নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

একজন মেয়ে থেকে মায়ের জন্মের গল্পগাঁথা, প্রতিদিন নিজের \'ভাল মা\' হয়ে ওঠার চেষ্টার গল্প।

মেয়ে থেকে মা

একজন ডাক্তার মা আমি যে মাতৃত্বের এই রঙ্গিন সময়টাতে সন্তানকে খাঁটি মানুষ করে গড়ে তুলতে চাই আমার পেশাগত জ্ঞ্যান আর স্নেহ মমতার মিশ্রণে

মেয়ে থেকে মা › বিস্তারিত পোস্টঃ

"আমি সেই মেয়ে"

০৬ ই জুলাই, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২১

আমি সেই মেয়ে যে স্কুলে পড়াকালীন এক ছেলেকে ‘আমার ভাই’ বলে সম্মান দেখাতাম ভাইয়ের, কিন্তু সেই ছেলে যখন আড়ালে আমাকে বোন ছাড়া অন্য কিছু ভেবে শারীরিক অবয়ব নিয়ে বাজে কথা বলে এরকম প্রমাণ পেয়েছি প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিলাম । স্কুলে পড়ুয়া ছোট্ট মেয়েটি তখন রীতিমত ভেঙ্গে পরেছিলাম । নিজেকেই খানিক্ষণের জন্যে দোষী মনে হয়েছিল । মনে হয়েছিল 'আমারই ভুল আছে আচরণে, নইলে যাকে ভাই ডাকি সে কেন আমায় অন্য নজরে দেখবে আমার পিছনে?'
কিন্তু নিজেই নিজের মনোবল ভাংতে দেই নি । নিজেই বুঝিয়েছি নিজেকে যে কিছু মানুষ পৃথিবীতে আছে-ছিল-থাকবে যারা কখনো কোনও সম্পর্কের মর্যাদা দেবে না, সে যতই পবিত্র সম্পর্ক হোক না কেন! সেই সম্পর্ককে তারা আড়াল হিসেবে ব্যাবহার করবে নোংরা মনের;
আর একটা দিনও হাস্যালাপ করিনি কলেজে উঠে, যেই কলেজ ‘ক্যান্টণমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজ’ অর্থাৎ একই বাউন্ডারির মাঝের একই প্রতিষ্ঠান ছিল।
তথাকথিত ‘ভাই-বোন’ সম্পর্কের চেয়ে আত্মসম্মান প্রিয় ছিল আমার ।

আমি সেই মেয়ে যে একই তারিখে জন্মদিন বলে স্কুলের এক ছেলেকে বোজম ফ্রেন্ডের মর্যাদা দিয়েছিলাম । কিন্তু সেই ছেলে যখন ‘অক চুমু খাসি’ বলেছে শুনেছিলাম, জনসমক্ষে ‘এই শালা তুই নাকি আমাকে চুমু খেয়েছিস!’ বলে সবার সামনে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম এবং তার ‘না এমনি বলসি’ উত্তর শুনে হেটে এসেছিলাম ।
সবার সামনে ‘চুমু’ নিয়ে কথা না বলার চেয়ে নিজের কৃতকর্মের স্বচ্ছতার প্রমাণ দেয়া আমার জন্যে সেই বয়সেই বেশি জরুরী ছিল ।

আমি সেই মেয়ে যে অসম্ভব চঞ্চল শিক্ষার্থীদের লিস্টের অন্তর্ভূক্ত ছিলাম কলেজে । কোন কেরি-ক্যাচার টাইপের দুষ্টুমি বা দুর্ঘটনা ঘটলে দোষীদের সাথে সন্দেহভাজন হিসেবে আমারও ডাক পরতো প্রিন্সিপ্যালের রুমে আমি কিছু করেছি কিনা বা কিছু জানি কিনা তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। কিন্তু পরীক্ষাহলে একেবারে শেষ সময়ে এক্সট্রা পেপার চাওয়ার অপরাধে যখন শিক্ষক ‘বেয়াদপ’ বলেছিলেন নির্দ্বিধায় গিয়ে প্রিন্সিপ্যালকে নালিশ করে এসেছিলাম । কারণ যে কাজ করে কোন অপরাধ আমি করিনি তার জন্যে গালি শুনতে রাজি ছিলাম না আমি।

একবার গভীর রাতে বাবা সেন্সলেস হয়ে বাথরুমে পরে গিয়ে রক্তে মাখামাখি হয়ে শুয়েছিলেন, মা হতবিহবল হয়ে কাদছিল বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাথ্রুমের মেঝেতেই। তার সেই হুশও ছিল না যে মানুষটাকে বাথরুমের বাইরে আনতে হবে কমসেকম ! আমি রাত আড়াইটার সময় বেরিয়ে গিয়ে ডাক্তার এম্বুলেন্স সব কিছুর ব্যাবস্থা করে মা-বাবাকে তৈরী করে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম । তখন আমার বয়স ১৯/২০ ।
নিজের বাবা-মায়ের পাশে দাড়াতে নিজের গা থেকে ‘মেয়ে-মানুষ’ ট্যাগ ঝেড়ে ফেলে ‘সন্তান’ হওয়াটাই আমার আজীবনের লক্ষ্য ছিল ।
তখন কিন্তু ক্যান্টনমেন্টের চেনা গন্ডিতে ছিলাম না আমরা।

আমি সেই মেয়ে, যে মফস্বলের ছোট্ট একটা সরকারী মেডিকেল কলেজের ‘সবচেয়ে ভালো মানুষ’ বলে পরিচিত ডাক্তারের বিয়ের সম্বন্ধের বায়োডাটায় মিথ্যে তথ্য দেখে নিজের ব্যাচমেইট, শিক্ষক , উনার ব্যাচমেইট, আশপাশের সমাজের চাপ এবং ‘কে-কি-বলবে’ না ভেবে ‘আমি দুঃখিত, সম্ভব না’ বলে চলে এসেছিলাম ।
উনি এতোটাই ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন যে উনাকে এবং উনার পরিবারকে সরাসরি সব জানাবার পরও এবং এক পর্যায়ে উনারাও ‘কর্মফল’ মেনে নিয়ে সরে গিয়েছিলেন কোন অভিযোগ না করে । তবুও পরবর্তী সময়ে বহুবার শিক্ষক-প্রতিবেশি-সিনিওরকে জবাবদিহি করতে হয়েছে আমায় , আমার নিজের ব্যাক্তিগত জীবনের সিদ্ধান্তের কারণ নিয়ে।
কিন্তু একজন মিথ্যাবাদীকে নিজের জীবনে আসতে দেইনি।

আমি সেই মেয়ে, যার গৃহ পরিচারিকাকে এক নেশাখোর দোকানদার অপমান করেছে শুনে সেই দোকানদারকে সবার সামনে ধমকে এসেছিলাম । সেই দোকানদার নেশা করা লাল চোখে বলেছিল 'আপা ধমকি দিলেন নাকি?' আমি সবার সামনে বলেছিলাম , 'এই যে সবার সামনে বলছি আপনি একটা মেয়েকে অপমান করলে অবশ্যই আপনাকে আমি ধমকিই দিলাম' ।
“ ‘কাজের মেয়ে’ র জন্যে রিস্ক নিতে হবে কেন ? ” এরকম কথা ঘরে বাইরে অনেকের মুখে শুনতে হয়েছিল, কিন্তু শুনেও যা উচিত মনে করেছি তা করে গিয়েছি ।

আমি সেই মেয়ে, যে লোকাল ঔষধের দোকানগুলো যাতে রোগীদের থেকে তিন হাজার টাকার ঔষধের দাম দশ হাজার টাকা না নিতে পারে সে জন্যে পুরো ইন্টার্নী লাইফ সোচ্চার ছিলাম । যার ফলশ্রুতিতে ডিউটি থেকে ফেরার পথে রাত ১১টার দিকে এরা একবার আমায় ঘিরেও ধরেছিল। তখনো ভয়ে কুকড়ে যাইনি, আর ঐ ঘটনার পরেও থেমে যাইনি।

আমি সেই মেয়ে, যে লক্ষ্মীপূজোর সময়ে ‘ঘরের লক্ষ্মীকে ঘর ছেড়ে যেতে নেই’ এমন সামাজিক বাধা অগ্রাহ্য করে মরনাপন্ন শাশুড়িকে পূজোর দিনেই হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিতসা শুরু করেছিলাম । ফার্স্ট স্টেইজ প্রেগন্যান্সিতে ফিজিক্যাল স্ট্রেস নিলে কি হতে পারে তা জেনেই দিন-রাত তার শুশ্রুষা করে গিয়েছি । মিস ক্যারেজ হয়ে যাচ্ছে বুঝেও ওয়াশরুমে গিয়েছি -এসেছি আর সেবা করেছি। নিজের অনাগত প্রথম সন্তানকে মনে মনে বিদায় জানিয়ে আড়ালে চোখ মুছে মুছে সেবা করে গিয়েছি ।
এবং মরনাপন্ন মানুষটাকে হাটার মত অবস্থায় দাড় করিয়ে তবে দম নিয়েছি।এমনো নয় যে আমার শশুর শাশুড়ি ব্যাতিত বাকি আত্মীয় সজন যারা শাশুড়িমাকে হাসপাতালে নেবার বিপক্ষে ছিল তারা এর পরে আমায় খুব সম্মানের আসনে বসিয়ে ধন্য ধন্য করেছে, বরং তারা যা করেছিল তা 'অনুচিত' প্রমাণিত হওয়াতে তারা অসুন্তষ্টই হয়েছে।
কিন্তু নিজের লক্ষ্য আর দায়িত্ব থেকে সরে আসতে শিখিনি । আর না সে দায়িত্ব কারো প্রশংসার লোভে পালন করেছি কোনদিন।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্রভাবশালী শিক্ষিকা ‘শাশুড়ির সেবা করা লাগলে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করতে এসেছো কেনো?’ টাইপের কথা বলেছিলেন আমার গার্ডিয়ানের সামনেই এবং বলে দিয়েছিলেন যে উনি পাশ করাবেন না। উনার নিজের ব্যাক্তিগত সমস্যার কারনেই একটু অমন আচরণের ছিলেন আসলে।
কাজেই সেকেন্ড পার্টে উঠেও ঐ একটা পেপারে পাশ করতে পারি নাই , সবাই তখন বলেছিল উনাকে একটু ভালোমত (!!) রিকোয়েস্ট করতে । টিচিং স্টাফ হিসেবে বহুবার তার রুমে গিয়েছি কিন্তু তোষামোদি করতে কখনোই না।
যেখানে মানুষের চান্স পেতে অসুবিধে হয় এবং হয়তো আমারো হবে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করলে সেখান থেকে সব ছেড়ে চলে এসেছিলাম এক মাসের সিদ্ধান্তে। হয়তো সেই মুহূর্তে একটু ঝুকে গিয়ে চলতি হাওয়ায় পাল ওড়াতে পারলে হয়তো আজকে আমার ক্যারিয়ারের পাখায় যুক্ত হত নতুন কোন পালক !
নিজের সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েও অন্যায় মেনে নিতে পারিনি । পিছিয়ে গিয়েছি সবার থেকে, কিন্তু হেরে যাইনি আমি

আমিও কৈশোর-তারুণ্যে ছেলেমি করা-ভুল করা- ক্রাশ খাওয়া-কান্না করা -ভেঙ্গে পরা সব স্টেইজ পার একটা মানুষ ।
কিন্তু আমি সেই মেয়ে যে সব কিছুর পরেও উঠে দাড়াতে পারি , ঘুরে দাড়াতে পারি । পেশাগত জীবনে আর কিছুই যদি না-ও করি, নিজের চরিত্রগত গুণ গুলো বিষর্জন দেবোনা আর এটাই আমার প্রাপ্তি ।

আমিই সেই মেয়ে যার অতীত ও ভবিষ্যতের ব্যার্থতা এবং সম্ভাব্য ব্যার্থতা নিয়ে , এমনকি যার পরিবার- স্বামী-সন্তান নিয়ে অনেকেই সমালোচনা কর , অহেতুক কষ্ট দিয়ে কথা বল।
তারা জেনে রাখো, আমিই সেই মেয়ে যার ‘পেছনে’ কথা বল তোমরা, সামনে নয় ।

তবুও তোমাদের ধন্যবাদ নিজের সময় খরচ করে আমায় নিয়ে কথা বলার মত গুরুত্বপূর্ণ তোমরা ভাবো বলে !
আরো ধন্যবাদ এজন্যে যে, আমি আজ যা তার পিছনে তোমাদের অবদান নিছক কম নয় কিন্তু ! তোমরা কথা বল বলেই আমি প্রতি নিয়ত নিজেকে শুধরাতে চেষ্টা করি,

পুনশ্চঃ এই কথাগুলো লিখে রেখে যাচ্ছি আমার মেয়ের জন্যে ও আরো সব মেয়েদের জন্যে যারা সব ভয় , সব বাঁধা, সামাজিক ট্যাবু এমনকি আক্রমনকেও জয় করে আগামীর পৃথবীকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে নিজের যোগ্য ভূমিকা রাখবে

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই জুলাই, ২০১৬ সকাল ১০:৪৪

বিজন রয় বলেছেন: ভাল পোস্ট দিয়ে ব্লগিং শুরু।

ব্লগে স্বাগতম।
শুভকামনা, শুভব্লগিং।

০৭ ই জুলাই, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:০৩

মেয়ে থেকে মা বলেছেন: উতসাহিত করার জন্যে অনেক ধন্যবাদ, মেডিকেলের ভাষায় শ্বাস নেয়াকে বলে ইন্সপায়ার করা। কিন্তু ইন্সপায়ার করতে সবাই পারেনা। থ্যাঙ্কিউ
:)

২| ০৭ ই জুলাই, ২০১৬ সকাল ১০:৫৬

সামু পাগলা০০৭ বলেছেন: আপনার নিকটা সাম্প্রতিক ব্লগে চোখে পরল। খুব ইন্টারেস্টিং শক্তিশালি একটা নাম! ক্লিক করে এসে পরলাম। অসাধারন সব কথা পড়লাম। আপনি মানুষ হিসেবে অনেক শক্ত মনের কিন্তু মায়ায় ভরা মনে হল। আপনার ব্লগবাড়িতে মাঝেমাঝেই আসব, এবং আমার ব্লগবাড়িতেও আপনাকে স্বাগতম আপু।

অনেক দোয়া আপনার মেয়ের জন্যে। সে আপনার মতো মা পেয়ে ভাগ্যবতী।
শুভকামনা রাশি রাশি।

০৭ ই জুলাই, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:০৫

মেয়ে থেকে মা বলেছেন: আপনার ব্লগ বাড়িতে তখন গিয়েছিলাম যখন কমেন্ট কিভাবে করতে হয় তাও শিখে উঠতে পারিনি । এখন শিখেছি । আবার যাবো। থ্যাঙ্কিউ ভাই ।
ঈদ মুবারক

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.