। পাংখোয়ারা মূলত রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি এলাকায় বসবাস করে। হাচিসন এদের ২টি গোত্রের কথা উলেখ করেছেন ১) পাংখোয়া ও ২) ডনজাঙ। অতীতের কোন এক সময় তারা মিজোরামের পাংখোয়া (পাং=শিমুলফুল, খোয়া=গ্রাম) নামক গ্রাম থেকে এ পার্বত্য অঞ্চলে এসেছিল। লুসাইদের সঙ্গে এদের নানা বিষয়ে সাদৃশ্য রয়েছে। চীনা-তিববতী ভাষা পরিবারের কুকি-চীন-নাগা শাখা ভূক্ত পাংখোয়া ভাষায় নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই। রোমান হরফ প্রয়োগের দৃষ্টান্ত রয়েছে বিভিন্ন চিঠিপত্রে। এক সময়ে প্রকৃতির পুজারী হলে ও বর্তমানে এরা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছে। এদের নিজস্ব সংস্কৃতি প্রায় লুপ্ত শুধু ভাষাটি বলা যায় টিকে আছে বিপন্ন অবস্থায়।
লুসাই : লুসাই মূলত চীন-তিববতি ভাষা পরিবার ভূক্ত একটি ভাষা পার্বত্য চট্রগ্রামের উত্তরের লুসাই পাহাড় থেকে তারা এ অঞ্চলে আসে। মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর লুসাইরা বাংলাদেশে সংখ্যায় খুবই কম। ১৯৯১ সালের হিসাবে দেখা যায় এদের সংখ্যা ৬৬২ জন। লুসাইদের অন্য নাম হচ্ছে মিজো, লুসেই, হুয়ালাংগো ইত্যাদি। মায়ানমার এবং ভারতে এদের সংখ্যা যথাক্রমে ১২৫০০ এবং ৫,৩৮,৮৪২ জন। এরা রাঙ্গামাটির বাঘাই ছড়ি বরকল সীমান্তবর্তী এলাকায় বাস করে। এখানে লুসাইরা সংখ্যায় কম হলেও অন্যান্য কুকি-চীনভাষী লোকদের মধ্যে বম এবং পাংখোয়ারা লুসাইদের ভাষা বুঝতে পারে। এরা প্রত্যেকই রোমান ২৫টি হরফ নির্ধারণ করেছে তাদের ভাষায় ব্যবহারের জন্য।
বম : পার্বত্য চট্টগ্রমের বান্দরবান জেলাই প্রধানত বমরা বাস করে। এছাড়া রাঙ্গামাটির বিলাই ছড়িতেও এদের কিছু পরিবার আছে। ১৯৯১ সালের আদম শুমারিতে এদের জনসংখ্যা ৬৯৭৮ জন। প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারে এদের জনসংখ্যা ৩৫৮১ জন (২০০০)। সেখানে ফালাম এলাকা ও চীনা পাহাড়ে এদের বাস। বমদেরকে বম, বন, বাউন, বোনজোগি, বঙ ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়। এদের ভাষা মূলত চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের কুকি-চিন-নাগা শাখা ভুক্ত। ধারণা করা হয় যে, এক সময় চীনের মূল ভূ-খণ্ডের ‘চিনলুং’ পতিমালা এলাকায় এই উপজাতি বসবাস করতেন। পরবর্তী কালে বার্মার চেনদুইন ও ইবাবতী নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় বসবাস করেছিলেন। শানদের ইতিহাসে এর উলেখ পাওয়া যায়। বোমরা ‘লাই’ শ্রেণীভুক্ত জনগোষ্ঠী। বমরা নিজেদেরকে ‘লাই’ বা ‘লাইমি’ বলে যার অর্থ হচ্ছে- মানুষ। এদের প্রধান দুটি গোত্র হচ্ছে- শুনথলা ও পাংহয়। কৃষিজীবি বমরা অধিকাংশই বর্তমানে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহন করেছে। বর্তমানে বমরা ২৫টি রোমান হরফ ব্যবহার করছে তাদের ভাষায়। চাক ভাষা : চাকরা বাংলাদেশের বান্দরবান জেলায় বাস করে। এছাড়াও মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যেও তারা বাস করে। সেখানে তাদের আরেক নাম হচ্ছে সাক বা থাক। মায়ানমারে তাদের সংখ্যা ২০ হাজার (এথনোলগ; ২০০৫) আর বাংলাদেশে চাকদের সংখ্যা ২০০০। পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণে বাইশারি, নাক্ষ্যংছড়ি, আলিখ্যং, কামিছড়া, কোয়াংঝিরি, ক্রোক্ষ্যং প্রভৃতি জায়গাতে বাস করে। নামগত সাদৃশ্য ছাড়া চাকমাদের সঙ্গে এদের কোন মিল নেই। চাকদের ভাষা চীনা-তিব্বতি পরিবারের। চাক বা আসাক (অংধশ) ভাষার সাথে উত্তর বার্মার মিটকিনা, কাথা এবং চেনদুইন অঞ্চলের কাডু, গানান জনগোষ্ঠীর ভাষার মিল পাওয়া যায়। জর্জ গ্রিয়ারসনের মতে মনিপুরের আন্দো, সেংমাই এবং বাইরেল উপভাষার সঙ্গে চাক ভাষার সাদৃশ্য রয়েছে। চাক ভাষার কোন বর্ণমালা নেই। তবে চাকদের লোক সংস্কৃতি, লোকগাঁথা, ধাঁধাঁ, লোকগীতি ইত্যাদি যথেষ্ট সমৃদ্ধ। লোফলার (১৯৬৩), বারনট (১৯৬৬), লুচি (১৯৮৫) প্রমুখ গবেষক চাক জাতি ও ভাষা নিয়ে ইতেপূর্বে কাজ করেছেন। চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের লুইশ গোত্রভুক্ত চাক ভাষা। যদিও কেউ কেউ এটিকে অসনাক্তকৃত ভাষারূপে চিহ্নিত করেছেন। এখানে লক্ষণীয় যে চাক ভাষায় স্বর বা ঃড়হব বৈচিত্র্য রয়েছে। যে কারণে অন্যদের পক্ষে এটি উচ্চারণ করা বেশ কঠিন।
ঠার/থেক বা ঠেট ভাষা : বর্তমানে বাংলাদেশে ঠার বা থেক বা ঠেট ভাষা-ভাষীর সংখ্যা প্রায় ৪০০০০। ১৬৩৮ সালে শরণার্থী আরাকানরাজ বলালরাজার সাথে মনতং জাতির যে ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাদের ভাষার নাম ঠার বা ঠেট বা থেক ভাষা। লোকচিকিৎসা পেশার সাথে সম্পৃক্ততার ফলে কালক্রমে এরা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাইদ্যা বা বেদে নামে পরিচিতি লাভ করে। এই মনতং বা বেদের নিজ জাতির লোকদের মধ্যে ঠার ভাষা ব্যবহার করলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে এরা বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। ঠার ভাষা বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। ঠার ভাষা-র নিজস্ব কোন বর্ণমালা না থাকলেও মৌখিক সাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ। ঠার বা থেক বা ঠেট ভাষা-র বার্মা, চীন, লাওসে প্রচলিত কাডু ভাষার সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশের চাক ভাষার সঙ্গে এই ভাষায় মিল বা ঘনিষ্ঠতাও গবেষণার বিষয়। উত্তর বার্মায় প্রচলিত থেক, সাক, আসাক ইত্যাদি সবগুলোকেই কাডু ভাষার অন্তর্গত বলে ধরা হয়। সেখানে এই ভাষাভাষী লোক সংখ্যা ১,২৮,৫০০ বা তারও বেশি। এটি চীনা-তিব্বতি গোত্রভুক্ত ভাষা ।
রাখাইন ভাষা : পটুয়াখালী, কক্সবাজার, বরগুনা, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় সতের হাজার লোক রাখাইন ভাষায় কথা বলে। পটুয়াখালী কক্সবাজার ছাড়াও মহেশখালিসহ কিছু কিছু পার্বত্য অঞ্চলে (বান্দরবান, রাঙামাটি) ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রাখাইনরা নিজেদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ব্যাপারে রক্ষণশীল জাতি। তারা নিজেদেরকে রাখ্যাইন>রাখাইন বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। রাখাইন ভাষা অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি ভাষা এটি মুলত মারমা ভাষার উপভাষা। জানা যায় খ্রিষ্ট পূর্ব ৩৩২৫ সাল হতে রাখাইন রাজা মারায়ু কর্তৃক রাখাইন প্রে বা রাখাইন রাজ্যে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত রাখাইন ভাষা ছিল ঐ রাজ্যের একমাত্র জাতীয় ভাষা। রাখাইনদের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। রাখাইন বর্ণমালায় স্বরবর্ণ বা ছারা হল ১২টি এবং ব্যাঞ্জনবর্ণ বা ব্যেঃ মোট ৩৩টি। আদম শুমারি রিপোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় বাংলাদেশে রাখাইনদের সংখ্যা ১৬৯৩২ জন। মারমা, রাখাইন এবং ম্যা মূলত একই ভাষিক গোত্রের বিভিন্ন উপ-ভাষাভাষী আদিবাসী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। যাদের আদি নিবাস ছিল বার্মার পেগু শহরে। দীর্ঘদিন ধরে জীবনাচরণ এবং অবস্থানগত ভিন্নতার কারণে মারমা এবং রাখাইনদের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হলেও তারা যে মূলত একই জাতি এ বিষয়ে অধিকাংশ গবেষকগণই একমত। বাংলাদেশে রাখাইনদের ভাষা নিয়ে উলেখযোগ্য কোন গবেষণা দৃষ্টিগোচর হয় না। একমাত্র গবেষক হলেন ভাষাবিজ্ঞানী মনিরুজ্জামান (১৯৯৪)। তিনি রাখাইনদের দুটি প্রধান উপভাষা বা ভাষিক বৈচিত্র্যের সন্ধান জানাচ্ছেন। যার একটি হচ্ছে র্যামর্য এবং অন্যটি মারৌও। মারমা এবং রাখাইন উভয় গোত্র একই বর্মী লিপি ব্যবহার করে। দ্রাবিড় ভাষাসমূহ দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের এক বিশাল ভাষা পরিবার হচ্ছে দ্রাবিড় পরিবার। আর্যদের আগমনের বহু পূর্বেই এই দ্রাবিড় ভাষাসমূহ সমগ্র ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের ভাষাসমূহের মধ্যে ওঁরাওদের কুঁড়ুঁখ উলেখযোগ্য। যদিও পাহাড়িয়া, মালতো প্রভৃতি জাতির মধ্যে এক সময়ে দ্রাবিড় ভাষা প্রচলিত ছিল কিন্তু বর্তমানে তারা সাদরি ব্যবহার করে।
ওরাঁও বা কুঁড়ুখ ভাষা: বাংলাদেশে উত্তরবঙ্গের প্রায় সবকটি জেলাতেই এক সময় ওঁরাও বা কুঁড়ুখ ভাষা-ভাষীদের বসবাস থাকলেও বর্তমানে শুধুমাত্র রংপুর, দিনাজপুর, জয়পুরহাট জেলাতে কুড়ুঁখ ভাষী ওরাঁওগণ বাস করে। এছাড়াও সিলেটের চা বাগানে অল্প কিছু ওরাঁও বাস করে। বর্তমানে বাংলাদেশ এদের মোট সংখ্যা প্রায় ২৫,০০০। কুঁড়ুখ ভাষাটি আদি ও কথ্য ভাষা। এই ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই। বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে একমাত্র ওরাঁওরাই দ্রাবিড়িয় ভাষা বংশের সদস্য। নৃতাত্ত্বিক দিক থেকেও এদেরকে দ্রাবিড় বা প্রাক-দ্রাবিড়গোষ্ঠীভুক্ত করা হয়েছে। যেহেতু এদের চেহারা কালো, নাক খাঁড়া ও চ্যাপ্টা, চুল কোঁকড়ানো, মাথা গোলাকৃতির এবং উচচতা মাঝারি কাজেই এরা মঙ্গোলীয় বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে না। অধুনাকালে কেউ কেউ অবশ্য ওরাঁওদেরকে সাঁওতালদের সঙ্গে মিলিয়ে আদি অস্ট্রেলীয় গোষ্ঠীভুক্ত বলে মত প্রকাশ করেছেন । ওরাঁও ঠিক কোন গোষ্ঠীভুক্ত এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ভাষাবিচারে এরা নিঃসন্দেহে দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের।
পাহাড়িয়া ভাষা : বাংলাদেশের রাজশাহী, জয়পুরহাট, দিনাজপুর জেলায় প্রায় ৭৩৬১ জন পাহাড়িয়া জাতির লোক বাস করে। পাহাড়িয়া জাতির দুটি শাখা রয়েছে। এদের একটি শাওরিয়া পাহাড়িয়া বা মালের এবং অন্যটি মাল পাহাড়িয়া বা মালো। বাংলাদেশে মাল পাহাড়িয়াদের সংখ্যা কম। এদের ভাষাকে মালতো বলা হলেও আসলে মিশ্র ভাষা এবং দীর্ঘদিন বাঙালিদের পাশাপাশি বসবাসের ফলে মূল ভাষা হারিয়ে গেছে। শাওরিয়া পাহাড়িয়াদের ভাষা বর্তমানে সাদরি-র খুব নিকটবর্তী এমনকী সাদরি নামে বহুল পরিচিত। শাওরিয়া ও মাল পাহাড়িয়াদের ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই।
মাহালি ভাষা : উত্তরবঙ্গের মাহালি জাতিগোষ্ঠীর ভাষার নাম মাহালি ভাষা হলেও এই ভাষার বর্তমান রূপকে সাদরিই বলা হয়। সম্ভবত মূল রূপটি বিলুপ্ত হয়েছে যা দ্রাবিড় গোত্রভুক্ত ছিল। এদের কথ্য ভাষায় মূল বর্তমানে শুধু মাহালি ভাষার কিছু কিছু শব্দাবলীর প্রচলন লক্ষ করা যায়। যেমন-দাস(পানি), দাকা (ভাত), দানড়ি (গরু) ইত্যাদি।
ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষাসমূহঃ বাংলাদেশে ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারভুক্ত ভাষার মধ্যে বাংলা উলেখযোগ্য হলেও আদিবাসীদের মধ্যে চাকমা ভাষা এবং সাদরি ভাষা এই গোত্র ভুক্ত ভাষা। এছাড়া মণিপুরীদের মধ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া, হাজং প্রভৃতি এই বর্গের ভাষা।
চাকমা ভাষা : বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে জনসংখ্যা এবং অবস্থান বিচারে চাকমা বা চাক্সমা অন্যতম। চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও ভারতের মিজোরাম, আসাম, ত্রিপুরা ও অরুণাচল প্রদেশেও বাস করে। এছাড়া চাকমাদের একটি শাখা মায়ানমারে রয়েছে বলে জানা যায় ।
©somewhere in net ltd.
১|
০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১০ সকাল ১০:০০
সপ্রতিভ বলেছেন: তথ্যবহুল লেখা ! তবে একটু বড় হয়ে গেসে।