![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
I am a social worker.
তওবা : আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম
--প্রভাষক বি.এইচ.মাহিনী
সৃষ্টির সেরা মাখলুক হিসেবে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে। ভালো-মন্দ দুটি পথের মধ্যেই ইচ্ছেমতো যে-কোনো একটি পথ বেছে নেওয়ার এখতিয়ার দিয়েছেন তিনি মানুষকে। এ কারণে মানুষ ইচ্ছে করলেই তার রবের (প্রতিপালক) অবাধ্য হতে পারে। ফেরেশতাদের আল্লাহ তায়ালা অবাধ্য হওয়ার ক্ষমতাই দেননি। মানুষ বিপধগামী হলে যাতে আবার সঠিক পথে ফিরে আসতে পারে সেজন্যে নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। তাঁদের প্রতি ওহি নাজিল করে সাধারণ মানুষকে সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন। ভুল করে বিপথগামী হলে সংশোধন হয়ে সঠিক পথে ফিরে আসতে রেখেছেন ‘তাওবা’র বিধান। এখানেই ফেরেশতাসহ সব মাখলুকাতের ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব।
ইসলামে তওবা শব্দের মূল উৎস হল কুরআন ও হাদিস। কুরআনের অনেক স্থানে তওবা শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। ‘তওবা’ আরবি শব্দ। যার অর্থ প্রত্যাবর্তন করা, ফিরে আসা। কুরআন ও হাদীসে শব্দটি আল্লাহ তায়ালার নিষেধকৃত বিষয়সমূহ ত্যাগ করা ও তার আদেশকৃত বিষয়সমূহ’র দিকে ফিরে আসা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। ইসলামি ধর্মতত্ত্বে শব্দটি নিজের কৃত পাপের জন্য অনুতপ্ত হওয়া, তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, এবং তা পরিত্যাগের দৃঢ় সংকল্পকে বোঝায়। যেহেতু কুরআন ও হাদীসে কৃত পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার বিষয়টি বহুবার উল্লেখ করে এর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, সে কারণে ইসলামি ধর্তমত্ত্বে তওবার গুরুত্ব অপরিসীম। তওবা ব্যাতিরেকে কবিরা গুনাহ মাফ হয় না। যে তওবার পর পাপকর্মের পুনরাবৃত্তি হয় না, তাকে বলে তওবাতুন নাসুহা বা খাঁটি তওবা। কুরআনের ৬৬নং সূরা আত-তাহরিমের ৮নং আয়াতে ‘তওবা’ শব্দটি ‘নাসূহ’ (نصوح) শব্দ সহকারে ববহৃত হয়েছে যার অর্থ খাঁটি। সুতরাং, তওবার প্রকৃত তাৎপর্য হল আন্তরিক অনুশোচনা।
আল-কুরআনে তওবা : কুরআনের একটি পূর্ণাঙ্গ সূরার নামকরণ করা হয়েছে ‘তওবা’। এছাড়া সূরা নুর, সূরা তাহরিম, সূরা বাকারা, সূরা ফুরকানসহ কুরআনের আরও অনেক স্থানে তওবা এবং এর গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা আন-নূরের ৩১ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন (তওবা) কর, যেন তোমরা সফলকাম হতে পার।’ এছাড়ও আল্লাহ তায়ালা সূরা আত-তাহরিমের ৮নং আয়াতে বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর সমীপে খাঁটি তওবা কর, এই আশায় যে, তোমাদের প্রভু তোমাদের সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন, আর তোমাদেরকে এমন উদ্যানসমূহে উপবিষ্ট করবেন যার নিম্নদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত থাকবে।’
পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে প্রেরণের অনেক আগেই আল্লাহ আমাদের রূহ তৈরি করেছেন। আলমে আরওয়াহ বা রুহের জগতে আমাদের সবার রূহকে উদ্দেশ করে আল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমি কি তোমাদের রব নই? আমরা সবাই বলেছিলাম, হ্যাঁ। আমরা আল্লাহর দুনিয়াতেও কালেমার অঙ্গীকার করেছি। জান্নাতের বিনিময়ে আল্লাহ মুমিনদের জান-মাল ক্রয় করে নিয়েছেন। কিন্তু কখনও কখনও আমরা হেদায়েতের আলোর পথ থেকে দূরে সরে গিয়ে পাপাচারের অন্ধকারে নিজেদের নিমজ্জিত করি। কোনো কোনো পাপে সাময়িক সুখ অনুভূত হলেও পাপের পীড়া কামড় দেয় বারবার। ফলে মানসিক বিষাদ অনুভব হতে থাকে। পক্ষান্তরে তওবা করলে, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে, তিনি মানুষকে নবজীবন দান করেন।
‘তওবা’ একটি মহা শব্দ। যার অর্থ ফিরে আসা। তওবার দহনেই গোলামের পাপে কলুষিত আত্মা মনিবের সঙ্গে নবরূপে মিলিত হয়। মহান আল্লাহ চান তার বান্দারাও যেন গোনাহ করার সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে নেয়। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে তওবার ওপর জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বান্দার তওবায় আল্লাহ অত্যন্ত খুশি হন। তওবার ফলে তিনি এত খুশি হন যে, তার উদাহরণ দিতে গিয়ে নবী স. বলেন, এক মুসাফির তার উটসহ সফরে এক মারাত্মক মরুভূমিতে গিয়ে পড়লে বিশ্রামের জন্য এক গাছের ছায়ায় মাথা রেখে শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়ল। এর মধ্যেই তার উট গায়েব হয়ে গেল। সে এদিক-সেদিক খোঁজাখুঁজি শুরু করল; কিন্তু সে বৃথায় হয়রান হলো। ক্ষুধা ও পিপাসায় বেশি কাতর হয়ে পড়ল। তারপর ফিরে সে গাছের কাছে এসে শোয়ামাত্র চোখ লেগে গেল। কিছু পরে চোখ খুলতেই দেখতে পেল তার সেই উট খাদ্য ও পানিসহ দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে সে এত খুশি হলো যে, উটের লাগাম ধরে খুশির উচ্ছ্বাসে (নিজের অজান্তেই) বলে উঠল, ‘আল্লাহ তুই আমার বান্দা আমি তোর রব।’ নবী স. বলেন, তওবা করলে আল্লাহ হারিয়ে যাওয়া উটওয়ালা অপেক্ষা অধিক খুশি হন। (বুখারি ও মুসলিম)।
আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তিনি চান বান্দা তওবা করুক। এজন্যই দিনে-রাতে হাত বাড়িয়ে দেন। তিনি সব গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। নবী করিম স. এর কোনো পাপ ছিল না। তবু তিনি প্রত্যেহ ১০০ বার আল্লাহর কাছে তওবা করতেন। উম্মতকে বেশি বেশি তওবা করতে উৎসাহিত করতেন। আল্লাহ তায়ালা সূরা আত-তাহরিমের ৮নং আয়াতে বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো, আন্তরিক বা খাঁটি তওবা।’
তওবা হলো অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করা, যে গুপ্ত অথবা প্রকাশ্য জিনিস আল্লাহ ঘৃণা করেন সে জিনিস থেকে, যা তিনি পছন্দ করেন তার কাছে ফিরে আসার নাম তওবা। ওলামায়ে কেরাম তওবার কয়েকটি শর্ত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে শর্তগুলো পূরণ না হলে তওবা কবুল হয় নাÑ১. তওবা হবে আন্তরিকভাবে একান্ত আল্লাহর জন্য। ২. পাপে লিপ্ত থাকা অবস্থায় তওবা গ্রাহ্য নয়। সঙ্গে সঙ্গে পাপ বর্জন করতে হবে। ৩. বিগত পাপের ওপর অনুশোচনা প্রকাশ করতে হবে। ৪. পুনরায় মরণ পর্যন্ত তার প্রতি না ফেরার দৃঢ় সংকল্প করতে হবে। ৫. কোনো মানুষের অধিকার হরণ করলে তার অধিকার আদায় করে নিতে হবে কিংবা তার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিতে হবে। ৬. কবুল হওয়ার নির্ধারিত সময় তথা মরণ নিকটবর্তী হওয়ার আগে ও পশ্চিমাকাশে সূর্য উদিত হওয়ার আগে তওবা করতে হবে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা সূরা নূহের ১০-১২ নং আয়াতে নুহ আ. এর কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘(নূহ আ. বলল), আমি তাদের বললাম, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। তিনিতো মহাক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত করবেন। তিনি তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি দ্বারা সমৃদ্ধ করবেন। আর তোমাদের জন্য বাগান তৈরি করে দেবেন এবং প্রবাহিত করে দেবেন নদীনালা।’
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ১৭ ও ১৮ নং আয়াতে বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তওবা করে, এরাই হল সেসব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন; আল্লাহ মহাজ্ঞানী রহস্যবিদ। আর এমন লোকদের জন্য কোন ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমনকি যখন মাথার উপর মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকে-আমি এখন তওবা করছি। আর তওবা নেই তাদের জন্য, যারা কুফুরি(অবাধ্য) অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। আমি তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।’
হাদিসে তওবা ঃ কুরআনের ন্যায়, হাদীসেও তওবার উল্লেখ রয়েছে এবং এর প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। তিরমিযী গ্রন্থে একটি হাদিসে এসেছে- রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তানই পাপ করে, পাপীদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম, যারা তওবা করে।’ এছাড়ও রাসূল স. বলেছেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তান ত্রুটিশীল ও অপরাধী, আর অপরাধীদের মধ্যে উত্তম লোক তারা যারা তওবা করে।’ (আহমাদ ১৩০৪৯, তিরমিযী ২৪৯৯, ইবনে মাজাহ ৪২৫১, দারেমী ২৭২৭, বাইহাক্বী ৭১২৭)।
সহিহ মুসলিমের ৬৬২১নং হাদিসে উল্লেখ রয়েছে- আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূল স. বলেন, ‘সেই সত্ত্বার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, মানুষ যদি পাপ না করতো তবে আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে উঠিয়ে নিয়ে এমন এক সম্প্রদায়ের অবতারণা করতেন, যারা পাপ করত এবং পরে (নিজের ভুল বুঝতে পেরে) আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতো এবং আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিতেন।’ এছাড়াও সহিহ মুসলিম গ্রন্থে এসেছে, আনাস ইবনে মালিক রা. বর্ণনা করেন, কোনো এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসুলের কাছে এসে বলল, আমি এমন এক পাপ করেছি যার জন্য আমার উপর ‘হদ’ (আইনের শাস্তি) প্রযোজ্য হয়, তাই আল্লাহর কিতাব (বিধান) অনুসারে আমার উপর তা প্রয়োগ করুন। রাসুল স. বললেন-‘তুমি কি সালাত আদায়ের সময় আমাদের সঙ্গে ছিলে না? লোকটি বলল, হ্যা। আল্লাহর রাসুল স. বললেন, আল্লাহ তোমাকে মাফ করে দিয়েছেন।
তাওবা বিহীন মৃত্যু কুফুরি মৃত্যুর শামিল। আমরা মানুষ। জেনে না জেনে, বুঝে না বুঝে প্রতিক্ষণে অসংখ্য পাপরাশি জমা করছি। অজান্তেই করে ফেলছি কুফরি বা শিরকের মতো কবিরাহ্ (বড়) গুনাহ। তাই প্রভুর সান্নিধ্য পেতে ও জাহান্নামের অনন্ত আগুনের লেলিহান শিখার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতে আসুন তওবায়ে নুসুহা করে মাসুম আত্মা নিয়ে ¯্রষ্টার সান্নিধ্যে আসিন হই। (আমিন)
লেখক-প্রভাষক বি এইচ মাহিনী
প্রভাষক- গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা
প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক-সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর।
০১৭৩৫-১৭৬২৮৬
©somewhere in net ltd.