![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
https://www.facebook.com/firefromtheclouds
নভেম্বর (দ্বিতীয় সপ্তাহ), ১৯৭০
রাওয়ালপিন্ডি, পশ্চিম পাকিস্তান
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম উনি বর্তমানে সি-১৩০ ট্রান্সপোর্ট স্কোয়াড্রনে কর্মরত। উনার পোস্টিং এখন রাওয়ালপিন্ডিতে। ১২ নভেম্বরের ভয়াবহ ঘূর্নিঝড় আর জ্বলোচ্ছাসের (ভোলা সাইক্লোন) পর উনারা যারা পশ্চিমে ছিলেন তারা টিভি কিংবা রেডিওতে শুনলেন যে পূর্বে ঘূর্নিঝড় আর জ্বলোচ্ছাস হয়েছে এবং তাতে অনেক লোকজন মারা গেছে। কিন্তু তা যে কতটুকু ভয়াবহ সরকারী গনমাধ্যম থেকে আমরা বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারলেননা। তবে বিবিসি কিংবা ভয়েস অব আমেরিকা অথবা ইন্ডিয়ান রেডিও থেকে উনারা জানতে পারলন যে ভয়াবহ এক দূর্যোগ হয়েছে সেখানে আর লাখ লাখ লোক মারা গেছে। কিন্তু সেটা যে কতটা ভয়াবহ সেটা তখনো এতটুকু আঁচ করতে পারেননি।
বাঙ্গালী রাজনীতি,জাতীয়তাবোধ কিংবা দেশের হালচাল এসব নিয়ে সাধারন কৌতুহলের বাইরে তেমন বিশেষ কিছু আগ্রহ ছিলনা উনার। তবে বাঙ্গালী অফিসার হিসেবে বাঙ্গালীদের কোন ভালো খবরে উনিও আনন্দিত হতেন যেমনটা খুব সাধারনভাবেই হবার কথা। ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর পশ্চিম পাকিস্তানে সব বাঙ্গালী অফিসারেরা অনেক খুশী হয়েছিল, পার্টি করেছিল। ব্যাস,এটুকুই। সাধারনভাবে তাদের তেমন কোন ধারনা ছিলনা যে পশ্চিম আর পূর্বের মধ্যে বৈষম্য কেন আর কতটুকু আছে।
২২ নভেম্বর, ১৯৭০
রাওয়ালপিন্ডি, পশ্চিম পাকিস্তান
সেই দূর্যোগের প্রায় ২০ দিন পর ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলমের স্কোয়াড্রনের উপর নির্দেশ এসেছে যে উনাদের ঢাকাতে স্বানান্তরিত হতে হবে। তবে কেবল মাত্র একটি সি-১৩০ আর কিছু কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিমানে অল্প কিছু ত্রান নিয়ে উনারা রওনা হলেন ঢাকার দিকে। তখন তাদের অনেক ঘুরে শ্রীলংকা হয়ে ঢাকা আসতে হতো ।
(এর কারন ছিলো, কিছু পাকিস্তানী অথবা ভারতীয় দুস্কৃতিকারী (খুব সম্ভবত আইএসআই এর মদদপুষ্ট ) একটি ভারতীয় বিমান ছিনতাই করে পাকিস্তানে নিয়ে যেতে বলে, এরপর করাচীতে অবতরনে বাধ্য করা হয় সেই বিমান। এরপর তারা ভারতীয় সরকারের কাছে বিপুল অর্থ দাবী করে। ভারত সরকার দিতে রাজী না হওয়ায় যাত্রীসহ সেই বিমান উড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর ভারত সরকার পালটা ব্যবস্থা হিসেবে ভারতের উপর দিয়ে পাকিস্তানী বেসামরিক বিমানের ওভার ফ্লাইও বন্ধ করে দেয়।)
২৪ নভেম্বর, ১৯৭০
তেজগাও এয়ারপোর্ট, ঢাকা
উনি বেশ অনেকদিন পর ঢাকা এসেছেন। ঢাকা এয়ারপোর্টের উপরে আসার পর পরই বেশ অবাক হলেন উনি। শুধু অবাক না, উনি ভাবতে থাকলেন, “আমি এসব কি দেখছি?” ঢাকা এয়ারপোর্টের উপর দিয়ে তাদের বেশ অনেক্ষন সার্কিট করতে হল কেবল ল্যান্ড করার জন্য কিছু জায়গা খুঁজে পেতে। না, রানওয়ে কিংবা এয়ারপোর্টের কোন ক্ষতি হয়নি। উনি অবাক হয়েছিলেন এ কারনে যে, এয়ারপোর্টে শত শত বিমান, নতুন কোন বিমান ল্যান্ড করার সুযোগ পর্যন্ত নেই!! পৃথিবীর প্রতিটি কোণ থেকে নানা জাতি তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আর ঢাকা এয়ারপোর্টে তাই শতশত বিমান,আর উনারা নিজের দেশের মধ্যে থেকেই সাহায্য নিয়ে হাজির হয়েছেন ঠিক ২২ দিন পর!!
হ্যা,ঠিক ২২ দিন পর!!
(১৯৭০ এর সাইক্লোনের পর বাংলাদেশে প্রায় ৩৮ টি হেলিকপ্টার ত্রান এবং উদ্ধার কাজে নিয়োজিত ছিল। এর মধ্যে কেবল একটিও পাকিস্তানী ছিলনা। পাকিস্তান সরকার দাবী করে ভারতীয় আকাশ পথ অবরোধের কারনে তারা পূর্বে হেলিকপ্টার এবং অন্যান্য যন্ত্র স্থানান্তর করতে পারেনি। কিন্তু ভারত সরকার এই দাবী অস্বীকার করে। ভারতীয়দের যে যাই বলুক, ৭০ এর এই দূর্যোগের পর সবচেয়ে প্রথম সাহায্যের হাত তারাই বাড়িয়ে দেয়। ভারত সরকার সেই সময়ের প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার সাহায্য হিসেবে প্রদান করে একটি গরীব দেশ হওয়া সত্ত্বেও। পশ্চিম বঙ্গের সামরিক বিমান এবং জাহাজের মাধ্যমে ত্রান এবং উদ্ধার কাজে অংশ নেবার প্রস্তাবও দেয়া হয়। কিন্তু পাকিস্তান সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এমনকি বেসামরিক কোন বিমানকেও পূর্ব পাকিস্তানে ত্রান নিয়ে আসতে দেয়া হয়নি ভারত থেকে। সকল ত্রান স্থল পথে সীমান্ত থেকে ধীর গতিতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। )
২৫ নভেম্বর, ১৯৭০
পূর্ব পাকিস্তান, উপকূলীয় অঞ্চল
ঘূর্ণিঝড়ের ২৩ দিনের দিন উনারা ত্রান ফেলতে এসেছেন। রায়পুরা, হাতিয়া আর উপকূলীয় নানা দ্বীপের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলেন উনারা। কিন্তু প্রানের কোন চিহ্ন দেখছিলেন না। এমন কাউকে পাচ্ছিলেননা কিংবা কোন নাড়াচাড়া দেখছিলেন না যেটা দেখে তাদের উদ্দেশ্যে কিছু দিতে পারতেন। উনারা নীচে নামতে থাকলেন, ৫০০০ ফিট, ২০০০ ফিট, ১০০০ ফিট, কিন্তু কোন জীবিত প্রানীই দেখতে পাচ্ছিলেন না। পুরো অঞ্চল দুমড়ে মুচড়ে গেছে। সে বর্নণা অন্য এক আলাদা অধ্যায়। তবে ১০০০ ফুতে নেমে আসার পর আমরা মাটির উপর কালো কালো কিসের যেন সারি সারি দাগের মত দেখতে পাচ্ছিলেন। তাদের কৌতুহল হয়। তারা আরো নীচে আসেন, ৫০০ ফিট, ৩০০ ফিট, ২০০ ফিট… তাদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। উপর থেকে যেসব কালো কালো দাগের মত দেখছিলেন,সেসব আসলে মৃতদেহ। মানুষ,গবাদিপশু সবার মৃতদেহ। সাগরের পানি সরে যাবার পর মৃতদেহগুলো মাটির উপর সারি সারি হয়ে পরে আছে। এতদিনেও কেউ তাদের সরাতে আসেনি। পঁচে গিয়ে কালো কালো দাগের মত দেখাচ্ছিলো উপর থেকে। এই ঘটনাগুলো উনি সেভাবে নিজের কাছে কিছু বন্ধু আর পরিবারের লোক ছাড়া কাউকে সেভাবে কখনোই বলেননি। কিন্তু জীবনের শেষে এসে হয়তো একসময় উনার ইচ্ছা হবে আসলে কি হয়েছিলো তার কিছু কিছু ঘটনা পরের প্রজন্মকে জানিয়ে যাবার।
সেই রাতে উনি ঠিকমত ঘুমাতে পারলেননা। প্রথমবারের মত বুঝতে পারছিলেন বাঙ্গালীদের সাথে বড় ধরনের কোন বৈষম্য করা হচ্ছে যেটা উনারা পশ্চিমে থেকে খোলা চোখে ধরতে পারেননি, কিংবা চেষ্টাও করেননি সেভাবে।
(সাইক্লোন আঘাত হানবার পরদিন তিনটি নেভাল বোট এবং একটি হসপিটাল শিপ হাতিয়া, সন্দীপ এবং অন্যান্য এলাকার উদ্দেশ্যে উদ্ধার কাজে গমন করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নভেম্বরের ১৬ তারিখ চীনে রাষ্ট্রীয় সফর স্থগিত করে পূর্ব পাকিস্তানে এসে দূর্গত এলাকার উপর দিয়ে বিমান থেকে উড়ে উড়ে দেখে যান। তিনি দূর্গতদের উদ্ধারে ঘোষনা দেন, “no effort to be spared”। তিনি সকল জায়গায় রাষ্ট্রীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দিলেন, সেই সাথে শোক দিবস পালনের ঘোষনা দিলেন ২১ শে নভেম্বর। সাইক্লোন আঘাত হানার ৭ দিন পর। প্রায় ৪০ টি দেশের উদ্ধারকারী দল এদেশে এসে পৌছায় সাইক্লোনের ২ সপ্তাহের মধ্যে, জাপানী পার্লামেন্টে সমালোচনা হয় যথাযথ সাহায্য না পাঠাবার জন্য। যে কারনে আবারো জাপানী উদ্ধারকারী দল ত্রান এবং বিমান সহ এদেশে এসে পৌছায় ২ সপ্তাহের মধ্যেই। কিন্তু পাকিস্তানী বিমান প্রথম ত্রান কাজের জন্য উড্ড্যন করে সাইক্লোনের তিন সপ্তাহ পার হবার পর!! )
৩রা মার্চ, ১৯৭১
করাচী, পশ্চিম পাকিস্তান
পিআইএ এর একটি বোয়িং ৭০৭ টেকঅফের জন্য তৈরী। সেই বিমানের কো পাইলট ক্যাপ্টেন নিজাম আহমেদ চৌধুরি। করাচি – ঢাকা নিয়মিত ফ্লাইটের জন্য সবই প্রস্তুত। প্রসিডিউর অনুযায়ী উড্ডয়নের আগে লোড শিট (যাত্রী সংখ্যা, মালামালের হিসেব এবং তেল ইত্যাদি সংক্রান্ত তথ্য এতে লেখা থাকে) দেখে নেবার কথা, নিজাম আহমেদ চৌধুরী তা চেক করে বেশ অবাক হলেন। লোড এবং যাত্রী কোনটাই নিয়মিত ফ্লাইটের মতো নয়। সর্বোচ্চ সংখ্যক যাত্রী এবং মালামালের উল্লেখ আছে সেই লোড শিটে, যদিও যাত্রীদের সবাই বেসামরিক। তবু উনার সন্দেহ হল। উনি কো পাইলটের আসন ছেড়ে যাত্রীদের দেখতে বিমানের ভেতরে ঢুকলেন এবং অবাক হলেন। কারন এদের একজনও বেসামরিক যাত্রী নয় তা পোষাক, চুল এবং হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছিলো।
তিনি এমনিতেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নিজের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ নিয়ে খুশী ছিলেননা। তিনি বুঝতে পারলেন এটা এক অশুভ সংকেত। তিনি প্রধান পাইলটের সাথে তর্কে লিপ্ত হন এবং এক পর্যায়ে এই ফ্লাইট নিয়ে যেতে অস্বীকার করে বিমান থেকে নেমে যান। সামরিক কর্তুপক্ষের আদেশে গ্রেফতার করা হলো নিজাম আহমেদ চৌধুরিকে এবং তাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হলো। অন্য আরেক পাকিস্তানী ক্যাপ্টেনকে কো-পাইলট হিসেবে রিপ্লেস করে ফ্লাইট চালনা করা হলো।
(এরপর পুরো ৭১ জুড়েই আর কোন বাঙ্গালী বৈমানিক এই রুটে উড্ডয়ন করেননি। আভ্যন্তরীন কিছু রুটে মার্চের ২৫ তারিখ পর্যন্ত ফ্লাইট পরিচালনায় ছিলেন কিছু বাঙ্গালী বৈমানিক। তবে নিজাম আহমেদ চৌধুরীর ভাগ্য ভালোই ছিলো কারন উনার স্ত্রী ছিলেন একজন জার্মান নাগরিক যিনি ওই সময় ঢাকায় ছিলেন। বেশ কিছুদিন খোজ না পেয়ে উনি জার্মান দুতাবাসের মাধ্যমে পাকিস্থান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেন।তাকে মুক্তি দেয়া হয় কিন্তু সেইসাথে পিআইএ থেকে বরখাস্ত করা হয়। ৭১ এর বাকীটা সময় তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে অন্তরীন করে নজরদারীতে রাখা হয়। এরপর স্বাধীনতার পর উনি করাচী থেকে ঢাকা পালিয়ে আসেন।)
নিজাম আহমেদ চৌধুরির এই ঘটনা অন্যদেরও প্রভাবিত করে। যাদের অনেকেই পাকিস্তান ত্যাগ করে দেশের বাইরে চলে যান এদের মধ্যেই ৪ জন পরে কিলো ফ্লাইটে যোগ দেন। কিলো ফ্লাইটের ৯ জন বৈমানিকের মধ্যে ৬ জন ছিলেন সিভিল পাইলট, যাদের ৪ জন পি আই এ এবং বাকী ২ জন কৃষি অধিদপ্তরের অধীনে কাজ করতেন।
পিআইএর এমন চারজন পাইলটের কথা জানা যায় যারা ২৬ মার্চের পর ঢাকা ত্যাগ করতে পারেননি। পরবর্তীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের এপ্রিল এর প্রথম সপ্তাহে গ্রেফতার করে এবং এপ্রিল মাসের মধ্যেই ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ এবং নির্যাতনের পর তাদের সবাইকে হত্যা করে। উনারা হচ্ছেনঃ
- ক্যাপ্টেন সিকান্দার আলী, জেষ্ঠ্যতম বৈমানিক, পুর্ব পাকিস্তান
- ক্যাপ্টেন আবু তাহের মোহাম্মদ আলমগীর
- ক্যাপ্টেন এন এস হায়দার
- ক্যাপ্টেন আমিনুল ইসলাম
মার্চ (দ্বিতীয় সপ্তাহ), ১৯৭১
রাওয়ালপিন্ডি, পশ্চিম পাকিস্তান
সবকিছুর বাইরে পশ্চিম পাকিস্তানীরা যে কোন একটা পরিকল্পনা করছে সেটা অনেকের মত ফ্লাঃ লেঃ আলমও বেশ কিছুদিন আগেই টের পান। হুট করে একসময় নির্দেশ আসলো যে উনাদের কিছু ‘স্পেশাল যাত্রী’ পরিবহন করতে হবে। সেই সময় স্কোয়াড্রনের লোড মাস্টারদের প্রায় সকলেই ছিল বাঙ্গালী। একদিন উনাকে বাঙ্গালী এক লোড মাস্টার বললো,
- “স্যার, এরা যে যাত্রী নিয়ে ঢাকা যাচ্ছে, এরাতো আসলে সবাই সৈনিক।“
উনি বললেন,
- “ আমাকে একটা প্যাসেঞ্জারস লিস্ট কার্বন কপি করে দিতে পারবে নাকি।“
লোডমাস্টার বললো যে সে পারবে। উনি লিস্ট পেয়ে দেখলেন সত্যিই তাই। উনার এক পরিচিত আত্মীয় ছিল শেখ মুজিবের খুব ঘনিষ্ঠ। তাকে উনি ব্যক্তিগতভাবে সেই লিস্টের একটা কপি দিয়ে অনুরোধ করলেন যেভাবেই হোক শেখ মুজিবুর রহমানকে পৌছে দিতে। সেটা পৌছেছিলো নাকি উনার হয়তো কখনোই জানা হবেনা।
২৬ মার্চ, ১৯৭১
রাওয়ালপিন্ডি, পশ্চিম পাকিস্তান
ফ্লাঃ লে; শামসুল আলম এবং অন্য বাঙ্গালী অফিসারেরা বুঝতে পারলেন যে পূর্বে বড় ধরনের কিছু হয়েছে যখন ২৬ মার্চ সকল বাঙালি অফিসারদের গ্রাউন্ডেড করা হল। যার মানে হচ্ছে বাঙ্গালী অফিসারেরা ফ্লাই করতে পারবেনা। পাকিস্তানী টিভি আর রেডিওতে শুনলেন যে সামান্য গন্ডগোল হয়েছিলো যা সামলে নেয়া হয়েছে। পূর্বে শান্তি বিরাজ করছে। তবে রাতে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা এসবে শুনে উনারা জানতে পারেন যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে পূর্বে।
উনাদের উপর সারাক্ষন নজরদারী ছিলো এটা উনারা বুঝতে পারতেন। পূর্বে পরিস্থিতি যে খুব ভয়াবহ সেটা আরো নিশ্চিত হলেন কর্নেল জিয়াউদ্দীন নামে আর্মি হেডকোয়ার্টারের এমএস ব্রাঞ্চে (কর্মকর্তাদের বদলী, স্থানান্তর, প্রসাশনিক বিষয়াদী এবং অন্যান্য ব্যাপার এমএস ব্রাঞ্চ দেখভাল করে) কর্মরত এক বাঙ্গালী সামরিক কর্মকর্তার মাধ্যমে। উনি তাকে বললেন,পূর্বে ভয়াবহ অবস্থা। প্রতিদিন অনেক অনেক আহত নিহত হবার খবর আসছে। পুরোদমে যুদ্ধের মত চলছে বলেই মনে হচ্ছে।
(আমার ধারনা মতে পাকিস্তানী বাহিনীর যুদ্ধের সময় যতটা হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল, তার ৬০ ভাগ হয়েছিল ২৬ মার্চ রাত থেকে ২০ শে এপ্রিল এবং এরপর ২১ নভেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে। এ কারনে যুদ্ধ শুরু হবার কিছুদিনের মধ্যেই পুর্ব থেকে পশ্চিমে এমএস ব্রাঞ্চে হাজার হাজার হতাহতের খবর (যার মধ্যে অন্তত ১০০ জন অফিসার) আসা পশ্চিমাদের জন্য মারাত্মক ব্যাপার ছিল। ২৬ মার্চ থেকে ২০ শে এপ্রিলের মধ্যে ইপিআর, ইস্টবেগল রেজিমেন্ট এবং নানা জায়গার বাঙ্গালী পুলিশের প্রি এম্পটিভ স্টাইক এবং এম্ব্যুশে অন্তত ৩০০০ হাজার পাকিস্তানী সেনা এবং অফিসার মারা যায় অথবা যুদ্ধবন্দী হিসেবে ধৃত হয়,যাদের কিছুদিন পর বিএসএফের হাত ঘুরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে স্থানান্তর করা হয়। এরমধ্যে পাকিস্তানীরা সবচেয়ে বেশি লোকবল ক্ষয় করে চট্টগ্রামে,এরপর রাজশাহী এবং যশোরে। বাঙ্গালী সামরিক অফিসার,সেনা এবং পরিবার বর্গের উপর সবচেয়ে বেশি নৃশংশতার ঘটনা ঘটে কুমিল্লায়,যেখানে প্রায় ১১০০ বাঙ্গালী অফিসার এবং সেনাকে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে (ইবিআরসি) অতর্কিত হামলা করে হত্যা করা হয় প্রশিক্ষণরত প্রায় ৫০০ সেনা এবং অফিসারকে।)
উনি কর্নেল জিয়াউদ্দীনকে জিজ্ঞেস করলেন,
- “স্যার আমাদের কি করা উচিত?“
উনি বললেন,
- “যা করবে নিজের বুদ্ধি দিয়ে কর। এমনকি বাঙ্গালী কাউকেও বলবার দরকার নেই। কাউকে বিশ্বাস করোনা।“
সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে দেশে কিংবা ভারতে পালানো অসম্ভব মনে হচ্ছিলো। তবু ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সামসুল আলম,জিডি(পি),পাক ৪৯২১, সিদ্ধান্ত নিলেন যে উনি দেশে চলে যাবেন আর সেটা যেভাবেই হোক!!
৩রা এপ্রিল, ১৯৭১
প্রধানমন্রীর কার্য্যালয়, দিল্লী
তাজউদ্দীন আহমেদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করবার সুযোগ পেয়েছেন, তিনি নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। তাকে কোলকাতা থেকে সরাসরি দিল্লী উড়িয়ে আনা হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী উনাকে জিজ্ঞেস করলেন,
- “ আপনারা কি সত্যি স্বাধীনতা চান?”
তাজউদ্দীন আহমেদ জবাব দিলেন,
- “আমরা স্বাধীনতা চাই।“
ইন্দিরা গান্ধী বললেন,
- “তাহলে আপনাদের দেরী না করে খুব দ্রুত স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করতে হবে। আপনাদের স্বাধীনতার জন্য যা করা প্রয়োজন আমাদের সামর্থ্যের সবটূকু দিয়ে আমরা করবো।“
এপ্রিল (দ্বিতীয় সপ্তাহ), ১৯৭১
দাউদকান্দি ফেরী ঘাট, কুমিল্লা
স্কোঃ লীঃ সুলতান মাহমুদ (পরবর্তীতে এয়ার ভাইস মার্শাল এবং বিমান বাহিনী প্রধান) তার এক বন্ধুর ভক্সওয়াগেন গাড়িতে করে দাউদকানী ফেরী ঘাটে পৌছেছেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে এরপর সীমান্ত পার হয়ে আগরতলা পৌছানো। ঘাটে তার বেশভুষা, হাবভাব এবং চুলের কাটিং দেখে স্থানীয় কিছু পাকিস্তানপ্রেমীর সন্দেহ হলো। তারা সেখানে পাকিস্তানীদের হয়ে দ্বায়িত্বপালন লক্ষ্য রাখছিলো যাতে সেনাবাহিনী কিংবা ইপিআর এর কোন সদস্য নদী পার হয়ে ওপারে সহজে যেতে না পারে। যাকেই সন্দেহ হচ্ছিলো তাকেই তারা তুলে নিচ্ছিলো। সুলতান মাহমুদকেও তারা চ্যালেঞ্জ করে বসলো।
দূর থেকে এই অবস্থা দেখে তার বন্ধু গাড়ি নিয়ে সটকে পড়লেন সুলতান মাহমুদকে ভাগ্যের হাতে সপে দিয়ে। সুলতান মাহমুদ কিছু সময় কথা চালিয়ে গেলেন এবং প্রমত্তা মেঘনা নদীতে ঝাপিয়ে পড়লেন সুযোগ বুঝে আর কোন উপায় না দেখে। পরে জোয়ারের টানে অপর পাড়ে গিয়ে উঠলেন ভাগ্যক্রমে।
কিছুদিনপর তিনি বর্তমান বাক্ষনবাড়িয়ার নবীনগর হয়ে ভারতে পৌছাতে সক্ষম হবেন। ভাগ্যিস ওইসব লোকেদের হাতে তখনো অস্ত্র দেয়া শুরু করেনি পাকিস্তানীরা।
(উনি মতিউর রহমানের কোর্সমেট ছিলেন, শ্রীলঙ্কা হয়ে ছুটিতে এসেছিলেন ঢাকায় মার্চের প্রথম দিকে। এরপর অক্টোবরের প্রথমদিকে তিনি সদ্য গঠিত বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ এবং গৌরবজনক ইতিহাসের সাক্ষী হবেন। বাহিনী গঠিত হবার কয়দিন পর যোগ দেবেন কারন এর আগে ১নং সেক্টরে স্থলযুদ্ধে (মদুনাঘাট পাওয়ার সাব-ষ্টেশন অভিযান) অংশ নিয়ে পায়ে গুলি লাগার কারনে কিছুদিন চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিলো। প্রথমে ২নং সেক্টরে যুদ্ধ করলেও পরে হাই কমান্ডের নির্দেশে ১নং সেক্টরে যোগ দেন।)
এপ্রিল (মাঝামাঝি কোন সময়), ১৯৭১
করাচী, পশ্চিম পাকিস্তান
ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলম এবং অন্যান্য বাঙ্গালী অফিসারদের তখন তেমন কোন কাজ ছিলনা অফিসে। নজরবন্দী হিসেবে থাকছিলেন, অল্প কিছু দাপ্তরিক কাজ ছাড়া অন্য কোন কিছুতে তাদের টানা হতনা। এর মধ্যে উনি ছুটি চাইলেন ১ মাসের জন্য পারিবারিক কারন দেখিয়ে। অবাক করে দিয়ে তার ছুটি মঞ্জুর করা হল। পুরো ১ মাসের ছুটি!
উনার বোন তখন থাকতেন করাচীতে। ছুটি নিয়েই করাচী চলে গেলেন। উনার কাছে তখন প্রায় ৬০ হাজার রুপী ছিল। ৬০ হাজার রুপী তখন অনেক অনেক টাকা! পুরো মাস জুড়ে সেই ৬০ হাজার রুপীর ৫০ হাজার রুপী তুলে ফেললেন হাবীব ব্যাংক থেকে। এরপর ভাবলেন কাজে যোগ দেবেন নাকি ভারতে পালিয়ে যাবেন? কিন্তু কাজে যোগ দেয়ার ব্যাপারে কিছুতেই অনকে বোঝাতে পারলেন না। আবার ভারতে পৌছানোটাও অনেক দুরুহ ছিল। এজন্য শেষ মুহুর্তে অন্য একটা সিদ্ধান্ত নেন। উনি করাচী থেকে প্রথমে রাওয়াল্পিন্ডির প্লেনের টিকেট কাটলেন। আবার একই সাথে ঢাকার টিকেটও কাটলেন। স্কোয়াড্রনে জানিয়ে দিলেন যে রাওয়াল্পিন্ডি ফিরছেন।
করাচী থেকে ঢাকার প্লেনে চেপে বসলেন উনি। মনে মনে বেশ খুশিই ছিলেন যে পাকিস্তানীদের ধোঁকা দিতে পেরেছেন এবং যথাসময়ে ঢাকায় এসে পৌছাবেন।
এপ্রিল (মাঝামাঝি কোন সময়), ১৯৭১
ঢাকা, পূর্ব পাকিস্তান
ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলম কিছুক্ষন আগে ঢাকা পৌছেছেন। পৌছানোর পরই অদ্ভুত একটা ব্যাপার দেখলেন। পুরো বিমানবন্দর সৈন্যে ভরা আর তেমন কোন শ্রমিকই চোখে পড়ছেনা। উনি উনার লাগেজ খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু অনেক পরেও যখন এসে পৌছালোনা, তখন খোঁজে বের হলেন। উনার পরিচিত এক বিমান বাহিনীর অফিসারকে চোখে পরে গেলেন হুট করেই। সেই অফিসার উনাকে জিজ্ঞেস করলেন,
- “আরে আলম, তুমি এখানে কি মনে করে?”
উনি জবাব দিলেন,
- , “অনেকদিন দেশে আসা হয়না, তাই ছুটি নিয়ে বাড়িতে বেড়াতে আসলাম।“
সেই অফিসার বললো,
- “তো কি খুঁজছো?”
জবাব দিলেন,
- “লাগেজ খুঁজছি, এখনো এসে পৌছাচ্ছেনা কেন বুঝতে পারছিনা।“
সেই অফিসার বললো,
- “এসে যাবে, ওদিকে গিয়ে দেখো। বাঙ্গালী আনলোডাররা নেইতো, তাই এখন ঝামেলা হচ্ছে। অপেক্ষা কর, পেয়ে যাবে।“
এর একটুপর উনি উনার লাগেজ দেখতে পেলেন। তবে সেই অফিসার আরো কয়জন সহ উনার কাছে চলে এলো। বললো,
- “শহরের অবস্থা তো খারাপ, যাবে কিভাবে?”
উনি বললেন,
- “সেটা সমস্যা হবেনা। কোন কিছু জোগাড় করে চলে যাব।“
সেই অফিসার বললো,
- “দেখ, আমি একটা গাড়ি ম্যানেজ করেছি, তুমি ওটাতে করে চলে যাও। “
উনি জবাব দিলেন,
- , “না থাক, আমি নিজেই কিছু একটা জোগাড় করে চলে যাব।“
তবু সেই অফিসার উনাকে প্রায় বাধ্য করলো গাড়িতে উঠতে শহরের নানা পরিস্থিতির কথা বলে। গাড়ি এগিয়ে চলছিলো। কিন্তু ফ্লাঃ লেঃ আলম খেয়াল করলেন যে সেগুনবাগিচার দিকে না গিয়ে গাড়ি যাচ্ছে এখনকার যে প্রধানমন্ত্রী কার্য্যালয় আছে, তার সামনের রাস্তা দিয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে। জিজ্ঞেস করতেই উনাকে বলা হল, এখানে কিছু কাজ আছে, এরপর আমাকে বাড়ি পৌছে দেয়া হবে। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হল বর্তমানে এয়ারফোর্স মেসের ওখানে। নিয়ে বললো,
- “তুমি চেঞ্জআপ করে নাও ওই রুমে গিয়ে। আমার অল্পকিছু সময় দেরী হবে।“
ফ্লাঃ লেঃ আলম লাগেজ বের করে ওই রুমে প্রবেশ করলেন। এরপরেই বাইরে থেকে খট করে আওয়াজ আসলো দরজা আটকে দেবার। জানালার ওখান থেকে তাকে বলা হল,
- “আমরা জানি তুমি কিভাবে এখানে এসেছো। পালাবার চেষ্টা করে লাভ নেই।“
এরপর রাতে তাকে খেতে দেয়া হল। আর কয়েকজন এসে তার লাগেজ চেক করলো। ব্যাগে এতো টাকা দেখে বললো,
- “তুমি এতো টাকা কেন নিয়ে এসেছো?”
উনি জবাব দিলেন,
- “অনেকদিন পর বাড়িতে আসছি। বাড়িতে কাজ করাবো, এজন্য নিয়ে এসেছি।“
এরপর উনার সকল লাগেজ নিয়ে যাওয়া হয়, যার কিছুই আর ফেরত পাওয়া হবেনা। ঘরে কেবল একজোড়া স্যান্ডেল, জুতা, শার্ট, প্যান্ট আর পরনে লুঙ্গি ফতুয়া। এভাবেই সকাল হল, বাইরে গার্ড ছিল, কড়া পাহারা। উনি বুঝতে পারছিলেন এখন পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। কিছুটা সময়ের জন্য নিজেকে ভাগ্যের কাছে ছেড়ে দিতে হবে…
সকালে উনাকে বেশ ভালো নাস্তা করানো হল। একটু পর সেই অফিসার আবার আসলেন। উনাকে বললেন,
- “আলম, তোমাকে একটু যেতে হবে আমার সাথে, বেশি সময় নেই, যেভাবে আছো সেভাবেই চল।“
উনি বললেন,
- “আমি একটু ড্রেস চেঞ্জ করে আসি, জুতা পড়ে নেই।“
সেই অফিসার জবাব দিলো,
- “ এর কোন দরকার নেই।“
উনি প্যান্ট, শার্ট আর সাথে স্যান্ডেল পড়ে গাড়িতে উঠে পড়লেণ। টাকে নিয়ে যাওয়া হল কুর্মিটোলার দিকে। ওখানে একটা আর্মি ইউনিট ছিল বলে জানতেন, খুব সম্ভবত সেখানেই। সেখানে নিয়ে বলা হল,
- “তুমি এখানে কয়েকদিন থাকবে। কিছুদিন পর তোমাকে চলে যেতে দেয়া হবে।“
এরপর আর্মির এক সুবেদার আসলো। তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হল,
- “ইনি আমাদের অফিসার, ভালো করে যেন খেয়াল রাখা হয়।“
সেই অফিসার চলে গেলেন... সেই সুবেদার উনাকে বললো,
- “সামনে চলো।“
উনি দেখলেম সামনে একটা টিনের চালা দেয়া ঘরের মত। সেইদিকে উদ্দেশ্য করে হাটতে থাকলেন। হাটা শুরু করতে না করতেই ধাম করে মোটা কোন লাঠি দিয়ে উনার পেছন দিকে বাড়ি দেয়া হল। উনার প্রায় দম বন্ধ হবার জোগাড় হলো। উনাকে আবার বলা হল,
- “ সামনে দেখ, হাটতে থাক।“
উনাকে সেই ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হল। প্রায় ১৫-২০ জনের মত লোক সেখানে শুয়ে ছিলো। উনি ঢুকতেই একজন ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলো কোন শব্দ না করবার জন্য। বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে চলে যেতেই তাকে একজন বললো,
- “কথা কইয়েন না, চুপ কইরা পইড়া থাকেন।“
আসার পথে স্যান্ডেল খুলে যায়, সেটা নিয়ে আসতে চাইলে আরেকজন বললো,
- “কাপড় চোপড়ই থাকবোনা, সাহেবে স্যান্ডেল খোঁজে! মাইরের সময় মুখ বুইজা থাইকেন, সব সইয়া যাইবো।“
একটুপর সবাইকে লাইন ধরে দাড় করিয়ে বাইরে নেয়া হল। একেকজনকে ডাক দেয়, এরপর শুরু হয় বেদম প্রহার। এভাবে প্রায় সারাদিনই চলতে লাগলো। মারতে থাকে আর গালি দিতে থাকে উর্দুতে। সেসবের খুব বেশি কিছু উনার মনে থাকবেনা একসময়।তবে “কুত্তা বাঙ্গাল” আর “শালে মুজিব কে বাচ্চে” এই দুটা স্পষ্ট মনে থাকবে উনার।
এভাবেই দিন চলছিলো। খেতে দেয় কি দেয়না। সেটা খেতেও কষ্ট হয়। এভাবে চললো বেশ কয়দিন। মাঝে মাঝে কয়েকজনকে নিয়ে যায়, নতুন কেউ কেউ আসে। যাদের নিয়ে যায় তাদের তেমন কেউই ফেরত আসেনা। অল্প কয়জনকে ফিরে আসতে দেখবেন, কিন্তু তাদের দেখে মনে হযবে নরকের উদাহরন হয়তো আল্লাহ এই পৃথিবীতেই সৃষ্টি করে রেখেছেন। এভাবে একদিন উনারও ডাক আসবে!
মে মাস (হয়তো), ১৯৭১
ঢাকা, পুর্ব পাকিস্তান
ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলমকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সামরিক বাহিনীর কুখ্যাত জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে। সামরিক বাহিনীতে কাজ করার সুবাদে এর সম্পর্কে উনার কিছু জানা ছিল। এখন যেখানে ডিজিএফআই হেডকোয়ার্টার,সেখানে ছিল এর অবস্থান। প্রথমেই উনাকে মেজর পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। উনি তাকে বলেন,
- “আলম,তুমি সত্য স্বীকার করে নাও। তাহলে তোমাকে কিছু বলা হবেনা। তুমি স্বীকারোক্তি দাও যে তুমি মুক্তিবাহিনিতে যোগ দেবার জন্য পালিয়ে ঢাকা চলে এসেছো।“
উনি বললেন,
- “আমিতো ছুটিতে এসেছি ঢাকায়। পরিবারের জন্য খুব খারাপ লাগছিল। আমি কেন এমন স্বীকারোক্তি দেব?“
এরপর বলা হল,
- “তোমার ভালো তুমি বুঝে নেবে। আর কি বলবে,সেটা আমরা ঠিক করে দেব।“
এরপর উনাকে নিয়ে যাওয়া হবে ডিটেনশন সেলে। গায়ের সব কাপড় খুলে হাত উপরে বেধে দাড় করিয়ে রাখা হবে। এরপর চলতে থাকে অত্যাচার। সেসবের কোন স্মৃতিই সেভাবে মনে করতে পারবেননা উনি অনেক বছর পর। কতবার যে জ্ঞান হারাবেন উনি নিজেও জানবেননা। আর মাথার উপর ছিল ১০০০ ওয়াটের বাল্ব। মারামারি শেষ হলে তাকে চোখের উপরে সেই বাল্ব জ্বালিয়ে রেখে ঝুলিয়ে রাখা হল। তাপে উনার মুখের চামড়া পুড়ে গিয়েছিল। উনি চোখ খুলে তাকাতে পারছিলেননা। প্রচন্ড ক্লান্ত ছিলেন,কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যও ঘুমাতে পারছিলেননা। চোখের উপর এমন আলোর উৎস থাকলে ঘুমানো কখনই সম্ভব নয়। দুইদিন পর উনি ঘোরের মধ্যে চলে গেলেন। তাকে বার বার ওই একই কথা জিজ্ঞেস করা হচ্ছিলো আর বক্তব্য লিখতে বলা হচ্ছিলো। উনি বার বার লিখছিলেন,
- “I, Flight Lieutenant Shamsul Alam, PAK/4921, came here to meet my family on my holidays and I would have gone back within few days.”
এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পাশের এক সেলে। যেখান থেকে উনি নিয়মিত বীভৎস চীৎকার শুনতে পেতেন। সেখানে যাবার পর উনি দেখলেন মেঝেতে ছোপ ছোপ দলা বাধা রক্ত। মনে হচ্ছিলো যেন কেউ একটু আগে এখানে মুরগী জবাই করেছে। তাকে সেখানে নিয়ে আবার নির্যাতন করা হল,যেগুলো বর্ননা করবার ইচ্ছা এই ঘটনা প্রবাহের বাইরেই থাকুক। এরপর আবার তাকে বক্তব্য লিখতে দেয়া হল,উনি সেই একই কথা লিখলেন। তাকে আবার সেই বাল্বের নীচে ঝুলিয়ে দেয়া হল। ৩-৪ দিন পরেই উনি উনার সমস্ত মনবল হারিয়ে ফেললেন। উনার মাথা কাজ করছিল না। না ঘুমিয়ে এভাবে তীব্র আলো আর তাপের নীচে থাকা একটা অসহনীয় অনুভূতি। তাকে আবার জিজ্ঞেস করা হল যে উনি ঠিক বক্তব্য লিখবেন নাকি। উনি এবার বললেন,
- ”তোমরাই বলে দাও আমাকে কি লিখতে হবে। আমি লিখে সই করে দিচ্ছি।“
ওরা উনাকে লিখতে বললো,
- “I, Flight Lieutenant Shamsul Alam, PAK/4921 has deserted PAF which was planned and came in Dhaka to join muktibahini.”
উনি লিখে সই করে দিলেন। পাকিস্তানিরা তাকে বললো,
- “আগে লিখে দিলেই এতো কষ্ট করতে হতনা।“
উনি এবার অনুরোধ করলেন উনাকে তার কাপড়গুলো দিতে। উত্তরে তাকে বলা হল,
- “তুমি সেসব পাবে যদি আমাদের সাহায্য কর।“
উনি বললেন,
- “কি সাহায্য লাগবে?”
তাকে বলা হল, একজন বন্দী আছে,যার ভাষা ওরা বুঝতে পারছেনা। ওর জন্য ইন্টারপ্রিটার হিসেবে কাজ করত হবে। তার বক্তব্য তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। নিরুপায় হয়ে উনি রাজী হলেন।
সেলে নিয়ে আসা হল একটা লুঙ্গী আর গেঞ্জী পরা ২২-২৩ বছরের এক ছেলেকে। তার পুরো শরীর জমাট বাধা রক্তে কালো হয়ে আছে। ঠোট মুখ ফুলে একাকার,চেহারা বোঝাই যাচ্ছেনা। উনাকে বলা হল তার সাথে কথা বলতে। উনি তার সাথে কথা বলে বুঝলেন,সে ময়মনসিংহ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে যেটা পাকিস্তানীরা ঠিকভাবে বুঝতে পারছিলনা। যেটা জানএন তা হচ্ছে,”ভাওয়াল গড়ের কোন এক জায়গায় মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। যাদের এই ছেলেটা সাহায্য করতো। তাদের অস্ত্র,গুলি এসব বহন করতো। একদিন পাক বাহিনী ওখানে আক্রমন করলে তাকে একটা গুলির বাক্স দেয়া হয় মাথায় করে বহন করবার জন্য আর তাদের সাথে পালাতে। অবস্থা যখন বেগতিক হয়,তখন মুক্তিবাহিনী অথবা হয়তো ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের কোন ইউনিটের সদস্যরা যে যার মত পিছু হটে সেই এলাকা ত্যাগ করে। কিন্তু তার মাথায় যেহেতু ভারী গুলির বাক্স ছিল,সে সেটা রেখে পালাতে পারেনি। সে পেছনে পরে যায়,এরপর কাউকে খুজে না পেয়ে সেই বাক্স মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর পাক বাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পরে যায়। তাকে যে দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, সেই গুলির বাক্স হেফাযতে রাখা তাঁর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সে গুলির বাক্স সহ ধরা পরে যায়। এরপর তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়,তখন সে এসবই বলছিল,কিন্তু তাঁর ভাষার জন্য কেউ সেভাবে বুঝতে পারছিলনা।“
তাঁর (ওই ছেলেটির) বক্তব্য ফ্লাঃ লেঃ আলম বুঝিয়ে বললেন। এরপর একজন নায়েক কিংবা এমন পদের সৈনিক আসলো। তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। এরপর বুট দিয়ে মাথার একপাশে লাত্থি দিল। উনার মনে হল যে খুলি ফেটে যাবে। আবার পেটের মধ্যে লাত্থি দিল। যখনই পেটে লাত্থি দিচ্ছিল, তখনই মুখ দিয়ে দল দলা রক্ত বের হচ্ছিল। মাথায় লাত্থি দিলে ছিটকে ছিটকে রক্ত বের হচ্ছিল,যার জন্য পুরা কক্ষে ছোপ ছোপ রক্ত দেখতে পাচ্ছিলেন ফ্লাঃ লেঃ আলম। উনি এতোক্ষনে এরকম দলা দলা আর ছোপ ছোপ রক্তের কারন কি বুঝতে পারলেন!!
(আমরা অনেকে এখন মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের নানা বীরত্ব নিয়ে অনেক কথা বলি। এর খুব অল্পই আমরা জানি। এমন হাজার হাজার মানুষের কাহিনী আমাদের অজানাই থেকে যাবে। আমি জানিনা এই ছেলের কাহিনীটা বীরত্বের সংজ্ঞায় পড়ে নাকি। আমার মনে হয় বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই ২৬ মার্চের পর আমি যুদ্ধে যাব,দেশ মুক্ত করবো এমন কিছু আগে ভেবে রেখে,এরপর ধীরেসুস্থে মুক্তিযোদ্ধা হয়নি। সময় ঠিক করে দিয়েছে কে কি করবে। যার মন যেটা বলেছে সে তাই করেছে। সেই অদ্ভুত সময়ে কে কোন পথ অবলম্বন করবে সেটা নির্ধারিত অথবা আগে থেকে বলে দেবার মত করে কিছু ঘটেনি, তবে যে অন্তর থেকে আসলে যেমন, ঠিক সেই পথেই গেছে। ভীরুতার জন্য অন্যায়ের সমর্থনও অপরাধ। কেউ ভয়ে পাকিস্তানীদের সমর্থন করলো,সে জন্য যেমন সে নিজের কাজের জন্য ক্ষমা পেতে পারেনা,আবার তেমনি দেশের জন্য কিছু করবার অথবা যুদ্ধে যাবার ক্ষমতা থাকার পরেও কেউ যদি সেটা না করে থাকে,তবে সেটাও একরকমের অপরাধের মতই। এমন মানুষগুলোর জন্য দেশের উন্নতি থেমে থাকে। এরা সুবিধাবাদী। নিজের ব্যাপার দেখবে,কিন্তু দেশ কিংবা অন্যের বিপদে এরা কোন কাজে আসেনা। আবার যেমন এই ছেলেটা,সে ঠিক তাই করেছে যা তার কাছে ঠিক মনে হয়েছে। সে হয়তো জানতোও না রাজনীতি আসলে কি অথবা দেশে ঠিক কি হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনে তাঁকে অনেক বড় কেউ মনে করতো,কিন্তু আসলে সে কেমন সেটা বিচার করবার ক্ষমতাও হয়তো তার ছিলনা। তবে নিজের মানুষ,নিজের মাটিকে যে ভালোবাসতে হয়, সেটা সে উপলব্ধি করতো। আর একটা মানুষ শুধু অনেক ডিগ্রী নিলে অথবা জ্ঞান অর্জন করলেই বড় মানুষ হয়না। বড় মনের মানুষ হতে গেলে কিংবা মানুষ হিসেবে নিজের উতকর্ষতার জন্য তার বোধ উন্নত হতে হয়,নিজের মানবিক গুনাবলী উন্নত করতে হয়,ভুল শুদ্ধের সঠিক উপলব্ধির প্রয়োজন হয়। )
১০ মে, ১৯৭১
পিএএফ হেডকোয়ার্টার, পেশোয়ার
উইং কমান্ডার এ জি মাহমুদের পোস্টিং এখন পেশোয়ারের বিমান বাহিনী সদরদপ্তরের প্রসাশনিক বিভাগে। ২৫শে মার্চের পর থেকেই সকল বাঙ্গালী পাইলট গ্রাউন্ডেড অবস্থায় আছেন এবং বাকী সকলকে বিভিন্ন কম গুরুত্বপূর্ন পদে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। রিসালপুরের পাকিস্তান এয়ারফোর্স একাডেমীতে ছিলেন ৫৬ জন ফ্লাইট ক্যাডেট, তাদের প্রশিক্ষণ স্থগিত করে নজরবন্দী রাখা হয়েছে। তাদের ঢাকা পাঠাবার জন্য ব্যবস্থ্যা নিতে উইং কমান্ডার মাহমুদকেই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। উনি জানতে পারলেন ঢাকায় অবতরনের সাথে সাথেই তাদের সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হবে যাতে তাদের সহজেই নির্মুল করে ফেলা যায়। তা নাহলে তারা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে পারে।
এয়ার কমোডোর এনাম ছিলেন এয়ার অফিসার কমান্ডিং (এওসি) ইস্ট পাকিস্তান। উনার সাথে আগের পরিচয়ের সুত্র ধরে তার কাছেই ফ্লাইট ক্যাডেটদের সুরক্ষার জন্য কিছু একটা করা যেতে পারে বলে উনি মনে করলেন। ইস্ট পাকিস্তান এয়ার কমান্ডের কাছে তাদের সুরক্ষার সকল ব্যবস্থ্যা নিতে উনি এওসি ইস্ট পাকিস্তান বরাবর একটি বার্তাপত্র লিখে পাঠালেন, “IMMEDIATE” প্রাধিকার দিয়ে।
এরপর তাদের ভাগ্যে কি হয়েছিলো সেভাবে হয়তো উনার জানা হয়ে ওঠেনি।
১৭ মে, ১৯৭১
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী কার্য্যালয়
বালিগঞ্জ, কলকাতা
গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের সাথে দেখা করতে এসেছেন। গত ১৫ মে উনি তৃতীয়বারের প্রচেষ্টায় আগরতলা পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন আরো কিছু সদস্য এবং তাদের পরিবার সহ। তাকে একটী বিমানে পরেরদিন কলকাতায় উড়িয়ে আনা হয়। এটাই তার অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কর্মকর্তাদের সাথে প্রথম আনুষ্ঠানিক সাক্ষাত। উনি তাজউদ্দীন আহমেদকে বললেন,
- “স্যার, আমরা বিমান বাহিনীর বেশ কয়জন উর্ধতন কর্মকর্তা ঢাকা থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছি। এর মধ্যে বেশ কয়জনেরই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে। আরও বেশ অনেকজন এয়ারম্যান পালিয়ে নানা সেক্টরে যুদ্ধ করছে যাদের বিমান রক্ষণাবেক্ষণে দক্ষতা আছে। দেশের জন্য আমরা যে কাজই দরকার করতে রাজি, তবে মুক্তিযুদ্ধে বিমান বাহিনীর প্রয়োজনীয়তাও আছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের যদি কিছু বিমান আর একটা এয়ারফিল্ডের ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন তবে খুব ভালো হত।“
তাজউদ্দীন আহমেদ উত্তর দিলেন,
- “আমি যথাসাধ্য চেস্টা করবো।“
এর আগে তিনি কর্নেল ওসমানীকেও এই ব্যাপারে বলেছিলেন। তবে সেই সময়ের পরিস্থিতিতে ব্যাপারটা সম্ভব হবেনা বলে কর্নেল ওসমানী তাকে জানিয়ে দেন। তবে নীতিনির্ধারক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের মাধ্যমে ব্যাপারটি ভারত সরকারের উপর মহলে যেতে পারে ভেবে নিয়ে তিনি চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মে মাস (মাঝামাঝি কোন সময়), ১৯৭১
ঢাকা, পূর্ব পাকিস্তান
ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলমকে ছেড়ে দেবার জন্য বলা হয়েছে। তাকে নিয়ে আসা হয় অন্য আরেক জায়গায়। ওখানে আগের মতই দিন কাটতে লাগলো। নিয়মিত মারামারি আর অন্য সময় মেঝেতে কোনমতে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকা অথবা ঘুমাবার চেষ্টা করা ছাড়া অন্য কিছু করার ছিলোনা।
এরমাঝে এয়ারফোর্সের এক লিগ্যাল অফিসার আসলেন উনার কাছে। উনি তাকে জানালেন উনার বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শাল হচ্ছে এবং তাকে পিএএফ এক্টের সেকশন ২৩ দ্বারা দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। এরপর উনার কাছ থেকে কিছু কাগজ সই করিয়ে নিয়ে যায় আর অভিযোগ পড়ে শোনায়। উনি জানতেন না যে সেকশন ২৩ এ কি আছে। এরমধ্যে অনেক ঘটনা ঘটেছে সেকশন ২৩ এ কি আছে সেটা জানবার প্রচেষ্টায়,যেগুলো হয়তো অপ্রাসঙ্গিক। শেষ পর্যন্ত একটা নিউজপেপার হাতে পাবেন উনি,যেটার একপাশে কৌশলে ফটোকপি করা ছিলো “পিএএফ এক্টের সেকশন ২৩”। ,যাতে বলা আছে, এর শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন। উনি ভাবলেন,হয় উনার জীবন এভাবেই কেটে যাবে। নয়তো কিছুদিনের মধ্যেই মারা যাবেন। উনি এর যেকোন একটার চেয়ে জীবনের ঝুঁকি নেয়াটাই ভালো মনে করলেন।
মে (শেষ সপ্তাহ), ১৯৭১
দিল্লী, ভারত
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধান সেনাপতিকে নিয়ে দিল্লী সফরে গেছেন। এখানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে মুক্তিযুদ্ধে যগ দেয়া সদস্য, বর্তমান পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন আলোচনার পর একটি প্রতিবেদন পেশ করা হয়। এখানে প্রধান সেনাপতি তার মতামত তুলে ধরেন, ১৯৭১ সালের মে মাসে লিখিতভাবে প্রদত্ত চাহিদার পরবর্তী সময়ে শত্রুদের বিমানঘাটি থেকে পালিয়ে এসে গ্রুপ ক্যাপ্টেন ও উইং কমান্ডার পদবীর চাকুরীরত দুজন জেষ্ঠ্য অফিসার এবং বেশ কয়জন আধুনিক জঙ্গীবিমানের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জঙ্গী বৈমানিক এবং প্রায় দুইশত গ্রাউন্ড ক্রু বাংলাদেশ বাহিনীতে(মুক্তিবাহিনী) যগ দিয়েছেন। দিল্লীতে যাচাই শেষে বর্তমানে অফিসারদের মাঠপর্যায়ে ষ্টাফ অফিসার হিসেবে অপব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া প্রাক্তন পিআইএর কিছু ক্যাপ্টেন/বৈমানিক আছেন যাদের ফ্লাইংয়ে নিযুক্ত না রাখলে তাঁরা তাঁদের উপযুক্তরা হারাবেন। শত্রুকে আঘাত হানার জন্য এঁদের আকাশে উড্ডয়নের পথ খুঁজে বের করতে হবে।
জুন (হয়তো প্রথম সপ্তাহ), ১৯৭১
ঢাকা, পুর্ব পাকিস্তান
ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলমদের ১ দিন কিংবা দুইদিন পর পর গোসলের জন্য কিছুটা সময় দেয়া হতো। গায়ে দুর্গন্ধযুক্ত কাউকে পেটাতে আসার সময় সেই গন্ধ নাকে আসলেও তো খারাপ লাগে,এজন্যই হয়তো তারা আমাদের গোসলের সুযোগ দিত। আর টয়লেটও ছিল সেখানেই। উনি লক্ষ্য করে দেখলেন,গোসলের জায়গার টিউবওয়েলের সামনে কাঁটাতারের ফেন্সিং আছে,তবে সামনের প্রায় ফাঁকা। আশেপাশে প্রায় কিছুই নেই। আর কিছুদিন যাবার পর দেখলেন যে প্রহরীরা যারা উনাদের নিয়ে যেত সেখানে,তারাও খানিকটা ঢিলেঢালা হয়ে গেছে। উনারা গোসলের সময়টায় কি করছেন সেটা সেভাবে খেয়াল করতোনা। উনি এমনই কোন কিছুর সুযোগ নিয়ে একদিন ভোরে গোসলের সময় প্রহরী একটু অসতর্ক হতেই কাঁটাতারের ফাঁক গলে শরীর বের করে দিয়েই ছুটতে শুরু করলেন। পেছনে কি হয়েছে উনার জানা হবেনা।
প্রায় ঘন্টাখানেক এভাবে ছুটবার পর উনি সম্ভবত মিরপুরের দিকের কোথাও আসবেন (উনাকে সম্ভবত মোহাম্মদপুরের আশেপাশের কোন জায়গায়ই রাখা হয়েছিল)। উনার পকেটে একটা পয়সাও নেই,উনি এক ট্যাক্সিওয়ালাকে দেখতে পেলেন। উনি ট্যাক্সিওয়ালাকে বললেন উনাকে সেগুনবাগিচায় নিয়ে যাবার জন্য। উনার পোশাকের অবস্থা দেখে সে দ্বিধায় ছিল। এরপর কি মনে করে জানি রাজী হয়ে গেলো। এরপর উনি বাসায় চলে আসলেন আর ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। বাসায় তাকে দেখে সবাই তো অবাক,তারা কেউ জানতোনা যে উনি এতোদিন ধরে দেশে। উনি অল্প কিছু ঘটনা তাদের খুলে বললেন। এরপর উনার কিছু জিনিস আর অল্প কিছু টাকা গুছিয়ে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে চলে যাবেন পরিচিত এক জায়গায়। আর পরিবারের অন্যদের উনার সাথে সেখানে গোপনে যোগাযোগ করতে বললেন। আর বললেন বাসায় কেউ এলে যাতে বলা হয় তারা উনার কোন খোঁজ জানেনা। সেদিনই উনার বাসায় তল্লাশী করতে আসবে পাকিস্তানীরা। উনার কথা জিজ্ঞেস করাতে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হবে উনি পশ্চিম পাকিস্তানে আছেন। উনি যে দেশে এসেছেন এ ব্যাপারে তারা কিছুই জানেনা বলে কান্নাকাটি শুরু করে দেবে। এরপর পাকিস্তানীরা চলে যাবে।
এর কিছুদিন গোপন স্থানে থেকে বাসায় ফিরে এসে পরিচিত কিছু মানুষের মাধ্যমে সবকিছু ঠিক করে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলম। সেটা এক অন্য অধ্যায়।
আগস্ট (প্রথম সপ্তাহ), ১৯৭১
থিয়েটার রোড, কলকাতা
অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের কার্য্যালয়
সকাল ১১টা। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ জরুরীভাবে তলব করেছেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে। উনার কার্য্যালয়ে পৌঁছে তিনি দেখতে পান ডিফেন্স সেক্রেটারি কে বি লাল, আরেক ব্যুরোক্র্যাট অশোক রায় এবং ভারতীয় বিমান বাহিনীর পুর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার এয়ার মার্শাল হরিচান্দ দেওয়ানকে। । বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদ, কর্ণেল ওসমানী আর উনি নিজে উপস্থিত ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমেদ উনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
- “উনারা বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠনের ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলতে আগ্রহী।“
কে বি লাল তাকে বললেন,
- “ এ মুহূর্তে তো আমাদের আপনাদেরকে বিমান দেবার সামর্থ্য নেই। তবে আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে তবে আমাদের স্কোয়াড্রনের সাথে ফ্লাই করতে পারেন।“
উত্তরে এ কে খন্দকার বললেন,
- “আপনাদের সাথে ফ্লাই করতে গেলে আমাদের বৈমানিকেরা কোন দেশের নিয়ন্ত্রনে থাকবে? কোন দেশের আইন মেনে চলবে? ভারতের আইন না বাংলাদেশের আইন।“
উত্তরে কে বি লাল বললেন,
- “স্বাভাবিকভাবেই ভারতের আইন মেনে চলতে হবে।“
এ কে খন্দকার এরপর তাজউদ্দিন আহমেদকে বললেন,
- “সবচেয়ে ভালো হবে যদি উনারা কিছু বিমান, সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষনের জন্য একটি এয়ারফিল্ডের ব্যবস্থ্যা করে দেন। আমাদের নিজের বৈমানিক এবং গ্রাউন্ড ক্রুরাই নিজেদের অভিযান এবং রক্ষনাবেক্ষন কাজ চালাতে পারবে।“
এর বাইরে সেদিন আর তেমন কোন কথা হয়নি।
আগস্ট (তৃতীয় সপ্তাহ), ১৯৭১
আলীপুর, কলকাতা
এয়ার চিফ মার্শাল প্রতাপ চন্দ্র লাল (জন্ম এলাহাবাদে কিন্তু উনার মা ছিলেন বাঙ্গালী) চা পানের দাওয়াত দিয়েছেন এ কে খন্দকারকে নিজ হোটেলে। মিসেস ইলা লালও ( বাংলাদেশের কুমিল্লার মেয়ে ছিলেন) সেখানে উপস্থিত আছেন। আলোচনার একপর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর এয়ার উইং গঠনের বিষয়টিও উঠে আসে। যদিও পি সি লাল এ ব্যাপারে নানা জটীলতার কথা তুলে ধরেন। একপর্যায়ে এ কে খন্দকার বলেন,
- “স্যার, এখন তো গেরিলা যুদ্ধ চলছে। পরে একসময় আমাদের বিমানও চালাতে হতে পারে। তখন বিমানের প্রথম আক্রমনটি আমরাই করতে চাই।“
এয়ার চীফ মার্শাল পি সি লাল মৃদু হাসলেন, মুখে কোন উত্তর দিলেননা।
(বিমান বাহিনি গঠনের পেছনে ক্রিয়ানক হিসেবে কাজ করেন তৎকালীন ভারতের বিমানবাহিনীর প্রধান পিসি লালের স্ত্রী ইলা লাল। নিজে বাঙালি হবার কারণে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ইলা লালের সহানুভূতি ছিল সেই প্রথম থেকেই। এরই মাঝে একদিন হঠাত কলকাতায় এলে ইলা লালের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয় বাঙালী বৈমানিক ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট সদরুদ্দিনের। তিনি ইলা লালকে বুঝিয়ে বলেন আমাদের নিজস্ব বিমানবাহিনীর প্রয়োজনীয়তার কথা। পরবর্তীতে ইলা লালই তার স্বামী প্রতাপ চন্দ্র লালকে বাধ্য করেন এই ব্যাপারে আশু পদক্ষেপের জন্য।)
তবে এরমধ্যেই ভারতীয় সরকারের সাথে নানা পর্যায়ের আলোচনায় বাঙ্গালী প্রশিক্ষিত বৈমানিকদের ব্যবহারের ব্যাপারটি আসে। এরপাশাপাশি বিদেশী বাঙ্গালী কুটনোইতিকরা যারা পক্ষত্যাগ করেছিলেন, তাদের মাধ্যমে নিজস্ব বিমান কেনার প্রস্তাবও আসতে থাকে। কিন্তু তৎকালীন সময়ের বাস্তবতায় সেইসব কোনভাবেই সম্ভব ছিলোনা। একটি ছোট বিমানের দাম এই বর্তমান যুগেই যেখানে কোটি কোটি টাকা, তখনও এরচেয়ে কম ছিলোনা। যা বাংলাদেশ সরকারের সেই পরিস্থিতিতে ক্রয় করা অসম্ভবই ছিলো।
আগস্ট (শেষ সপ্তাহ), ১৯৭১
থিয়েটার রোড, কলকাতা
এয়ার চীফ মার্শাল পি সি লাল প্রশিক্ষিত ও যোগ্য বৈমানিকদের ব্যাপারে একটি পত্র পাঠিয়েছেন। সেটা নিয়েই আলোচনা চলছে বাংলাদেশ সরকারের ক্রীড়ানকদের মধ্যে। উনি দুটি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন,
১। বাঙ্গালী বৈমানিকদের ভারতীয় বিমান বাহিনীর অপারেশনাল ইউনিটগুলোতে আত্মীকরনের মাধ্যমে ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সেইসকল অফিসারদের ভারতীয় বিমান বাহিনীর নিজস্ব নিয়ম শৃংখলার বিধিবিধান এবং আইন মেনে চলতে হবে।
২। দুটি পুরনো ভ্যাম্পায়ার জঙ্গী বিমান প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠন করা যেতে পারে। যা বাংগালী বৈমানিক এবং গ্রাউন্ড ক্রুদের দ্বারা পরিচালিত হবে।
এ ব্যাপারে একটি নোটশিটের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের মতামত জানানো হয়। যাতে দুটি প্রস্তাবই কৌশলী উত্তরের মাধ্যমে এড়িয়ে যাওয়া হয় এবং এর বদলে নিজেদের জন্য কিছু বিমান আর এয়ারফিল্ড চাওয়া হয়।
প্রথম প্রস্তাবের ব্যাপারে নোটশিটে এ কে খন্দকার মত দেন যে, যেহেতু বাঙ্গালী বৈমানিকেরা পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে দীর্ঘ্যদিন পশ্চিমা অথবা আমেরিকান বিমান চালনা করেছেন কিন্তু ভারতীয় বিমান বাহিনীতে সেসব ব্যবহার করা হয়না, তাই এই প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয়। যেহেতু এগুলোর পরিচালন পদ্ধতি এবং অন্যান্য শট্যান্ডার্ড প্রসিডিরের মধ্যে তেমন মিল নেই।
আবার দ্বিতীয় প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অন্তত এমন কিছু বিমান দরকার যা যুগের সাথে মানানসই হবে যদি তা যুগের চেয়েও আধুনিক না হয়। ভ্যাম্পায়ার বিমান সম্পর্কে বলা হয় যে এটি অত্যন্ত পুরোনো বিমান যা ১৯৪৬ সালে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিলো। এই বিমানের গতি এবং সমরাস্ত্র বহনের সক্ষমতা একেবারেই কম যা পাকিস্তানীদের ব্যবহৃত স্যাবর এফ-৮৬ বিমানের সাথে কোন ভাবেই তুলনীয় নয়। এরচেয়ে এমন কিছু বিমান দেয়া বাস্তবসম্মতহবে যা এখনো আউট ডেটেড হয়ে যায়নি। এই ব্যাপারে ভারতীয়দের কাছে হান্টার জঙ্গী বিমান অথবা এই ধরনের কোন বিমান প্রদানের অনুরোধ করা হয়।
এই মতামত সম্ভবত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত পৌছেছিলো।
সেপ্টেম্বর (প্রথম সপ্তাহ), ১৯৭১
থিয়েটার রোড, কলকাতা
গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার আজকে খুবই উৎফুল্ল। এইমাত্র উনাকে জানানো হয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠনের ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন।
এরপর কিছুদিনের মধ্যেই একটি কানাডার তৈরী অটার বিমান, একটি ফ্রান্সের নির্মিত এলুয়েট-III হেলিকপ্টার এবং একটি ডিসি-৩ (ডিএইচ-৪৭) ডাকোটা বিমান পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশী বিমানসেনাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরমধ্যে ডিসি-৩ ডাকোটা বিমানটি যোধপুরের মহারাজা ভারত সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্য উপহার হিসেবে প্রদান করেন যা তিনি ব্যক্তিগত পরিবহরের কাজে ব্যবহার করতেন।
বিমান বাহিনীর জন্য ঘাটি নির্বাচন করা হলো নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরকে। এটি ছিলো চীন ভারত সীমান্তের কাছাকাছি ভারতের সবচেয়ে পুবের ঘাটি জোড়হাট এয়ার বেসের অধীনে। এটি নির্বাচনের ব্যাপারে বেশ কিছু ব্যাপার বিবেচনায় আনা হয়ঃ
১। এটি নিয়মিত ব্যবহৃত হতনা। সপ্তাহে একটি মাত্র ফ্লাইট সাধারনত এখানে আসতো রসদ এবং সৈন্য নিয়ে। তাই এটাকে বাংলাদেশ বিম্ন বাহিনীর জন্য ছেড়ে দিলেও অপারেশনাল কার্যক্রমে কোন ব্যাঘাত ঘটতোনা।
২। এর বাইরে এতে ছিলো একটি ৫০০০ ফুট রানওয়ে, যা ভারতীয়দের প্রদানকৃত সবগুলো বিমানের জন্যই যথেষ্ঠ ছিলো এবং রানওয়েটি ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত ছিলো।
৩। এতে একটি কাঠের তৈরী এটিসি টাওয়ার ছিলো যা দরকারের সময় ব্যবহার করা সম্ভব ছিলো।
৪। এটি পাকিস্তানী রাডার কাভারেজের ঠিক বাইরে ছিলো, যে কারনে দিবা রাত্রি টানা উড্ডয়ন প্রশিক্ষন এবং অন্যান্য বিষয় পাকিস্তানীদের জজ্রের বাইরে থাকতো।
৫। এটি ছিলো লোকালয়ের অল্প বাইরে এবং কাছাকাছি একই আর্মি ইউনিট ছিলো, যে কারনে কোন কার্যক্রম সাধারনের নজরে আসতোনা এবং যেকোন অন্তর্ঘাতমুলক কাজে গ্রাউন্ড ট্রুপসের সাপোর্ট স্বল্প সময়ে পাওয়া সম্ভব ছিলো।
(এর বাইরে বিমান প্রদানের ব্যাপারে ভারতীয়রা বেশ কিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়েছিলো। প্রধানত, পাকিস্তান বিমান বাহিনী (এলিউট এবং ডিসি-৩) এবং কৃষি অধিদপ্তরের অধীনে (ডাকোটা) এ ধরনের বিমান ছিলো। যার ফলে যদি কোন কারনে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও এগুলো বিধ্বস্ত হতো তবেও পাকিস্তানীরা এগুলো ভারতীয় বিমান বলে দাবী করতে পারতোনা সন্দেহ ব্যতিরেকে। এছাড়াও ভারতীয়রা প্রথমত রাডার এড়িয়ে রাত্রীকালীন মিশনের মাধ্যমে পাকিস্তানীদের আক্রমন করতে চেয়েছিলো মুক্তিবাহিনীর মাধ্যমে। কারন, পাকিস্তানী স্যাবর যুদ্ধবিমানের “নাইট ফ্লাইং ক্যাপাবিলিটি” ছিলোনা। তাই এসব বিমানের রাত্রীকালীন উড্ডয়নের সময় এন্টি এয়ারক্রাফট গান ছাড়া অন্য কোনকিছুর থেকে হুমকীর মুখে পড়ার সম্ভাবনা ছিলোনা। আর যেহেতু সকল ধরনের নেভিগেশন বাতি নিভিয়ে মিশন সম্পন্ন করার পরিকল্পনা ছিলো, সেটাও এন্টি এয়ারক্রাফট আর্টিলারী গান অপারেটরদের অনেকটা আন্দাজেই করতে হতো। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষনা ছাড়া ভারতীয়দের পূর্ব পাকিস্তানের ভেতর আক্রমনে যাওয়া কঠিন ছিলো, কারন এতে করে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়তে হতো।)
২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
বাগডোগরা এয়ার বেস, পশ্চিমবঙ্গ
১১২ নং হেলিকপ্টার ইউনিটের ফ্লাঃ লেঃ চন্দ্র মোহন সিংলাকে ইউনিটের সিও স্কোঃ লীঃ নরেশ (পরে অবঃ এয়ার মার্শাল) ডেকে পাঠিয়েছেন। ফ্লাঃ লেঃ সিংলা ইউনিটের চারজন ফ্লাইং ইন্সট্রাকটারের একজন এবং সবচেয়ে জুনিয়র।
স্কোঃ লীঃ নরেশ বললেন,
- “কাল সকালে তোমাকে তেজপুর যেতে হবে।“
ব্যক্তিগত এবং প্রসাশনিক কারন দেখিয়ে কিছুটা গরিমসি করলেও কোন কিছু শোনা হলনা। কিছুদিন পরই তার ফ্লাইং ক্যাটাগরি আপগ্রেড হবার কথা আর অল্প কিছু ঘন্টা ফ্লাই করলেই। সেইসাথে বিদেশ সেবা মেডেল পাবেন ভুটানে কয়টা মিশন করতে পারলেই। আর শেষ কারন হিসেবে দেখালেন, উনি সবচেয়ে জুনিয়র, তবুও উনিই কেন? কিন্তু কোন কিছুই শোনা হলনা।
ফিরে এসে আবার সাহস করে সিওর অফিসে গেলেন উনি। আবার কারন দেখিয়ে এড়াবার চেস্টা করলেন। কিন্তু স্কোঃ লীঃ নরেশ সব হাসিমুখে শুনলেন জবাব দিলেন,
- “A Dakota will pick you up at 0800 hrs tomorrow”
নিয়তি মেনে নিয়ে উনি জিজ্ঞেস করলেন,
- “ আমার এসাইনমেন্ট কি আর কতদিনের জন্য আমি লাগেজ গোছাবো?”
স্কোঃ লীঃ নরেশ বললেন,
- “ ৪-৫ সপ্তাহের জন্য প্যাক কর তোমার বিছানা পত্র সহ। তেজপুরে সব জানতে পারবে।“
ফ্লাঃ লেঃ সিংলা ভাবতে লাগলেন, ইউনিটে চারজন ইন্সট্রাকটর আছে। এরমধ্যে উনি এমন কি অপরাধ করলেন যার জন্য উনাকেই যেতে হচ্ছে। নিশ্চিত ওখানে গাদা গাদা ফাইল উনার জন্য অপেক্ষা করছে। যুদ্ধ প্রায় অবশ্যম্ভাবী, অন্যরা যেখানে যুদ্ধে অংশ নেবে নিশ্চিত সেখানে উনি কোন পাপ কিংবা ক্রুটির কারনে এই পরিনতি হচ্ছে ভেবে পাচ্ছিলেননা।
উনি তখনও জানেননা, নিয়তিই তাকে সুযোগ করে দিচ্ছে এমন এক ইতিহাসের অংশ হবার যেটা নিয়ে জীবনের বাকী পুরোটা সময় বুকে অন্যরকম গর্ব ধারন করবেন!!
২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
১১৫ হেলিকপ্টার ইউনিট
তেজপুর এয়ারবেস, আসাম
সকাল ৮ টায় ডাকোটাতে বাগডোগরা থেকে তেজপুরে এসে নামলেন ফ্লাঃ লেঃ সিংলা। অফিসার কমান্ডিং ১১৫ নং হেলিকপ্টার ইউনিট টারমাকে অপেক্ষায় ছিলেন যা একজন ফ্লাঃ লেঃ এর জন্য ভিআইপি মর্যাদার ব্যাপার। এয়ার অফিসার কমান্ডিং তেজপুরের সাথে দেখা করবার পর উনি বললেন,
- “যদি তুমি “চেতাক” (এলিউট হেলিকপ্টারের ভারতীয় বিমান বাহিনীর দেয়া নাম) একা চালাতে জানো তাহলে তা তোমার জন্য প্রস্তুত আছে। সেটাকে নিয়ে ডিমাপুর চলে যাও। চেতাকের জন্য সব ধরনের রক্ষনাবেক্ষন সহযোগিতা তুমি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই পাবে। আর কোন প্রশ্ন আছে? না থাকলে রওনা দাও।”
এরপর একটী ম্যাপ, একটি ভিএইচএফ সেট আর এনডিবি (নন ডিরেকশনাল বিকন, বিমানে ব্যবহৃত নেভিগেশন যন্ত্র) ফ্রিকোয়েন্সি জেনে আরো কিছু সরঞ্জাম ইস্যু করে ডিমাপুরের দিকে একলা উড়ে চললেন সেই “চেতাক” (Alouttee-III) নিয়ে।
২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
ডিমাপুর এয়ারফিল্ড, নাগাল্যান্ড
এতোদিন একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের অধীনে ১৫ জন এয়ারমেন দিয়ে তদারকি চলছিলো ডিমাপুর এয়ারফিল্ডের। মাঝে মাঝে কিছু ডাকোটা উড়ে আসতো সেনা নিয়ে, সেই কাজের তদারকি আর এয়ারফিল্ডের মেইন্টেন্যান্সের জন্য এই অল্প জনবলই যথেষ্ঠ ছিলো। জোড়হাট এয়ারবেসের স্টেশন কমান্ডার চন্দন সিং এর অধীনে ছিলো এই এয়ারফিল্ড। সকালেই চন্দন সিং স্কোঃ লীঃ চৌধুরী সহ ডিমাপুর এসে পৌছেছেন। এর আগে ২৬শে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই বাঙ্গালী বৈমানিকেরা ডিমাপুরে এসে জড়ো হয়েছিলেন।
২৭শে সেপ্টেম্বর যশোর আর আগরতলার কাছাকাছি সেক্টরগুলো থেকে বাঙ্গালী গ্রাউন্ড ক্রুদের বাছাই করে নিয়ে আশা হয়। সর্বমোট ৪৯ জন গ্রাউন্ড ক্রু উপস্থিত হন, এদের সহ ৯ জন বৈমানিক মিলে সর্বমোট ৫৮ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথম এয়ার উইং। তিনটি বিমানের জন্য নয়জন বৈমানিককে তিনটি গ্রুপে ভাগ করে দেয়া হয়।
এলিউট-৩ এর জন্যঃ
স্কোঃ লীঃ সুলতাম মাহমুদ (পিএএফ)
ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম (পিএএফ)
ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ (পিআইএ)
ডাকোটার জন্যঃ
ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ (প্লান্ট প্রটেকশন পাইলট)
ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলম (পিএএফ)
ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন (সিবা-গেইগী)
ডিসি-৩ এর জন্যঃ
ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার (পিআইএ)
ক্যাপ্টেন খালেক (পিআইএ)
ক্যাপ্টেন মুকিত(প্ল্যান্ট প্রটেকশন পাইলট)
ইন্সট্রাকটর পাইলট হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করবেনঃ
ডাকোটার জন্য স্কোঃ লীঃ সঞ্জয় কুমার চৌধুরী
অটার এর জন্য ফ্লাঃ লেঃ ঘোষাল
এলিউট-III হেলিকপ্টারের জন্য ফ্লাঃ লেঃ সিংলা।
সকাল ১১টা, এয়ার চীফ মার্শাল পিসি লাল এবং এয়ার মার্শাল দেওয়ান আরো কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ ডিমাপুরে পৌছেছেন। এ কে খন্দকারের অধীনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বিমানসেনারা তাদের এয়ারফিল্ডে অভ্যর্থনা জানান। এ কে খন্দকার এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে এক সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠনের ঘোষনা দেন। এরপর প্রধান অতিথি হিসেবে পিসি লাল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্য শুভকামনা জানান এবং দেশ মাতৃকার লড়াইয়ে নিজেদের উজার করে দিতে বলেন। শুরু হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর আনুষ্ঠানিক যাত্রা। এ কে খন্দকার হলেন বাহিনী প্রধান। স্কোঃ লীঃ সুলতান মাহমুদকে করা হয় এয়ার উইং এর অফিসার কমান্ডিং। উনি অক্টোবরের ১৪ তারিখ থেকে দ্বায়িত্ব বুঝে নেন।
সেদিনই সকালে চন্দন সিং দুইজন বাঙ্গালী পাইলটের সাথে ফ্লাঃ লেঃ সিংলার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তৃতীয়জন উপস্থিত হতে পারেননি তখনো। তারা ছিলেন ফ্লাইট লেঃ বদরুল আলম, ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দীন এবং স্কোঃ লীঃ সুলতান মাহমুদ। চন্দন সিং তাকে বললেন,
- “এক সপ্তাহের মধ্যে এদের অপারেশনাল করতে হবে।“
ফ্লাঃ লেঃ সিংলা বিস্মিত হয়ে বললেন,
- “যদি আইএএফ এর সিলেবাস ফলো করি, তবে টানা সাতদিন সাতরাত কাজ করলেও তা সিলেবাসে উল্লেখ করা দিবা এবং রাত্রীকালীন কনভার্শনের জন্য নুন্যতম উড্ডয়ন ঘন্টার সমান হবেনা।“
চন্দন সিং জবাব দিলেন,
- “আইএএফ এর সকল নিয়ম এখন থেকেই ভুলে যেতে পারো। কিভাবে সম্ভব করবে তোমার ব্যাপার, কিন্তু অবশ্যই করতে হবে।“
(২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিমান বাহিনী দিবস হিসেবে উদযাপন করা হতো। এরপর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে বিভিন্ন বাহিনীর জন্য আলাদাভাবে দিবস পালন না করে ২১ নভেম্বরকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে একত্রে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।)
৪ অক্টোবর, ১৯৭১
থিয়েটার রোড, কলকাতা
গতকাল সকলে কলকাতা ফিরেছেন। আজ অস্থায়ী সরকারে কর্মরত বিমান বাহিনী অফিসারদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলছে নতুন গুঠিত এয়ার উইং এর নাম কি দেয়া যায় তা নিয়ে। ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম প্রস্তাব করলেন,
- “এর নাম ‘কিলো ফ্লাইট” রাখা যেতে পারে। “Khondokar” নামের প্রথম অক্ষর “K” নিয়ে “কিলো ফ্লাইট” (সামরিক বাহিনীতে অক্ষরগুলোকে নিজেদের ব্যবহারের সুবিধার্থে আলাদারুপে প্রকাশ করা হয়, যেমনঃ A=Alpha, B=Bravo, C=Charlie, D=Delta etc )।“
ইতিমধ্যে মুক্তিবাহিনীতে ব্যক্তির নাম নিয়ে ব্রিগেড গঠিত হয়েছিলো, তাই এ কে খন্দকারের প্রচেস্টাকে সম্মান জানাতে এই নামকরন যুক্তিযুক্ত ছিলো। এই নামের আড়ালে বিমান বাহিনীর কার্যক্রমও ছমদনামে চালানো যেত যা নানা ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করতো। সর্বসম্মতিক্রমে এই নাম গৃহিত হলো।
৪ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রথম অপারেশনাল ইউনিটের নাম হলো “কিলো ফ্লাইট”!
৭ অক্টোবর, ১৯৭১
ডিমাপুর এয়ারফিল্ড, নাগাল্যান্ড
গত একসপ্তাহ যাবত সকাল, দুপুর এবং রাতে বিরামহীন উড্ডয়ন এবং প্রশিক্ষন চলেছে। বাঙ্গালী বৈমানিকদের হেলিকপ্টারে অভিজ্ঞতা না থাকার জন্য ফ্লাঃ লেঃ সিংলার কাজ আরো দুরুহ হয়ে গেছে। ফিক্সড উইং বিমানের পরিচালন পদ্ধতিতে দীর্ঘ্যদিনের অভ্যস্থতা, তাদের বয়স এবং মানসিক অবস্থা সব মিলিয়ে কাজটা এতো অল্প সময়ে অসাধ্যই ছিলো। হোভারিং এর সময় হেলিকপ্টার পুরা এয়ারফিল্ড জুড়ে হেলছে দুলছে আবার ফাইনাল এপ্রোচে স্পিড কন্ট্রোলে অভ্যস্ত করতে গিয়ে উনার ঘাম ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু সবকিছু পেরিয়ে নির্ধারিত সময়েই উনি চন্দন সিং কে জানালেন,
- “আমার লোকেরা দিন রাত ফ্লাই করবার জন্য সম্পূর্ন প্রস্তুত।“
চন্দন সিং জবাব দিলেন,
- “নেভিগেশন ফেজের জন্য রাতের মধ্যে তোমাদের জোড়হাট এটিসিতে দেখতে চাই।“
৮ অক্টোবর, ১৯৭১
জোড়হাট এয়ার বেস, নাগাল্যান্ড
কোন ধরনের বিশ্রাম নেয়ার সুযোগই পাননি ফ্লাঃ লেঃ সিংলা। জোড়হাটে উপস্থিত হতে হয়েছে তাদের। সেখানে একটি চেতাক, সিরিয়াল নং-৩৬৪ (ভারতীয় বিমান বাহিনীতে এলিউট-৩ চেতাক নামে পরিচিত ছিলো) একটি ট্রান্সপোর্ট বিমানের মাধ্যমে উড়িয়ে আনা হয়েছে ইতিমধ্যে। এই চেতাকে দুটি মাইস্টায়ার জঙ্গী বিমানের রকেটপড মাউন্ট করা ছিলো দুপাশে। প্রতি পডে সাতটি করে মোট চৌদ্দটি রকেট ছিলো, যা পেয়ার হিসেবে কিংবা সবগুলো একত্রে (পেয়ার/সালভো) নিক্ষেপ করা যেতো। সালভো/পেয়ার এর সিলেকশন সুইচ ছিলো ক্যাপ্টেন্স কন্ট্রোল কলামে। দুই ব্যারেলের একটি মেশিনগান হেলিকপ্টারের পাটাতনে সাইড ফায়ারিং পজিশনে মাউন্ট করা ছিলো। বামদিকের স্লাইডিং দরজাটি এয়ার গানারের সুবিধার্থে অপসারন করা হয়।
এই ৩৬৪ নং সিরিয়ালের আর্মড ভার্সন এলিউট-৩ হেলিকপ্টারটিতে কয়জন আর্মামেন্ট ফিটার এবং অনেক অনেক রকেট নিয়ে চন্দন সিং কে কো পাইলটের সিটে বসিয়ে ফ্লাঃ লেঃ সিংলা ডিমাপুরে উড়ে যাবেন কিছুক্ষন পর। বাংলাদেশ বিমান বাহিনিতে যোগ হবে প্রথম ঘাতক পতঙ্গ!!
(পরে এতেও ২৫ পাউন্ড ওজনের বোমা ফেলার জন্য ব্যবস্থা করা হয়। খুব নিচু দিয়ে উড়তে হয়, তাই আর্মার প্রোটেকশনের জন্য এর তলদেশে এক ইঞ্চি পুরু স্টিল প্লেট লাগিয়ে একেও অতি অল্প সময়ে যুদ্ধের উপযোগী করে তোলে আমাদের বিমানসেনারা।
এর বাইরে কিছুদিনের মধ্যেই কানাডার তৈরি অটার বিমানটির সামরিকীকরনের প্রক্রিয়া শেষ হবে। রকেটপড লাগিয়ে এটিকে যুদ্ধের উপযোগী করা হয়। এলিউটের মতই ১৪টি রকেট নিক্ষেপণের ব্যবস্থা করা হয় এতে পেয়ার/সালভো মোডে। পেছনের দরজা (কারগো ডোর) খুলে লাগানো হয় একটী ৩০৩ ব্রাউনিং মেশিনগান। বিমানের টেইল সেকশনে স্থাপন করা হয় ৩ টি ২৫ পাউন্ড বোম র্যা ক। বোমাগুলো স্বয়ংক্রিয় ছিল না, বলে হাত দিয়ে পিন খুলে নিক্ষেপ করতে হতো। অটারের গতি ছিল ঘণ্টায় ৮০ মাইল। আর ৩ দিন পরেই ১১ অক্টোবর অটারটি জঙ্গী বিমানে রুপান্তরিত হয়ে ওয়ার্কশপ থেকে ফেরত আসবে।
ডিসি-৩ বিমানটিকেও বোমা ফেলবার জন্য উপযোগী করে প্রস্তুত করা হয়। পাচটি র্যারকের প্রতিটি থেকে ১০০০ পাউন্ডের একটি করে বোমা ফেলা যেতো।)
৯ অক্টোবর, ১৯৭১
ডিমাপুর এয়ারফিল্ড, নাগাল্যান্ড
গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং সকালেই ফ্লাঃ লেঃ সিংলার প্রশিক্ষনের অবস্থা দেখতে আসলেন। উনি বললেন ফ্লাঃ লেঃ সিংলা যেনো তার প্রশিক্ষনার্থী বৈমানিকদের দ্রুত সঠিক নিশানায় রকেট নিক্ষেপে পারদর্শী করে তোলেন। সিংলা গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং কে একটু পাশে আসবার অনুরোধ করলেন ব্যক্তিগত কথা বলবার জন্য। উনি বললেন,
- “ভারতীয় বিমান বাহিনীতে এ ধরনের হেলিকপ্টার দিয়ে কখনোই এমন কাজ করা হয়নি। আমার কোন ধারনাই নেই কিভাবে এসব করা যাবে। কে আমাদের গাইড করবে?“
চন্দন সিং হাসলেন, হেসে জবাব দিলেন,
- “ তুমি শিখে ফেলবে, আমি জানি।“
এই মুহুর্তে ডিমাপুরে দুইটি চেতাক ছিলো, একটী আর্মড ভার্সন, আরেকটি নরমাল প্যাসেঞ্জার ভার্সন। .আর্মড ভার্সন হেলিকপ্টারটী অতিরিক্ত আর্মামেন্ট লোডের কারনে এবং মোডিফিকেশনের কারনে কিছুটা ভারী হয়ে অন্যটির চেয়ে আলাদা আচরন করছিলো। সেটার সাথে অভ্যস্ত হওয়ার ব্যাপারটা আগে সেরে ফেলা হলো। এরপর গানসাইটের কিছু সমস্যা অদ্ভুত মোডিফিকেশনের মাধ্যমে দূর করা হলো।
এই সময় থেকে বাংলাদেশী এবং ভারতীয় প্রশিক্ষক বৈমানিকেরা সমস্ত নিয়ম কানুনের বাইরে নিজেদের বুদ্ধিতে চলার স্বাধীনতা উপভোগ করছিলো, ছিলোনা কোন রাল ফিতা গলায় লাগানো বড় অফিসারের হম্বিতম্বি। কিছুদিনের মধ্যেই তারা নিজেদের সক্ষমতাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন। এই কিলো ফ্লাইটের বৈমানিক এবং তাদের প্রশিক্ষকেরা সহ বৈমানিক হিসেবে অনেকের লাভ করবেন নিজেদের দেশের জীবিত হিসেবে বীরত্বের সর্বোচ্চ সম্মান (উদাহরন হিসেবে ফ্লাঃ লেঃ সিংলা, বীর চক্র এবং তার সহ পাইলট স্কোঃ লীঃ সুলতান মাহমুদ, বীর উত্তম যখন একই মিশনে অংশ নেবেন তখন তা এমন এক কম্বিনেশন তৈরী করবে যাতে ভিন্ন দুই দেশের বীরত্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা (সর্বোচ্চ সম্মান চরমবীর চক্র এবং বীরশ্রেষ্ঠ মরণোত্তর পদক) পাওয়া দুই পাইলট একত্রে মিশনে যাচ্ছেন, যা ইতিহাসে বিরল)।
১৬ অক্টোবর, ১৯৭১
ডিমাপুর এয়ারফিল্ড, নাগাল্যান্ড
গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং কিলো ফ্লাইটের ওসি স্কোঃ লীঃ সুলতান মাহমুদকে ডেকে পাঠিয়েছেন (উনি এর আগে ১৪ অক্টোবর ওসি কিলো ফ্লাইট হিসেবে অফিসিয়ালি দ্বায়িত্বভার গ্রহন করেছেন)। উনি সুলতান মাহমুদ এবং তার দেশের বিমানসেনাদের আর্মড এলুয়েট অথবা চেতাকটির জন্য একটী প্রতীক ডিজাইন করে তা একে দিতে বললেন। এছাড়া এটির জন্য একটি নাম অথবা নাম্বার দেয়ার জন্যও বললেন।
চন্দন সিং এর এই কথা সুলতান মাহমুদ এবং অন্যান্যদের মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনার সৃস্টি করলো। ব্যাপক শোরগোলের মধ্যে দিয়ে তারা এই ব্যাপারে আলোচনা করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো যে হেলিকপ্টারের ভার্টিকাল স্ট্যাবিলাইজারটিতে একটি লাল বৃত্ত আঁকবেন যার মধ্যে থাকবে সবুজ রঙে আকা বাংলাদেশের ম্যাপ।
এর বাইরেও ঠিক করা হলো যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্য এর কলসাইন হবে ইবিআর।
চন্দন সিং সম্মতি দিলেন, রাতারাতি আইএএফ এর রাউন্ডেল মুছে ফেলা হলো এবং চেতাকটি বাংলাদেশী রঙ পেলো।
এই প্রথম কোন এয়ারক্রাফট বাংলাদেশী নাম, কলসাইন এবং রাউন্ডেল পেলো। এবং তাও হলো বিমান বাহিনী প্রধানের কোন ধরনের অনুমতি ছাড়াই। যুদ্ধের অস্থির সময়ে এইসব ব্যাপার কারো জন্য থেমে থাকেনা।
এরপর থেকে সবার লগবুকেই ৩৬৪ এর পরিবর্তে ইবিআর দিয়ে সনাক্ত করা হতো এই হেলিকপ্টারটিকে। অটার এবং ডিসি-৩ বিমানটিও এই সময়েই নিজস্ব রঙ এবং নাম পায়।
অক্টোবর (তৃতীয় সপ্তাহ), ১৯৭১
ডিমাপুর এয়ারফিল্ড, নাগাল্যান্ড
ওয়ার্শপে সামরিকীকরনের জন্য নানা মোডিফিকেশন শেষে ফ্লাঃ লেঃ ঘোষাল অটার বিমানটিকে আবার উড়িয়ে এনেছেন কয়দিন আগে। উনার একজন প্রশিক্ষনার্থী বৈমানিক হলেন ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলম। সবাই আজ তার জন্য তীব্র উৎকন্ঠা নিয়ে রানওয়েতে অপেক্ষা করছে কারন উনি একটি একক মিশনে গিয়ে এখনো ফিরে আসেননি। যদিও যা তেল ছিলো তা বেশ অনেকক্ষন আগেই ফুরিয়ে যাবার কথা। পুরো ক্যাম্প তার খবরের জন্য অপেক্ষা করছিলো।
সুর্য্যাস্তের কিছুক্ষন পর উনি ফিরে আসলেন নিরাপদেই। জানা গেলো যে উনি পূর্ব পাকিস্তানের উপর দিয়ে লো লেভেল ফ্লাই করে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন, এরপর ওখান থেকে রিফুয়েল করে ফেরত এসেছেন। ওইদিন আর কিছু হলোনা।
পরদিন রাতে ডিনারের পর ওসি কিলো ফ্লাইট, স্কোঃ লীঃ সুলতান মাহমুদ তার রিভলভার লোড করলেন এবং ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলমকে ডেকে পাঠালেন। সবাই ভয়ংকর কিছুর আশংকা করছিলো। রাতের পোকামাকড়ের ফিসফিসও নিস্তব্ধতার কারনে স্পস্ট শোনা যাচ্ছিলো। সুলতান মাহমুদ ফ্লাঃ লেঃ আলমকে নিয়ে রানওয়ের অন্ধকার অংশে চলে গেলেন।
একটা গুলির শব্দ শোনার ভয়ে ছিলেন সবাই। তারা ফিরে আসবার আগে ক্যাম্পের কেউ নিজেদের মধ্যেও একটা টু শব্দ পর্যন্ত করেননি!!
এরপর কোন কিলো ফ্লাইট মিশনে তিনি ক্যাপ্টেনের আসনে বসেননি অথবা আর একক উড্ডয়নের অনুমতি পাননি।
অক্টোবর (শেষ সপ্তাহ), ১৯৭১
জোড়হাট এয়ারবেস, আসাম
গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং অপারেশন রুমে আলোচনা করছেন। চন্দন সিং ড্রাফট পরিকল্পনা একে খন্দকারকে বুঝিয়ে বললেন। সিদ্ধান্ত হলো যে ৩ নভেম্বর প্রথম আক্রমন পরিচালিত হবে। এলিউট নারায়নগঞ্জের গদানাইলে এবং অটার ইস্টার্ণ রিফাইনারিতে আক্রমন করবে (ইস্টার্ণ রিফাইনারীর বদলে পরে বাঙ্গালী বৈমানিকদের আপ্ততির পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষ্যবস্তু হবে ওখানের তেলের আধারগুলো)। আর ডাকোটা নিয়ে তেজগাও বিমানবন্দরে ক্যাপ্টেন মুকিত, ক্যাপ্টেন খালেক এবং ক্যাপ্টেন সাত্তার আক্রমন করবেন।
(পরবর্তীতে ডাকোটা মিশন বাতিল করা হয়। কারন ডাকোটায় ব্যবহৃত জ্বালানী তেলের কারনে উড্ডয়নের সময় এর ইঞ্জিনের পেছনে যে ধোয়া বের হয় তাতে অঙ্গিস্ফুলিঙ্গ থাকে যা অন্ধকার রাতে অনেকদুর থেকে দেখা যায়। তাই ডাকোটা দিয়ে অভিযান নিরাপদ নয়। এতে ডাকোটার বৈমানিকেরা অত্যন্ত হতাশ হন। পরে এই ডাকোটা কর্নেল ওসমানীর ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য দেয়া হয় মুক্তিবাহিনীর নানা সেক্টরে আসা যাওয়ার কাজে এবং পরিবহন কাজের জন্য)
পরিকল্পনা করা হয় যে বিমানগুলো আক্রমনের আগে বেশ কয়েক জায়গায় রিফুয়েল করবে এবং শেষ যে জায়গা থেকে উড্ডয়ন করেছে, অভিযান শেষে সেখানেই ফিরে আসবে। কৈলাশহরকে প্রাথমিকভাবে আক্রমন শুরুর ঘাটি হিসেবে নির্বাচন করা হয়।
(৩ নভেম্বরের কিছু সময় আগে আক্রমনের পরিকল্পনা বাদ দেয়া হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য যান চলাচলে অসুবিধা এবং অপর্যাপ্ত সমর প্রস্তুতির কারনে। সেই বছর বেশ অনেকদিন ধরে বৃষ্টি হয়েছিলো যে কারনে নভেম্বরেও ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য ভারী যান চলাচলের জন্য উপযুক্ত ছিলোনা নানা অন্যা দুর্গত এবং নদীবহুল স্থান। পরবর্তীতে আক্রমনের দিন নির্ধারন করা হয় ২৮ নভেম্বর। সেদিন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রতি আক্রমনের আশংকায় দমদম বিমান ঘাটী থেকে সকল বিমান অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। তবে শেষ মুহুর্তে সবুজ সংকেত না পাওয়ার অভিযানের দিন আরো পাচদিন পিছিয়ে ৩ ডিসেম্বর করা হয়। যা নিতান্তই কাকতালীয়ভাবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরুর আনুষ্ঠানিক ঘোষনার দিন হয়ে যায়। তবে কিলো ফ্লাইটের অভিযানের মাধ্যমেই পুর্ব পাকিস্তানে প্রথম বিমান আক্রমন শুরু করবে মিত্র বাহিনী।
হয়তো পি সি লাল তার মৃদু হাসির দিয়ে বেশ কয়মাস আগে একে খন্দকারের অনুরোধ কিংবা দাবীর প্রতি সম্মতিই জানিয়েছিলেন, যার কারনে তার নিজের বাহিনীর আক্রমন সংযত রাখবেন। কিলো ফ্লাইটের আক্রমন শেষ হবার পরপর ভোররাত থেকেই শুরু হবে ভারতীয় বিমান বাহিনীর একের পর এক এয়ার রেইড)
০১ ডিসেম্বর, ১৯৭১
জোড়হাট এয়ারবেস, আসাম
সকাল ৯ টা
কিলো ফ্লাইটের আক্রমননের জন্য নির্বাচিত সকল বৈমানিককে গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং ব্রিফিং রুমে ডেকেছেন। ম্যাপ এবং চার্টের মাধ্যমে সবাইকে অপারেশনের পরিকল্পনা পুঙ্খানুপুংখ রুপে বুঝিয়ে দিলেন চন্দন সিং।
এরপর দুপুরে পরিকল্পিত নাইট স্ট্রাইকের ব্যাপারে আবার আলোচনায় ডাকলেন সবাইকে। উনি জানতে চাইলেন আগরতলার কাছের একটি এয়ারফিল্ড থেকে আক্রমন করা হবে গোদানাইলে, কিলো ফ্লাইটের বৈমানিকেরা সেটার জন্য প্রস্তুত কিনা এবং রাতের অন্ধকারে ঠিকমত নেভিগেট করে সঠিক লক্ষ্যে আঘাত হেনে ফিরে আসতে পারবে কিনা। তাকে বলা হলো, সবকিছুই সম্ভব কিন্তু অন্ধকার রাতে কোন ধরনের হোমিং ডিভাইস ছাড়া অনুজ্জ্বল স্থানে ফিরে আশা ভয়ঙ্কর হতে পারে প্রবল বাতাসের মধ্যে। এমনকি হ্যান্ডহেল্ড রেডিও সেট থাকলেও সঠিক নির্দেশনা দিয়ে ফিরিয়ে আনা কঠিনই হবে।
রাতারাতি এই সমস্যার সমাধান করা হলো, একটী পেট্রোম্যাক্স বাতি একটি টিনের ডিব্বা দিয়ে অল্প ছিদ্র করে ঢাকা হলো। ওইটা রানওয়ের নির্দিস্ট স্থানে স্থাপন করে ম্যানুয়ালি অপারেট করা হবে রাতে ফিরে আসবার সময়। এটি একটি লাইট হাউজের মতো কাজ করবে হোমিং এর জন্য। (পরিস্কার আকাশে একটি ম্যাচের কাঠি জ্বালালেও তা ৫০ কিমি দূর থেকে মানুষ দেখতে পায়)
০২ ডিসেম্বর, ১৯৭১
কৈলাশহর এয়ারফিল্ড, আসাম
পুরো কিলো ফ্লাইট বহর কৈলাশহরে পৌছেছে আজ। গতকালই ডাকোটা এখানে চলে আসে। আজ এসেছে এলিউটটি। ডিসি-৩ টি আসা যাওয়ার মধ্যেই আছে। এখানেই পুরো আর্মামেন্ট লোড সহ কিলো ফ্লাইটের ডাকোটা এবং এলিউট-৩ এর সকল কারিগরী দিক এবং অন্যান্য নিরিক্ষা সম্পন্ন করা হলো।
০৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১
তেলিয়ামুড়া, ত্রিপুরা
রাত ১ টা
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির এতো উৎকর্ষের মাঝেও রাতে হেলিকপ্টার চালানো বিবেচনা করা হয় ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে। তবে সুলতান মাহমুদ এবং বদরুল আলম উড্ডয়ন করলেন পূর্ণ তেল এবং আর্মামেন্ট লোড সহ। সকল প্রসিডিউর ফলো করে তারা উড্ডয়ন করে হোভারে ছিলেন, হেলিকপ্টারের নেভিগেশন লাইট অন ছিলো। কুয়াশা ভেদ করেও তাদের স্পস্ট দেখা যাচ্ছিলো। একটি হ্যান্ডহেল্ড মাইক নিয়ে ফ্লাঃ লেঃ সিংলা তাদের লাইট অফ করতে বললেন। এর কয় সেকেন্ড পর হেলিকপ্টারের গর্জন শোনা গেলেও তা রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলো। সেদিন ছিলো ভরা পূর্ণিমা, সাথে শীতের রাতের ঘন কুয়াশা মিলে ভৌতিক থমথমে পরিবেশে শুরু হলো বাঙ্গালী বৈমানিকদের প্রথম এটাক মিশন। গন্তব্য এবং লক্ষ্যঃ নারায়নগঙ্গের গোদানাইল ফুয়েল ডিপো!!
(এটাকে প্রথম বললেও আসলে প্রথমে উড্ডয়ন করে অটার টি। অটারটি যখন তেলিয়ামুড়ার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো তখন এলিউটে সুলতান মাহমুদ এবং বদরুল আলম সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন শেষ করে উড্ডয়নের অপেক্ষায় ছিলো। তবে প্রথম আঘাত হানে এলিউটটি।)
স্কোঃ লি সুলতান এবং ফ্লাইং অফিসার বদরুল যখন আখাউড়া সীমান্তে পৌছালেন তখনই শুরু হলো গুলি বৃষ্টি। কিছুদিন আগে ভারতীয়রা সীমান্তে আক্রমন করায় পাকিস্তানীরা ছিলো রেড এলার্টে। আবার চরম গোপনীয়তা রক্ষার কারনে ভারতীয় সেনারাও এই মিশন সম্পর্কে কিছু জানতেননা। দুপক্ষই হেলিকপ্টারটির আগমন সম্পর্কে না জানার কারনে প্রতিপক্ষ ভেবে গোলাগুলি শুরু করে। ট্রেসার বুলেট ধেয়ে আসছিলো চারদিক থেকে। বদরুল আলম কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে সুলতান মাহমুদকে বললেন,
- “এ কোথায় নিয়ে আসলেন স্যার? আপনি না বলেছিলেন টার্গেটে পৌছাবার আগ পর্যন্ত বসে আরাম কর আর যন্ত্রপাতির দিকে লক্ষ্য রাখো।“
কিছুই বলার ছিলোনা সুলতান মাহমুদের। একবার বদরুল আলমের দিকে তাকিয়ে আবার সামনের দিকে মনোনিবেশ করলেন। তার মাথায় কেবল টার্গীটে পৌছাবার চিন্তা!!
কিছুক্ষন পরেই তারা ফায়ারিং রেঞ্জের বাইরে চলে আসতে সক্ষম হন। ইলিয়টগঞ্জ এর কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বিধ্বস্ত একটি সেতু দেখতে পান, এরপরেই দ্রুত টার্ন নিয়ে তারা ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়ক চলছিলেন। এইসময় তারা অত্যন্ত নীচু দিয়ে উড়ে আকাবাকা মহাসড়ক ফলো করছিলেন লক্ষ্যে পৌছাতে, এছাড়া আর কোন উপায় ছিলোনা রাতের বেলা লক্ষ্যে পৌছাবার। দাউদকান্দির কাছে একটি মাইক্রোওয়েভ টাওয়ার এবং দুটি নদী পার হবার সময় বৈদ্যুতিক পোলের সাথে আঘাত পাবার হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পান। তারা উড়ে চলছিলেন মহাসড়কের গাছগুলোর ঠিক উপর দিয়ে। এভাবে তারা ডেমরা পৌছালেন। শীতলক্ষ্যার কাছে এসে দক্ষিণে মোড় নিয়ে সোজা গোদনাইলের দিকে এগুলেন। এসময় সাথে থাকা এয়ার গানার সার্জেন্ট শহীদুল্লাহ (বীর প্রতীক) প্রায় চীৎকার করে ওঠেন। খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তিনি দেখতে পান ঠিক নিচেই নদীর পানি এবং তারা একটি বৈদ্যুতিক পোলের তারের ঠিক নীচ দিয়ে উড়ে চলেছেন। কিছুক্ষন পর অবশ্য আর কোন ঘটনা ছাড়াই তারা লক্ষ্যস্থলে পৌছে যান। পৌঁছেই তেলের ট্যাংকারের ওপর তারা রকেট নিক্ষেপ করেন। মুহূর্তের মধ্যেই ট্যাংকারগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে পুরো আকাশ। আগুনের উজ্জ্বলতার কারনে কালো ধোয়ার কুন্ডলী অনেক দূর থেকেও দেখা যাচ্ছিলো।
ফিরবার সময়ে আবার আখাউড়ার কাছে এসে হাল্কা গোলাগুলির মুখে পড়েন তারা। তবে মশনের সফলতার আনন্দে এসব তাদের বিচলিত করলোনা আর। দীর্ঘ্য সাড়ে তিনঘন্টার সফল অভিযান শেষে যখন তারা নিরাপদে অবতরন করলেন, তখন আর কেবল ১০-১৫ মিনিটের তেল অবশিষ্ট ছিলো। একটু দিকভ্রান্ত হলেই তাদের অভিযান সফল হতোনা এবং ফিরতে পারাটাও কঠিন হয়ে যেতো।
(আক্রমনের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে প্রথমে নারায়নগঞ্জের গোদানাইলে ইএসএসও বার্মার তেলের ডিপো এবং চট্টগ্রাম ইস্টার্ণ রিফাইনারীতে হামলার প্রাথমিক পরিকল্পনা আসে ভারতীয়দের পক্ষ থেকে। কিন্তু বাঙ্গালী বৈমানিকেরা ইস্টার্ণ রিফাইনারিতে আক্রমনের বিরুদ্ধে মতো দেন, যা ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র তেল শোধনাগার। এর বদলে তারা চট্টগ্রামের তেল সংরক্ষনের আধারগুলোতে আক্রমনের পরিকল্পনা করেন। তাদের যুক্তি ছিলো, যদি এই রিফাইনারি ধ্বংস করা হয় তবে দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশ তার প্রয়োজনীয় তেল পরিশোধন করতে পারবেনা। তাই এটা কোনভাবেই ধ্বংস করা যাবেনা।
লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ওইদুটো তেলের ডিপো বেছে নেবার প্রধান কারন হচ্ছে ওই দুটো ডিপোতেই এভিয়েশন ফুয়েল (জেট A-1) মজুদ থাকতো। যদি কোনভাবে এই দুটি ডিপো দ্বংস করা যেতো তবে খুব সহজে আবার বিদেশ কিংবা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এই ধরনের তেল আনা সময় এবং বেশ কস্টসাধ্য ছিলো। যার কারনে বেশকিছুদিনের জন্য পাকিস্তানীদের বিমান বাহিনির কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্থ হতো তেলের অভাবে। এর বাইরে সাধারন যানবাহন এবং নোয়যানের জন্যও তেলের মজুদ এই দুই ডিপোতে ছিলো। যার কারনে সামগ্রিকভাবে পাকিস্তান বাহিনীর কার্যক্রমে ব্যাপক প্রভাব পড়তো।)
০৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১
কৈলাশহর এয়ারফিল্ড, ত্রিপুরা
রাত ১২০০ টা
এইমাত্র চট্টগ্রামে ফুয়েলডাম্পে আক্রমনের জন্য উড্ডয়ন করেছে কিলো ফ্লাইটের অটারটি। ক্যাপ্টেন হিসেবে আছেন আকরাম আহমেদ এবং কো পাইলট ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলম। দীর্ঘ্যদিন প্ল্যান্ট প্রটেকশনের কাজ করার সুবাদে চট্টগ্রামের রুট এবং নানা গুরুত্বপূর্ন স্থাপনার অবস্থান তার মুখস্থই বলা চলে।
পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা উড়ে গেলে আগরতলার কাছের তেলিয়ামুড়ার উপর দিয়ে। এর কাছাকাছি আসার পর উনারা বিমানের বাতিগুলো পরপর বেশ কয়বার জ্বালালেন নেভালেন। তেলিয়ামুড়া থেকে সবুজ রঙয়ের মশাল জ্বালিয়ে তাদের সংকেত দেয়া হলো যে তারা নির্ধারিত রুটেই আছেন। গভীর অন্ধকারে দিকভ্রান্ত হলে তারা এই আলো দেখে রুট সংশোধন করতে পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে।
এরপর তারা উড়ে চললেন ফেনীর উপকুলে রিভারমক বলে একটি স্থান আছে তার উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে অবস্থান চিহ্নিত করে এগিয়ে যাবেন চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। উপকুল ধরে খুব লো ফ্লাই করে তারা এগিয়ে চলবেন চট্টগ্রাম বন্দরের কাছের ফুয়েল ডিপোতে।
সীতাকুন্ডের কাছে পৌছে বামে তাকিয়ে তারা দেখলেন সেখানে পুরো অন্ধকার। পুরো চট্টগ্রাম পাকিস্তানীরা ব্লাক আউট করে রেখেছিলো বিমান আক্রমন থেকে সুরক্ষার জন্য। সেদিন ছিলো পূর্ন চন্দ্রের রাত, ভরা পূর্ণিমা!!
আরো কিছুদুর এগিয়ে তারা বন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজগুলোর আলো দেখতে পেলেন। বুঝতে পারলেন লখ্য খুব কাছেই। ৫০০ ফুট উচ্চতা থেকে তারা ক্রমশ উপরের দিকে উঠতে থাকলেন। বোম্বিং অপারেশনে আক্রমনের জন্য একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় আসার দরকার ছিলো। ভরা পূর্ণিমার কারনে সবকিছু স্পস্ট দেখা যাচ্ছিলো। দূর থেকেই তারা ফুয়েল ডাম্প দেখতে পেলেন। তারা আক্রমনের জন্য ডাইভ দিলেন।
এখানে অতিরিক্ত উত্তেজনায় ভুল করে বসেন তারা। সালভো মুডে সব রকেট নিক্ষেপ করবার কথা থাকলেও তারা ফায়ার করলেন পেয়ার মুডে। ১৪ টির বদলে ২ টি রকেট উড়ে গেলো। উপর থেকে দেখতে পেলেন নীচে প্রচন্ড শব্দের পর জ্বলে উঠেছে ফুয়েল ডাম্প।
তবে তারা যেহেতু কোন বাধা পাননি, তাই নিজেদের ভুল শোঢরাতে আবার আক্রমনের মাধ্যমে সব রকেট ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলেন। একটি সার্কেল করে এসে আবার তারা আক্রমনের জন্য ডাইভ দিলেন। এবার সালভো মুডে একেবারে সব রকেট নিঃশেষ করলেন। দাউ দাউ আগুনে ব্যাপক শব্দ করে বিস্ফোরিত হচ্ছিলো তেলের আধার।
তবে রকেট ফায়ারের সময় আলোর ঝলক দেখে এবার হুশ হলো এন্টি এয়ারক্রাফট গানারদের, প্রথমবার হয়তো তারা ভেবেছিলো এটা প্ল্যান্ট প্রটেকশন কিংবা ফ্লাইং ক্লাবের কোন বিমান হবে, কারন সামরিক বিমানের আওয়াজ আরো উচ্চ হয়। এই আওয়াজ তাদের পরিচিত ছিলো। পেজা তুলোর মতো উড়ে আসতে লাগলো ট্রেসার বুলেট। যতই উনারা সরে যেতে চাইছিলেন, তাও মনে হচ্ছিলো যে উনাদের পতঙ্গের দিকে ধেয়ে আসছে তুলো তুলো আগুন। ভাগ্যক্রমে এর কোনটিই তাদের আঘাত করেনি!!
এরপর তারা ভারতের দিকে খুব লো ফ্লাই করে রওনা দেন। তাদের গন্তব্য এবার কৈলাশহর নয়, কুম্ভিগ্রাম এয়ারফিল্ড। সাড়ে চার ঘন্টার অপারেশন শেষ করে এখানে এসে যখন অবতরন করলেন তখন তাদের আর মাত্র ১০ মিনিটের তেল অবশিষ্ট ছিলো।
(চট্টগ্রামবাসীর কাছে সেদিনটি ছিল অন্য রকম একটি দিন। বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় নগরবাসীর। ভয়ার্ত, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে থাকে সাগর পানে। সেদিক থেকে ভেসে আসছে আগুনের লেলিহান শিখা। বহু মাইল দূর থেকেও দেখা গিয়েছিল এই কমলা রঙ্গের আভা। পুরো তেলের স্টক শেষ না হওয়া পর্যন্ত আগুন জ্বলেছিল একটানা তিন দিন যার স্মৃতি আজও অমলিন নগরীর প্রবীণদের মাঝে। ভাগ্যক্রমেই হয়তো তারা প্রথম যে ডাম্পে আঘাত করেছিলেন, তা ছিলো এভিয়েশন ফুয়েল ডাম্প।)
মার্চ (১ম সপ্তাহ), ২০১১
পূর্ব রাজাবাজার, ঢাকা
এক তরুণ ফ্লাঃ লেঃ কে দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছে বিমানবাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত প্রাক্তন বাহিনী প্রধানদের জন্য বাহিনী প্রধানের পক্ষ হতে সম্মাননা অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্র পৌছে দেবার জন্য। তাঁদেরই মধ্যে থেকে একজনের বাসার ঠিকানা দেয়া ছিলো রাজাবাজারের (ফার্মগেটের কাছেই)। এর আগেরদিন সে রাজাবাজারের গলি গলি ঘুরে ঠিকানা মিলিয়ে বাসা খুঁজে পায়নি হাতে সময় কম থাকার কারনে। সার্ভিসের জীপ নিয়ে গলির জ্যামে অনেকক্ষন আটকে থেকে সেদিন আর খোজার সাহসও করেনি। এরপরদিন আবার সকালে সে রওনা দিলো, তবে এবার সময় বাচাতে নিজের বাইকটা সম্বল করেই। বাসাও খুঁজে পাওয়া গেলো এবার খুব বেশি ঝামেলা না ভোগ করেই। এক প্রায় ৬০ পেরোনো ভদ্রলোক গেট থেকে এসে তাকে বাসার ভেতরে নিয়ে গেলেন। স্যারের কথা জিজ্ঞেস করতেই উনি বললেন,
- “উনি তো এখন আমেরিকায় আছেন, আসতে পারবেননা। তবে উনাকে খবর পৌছে দেব আর দাওয়াতপত্র যখন উনি আসবেন হাতে দিয়ে দেব।“
কিছুটা বিমর্ষ হলো সেই তরুণ অফিসার। সে ভেবেছিলো কিছু নতুন গল্প শুনতে পারবে। এর আগে যতবারই এমন সুযোগ পেয়েছে কখনোই এমন কিছু শুনতে পাবার সুযোগ হাতছাড়া করেনি। আর বাসায় গেলে এমনিতেই অনেক কথা বলেন পুরোনো দিনের সেইসব অফিসারেরা। এরপর কিছুক্ষন সেই ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হলো। উনি তাকে “তুমি” করে সম্বোধন করছিলেন। আর বিমান বাহিনীর অফিসারদের কথা বলার স্বভাবসুলভ সৌজন্যের মতো একটা ব্যাপার চোখে পড়ছিলো। ব্যাপারটা একটু কেমন যেনো লাগলো। এভাবে সাধারনত কেউ বলেনা ইউনিফর্ম পড়ে গেলে। কৌতুহল দমন করতে না পেরে সে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
- “If you don’t mind, may I know you were in defense or not.”
সেই ভদ্রলোক জবাব দিলেন,
“হ্যা, আবার নাও বলতে পারো। ৭১ এ আমি ক্যাডেট ছিলাম। ২ বছর পার করবার পর ৭১ এ আমাদের ট্রেনিং সাস্পেন্ড করা হয়। এরপর দেশে পাঠাবার কথা থাকলেও না পাঠিয়ে নজরবন্দী হিসেবে রাখা হয়। এরপর ৭৩ সালে আমরা ফেরত আসি দেশে বন্দী বিনিময় চুক্তির পর।“
এরপর আরো কিছু কথা হয় উনার সাথে, বিদায় নেবার আগে উনার ফোন নম্বরও নিয়ে আসে আরো বিস্তারিত কথা বলবার জন্য, জানা হয়তো হয়েছিলো আরো অনেক কিছুই। কিন্তু সেগুলো এই লেখার পরিধির বাইরে। সে এক অন্য কাহিনী!
উইং কমান্ডার মাহমুদ ৭১ এ কিংবা এর পরে সেই ক্যাডেটদের ভাগ্যে কি হয়েছিলো জানতেন নাকি জানা নেই। তবে সেই ৫৬ জনের একজন সেই তরুণ ফ্লাঃ লেঃ কে তার উত্তরের কিছুটা নিজের অজান্তেই জানিয়ে দিলেন ঠিক ৪০ বছর পর!!
পরিশিষ্টঃ
এটা নিতান্তই সাধারন একটি ব্লগ ভার্সন পোষ্ট, আরো বিশাল ক্যানভাসের কিছু থেকে যথাসম্ভব কাটছাট করে তুলে আনা ক্ষুদ্র একটা অংশ; ভুলেভালে ভরা একটি ব্লগ পোষ্ট। তাই হুট করেই শেষ করা ছাড়া উপায় নেই। এটা গল্পের মতো করে সময়ের মাঝে কিছুটা লাফঝাপ দিয়ে ইতিহাসের ধারেকাছে দিয়ে যাবার দুর্বল অপচেষ্টা। তবে কিছু ব্যাপার এর বাইরেও থেকে যায় যা সময়ের পরিধিতে বেধে বলা সম্ভব নয় ব্লগে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বিমান বাহিনী এবং এর একমাত্র উইং কিলো ফ্লাইটই ছিলো সম্ভবত তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্র বিমান বাহিনী। তবে মাত্র দুটি আর্মড বিমান নিয়ে মাত্র ১০ দিনের মধ্যে এতো মিশন/হামলা পরিচালনা মনে হয় আর কোন বিমান বাহিনীই করেনি। মুক্তিযুদ্ধে এই ছোট্ট কিলো ফ্লাইট কি করলো, শত্রুর কতটা ক্ষতি করলো কিংবা বীরত্ব দিয়ে দেশকে কতটা উদ্ধার করে দিলো তা বোঝানো এই লেখার উদ্দেশ্য নয়, কখনো ছিলোনা। এই কিলো ফ্লাইট আমাদের সুর্যোদয়ের সাক্ষী। এর পেছনের কাহিনীগুলো থেকে আমাদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের অনেক অনেককিছু শেখার আছে। এই কিলো ফ্লাইট গঠনের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে শত মানুষের স্বপ্ন, দেশপ্রেম আর দৃঢ় সংকল্পের বুক ভার করা, মাথা উচু করে বাঁচতে চাওয়ার সংগ্রামের টুকরো গল্প।
যুদ্ধে জিতবোই, জিতে বীরত্বের খেতাব কিংবা অনেক বড় কোন পুরস্কার পাব এটা আগে ভেবে নিয়ে কিন্তু কেউ যুদ্ধে যায়নি। যুদ্ধে গেছে এটা জেনে যে এটাই করা উচিত, নৈতিক দিক দিয়ে নিজের অবস্থান সুস্পষ্ট এটা জেনেই।
এই দেশের স্বাধীনতা পরবর্তি ইতিহাস অথবা ঘটনাপ্রবাহ খুব বেশি একটা সুখকর কিংবা সম্মানের না। দেশের ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে বাচ্চারা ইতিহাসও ভিন্নভাবে শিখেছে। কারো কাছে শেখ মুজিব মহামানব, কারো কাছে জিয়াউর রহমান। আবার দেশের একটা অংশ যাদের পরিমান শতকরা হিসেবে খুব কম হলেও সংখ্যার হিসেবে কোটি ছাড়িয়ে যাবে তাদের কাছে এই মুক্তিযুদ্ধ তেমন কোন মানেই রাখেনা। সব হিসাব নিকাশের বাইরে বেরিয়ে আসল সত্য হছে আমাদের আছে নিজের একটা দেশ, একটা পতাকা। দৃষ্টীভঙ্গী যাই হোক, এই দেশের প্রতি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে বুক ভরা মায়া রাখে, পতাকা গায়ে জড়িয়ে আবেগে ভাসতে শেখে। এর বেশি কিছু লাগবেনা। আমাদের দরকার দেশের জন্য বুক ভরা মায়া ধারন করা একটা নতুন প্রজন্মের, যারা আমাদের ক্ষুদ্রতা এবং ব্যর্থতার বাইরে বেরিয়ে দেশটাকে সম্মান করতে শিখবে নিজের মায়ের মতো, ভালোবাসবে নিজের সন্তানের মতো।
দেশটা একদিন না একদিন হয়ে উঠবে লাখ লাখ মানুষের রক্তে কেনা সেই স্বপ্নের মতো, আমাদের “সোনার বাংলাদেশ”!!
তথ্যসুত্রঃ
কিলো ফ্লাইটের বৈমানিকদের সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা, এয়ার কমোডর সিএম সিংলার সাক্ষাৎকার, একাত্তরঃ ভেতরে বাইরেঃ এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) এ কে খন্দকার, ঈগলস ওভার বাংলাদেশ, বিমান বাহিনী জাদুঘরে সংরক্ষিত পাইলটস লগবুক, মাই ডেসটিনিঃ এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) এ জি মাহমুদ, এয়ার কমোডর নারিন্দর চাতরাথ (অবঃ) এবং লেঃ কর্নেল অমরেন্দ্রনাথ মুখার্জী (অবঃ) সাথে কথোপোকথন এবং অন্যান্য
©somewhere in net ltd.