![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
I am a social worker.
বি.এইচ.মাহিনী : আজ যা বর্তমান কাল তা ইতিহাস। ইতিহাস-ঐতিহ্যই একটা জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ। কিছু প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য আমরা হেলায় হারিয়ে ফেলি। আর পরে সে হারানো ঐতিহ্যের জন্য আফসোস করি। সংস্কারের মাধ্যমে এসকল হারানো প্রায় প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারি আমরা। এমনই একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন ‘১১ শিবমন্দির’। শিবমন্দিরটি অভয়নগর উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের অভয়নগর মৌজায় অবস্থিত। যশোর থেকে প্রায় ৪০ কি.মি. পূর্ব-দক্ষিণে ও খুলনার ফুলতলা উপজেলার পায়গ্রাম কসবা থেকে মাত্র দু’ মাইল উত্তরে ভৈরব নদীর তীরে অভয়নগর গ্রাম, আর এ গ্রামেই ১১শিব মন্দির অবস্থিত। ভাটপাড়া ঘাট পার হলে মাত্র পাঁচ টাকার পথ ১১ শিবমন্দির। অন্যদিকে নওয়াপাড় থেকে রাজঘাট হয়ে জেজেআই জুট মিল ঘাট পার হলেই মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ হাঁটলেই চোখে পড়বে নয়নাভিরাম এ মন্দিরের। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৪৫ সাল থেকে ১৭৬৪ সালের মধ্যে যশোরের চাঁচড়ার রাজা নীলকণ্ঠ রায় এই ১১ শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সেই হিসাবে মন্দিরগুলোর বয়স ৩শ’ বছরের বেশী। শিবমন্দিরের পাশেই ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে অভয়নগর থানাভবন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, অঞ্চলটি চাঁচড়ার রাজা নীলন্ঠের কন্যা ‘অভয়া’র সম্পত্তিভুক্ত করে দেয়া হয়েছিল বলে এ অঞ্চলের নাম করণ হয় ‘অভয়নগর’। বর্গীদের সম্ভাব্য আক্রমণ হতে নিরাপদে থাকার জন্য রাজা নীলকন্ঠ ধুলগ্রামে দ্বাদশ শিবমন্দির ও ১টি কালীমন্দির এবং দেওয়ান হরিরাম মিত্রের বসবাসের জন্য অভয়নগর মৌজায় একাদশ শিবমন্দির বিশিষ্ট একটি বিশাল বাড়ি নির্মাণ করেন। ঘটনাচক্রে বর্গীদের হামলার আশঙ্কা তিরোহিত হয়ে যাওয়ায় ধুলগ্রামের রাজবাড়িতে নীলকন্ঠের বসবাস নিষ্প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। চাঁচড়ার রাজা নীলকন্ঠের দেওয়ান হরিরাম মিত্র ধুলগ্রামের দ্বাদশ শিবমন্দির বিশিষ্ট বাড়িতে বসবাস করার অনুমতি পান। ইতোমধ্যে নীলকন্ঠের কন্যা ‘অভয়া’ বিধবা হয়ে রাজবাড়িতে ফিরে আসেন। তিনি ছিলেন শিবভক্ত। কন্যার অনুরোধে রাজা অভয়নগরে ধর্মকর্মের জন্য একাদশ শিবমন্দির, একটি বাড়ি ও সংলগ্ন অঞ্চল ‘অভয়া’র সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করেন। ১১টি শিব মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন ১১টি কষ্টি পাথরের শিবলিঙ্গ। এছাড়া বিভিন্ন প্রকারের দেব দেবীদের জন্য আলাদা আলাদা মন্দিরও স্থাপন করেন রাজা নীলকন্ঠ রায়। কথিত আছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরালয় খুলনার ফুলতলার জমিদারদের সাথে এই অভয়নগরের ‘অভয়া’ দেবী ও তার শ্বশুর কুলের আতœীয়তার সম্পর্ক ছিলো। এখানে পৃথিবীর বহু দেশের নামিদামি লোকের আনাগোনা ছিলো। মন্দির এলাকার বেশ কিছু জমি ইতিমধ্যে বেহাত হয়ে গেছে। চুরি আর লুটপাট হয়ে গেছে মন্দিরের প্রতœতাত্বিক নিদর্শন শিবলিঙ্গসহ মূল্যবান বহু মালামাল। ধ্বসে পড়ছে ইট-সুরকি। এক সময় এখানে প্রতিদিন জমজমাট পূজা হতো, মেলা বসতো। পূজা-অর্চনার পর অবশিষ্ট ভোজ গরিব ব্রাহ্মনদের মাঝে বন্টন করা হতো। বাঘুটিয়া ইউনিয়নের অভয়নগরে অবস্থিত অভয়া’র বসতবাটি ভেঙে গেলেও শিবমন্দিরগুলো এখনও প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে গৌরবম-িত অবয়বে দাঁড়িয়ে রয়েছে আজো। সনাতন ধর্মের ভক্তরা কোনক্রমে একটি মন্দিরে এখনো জোড়া তালি দিয়ে নিত্য পুজা দিয়ে আসলেও সেটিও যে কোন সময় ধ্বসে দূর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশংকা অভয়নগর গ্রামের মানুষের। দেশের অনন্য স্থাপনা অভয়নগরের ১১ শিবমন্দির রক্ষা করতে পারলে তা হবে এ অঞ্চলের একটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। সনাতন ধর্মের পাশাপাশি সাহিত্য ও ইতিহাসের তথ্য সন্ধানী মানুষেরা এখান থেকে জানতে পারবেন যশোরের রাজা-রানীদের ইতিহাস-ঐতিহ্য।
একাদশ শিবমন্দিরের মধ্যে উত্তর পাশের মন্দিরটি সবচেয়ে বড়। পূর্ব সারিতে রয়েছে ৪টি ও পশ্চিম সারিতে দৃশ্যমান ৪টিসহ মোট ৮টি এবং সদর তোরণের দুইপাশে দুটি মন্দির নিয়ে মোট ১১টি মন্দির। সংস্কারের অভাবে ক্ষয়মান মন্দিরগুলো, তা সত্ত্বেও কালের সাক্ষী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে অতীত গৌরবের বিমূর্ততায় এ প্রাচীন মন্দিরগুলো । ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি ব্যাসের বড় মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ২৪ ফুট ৪ ইঞ্চি ও প্রস্থ ২২ ফুট ৩ ইঞ্চি। স্থানীয় বয়োবৃদ্ধ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রাচীর বেষ্টিত মন্দিরের উত্তর-পশ্চিম কোনে একটি জলাশয় ছিল। মন্দিরের সামনের দেয়াল অতিসুন্দর পোড়ামাটির চিত্রফলক দ্বারা অলংকৃত ছিল। মন্দিরগুলোর অপূর্ব বিন্যাস এখনো স্মরণ করিয়ে দেয় কোনো কুশলী হতের কথা। বিদ্যমান মন্দিরগুলোর অনিন্দ সুন্দর কারুকাজের দিকে তাকালে এখনো মন হারিয়ে যায়, চোখ জুড়ায়। অরক্ষিত হলেও প্রাচীরবেষ্টিত মন্দিরগুলোর নির্মাণশৈলী ও কুশলী অবস্থান যেমন আকর্ষণীয় তেমনি ভাবগম্ভীর। মন্দিরে পুরনো জৌলুস দৃশ্যমান না হলেও মন্দিরগুলোর খাড়া অবস্থানের ম্লানময় বিদ্যমানতা দর্শনার্থীকে নিয়ে যায় ‘অভয়া’র জৌলুসময় কথা স্মরণ করে দিতে। পুরাকীর্তি বিভাগ মন্দিরগুলোর দায়িত্বভার নিলেও সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষনের কোনো পদক্ষেপ আজও গ্রহণ করেনি। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দিকে আবারো অভয়নগরকে জাগ্রত করতে এই ১১ শিব মন্দিরকে ঘিরে নেয়া হয় নানা উদ্যোগ। দেশ বিভাগের পর এই অঞ্চলের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেশ ত্যাগ করলে প্রাচীন জৌলুস হারায় অভয়নগর ও ১১ শিবমন্দির। এক পর্যায়ে অভয়নগর থেকে সব কিছু স্থানান্তর করা হয় নওয়াপাড়া শহরে। ফলে নদীর উত্তর প্রান্তে পড়ে থাকে ‘অভয়াদেবী’র স্মৃতি বিজড়িত ১১ শিব মন্দিরসহ বিশাল জমিদার বাড়ি। কালে কালে সেই জমিদার বাড়িটি বিলীন হয়েছে দখলদারিত্ব আর লুটপাটের স্রোতে। স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, ১১ মন্দিরের একটিতে এখনো নিত্য পূজা অর্চনা করেন অভয়নগর গ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। বাকী ১০টি মন্দির ঝোপজঙ্গলে ভরা। সেগুলো থেকে খসে পড়ছে ইট-সুরকি।
©somewhere in net ltd.