নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দীপকের খোলা খাতা Dipak Ray

Dipak Ray, Kalirhat, Krishnagar, Nadia, WB, India

দীপক ৭৪ রায়

Dipak Ray, Kalirhat, Krishnagar, Nadia, WB, India, Ph. 9775179985 Mail. [email protected]আমি লিখি, লেখার চেষ্টা করি। যা বিশ্বাস করি না, তা লিখি না। শিক্ষকতা আমার পেশা, লেখালেখি-সাংবাদিকতা নেশা। আমার লেখার সমালোচনা হলে, আমি সমৃদ্ধ হই।

দীপক ৭৪ রায় › বিস্তারিত পোস্টঃ

সিরাজ-উদ-দৌলাঃ ইতিহাসের পাতায় সসম্মানেই আছেন বাংলার এক ট্র্যাজিক চরিত্র ।। দীপক রায়

০৯ ই মে, ২০১২ বিকাল ৫:০৫



সিরাজ-উদ-দৌলা, যার অর্থ ‘রাষ্ট্রের প্রদীপ‘। এটি সিরাজের আসল নাম নয়, এটি ছিল প্রিয় দাদু আলিবর্দি খাঁর থেকে পাওয়া উপাধি। তাঁর মূল নাম ছিল মির্জা মহম্মদ। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ মুখোপাধ্যায়ের তথ্য অনুযায়ী সিরাজের জন্ম সম্ভবতঃ ১৭৩৩ সালের মার্চ মাসের প্রথমে বা মাঝামাঝি । বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দি খাঁ প্রথমে ছিলেন বিহারের সহকারী শাসক বা নায়েব নাজিম। আলিবর্দির নিজের তিন ছেলের সাথে নিজেরই তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছিল। ছোট ছেলে জইনুদ্দিন ও ছোট মেয়ে আমিনার গর্ভজাত মির্জা মহম্মদের জন্মের পরপরই আলিবর্দি খাঁ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব হয়েছিলেন। সেই কারনে খুশি হয়ে মির্জা মহম্মদের নাম পাল্টে রাখলেন সিরাজ-উদ-দৌলা।

১৭৫৬ সালের ১৫ ই এপ্রিল সিরাজ-উদ-দৌলা সিংহাসনে বসেছিলেন। যদিও তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩ বছর। তবে সিরাজ-উদ-দৌলা অনেক আগে থেকেই দাদুর কাছে নানা দায়িত্ব পেয়ে নিজের উৎকর্ষতা প্রমান করেছিলেন। ১৭৪৬ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মির্জা ইরাজ খানের কন্যা লুৎফুন্নেসার সাথে বিবাহ করার পর ১৯৪৮ সালে সিরাজ-উদ-দৌলার পিতা জইনুদ্দিন আফগানদের হাতে নিহত হন। সেই প্রতিশোধ সিরাজ-উদ-দৌলা নিয়েছিলেন ১৯৪৮ সালে আফগান বিদ্রোহ দমন করে। ১৭৪৯ সালে উড়িষ্যায় করেছিলেন বর্গি দমন। এই সময় সিরাজ নবাব আলিবর্দির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, যা সিরাজের এক বিরাট ভুল। কিন্তু তবুও ১৯৫০ সালে পাটনায় বিপদে পড়লে সিরাজ-উদ-দৌলাকে প্রানে বাঁচিয়েছিলেন দাদু আলিবর্দি খাঁ। বৃদ্ধ আলিবর্দি খাঁ সিরাজকে আগলে রেখেছিলেন পরম স্নেহে। তাঁকে বানিয়ে দিয়েছিলেন হীরাঝিল আর মনসুরগঞ্জ প্রাসাদ। আর এখানেই ঘটেছিল সিরাজ-উদ-দৌলার অধঃপতন। দিবারাত্রি মদ্যপান আর হারেমে বুঁদ হয়ে গিয়েছিলেন। বিপদ বুঝে আলিবর্দি খাঁ সিরাজ-উদ-দৌলাকে মসনদে বসানোর কথা ভাবলেন। কিন্তু তাঁর আগেই মারা গেলেন তিনি। তবে মারা যাবার আগে ১০ লাইনের একটি চিঠি লিখে গিয়েছিলেন তিনি। যেই চিঠির প্রতিটি বাক্য সিরাজ-উদ-দৌলা মেনে চলেছিলেন আমৃত্যু। পবিত্র কোরান ছুঁয়ে শপথ নিয়ে আর কখনো মদ-হারেম মুখো হননি।

আলিবর্দি খাঁ ফরাসি ও ইংরেজদের কাছে যথেষ্ট সম্মান ও উপঢৌকন পেতেন। সিরাজও সেটা পেতে লাগলেন। শক্ত হাতে রাজ্যের হাল ধরেন। মিরজাফরকে সরিয়ে মিরমদনকে বকশি ও মদনলালকে পেশকার পদে বসান। মিরজাফরের সাথে দূরত্বের সুচনা হল। মতিঝিলে ভেঙ্গে দিলেন মাসি ঘসেটি বেগমের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের আখড়া। সিরাজ-উদ-দৌলা আরেক শত্রু বিহারের শওকত জঙ্গের আনুগত্যও আদায় করলেন। ইংরেজরা সিরাজ-উদ-দৌলার দুতকে অপমান করলে কলকাতায় গিয়ে ইংরেজদের শায়েস্তাও করেন। স্বয়ং গভর্নর ড্রেক পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। দূরত্ব তৈরি হয় ইংরেজদের সাথেও। মসনদে বসে কয়েকমাসের ভিতরে এতগুলি সফল কাজও তিনি করেছিলেন। তবু কিন্তু এরপরেই সিরাজ-উদ-দৌলা আবার এক ভুল করে বসলেন। পরাজিত ইংরেজদের তাড়িয়ে না দিয়ে সকল বন্দীদের মুক্ত করে দেন। ফলে ১৭৫৭ সালের ২ রা জানুয়ারি অ্যাডমিরাল ওয়াটসন মাদ্রাজ থেকে আরও সৈন্য এনে কলকাতা পুনর্দখল করল। সিরাজ-উদ-দৌলা আবার ইংরেজদের সাথে লড়াইয়ের ময়দানে নামলেন। কিন্তু লর্ড ক্লাইভের কৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে সিরাজ-উদ-দৌলা বাধ্য হলেন ইংরেজদের সাথে সন্ধি করতে, ফলে আবার মিত্রতা হল। কিন্তু এই মিত্রতার ভিতরেই জন্ম নিল ধংসের বীজ। ফরাসিদের আক্রমন করল ইংরেজ, সিরাজ-উদ-দৌলা তাতে সাহায্য করলেন। কিন্তু ফরাসিরা আসলেই ছিল নবাবের বন্ধু। কিন্তু সন্ধির কারনে সিরাজ-উদ-দৌলা নিজ হাতে নিজের কবর খুঁড়ে বিপদ দেকে আনলেন।

ফরাসিদের বাংলা ছেড়ে যাবার নির্দেশ দিলেন সিরাজ-উদ-দৌলা। ফলে একদিকে মিত্র ফরাসিদের হারালেন, অন্যদিকে মিরজাফর, ইয়ারলতিফ, জগৎশেঠরা ইংরেজদের সাথে যুক্ত হয়ে শত্রুর সংখ্যা বেড়ে গেল। ইংরেজরা দেখলেন, সিরাজের আত্মীয়, অভিজাত, বুদ্ধিমান, শিক্ষিত, পণ্ডিত ও ক্ষমতাশালী মিরজাফরকে নবাব করলে তাঁদের প্রভুত্ব বিস্তারে সুবিধা হবে। তাই শুরু হল চক্রান্ত। পাঞ্জাবী ব্যাবসায়ি উমিচাঁদও যুক্ত হয়ে গেলেন এই চক্রান্তে। শুরু হল ইংরেজ ও সিরাজ-উদ-দৌলা দ্বন্দ্ব। কিন্তু সিরাজ-উদ-দৌলা একটুও টের পাননি যে মিরজাফর এই চক্রান্তের শরিক। ফলে সিরাজ-উদ-দৌলা মিরজাফরকে দিলেন সেনাপতির দায়িত্ব। হয়ে গেল ইতিহাসের আরেক চরমতম ভুল। ১৭৫৭ সালের ১ লা মে থেকে ২২ শে জুন পর্যন্ত সিরাজ-উদ-দৌলার কাছে হয়ে গেল এক বিভীষিকা। সব চক্রান্ত আর যুদ্ধের প্রস্তুতি হয়েছিল এই কয়েকটা দিন।

২৩ শে জুন এলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ। স্থান পলাশির প্রান্তর। আমবাগান ঘেরা ভাগীরথী নদীর তীরে সিরাজ-উদ-দৌলার সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত। ৫০০০ মোঘল ঘোড়সওয়ার, ৭০০০ পদাতিক রাজপুত ও পাঠান, ছিল ৫৫ খানা ভারি কামান। এছাড়া ছিল আরও ৩৮ হাজার দেশীয় সৈন্য। ছিল হাতি ও বলদে টানা ৫৫ টি কামানের গাড়ি। কিন্তু চক্রান্তের কারনে মাত্র ১২ হাজার সৈন্য লড়াই করেছিল। বাকিরা সেনাপতিদের নির্দেশ না পেয়ে চুপ থাকতে বাধ্য হয়েছিল। আর ইংরেজরা মাত্র ৩২০০ সৈন্য আর ৬ খানা ছোট কামান দিয়ে প্রায় যুদ্ধ না করেই পরাজিত করল সিরাজ-উদ-দৌলাকে। তবে সিরাজ-উদ-দৌলার জন্য মিরমদন আর মোহনলাল কম চেষ্টা করেননি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ইংরেজদের ঘায়েল করেছিলেন ভালই। দুপুরে আকাশকালো মেঘ আর বৃষ্টি নবাবের বাহিনীকে বিপদে ফেলেছিল। সমস্ত কামানের বারুদ ভিজে যায়। কিন্তু ইংরেজদের কামান ছিল সচল।

মিরমদন, মোহনলালের জামাই বাহাদুর আলি খান, গোলন্দাজ প্রধান নোয়ে সিং হাজারির মত বড় বড় সেনাপতিরা কামানের মুখে মারা গেলে সাধারন সৈন্যরা বিভ্রান্ত হন। অন্য সেনাপতি মোহনলাল, ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও মিরজাফর নিষ্ক্রিয় থাকলেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন প্রায় ৩৫ হাজার সৈন্য নিয়ে। বিভ্রান্ত সিরাজ-উদ-দৌলা দ্রুতগামী উটে চড়ে ২ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে ফিরে গেলেন মুর্শিদাবাদে। প্রচুর সৈন্য মারা গেলেন। পরদিন ২৪ শে জুন ভোরবেলায় লর্ড ক্লাইভ মিরজাফরকে নবাব বলে ঘোষণা করলেন। সিরাজ-উদ-দৌলা রাজধানী মুর্শিদাবাদ ছেড়ে পালালেন ছদ্মবেশে। বন্দী হলেন মোহনলাল ও অন্যান্যরা। ২৯ শে জুন লর্ড ক্লাইভ নিজে গিয়ে মিরজাফরকে নবাবের সিংহাসনে বসালেন। প্রচুর ধনরত্ন ভাগাভাগি হল।

২ রা জুলাই বন্দী হলেন সিরাজ-উদ-দৌলা। মাঝরাতে মিরজাফর বিচারসভা বসালেন। কিন্তু সিরাজ-উদ-দৌলাকে শাস্তি দেওয়া নিয়ে মতভেদ হল। মিরজাফর হত্যার পক্ষে ছিলেন না। তাই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত হল। কিন্তু মিরজাফরের পুত্র মিরন সেই রাতেই মহম্মদি বেগকে দিয়ে সিরাজ-উদ-দৌলাকে হত্যা করালেন। যা মিরজাফর মেনে নিতে পারেননি। পরদিন ৩ রা জুলাই হাতির পিঠে করে সিরাজ-উদ-দৌলার খণ্ড বিখণ্ড দেহ সারা মুর্শিদাবাদ প্রদক্ষিন করানো হল। মৃতদেহ সিরাজ-উদ-দৌলার মা আমিনাকে দেখিয়ে খোসবাগে দাদু আলীবর্দি খাঁর সমাধির পাশে সমাহিত করা হল। এরপরে আলীবর্দি খাঁর উত্তরাধিকারী প্রতিটি শিশু ও পুরুষকে হত্যা করল মিরন। হত্যা করা হল সিরাজ-উদ-দৌলার প্রতিটি বন্ধুকেও। এভাবেই শেষ হয়ে গেল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন সাম্রাজ্য।

সিরাজ-উদ-দৌলার ব্যক্তিগত চরিত্র সমালোচনার উদ্ধে নয়। নবাব পরিবারের এক গৃহশিক্ষক গোলাম হোসেনের মতে ‘সিরাজ-উদ-দৌলা ছিলেন নিষ্ঠুর, ব্যভিচারী, লম্পট, অর্থলোলুপ ও মদ্যপ‘। ইংরেজ ও ফরাসিদের চোখেও সিরাজ-উদ-দৌলা ছিলেন ‘নিষ্ঠুর‘। সমকালীন লেখক ভোলানাথ চন্দ্র সিরাজ-উদ-দৌলাকে বলেছেন ‘নিষ্ঠুর ও ব্যভিচারী‘। কিন্তু আবার কিছু ঐতিহাসিকেরা এও বলেন, ‘সিরাজ-উদ-দৌলা আর যাই হোক, কাপুরুষ ছিলেন না। নিজ সাম্রাজ্য রক্ষায় আমৃত্যু সচেষ্ট ছিলেন। মিরজাফরের মত তিনি দেশকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেননি। অল্প বয়স, অল্প শিক্ষা, অভিভাবকহীনতা আর নিজেদের ঘরের শত্রুদের জন্য তিনি ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন‘। আর তাই সিরাজ-উদ-দৌলা যাবতীয় ব্যক্তিগত দোষ থাকলেও ইতিহাসের পাতায় সসম্মানেই আছেন বাংলার এক ট্র্যাজিক চরিত্র হিসাবে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.