নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

তবু আজও স্বপ্ন দেখার নেই মানা ........

শহুরে আগন্তুক

নিজের কাছে নিজেই অচেনা রয়ে গেছি আজো । চেনার চেষ্টা করছি । মানুষ হিসেবে কেমন তা অন্যরাই ভাল বলতে পারবে । আমার কাছে আমি আমার মতোই । আশাবাদী , স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি । সুন্দর এবং শুদ্ধ অনুভূতিময় স্বপ্ন ।

শহুরে আগন্তুক › বিস্তারিত পোস্টঃ

এঁটেল মাটির জিলাপি

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:৫২

পাশের এলাকায় মেলা বসেছে । সেখানে গিয়ে সাথে যাওয়া অভিভাবককে যথেষ্টর চেয়েও বেশী জ্বালিয়ে অনেক কিছু কিনে ফেলা হলো । স্কুল পর্ব তখনও শুরু হয় নি । নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে আমি বেশ স্বাধীন মানুষ । সারাদিন টো টো করে ঘুরার ফাঁকে বিকেলে রাশেদা ফুপি আর সন্ধ্যায় উঠোনে মা‘র সাথে হারিকেন জ্বালিয়ে মাদুর পেতে বসে কয়লার কালো রঙের প্রলেপ দেওয়া স্লেটটায় কিছুক্ষণ কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং আঁকা শেষে, ঘনঘন হাই তুলে খেয়ে ঘুমাতে চলে যাওয়া ছাড়া আর তেমন কোন কাজ নেই । তখন বাড়ির আশেপাশে মেলা বসা মানে ঈদের কাছাকাছি আনন্দ । হলুদ পুঁতির গুলি-ওয়ালা ফাইভ স্টার বন্দুক, পানিতে চলা টিনের জাহাজ, খই উখড়া, মুছি মেঠাই দিয়ে পাক দেওয়া নিমকি, টমটম গাড়ি সব কিনে সারা মাসের বাজার এক দিনে করে ফেলার মতো অবস্থায় চলে যাওয়ার পর চোখে পড়লো রাস্তার পাশের এক দোকানে । সেখানে নানান রঙের মাটির পুতুল; টিয়া পাখি, সাদা পাঞ্জাবীর জামাই আর লাল রঙের বউ, হুবহু তালের মতো দেখতে মাটির ব্যাংক, ছোট ছোট হাঁড়ি, পাতিল সহ আরও নানান রকমের জিনিস । মফস্বলের চেয়ে কিছুটা পিছনে, গ্রামের চেয়ে কিছুটা আগে এমন জায়গাগুলোর বাচ্চাদের কাছে তখন ব্যাটারি দিয়ে চলা রোবোকপ, রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি, হেলিকপ্টার জাতীয় খেলনা খুব বেশী দেখা যেতো না । প্লাস্টিকের সস্তা খেলনা, না হয় মাটির পুতুলই ভরসা । বয়সও তখন নিতান্তই কম । চার – পাঁচ হবে বড়জোর । তারপরও এক বস্তা জঞ্জাল কেনার পর ছেলে হয়েও মাটির জিনিসপত্র কিনতে চাওয়ার মতো মেয়েলি ইচ্ছা পূরণ হচ্ছে না দেখে মেলায় সবার সামনেই মাটিতে গড়াগড়ি দিতে শুরু করার দৃশ্য দেখে সাথের বড় মানুষটা স্বাভাবিক কারনেই অত্যন্ত বিরক্ত হলেন । কানের নিচে দুই একটা চড় থাপ্পড় তিনি বসাতেই পারতেন, কিন্তু কি মনে করে যেন তা আর করলেন না । তার বদলে মাটিতে গড়াগড়ি দেওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখে ঠাণ্ডা চোখে বললেন,



- " আরও ভালো মতো গড়ান দে । আমি কিছু কমু না, বাইত যাওনের পর পিট্টিটা তোর মা-ই দিবো নে জামা নষ্ট করার জন্য । থামস কেন? ভালো মতো গড়ান দে ... আরও ভালো মতো । "



বোঝা গেলো আবদার পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই । কাজেই আরও কিছুক্ষণ বৃথা আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার আর গড়াগড়ি দেওয়া চালানো শেষে মুখ গোঁজ করে বাধ্য হয়ে উঠে পড়তেই হল ।



সৌভাগ্যক্রমে বাসায় জামা কাপড় ময়লা করার জন্য বকাঝকা খেয়েই ছাড়া পাওয়া গেলো, ধোলাই পর্ব আর অনুষ্ঠিত হল না । কিন্তু মনটা হয়ে থাকলো ভার । চোখের সামনে ভাসছে ঝকঝকে মাটির খেলনাগুলো । কি করা যায়? বাসা থেকে যে কিনে দেবে না সে তো বোঝাই যাচ্ছে, কিন্তু মন তো মানছে না ! এখন উপায় ? ...... অনেক ভেবে-চিন্তে বুদ্ধি বের হল একটা । কেনা যখন যাবে না, নিজেই বানিয়ে নেওয়া যাক তবে । বুদ্ধিটা দুনিয়ার যাবতীয় ফিচলে বুদ্ধিতে অঘোষিত পিএইচডি ডিগ্রি ধারী এক বছরের বড় চাচাতো ভাই মাকসুদ কে জানালাম । শোনা মাত্রই সেও মহানন্দে রাজী ।



এবার সমস্যা হল আরেক জায়গায় । সব মাটি দিয়ে কুমার হওয়া যাবে না । তার জন্য দরকার হলদে রঙের আঁশটে এঁটেল মাটি যা পাওয়া যায় বাড়ি থেকে দূরের “ চিত্তরঞ্জন মাঠ “ বলে এক জায়গায় । অতদূরে একা একা চলে গেলে বাসায় ফিরে এসে আস্ত থাকতে পারার সম্ভাবনা কম । লুকিয়েও যাওয়া যাবে না । এলাকার মেম্বারের বড় নাতি বলে আশেপাশের যত মানুষ আছে সবাই আমাকে চেনে । কেউ না কেউ দেখে ফেলে বাসায় এসে খবর পাচার করে দিয়ে শক্ত পিট্টি খাওয়ার পাকা বন্দোবস্ত করে দেবেই দেবে । তাহলে কি করা যায়?



সেই ছোট বেলাতেই আবিষ্কার করলাম ইচ্ছা থাকলে উপায় আসলেই হয় । এক বছর আগে দুনিয়ায় আসা অত্যন্ত দায়িত্ববান বড় ভাই কোথা থেকে যেন খবর নিয়ে আসলো যে কোন মাটিকেই কিছুক্ষণ আগুনে পোড়ালে সেটা পুড়ে নাকি হলুদ হয়ে এঁটেল মাটি হয়ে যায় । কাজেই মাটির সমস্যাও সমাধান হয়ে গেলো সহজেই ।



আমাদের তখন গৃহস্থ ধরণের বাড়ি । বিশাল খোলামেলা বাড়িতে নিজেদের জমির ধান রাখার জন্য ঘরের চাল সমান উঁচু মাটির গোলা, ভেতরে দুই-তিন জন মানুষ ঢুকে একসাথে বসে থাকতে পারবে এমন সাইজের চকচকে কালো রঙের পোড়া মাটির মটকা, বাড়ির পেছনের দিকে গোয়ালের তিনটা গরুর জন্য খড়ের গাদা ( আমরা বলতাম খড়ের পাড়া ) সবই আছে; নেই কেবল লুকিয়ে এঁটেল মাটি বানানোর ফ্যাক্টরি খোলার মতো নির্জন জায়গা । একটা দিন দুই ভাই মিলে কাটালাম জায়গা খুঁজে । অবশেষে সেটাও পাওয়া গেলো ।



আগের দিন গরুকে সারা বছর খাওয়ানোর জন্য দশ হাজার টাকার নতুন খড় কেনা হয়েছে । বৃষ্টির পানি জমলে খড় নষ্ট হয়ে যায় বলে গাদা বানানো হতো বাঁশের খুঁটির দিয়ে মাটি থেকে দেড় – দুই ফুট উঁচু মাচা বানিয়ে তার উপর । মাচার নিচের জায়গাটা লুকিয়ে কিছু করার জন্য একেবারে আদর্শ । পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে চলে গেলেও,উবু হয়ে উঁকি না দিলে বোঝার কোন উপায় নেই যে মাচার নিচে কেউ আছে । তবে এই জায়গার ভয়টা অন্য রকম । খড়ের গাদার নিচে ইঁদুরের গর্ত আছে বলে মাঝেমাঝেই বাড়ির পাশের পুকুর থেকে সাপ উঠে চলে আসে গর্তে ঢুকে ইঁদুর ধরে খেতে । প্রতিবার খড় শেষ হয়ে যাওয়ার পর সব গর্তে ধুপ দিয়ে ধোঁয়া দেওয়া হতো যেন গর্তের ভেতরের বাসিন্দারা সুড়সুড় করে বের হয়ে আসেন । সব সময় যে ধেড়ে সাইজের ইঁদুরই বেরোতো তা না, কয়েক ফুট লম্বা বিশাল বিশাল সাপও বের হয়েছে বহুবার । কাজেই গাদার নিচে ঢুকলে এক বা একাধিক সর্প বাবাজীর সাথে সামাজিক সৌজন্য সাক্ষাত করার একটা সুযোগ কপালে জুটে যাওয়ার সম্ভাবনা খারাপ না ।



কিন্তু ভয় পেলে তো চলবে না ! মাউণ্টন ডিউ-য়ের নাম না শুনলেও নিজ থেকেই আমরা জানি “ ডার কি আগে জিত হ্যায় “ । বিসমিল্লাহ্‌ বলে দুই ভাই হাফ প্যান্ট আর স্যাণ্ডো গেঞ্জি গায়ে হামাগুড়ি ঢুকে গেলাম খড়ের গাদার নিচে, দুপুর বেলায়ও যেখানটা প্রায় অন্ধকার । সাথে রান্না ঘর থেকে চুরি করে নিয়ে আসা কেরোসিনের কুপি, প্রজাপতি দেশলাই আর গর্ত করার জন্য শামুকের চারা ( শামুকের শক্ত খোলস ) . প্রথমে ছোট খাট একটা গর্তের মতো করলাম দু’জনে । তারপর ঐ গর্তে ঢাললাম ইঁদুর নিজের বাড়ি বানাতে গিয়ে পেছনে ফেলে যাওয়া ঝুরঝুরে মাটি । মাটিতে সহজে আগুন ধরবে না বলে কুপি খুলে কেরোসিন ঢেলে ভিজানো হলো ভালো মতো । তারপর আগুন দেওয়া হল ।



দপ দপ করে আগুন জ্বলছে । উত্তাপ বাড়ছে আস্তে আস্তে । খড়ের গাদার নিচের অন্ধকার জায়গাটা কেমন লালচে একটা আভা । দুই ভাই এক দৃষ্টিতে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছি কীভাবে মাটি পুড়তে পুড়তে ধীরে ধীরে টকটকে লাল হয়ে যাচ্ছে । পরিবেশ , পরিস্থিতি, লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু করার আনন্দ ; সব মিলে প্রায় হিপনোটাইজড অবস্থা । আরও মাটি দিলাম, কেরোসিন ঢাললাম । এরপর যে ব্যাপারটা ঘটলো তার জন্য দুই জনের কেউই প্রস্তুত ছিলাম না । খড়ের গাদার নিচের দিকের খড়ে হুট করে আগুন লেগে গেলো ।



তখন গরম কাল । প্রচণ্ড রোদে সকল খড় শুকিয়ে খটখটে হয়ে আছে । দুই ভাই চোখের সামনে দেখছি আস্তে আস্তে আগুন বাড়ছে । সাথে বাড়ছে ধোঁয়া । কীভাবে নিভাবো বুঝলাম না । আগুন নিভানোর দুইটা উপায়-ই জানতাম কেবল তখন ; পানি ঢালা আর ফুঁ দিয়ে নিভানো । পানি সাথে ছিল না বলে দুই ভাই একসাথে হামাগুড়ি দিয়ে থাকা অবস্থাতেই ফুঁ দিয়ে কিছুক্ষণ আগুন নেভানোর চেষ্টা চালিয়ে গেলাম । বুকের ভেতরের ছোট্ট ফুসফুসটার সমস্ত শক্তি একসাথে করে ফুঁ দিতে দিতে বুক ব্যথা হয়ে গেলেও লাভ হলো না কোন । এতো আর এক পলকা মোমের আগুন না যে ফুঁ দিলেই নিভে যাবে । দেখতে দেখেতে খড়ের গাদার নিচে দিয়ে ভালো আগুন লেগে গেলো, ক্রমেই বেড়ে চলা ভেতরের উত্তাপে থাকতে না পেরে দুই জনকেই মাচার নিচ থেকে বের হয়ে আসতে হল । ওদিকে সময় যতো যাচ্ছে আগুন আরও বাড়ছেই । কি করি এখন ? এমন একটা অকাজ করার পর তা ডাক দিয়ে দেখাতে বাড়ির বড় কাউকে ডাকার চিন্তা ভুলেও ভাবতে পারলাম না । দুইজন দৌড় দিয়ে নিজেদের ঘরে গিয়ে তালপাতার হাত পাখা নিয়ে এসে জোরে জোরে বাতাস দিতে থাকলাম আগুন নেভানোর জন্য । মাথায় ছিল ফুঁ বেশী জোরে দেওয়া যায় না বলে আগুন নেভে নি , পাখার জোর বাতাসে নিশ্চয়ই নিভে যাবে ( কি পরিমাণ আহাম্মকই না ছিলাম! ). বাতাস দেওয়ার পর ফলটা যা হল তা এক কথায় ভয়াবহ । আগুন নেভার বদলে ছড়িয়ে গেলো আরও দ্রুত । ততোক্ষণে অবস্থা সব দিক দিয়েই পিচ্ছি আমাদের আয়ত্তের বাইরে । বাড়ির আর সবার কথা বাদ দিলাম, দাদা আগের দিন অতোগুলো টাকা ( আজ থেকে ১৭ – ১৮ বছর আগের দশ হাজার টাকার মূল্য এখনকার চেয়ে অনেক অনেক বেশী ছিলো । আর ধনী আমরা কখনোই ছিলাম না ।) দিয়ে কেনা খড়ের গাদায় বন-ফায়ার করেছি দেখেলে ধরে তো নিশ্চিত সোজা হাড্ডি-মাংস এক করে ফেলবেন । আমার অত্যন্ত ভালো মানুষ দাদা আবদুল আলী গাজী ছিলেন ভয়ঙ্কর রাগী । চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় । চার দাদার সবার পরিবারের মিলে মিশে থাকে গাজী বাড়ির সবাইতো বটেই, এলাকার মানুষও ওনাকে ভয় পেতো । নানা বাধা-বিঘ্ন সত্ত্বেও সারাটা জীবন তিনি আমাদের এলাকা আর জেলার মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন । সব সময় দেখেছি তার মাত্রাতিরিক্ত রাগের কারণে মানুষ তাকে শ্রদ্ধার পাশাপাশি সমীহও করে করে চলতো সব সময় । দাদা রেগে গেছেন এই খবরের অর্থ আমাদের সবার কাছে ছিল বাসায় রোজ কেয়ামত । কাজেই যখন দুইজনই বুঝলাম অবস্থা তো মোটেও সুবিধার না, তখন মাকসুদ দিলো বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে এক দৌড়ে বর্ডার ক্রস করে দেশান্তরী হয়ে যাওয়ার মতো ভোঁ-দৌড় আর আমি ভালমতো দরজা লাগিয়ে পজিশন নিলাম কেউ থাকে না এমন ছোট্ট একটা ঘরের চৌকির নিচে ।



চৌকির নিচে ঘাপটি মেরে মাটির উপর মেরে শুয়ে আছি আর বাইরে মানুষের চিৎকার , দৌড়াদৌড়ি আর বালতি বালতি পানি খড়ের গাদায় ছুড়ে মারার শব্দ কানে আসছে । ততোক্ষণে আগুন খড়ের গাদায় প্রায় পুরোপুরি ছড়িয়ে গেছে । পরে শুনেছিলাম, পাশের বাড়ির ফুপুর ছেলে খাইরুল ভাই সাহস করে মই দিয়ে আগুনের উপর দিয়েই গাদার একেবারে উঠে গিয়ে বড় একটা লেপ দিয়ে আগুন নিভিয়েছেন আর সবাই নিচ থেকে সমানে পানি দিয়ে গেছেন । তাও তেমন লাভ হয় নি, ছোটখাটো ঢিবির মতো উঁচু খড়ের গাদার অর্ধেকেরও বেশী খড় আমাদের “ প্রজেক্ট এঁটেল মাটি”-র কবলে পড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো ।



যাই হোক, ক্ষয়ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে অবশেষে আগুন থামলো । ইতোমধ্যেই সবাই বুঝে গেছে চমৎকার ঐ কাজের পেছনের খলনায়ক কারা কারা । যেই ছোট্ট ঘরটাতে দরজা লাগিয়ে বসে আছি সেটা ভুলে বাদ দিয়ে বাড়ির বাদবাকি নানা জায়গায় খোঁজা হলো আমাকে, পাওয়া গেলো না । আমি তখন ঘরের বাইরে থেকে ক্ষণেক্ষণে ভেশে একেক জনের হুঙ্কার শুনছি আমাকে পাওয়ার পর ধরে কি কি করা হবে তা নিয়ে আর অন্ধকারে একা কুলকুল করে ঘামছি । হঠাৎ খেয়াল করলাম বাইরের সবাই একেবারে চুপচাপ হয়ে গেলো । সুনসান নীরবতার কারণটা খুব সহজেই অনুমেয় । দাদা বাসায় এসেছেন ।



দাদা বাসায় এসে সব দেখলেন, কারা কারা ঐ মহৎ কর্ম করেছে বিশদভাবে জানলেন, তার বিদেশ প্রবাসী বড় ছেলের ঘরের একমাত্র আদরের নাতি খালিদ রহমান যে পলাতক অবস্থায় আছে এবং কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাও শুনলেন । আরও কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি চলার পর সবাই খেয়াল করলো একটা ঘরে খোঁজাই হয় নি, এবং সেটা ভেতর থেকে ছিটকানি লাগিয়ে আটকানো । দাদা এসে প্রথমে নাম ধরে ডেকে কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলতে বললেন । আমার তখন ভয়ে সারা শরীর কাঁপছে , দরজা খোলার সাহস হলো না । দরজা ভাঙ্গা হল । দাদা চৌকির নিচে উঁকি দিয়ে দেখলেন তার নাতীর চেহারা ভয়ে, আতঙ্কে নীল হয়ে আছে । আমাকে খাটের নিচ থেকে বের করে বাইরে নিয়ে গেলেন । তখন মনে হচ্ছিলো যেকোনো সময় মাথা ঘুরিয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যাবো । আশপাশ থেকে সবাইকে বিদায় করে দিয়ে তিনি একা আমাকে নিয়ে বাড়ির উঠানে বসলেন । আমি দাড়িয়ে আর তিনি লোহার একটা চেয়ারে । আড়চোখে তাকিয়ে দেখি খড়ের গাদার আগুন নিভে গেলেও তখনও সাদা ধোঁয়া বেরোচ্ছে ।



- “ দাদা, এই কাজটা তুমি কেন করলা ? আগুন লাইগা তো বাড়ির মানুষও মারা যাইতে পারতো । “



আমি কাঁপতে কাঁপতে জবাব দিলাম, - “ ইচ্ছা করে করি নাই দাদা । ভুলে হয়ে গেছে । “



- “ কি করতে চাইছিলা আসলে বলো তো আমারে । “



আতঙ্কে অস্থির অবস্থায় থেকে যতোটুকু খুলে বলা সম্ভব বললাম । বলার পর তাকিয়ে দেখি দাদা চশমার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন । প্রথমে মনে হল চোখে ভুল দেখছি, নিশ্চয়ই মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে । কিন্তু না, আবারও তাকিয়ে দেখি দাদা আসলেই হাসছেন আমার কথা শুনে! দাদাকে হাসতে দেখেছি খুব কম । তারউপর অমন বিরাট বিপদজনক একটা অপরাধ করার পর তাকে হাসতে দেখে আমার মাথা এবার আসলেই এলোমেলো হয়ে গেলো । দাদা হাসতে হাসতেই বললেন ,



- “ তোমার কিছু দরকার হলে সেটা যদি অন্যরা না দেয় তুমি আমারে এসে বলবা । ভবিষ্যতে বাড়িঘর পুরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করে ফেলার দরকার নাই । “



যা যা শুনলাম তাতে নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিলো না । এরপর যা ঘটলো তা দেখে নিজের চোখকেও অবিশ্বাস করতে ইচ্ছা হল । আমি ছোট বেলা থেকেই গুঁড়ের জিলাপি খুব বেশী পছন্দ করি । দাদা থেকে আমার জন্য বাজার থেকে ঐ জিলাপি কিনে নিয়ে এসেছিলেন সেদিন । কিন্তু বাসায় এসে দেখেন তারই গুণধর নাতির কারণে সারা বাড়ি লণ্ডভণ্ড, তাকে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না ।খুঁজে পাওয়ার পর এবার সেই গরম জিলাপির ঠোঙ্গা বের হল ।



.......... ভেবেছিলাম লিখাটাতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুব হাসি খুশি একটা ভাব ধরে রাখবো । অন্যদের কাছে থাকলো কিনা জানি না, কিন্তু আমার নিজের কাছে আমি হাসি খুশি ভাবটা ধরে রাখতে পারলাম না । চোখ দুইটা পানিতে ভিজে গেছে ।



দাদা মারা গেছেন আজ প্রায় চার বছর হতে চললো । যখন ছিলেন তার থেকে দূরে দূরে থেকেছি যতটা পারি । আজ তিনি নেই । অথচ না থেকেও কত তীব্রভাবেই না তিনি রয়ে গেছেন আমাদের সাথে, আমার সাথে । আজও সুযোগ পেলেই মিষ্টির দোকান থেকে জিলাপি কিনে বাসায় নিয়ে আসি, কিন্তু সেই দিনের মতো স্বাদ তো আর কোন দিন পেলাম না । এখনও মনে হয় একটু দেরী করে ঘুম ভাঙ্গতে একটু দেরী হয়ে গেলেই কেউ জানলার সামনে এসে জোরে ডাক দেবে, “ বাবাজী খালিদ রহমান, উঠবা না ঘুম থেইকা ? “



মানুষ আসলে কাছের কাউকে হারিয়ে ফেলার পরেই সেই মানুষটার মূল্য পুরোপুরি বুঝতে পারে , হারানোর আগে না ।



..... আশপাশের জানলা, দরজার ফাঁক দিয়ে সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল দাদা আমাকে কি করেন তা দেখার জন্য । সবাই অবাক হয়ে দেখল কোন শাস্তির দাদা আমার হাতে একটা বড় জিলাপির ঠোঙ্গা ধরিয়ে দিয়েছেন । ধুলো, মাটিতে সারা শরীর মাখামাখি অবস্থায় আমি ঠোঙ্গা থেকে কাঁপাকাঁপা হাতে একটু একটু করে জিলাপি নিয়ে কুটকুট করে খাচ্ছি আর দাদা আমার দিকে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে আছেন । .............. দুই প্রজন্মের দুইজন প্রতিনিধি , যাদের শরীরে একই রক্ত বহমান । একজন ধীর, স্থির মহীরুহর মতো ছায়া দিয়ে রেখেছেন তার চারপাশের সবাইকে , পৌরুষত্বের রুক্ষতার আবরণে সবাইকে বুকে ধরে আগলে রেখেছেন অপ্রকাশিত এক পরম মমতায়; আর আরেকজন নিতান্তই ছোট বাড়ন্ত লকলকে একটা গাছ, যে ঐ মহীরুহর ছায়ায় থেকে তার বিশালত্বে মুগ্ধ হয়ে নিজেও আস্তে আস্তে মাথা তুলে উঠে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে নিরন্তর । আমাকে সেদিন কেউ মুখে বলে কিছুই শেখায় নি , কিন্তু নিজের অজান্তেই আমি যেন অনেক কিছু শিখে ফেললাম । আমাকে যেন দাদা খুব সহজেই শিখিয়ে দিলেন জীবনে ভুল, অন্যায় হবেই; কিন্তু সেসব যত বড়ই হোক না কেন তা স্বীকার করার সৎ সাহস সব সময় মনে রাখতে হবে; আমাকে জানানো হলো কেবল মানুষের বাহ্যিক আচরণ দেখেই সবার ব্যাপারে সিদ্ধান্তের সীমা রেখা টেনে ফেলা ভুল; মানুষের ভেতরের মনটা কেমন সেটাই আগে বোঝার চেষ্টা করতে হবে কাউকে জানতে চাইলে । ...... সেদিন যেন কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে মনের বয়স বেড়ে গেলো অনেকখানি ।



হারিয়ে যাওয়ার পরও এভাবেই বুঝি মহীরুহর মতো কিছু মানুষ নিজের অস্তিত্ব রেখে যায় সবার মাঝে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ।

মন্তব্য ১৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:০৪

মামুন রশিদ বলেছেন: রীতিমত ভয়ন্কর ব্যাপার ঘটিয়েছিলেন! যাই হোক আপনাদের দুজনেরও ক্ষতি হতে পারতো ।

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:০৯

শহুরে আগন্তুক বলেছেন: বাচ্চা মানুষ ছিলাম .. বিপদ বুঝিই নি আসলে ।

২| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:৩৯

মোঃ আনারুল ইসলাম বলেছেন: আপনার লিখুনী পড়ে আমার শৈশবে ফিরে গেলাম । পড়ে মজা পেলাম ।

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:৪১

শহুরে আগন্তুক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই । ভালো থাকবেন ।

৩| ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:১৬

ঢাকাবাসী বলেছেন: মনে পড়ে অনেক কিছু। ভাল লেগেছে।

২৭ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ২:৩৫

শহুরে আগন্তুক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই ।

৪| ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:১৭

হাসান মাহবুব বলেছেন: চমৎকার লাগলো লেখাটা।

২৯ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১:০৯

শহুরে আগন্তুক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই ।

৫| ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:৪২

প‌্যাপিলন বলেছেন: আহা নস্টালজিয়া। খুব বেশি বিষন্ন হয়ে গেলে ফেলে আসা শৈশবের স্মৃতিময় স্থানগুলো গুগল আর্থে গিয়ে চষে বেড়াই

২৯ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১:১৪

শহুরে আগন্তুক বলেছেন: প্রবাসে আছেন নাকি ভাই ?

৬| ০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:২০

শীলা শিপা বলেছেন: নিজের করা দুষ্টুমি গুলো মনে পরছে... আর খারাপ লাগছে দাদার কথা ভেবে... তাকে আমি দেখিনি কক্ষনো... :(

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:২৩

শহুরে আগন্তুক বলেছেন: :(

৭| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:৩২

আশরাফুল ইসলাম দূর্জয় বলেছেন:
স্মৃতিকাতরকায় ডুব দিয়ে আনলেন।

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:১৪

শহুরে আগন্তুক বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই পড়ার জন্য !

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.