![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বলা হয়ে থাকে ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা সক্রিয় যুদ্ধ করে ছিলো তাদের একটা বড় অংশ ছিলো গ্রামের কৃষক। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে বীর বাঙালি রুখে দাঁড়ায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই কৃষকই হয়েছে সবচেয়ে বেশী নিগৃহীত, অবহেলিত, নিষ্পেষিত। সে সময় দিনমজুরের মজুরি ছিল এক থেকে দুই বা আড়াই টাকা। আর ৭১ সালে চাষীর মজুরি ২ টাকা দিয়ে চাল পাওয়া যেতো ১ থেকে দেড় সের। তার পুরো দিনের মজুরি দিয়ে চাল ছাড়া আর কিছুই কেনা যেতো না। কৃষকের সোনার বাংলার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে গেলো। ১৯৪৩ সালে বিশ্বযুদ্ধের কারণে দ্রব্যমূল্য অসম্ভব বাড়ার কারণে কৃষিমজুরের মজুরি বাড়িয়ে বার আনা করেছিলেন। তখন সেই বার আনা দিয়ে কৃষিমজুররা যেটুকু চাল কিনতে পারতো, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে নিজের ফলানো ফসল কিনতে তাকে সেই ৪৩ সালের মতোই শ্রম দিয়ে সারা দিনের মজুরি শেষ করতে হতো ওই ১ থেকে দেড় সের চাল কেনার জন্য। নতুন স্বাধীন দেশে কৃষকের যে স্বপ্ন ছিল সেটা বাস্তবায়নের জন্য দরকার ছিল মাঠে ঘাটে লাঙল হাতে ঝাঁপিয়ে কাজ করার। সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত করার নামে সব দখল করার ফলে কৃষক হয়ে নিঃস্ব, তার যেয়ে একখণ্ড জমির স্বপ্ন তা পুরোটাই হয়ে গেলো দুঃস্বপ্নের মতো। তাছাড়া কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত হয়ে যাওয়ায় ছোট কৃষকরা কৃষি জমি ছেড়ে লাভের আশায় সেখানে যোগদান করা শুরু করলো। সেই সময় মরহুম শেখ মুজিবর রহমানের ২৫ বিঘা জমির খাজনা মাফ সুফলটা পুরোপুরি ভোগ করলো বিভিন্ন ভাবে যাদের অঢেল জমি আছে তারা, আর যার কোন মতে দুবিঘা জমি আছে নিজে চাষ করে খান তার কিছুই এসে গেলো না। বলতে গেলে সেই সময় ওই ২৫ বিঘা খাজনা মাফ ছাড়া কৃষিতে আর কোনো কিছুই না। আর ফলে এক ফসলি দুফসলি জমিতে উৎপাদন করে কৃষকের চলাও মুশকিল হয়ে গেলো। ফলে কৃষকও তার জমিজমা বিক্রি শুরু করে অন্য কাজে যোগদান করা শুরু করলো। আর এর ফলে কলে-কারখানায় কাজের সুযোগও কমে গেলো। হিসাব অনুযায়ী সে সময় বাংলায় ভূমিহীনের সংখ্যা অনুমান করা যায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। আর তা বাড়তে বাড়তে ১৯৭৩-৭৪ এর দিকে এসে জমিহীনের সংখ্যা বেড়ে ৪০/৪৫ শতাংশ হয়ে গেলো। ঘরে খাবারও নাই জমিতে ধানও নাই আমার কৃষক বলতে গেলে তখন পুরোই দুরবস্থার মধ্যে। ফলে যারা বর্গা চাষি তারা চাষারা ছিন্নমূল হয়ে শহরে আশ্রয় নিলো। তাদের চূড়ান্ত গতি হলো ঢাকার দিনমজুর হিসেবে। ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা বস্তিতে হলো এদের বসবাস। আর যেহেতু ক্রমাগত তারা জমি হারা হচ্ছেন তাই দ্রুত এই সংখ্যাটাও বাড়তে লাগলো।
এর পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের আমলে " খাল কাটা কর্মসূচীর " মাধ্যমে যত্রতত্র খাল কেটে ক্ষুদ্র চাষীর দুই, এক বিঘে জমিও শেষ করে দেওয়া হলো। জোতদারদের বসানো পাম্পের পানি খাল দিয়ে যে জমিতে ঢুকলো সে জমি জোতদার বা ধনী কৃষকের, কিন্তু যেহেতু পানি ঢুকেছে সেহেতু দুএক বিঘে জমির মালিককেও পানির জন্য টাকা গুনতে হলো। একদিকে খালে খালে ভরে উঠলো বাংলার সমান জমিগুলো। আরেকদিকে খণ্ড খণ্ড হতে থাকলো এমনিতেই খণ্ড হয়ে থাকা জমি। বেহাত হতে থাকলো ছোট ছোট জমির টুকরোগুলো। ফুড ফর ওয়ার্ক বা কাজের বিনিময়ে খাদ্যের নামে তিনি চালু করলেন বাস্তবে চালু করলেন খয়রাতি সাহায্য। আর এর মাধ্যমে দেশে ঢুকলো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আর দখল করা শুরু করলো চাষের জমি। বন্ধাবীজ দিয়ে, কীটনাশক দিয়ে, কারিগরি সহায়তার নামে বাঁধের মধ্যে ফেলে চাষীর জমি কর্পোরেট থাবায় ফেলেছে। একদিকে প্রচুর টাকা গেলো গ্রামের ধনী কৃষকের হাতে আরেকদিকে সেই টাকায় গরিব চাষীগুলো তাদের খণ্ড খণ্ড জমিগুলো হারালো। আর চাষী আসতে লাগলো শহরে, বস্তিতে, রেল লাইনের ধারে। যা আজও অব্যাহত।
আর পরে এরশাদের সময় কাচা টাকার মালিকেরা একেকজন মধ্যসত্ত্ব ভূগির পালন করতে গিয়ে কৃষকদের করেছেন আরও নিঃস্ব। যে ভেন্ডি শহরে ১০০ টাকার উপরে বিক্রি হয় তা আমার কৃষক মধ্যসত্ত্ব ভূগির কাছে বিক্রি করে মাত্র ২৫-৩০ টাকায়। যা এখনও বিদ্যমান।
আর ধানের সময় সরকার নিয়ম করে সরকার নিজে ধান সংগ্রহ করে খোলা বাজারে বিক্রি করবে। কৃষক ভাবে হয়তো সে এবার টাকাটা ঠিক পাবে কিন্তু বাস্তবে সরকার তার ফলানো ফসল নিয়ে তাকে স্লিপ দেয়। আর বহুদিন পর বহু ঘোরাঘুরি করে সেই স্লিপ ভাঙিয়ে সে টাকা পায়। আর তার জন্য তাঁকে মেম্বার, চেয়ারম্যান, টাউট-বাটপারদের কমিশন দিতে হয়। আমার কৃষককে সার, কীটনাশক, বীজ, কিনতে হয় সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে, কিন্তু সে ফসল বেচতে গিয়ে বাজারদরের কথা তুলতে পারে না।
সেই সাথে কৃষিতে কর্পোরেট পুঁজির অনুপ্রবেশের কারনে ট্রাক্টর, মেশিন, শ্যালো, সেচ, যান্ত্রিকায়ন, আধুনিকায়ন, অধিক ফলন, হাইব্রিড, মোবাইল,ক্ষুদ্রঋণ,ব্যাংকঋণ এখন কৃষকের কাছে আরেকটি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এনজিও আর ব্যাঙ্কের ক্ষুদ্র-মাঝারি ঋণের টাকা শোধ করতে কৃষক যেমন তার ফসলের প্রায় পুরোটা বিক্রি করে ঠিক তেমনি মিডিয়ায় কৃষক বিপ্লব দেখানো লোকদের মাধ্যমে হাইব্রিড বীজের ফলে উৎপাদিত ফসল কৃষক দাম না পাওয়ার কারনে আজ কৃষক বেঁচেও অনেকটা মৃতের মতো অবস্থা।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে নিরাপদ খাদ্য মজুদ হিসেবে ধরে নেওয়া হয় ১০ থেকে ১২ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য। এসব থাকে সরকারের গুদামে। এই মজুদ নিরাপত্তা দেয় শহুরে নাগরিকদের । কৃষক এবং ক্ষেতমজুর এই নিরাপত্তায় পড়ে না। বতর, আকাল, মঙ্গা যাই হোক না কেন ক্ষেতমজুরকে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামেই খাদ্য কিনতে হয়। কৃষক, ক্ষেতমজুর যখন বাজার দরে খাদ্য কেনে তখন সরকারের বিভিন্ন বাহিনীকে বরাদ্দ দেওয়া হয় নামমাত্র মূল্যে। চার-পাঁচ টাকা কেজি দরে। তারা তাদের সারা মাসের খোরাক পায় আড়াইশ থেকে ৩০০ টাকায়। মজুরকে খরচ করতে হয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। ধনীদের জন্য কেজি ৩০ টাকায়ও ক্ষতি নেই, কারণ সরকার ৩০ টাকা জোগানোর ব্যবস্থা করে দেয়। বাজারমূল্য অসম্ভব বেড়ে গেলে শ্রমিক বা অন্যান্য ক্ষুদ্র পেশার গতরখাটা মানুষগুলোও শ্রমবাজার বাড়িয়ে নিতে পারে। কৃষক পারে না। চার থেকে সাড়ে চার কোটি ক্ষেত মজুর বছরের অর্ধেক সময় বেকার। দিনের অর্ধেক সময় অনাহারি। তাদের বাজারমূল্যের সঙ্গে শ্রমমূল্য বাড়িয়ে নেওয়ার, মানিয়ে নেওয়ার সুযোগই নেই।
৯০এ দেশের জাতীয় রাজনীতিতে স্বৈরাচার পতন হলেও বাস্তবে কৃষিতে স্বৈরাচারের কোন পতন হয়নি। আমরা একদিকে দেখেছি হাইব্রিড বীজের মাধ্যমে হাজার হাজার প্রান্তিক চাষিকে ক্ষতিগ্রস্থ হতে, কৃষকের হাহাকার আর বুক চাপড়াতে। দেখেছি সারের জন্য কৃষককে আত্মহত্যা করতে আবার দেখেছি সরকারি তামাশার কারনে কৃষকের নিজ হাতে কষ্ট করে উৎপন্ন করা পণ্যকে পানিতে, রাস্তায় ফেলে দিতে। যেই ফসল উৎপন্ন করে কৃষকের মুখে হাসি ফুটার কথা সেই কৃষকই হয়েছে তার কান্নার কারণ।
তাই সবশেষে বলতে চাই আমরা তরুন প্রজন্মের কথা, সকলের শিক্ষার অধিকারের কথা, শ্রমিকের কথা যতই বলি না সব কিছুই ম্লান হয়ে যাবে যদি না আমরা কৃষকের কথা না বলি। কারণ এ সকল কিছু তখনই ঠিক থাকবে যখন আমার কৃষক তার ফসল ঠিক মতো ফলাতে পারবে। জীবন বাঁচানো থেকে শুরু করে অধিকারের আন্দোলন সব কিছুই খাদ্যের উপর নির্ভরশীল। আর কৃষকরা না বাঁচে খাদ্যও উৎপাদিত হবে না আমাদেরও সহজে খাবার জুটবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে শুরু বড় নেতা, আমলা, ব্যবাসায়ী সবাইকে আজ কৃষকের অধিকার দিতে হবে। এখন জায়গায় কৃষকদের সংগঠিত করে সমবায়ের মাধ্যমে কৃষকদের ন্যায্য মূল্য দিতে হবে, ভূমি সংস্কারের প্রশ্নকে সামনে আনতে হবে। তবেই আমাদের কৃষক বাঁচবে, দেশ সমৃদ্ধ হবে। একটা কথা সকলের মনে রাখা প্রয়োজন,
" কৃষকই সভ্যতা গড়ার প্রথম ও মুখ্য কারিগর "
মোহাম্মাদ রাসেল আহমেদ
প্রবাসী লেখক, ফ্রান্স
©somewhere in net ltd.
১|
২৭ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৯:৪৮
খেলাঘর বলেছেন:
আপনি ভুল জায়গায় এসে কথা বলছেন; এখানে সিনেমা রিভিউ নিয়ে লিখতে হয়।