নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি একজন শিক্ষক, লেখালেখি, সম্পাদনা ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করি। বাংলাদেশ কে ভালবাসি। দেশের জন্য, মানুষের জন্য সামান্য হলেও কিছু করতে চাই।

মা, মাটি ও মানুষকে ভালবাসি। ভালবাসতে চাই।

বিএইচ মাহিনী

I am a social worker.

বিএইচ মাহিনী › বিস্তারিত পোস্টঃ

রাসুল মুহাম্মদ স. এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

১৫ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৯:৩৮

'নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।' (সুরা আহযাব, আয়াত ২১)। ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্যে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে।’’ (সূরাহ আল-আহযাব-৩৩ঃ২২) রাসুল (সা.) বলেছেন, 'আমার সাহাবারা আকাশের তারকার মতো। তাদের যে কারো জীবন তোমরা অনুকরণ করবে, সঠিক পথপ্রাপ্ত হবে।' (আবু দাউদ)।
আনাস রা. বলেন:“আমি দশ বছর রাসূলুল্লাহ স.-এর খিদমত করেছি, আল্লাহর কসম! তিনি কখনও আমাকে ‘উহ্’ শব্দও বলেন নি এবং কখনও কোনো বিষয়ে আমাকে বলেন নি: তুমি কেন এটা করলে? কেন ওটা করলে না?”
এক অন্য রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলতেন: এই দুনিয়ায় আতর, স্ত্রী ও নামাজকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন, অবশ্য নামাজ সম্পর্কে আরও বলতেন:" قرة عيني في الصلاة " অর্থাৎ নামাজের মধ্যেই হচ্ছে আমার চোখের দৃষ্টিশক্তি। (মোসান্নেফ, ৪/৩২১) তিনি বলতেন, "সবচেয়ে সুন্দর চরিত্রবান ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা পূর্ণ ঈমানদার"। "তোমাদের মাঝ থেকে সবচেয়ে বেশি চরিত্রবান ব্যক্তিই আমার নিকট অধিক প্রিয় এবং কেয়ামত দিবসে সর্বাপেক্ষা আমার অধিক নিকটে উপবেশনকারী।" (তিরমিজী)। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন : "আল্লাহ সম্পর্কে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি অবগত এবং আল্লাহকে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি ভয় করি।"
আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা:) বলেন : আমরা গণনা করে দেখতাম রাসূল সা. এক মজলিসে একশত বার নিম্নের দুআটি পড়তেন: "হে আমার রব, তুমি আমাকে ক্ষমা কর, এবং আমার তাওবা কবুল কর, নিশ্চয় তুমি তাওবা কবুলকারী, দয়াশীল।" তিনি বলেছেনহে আল্লাহ ! আমার জাতিকে ক্ষমা কর, কেননা তারা জানে না।’
রাসূল সা.অত্যধিক প্রশংসা থেকে বারণ করে বলেছেন : ‘তোমরা আমার অত্যধিক প্রশংসা করো না, যে-রকম খ্রিস্টানরা মরিয়ম তনয়ের ক্ষেত্রে করেছে। নিশ্চয় আমি আল্লাহর বান্দা। অতএব তোমরা (আমাকে) বল : আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।’
আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠতম সত্তা হলেন হয়রত মুহাম্মাদ (সা.)। তাঁকে বিশ্ববাসীর জন্য সুন্দরতম নমুনা হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তিনি শারীরিক গঠন কাঠামোর দিক দিয়েও ছিলেন নজিরবিহীন। তাঁর মতো অঙ্গ সৌষ্ঠবের অধিকারী এত সুন্দর আর কেউ ছিল না, কিয়ামত পর্যন্ত হবেও না। তেমনি আল্লাহ তায়ালা তাঁকে অনুপম চরিত্র মাধুরী দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। চারিত্রিক সৌন্দর্যে তিনি ছিলেন সমস্ত সৃষ্টির সেরা। আল্লাহ তায়ালা তাঁর চরিত্রের প্রশংসা করে বলেছেন: নিসন্দেহে আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী। (সূরা আল কালাম-৪) কল্পনাবিলাসী কবিরাও তাঁর চরিত্রের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন, খোদার পরে তুমিই শ্রেষ্ঠ, সংক্ষেপে মোরা এই তো জানি।
আরও অনেক বিশেষণ তাঁর জন্য। তাঁর জন্য অফুরন্ত দরুদ-সালাম। আসলে তিনি কেমন ছিলেন এ পর্যায়ে আমরা একটু সংক্ষেপে দৃকপাত করতে চাই। প্রথমে আমরা আসুন লক্ষ্য করি কুরআনে কী বলা হচ্ছে। ইরশাদ হচ্ছে তিনি ‘শুধু আমাদের মতো একজন মানুষ’
বল, ‘আমি তো তোমাদের মতো একজন মানুষই, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহ্ একমাত্র ইলাহ্। সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে ও তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে। (সূরা কাহ্ফ ১৮ : ১১০)
বল, ‘আমি তো তোমাদের মতো একজন মানুষই, আমার প্রতি ওহী হয় যে, তোমাদের ইলাহ্ একমাত্র ইলাহ্। অতএব তোমরা তারই পথ দৃঢ়ভাবে অবলম্বন কর এবং তারই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। দুর্ভোগ অংশীবাদীদের জন্য। (সূরা হা-মীম আস্-সাজ্দাঃ ৪১:৬)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কথা বলতেন। অসঙ্কোচ, অনাড়ষ্ট, দ্ব্যর্থবোধক, ও অর্থপূর্ণ কথা। সহিষ্ণুতা, ধৈর্য ও ক্ষমাশীলতার গুণবৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে ছিল। পাপের সাথে সম্পৃক্ত কাজ থেকে তিনি দূরে থাকতেন। তিনি ক্রোধ ও দুর্বিনীত ব্যবস্থা থেক দূরে ছিলেন। সকলের প্রতি তিনি সহজেই রাজী হয়ে যেতেন। তাঁর দান ও দয়াশীলতা পরিমাপ করা অসম্ভব ছিল। তিনি কল্যাণ ও দানশীলতায় পরিপূর্ণ বাতাসের চেয়ে অগ্রণী ছিলেন। বীরত্ব ও বাহাদুরীর ক্ষেত্রে প্রিয় নবী সা. এর স্থান ছিল সবার উপরে। তিনি ছিলেন সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বীর। তিনি সুকঠিন সময়েও পশ্চাৎপসারণ না করে সামনে এগিয়ে যেতেন। তাঁর চেয়ে বেশী দৃঢ়তার সাথে অন্য কেউ শত্রুর মোকাবেলা করতে সক্ষম হতো না।
তিনি ছিলেন সর্বাধিক লাজুক প্রকৃতির। তিনি সাধারণত মাটির দিকে দৃষ্টি রাখতেন। কোনো কিছু তাঁর পছন্দ না হলে তাঁর চেহারা দেখেই বোঝা যেত। লজ্জাশীলতা ও সম্মানবোধ এত প্রবল ছিল যে, কারো মুখের ওপর সরাসরি অপ্রিয় কথা বলতেন না। তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশী ন্যায়পরায়ণ পাক-পবিত্র, সত্যবাদী এবং বিশিষ্ট আমানতদার। বন্ধু, শত্রু সকলেই এটা স্বীকার করতেন। তিনি ছিলেন অতি বিনয়ী ও নিরহঙ্কার। বিশ্বজাহানের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, আমাদের প্রাণপ্রিয় রাসূল (সা.) নিজের জুতো, কাপড় নিজেই সেলাই করতেন।
অঙ্গীকার পালনে তিনি ছিলেন অগ্রণী। তিনি আত্বীয়-স্বজনের প্রতি অতিমাত্রায় খেয়াল রাখতেন। মানুষের সাথে সহৃদয়তা ও আন্তরিকতার সাথে মেলামেশা করতেন। স্বভাবগতভাবেই তিনি কখনো অশালীন কথা বলতেন না। কাউকে কখনো অভিশাপ দিতেন না। উচ্চস্বরে কথা বলতেন না। তাঁর খাবার-দাবার, আচার-আচরণ, কথা-বার্তা সকল কিছু সকল মানুষের প্রতি সমান ছিল। তিনি কাউকে ছোট মনে করতেন না।
সাইয়্যেদুল মুরসালিন প্রিয়নবী (সা.) বেশীরভাগ সময় গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকতেন। অপ্রয়োজনে কথা বলতেন না। কথার শুর ও শেষে সুস্পষ্ট উচ্চারণ করতেন। তিনি ছিলেন নরম মেজাজের অধিকারী। তিনি কখনো সমালোচনা করতেন না। সত্য ও ন্যায়ের পরিপন্থী কোনো কিছু দেখলে তিনি বিরক্ত হতেন। তাঁর মন ছিল বড় উদার। তিনি কাউকে ইশারা করতে চাইলে হাতের পুরো তালু ব্যবহার করতেন। বিস্ময়ের সময় হাত উল্টাতেন। ক্রুদ্ধ হলে মুখ ফিরিয়ে নিতেন এবং খুশী হলে দৃষ্টি নিচু করতেন। অধিকাংশ সময়ে মৃদু হাসতেন। হাসির সময়ে তাঁর দাঁতের কিয়দংশ ঝকমক করত।
তিনি সম্মানিত লোককেই নেতা নিযুক্ত করতেন। মানুষের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকতেন। সাহাবাদের খবরা-খবর নিতেন। সব বিষয়েই মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতেন। কোনো বিষয়ে অমনোযোগী থাকা তিনি পছন্দ করতেন না। তাঁর কাছে তাঁদের মর্যাদাই ছিল অধিক— যারা ছিলেন অন্যের দুঃখে কাতর, স্বভাবতই গম্ভীর এবং অন্যের সাহায্যকারী। তিনি উঠতে বসতে সর্বদাই আল্লাহকে স্মরণ করতেন। তাঁর বসার জন্য আলাদা কোনো জায়গা ছিল না। যেখানে খালি জায়গা পেতেন সেখানেই বসতেন। তিনি ছিলেন সবার কাছে পিতৃতুল্য। তিনি তাদেরকেই অধিক সম্মান দিতেন যারা বেশীমাত্রায় তাকওয়ার অধিকারী। তাঁর মজলিস বা সমাবশ ছিল জ্ঞান, ধৈর্য, লজ্জাশীলতা ও আমানতদারীর মজলিস। তিনি বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করতে আদেশ দিতেন। অপরিচিত লোককে অবজ্ঞা বা উপেক্ষা করা হতো না।
তিনি তিনটি বিষয় থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতেন। ১) অহঙ্কার ২) কোনো জিনিসের বাহুল্য এবং ৩) অর্থহীন কথা। আর তিনটি বিষয় থেকে লোকদের নিরাপদ রাখতেন। এগুলো হচ্ছে— ১) পরের নিন্দা ২) কাউকে লজ্জা দেওয়া এবং ৩) অন্যের দোষ প্রকাশ করা।
তিনি এমন কথাই শুধু মুখে আনতেন, যে কথায় সওয়াব লাভের আশা থাকত। তিনি যখন কথা বলতেন তখন সাহাবীগণ এমনভাবে মাথা নিচু করে বসতেন যে, মনে হতো তাদের মাথায় চড়ুই পাখি বসে আছে। তিনি হাসলে সাহাবীগণ হাসতেন, তিনি অবাক হলে তারাও অবাক হতেন, তিনি নীরব হলে সবাই নীরব হয়ে যেতেন। এমনই ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন তাঁর মজলিশের সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাশীল। পোশাক পরিধানে তিনি ছিলেন অতীব শালীন।
মোটকথা, মহানবী (সা.) তুলনাহীন গুণবৈশিষ্ট্যের অধিকারী একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ ছিলেন। মহান রাব্বুল আলামিন তাঁকে অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন। আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় নবীর সম্মানে বলেছেন, ইন্নাকা লা আলা খুলুকিন আযীম’, অর্থাৎ নিঃসন্দেহে আপনি সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী’। এটি এমন তুলনাবিহীন গুণ যার কারণে মানুষ তাঁর প্রতি ছুটে আসত। তাঁর প্রতি মানুষের মনে ভালোবাসা ছিল বদ্ধমূল। মানবীয় গুণাবলীর সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যের কারণে তাঁর স্বজাতির রক্ষতা পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল।
তিনি সব ধর্মের প্রতি উদারতায়, বিধর্মীদের সাথে ব্যবহারে, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও মহামানবতায়, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে, নারীজাতির উন্নয়নে, মাতৃভক্তিতে, সাম্য ও মৈত্রী স্থাপনে, সুদক্ষ কূটনীতিকরূপে, ক্রীতদাসদের মুক্তিদানে, জ্ঞান-সাধনায়, আল্লাহর প্রতি নির্ভরতায়, ক্ষমায়, ন্যায়বিচারে, বদান্যতায়, জীবে দয়ায়, শ্রমের মর্যাদা দানে, স্বামীরূপে, গৃহীরূপে, পিতারূপে, স্বাবলম্বনে, চরিত্র-মাধুর্যে, বীরবেশে, রাষ্ট্রনায়করূপে সেনাপতিরূপে, আদর্শ প্রতিষ্ঠায়, বিবাহ-প্রথার উন্নয়নে, বহুবিবাহের ব্যবস্থায়, যুগ সমস্যার সমাধানে, বৈজ্ঞানিকরূপে, অতিথি সেবায়, আর্ত, পীড়িত ও দুর্গতদের সেবা ও সাহায্যদানে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে ও অন্যান্য কার্যে, নাগরিক জীবনের কর্তব্য পালনে, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সফল মানুষরূপে তথা মানবীয় সকল গুণরাশির সর্বোচ্চ শিখরে তাঁর স্থান ছিল। মোটকথা সকল গুণবাচক বিশেষণের তিনিই ছিলেন শেষ কথা।

আদর্শ মানব হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (সা.) : মহানবী (সা.) এর সুরভিত জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ। বিশেষ করে তাঁর স্বভাব চরিত্র, আচার আচরণ, কথাবার্তা, হুকুম আহকাম। এগুলো অনুসরণ করলে শুধু সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যাবে তা নয়। বরং আল্লাহর কাছে সঞ্চিত তার উত্তম প্রতিদানে ধন্য হওয়া যাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন : “নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ, যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।” (সূরা- আহযাব ২১) প্রকৃত পে তিনিই মানুষকে সঠিক ও সরল পথের সন্ধান দিয়েছেন। তার সার্টিফিকেট স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন : “আপনি তো অবশ্যই সরল পথ প্রদর্শন করেন”। (সূরা আশ-শূরা- ৫২) আবার আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে রাসূল (সা.) এর ইত্তেবা করতে হবে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন : “হে রাসূল (সা.)! আপনি তাদের বলে দিন তোমরা যদি প্রকৃতই আল্লাহকে ভালোবেসে থাক তাহলে আমার অনুসরণ কর, তবেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন”। (সূরা আলে ইমরান- ৩১) তাই প্রকৃত অর্থে রাসূল (সা.) সকলের জন্য আদর্শ মানুষ ও পথ প্রদর্শক।
রাসূল (সা.) আদর্শ মানুষ তা-বুঝার সুবিধার্থে এবং প্রবন্ধ সংপ্তি করার জন্য তার জীবন চরিতকে নিম্নোক্ত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হলো।
১. ব্যক্তিগত জীবনে আদর্শ ২. পারিবারিক জীবনে আদর্শ ৩. সামাজিক জীবনে আদর্শ ৪. অর্থনৈতিক জীবনে আদর্শ ৫. শিক্ষা জীবনে আদর্শ ৬ .বিচার ব্যবস্থায় আদর্শ ৭. জিহাদ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় আদর্শ ৮. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আদর্শ
১. ব্যক্তিগত জীবনে আদর্শ : রাসূল (সা.) এর দৈহিক সৌন্দর্য ছিল যেমন অতুলনীয় তেমনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও ছিল অত্যন্ত নির্মল, স্বচ্ছ ও পবিত্র। সকল মৌলিক মানবীয় গুণাবলীর সমাহার ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে। তাঁর এই গুণের কারণে অসভ্য বর্বর আবর জাতির মনের আদালতে এমনই বিশ্বাসের সৌধ নির্মাণ করতে সম হয়েছিলেন, যার ফলে তিনিই প্রথম ‘আল-আমিন’ উপাধি লাভ করেন। অথচ তখনও তিনি নবী হননি। অতি সাধারণ মানুষ বেশেই সকল মানুষের হৃদয়ের মণি কোঠায় বিশুদ্ধতা ও আস্থার পূর্ণস্থান দখল করে নিয়েছেন। চরম শক্রও তাঁর কাছে তাদের মূল্যবান সম্পদ আমানত রাখত সংকোচহীনভাবে। তিনি সেগুলো হেফাজত করতেন পূর্ণ আস্থার সাথে। এ কথা সত্য যে, তিনি যদি নবী নাও হতেন তাহলেও পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও আদর্শ মানুষ হতেন তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
তিনি ব্যক্তিগত জীবনে এত মা পরায়ণ, কষ্ট সহিষ্ণু, ধৈর্যশীল ছিলেন যে সর্বদা অন্যের কল্যাণে নিজের কষ্ট স্বীকার করতেন। যাদের কল্যাণে তিনি কষ্ট স্বীকার করতেন তারাই তাকে গালাগাল করত, রাস্তায় কাঁটা দিত, তার উপর পাথর মেরে খুন ঝরাত, তাঁকে গৃহহারা ও দেশত্যাগে বাধ্য করত। তারপরেও তিনি তাদের জন্য বদ দোয়া করতেন না এবং তাদের কল্যাণ কামনা থেকে বিরত থাকতেন না। ব্যক্তিগত জীবণে অত্যন্ত সৎ স্বভাবের ছিলেন। যা মানুষের জন্য খুবই অনুসরণীয় আদর্শ। যেমন তিনি বলেন, ‘দশটি কাজ স্বভাব ধর্মের অন্তর্গতঃ গোঁফ ছাঁটা, দাড়ি লম্বা করা, মিস্ওয়াক করা, নাকে পানি দেয়া, নখ কাটা, আঙ্গুলের গ্রন্থি ধৌত করা, বগলের লোম উপড়ে ফেলা, নাভির নিচের লোম মুন্ডন করা এবং পানি কম খরচ করা। তিনি মানুষকে এমন অতি সূক্ষ্ম আদর্শ শিা দিয়ে গেছেন যা পৃথিবীতে অন্য কেউ দিতে পারেন নাই।
২. পারিবারিক জীবনে আদর্শ : পরিবার রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম একক। আর আদর্শ পরিবার সুন্দর-সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান। এই পারিবারিক জীবনে রাসূল (সা.) অনুপম আদর্শের প্রতীক। পারিবারিক জীবনে তিনি পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতি, বৃদ্ধ, ছোট-বড় সকলের অধিকার নিশ্চিত করেছেন। এমনকি পিতা-মাতার অবর্তমানে তাদের বন্ধু-বান্ধবদের অধিকারও নিশ্চিত করেছেন এবং পারিবারিক কাজে স্ত্রীদের সহযোগিতা করেছেন। এমনকি চাঁদনী রাতে মা আয়েশা (রা.) সাথে দৌড় প্রতিযোগিতাও করতেন। তিনি আয়েশা (রা.)কে বলেন তোমরা দিনের আলোতে এবং রাতের আঁধারে আমার মধ্যে যা দেখ তা মানুষের নিকট প্রকাশ কর। মা আয়েশা (রা.) কে রাসূল (সা.) এর জীবন চরিত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে জবাবে বলেন : আল-কুরআন হলো তাঁর জীবন চরিত। পারিবারিক জীবনে তিনি যে আদর্শ স্থাপন করেছেন তা সকলের জন্য অনুসরণীয়।
৩. সামাজিক জীবনে আদর্শ : পৃথিবীর আদি মানুষ হযরত আদম (আ.) হতে সমাজ ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। অতঃপর প্রাথমিক যুগ থেকে মানবসমাজের ক্রমবৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী প্রসার ঘটে। নানা ধরনের জাগতিক মোহ ও শয়তানের কু-মন্ত্রণায়, গোত্র, সম্প্রদায় ভেদে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে এবং পরস্পর শত্রুতা করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: মানবজাতি একই সমাজভুক্ত ছিল, অতঃপর তাঁরা বিভেদ সৃষ্টি করল। (সূরা- ইউনুস : ১৯) আর রাসূল (সা.) এর আগমনের প্রাক্কালে আরবের সামাজিক অবস্থা ছিল চরম বিপর্যয় ও ঝুঁকিপূর্ণ। সামাজিক অনাচার পাপ পঙ্কিলতা এত চরমে পৌঁছেছিল যে তারা সব সময় মদ, যুদ্ধ আর নারী নিয়ে ব্যস্ত থাকত। এমনকি তারা পিতার বিবাহিত স্ত্রীকে বিবাহ করতে কুণ্ঠাবোধ করতো না। এমন বিপর্যয় পূর্ণ অবস্থায় ওহীবিহীন জিন্দেগির ৪০টি বছর সামাজিক কল্যাণমূলক বিভিন্ন কার্মসূচির উদ্যোগ নিয়ে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ফলে নৈতিকতার চরম বিপর্যয়ের সে যুগেও উদভ্রান্ত মানুষগুলোর ইস্পাত কঠিন হৃদয়কে জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সামাজিক সকল অনৈক্য ভুলে একই সূত্রে আবদ্ধ হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর। দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওনা। (সূরা আলে ইমরান-১০৩) শুধু তাই নয় আল কুরআনে এবং আল হাদিসে মুসলমানদের পরস্পর ভাই ভাই বলে ঘোষণা করেছেন। সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় মহা নবী (সা.) বলেছেন:‘সে ব্যক্তি প্রকৃত মুসলমান নয় যার মুখ ও হাত হতে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।
তিনি আরও ঘোষণা করেছেন:‘ যে ব্যক্তির বড়দের সম্মান করে না এবং ছোটদের স্নেহ করে না সে আমার দলভুক্ত নয়’। (সুনানু আবু দাউদ) তিনি বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেন: প্রত্যেক মুসলমানের ধন সম্পদ, জান ও ইজ্জত কিয়ামত পর্যন্ত পবিত্র আমানত হিসেবে জানবে। তিনি আরবের সেই জাহেলি সমাজকে সোনালী সমাজে পরিণত করেছিলেন কাউকে আহ্বান করে, কাউকে সতর্ক করে, আবার কাউকে ভালোবেসে কাছে টেনে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ইনসাফ ও ন্যায়বিচার দারুণভাবে উপেতি।
৪. অর্থনৈতিক জীবনে আদর্শ : ইসলাম পূর্ব আরববাসীরা অন্যায় ও অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করত। তারা লুণ্ঠন, রাহাজানি, ছিনতাই, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, ঘুষ, জুয়া, প্রতারণা, দুর্নীতি ইত্যাদি হারাম পন্থায় অর্থ উপার্জন করত। সুদ ছিল অর্থনৈতিক শোষণের প্রধান হাতিয়ার। আর রাসূল (সা.) এগুলো সবকিছু হারাম ঘোষণা করে দেন। তিনি সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা বাতিল করে যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু করেন। তিনি সুদ এবং মজুতদারীকে হারাম ঘোষণা করেছেন, যাতে সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছুলোকের হাতে কুক্ষিগত না হয়। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেছেন: “যাতে সম্পদ তোমাদের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মধ্যে আবর্তিত না হয়।’ (সূরা আল হাশর : ৭) মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘সাদাকা হলো দলিল’। তিনি গ্রাম ও শহরের যাকাত দাতাদের নিকট থেকে যাকাত আদায় করে; প্রথমে গ্রামের গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। অবশিষ্ট কেন্দ্রীয় বায়তুলমালে জমা করতেন। রাসূল (সা.) এর প্রণীত অর্থনীতির প্রভাবে সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হয়েছিল। ফলে খলিফা হযরত ওমর (রা.) খিলাফতের সময় যাকাত দেয়ার জন্য পথে-পথে ঘুরেও যাকাত গ্রহণ করার মত কোনো লোক পাওয়া যেত না।
৫. শিক্ষা জীবনে আদর্শ : শিক্ষা ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) যে পথ দেখিছেন ইতিহাসের পাতায় তা বিরল। বিশেষ করে জ্ঞান- বিজ্ঞানের উপর বিশেষভাবে গুরত্ব দিয়েছেন। তিনি দ্বার্থহীন কণ্ঠে বলেছেন জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর নারীর উপর ফরজ’। (বায়হাকী) আবার এ জ্ঞানার্জনের জন্য উত্তম প্রতিদানের কথাও বলেছেন। তাঁর উপর প্রথম যে ওহী নাযিল হয়েছিল তাও ছিল “পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন“। (সূরা আল আ‘লাক : ১) তিনি ছিলেন জ্ঞানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তাই তিনি বলেছেন ‘আলেমগণ নবীদের উত্তরসূরি’। অপর দিকে পবিত্র কুরআন মজিদে ইলম তথা জ্ঞান শব্দটি এসেছে ৬২৪ বার। রাসূল (সা.) এমন সব সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রগতিকে অব্যাহত রাখার গ্যারান্টি প্রদান করেছে। কারণ এতে সকলের অধিকার রয়েছে, ইহা কারো জন্য নির্দিষ্ট ও সীমিত নয়। এর ব্যাপকতার জন্য রাসূল (সা.) বদর যুদ্ধের বন্দিদের শিক্ষার বিনিময় মুক্ত করে দেন। তাঁর জামানায় রাষ্ট্রীয়ভাবে লেখার কাজে ৫০ জন লেখক নিয়োজিত ছিল। মহানবী (সা.) এর হিজরতের পর মসজিদে নববী কেন্দ্রীক “সুফফা” প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে পৃথিবীর ইতিহাসে নজির স্থাপন করেছেন।
৬. বিচার ব্যবস্থায় আদর্শ : গরমযঃ রং জরমযঃ -এ বিশ্বাসের সমাজে বিচারব্যবস্থা বলতে কোনো কিছুই ছিল না। সে সময় রাসূল (সা.) ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রবর্তন করে আমাদের ন্যায় বিচারের পথ দেখিয়েছেন। তাঁর বিচারব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল মানুষের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। বাদ-বিসম্বাদকারীদের মধ্যে ন্যায়ভিত্তিক বিচার করা। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন: “মানুষের মাঝে যখন বিচার করবে তখন ইনসাফের সাথে করবে।” (সূরা আন নিসা : ৫৮) মদিনা নামক মডেল রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ছিলেন হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আল্লাহ তায়ালার নাযিল করা বিধান মতে তাদের মধ্যে বিচার করন”। (সূরা আল মায়িদাহ : ৪৮) তাঁর বিচারব্যবস্থায় ছিল না কোন দলীয়করণ, আত্মীয়প্রীতি, স্বজনপ্রীতি। তিনি ছিলেন সকল মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে। একদা এক মহিলাকে চুরির দায়ে হাত কাটার নির্দেশ দিলে, মহিলার বংশ মর্যাদার কথা উল্লেখ করে কিছু সাহাবী হাত না কাটার সুপারিশ করেন। তখন তিনি বলেন, তোমরা জেনে রাখ আমার মেয়ে ফাতিমাও যদি আজ চুরি করত তাহলে তার হাতও কেটে ফেলতাম।’
৭. জিহাদ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় আদর্শ : ইসলামে জিহাদ ফরজ বলে ঘোষণা করেছে। তবে তা আক্রামণাত্মক নয় বরং আত্মরক্ষামূলক। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “যারা তোমাদের সাথে লড়াই করে আল্লাহর পথে তাদের সাথে তোমরা লড়াই কর তবে সীমা লঙ্ঘন করো না।” (সূরা বাকারাহ : ১৯০) মহানবী (সা.) এর ২৪ বছরের নবুয়তী জিন্দেগিতে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ করেছেন। সরাসরি ২৭টি যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর এ সকল যুদ্ধ ছিল মানবতার মুক্তির জন্য। তায়েফের ময়দানসহ শত শত ঘটনা তাঁর জীবনে খুঁজে পাওয়া যায়। জীবনের কঠিন মুহূর্ত হলো যুদ্ধক্ষেত্র। অথচ সেখানেও তিনি ছিলেন মানবতার কল্যাণে মগ্ন। হিংসা বিদ্বেষ কোনো কিছুই তাঁকে উত্তেজিত করতে পারেনি। আধিপত্য বিস্তার, রাজ্য দখল তাঁর মূলনীতি ছিল না বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মানবতার মুক্তি ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। সেনাবাহিনীর প্রতি তার নির্দেশ ছিল, যে “কোনো বৃদ্ধ, শিশু ও নারীকে হত্যা করবে না। গণিমতের মাল আত্মসাৎ করবে না।” মক্কা বিজয়ের দিন তিনি নির্দেশ দেন, আহত ব্যক্তির উপর হামলা চালাবে না। পলায়নরত ব্যক্তির পিছু ছুটবে না, যে ব্যক্তি দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকবে তাকে কিছু বলবে না।
তিনি আরও বলেন সন্ন্যাসীদের কষ্ট দিবে না এবং তাদের উপাসনালয় ভাঙবে না, ফলের বাগান, গাছ ও ফসল নষ্ট করবে না। বদর যুদ্ধ থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত সবকটি যুদ্ধে তাঁর মোকাবিলায় ১৫ হাজারের বেশি লোক আসে নাই। তারমধ্যেই ৭৫৯ জনের বেশি হতাহতও হয়নি। আরবের ন্যায় মরুভূমির বুকে মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে চরম উচ্ছৃঙ্খল, হিংসুটে, দাঙ্গাবাজ, মানু খেকো গোত্র ও ব্যক্তিবর্গকে একটি নৈতিক মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত করা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। তাই আলেকজান্ডার পাওয়েল বলেন: ‘কিন্তু যুদ্ধ বিজয়ের পর মুসলমানগণ যে পরিমাণে সহনশীলতা প্রদর্শন করেছিলেন তা খ্রিস্টান জাতিসমূহকে লজ্জিত করে।’ সুতারাং শান্তি প্রতিষ্ঠায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন অতুলনীয়।
৮. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আদর্শ : মহানবী (সা.) এর আন্তর্জাতিক নীতির মূল কথা ছিল বিশ্ব ইসলামী ভ্রাতৃত্ব। এ ভ্রাতৃত্বই সারা বিশ্বের মানুষকে একই সুতায় গ্রোথিত করতে সক্ষম। ভাষা, বর্ণ, পেশাগত ও ভৌগোলিক দিক দিয়ে যে ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠে তা মানুষকে শান্তি দিতে ব্যর্থ। সকল মানুষই এক সম্প্রদায় ভূক্ত। আদি পিতা হযরত আদম (আ.) থেকে সকল মানুষের সৃষ্টি। সুতরাং বংশ, গোত্র, বর্ণ, ভাষা, সম্প্রদায় ইত্যাদির ভিত্তিতে মানুষে-মানুষে পার্থক্য করা অযৌক্তিক। কেননা একমাত্র তাকওয়ার ভিত্তিতে মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হয়। ঐক্যের এ মূলনীতির ভিত্তিতে মহানবী (সা.) পারস্পরিক সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে শতধা বিভক্ত আরব জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি বলেছেন: ‘হে লোক সকল! আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : হে মানব জাতি, আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন সমাজ ও গোত্রে বিভক্ত করে দিয়েছি। যেন তোমরা পৃথকভাবে পরিচিতি লাভ করতে পার। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় যে তাকওয়ার দিক থেকে অধিক।” সুতরাং অনারবের উপর আরবের, কালোর উপর সাদার কোনো প্রাধান্য নেই। তিনি আরও বলেছেন: ‘সমগ্র মানবজাতি এক আদমের সন্তান, আর আদমের প্রকৃত পরিচয় তাঁকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখন থেকে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের সকল দাবি, রক্ত ও ধন-সম্পদের সকল দাবি এবং সকল প্রতিশোধ স্পৃহা আমার পায়ের নিচে পদদলিত হলো। এ হলো তাঁর আন্তর্জাতিক নীতি। এ নীতিই পারে আন্তর্জাতিক বিশ্বে শান্তি দিতে।
৯. মহানবীর স. আত্মসম্মানবোধ : মহানবীর আত্মসম্মানবোধ অতি প্রবল ছিল বলে ভিক্ষাবৃত্তিকে তিনি অতিশয় ঘৃণা করতেন। এক সময় এক ভিক্ষুক তাঁর কাছে উপস্থিত হলে, তিনি তাকে একখানা কুঠার দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘এটা নিয়ে কাঠ কেটে তা বিক্রি করে জীবন ধারণ করবে।’’
উপসংহার : আলোচনার শেষ প্রান্তে এসে আমরা এ কথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, মানব রচিত মতবাদের ব্যর্থতা সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এ থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো মহা নবী (সা.) মানুষের যে অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছেন তা নিশ্চিত করা। তাঁর অনুসারীরা তাঁর এ আদর্শকে ১০০ ভাগ বাস্তবায়ন করে একটি সোনালী সমাজের ভিত নির্মাণ করেছেন। বহু শতাব্দী অতীত হয়ে যাওয়ার পরেও আজকের সমাজ ও সভ্যতা যতটুকু অবশিষ্ট আছে তা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর অবদান। তাই আজকে প্রয়োজন তাঁকে আমাদের আদর্শ হিসেবে পরিপূর্ণভাবে মেনে নেয়া। পরিশেষে জর্জ বার্নাডশ গ্রন্থে লিখিত উক্তি দিয়ে প্রবন্ধ সমাপ্ত করতে চাই।
তিনি বলেছেন, যদি সমগ্র বিশ্বের ধর্ম, সম্প্রদায়, আদর্শ ও মতবাদ সম্পন্ন মানব জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে কোনো নায়কের শাসনাধীনে আনীত হত তা এক মাত্র হযরত মুহাম্মদ (সা.) ই সুযোগ্য নেতারূপে তাদের শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে পারতেন। অতএব বিনা দিধায় আমরা বলতে পারি যে হযরত মুহাম্মদ (সা.) আমাদের একমাত্র আদর্শ মানব।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.