![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলাদেশ শুধু একটি দেশ বা মানচিত্র নয়, একটি ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু শুধু একজন ব্যক্তি নন, একটি ইতিহাসও। একইভাবে ২৬ মার্চ শুধু একটি দিন নয়, বিশ্বের ডায়েরিতে একটি ইতিহাস।
একাত্তরের ৭ মার্চ থেকে একদিকে চলছিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নির্দেশ, অন্যদিকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ। বাঙালি ইয়াহিয়ার নির্দেশের তোয়াক্কা না করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতোই চলতে থাকে। এভাবেই চলছিল ২৫ মার্চ পর্যন্ত।
সেই রাতেই অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে একদিকে নিরস্ত্র-নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানী সেনারা। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানা রাইফেলস সদর দফতর। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণাটি ছিল ÒThis may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.
এর বাংলা অনুবাদ :এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে|
এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়। এরপর তিনি বাংলায় লেখা একটি বার্তাও পাঠান। তা হলো-পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্য আবেদন করেছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্র“দের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর,বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপোস নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্র“কে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’
বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা তাৎক্ষণিক বিশেষ ব্যবস্থায় পাঠানো হয় সারাদেশে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বাঙালি জওয়ান ও অফিসাররা। পাক সেনারা রাত দেড়টায় বঙ্গবন্ধুকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায়।
এ ব্যাপারে টিক্কাখানের এডিসি মেজর এস.জি. জিলানীর বক্তব্যে জানা যায়, তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন ভিআইপি বন্দি। পাকিস্তানীদের ভয় ছিল, অন্য কোন রাষ্ট্র, বিশেষ করে ভারত তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে। তাই গ্রেফতারের পর তার অবস্থান গোপন রাখা হয়েছিল এবং এক জায়গায় তাকে বেশিক্ষণ রাখা হতো না। তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা দুইবার বাতিল করা হয়েছিল এই ভয় থেকে-খবরটি ভারতে পাচার হয়ে গেছে। মধ্য আকাশে বিমানকে ভারত ধাওয়া করতে পারে।
পরে করাচি হয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় লায়ালপুর কারাগারে। সেই কারাগারটি বর্তমানে পরিচিত ফয়সালাবাদ সেন্ট্রাল জেল নামে। এখানেই একাত্তরের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাখা হয় বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে কবে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেই বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত। তবে শামসুল হুদা চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর বইতে ২৯ মার্চের কথা বলেছেন। অন্যদিকে রবার্ট পেইনের The Tortured and The Damned' বইয়ের অনুবাদে বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের লিখেছেন ২৯ মার্চ পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক দি ডন যে ছবিটি প্রকাশ করে সেটি ২৭ মার্চের তোলা।
বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জহির আলম খান। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসাবে ১৯৭০ সালের মে মাসে তাকে কুমিল্লা সেনানিবাসে পাঠানো হয়। ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৩ তারিখ তাকে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে বঙ্গন্ধুকে গ্রেফতার করেন তিনি। তার সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতা সম্বলিত "The Way It-Was" নামক একটি আত্মজীবনীমূলক বইয়ে তিনি লিখেছেন তার সেই অভিজ্ঞতার কথা।
ব্রিগেডিয়ার জহির জেনারেল নিয়াজির নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বিকেলে একটি সি-১৩০ কার্গো বিমানে করে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসেন। তখন তিনি দেখতে পান বাংলাদেশের পতাকায় ছেয়ে আছে সারা ঢাকা শহর। তাকে জানানো হলো, একমাত্র পাকিস্তানি পতাকাটি মোহাম্মদপুরের বিহারি কলোনিতে উড়ছে। বিমানবন্দর থেকে তাকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দফতরে। সেখানে তাকে প্রথমবারের মতো কর্নেল এসডি আহমদ বলেন, ২৪ মার্চ অথবা ২৫ মার্চ শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করতে হবে। তিনি যেনো সেভাবে প্রস্তুতি নেন। ২৩ মার্চ সন্ধ্যায়
ব্রিগেডিয়ার জহির মেজর বিল্লাল, ক্যাপ্টেন হুমায়ূন, ক্যাপ্টেন সাঈদকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বরের বাড়ির আশপাশ এলাকা রেকি করেন। তারা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনের সড়কে দেখতে পান বিপুল জনসমাগম। পরদিন সকালে তারা ধানমণ্ডির সড়কগুলো ঘুরেফিরে দেখে একটা ধারণা নেন। ২৪ মার্চ সকালে নির্দেশ মতো ব্রিগেডিয়ার জহির জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে দেখা করেন। ফরমান আলী তাকে বলেন ২৫ তারিখ রাতে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করতেই হবে।
২৫ মার্চ রাত নয়টায় ব্রিগেডিয়ার জহির তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বরের দিকে যাত্রা করার কথা থাকলেও যাত্রা করতে বেজে যায় রাত প্রায় এগারোটা। তখন তার সঙ্গে ছিলেন মেজর বিল্লাল, ক্যাপ্টেন সাঈদ ও ক্যাপ্টেন হুমায়ূন। তাদের যাত্রাপথ ছিল তেজগাঁ বিমানবন্দর, সংসদ ভবন (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়), মোহাম্মদপুর হয়ে ধানমণ্ডি। পথে পথে অসংখ্য ব্যারিকেড। কোথাও উল্টানো গাড়ি, কোথাও বা গাছের গুঁড়ি কিংবা বড় বড় পাইপ। একাধিক জায়গায় ব্রিগেডিয়ার জহিরের সৈন্যরা রকেট লঞ্চার দিয়ে গুলিবর্ষণ করে ব্যারিকেড সরায়। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতেই শুরু হয়ে যায় অপারেশন সার্চ লাইট। মধ্যরাতের পর পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশ করে। চারপাশে গাঢ় অন্ধকার। রাস্তার বাতিগুলোও ছিল নেভানো। ক্যাপ্টেন হুমায়ূনের সৈন্যরাই প্রথম বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশ করে। গোলাগুলির কারণে তখন বত্রিশ নম্বর ছিল জনমানব শূন্য। বাড়ির সামনে ছিল কিছু পুলিশ পাহারা। এরই মধ্যে তারাও সরে পড়েছে। হঠাৎ পাকিস্তানি সৈন্যরা দেখে বাড়ির একজন লোক তাদের দিকে ধেয়ে আসছে একটি বড় দা নিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করা হয়। তখন কেউ ছিল না বত্রিশ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিচতলায়। প্রথম তলাও খালি। একটি বন্ধ রুমের ভেতরে কিছু মানুষের আওয়াজ শুনতে পেয়ে মেজর বিল্লালকে দরজা ভাঙ্গার হুকুম দেন ব্রিগেডিয়ার জহির। দরজা ভাঙ্গার পর তারা দেখেন ভেতরে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুও আছেন। এ সময় হাবিলদার মেজর খান ওয়াজির বঙ্গবন্ধুকে শাবীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করে। ব্রিগেডিয়ার জহির বঙ্গবন্ধুকে তার সঙ্গে যেতে বলেন। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দেন। বঙ্গবন্ধু তার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের প্রিয় পাইপটাকে হাতে তুলে নেন। এরপর ব্রিগেডিয়ার জহিরের সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন। ততক্ষণে সারা ঢাকা শহরে ইতিহাসের ভয়াবহতম হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। বন্দী বঙ্গবন্ধুকে যখন সেনানিবাসে নিয়ে যওয়ার জন্য একটি ট্রাকে তোলা হয় তখন ঢাকা শহর জ্বলছিল। চারদিকে মানুষের গগনবিদারি চিৎকার আর আগুনের লেলিহান শিখা। ঢাকা তখন জ্বলছে ।
২৬ মার্চ জে. ইয়াহিয়া এক ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আর বঙ্গবন্ধুকে আখ্যা দেন দেশদ্রোহী বলে।
©somewhere in net ltd.