নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

তবু আজও স্বপ্ন দেখার নেই মানা ........

শহুরে আগন্তুক

নিজের কাছে নিজেই অচেনা রয়ে গেছি আজো । চেনার চেষ্টা করছি । মানুষ হিসেবে কেমন তা অন্যরাই ভাল বলতে পারবে । আমার কাছে আমি আমার মতোই । আশাবাদী , স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি । সুন্দর এবং শুদ্ধ অনুভূতিময় স্বপ্ন ।

শহুরে আগন্তুক › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাবা: একজন নিঃসঙ্গ শেরপা

২১ শে জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫৬



খুব ছোট বেলার একটা স্মৃতি আমার বেশ মনে আছে । স্মৃতিটা আমার সুদূরতম
শৈশবের প্রথম স্মৃতিগুলোর একটি ।

বাবা বিদেশ থেকে ছুটিতে বাড়ি ফিরেছেন মাসখানেক হলো । পাঁচ বা সাড়ে পাঁচ বছর বয়সের আমি জন্মের পর সেবারই তাকে প্রথম দেখছি । শান্ত স্বভাবের সুদর্শন, লম্বা - চওড়া স্বাস্থ্যের একজন মানুষ । ছোট বেলায় জ্বরে ভুগতাম । দুই - একদিন হলো তীব্র জ্বর থেকে সুস্থ হয়েছি এমন সময় লক্ষ্য করলাম একরাতে বাড়ির সবার ব্যস্ততা হঠাৎ করে অনেক বেড়ে গেছে । কেন তার কারণটা ছোট্ট আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না । কেউ আমার দিকে মনোযোগই দিচ্ছে না, অথচ আমার ভয়ংকর রকম " পাইপ আইসক্রিম " খাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছে । এমনই ভয়ংকর ইচ্ছা যে আমার মনে হচ্ছিলো পলিথিনের টিউবের ভেতর চিনি আর নীল- সবুজ- লাল এর কোন একটা রঙ মেশানো বরফ এক্ষনই হাতে না পেলে জীবন পুরোপুরি ব্যর্থ । এক্ষনই খেতে হবে আমার.... এক্ষনই! কিছুক্ষন মা আর বড় বোনের পেছনে ঘুরঘুর শুরু করলাম ।
লাভ হলো না, তারা আমাকে পাত্তাই দিলেন না। শেষ চেষ্টা হিসেবে গেলাম বাবার কাছে । তিনি একটু হেসে বললেন কি চাই? আবদার পেশ করা হলো । আইসক্রিমের কথা শুনে তার মুখের হাসি মুছে যায় । একটু গম্ভীর গলায় বললেন, ঐ আইসক্রিম ভালো না । খেলে দাঁতে পোঁকা হয় । আর আইসক্রিম খেলে আবার জ্বর আসবে । কাজেই আইসক্রিম খাওয়া যাবে না ।
আবদার পূরণ হবে না শুনে আমার কি যে কষ্ট লাগলো! রাগে, দুঃখে বলেই বসলাম - " তোমার মতো বাবা আমার লাগবে না । " কথাটা শুনে চুপ হয়ে গিয়ে বাবা কিছুক্ষন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে । আর আমি রাতে ঘুমুতে গেলাম না খেয়ে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে । পৃথিবীতে আমি খুব বেশী অভিমান নিয়ে জন্মেছি ।
পরদিন সকালে একটু বেলা করে ঘুম ভাঙ্গলো এবং আবিষ্কার করলাম বাবা নেই । তিনি আবার মাথার উপর বোঁ বোঁ শব্দে যে " পেলেন " উড়ে যায়, তাতে চড়ে বসে আবার পাড়ি জমিয়েছেন মালয়শিয়া নামের বহুদূরের কোন দেশে । এবার আমি মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে চিৎকার করে আবার কাঁদলাম বহুক্ষণ ।
...... বাবাকে নিয়ে শৈশবে আমার তেমন আর কোন স্মৃতি নেই । আমি কেবল জানতাম " বাবা " নামের একজন মানুষ বিদেশ থাকেন, যার হাস্যোজ্বল ছবি আমি অ্যালবামে দেখি, যিনি মাঝেমাঝে আমার জন্যে খেলনা পাঠান – গাড়ি, হেলিকপ্টার, রোবোকপ । বাবা আমাদের জন্যে কেবল কষ্টই করেন । তিনি আমাদের ভালো রাখার জন্যেই বছরের পর বছর দেশে ফিরতে পারেন না । ধীরে ধীরে তিনি আমার কাছে অপরিচিত একজন মানুষই হয়ে গেলেন যেন ।
স্কুলে ভর্তি হয়ে লিখতে শেখার পর বাবা আমাকে চিঠি লেখা শুরু করলেন। তখনও মোবাইলের যুগ শুরু হয় নি । সুদূরের প্রিয়জনদের সাথে চিঠিই ছিল যোগাযোগের মাধ্যম । প্রতি মাসেই আমি একটা করে চিঠি পাই - নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে অক্ষরের চিঠি । বাবা আমাকে বহুকিছু লেখেন । ভালো মতো খেতে বলেন, ঘুমুতে বলেন, মন দিয়ে পড়াশোনা করতে বলেন, মা'কে বাড়ির কাজে সাহায্য করতে বলেন..... জবাবে আমি লেখার কিছু খুঁজে পাই না । আমার চিঠিগুলো হয়ে " সালাম নেবেন । ভালো আছি, ভালো থাকবেন । নিজের যত্ন নিবেন " – ধরনের বাঁধাধরা গতানুগতিক কিছু লাইনের। স্কুলের বাংলা লেখার রুল টানা কাগজের খাতা থেকে পাতা ছিঁড়ে তাকে আমি লিখি, কিন্তু তবুও লাইন হয়ে যায় আঁকাবাঁকা । একাধিক বানান ভুল হয় । কাঁটাকুঁটি করে আবার শুদ্ধ করার চেষ্টা করি । সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত চিঠি যা দাড়ায় তা বাবার অসম্ভব সুন্দর গোঁছানো চিঠির জবাবে পাঠাতে আমার লজ্জাই লাগে । বাবার আমাকে লেখা কিছু চিঠি এখনও আমার কাছে আছে, পনের - ষোল বছর আগেকার । আমি অবসর পেলে এখনও একা একা পড়ি । গলায় আবেগ দলা পাঁকায় ।

একসময় বাসায় টিএন্ডটি ফোন এলো । তখন থেকে চিঠি লেখা বন্ধ হয়ে গেলো, আমি একটু হাফই ছাড়লাম । কিইবা দরকার আর? লাল টুকটুকে রিসিভারটা কানে চেপে হাজার হাজার মাইল দূরের মানুষটার সাথে তো সরাসরিই কথা বলা যায় । কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায় । লাল রিসিভারটা কানে ঠেকানোর পর আমি কি বলবো কথা খুঁজে পাই না । বাবার সাথে ততদিনে আমার মানসিক দুরুত্ব হয়ে গেছে বিশাল । পাহাড়ের মতো । পাহাড় কি আর চাইলেই ডিঙ্গানো যায়? ....... আর তখন আমি ইতোমধ্যেই জানি, তার বিদেশে পড়ে থাকতে হওয়ার অন্যতম কারণ আমি-ই । জন্মের দুই মাসের মাথায় আমার প্রচন্ড নিওমোনিয়া হয়। ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দিয়ে জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন এই ছেলে আর বাঁচবে না, চিকিৎসা করানোর মানে নেই আর । আমার পরিবার, আমার বাবা হাল ছাড়েন নি । চিকিৎসা করাতে নিয়ে গেছেন আরও ভালো জায়গায়, শিশু ওয়ার্ডে আমাকে কোলে করে জেগে থেকেছেন মা আর বাবা নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন হাসপাতালের বারান্দায়, সিঁড়িতে । একমাত্র যুবরাজের জন্যে টাকা খরচ হয়েছে পানির মতো, সবই ঋণের টাকা । ওই ঋণের দায় মেটাতেই মূলত বাবার বিদেশ যেতে হওয়া । পুরো ব্যাপারটা জানার পর থেকেই আমি সুক্ষ্ণ একটা অপরাধবোধে ভুগতাম, এখনও ভুগি ।

বাবা ষোল বছর বিদেশে কাটিয়ে যখন দেশে ফিরলেন তখন আমার বয়স প্রায় সতের । বাবা ততদিনে আমার কাছে হয়ে দাড়িয়েছেন নিতান্তই অপরিচিত একজন মানুষ, যাকে জন্মের পর আমি বলতে গেলে দেখিই নি কখনো । এখন আমার বয়স চব্বিশ, সে মানসিক দুরুত্ব আর ঘুঁচে নি । বাবা আমার সাথে সহজ হতে পারেন নি, আমিও না । তার থেকে আর কিছু পাই বা না পাই, নীরবতাটা আমি পেয়েছি । আমার বন্ধু - বান্ধবরা যখন বাবা বিষয়ক নানা গল্প করে ; বাবার সাথে হাসার গল্প, ঝগড়ার গল্প, কান্নার গল্প, বাবার তাদের পিঠে হাত রাখার গল্প - আমার কাছে সেসব নিতান্তই রুপকথার মতো লাগে ....... অথচ এমনটা নয় যে আমি তাকে ভালোবাসি না । আমি তাকে তীব্রভাবেই ভালোবাসি । আমার রক্তেই তো তার উপস্থিতি । আমাকেও যে তিনি কতোটা ভালোবাসেন তা তিনি আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ে আমার গায়ে এসে লাগা বাতাসেই আমি টের পাই । অথচ দুজনের কেউই কখনো নিজেদের আবেগ প্রকাশ করি না, করতে পারি না । ওটা বিহ্বলতার সূর্যের আলোর তীব্রতায় ঢাকা পড়ে যাওয়া রাতের তারার উপস্থিতির মতোই সত্য; উপস্থিতি ধ্রুব হয়েই আছে চিরকাল, কিন্তু খালি চোখে দেখা যায় না । উপলব্ধির গভীরতা আমাদের অন্তরে চিরদিন,যদিও শব্দের প্রবাহ চির নিশ্চুপ ।

আজ তবে এখানেই ইতি টানি ..... সময় পেড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত । আমি বড় হয়ে যাচ্ছি আর আমার সাদা মনের বাবা বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন । দুজনেই ব্যক্তিগত জীবনে প্রিয়জন বেষ্টিত নিঃসঙ্গ মানুষ .. নিঃসঙ্গ শেরপা । একদিন নিশ্চয়ই আমাদের মাঝের জমাট বাঁধা নৈঃশব্দের নিরবতা ভাঙ্গবে ।
আমিই ভাঙ্গবো ।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে জুন, ২০১৫ রাত ৮:১৩

দৃষ্টিসীমানা বলেছেন: অনুভূতির প্রকাশটি খুব ভাল লাগল । ভাল থাকুন ।

২১ শে জুন, ২০১৫ রাত ৮:১৮

শহুরে আগন্তুক বলেছেন: আপনিও .....

২| ২১ শে জুন, ২০১৫ রাত ৮:১৯

মিতক্ষরা বলেছেন: "একদিন নিশ্চয়ই আমাদের মাঝের জমাট বাঁধা নৈঃশব্দের নিরবতা ভাঙ্গবে । "


হ্যা, হঠাৎ কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে...............।

২১ শে জুন, ২০১৫ রাত ৮:২২

শহুরে আগন্তুক বলেছেন: তাই যেন হয় ...

( আচ্ছা , পোস্ট এডিট করার অপশন কোথায় ?? স্পেসিং ঠিক করতাম একটু ...... নতুন ভার্শনে কিভাবে করবো বুঝতে পারছি না :( )

৩| ২৩ শে জুন, ২০১৫ বিকাল ৪:০৯

ঢাকাবাসী বলেছেন: লেখাটি ভাল লাগল্ । এডিট করতে বাঁদিকে 'নতুন ব্লগ লিখুন' এ ক্লিক করুন, আপনার ড্রাফট বা অটোড্রাফট লেখা জায়গাতে আপনার লেখাটি পাবেন, সেখানে এডিট অপশন আছে, আরামসে করুন না। ধন্যবাদ।

৩০ শে জুন, ২০১৫ দুপুর ১:০২

শহুরে আগন্তুক বলেছেন: Thank you !!!!!! :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.