নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রতিবাদ তো পজিটিভ ও হতে পারে।

ডাব্বা

জোছনা রাত। হট চকলেট। লেক এর পাড়। ছোট ছোট চুমুক। ভেজা রাস্তায় চেনা মুখ। আলিঙ্গন। হট চুমুক। ছোট ছোট জোছনা রাত। চকলেট লেক এর পাড়।

ডাব্বা › বিস্তারিত পোস্টঃ

কালো জামা, কালো হ্যাট, কালো জুতা পায় - একটি অশরীরী অভিজ্ঞতা

১২ ই মার্চ, ২০২১ রাত ৯:৫০


স্থানঃ হ্যালিফ্যাক্স। ক্যানাডার নোভা স্কোশিয়া প্রদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে একটি রিসার্চের কাজ চলছে। অনলাইনে আর স্কাইপে একবছর গবেষণাকাজ দেখভাল করার পর সুযোগ এলো কাজটির সরাসরি তত্বাবধান করার। এক সিমেস্টার(semester) থাকলেই হবে। টরন্টো থেকে দু'ঘন্টা পাঁচ মিনিটের এয়ার ক্যানাডার ফ্লাইট শেষে পরিচয় হলো তিন পিএইচডি স্টুডেন্টের সাথে যারা আমার সাহায্যকারী হিসেবে যোগ দিয়েছে। গল্পটা ওদের নিয়েই, ওদের সাথেই।

তখন শীতকাল। শীতটা এখানে বেশ ভেজা ভেজা। যদিও অটোয়া, টরন্টো, বা মন্ট্রিয়লের মতো অত ঠান্ডা পরে না। তবে বৃষ্টি হয় প্রায়ই। তুষারপাতের পর বৃষ্টি হয়ে তুষার ধুয়ে গেলেও ব্ল্যাক আইস তৈরি করে যায়। তখন হাঁটাচলায় সাবধান না হলেই পপাত ধরণীতল।

আমার তিন সহযোগীই বয়সে তরুন। প্রাণের অভাব নেই। সারাদিন বই, কাগজপত্র, আর নিরস তাত্বিক আলোচনা নিয়ে ডুবে থাকলেও সন্ধ্যায় আমরা চারজন প্রায়ই 'স্যালভ্যাতরি'তে পিৎজা শেয়ার করি, কফি খাই। ওদের জীবনের গল্প শুনি। আমি বাংলাদেশের গল্প বলি। আবাহনী, মোহামেডান এর যুদ্ধের কথা শোনাই। আমার কৈশোরের কথা বলি। ওরা অবাক হয় শুনে যে কিশোর বয়সেই বন্ধু, বাবা-মা, ভাইবোন, দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে এসেছি। লিন্ডা বলে, 'ঘুরতে যাওয়া যায় কিন্তু বন্ধু ছেড়ে থাকা যায়না'। আমি হেসে বলি, 'নতুন বন্ধু হয়ে যায় অনেক'। আড্ডায় নোওম চমস্কি, বোনো(Bono), Doors, সার্ত্রে, অ্যাটউড, ক্যানাডিয়ান টায়ার এর কাস্টমার সার্ভিস, ইয়েমেনে সৌদি স্বার্থ, হট চকলেট, এমনকি বাখরখানিও এসে ঘুরে যায়, কোনো কিছুই বাঁধা দেয়না আমাদের। দুনিয়ার উদ্ভট সব বিষয় নিয়ে মতামত শেয়ার করি।

তিনজন ছাত্রের মাঝে সবচেয়ে লম্বা লিন্ডা মাঝে মাঝে ওর বয়ফ্রেন্ড জেরোমকে নিয়ে আসতো। জেরোম আদিবাসী, যাদের আমরা First Nation বলি, থিয়েটার আর্টে পড়ে। গভীর অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলে। কথায় কথায় নাটকের ডায়ালগ শোনায়, সাধারন কথাও মজা করে টেনে টেনে বলে। দেখা হলেই জিজ্ঞেস করবে, 'মিস্টার... , টালিয়াক'? ওদের ভাষায় what's up? কেমন চলছে?

এমনই এক শুক্রবার লাইব্রেরির কাজ শেষ করে আমরা African Cuisine নামের এক ইথিওপিয়ান র‍্যাস্টোরান্টে (restaurant) গেলাম ডিনার সারতে। নাটকে আমার আগ্রহের কথা জেনে জেরোম প্রস্তাব করলো যে আমাকে তার থিয়েটার গ্রুপের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চায় আমি যদি আগ্রহী থাকি। সম্ভব হলে আজ রাতেই।

সবাই রাজী হলো। পরদিন শনিবার। কাজে যেতে হবে না।

রাত আটটার মতো বাজে তখন। শীতের রাত। রাস্তাঘাট নির্জন হয়ে এসেছে। বিচ রৌড পেরিয়ে খানিকটা গেলেই একটা দোতলা বাড়ির বেইযম্যান্টে ওদের স্টুডিও। শর্টকাট হবে ট্রেইল(trail) ধরে গেলে, ২৫ মিনিটের পায়ে হাটা পথ। Ember পোর্টেবল কফির মাগটা হাতে নিয়ে টিম হরটন'স থেকে ইংলিশ টফি ভরে সবাই ট্রেইলের দিকে রওনা দিলাম।

আবছা আকাশে আধখাওয়া চাঁদ। বাতাসে ঠান্ডাটা কনকনে হয়ে শরীরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। জ্যাকেটটা গলা পর্যন্ত টেনে দিলাম। টুক(toque) টা নামিয়ে দিলাম কান ঢেকে। ব্ল্যাক আইসের ভয়ে রাস্তায় জোরে পা ও ফেলা যাচ্ছে না। এমনিতে শান্ত শহরটা এই আবহাওয়ায় আরো নিঃসঙ্গ লাগছে।

জায়গাটা কয়েক মিনিট হাঁটলেই এসকাসনি আদিবাসী এলাকার একদম কাছে। হালকা তুষারে ঢাকা আঁকাবাঁকা ট্রেইলের কোথাও সরু কাঠের রাস্তা, কোথাও সুরকি বিছানো, পাথুরে পথও পেরোলাম খানিকটা তবে বেশিরভাগটাই ঠান্ডায় জমে যাওয়া শক্ত মাটি। বয়সে ও অযত্নে কোমড় ভেঙে যাওয়া গাছের পড়ে থাকা পথের দুপাশে বড় বড় গাছ, জ্যাক পাইন, টামারাক, সাদা স্প্রুস, কালো স্প্রুস। পঞ্চাশ, ষাট ফুট তো হবেই। গরমের সময় নাকি এখানে ভালুকের আনাগোনা আছে। এই শীতে অবশ্য ভয় নেই। তবু বালসামের শুকনো পাতায় পা পড়লেই খসখস শব্দে কান এমনিতেই খাড়া হয়ে যাচ্ছে। Involuntary sense গুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠে।

৯টা বাজে প্রায়।

বাতাসে তারপিনের গন্ধটা বেশ জোরালো লাগছে এখন। ক্রিসমাসের এই সময়টায় পাইন, ফার, স্প্রুস থেকে বের হওয়া এই গন্ধটা অপার্থিব লাগে আমার। তাজা বাতাসে ফুসফুস ভরে নিঃশ্বাস নেই আমি।

লিন্ডা সিগারেট চাইলো জেরোমের কাছে। একটু থামলাম সবাই। হাতের গ্লাভস খুলে সিগারেট ধরাতে গিয়ে হাত থেকে পড়ে গেল লাইটার। জায়গাটা ঘন জঙ্গলের প্রায় মাঝামাঝিতে। বাইরে থেকে আলো আসছে না, ট্রেইলটা কোনওভাবে ফলো করা যাচ্ছে শুধু। স্মার্টফোন তখনও কেবল স্টার ওয়ারস এর টুল, বাজারে আসেনি যে তার ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে পথ চলব। লাইটারটা খুঁজে পেতে লিন্ডা ও জেরোম উবু হতেই জিনিসটা প্রথম আমার চোখে পড়লো।

আমাদের থেকে বিশ গজ মতো দুরে কোনাকুনি পথে দাড়ানো। সরাসরি এদিকেই তাঁকিয়ে আছে। অস্বাভাবিক লম্বা একহারা গড়নের অবয়ব। একটু যেনো কাত হয়ে ঝুঁকে আছে। স্থির। ততক্ষণে লাইটার খুঁজে পেয়েছে জেরোম। হাতের মাঝে কায়দা করে ধরে লিন্ডার ঠোঁটের কাছে নিয়ে জ্বালাতেই অবয়বটা নড়ে উঠলো, হাঁটু ছাড়ানো ঝুলের একটা কালো জামা গায়ে। পায়ে সম্ভবত কালো জুতো।

আমার তখন জমে যাওয়া অবস্থা। তিন স্টুডেন্ট আর জেরোম ট্রেইলের উপরই বসে পড়েছে। সবাই ধূমপায়ী, সিগারেটের নেশা পেয়েছে। আমি তখনও ছায়ার দিকে তাঁকিয়ে, চোখ সরাতে পারছি না। আশা করছি জেরোম কিছু বলবে কারণ এখানে আসার আইডিয়াটা ওরই ছিলো আর এলাকাটাও ওরই বেশি পরিচিত।

কিন্তু কারো মধ্যেই কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করছি না। এ যেন নিত্যকার ঘটনা! লিন্ডা আর জেরোম নিজেদের মধ্যে কী নিয়ে হাসাহাসি করছে। বাকিরাও হাত পা ছড়িয়ে বসে। আমার তখন সব ধরনের বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়েছে। বুঝে উঠতে পারছিনা কী করা উচিত। হাতে তখনও ইংলিশ টফির মাগটা শক্ত করে ধরা।

ছায়াটি সেই থেকে একই স্থানে দাড়ানো। বা হাতটা নড়ছে থেমে থেমে। আরেকটু ভালো করে তাঁকালাম, মাথায় ফেডোরা (fedora)। চেহারাটা ঠাহর করা যাচ্ছে না। শুধু টের পাচ্ছি হাত ঘামছে আমার। পায়ের আঙুলগুলো ঠান্ডা হয়ে আসছে। মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। কফির মাগটাকে মনে হচ্ছে বারো কেজি ওজনের ডাম্বেল। তবু একটা জিনিস ভালো লাগছে যে জিনিসটা নড়ছে না। এক জায়গায়ই স্থির হয়ে আছে। এতে একটু সাহস পেতে শুরু করলাম। সমস্ত অন্তরাত্মা এক করে ছায়ার দিকে তাঁকিয়ে হাঁক দিলাম, 'টালিয়াক!' কোনও উত্তর এলোনা। আবার হাঁকলাম, 'টালিয়াক'!

বন করে লাটিমের মতো ঘুরে গেলো একপাঁক। ভাসছে শুন্যে। আমি এখন বেশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি শয়তানটার নীলচে কালো চোখ। মোটা থ্যাবড়ানো ঠোঁট।

'টালিয়াক'! শুকনো গলায় আবার হাঁক দিলাম। মাটিতে পা ঝাপটা দিলাম। আমার ঠিক খেয়াল নেই তখন আমি আর কী কী করছিলাম তবে লিন্ডা পরে বলেছিল আমি নাকি এক পর্যায়ে জেরোমের চুলের মুঠি ধরে জঙ্গলের দিকে আঙুল উঁচিয়ে শুধু বলে যাচ্ছিলাম, 'টালিয়াক, টালিয়াক, টালিয়াক, টালিয়াক!' নন-স্টপ।

আমার হঠাৎ এই অবস্থা দেখে জেরোম খুব ভয় পেয়ে যায়। লিন্ডা আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করে। আমি তখনও কেঁপে কেঁপে চিৎকার করেই যাচ্ছি, 'টালিয়াক, টালিয়াক'। জেরোম একবার আমার দিকে তাকায়, একবার লিন্ডার দিকে তাকায়, একবার জঙ্গলের দিকে তাকায়। জঙ্গলে কাউকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে উঠে 'জিকালি, জিকালি। পুনাজেও, পুনাজেও। জি'কালি, পুনাজেও।'

কেমন একটা ঘোরের মধ্যে থাকলেও আমি বুঝতে পারছিলাম কিছু ঘটছে আমার চারপাশে। আমাকে নিয়ে অন্যদের ব্যতিব্যস্ততা ধরতে পারছিলাম।

'পুনাজেও। জি'কালি!' জেরোমের চিৎকার থেমে নেই।

হঠাৎ সটান দাঁড়িয়ে গেল ছায়াটা। মনে হলো যেন আকাশ ছুঁয়ে আছে। শূন্যে ভেসে আমাদের চারদিকে একপাঁক ঘুরেই মাথার উপর দিয়ে চোখের নিমিষে মিলিয়ে গেল।

ধপাস করে শব্দ হলো একটা।

Queen Elizabeth II Health Sciences Centre হাসপাতালে আবিষ্কার করলাম নিজেকে। জেরোম আর লিন্ডাকে পাশে দেখলাম। চোখে মুখে স্বস্তির হাসি।


পুনশ্চঃ
(১) আদিবাসীদের মিকমাক ভাষায় জি'কালি অর্থ go away, পুনাজেও অর্থ leave us alone.
(২) অ্যান্ড্রু, চার্লস, জেরোম বা লিন্ডা, কেউ-ই সেদিন কিছু দেখেনি।
(৩) লম্বা এই ছায়াকে জেরোম বংশপরম্পরায় জেনে এসেছে এই জঙ্গলের অভিভাবক হিসেবে।
(৪) জেরোম আর লিন্ডা এরপরের কয়েকটি দিন আড্ডা শেষে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতো।

মন্তব্য ১৬ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১০:৩৮

চাঁদগাজী বলেছেন:


আবার ডাব্বা মারছেন?

১২ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১০:৫৫

ডাব্বা বলেছেন: কেন?

২| ১২ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১১:০৫

চাঁদগাজী বলেছেন:



এটা কি গল্প, নাকি অভিজ্ঞতা?

১২ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১১:১৪

ডাব্বা বলেছেন: কালো জামা, কালো হ্যাট, কালো জুতা পায় - একটি অশরীরী অভিজ্ঞতা

৩| ১৩ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১২:০০

চাঁদগাজী বলেছেন:


গল্পনয়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা?

১৩ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১২:৫৫

ডাব্বা বলেছেন: আমার কিছু এধরনের অভিজ্ঞতা আছে।

৪| ১৩ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১২:১৪

কল্পদ্রুম বলেছেন: টালিয়াক, জিকালি, পুনাজেও এগুলো কোন ভাষার শব্দ? অভিজ্ঞতা হলেও একরকম ভৌতিক গল্পের স্বাদ পেলাম।

১৩ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১২:৫৮

ডাব্বা বলেছেন: একটা আদিবাসী গোষ্ঠীর ভাষা, মিকমাক। ধন্যবাদ আপনাকে।

৫| ১৩ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১:০০

রাজীব নুর বলেছেন: মনে হলো যেন বিদেশী গল্পের অনুবাদ পড়লাম।

১৩ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১:১৫

ডাব্বা বলেছেন: আপনার একটা পৌস্টে বলেছিলাম আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে এই সম্পর্কে। গুছিয়ে নিয়ে শেয়ার করলাম।

৬| ১৩ ই মার্চ, ২০২১ সকাল ১০:৩০

জুল ভার্ন বলেছেন: লেখায় যেমন নতুনত্ব, ভিন্নতা আছে -তেমনই গল্পেও মুগ্ধতা আছে।
সুন্দর!!!

১৩ ই মার্চ, ২০২১ রাত ৯:২৮

ডাব্বা বলেছেন: ধন্যবাদ জুল ভার্ন। সামনে আরো কয়েকটি ঘটনা শেয়ার করব, গল্প আকারে।

৭| ১৩ ই মার্চ, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৩৭

চাঁদগাজী বলেছেন:


লেখক বলেছেন: আমার কিছু এধরনের অভিজ্ঞতা আছে।

-আপনি তো ভালো ধরণের ডাব্বা মেরে যাচ্ছেন।

১৩ ই মার্চ, ২০২১ রাত ৯:২৯

ডাব্বা বলেছেন: ছোট বেলায় কোনও কিশোরীকে ভালো লেগে গেলে এভাবে প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে পাশে থাকতাম। ধন্যবাদ।

৮| ১৩ ই মার্চ, ২০২১ রাত ৮:২৬

সোহানী বলেছেন: চমৎকার একটা অশরীরী অভিজ্ঞতার গল্প। মনোমুগ্ধকর বর্ননা।

১৩ ই মার্চ, ২০২১ রাত ৯:৩২

ডাব্বা বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে সোহানী। একসময় Ghost hunting এর একটা টিম ছিল আমার। কোনও একদিন শেয়ার করব সেই অভিজ্ঞতা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.