নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

তবু আজও স্বপ্ন দেখার নেই মানা ........

শহুরে আগন্তুক

নিজের কাছে নিজেই অচেনা রয়ে গেছি আজো । চেনার চেষ্টা করছি । মানুষ হিসেবে কেমন তা অন্যরাই ভাল বলতে পারবে । আমার কাছে আমি আমার মতোই । আশাবাদী , স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি । সুন্দর এবং শুদ্ধ অনুভূতিময় স্বপ্ন ।

শহুরে আগন্তুক › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডাক পাঠানোর ঠিকানা

০২ রা জুন, ২০১৫ বিকাল ৫:৪৩



জানলার কাঁচ আর গ্রিলে ফোঁটায় ফোঁটায় জমা বৃষ্টির পানির অবস্থান বিন্যাস আমার কাছে বেশ অর্থবহ লাগে । এরা একজন আরেকজনের গা ঘেষে বসেছে ;খুব বেশী দূরেও না, আবার খুব বেশী কাছেও না । নাগরিক ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ । মাঝেমাঝেই আবার দেখাচ্ছে একজন আরেকজনের সাথে মিলে যাচ্ছে, দুইয়ে মিলে তৈরি করছে বৃহৎত্তর, উজ্জ্বল কোন অবস্থান । ভালোবাসা... একটু পরই আবার আশেপাশের কিছু বৃষ্টির ফোঁটা এসে জড়িয়ে যাচ্ছে ওই দুজনের মাঝে, বাড়ছে বোঝা । আগের ফোঁটাদুটো আর এক থাকতে পারছে না, অনাহুত কিছু আগন্তুককে ধরে রাখতে গিয়ে এরা একজন আরেকজনের প্রতি নিজস্বতা হারাচ্ছে, নিজেদের পরম আবেগের অবস্থানে হয়ে যাচ্ছে টলমলে । তারপর একসময় অবধারিতভাবে টুপ করে ঝরে পড়ে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া .... বিচ্ছেদ ।

ঝুম বৃষ্টি বাইরে । এমন সময়ে মুঠোফোনে ডাক পাঠানোর ঠিকানার খাতা খুলে বসে অতীত হাতড়ানো যেতেই পারে । ৪৬২ জন মানুষ... মোবাইলের কন্টাক্ট লিস্টটা অদ্ভুত এক স্মৃতিময় জায়গা লাগে আমার কাছে । অবসরে এ স্মৃতির খাতা খুলে বসা যায়, সময়টা একই সাথে হয়ে যায় আনন্দের এবং বিষাদের । একেক জন মানুষের সাথে একেক রকম স্মৃতি , ঘটনা পরম্পরা ।

কিন্তু কার কথা বলি প্রথমে?

সেই আংকেলটার কথা বলি, যিনি এমনই এক ঝুম বৃষ্টির বিকেলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন?

কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ি তখন। দুপুর থেকে হওয়া বৃষ্টিতে আমার কলেজের সামনের রাস্তা সহ পুরো মতিঝিল সমুদ্দুর । আমি প্যান্ট গুটিয়ে পা টিপে টিপে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগোচ্ছি, সমুদ্দুরের বুকে ইতস্তত জেগে থাকা ছোট ছোট দ্বীপে পা রেখে । কিন্তু এতো সতর্কতায়ও কাজ হলো না। পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে থাকা বেশ বড়সড় এক গর্তে পা হড়কে পড়ে গিয়ে পুরোপুরি ভিজে গেলাম। দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দেখি দাঁড়ানো যাচ্ছে না, পা মচকে গেছে । আমি অসহায়ের মতো রাস্তার পানিতে বসে আছি, হাত কনুই পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে ভর দিয়ে উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করছি - এমন সময় অপরিচিত মাঝবয়সী এক লোক পানি ভেঙ্গে এগিয়ে এলেন। আমাকে টেনে তুলে নিজের পায়ে দাড় করিয়ে পকেট থেকে সাদা রঙ্গের একটা রুমাল বের করে মাথা মুছিয়ে দিলেন, মোবাইলের ব্যাটারি খুলে রাখার জন্যে একটা পলিথিন বের করে হাতে ধরিয়ে দিলেন। অপরিচিত একজন মানুষের কাছ থেকে এতো আন্তরিকতা পেয়ে আমি হতভম্ব। কি বলবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না.... রাস্তার একপাশে নিয়ে জিজ্ঞাস করলেন কোথায় থাকি, কিসে পড়ি, বাসায় কে কে থাকেন ইত্যাদি ইত্যাদি । স্বেচ্ছায় নিজেকে নিয়ে একা থাকি বলে আমি মানুষের ভালোবাসা পেয়ে অভ্যস্ত নই । জবাব দিতে গিয়ে কথা জড়িয়ে যাচ্ছিলো বারবার । তিনি সেটা টের পেয়েই বোধহয় দ্রুত বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগে আমার মাথায় হাত রেখে একটু হেসে বললেন, " রাস্তা - ঘাটে আরেকটু সাবধানে চলতে হবে বাবা । এই কার্ডটা রাখো । সময় করে একদিন আমার অফিসে এসে চা খেয়ো যেয়ো একদিন । " আমি পেছনে দাড়িয়ে অনেকক্ষন দেখলাম তার চলে যাওয়া। আমার চোখ ভিজে গিয়েছিলো ।

তার ভিজিটিং কার্ডটা এখনো আমার কাছে আছে, তবে চা খেতে কখনো যাওয়া হয় নি । অথচ বহুদিন তার অফিসের নিচ দিয়ে আমি হেঁটে চলে গেছি । ভালোবাসার মানুষদের খুব কাছে কখনো যেতে হয় না। আমার মনে হতো গেলে হয় দেখবো তিনি অফিসে নেই, প্রচন্ড ব্যস্ত বা আমাকে চিনতেই পারছেন না ।

ইউনিভার্সিটির সেই মেয়েটার কথা বলি যে খুব মমতায় এক সকালে আমাকে খাইয়েছিলো?

আমি আজন্ম বখাটে মানুষ। রাতে প্রায়ই ঘুমাই দেরি করে, সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর ক্লাস ধরার জন্যে করতে হয় তাড়হুড়া। প্রায় কোনদিনই নাস্তা করতে পারি না। সেদিনও করিনি। বাসের সিটে বসে মনে হচ্ছিলো না খেয়ে বের হওয়াটা বোকামি হয়ে গেছে ভীষন । ক্ষুধায় পেট ব্যথা করছে । পাশে দাড়ানো বন্ধুর কাছে কোন খাবার আছে কিনা জিজ্ঞাস করলাম । নেই । আমি আগের রাতেও কিছু খাই নি। মাথা ঘোরাতে থাকলো.... বাস যখন কার্জন হলে এসে থামার পর বেশ কিছু যাত্রীর সাথে অন্য ডিপার্টমেন্টে পড়া আমার স্বল্প পরিচিতা এক বান্ধবীও নামলো। সে নেমে ক্লাসের দিকে না গিয়ে ঘুরে আমি যে সিটে বসেছি তার জানলার পাশে এসে দাড়িয়ে ব্যাগ খুলে তার টিফিন বক্সটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। আমি অবাক, না করারও সময় পেলাম না। সে পূর্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে চলে গেলো নিজের গন্তব্যে ..... এ ঘটনার মাসখানেক আগে মানুষটা অনেক কষ্টে নিজের সংকোচ কাটিয়ে তার মনের কিছু কথা আমাকে বলেছিলো । না বললেই ভালো করতো, অহেতুক নিজের কষ্টই বাড়িয়েছিলো কেবল বেচারি... টিফিন বক্সটা খুলে একটা স্যান্ডউইচ, চিকেন রোল আর সেদ্ধ ডিম পাওয়া গেলো । খেয়ে ফেললাম। ভালোবাসা কাউকে নি দিলেও স্বার্থপরের মতো ভালোবাসার দান গ্রহনে আমার আপত্তি কোন কালেই ছিলো না।

বাংলাদেশ রেলওয়ের জামান আঙ্কেলের কথা বলি?

তারসাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো উত্তরা রেলস্টেশনে। ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষে পড়ি তখন। ট্রেনের টিকিট কাঁটতে গিয়ে দেখি টিকেট কাউন্টার বন্ধ। দেড় ঘন্টা দাড়িয়ে থাকলাম প্ল্যাটফর্মে, কাউন্টার আর খোলে না। শেষে ত্যক্ত - বিরক্ত হয়ে অফিসে গেলাম। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সের কাঁচাপাকা চুলের এক লোক বসা। তিনি বললেন কি সমস্যা। জানালাম ... মধ্যদুপুর তখন। তিনি অবসর ছিলেন আমিও। এক কথা, দুই কথা... সময় কেটে গেলো অনেকক্ষন। এরই মধ্যে এক ফাঁকে উঠে গিয়ে তিনি আমার জন্যে টিকিট করিয়ে এনেছেন । বসার জন্যে খুব আরামদায়ক সিট - ইঞ্জিনের দিকে মুখ করানো, জানালার পাশে। আংকেল মজার মানুষ। দুষ্টুমির হাসি হাসতে হাসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানান প্রশ্ন করলেন। বেশীরভাগই প্রেম ভালোবাসা সংক্রান্ত। সবার শেষে পরামর্শ দিলেন যে বিয়ে করলে অবশ্যই লম্বা মেয়ে বিয়ে করতে হবে। নাহলে ছেলে - মেয়ে সব হবে বাটকু সাইজের। বউ একটু রাগী আর সংসারী হলে ভালো হয়। রাগী মেয়েরা নাকি মায়াবতী ধরনের হয়। সেদিন স্টেশনের ক্যান্টিন বন্ধ বলে তেমন আপ্যায়ন করতে পারলেন না। আফসোস করলেন খুব সেজন্যে। উত্তরা স্টেশনে আবার গেলে যেন তারসাথে অবশ্যই দেখা করি এই বলে তার মোবাইল নম্বারটা একটা কাগজে লিখে হাতে ধরিয়ে দিলেন। তারসাথে আবার গল্প করার জন্যেই সারপ্রাইজ হিসেবে ফোন না দিয়ে উত্তরা স্টেশনে মাস ছয়েক আগে গিয়েছিলাম একবার। তিনি আর নেই ওখানে । ফোন দিয়ে শুনলাম দেড় বছর আগে হার্ট এটাকে মারা গেছেন ।

.... আর লিখতে ইচ্ছা করছে না । অথচ আরেকজন মানুষের কথা অবশ্যই লেখা উচিত, পিঙ্গল চুলের অদ্ভুত সুন্দর চোখের যে মানুষটা কোন একদিন ইথারে শব্দ ভাসিয়ে গভীর আবেগে বলেছিলো- তোমাকে ছাড়া কি বেঁচে থাকা যায়? .... বহুদিন দেখা হয় না। কেমন আছে, কোথায় আছে, কিভাবে আছে বা কারও সাথে আছে কিনা কিছুই আমি জানি না । ভালোই আছে নিশ্চয়ই । চারপাশটা একটু নীরব হয়ে এলেই আমি ফিসফিসিয়ে বলে সেই মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বাক্যটা শুনতে পাই । আমার অসহ্য লাগে । কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে ডুব দিয়ে হারিয়ে যাই জনারণ্যে.... মানুষটার সাথে যতদিন দেখা হয়েছে, সবসময়ই ছিলো প্রখর রোদ । আমাদের কখনো একসাথে এক ছাতার নিচে বৃষ্টিতে ভেজা হয় নি । সে কাঁচের চুঁড়ি খুব পছন্দ করে। আমার এমন বৃষ্টির বিকেলগুলোতে পাশে বসে রিকশার হুড থেকে তার হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানির স্পর্শ নিতে গিয়ে বেজে ওঠা চুঁড়ির জলতরঙ্গের শব্দ শুনতে ইচ্ছা হয় প্রায়ই .... তার ডাক পাঠানোর ঠিকানাটা বন্ধ হয়ে গেছে । নিষ্প্রাণ এক কন্ঠ তার হারিয়ে যাওয়ার খবরই প্রতিধ্বনিত করে চলে কেবল । এখন আর খোজও নেই না । আমি খুব বেশী অভিমান নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি ।বুকের ভেতর অভিমান জমতে জমতে পাহাড় হয়ে গেছে । পাহাড় কি আর চাইলেই ডিঙ্গানো যায়?

..... নাহ, আর লিখবো না । কি হয় স্মৃতি লিখে? কি লাভ কবে কোথায় ঘটে যাওয়া এসব হাতড়ে নিজের বিষাদ বাড়িয়ে? তারচেয়ে বরং কিছু বিষাদ আজ হোক পাখি, তাদের আগল খুলে উড়িয়ে দেই মেঘলা আকাশে... বহুদূর ভেসে গিয়ে দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়ে ঝড়ুক ।

“ হিজলের বন ফুলের আখরে লিখিয়া রঙিন চিঠি,
নিরালা বাদলে ভাসায়ে দিয়েছে না জানি সে কোন দিঠি!
চিঠির উপরে চিঠি ভেসে যায় জনহীন বন বাটে,
না জানি তাহারা ভিড়িবে যাইয়া কার কেয়া-বন ঘাটে!
কোন্ সে বিরল বুনো ঝাউ শাখে বুনিয়া গোলাপী শাড়ী, -
হয়ত আজিও চেয়ে আছে পথে কানন-কুমার তারি!
এ দিকে দিগন্তে যতদূর চাহি, পাংশু মেঘের জাল
পায়ে জড়াইয়া পথে দাঁড়ায়েছে আজিকার মহাকাল । “

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা জুন, ২০১৫ রাত ১০:৫০

মোঃ ইমরান কবির রুপম বলেছেন: খুব ই ভালো লাগলা , আসলে জানেন কি আমাদের সাথে সব সময় এরকমেই হয় । দেখেন উত্তরার আংকেলের কথা আমায় খুব ভাবিয়েছে । দেখেন এরকম একটা লেখা কত জন দেখেছে , খুব ই সামান্য । ধন্যবাদ ভালো লেখার জন্য

০৩ রা জুন, ২০১৫ রাত ১২:৪৭

শহুরে আগন্তুক বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ পড়ার জন্য :)

২| ১০ ই জুন, ২০১৫ বিকাল ৪:২০

হাসান মাহবুব বলেছেন: চমৎকার লেখা।

১২ ই জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:০৩

শহুরে আগন্তুক বলেছেন: ধন্যবাদ হাসান ভাই ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.