নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার সব লেখা

ডা: আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী

চিকিৎসক এবং লেখক

ডা: আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী › বিস্তারিত পোস্টঃ

‘ধর্ষণ’ কি একটি উপভোগ্য সংবাদ?

১৪ ই জুন, ২০১৪ বিকাল ৫:০৬

বেশ কিছুদিন আগের কথা। একদিন সম্পাদক সাহেব ফোন দিয়ে বললেন, ‘আপনার শিরোনাম গুলো আরেকটু আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করুন। বিতর্কিত হোক আপত্তি নেই তবে চোখে পড়ার মত কিছু একটা করতে হবে। আমরা যেটাকে বলি সেক্সি হেডলাইন’। বক্তব্যটা এখানে উল্লেখ করা খুব জরুরী না। তবে এরপরে আমার ভেতর নতুন একটি পরিবর্তন হল। আর তা হচ্ছে পত্রিকা কিংবা ব্লগে কোন লেখা পড়তে গেলে, কেন সেই লেখাটি পড়ছি তা নিজেকে একবার প্রশ্ন করি।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, আবিস্কার করলাম, সম্পাদক সাহেব ঠিক বলেছেন। কোন লেখাটি পড়ব, তা ঠিক করছি দুটো বিষয় লক্ষ্য করে। প্রথমটা লেখক আর দ্বিতীয়টা শিরোনাম। কোন কোন ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কারণটা এতোটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে, লেখকও মুখ্য থাকে না। যেসব লেখকের লেখা পড়তাম তাদের নতুন লেখার শিরোনাম পছন্দ না হওয়ায় কিংবা শিরোনাম দেখে যদি মনে হয় কি বলবেন মোটামুটি বুঝে গেছি, তখন সেই লেখা আর পড়ছি না। আবার অচেনা কিছু লেখকের লেখা পড়ছি, শুধু কিছু শব্দের টানে। শিরোনামে সাজানো শব্দগুলোর একটু হেরফের এর কারণে।

কিছুদিন আগে, একদিন গেলাম একটি পত্রিকার অনলাইন ভার্সানে। সেখানে খবর গুলো বিভিন্ন ভাবে শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে। আর তার একটি হচ্ছে ‘সর্বাধিক পঠিত’। আগ্রহ লাগল। ভাবলাম, দেখি কোন খবর গুলো বেশি বেশি পড়া হয়েছে। প্রথম দশটির শিরোনাম আছে ওখানে। যে তথ্যটি আবিষ্কার করলাম, তা হচ্ছে সেই দশটির মধ্যে চারটি ধর্ষণ সংক্রান্ত।

পত্র পত্রিকার প্রিন্টেড ফর্মটা বেশ অনেকদিন হলোই পড়া হয় না। দেশ বিদেশের যা খবর রাখি, তার অধিকাংশই পাই ফেসবুক কিংবা অনলাইন পত্রিকা থেকে। ইদানীং আরও সুবিধা হয়েছে। বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকার ফেসবুক পেজ এ লাইক দিয়ে রাখলে, একটি বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়। ফেসবুকের নিজের নিউজ ফিড এ প্রতিদিন ই বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য খবরের লিঙ্ক এসে হাজির হয়। যথারীতি এসবের ভেতর থেকে ‘সেক্সি হেডলাইন’ অনুযায়ী খবর গুলো পড়ে নিই।

যেহেতু নিজে লেখালেখি করি তাই আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করার চেষ্টা করি, তা হচ্ছে হেডলাইন কে সেক্সি বানাতে কি কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধারণ কোন ঘটনা কিংবা স্বাভাবিক কোন ঘটনার পাঠক সম্ভবতঃ বেশ কম। পাঠকের আধিক্য অস্বাভাবিক ঘটনায়। শুধু অস্বাভাবিক হলেই হবে না, সেটায় এমন কিছু মশলা যোগ করতে হবে যেন, তা আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের যত রিপোর্ট হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী পঠিত হয়েছে বোধকরি ‘ওসমান পরিবার’ সংক্রান্ত রিপোর্ট টি। কেউ মূল বক্তব্যের কিছু অংশ দিয়ে শিরোনাম করেছে কেউ বা কার্টুন সহযোগে। বক্তব্যটি কি ছিল সবাই জানলেও এই রিপোর্টটি বেশ অনেকেই পড়েছেন। এবং সম্ভবতঃ বেশ আগ্রহ নিয়েই। আর বেশি পড়েছেন, যে যত তির্যক ভাবে শিরোনাম করতে পেরেছেন, ‘সেক্সি হেডলাইন’ আর কি।

এই মুহূর্তে দেশে সংবাদের বেশ আকাল চলছে। এদেশে সংবাদ হিসেবে সবচেয়ে বেশি চলে বোধকরি ‘রাজনীতি’। আর সেখানেই যেহেতু বেশ স্থবির অবস্থা তাই সম্প্রতি খবর বলতে তেমন কিছুই নেই। ‘৭ বছর পরে দুইভাই গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে’ এই খবরই তাই বিশাল এক খবর। আর রাজনীতি বলতে এখন লীগ ছাড়া তেমন কেউ বাজারে নেই। নিজেদের ঝগড়া কিংবা দুর্নীতি কিংবা নেত্রীর সংবাদ সম্মেলন। ‘লাশ ভাসা’ কিংবা ‘আল্লাহ এবং নেত্রী ছাড়া...’ এই খবর গুলো ও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছু সেক্সি হেডলাইন সহযোগে, পরিবেশন চলছে। সত্যিকারের নতুনত্ব যা আসছে তা আসছে অপরাধ জগত থেকে। সেখানে দুটো ব্যাপারই পাঠক টানে। ‘খুন’ আর ‘ধর্ষণ’।

খুন ব্যাপারটায় জমিজমা কিংবা অ্যাকসিডেন্ট হলে বাজার পাওয়া একটু কষ্টকর। তবে ক্ষুদ্র কিছু হলে—তার আবার একটা আলাদা বাজার আছে। ‘এক টাকার জন্য খুন’ বেশ অনেকেই পড়বে। ‘কি পিশাচ!’ বলে গালাগালি দিতে দিতে আরেকজনের দিকে খবরের কাগজটা এগিয়ে দিবে। লাশের ওপর বেশ কিছু অত্যাচারও খবর হিসেবে বেশ উপাদেয়। ‘মাথা কাটা লাশ উদ্ধার’ এক শ্রেণীর পাঠক পড়বেনই। ‘ব্যাগের ভেতর টুকরো করে ভরে রাখা লাশ’ এই খবর তো গোগ্রাসে গেলার মত খবর।

অপরাধ সিরিজের সবচেয়ে আকর্ষণীয় টপিক নিঃসন্দেহে ‘ধর্ষণ’ যদি ‘ধর্ষণ’ একসময় নিজেই বেশ সেক্সি হেডলাইন ছিল, তবে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে এখন কিছুটা জেল্লা হারিয়েছে। এখন তাই সঙ্গে বেশ কিছু মশলা লাগাতে হয়। ধর্ষিতা বেঁচে গিয়ে থাকলে এবং ‘স্টেটমেন্ট’ দিয়ে থাকলে তো কথাই নেই-- সেটি বেশ উপাদেয় মশলা হয়ে যায়। স্টেটমেন্ট এর কিছু অংশ তাই শিরোনামে যোগ করে বোঝানো হয়, এখানেই শেষ না, ভেতরে আরও আছে। আর তেমনটা হলে সেই খবর পড়া পাঠকের জন্য অনেকটাই বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। পড়ে যদিও ‘আহা’ ‘উহু’ করবে, তবে একাকী পড়বে। খুঁটিয়ে পড়া হবে ধর্ষিতার বর্ণনা। কিভাবে, কতজন, কতক্ষণ, কোথায়—এসব বর্ণনা যতবেশি থাকবে, পঠন কাল ততই দীর্ঘায়িত হবে।

ইদানীং, বিভিন্ন পত্রিকার ফেসবুক পেজ বেছে বেছে নিউজ ফিড হিসেবে আমার নিউজ ফিডে পাঠায় তার মাঝে ধর্ষণ থাকবেই। কোথাও আকর্ষণীয় ধর্ষণ হয়েছে, আর সেটা রিপোর্ট হয়েছে অথচ সেটাকে মুখ্য খবর ভাববে না, এমনটা অসম্ভব। মজার যে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম, তা হচ্ছে শিরোনামে। ইদানীং বোধহয় শুধু ধর্ষণ, বাজার টানছে না। ‘অমুক গ্রামে যুবতী ধর্ষিতা’ খুব একটা খাওয়ানো যাচ্ছে না। সঙ্গে তাই আরও কিছু ‘ট্যাগ’ যোগ হচ্ছে। এই ‘ট্যাগ’ এর ভেতর সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয় ‘গণ’। এছাড়া ‘এক মাস’ কিংবা ‘উপর্যুপরি’ এসব ও হেডলাইন কে একটা সেক্সি সেপ দিচ্ছে। নিকটাত্মীয় কেউ হলে, তারও একটা আলাদা বাজার আছে। যত নিকট তত দামী। ‘চাচা’ র চেয়ে ‘বাবা’ অনেক বেশি আকর্ষণীয়।

আরও কিছু ছোট খাট ব্যাপারও আজকাল যোগ হচ্ছে। ‘স্ত্রীর সহযোগিতায়’ কিংবা ‘বাবা মায়ের সামনে’ ‘দুই বোনকে’ ‘পাঁচ বছরের শিশু’ ‘শিক্ষক’ ‘প্রেমিকের বন্ধু’। যত বিকৃতি ততো আকর্ষণীয়। তত সেক্সি। ততো পাঠক। ততো হিট। তাই প্রতিনিয়ত চলছে ধর্ষণকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপনের প্রতিযোগিতা।

আমি জানি অনেক ট্যাগ লাইন হয়তো বাদ পড়েছে, অনেক ট্যাগ লাইন হয়তো অচিরেই যুক্ত হবে। ধর্ষণের খবর দিনে দিনে আরও আকর্ষণীয় করে প্রকাশ করার উপায় বের হবে। পাঠক বাড়বে। হয়তো সর্বাধিক পঠিত খবরের প্রথম দশটিই হবে এই সংক্রান্ত। হয়তো আজকের এই লেখাটিতে ‘ধর্ষণ’ শব্দটি হয়তো আমি ইচ্ছে করেই যুক্ত করেছি, পাঠক জোগাড়ের আশায়। পত্রিকায় প্রকাশিত হলে, হিট বাড়বে, লেখকের নাম জানবে। একজন রিপোর্টারও হয়তো এই আশায় ধর্ষণের রিপোর্টে কিছু মশলা মেশায়।

নিজেদেরকে কি প্রশ্ন করা যায়? ‘ধর্ষণ ঘটিত রিপোর্ট গুলো কেন আমরা কেন পড়ি?’ সেকি শুধুই দেশের সার্বিক খবর রাখার উদ্দেশ্যে? নাকি বিকৃত রুচির তাড়নায়? যে বর্ণনা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে পড়ি, সেটা কেন পড়ি? যে কারণে সিনেমা দেখবার আগে শুনে নিই, কয়টা ‘রেপ সিন’ আছে? ঠিক যে কারণেসিনেমায় ‘ধর্ষণ’ দৃশ্যের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকি? কারণটা কি একই? উপভোগ করা?

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:০৮

ধর্ষণ বলেছেন: আকর্ষণ আছে বলে

২| ১৪ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫

অবাধ্য সৈনিক বলেছেন: ++++++

৩| ১৫ ই জুন, ২০১৪ বিকাল ৪:৪৫

নক্‌শী কাঁথার মাঠ বলেছেন: কালেরকন্ঠ মনে হয় ধর্ষণের খবরের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী। ধর্ষণ আর সানি লিওন, এই দুই বিষয়ে খবর কালের কন্ঠে থাকবেই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.