নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অন্ত্যজ বাঙালী, আতরাফ মুসলমান ...

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান।রবীন্দ্রনাথ

ইমন জুবায়ের

জীবন মানে শুধুই যদি প্রাণ রসায়ন/ জোছনা রাতে মুগ্ধ কেন আমার নয়ন। [email protected]

ইমন জুবায়ের › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প: ছোট ঘরে অনেক আলো

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:১২

মায়ের কথা শুনে আমার ভ্রুঁ কুঁচকে উঠল। চায়ের কাপটা নিয়ে কম্পিউটার টেবিলের ওপর রেখে সাবধানে জিজ্ঞেস করলাম, কেন ভাইয়া তোমাকে কিছু বলেছে?

কিছু না বলে মা চুপ করে থাকল। আজ অফিস থেকে ফেরার পর মা আমার ঘরে চা নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল: তুই তো চাকরি করিস। চল, আমরা অন্য বাসায় চলে যাই।

বাবা মারা যাবার পর বড় ভাইয়ের সঙ্গেই আছি। কখনও আলাদা হতে হবে ভাবিনি। হঠাৎই আমার মনে পড়ল, ক’দিন আগে শান্তা ভাবী বলছিল: তোমার বড় ভাইয়ের চট্টগ্রাম পোস্টিং হয়ে যাচ্ছে। তোমরা কি করবে? তোমার অফিস তো ঢাকায়। ভাইয়া একটা বাইং হাউজে জব করে। ভাইয়ার কি চট্টগ্রামে পোস্টিং হবে? সত্যমিথ্যা জানি না। ভাবী ইঙ্গিত দিলেন: ওখানে দু’রুমের কোয়ার্টার। বুঝতেই পারছ। যা বোঝার ছিল বুঝলাম। মাকে বললাম, তুমি কিছু ভেব না মা। যা করার আমি করছি।

অফিস শেষ করে বাসা দেখছি। বাসা মিলল কল্যানপুর। পুরনো একটি চারতলা দালানের তিন তলা। দু’রুমের ফ্ল্যাট। ভালোই হল। নতুন বাসাটা অফিসের কাছেই। হেঁটেই যাওয়া যাবে। কনভেন্সের টাকা বাঁচল। মাঝেমাঝে দুপুরে এসে খেয়ে যেতে পারব।

শিফটের আগের দিন ভাবীরা বাজিতপুর গেল। ভাবীর বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। মাকে গম্ভীর দেখাল। তবে মনে হল খুশি হয়েছে মা। রাকাকে মিস করবে। ভাইয়ার বড় মেয়ে রাকা ক্লাস এইটে পড়ে। মায়ের সঙ্গে অন্যরকম একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে রাকার।

দু’রুমের ফ্ল্যাট। আলাদা বসার ঘর নেই। রান্নাঘর ছোট। টিভি কিনতে পারিনি। আক্ষেপ নেই। পয়সা জমাচ্ছি। তবে টিভির আগে একটা ফ্রিজ কেনা জরুরি। বাবার একটা সাদাকালো ছবি মার ঘরে টাঙ্গালাম। ছবিটার মার প্রিয়। মায়ের প্রিয় আশ্রয়। বাবা হঠাৎ করেই মারা যান স্ট্রোকে।আমি তখন কলেজে পড়ি। ভাইয়া চাকরিতে ঢুকেছে। ঈদের দিন আজীমপুর কবরস্থান যাই। মাকে নিয়েও কখনও যেতে হয় বাবার কবরে।

মালপত্র ওঠানো সময় পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন উঁিক ঝুঁকি দিল। চোখে ছোট কালো ফ্রেমের চশমা, সবুজ ওড়না আর সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ পরা শ্যামলা মতন মিষ্টি দেখতে সপ্রতিভ চেহারার একটি মেয়ে এসে মাকে বলল, খালাম্মা। আমার নাম শ্যামলী। আমরা আপনাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকি। কোনও কিছুর দরকার হলে বললেন।

আচ্ছা। বলব মা।

পরে জানা গেল শ্যামলী ইডেনে পড়ছে। আমার মনে নতুন সম্ভাবনা উঁকি দিল।

নতুন এলাকায় নতুন প্রতিবেশীর ভূমিকা বড় হয়ে উঠতে থাকে। তারপর যা হয়। ভাইয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে আসতে লাগল। রাকার জন্য মায়ের মন খারাপ। মাঝেমাঝে ফোনে কথা বলে। ফোন করে আমিই কথা বলিয়ে দিই।মা কেন যেন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। শ্যামলীর মা রওশন চাচী; ঠিকে ঝি ঠিক করে দিলেন মহিলা। সকালে এসে দুঘন্টা কাজ করবে। রান্নাবান্না যা হয় করা যায়, কিন্তু এঁটো বাসনকোসন ধোওয়াই ঝামেলা। ফরসা গোলগাল চেহারা রওশন চাচীর । বেশ আলাপী । আমি এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত। আমি অফিস গেলে মা সারাদিন একা থাকে। রওশন চাচীর সঙ্গ পাবে। শ্যামলীর বাবা রফিকুল ইসলাম। ইর্স্টান ব্যাংকে চাকরি করেন ভদ্রলোক। দেখা হলেই বলেন, কী মিঞা ভালো তো? কুনু অসুবিধা হইলে বইল।

সব গুছিয়ে নেওয়ার পর মা বলল, সবই ভালো। তবে সমস্যা একটাই।

কী?

তুই বিয়ে করলে আমাকে এখান থেকে পাততাড়ি গুটাতে হবে ।

কেন?

আমি থাকলে এত ছোট ঘরে বউ নিয়ে সুখি হবি না।

উহ্ মা। বাদ দাও তো এসব। আমি ক্ষেপে ওঠার ভান করি।

মা হাসে।

দেখ আমি বিয়েই করব না। আমি বলি।

কী চুল রে মেয়ের। মা বলে।

কার কথা বলছ? আমি অবাক হওয়ার ভান করি।

কার আবার? শ্যামলীর।

তো, আমাদের ছোট ঘরে যথারীতি শ্যামলীও আসে । ভীষন সেজে আসে। যদিও একটু অড লাগে। আমি মনে মনে বলি, মেয়ে তুমি এমনিতেই সুন্দর। তুমি এলে আমাদের ছোট ঘরে অনেক আলো জ্বলে ওঠে। তোমাকে বেশি বেশি সাজতে হবে না। পারফিউমের মিষ্টি সুগন্ধ ছড়িয়ে আসে শ্যামলী; হাতে কখনও থাকে নিজের হাতে রান্না করা পায়েস কি তরকারীরর বাটি। খেয়ে প্রশংসা করতেই হয়। মায়ের রান্না নাকি ভালো। রান্না শিখবে মায়ের কাছে। আর আমিও নাকি ইংরেজিতে ভালো। সমাজবিজ্ঞানের কয়েকটা টপিকস যেন ওকে দেখিয়ে দিই নিরিবিলি।

অবসর সময়ে আমি ও মা বসে গল্প করি। কখনও মা বলে, বীণা শ্বশুর মারা গেলেন। জামাই বাবাজী একটা খবরও দিল না।

আমি ক্ষেপে উঠে বলি, বাদ দাও তো মা; যারা সম্পর্ক রাখতে চায় না। তাদের কথা বলে কি লাভ।

আমার বড় বোন বীণা আপার বিয়ে হয়েছে বাবা বেঁচে থাকতে। আগারগাঁও থাকে বীনা আপারা। বীণা আপার বর ফিরোজ দুলাভাই খানিকটা অদ্ভুত মানুষ। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান না। মাঝেমাঝে অবশ্য বীণা আপার সঙ্গেফোনে কথা হয় মার ।

মা কখনও বলে, কাল রাতে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম রে মিলন।

কি?

দেখলাম আমাদের বাড়ির পিছনের বাঁশঝাড়েরর কাছে আব্বা দাঁড়িয়ে আছেন।

ও। মা প্রায়ই স্বপ্নে দেখা বড়গ্রাম এর কথা বলে। আমার নানাবাড়ি বড়গ্রাম। জায়গাটা মুক্তাগাছা উপজেলা। মায়ের মেয়েবেলা বড়গ্রামে কেটেছিল। তারপর শহরে চলে আসে। আজও ভুলতে পারেনি মেয়েবেলার বড়গ্রামের ভায়া বিল ও আইমন নদীর কথা।

শ্যামলীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা দিনদিন রোম্যান্টিক হয়ে উঠতে থাকে। কলেজের পর ও মিস কল দেয়; আমি জাভেদ ভাইকে বুঝিয়ে সুজিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে আসি। তারপর কখনও বসুন্ধরা কখনও আইডিবি ভবন কখনও চাইনিজ রেস্তোঁরা কখনও বা রিক্সায় করে শ্যামলীর সঙ্গে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করি। আমি টের পাই, আমাদের সম্পর্কে মায়ের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় আছে। তবে মায়ের মুখ যে দিনদিন গম্ভীর হয়ে উঠছিল আমি তখনও খেয়াল করিনি। একদিন মা বলল, শ্যামলীকে আমারও ভালো লাগে রে মিলন।

আমি কী বলব। আমি চুপ করে থাকি।

মাঝেমাঝে মা বলে, কাল তোর ছুটি। চল, কাল মোহম্মদপুর যাই। আঞ্জুকে কতদিন দেখি না।

চল। বললাম। মোহম্মদপুরের নূরজাহান রোডে মায়ের এক খালাত বোন থাকেন। আঞ্জু খালা। মা কে নিয়ে মাঝেমাঝে নূরজাহান রোড যাই। আঞ্জু খালার ওপর আমার কিছু অভিমান আছে। আঞ্জু খালার এক মেয়ে আছে। রুপা। সিকদার মেডিকেলে পড়ে রুপা । গতবছর রুপার সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল মা । আঞ্জু খালা রাজী হয়নি। আমার মা খুব সহজ সরল। চাইনিজ ফ্রিজ আর এয়ারকুলারের শোরুমের সেলসম্যানের সঙ্গে যে ডাক্তারি পড়া মেয়ের বিয়ে এ সমাজে সহজে হয় না কিংবা হওয়া উচিত না - এসব নিত্যদিনের জটিলতা একেবারেই বুঝতে চায় না মা । মার এই অবুঝপনার জন্যই মায়ের প্রতি আমার যত টান।

একদিন সন্ধ্যাবেলা গভীর অস্বস্তি আর টেনশন নিয়ে অফিস থেকে ফিরলাম।

সেদিন দুপুরেই আগেই হেড অফিস থেকে খবর এল প্রতিষ্ঠানের মন্দা ভাব কাটছে না, কর্মী ছাঁটাই হবে। খবরটা শুনে খুব টেনশনে পড়ে যাই। তালিকায় আমার নাম আছে কিনা জানতে পারিনি। টেনশন কমাতে শ্যামলীকে ক’ বার ফোন করলাম। ওর ফোন বন্ধ পেলাম। শ্যামলী ফোন বন্ধ রেখেছে কেন? দুদিন হল শ্যামলীরা ফুলপুর গেছে। ফুলপুর জায়গাটা ময়মনসিংহ । বছরে বেশ ক’বার যায়। রফিক চাচার মোবাইল নম্বর আমার কাছে আছে। চাচাকে ফোন করা কি ঠিক হবে?

কলিংবেল চাপলাম। অনেকক্ষণ পরও ভিতর থেকে কেউ দরজা খুলল না। কি ব্যাপার-মা গেল কই? বাথরুমে নাকি? আমার কাছে এক্সট্রা চাবি থাকে। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলাম। সারা ফ্ল্যাট সুনসান করছে। মাকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। মা গেল কোথায়? বুকের ভিতরে ধড়াস ধড়াস করছে। হাত কাঁপছে। পায়ে শক্তি পাচ্ছি না। মাথা কাজ করছে না। শ্যামলীরা ফুলপুরে, ওদের ফ্ল্যাটে তো যাওয়ার কথা না। তা হলে? আমি জানি মা ভাইয়াদের ওখানে যাবে না। ভাইয়া মনে হল অফিস থেকে ফেরেনি। ভীষন উৎকন্ঠা নিয়ে শান্তা ভাবীকে ফোন করলাম। ভাবী? মা কি তোমাদের ওখানে? আমার গলা কাঁপছে।

শান্তা ভাবী বলল, না তো।

আমার বুকটার ভিতরে বিস্ফোরন ঘটে। মা গেল কই? আমার মা গেল কই? হঠাৎ বীণা আপার মুখটা ফ্ল্যাশ করল। মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে হয়নি তো মায়ের? কাঁপা কাঁপা হাতে বীণা আপাকে ফোন করলাম। সব শুনে বীণা আপা বলল, না তো। আমরা বাসা বদলেছি। মার তো আমাদের নতুন বাসা চেনার কথা না।

ওহ! আমি ফোনটা অফ করে দিলাম। ভীষণ অসহ্য লাগছে। আঞ্জু খালা কে ফোন করব কিনা ভাবলাম । করলাম। আঞ্জু খালা বললেন, না তো। তোর মা তো আমার এখানে আসেনি।

তা হলে মা গেল কোথায়? ফাঁকা ফ্ল্যাটে অসহ্য লাগছিল আমার। নিচে নেমে এলাম। নিচে নামতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। লোড শেডিং। গলিতে আবছা অন্ধকার। কই যাই? কী করি? ভীষণ দিশেহারা লাগছে। টের পেলাম সারা শরীর ঘেমে গেছে। চাকরির পর সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলাম। আজ অনেকদিন পর ঘোরের মধ্যে এক প্যাকেট সিগারেট কিনলাম গলির দোকান থেকে । অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে থাকি। অনেক দিন পর ধোঁওয়া গিলছি বলে কাশি হল। কাশতে কাশতে হাঁটছি। কিন্তু, মা গেল কোথায়? মোবাইল ফোন ইউজ করে না মা। কতবার বলেছি, শেখাতে চেষ্টা করেছি-এখন আমাকে টেনশনে ফেলল। উৎকন্ঠার সঙ্গে ক্রোধ টের পেলাম। অফিসে কর্মী ছাঁটাই হবে-সেই উদ্বেগ। মা গেল কোথায়? বড়গ্রাম গেল কি? মায়ের বাবার বাড়ি? আমাকে না বলে বলে মা বড়গ্রাম যাবে? কি এত দুঃখ আমার মায়ের? কি এত অভিমান? আমার সুখের জন্য মা ঘরছাড়া হল না তো মা? ভাবতেই প্রবল এক অপরাধবোধ গ্রাস করল আমাকে । মায়ের একটা কথা মনে পড়ল: তুই বিয়ে করলে আমাকে এখান থেকে পাততাড়ি গুটাতে হবে । সন্তানের সুখের জন্য নিজেকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিল। মা বলেই? আমার মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ঠ হচ্ছে। এখন যদি শ্যামলী পাশে থাকত। শ্যামলীর সঙ্গে আমার কথা বলা দরকার। অনেকটা মরিয়া হয়েই রফিক চাচাকে ফোন করলাম। রফিক চাচা বললেন, কেমন আছ বাবা?

জ্বী চাচা ভালো আছি। আপনারা ভালো? আমার নিজের কন্ঠস্বর আমার কানে কর্কস শোনাল।

রফিক চাচা বললেন, হ বাবা আমরা ভালো। দোওয়া কইর মিলন। শ্যামলীর বিয়া ঠিক হইছে। বজলুর রহমান ছেলে ভালো। ফলের ব্যবসা করে। রামপুর গঞ্জে মোকাম আছে। তোমার বোন ভালো থাকব বাবা।

ফোনটা আমার হাত থেকে খসে পড়ে গেল মনে হল। চারিদিকে ভূমিকম্প টের পাচ্ছি আমি । টের পাচ্ছি আমার পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। আমার ঘনঘন দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ছে। বুকের বাঁ পাশে চিনচিনে ব্যথা। হাঁটতে হাঁটতে গলি ছেড়ে কখন বড় রাস্তায় উঠে এসেছি। ফুটপাতে ভিড়। রাস্তায় যানযট। পেট্রোলের গন্ধ-অসহ্য একটা শহর। অচিরেই ভূমিকম্প হবে। তখন আমি খুশি হব।

মোবাইল ফোনটা বাজল। বীণা আপা। মার খবর পেলি?

না।

বলিস কী! কোনও খবর পেলে জানাস কেমন?

জানাব।

সন্ধ্যার রাস্তায় অনেকক্ষণ হাঁটার পর টের পেলাম আমার ভিতরের আবেগ অনুভূতিগুলি সব ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যাচ্ছে। শ্যামলীর মুখটার ওপর মায়ের মুখ ভেসে উঠল। মা কি বড়গ্রাম গেল? বড়গ্রাম রওনা হব? মহাখালি থেকে বাস ছাড়ে। মাকে কি সেখানে পাব? কি করব ভেবে পেলাম না। হঠাৎ আমার মনে হল ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তার গুঞ্জন গাড়ির হর্ণ মাথা জোরে জোরে আঘাত করছে। কারেন্ট এসেছে। মা?

গলিতে ঢুকতেই ফোন এল। আঞ্জু খালা। কি রে জাহানারার কোনও সংবাদ পেলি?

না।

কোনও খবর পেলে জানাস।

আচ্ছা, জানাব।

বাড়ির সামনে এসে বুকটা কেঁপে উঠল। মা। একটা সিএনজির দাঁড়িয়ে। ভাড়া মিটাচ্ছে। সিগারেট ধরিয়েছিলাম। সিগারেট ফেলে আমি প্রায় দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, মা, তুমি কই ছিলে?

মা বলল, বিকাল থেকে মনটা ভালো ছিল না রে। তোর বাবার কবরে গিয়ে মনটা শান্ত হল।

ওহ! মা তাহলে আজীমপুর গিয়েছিল।

আমার বুকটা তখনও ধকধক করছিল। শ্যামলীর বিয়ের কথাটা মাকে কী ভাবে বলি। মায়ের সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছি। ফোনটা বাজল। শান্তা ভাবী। জিজ্ঞেস করল, মা ফিরেছে?

হ্যাঁ।

তোমাদের নতুন বাসার ঠিকানা দাও তো।

দিলাম। আমার বুক ভীষণ কাঁপছে। শান্তা ভাবী আজ ফোন করল যে হঠাৎ। ঠিকানা চাইল। ভাবী কি আমাদের বাড়ি আসবে?

ঘরে ঢুকে মা বাথরুমে ঢুকল। গোরস্থানে গেছেন, কাপড় বদলাবেন।

কলিং বেল বাজল। দৌড়ে দরজা খুলে অবাক। বীণা আপা। পাশে লোপা। বীণা আপার বড় মেয়ে। ক্লাস এইটে পড়ে। কতদিন পরে দেখলাম লোপাকে। লোপা বলল, কেমন আছ মামা?

ভালো। আয়, ভিতরে আয়।

মা বাথরুম থেকে বেরিয়ে অবাক হয়ে গেল। বীণা আপা মাকে জড়িয়ে কান্না জুড়ে দিল। বীণা আপার বর ফিরোজ দুলাভাই মালয়েশিয়া গেছে। এই ফাঁকে এসেছে। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখছি লোপাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে মা । কলিং বেল বাজল। শান্তা ভাবী? দরজা খুলে দেখি আঞ্জু খালা। চশমা পরা মোটাসোটা শ্যামলা মহিলা। হাতে কমলার ঠোঙ্গা। বলল, তোর মা ফিরছে রে মিলন?

হ্যাঁ।

কমলার ঠোঙ্গা আমার হাতে দিয়ে আঞ্জু খালা বললেন, নে ধর। আমি তো টেনশনে শেষ।

কমলার ঠোঙ্গা নিয়ে আমি রান্নাঘরে আসি। আমার পিছন পিছন লোপাও এল। আমি লোপাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুই চা বানাতে পারিস?

লোপা বলল, পারি না আবার?

তাহলে বানা।

কলিংবেলটা বাজল। শান্তা ভাবী। দৌড়ে আবার দরজা খুললাম। হ্যাঁ। শান্তা ভাবীই। পাশে রাকা। রাকার হাতে খাবারের প্যাকেট। শান্তা ভাবী বলল, তোমার ভাই আজ চিটাগাং গেল। তাই ভাবলাম একবার দেখা করে যাই।

এসো। বলে সরে দাঁড়ালাম। আমার বুকের ভিতর কেমন যেন করছে। কতদিন পর সন্ধ্যাবেলায় আমাদের ছোট ঘরটা ঝলমল করছে। আড়াল থেকে ঈশ্বর দেখছেন। একবার কারেন্ট গিয়েছে। আজ আর যাবে না।

ঘরে মা বীণা আপা আঞ্জা খালা আর শান্তা ভাবী মিলে গল্প করছে। মহিলার একবার গল্প করতে বসলে হুঁশ থাকে না। আমি রান্নাঘরে ঢুকলাম। আমার পিছনে রাকা। লোপা মুখ তুলে বলল, হাই রাকা কেমন আছ তুমি?

ভালো। তুমি?

আমিও ভালো। লোপা বলল।

লোপার চা বানানো প্রায় শেষ। ছাঁকছে। আমাকে দেখে বলল, মামা, অনেকগুলি লোক, অতগুলি কাপ নেই যে। তাই গ্লাসে ঢালছি।

ঢাল। কালই কাপ কিনব। বললাম।

রাকা বলল, চাচ্চু তোমাকে কাপ কিনতে হবে না ।

কেন?

আর তিন দিন পর তোমার জন্মদিন। তোমার জন্মদিনে আমি কাপ গিফট করব।

আচ্ছা। করিস। আমার চোখ ভিজে ওঠে। ঈশ্বর যদি একবার শ্যামলীকে ফিরিয়ে দিতেন!

রাকা বলল, তুমি অনেক কষ্ট করেছ লোপা। দাও, এবার আমি করি। দাও আমি চিনি মিক্স করি।

করবে? কর। লোপা বলল।

আমি অবাক হয়ে দেখছি। এই জীবনকে আমি বুঝি না। কখন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বাঁক নেয়। কিছুই কি মানুষের নিয়ন্ত্রনে নেই? তা হলে? ইস্ এখন যদি শ্যামলীর থাকত। আমাদের ছোট ঘরটা আরও আলোয় ভরে উঠত। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আর ঠিক তখনই আমার ফোনটা বেজে উঠল। অপরিচিত নাম্বার। আমি জানি কে।

মন্তব্য ৪৪ টি রেটিং +১১/-০

মন্তব্য (৪৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:৩১

স্বপ্নকথক বলেছেন: ও ভাই, এইডা কি হৈল! ধুত! পড়তে পড়তে তো পড়েই যাচ্ছিলাম..মাগার এমনে আচমকা শেষ হৈলে কেমনে হৈব?


আপনে খুব খুব খুব ভালো লেখেন... আল্লাহ আপনার হায়াত দরাজ করুক।

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:৫২

ইমন জুবায়ের বলেছেন: =p~

২| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:৫২

শেখ মিনহাজ হোসেন বলেছেন: খুব ভালো ছিল। কিনতু হঠাত করে শেষ হয়ে গেল।

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:৫৩

ইমন জুবায়ের বলেছেন: তাই?

৩| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:১৭

সমুদ্র কন্যা বলেছেন: মুগ্ধ হয়ে পড়ছিলাম আর আপনি এমন হঠাৎই শেষ করে দিলেন?
এরপরে কি? এরপরে কি? শ্যামলীর ফোন?
কি হল বলেন।

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:২৮

ইমন জুবায়ের বলেছেন: হ্যাঁ। শ্যামলীর ফোন। কারণ ওর ফোনটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শ্যামলী অন্য একজনের ফোন থেকে ফোন করে।
ও এখান পালিয়ে আসছে ঢাকায়।
এমনই তো ভাবা যায়। আপনি কি বলেন?

৪| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:২০

রাজসোহান বলেছেন: অই মিয়া তাড়াতাড়ি বাকীটুক লেখেন। :-P :-P
না পারলে আমি থিম দেই :D :D আপনি লেখেন

শ্যামলী পালায়া আপনার কাছে আয়া পড়ছে......আর মা মাইন্যা নিছে

অহন লেখেন =p~ =p~

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:২৯

ইমন জুবায়ের বলেছেন: আসলে তাইতো ঘটবে। এত আলো যখন ছোট ঘরে। ;)

৫| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:৫৬

সব্যসাচী প্রসূন বলেছেন: যথারীতি ভাল লেগেছে ... তবে এবারের ধরণটা অন্য রকম সংলাপ ভিত্তিক ... আপনার বেশির গল্প বর্ণনাধর্মী হয়ে থাকে :)

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৫:০০

ইমন জুবায়ের বলেছেন: হুমম।

৬| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৫:০৬

অপ্‌সরা বলেছেন: শ্যামলী তাড়াতাড়ি চলে আসুক!!!!

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৫:১৮

ইমন জুবায়ের বলেছেন: আসবে।

৭| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:২৬

আকাশ_পাগলা বলেছেন: পোলার চাকরী কী চলেই গেল?
তাইলে বস সব শেষ।
ভাত ছাড়া আলো দিয়া দুনিয়া ঘুরবে না।
শ্যামলীকে নিয়ে তখন আরেক বিপদে পড়বে।

গল্পটা ভাল হইছে।
ফ্লো টা এত সুন্দর, পড়তে পড়তে শেষ যে হয়ে গেল বুঝলামই না।
++

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:২৮

ইমন জুবায়ের বলেছেন: পোলার চাকরি গেল কি না তা আগামীকাল বোঝা যাবে। চাকরি গেলে সমস্যা নাই; ভাবী আইসা পড়ছে; বড় ভাইয়ের বাইয়িং হাউজে এবার জব হয়ে যাবে।;)

৮| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৪৫

নীরজন বলেছেন: এত কষ্টের গল্প কেন লিখেন :(

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৫০

ইমন জুবায়ের বলেছেন: /:)

৯| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৮:২১

পল্লী বাউল বলেছেন: আচমকা শেষ হয়ে গেছে বলেই হয়তো বেশী ভাল লেগেছে।
ছোটগল্পের মজাটা পাওয়া গেছে পুরোপুরি।
+++

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৮:২৫

ইমন জুবায়ের বলেছেন: অনেক ভালো লাগল চমৎকার মন্তব্যে।

১০| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৮:২৫

জেরী বলেছেন: বরাবরই আপনি অনেক ভালো গল্প লিখেন ভাইয়া। এত প্রশংসা করে কমেন্টস করতে পারি না বলে শুধু +++ বলে যাই :(

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৮:২৬

ইমন জুবায়ের বলেছেন: সুন্দর কমেন্টে অনেক ভালো লাগছে।

১১| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৮:২৯

প্রণব আচার্য্য বলেছেন: চমৎকার লাগলো

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৮:৪৭

ইমন জুবায়ের বলেছেন: তাই?

১২| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৯:২৭

তায়েফ আহমাদ বলেছেন: অপরিচিত নাম্বার। আমি জানি কে।

খালি আপনি জানলে তো হবে না! আমাদের ও জানতে হবে।

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৯:৩৭

ইমন জুবায়ের বলেছেন: শ্যামলীর ফোন। কারণ ওর ফোনটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শ্যামলী অন্য একজনের ফোন থেকে ফোন করে।
ও এখান পালিয়ে আসছে ঢাকায়।
এমনই তো ভাবা যায়। আপনি কি বলেন?

১৩| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১০:১২

ভাঙ্গন বলেছেন: জেরী বলেছেন: বরাবরই আপনি অনেক ভালো গল্প লিখেন ভাইয়া। এত প্রশংসা করে কমেন্টস করতে পারি না বলে শুধু +++ বলে যাই :(
...........
আমিও!

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১০ সকাল ৭:১২

ইমন জুবায়ের বলেছেন: ভালো।

১৪| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:৩৭

তাজা কলম বলেছেন: এক নিশ্বাসে পড়লাম। আশা করছি ফলওয়ালার পোলার সাথে শেষটায় শ্যামলীর বিয়ে হবে না, ও থেকে যাবে মিলনেরই কাছে।

আপনাকে +

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:৫৭

ইমন জুবায়ের বলেছেন: শেষ লাইনে সেরকম হওয়ার ইঙ্গিত আছে।
আপনাকেও ধন্যবাদ।

১৫| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:১৮

রেজোওয়ানা বলেছেন: গল্পটা কি শেষ হয়ে গেল, না আরেকটা পর্ব আছে?

আগের তিনটা গল্প মিস করে ফেললাম কিভাবে? আমাকে মাইনাস।

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:২৭

ইমন জুবায়ের বলেছেন: এরপরও আরেক পর্বের দরকার?

আমাকে মাইনাস? বেশ।
চেনা দরজায় কড়া নাড়ে না। কার দোষ?

১৬| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৩৫

গুরুজী বলেছেন: দারুন হয়েছে। ইস, আমার যদি এরকম হত! শেষে হলেও যদি শ্যামলীর ফোনটা আসত ;(

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:১৮

ইমন জুবায়ের বলেছেন: আপনারও হবে। শেষে তো শ্যামলীর ফোনই এল!

১৭| ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৮:১৮

নীল ভোমরা বলেছেন: শুভাশীষ রইল। গল্পটা ভাল লাগলো। শ্যামলী পরিবহনের ফুলপুর-ঢাকা লাষ্ট বাসটা ঢাকায় এসে কখন যে পৌঁছায়?! আশা করি সে ফিরবে শীঘ্রই!

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ৮:৪৪

ইমন জুবায়ের বলেছেন: এরই মধ্যে শ্যামলী ফিরে এসেছে আলোকিত ঘরে ...

১৮| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১২:২৪

দীপান্বিতা বলেছেন: সুন্দর লাগল :)

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১০ সকাল ৭:৩১

ইমন জুবায়ের বলেছেন: =p~ =p~

১৯| ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১০ সকাল ১১:৪৭

শ্রাবনসন্ধ্যা বলেছেন: আলোর গল্প পেলাম.....ভাল লাগল।

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১০ দুপুর ১২:৪০

ইমন জুবায়ের বলেছেন: আলো আসবেই।

২০| ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:৩৯

সাপ্নিক বলেছেন: ভাইয়া, আমার যখন খুব খারাপ লাগে নিজেকে খুব একাকী মনে হয় তখন আপনার ব্লগে ঢুঁ মারি, নিমিষেই বেঁচে থাকার রসদ পেয়ে যাই, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এত সুন্দর গল্প আমাদেরকে উপহার দেওয়ার জন্য।

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ৮:০৩

ইমন জুবায়ের বলেছেন: Great indeed!

২১| ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১০:০৮

তারার হাসি বলেছেন:
আমি জানি কে, কি বলবে তাও জানি... নিঃশব্দের ভাষা, ভালবাসার ভাষা।

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১০ ভোর ৬:৫৪

ইমন জুবায়ের বলেছেন: হ্যাঁ।

২২| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:১৮

সামছা আকিদা জাহান বলেছেন: আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভূবন ভরা----

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:৪৪

ইমন জুবায়ের বলেছেন: আলো আলো আলো

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.