![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ঠাস করে চড়টা দিয়েই পাথর হয়ে যায় রুবায়েত। মাথাটা নিমেষেই শুন্য হয়ে যায়। এটা কি করলো সে? সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসে বেডরুম থেকে। ভুতে পাওয়া মানুষের মতো পায়ে পায়ে লিভিং রুমের সাথে লাগোয়া এক চিলতে বারান্দায় রাখা ইজি চেয়ারে এসে বসে সামনের প্লটটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই এলাকাটা নতুন আবাসিক হিসেবে গড়ে উঠছে। সবগুলো প্লটে বাড়ি ওঠেনি। কিছু প্লট মালিক আবার ডুপ্লেক্স ধরণের বাড়ি করে নিজেরাই এসে উঠেছেন। কিছু ডেভেলপারও আসছেন। এই যেমন ওদেরটাও ডেভেলপ করা হয়েছে। আজকাল ভালো ডেভেলপাররা মনে হচ্ছে বাড়ির প্ল্যানিং করার সময় আর্কিটেক্ট রাখছেন সঙ্গে। ওদের বাসাটা নশো সত্তুর স্কয়ার ফিটের হলেও রুমগুলো প্রত্যেকটা ইনডিভিজুয়াল, লিভিং রুমটা বেলকনি সহ একটু খোলামেলা, নিঃশ্বাস নেয়া যায়। ওদের পুবের প্লটটা, লিভিং রুমের বারান্দায় দাঁড়ালেই যেটা দেখা যায়, প্লটের মালিক বোধ করি দেশের বাইরে থাকেন, কিংবা এতটাই ধনী যে শহরের এই কোণায় পড়ে থাকা এক চিলতে জমি নিয়ে ভাবনার অবকাশ নেই। প্লটটাতে ছাপরা মতো একটা ঘর করা আছে। ছোট একটা বাচ্চা ছেলে, ওর মা, একটা বৃদ্ধ লোক, আরেক জন জোয়ান মতো ছেলে আছে। রুবায়েত এই বাসায় এসে উঠেছে মাস চারেক আগে, তখন থেকেই দেখছে ওদের, ছোট ছেলেটা আর মায়ের সম্পর্কটা বোঝা গেলেও, পুরুষ দু’জনের সম্পর্কটা এখনও পরিষ্কার বোঝেনি সে। জোয়ান ছেলেটা কোথাও কাজ করে, সন্ধ্যা নাগাদ চলে আসে। বৃদ্ধ মানুষটা সারাদিন বাসায় থাকে, প্লটের আনাচে কানাচে কিছু তরিতরকারির চাষ করে। সারাদিন খুন্তি নিয়ে খোঁচাতে থাকে এদিক সেদিক। মাঝে মাঝে উদাস চোখে ইট কাঠের বাড়িগুলোর দিকে চেয়ে থাকে। সেই ছোট্ট ছেলেটা নেংটি মতো কিছু পড়ে বৃদ্ধ মানুষটার পিছু পিছু সেও কিছু খোঁচাতে থাকে। যখনই এই বারন্দায় এসে বসবে, বৃদ্ধ এবং শিশুটির জমি কর্ষণ উপভোগ করে রুবায়েত। আহা! যেন পূর্ব প্রজন্ম উত্তর প্রজন্মের হাতে তুলে দিচ্ছে চাষের গোপন কৌশল। আজ প্লটটা খাঁ খাঁ করছে। কেউ নেই। রুবায়েত উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে ফাঁকা প্লটটার দিকে। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার রুবিকে চড় মারলো রুবায়েত। কি করে যে কি হয়ে যায়! রুবি এমনিতেই একটু চুপচাপ ধরণের। তর্কাতর্কিতে খুব একটা আগ্রহ নেই ওর। কখনো কখনো দু একটা কথার জবাব দিবে, কখনো তাও না। রুবায়েতের নটা পাঁচটা চাকরি। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় সে বাসায় ফেরে। রুবি’র ব্যাংকে চাকরি। সন্ধ্যার জ্যাম সাঁতরিয়ে ফিরতে ফিরতে সাড়ে আটটা। আসার সময় আবার কিছু কাঁচা বাজার করে। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে ঢোকে। এই ফাঁকে রুবায়েতকে এক কাপ চাও দিয়ে যায়। রুবায়েত বসে বসে টিভি চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টক শো দেখতে থাকে। মাঝে মাঝে রুবায়েত নিজেও ভাবে রুবি’র ওপর চাপ বেশি হয়ে যাচ্ছে, কাঁচা বাজারটা হলেও ওর নিজের করা উচিৎ। সমস্যা হচ্ছে, ও বাজারে গিয়ে দরদাম করতে পারে না। কেমন নার্ভাস হয়ে যায়। তরিতরকারিও ভালো চেনে না। মাংস কিনতে গেলে হাড় নিয়ে আসে। কয়েকবার চেষ্টা করেছিলো, রুবি না করে দিয়েছে, সেও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। আজ কি একটা দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি, রুবায়েত সকালে উঠেই আবদার করেছে সকালের নাস্তায় নতুন কিছু করার জন্য, রুবি ক্লান্তির দোহাই দিয়ে পাশ কাটিয়ে গেছে, বলেছে দুপুরে কিছু করার চেষ্টা করবে। রুবায়েত সকালে একটা ডিম ভেজে নিয়ে পাউরুটি আর মেয়নিজের বয়াম নিয়ে যখন টেবিলে বসেছে, রুবি তখনো বিছানায়। একই জিনিষ রোজ খেতে খেতে ঘাসের মতো লাগে। রুবায়েতের আয়েশী জীবনে অভ্যস্ত। ওর যা ভালো লাগে তাই সে করেছে, ওর যা চাই তাই সে পেয়েছে। রুবিকে বিয়ের পর সবকিছু কেমন পাল্টে যাচ্ছে। ওর আর ভালো লাগছে না। সকালে নাশতা করেই বাসার কাছে হাটা দুরত্বে এক বন্ধুর ফার্মেসীতে চলে যায়। ওখানে চুটিয়ে আড্ডা দেয় দুপুর পর্যন্ত। দুপুরে বাসায় এসে দেখে রুবি হাঁটুমুড়ে বসে শোবার ঘর মুচছে, বাথরুমে এক গামলা আধোয়া কাপড়। বাথরুমের কল দিয়ে পানি পড়ে বাথরুম ভেসে যাচছে। বোঝা যাচ্ছে কাজের বুয়া আসেনি আজকে। এতসব কাজের ফাঁকে স্পেশাল রান্না দূরে থাক, ঠিক সময়ে খাওয়া জোটে কিনা ওটাই রুবায়েতের আশঙ্কা। বাসায় ঢুকেই ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে, পত্রিকাটা হাতে নিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বলল...
- বাথরুমের কলটা বন্ধ করে দাও, পানিতে ভেসে যাচ্ছে
- দেখছোতো আমি একটা কাজ করছি, তুমি পারছো না বন্ধ করতে?
- পানিতো মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরেই পড়ছে, আমি না এলে কি ওটা বন্ধ হতো না?
- তুমি না এলে কি হতো সেটা আলোচনার দরকার কি? এখন যখন আছো, পত্রিকা হাত থেকে একটু নামিয়ে কলটা বন্ধ করে এসো।
- তুমিতো মনে হচ্ছে রান্নাঘরেও ঢোকনি, দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, খাবো কখন?
- এতো ক্ষিদা লাগলে, বাহির থেকে কিছু খাওয়া নিয়ে ঢোক নি কেন?
- আজকাল চাকুরীতে কি স্বামিদের সাথে কিভাবে কুটতর্ক করতে হয়, তাও শেখাচছে নাকি?
- হঠাৎ ও কথা আসছে কেন? তুমি দেখছো আজকে বুয়া আসে নি। ঘর মোছা, বাসি কাপড় ধোয়া, রান্না করা... তুমি জানতে চেয়েছো আমি কিছু খেয়েছি কিনা? কিছু বাজারতো সারতে পারতে... বিবেক বলতে কিছু কি তোমরা পুরুষ মানুষদের নেই?
- আর কাজের দোহাই দিয়ো না। কি এমন কাজ দেখতেই পাচ্ছি। সারাক্ষণ বাসাতেই আছো, কিছু খেয়ে নিলেই তো হয়? না খাওয়ার ঝামটা দিচ্ছ কেন? বিবেকের কথা বলছো, বিবেক আছে বলেই তোমার মতো মহিলা নিয়ে সংসার করছি, কাজের বেলায় লবডঙ্কা, খালি মুখে ফরফর...
- আহারে কি এমন মহাপুরুষ হয়ে গেছেন উনি, বিশজন মহিলাকে হাত ধুয়ে বসে থাকতে হবে উনার সেবার জন্য!
এসব তর্কাতর্কির সময় রুবায়েতের মাথায় একটা ছবি জমতে থাকে। একটা কুঁড়ে ঘর, চেয়ারে বসা সাদা পাঞ্জাবী পরা এক মানুষ, তার দুপা জড়িয়ে ধরে কাকুতি মিনতি করা দুই মহিলা। দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে আতংকে, বিস্ময়ে ফ্যাঁকাসে চেহারার এক বালক ... সেই ছবি ওকে ধীরে ধীরে সম্মোহিত করে ফেলে, ক্রোধে লাল হয়ে যায় রুবায়েত... তারপরই ঠাস করে এক চড়। নিমেষেই মাথার ভেতরে সব শুন্য হয়ে যায়। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার হলো এটা।
রুবি’র সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবটা ওর সেজো মামাই নিয়ে আসে। রুবায়েতের পাঁচ মামার মধ্যে সেজো মামা ছাড়া বাকি চার মামাই ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এবং অত্যন্ত ধনী। এই সেজো মামাই একটু অন্যরকম। পোস্ট অফিসের ছোট একটা চাকরি করেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। সেই চাকরি থেকে অবসরের পর তাঁর এলাকায় একটা স্কুলে বিনা বেতনে ইংরেজি পড়ান। তিনি নিজে বিয়ে করেন নি। তবে অন্যদের বিয়ে করানোর জন্য আদা জল খেয়ে নেমে পড়েন। ঢাকা ওয়াসা’র হিসাব বিভাগে রুবায়েতের চাকরিটা হবার পর থেকেই সেজো মামা রুবায়েতের বাসায় নিয়মিত হাজিরা দিতে থাকেন। রুবি ওনার পাড়াতেই থাকে। পাবনার মেয়ে। বাবা মা মারা গেছে। বড় ভাইয়ের সংসারে ভাই বউয়ের নিত্য মুখ ঝামটা সয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে, খুব সম্প্রতি একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি পেয়েছে। সেজো মামার মতে মেয়েটি অত্যন্ত সুশীল, কাঁচা বাজার করা থেকে ঘরের সব কাজ করে। উনার একটাই আশঙ্কা, বাসার কাজের সুবিদার জন্য ভাই বউ রুবিকে বিয়ে না দিয়ে আইবুড়ো করে ঘরেই রেখে দিবে। কাজেই রুবায়েতের উচিৎ এই ভালো মেয়েটিকে এক্ষুনি বিয়ে করে ওই নরক থেকে উদ্ধার করা। রুবায়েতের আবার এইসব সামাজিক মানবিক সমস্যাগুলো নিয়ে মাথাব্যথা নেই। পাঁচ বোনের এক ভাই সে। তাও সবার ছোট। আদরে আয়েশে বড় হয়েছে। নিজের হাতে কখনো কিছু করতে হয় নি। সবকিছু সবসময় হাতের কাছে তৈরি পেয়েছে। সেবা নিতে অভ্যস্ত সে। সেজো মামার পিড়াপিড়িতে ব্যাংকে গিয়ে রুবিকে দেখে আসে একদিন। চুপচাপ ভদ্র মেয়ে বলেই মনে হলো ওর। বিয়ে যখন করতেই হবে, আধুনিক মুখরা মেয়েদের চাইতে রুবিকেই মনে ধরলো রুবায়েতের। আর বোনদেরও রুবিকে পছন্দ হলে বিয়েটা হয়ে যায়। বিয়ের পর স্বামী কিংবা বিয়ে নিয়ে রুবিরও বিশেষ কোন স্বপ্ন বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে বলে মনে হয়নি। চুপচাপ চাকরির পাশাপাশি ঘরের কাজ করছে। রুবায়েতের কখন কি দরকার বুঝে নিয়েছে। ঠিক যেন একজন আদর্শ স্ত্রীর প্রতিচছবি। কিন্তু রুবায়েতের কেবল নেবার অভ্যেস। কখনো কেউ কিছু চায়নি ওর কাছে। রুবায়েতের বাবা মারা যান ও যখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে, বোনেদের সবার বিয়ে হয়ে গেছে ততদিনে। বাবা মারা যাবার পর ও আর ওর মা বড় বোনের সাথে থাকতে শুরু করে। বড় দুলাভাই প্রকৌশলী। সড়ক ও জনপথে চাকুরীতে আছেন। বেশ অমায়িক মানুষ। কলেজ পড়ুয়া রুবায়েতকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো খোঁজ খবর করেন নিয়মিত। ও যখন বি কম পড়ছে, তখন ওর মা মারা যান, বাবা মারা যাবার ঠিক দু বছরের মাথায়। বোনদের আদরে ভালোবাসায় ও কখনো ঠিক বুঝতে পারেনি মা কিংবা বাবার অভাব। বড় বোনের বাসায় থেকেই ও চাকুরীতে যোগ দেয় এবং বিয়ে করে নতুন বাসায় ওঠে। বোনদের স্নেহের প্রাচীরে আবদ্ধ রুবায়েত শরীরে বেড়ে উঠলেও, মনে বাড়তে পারে নি। একটা খোলা জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, সংগ্রাম, যন্ত্রণা ওর কাছে অচেনা রয়ে গেছে। ও এখনও শিশুর মতোই স্বার্থপর।
বিয়ের দ্বিতীয় দিনই রুবির সাথে ওর লেগে যায় মশারী টাঙ্গানোর মতো অতি তুচছ একটা বিষয় নিয়ে। ওরা তখনো বড় বোনের বাসায় আছে। রুবায়েত বিছানায় শুয়ে শুয়ে টিভি’র চ্যানেল ঘুরাচ্ছে। রাত হয়ে গেছে, রুবি মশারী বের করে ওকে জিজ্ঞেস করে, মশারী কিভাবে টানাবে ওকে যেন একবার দেখিয়ে দেয়। রুবায়েত তখন একটা ছবি দেখছে মনোযোগ দিয়ে। রুবি দ্বিতীয়বার বলতেই ছ্যাঁত করে ওঠে রুবায়েত,
- ন্যাকামো করো না, এতো বড় মেয়ে তুমি বুঝতে পারছো না? আগে লাগিয়ে দেখো মশারীর কোন মাথা কোথায় খাটে...
রুবায়েতের উঁচু গলার আওয়াজ শুনেই ওই সময়ে বাসায় থাকা রুবায়েতের দুই বোন এক সাথে রুমে ঢুকে পড়ে। যেন ওরা দরজায় কান লাগিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। ওরাও রুবায়েতের সুরে সুর মিলিয়ে রুবিকে বকা দেয়। বিয়ের দ্বিতীয় দিন রাতেই এমন আচরণের স্বীকার হয়ে রুবি অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে রুবায়েতের দিকে তাকিয়ে থাকে। রুবি’র আহত, অপমানিত সেই দৃষ্টি বেশ কিছুদিন রুবায়েতকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে। তবে গায়ে হাত তোলার এই ব্যাপারটা শুরু হয়েছে মাস চারেক আগে। রুবি’র ব্যাংকে অডিট চলছিলো তখন। ওর বাসায় ফিরতে খানিকটা দেরি হচ্ছিলো। যদিও ব্যাপারটা সে রুবায়েতকে বুঝিয়ে বলেছিলো। তারপরেও দু’এক দিন যেতেই রুবায়েতের অস্থিরতা শুরু হয়ে যায় এবং একদিন রাতে বাসায় ফিরতেই রুবায়েত প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ওর মাথায় ফিরে আসে সেই ছবিটা ... একটা কুঁড়ে ঘর, চেয়ারে বসা সাদা পাঞ্জাবী পরা এক মানুষ, তার দুপা জড়িয়ে ধরে কাকুতি মিনতি করা দুই মহিলা। দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে আতংকে, বিস্ময়ে ফ্যাঁকাসে চেহারার এক বালক ... আর তারপরেই ঠাস করে এক চড়। উত্তেজনা কমে আসলে কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ে রুবায়েত, ধীরে ধীরে একটা তীব্র অপরাধবোধ ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। ছবিটা ওকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে। সম্মোহিত করে ফেলছে। ছবিটা মাথায় জমতে শুরু করলেই ওর সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে তীব্র ঘৃণার এক মেঘ জমতে থাকে। সবকিছু তছনছ করে দিতে ইচছে হয়। মাথায় খুন চেপে যায়।
রুবায়েতের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা শহরতলীতে। এলাকাটা মূল শহর থেকে খানিকটা দূরে হলেও ছোট চাকুরীজীবী বা খেটে খাওয়া নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষদের বেশ একটা ঘন বসতিপুর্ণ এলাকাই ছিলো। ওরা থাকতো দোতলা একটা ভাড়া বাড়িতে। সেই বাড়ির সামনে টানা বারান্দা, উপর নিচ মিলিয়ে ছয়টা পরিবার। সেই বাড়ির লাগোয়া এক টুকরো জমিতে কিছু বস্তি মতো ছিলো। এক সকালে ওদেরই এক ঘর থেকে বেশ হৈ চৈ কান্নার আওয়াজে রুবায়েত ছুটে বেরিয়ে যায় দেখতে। ওর তখন সাত আট বছর হবে বোধ করি। দেখে একটা ঘরে বেশ লোক জমে গেছে ততক্ষণে। ঘরের ভিতরে বেশ কয়েকজন লোক বসে আছে। ঘরে আসবাব বলতে দুটো নড়বড়ে চেয়ার আর একটা ছোট খাট। মাথায় সপসপে তেল দেয়া কালোমতো এক লোক চেয়ারে বসে আছে আর তার দুই পা আঁকড়ে ধরে কান্না করছে এক মেয়ে আর তার বৃদ্ধা মা। লোকটা মেয়েটার স্বামী। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই নাকি লাপাত্তা। হঠাৎ তার কানে যায় তার স্ত্রী কোন এক গার্মেন্টসে কাজ করছে। এবার তার পৌরুষ চুপ থাকতে পারেনি। সে এসেছে তালাক দিতে। সে আঙ্গুল উঁচিয়ে এক তালাক উচ্চারণ করে। মেয়ে আর মা তার পা ধরে চিৎকার করে কাকুতি মিনতি করতে থাকে। সে দুই তালাক বলে। মেয়ে আর বৃদ্ধা মা কাদঁতে কাঁদতে আরও জোরে ওর পা চেপে ধরে মাটিতে মাথা কুটতে থাকে। নির্বিকার লোকটি তিন তালাক বলার সাথে সাথে মা মেয়ে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। আর উঠে দাঁড়িয়ে পা ঝাড়া দিয়ে বীরের মতো বেরিয়ে যায় মেয়েটার স্বামী। রুবায়েত অবাক তাকিয়ে দেখলো ঘর ভর্তি মানুষ কেউ টুঁ শব্দ করলো না। সেই ভিড়ে, দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে ভয়ে, আতংকে ফ্যাঁকাসে চেহারায় রুবায়েত জীবনের এক নিষ্ঠুরতম, এক নির্মমতম সত্য উপলব্ধি করলো, সে বুঝলো...পুরুষ কি, পুরুষের ক্ষমতা কি। এই ঘটনা চাক্ষুষ করার পর থেকেই ওর মাথাটা কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। অপরিচত কোন পুরুষ মানুষ দেখলে সে আতংকে কুঁকড়ে যেতো। ওর এই আচরণ ওর প্রতি ওর মা-বোনদের স্নেহ এবং প্রশ্রয় আরও বাড়িয়ে দেয়। ওরা স্নেহের কৃত্রিম এক জগত গড়ে তোলে রুবায়েতের চারপাশে। কৃত্রিম জগতে, বহির্জগতের ঘাত-প্রতিঘাত থেকে আড়ালে বেড়ে ওঠা রুবায়েত আর জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে নিষ্ঠুরতা আর কঠোরতার ঘা খেয়ে বেড়ে ওঠা রুবি, ওদের দুটো জীবন যেন প্রকৃতির ভুলের মাসুল দিচ্ছে আজ।
বারান্দায় ইজি চেয়ারে এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো টের পায়নি রুবায়েত। ঘুম ভাংতেই দেখে চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। ওর চারপাশে মশা ঘিরে আছে। বাসায় ঢুকে দেখে বাতি জ্বলছে কেবল রান্নাঘরে। রুবি কিছু করছে বোধকরি। খুটখাট আওয়াজ আসছে। রুবায়েত কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢোকে। ঝর্ণা ছেড়ে অনেকক্ষন গোসল করে। গা মুছে জামা পড়ে বেরিয়ে আসে। বাইরে কোথাও থেকে হেঁটে আসলে ভালো লাগবে। বেরিয়ে যাবার সময় রুবি কিছু খাবে কিনা জিজ্ঞেস করে। রুবির মুখের বাম পাশটা ফুলে আছে। রুবায়েত কিছু খাবে না বলে বেরিয়ে আসে। তবে পেট জানান দিচ্ছে ওর প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে।
ওদের এই আবাসিক এলাকাটা শহরের দক্ষিণে, শেষ মাথায়। আরও দক্ষিণে মিনিট পনের মতো হেঁটে গেলে একটা খালের মতো আছে, জল নেই বললেই চলে। তবে পাড়গুলো পাকা করা আছে। অনেকেই সকাল বিকেল হঁটাহাঁটি করেন। রুবায়েত হাঁটতে হাঁটতে খালপাড়ে এসে পড়ে। পরিচ্ছন্ন একটা যায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়ে। আরও অনেকেই বসে আছে। বেশ ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, বাতাসের কারণে মশা তেমন নেই। পেট গুড়গুড় করছে খিদেয়, ও চুপচাপ বসে আছে। শরীর ও মনে কেমন একটা অবসাদ ভাব। ওর কেন এমন হয় ভাবছে। ওর গায়ে কেউ কখনো হাত তোলেনি, তবে ও কেন রুবি’র গায়ে হাত তুললো, দুই দুইবার! গায়ে হাত তোলার মতো তেমন কিছুইতো ঘটেনি। ও কেন নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারছে না? ও কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? ওর কি কাউন্সেলিং প্রয়োজন? রুবিতো কিছু চায়নি কখনো ওর কাছে। বিয়ের পর থেকেই ও কেবল রুবায়েতের ভালো মন্দের খোঁজ খবরই রেখেছে। বিনিময়ে রুবায়েতের নিষ্ঠুর আচরণ সহ্য করে গেছে দিনের পর দিন। ওর কি করা উচিৎ? কার কাছে যাবে? এতোসব ভাবতে ভাবতেই রাত হয়ে যায় বেশ। মানুষজন কমে গেছে ততক্ষণে। খিদেও সহ্য করা যাচ্ছে না আর। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে রুবির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, ওর সাথে কথা বলতে হবে, ওর সাথে শেয়ার করতে হবে সবকিছু। একা একা আর এটা সামলানো যাবে না। বাইরে আর খেলো না কিছু, খাবার কিনে বাসায় ফিরে আসলো। রুবি সহ একসাথে খাবে। কলিং বেল বাজায়, কয়েকবার। রুবি কি বাথরুমে? নাকি ঘুমিয়ে পড়লো আবার? খাবার হাত থেকে নামিয়ে পকেট হাতড়িয়ে চাবি বের করে দরজা খুলে বাসায় ঢোকে রুবায়েত। ঘর অন্ধকার। রুবি নেই। রুবি কোথায় গেলো? ভাবতে ভাবতেই লাইট জ্বালায়। চোখে পড়ে ডাইনিং টেবিলের উপরেই এক গোছা চাবি চাপা দেয়া একটা সাদা কাগজ। কাগজ হাতে নিয়ে দেখে, রুবি চলে গেছে বাসা ছেড়ে, যাবার সময় তড়াহুড়া করে ওকে একটা চিঠি লিখে গেছে। রবায়েতের মাথাটা আবার শুন্য হয়ে যায়। খাবারগুলো টেবিলের উপর রেখে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। চিঠি চোখের সামনে মেলে ধরে...
‘রুবায়েত,
আমি চলে যাচ্ছি। তোমার আচরণ, তোমার চোখের দৃষ্টি, তোমার গায়ের স্পর্শ আমাকে তিল তিল করে হত্যা করছে। আমি বাঁচতে চাই। আমি ছোট বেলায় বাবা মাকে হারিয়েছি। সেই থেকে বড় ভাইয়ের সংসারে ভাই বউয়ের নিত্য গঞ্জনা, অপমান সহ্য করে আমি বেড়ে উঠেছি। মানুষের নিষ্ঠুরতা আমার কাছে নতুন নয়। কিন্তু তোমার কাছে নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি আরেকটা জিনিষের সাথে পরিচয় হলো, সেটা হচ্ছে ঘৃণা। মেয়েদের প্রতি তোমার নিদারুন একটা ঘৃণা আমাকে প্রতিটা মুহূর্তেই আতংকে শিহরিত করেছে। প্রথম যেবার গায়ে হাত তুললে, ভেবেছিলাম ক্ষণিকের রাগে অন্ধ হয়ে করেছো। ভেবেছিলাম বাইরে কোথাও ঝামেলা হয়েছে, বাসায় এসে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারোনি। মধ্যবিত্ত পুরুষেরা রাগ আর কোথায় দেখাবে, বউ ছাড়া? তাছাড়া তোমার সাথে তোমার বড় বোনদের আচরণতো দেখেছি! তোমরা কেউই বোধ করি স্বাভাবিক নও। প্রতিদিন প্রতিটা মুহূর্তে তুচ্ছ কারণে খোঁটা দেয়া, পদে পদে ত্রুটি খুঁজে বের করা আমার আর সহ্য হচ্ছে না। তারপর আজ আবার গায়ে হাত তুললে। সেই একই ঘৃণায়।
আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো না। ডিভোর্সের কাগজ পাঠিয়ে দিও। আমি সাইন করে দেবো। আর... নিজেকে বদলাতে চেষ্টা করো। যুগ অনেক এগিয়েছে। মেয়েদের মানুষ ভাবার চেষ্টা করো। ওদেরও শরীর আছে, ওদেরও ক্লান্তি আছে, ওদেরও মন আছে, ওদেরও কষ্ট আছে... কখনো পারতো বোঝার চেষ্টা করো। ভালো থেকো।
রুবি।‘
অনেক অনেকদিন পর, একা বাসায়, একটা অদ্ভুত বোবা আতংকে, কাউকে বুঝতে না পারার কষ্টে, বা কাউকে ভালোবাসতে না পারার যন্ত্রণায় রুবায়েতের দুচোখ বেয়ে ঝরঝর করে জল গড়াতে লাগলো...
©somewhere in net ltd.