![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাইরে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। কাল বৈশাখী ঝড়। এরকম ঝড়ে হাত-পা গুটিয়ে ঘরে নিরুপায় হয়ে বসে থাকতে হয়। তার উপর চলছে লোড-শেডিং।লেখক তার স্টাডিতে টেবিলের উপর এক তাড়া কাগজ নিয়ে বসে আছেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মাথা চলছে কিন্তু লেখকের কলম চলছে না। মোম বাতির শিখা অন্ধকারে কেঁপে কেঁপে উঠছে। কোন কোন সময় কলম থেকে আপনা আপনিই বের হয়ে আসে সাহিত্যের রসে ভরা অসংখ্য লাইন, যেগুলো পাতার পর পাতা এঁকে চলে কাহিনীর চরিত্রগুলো। কিন্তু লেখকের আজ কি হল? একটা লাইনও যে মাথায় আসছে না।
ঠক্! ঠক্! দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। লেখকের চিন্তার সবগুলো সূত্র ছিঁড়ে গেল। তিনি কিছুটা বিরক্তই হলেন। ঝড়জলের রাতে বোধ হয় কেউই অতিথি সেবা করে পূণ্য চাইবেন না।লেখক দরজার কাছে গিয়ে বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন- “ কে ? কি ব্যাপার?” দরজার অন্য পাশ থেকে উত্তর এল- ভাই, এই ছাই বৃষ্টির মাঝে আর দাঁড় করিয়ে রাখবেন না। দয়া করে একবার ভেতরে আসতে দেবেন ভাই? আর যে দাঁড়ানো যাচ্ছে না”
এমন নয় যে, লেখক খুব সহজেই লোকের কথায় গলে যান বা সাহায্যের জন্য তার দুই হাত আপনিই প্রসারিত হয়ে আসে। বরং তিনি কোন সামাজিকতার ধার ধারেন না। এদিক দিয়ে তার বেশ কুখ্যাতি আছে। কিন্তু দরজার অন্য পাশে দাঁড়ানো সাহায্য প্রার্থনাকারী লোকটার কন্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যা লেখককেও বিচলিত করে তুলল। লেখক সদর দরজা খুললেন, অবশ্যই খুব হৃষ্ট চিত্তে নয়।
আগন্তুক ঘরে ঢুকেই মেঝেতে জুতোর কাদা ছিটিয়ে মেঝেটাকে প্যাঁচপ্যাঁচে করে দিলেন। বর্ষাতিটা বন্ধ করার সময় লেখক্ কেও পানিতে ভিজিয়ে দিলেন। লেখক কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েই শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। সাথে সাথে দমকা হাওয়া এসে স্টাডির মোম বাতিটা নিভিয়ে দিল। লেখকের আগন্তুকের চেহারা দেখার উপায় থাকলো না। আগন্তুক বলে চললেন-“ দেখুন তো, অযথা আপনাকে এই ঝড়জলের রাতে বিরক্ত করছি। এজন্য আমার শাস্তি প্রাপ্য। আপনি নিশ্চয় কোনো কাজে ব্যস্ত ছিলেন।আমি অপদার্থের মত এসে নিশ্চয় আপনাকে এই বর্ষণমুখর সন্ধ্যার রস থেকে বঞ্চিত করলাম। কি বলেন? হা হা হা” কান ফাটানো হাসি দিয়ে আগন্তুক ঘরটাকে ভরিয়ে তুললেন। লেখক কিন্তু সে হাসিতে যোগ দেবার চেষ্টাও করলেন না। “ আসুন দেখি, স্টাডিতে গিয়ে বসা যাক।“ লেখক ও আগন্তুক অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে স্টাডিতে গিয়ে বসলেন।
এবার লেখকই শুরু করলেন,ভদ্রতার খাতিরে।অবশ্য গলায় আন্তরিকতা মেশানোর চেষ্টা করলেন না। “ তা নাম কী আপনার? কি করা হয়”? কড়াৎ কড়াৎ শব্দে পরপর তিন-চারটা প্রকাণ্ড বাজ পড়ল। আগন্তুকের পরিচয় সেই বাজের আওয়াজেই চাপা পড়ল। লেখক ব্যস্ত ভাবে দিয়াশলাই এর বাক্সটা খুঁজতে লাগলেন।মোমবাতিটা জ্বালান উচিত।
-“কি ভাই, কিছু খুঁজছেন নাকি?”
-‘হ্যাঁ। ম্যাচ বাক্সটা। অন্ধকারে বসে থাকলে নিজেকে ভূতের মত মনে হয়”।
-“ তা মনে হোক না। আমাকে আমার এক হিতাকাঙক্ষী একবার বলেছিলেন পৃথিবীর সব মানুষকেই একবার প্রেতাত্মার ভূমিকায় নামা উচিত। তাহলে পরকাল সম্পর্কে কিছুটা হলেও আইডিয়া হয়”।
-“কিন্তু প্রেতাত্মা সাজতে গিয়ে ম্যাচ না খুঁজে অন্ধকারে বসে থাকা কি খুব বুদ্ধিমানের কাজ”?
-“বুদ্ধিমানের কাজ না হলেও নির্বোধের কাজ তো নয়ই। স্রষ্টা সব বর্ষণমুখর সন্ধ্যাকেই তৈরি করেন মানুষকে তার নিত্যদিনের বিরক্তিতে ঠাসা জঘন্য সব কাজ থেকে রেহাই দেবার জন্য।’’
-“এওকি আপনার সেই হিতাকাঙক্ষীর বক্তব্য”?
-“ হা হা হা”-আবার সেই কান ফাটানো হাসি।লেখকের গা কাঁটা দিয়ে উঠল। তার ইচ্ছে করছে চেয়ারের উপর থম মেরে বসে থাকতে। কিন্তু আলাপী আগন্তুক তাকে সেই সু্যোগ দেবেন বলে মনে হয় না।
-“ম্যাচ খুঁজছিলেন ত? কোন জরুরী কাজ ছিল না কী?”-আগন্তুকের প্রশ্ন।
-“একটু লেখালেখি করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য কলম দিয়ে এক লাইনও বের হয়নি।’’
-“বের হবে কেমন করে? উত্তপ্ত মগজে আর যাই হোক, গল্পের প্লট এসে হাজির হয়না। এর জন্য চাই উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা।’’
-“আপনি প্লট খোঁজার ব্যাপারে P.H.D ডিগ্রী হাতিয়েছেন না কি?”
-“হা হা হা’’- আবার সেই হাসি। “ যাক আপনিও তাহলে তামাশা করতে জানেন। চাইলে আমি আপনাকে একখানা প্লট ধরিয়ে দিতে পারি।’’
-“ দিন তা হলে, বড়ই কৃতার্থ হই। পরে এসে বলবেন না আমার গল্প জোচ্চুরির ফসল।’’
-“আপনি বৃথাই এতো ভাবছেন। বেশিরভাগ লেখকই মনগড়া কাহিনীর বদলে নানা অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে লেখালেখি করেন।এখানে তো দোষের কিছু নেই।’’
-“তাহলে শোনান দেখি আপনার প্লট।’’
-“দাঁড়ান একটু আরাম করে বসে নিই, হুম……..।’’
আগন্তুকের চেয়ারটা কচকচ করে উঠল।
-“একজন বেকার যুবক, বাড়িতে প্রচণ্ড অভাব। কিন্তু চাকরি খোঁজার চেয়ে লেখালেখিতেই তার আগ্রহ বেশি।তার লেখনীতে রসও আছে।কিন্তু কবিতা বা উপন্যাস কেবল মনের খোরাকই জোগাতে পারে, তাতে পেট চলে না। কি ভাই, শুনছেন না কি বিরক্ত লাগছে?’’
-“না না আপনি বলে যান।’’
-“ তা সেই বেকার যুবক তার লেখা উপন্যাসের একটা পাণ্ডুলিপি নিয়ে চলে এলো ঢাকায়। সে ছিল লেখকের বিশাল ভক্ত। লেখককে সে তার পাণ্ডুলিপি দেখালো। লেখকও সন্তুষ্ট হলেন যুবকের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে।তিনি আশা দিলেন খুব দ্রুতই এই পাণ্ডুলিপি উপন্যাস আকারে বেরোবে। যুবকও হৃষ্ট চিত্তে বাড়ি ফিরে গেল। কিছুদিন পর উপন্যাস তো বের হলো, কিন্ত যুবকটি লেখকের পরিচয় পেল না।বরং যে লেখককে মনে মনে সে পূজা করত, সেই লেখকই হাতিয়ে নিল তার শ্রমলব্ধ কাহিনী। তার কাহিনী দেশজুড়ে প্রশংসা কুড়াচ্ছে অথচ সে-ই পেল না তার পুরষ্কার।লেখক চাইল নিজেকে লেখকের মুখোমুখি দাঁড় করাতে। মফস্বলে সংবর্ধনা নিতে এসেছিলেন লেখক।এক ঝড়জলের রাতে রেল লাইনের পাশ দিয়ে দ্রুত হাঁটছিলেন তিনি। ইচ্ছে করেই লোকজন সঙ্গে আনেননি। এমন সময় সেই যুবকের মুখোমুখি হলেন তিনি। যুবকের প্রতিশোধ নেবার কোনো ইচ্ছাই ছিলনা। সে শুধু জানতে চাইল কেন লেখক তার স্বপ্ন এভাবে চুরমার করে দিলেন।লেখক বরাবরই সব কিছু অস্বীকার করতে থাকেন। একসময় রেললাইন কাঁপিয়ে দৈত্যের মত একটা ট্রেন আসতে থাকে।লেখক যুবককে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন রেললাইন এর ওপর।এক নিমেষে যুবকের সব স্বপ্নের সাথে জীবনটাও ট্রেনের চাকার তলে পিষ্ট হয়ে গেল, ধ্বংস হয়ে গেল।’’
আগন্তুকের চেয়ারটা কচকচ শব্দ করেই যাচ্ছে।
-“প্লটটা কেমন লাগল সেলিম ভাই? দারুণ নয়? আপনার জবরদস্ত লেখনী আর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার জোরে গল্পটা জমবে ভাল।’’
লেখক এতক্ষণে ম্যাচ খুঁজে পেয়ে মোমবাতিটা জ্বালালেন।কাঁপা কাঁপা হাতে তুললেন তা আগন্তুকের মুখের সামনে।মুখটা রক্তে মাখা। পরনের সাদা শার্টটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু ঠোঁটের এককোণে ঠিকই একটা তাচ্ছিল্য মেশান হাসি ঝুলে আছে।
-“ওমর তুমি?” লেখক কোনমতে শব্দ দুইটি উচ্চারণ করলেন।“তুমি তো মরে গেছ।’’
-“কবেই ত আপনি আমাকে মেরে ফেলেছিলেন সেলিম ভাই। আজও কি আপনি আপনার পাপের কথা অস্বীকার করবেন?আমি কিন্তু কোনো প্রতিশোধ নিতে আসিনি।কেবল একবার পাপ স্বীকার করুন।’’
লেখক দুই হাতে তার বুক চেপে বসে পড়লেন। বাইরে তখনো ঝড় হয়েই যাচ্ছে। ঝড়ের মাঝে এই ঘরটাতে কি ঘটলো তা কেউই জানতে পারল না।
পরদিন সব কটা খবরের কাগজে বেরোল লেখকের মৃত্যু সংবাদ। মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়…………………………….।
©somewhere in net ltd.