![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি ছোটবেলা থেকে পড়াশুনার জন্য বেশ স্বাধীনতা পেয়েছি। আম্মা কোনোসময় বলতেন না এই পড়তে বসিস না কেন? তার কতক কারন ছিল! এক, গ্রামের স্কুলে আমার অবস্থান বেশ ভালো ছিল। দুই, দরিদ্রতার কারণে কেরোসিন তেল কিনে নিয়মিত হারিকেন বা লন্ঠন জালিয়ে এশার আযানের পরেও গভীর রাত পর্যন্ত পড়ার ব্যবস্থা না করতে পারা! তাই যদি কখনো আম্মা বা ভাই বোন রাতের বেলা হাতে কলম দেখত তবে রাগ করত! বলতো, রাতে শুধু পড়বি, লেখার কাজ সব দিনের বেলা, কারণ হিসেবে বলত রাতে লিখলে চোখ নষ্ট হয়ে যায়! যদিও এই ব্যাখ্যার কারণ তখন না বুঝলেও এখন বুঝি!
যখন সন্ধ্যা হত তখন হাত পা ধুয়ে পড়তে বসলে আম্মা বা দাদু (দাদি) মাগরিব এর নামাজ পড়ে পাশে এসে বসতেন। আম্মা ছিলেন ক্লাস ফোর পাস। সুতরাং খুব বড় ক্লাশের বই পড়ানো উনার দু:সাধ্য ছিল। প্রাইমারি বাংলা বই পড়াতে গিয়ে উনি নিজে আগে বানান করে পড়তেন তারপর অন্য ভাইবোন দের পড়াতেন! মেজো বোনের ফোরে বাংলা বইতে দুখোমিয়ার জীবণ কাহিনী পড়ানোর কথা এখনো কানে বাজে! আমরা জানি কাজী নজরুল ইসলাম খুব কষ্টে শৈশব কৈশোর কাটিয়েছিলেন। সেই গল্পে একটা লাইনের কিছু শব্দ ছিল "অনেক খাটুনির পর " আম্মা যে কয়বার খাটুনি বলেছিলেন মেঝো আপা সেই কবার খানুটি বলেছিলেন! সিলেবল আকারে বলেও আপা খাটুনিকে খানুটির বাইরে খুব সহজে আনতে পারেন নি! আমরা কতক ভাইবোন একসাথে পড়তে বসতাম বলে সেই দিনের কথা আজও দুই সন্তানের জননী মেঝো আপাকে বলে খেপানো প্রায়শই মুখরোচক হয়। অনেকদিন এমন হয়েছে পড়তে পড়তে এশার আগেই তেল ফুরিয়ে যেত! তখন মায়ের পাশে জড়ো হয়ে নবীদের কাহিনী বা রুপকথার গল্প শুনতাম। মধুর ছিল সেই দিন গুলো। পড়ার সময় হোক আর পরবর্তি গল্প শোনার সময়ই হোক।
আব্বা সবসময় সংসার বা আমাদের প্রতি একটু বেশি উদাসীন ছিলেন। তাই আমরা কি খেলাম বা কে কোন ক্লাশে কি রেজাল্ট করলাম বা আদৌ কোন খাতা কলম লাগবে কি না সেসব নিয়ে এখনো মাথাব্যথা নেই! যৌথ পরিবারে মায়ের সারাদিনের খাটুনির পর সন্ধ্যাকাল সময়টাই আমরা আম্মার সান্নিধ্য পেতাম। কখনো আহামরি খাবার খাওয়ানোর সুযোগ হয়নি! অনেকদিন এমন হয়েছে সন্ধ্যা থেকেই ঘরে বাতি জ্বলেনি! আমরা সেদিন হয় বারান্দায় খেলতাম নতুবা চাঁদনী রাত হলে উঠোনে ফেলে রাখা ধানের গাদায় লাফালাফি বা লুকোচুরি খেলতাম। আর আম্মা হয় তসবিহ পড়তেন না হলে সুর করে গজল, ক্বীরাত বা হুলিয়ানামা পড়তেন। মহানবীর হুলিয়ানামা শুনতে খুবই ভালো লাগতো। অবাক হতাম মহান স্রষ্টা একজনমাত্র নবীজিকে কত বড় অবস্থান দিয়েছেন গোনাহগার বান্দাদের শুপারিশের জন্য। আম্মা বলতেন হুলিয়ানামা মুখস্থ থাকলে হাশর ময়দানে নবীজিকে চিনতে সুবিধা হবে! নবীজী তখন সহজে শুপারিশ করবেন। খুব খেয়াল করে শুনতাম সেই হুলিয়ানামা। এইটা ঠিক, কখনো পুরোপুরি মুখস্থ হয়নি তবে আম্মার কন্ঠের সেই আওয়াজ আজও কানে বাজে! অনেক সময়ে আম্মা কেঁদে দিতেন। আমার ধর্মের ভিত ঐখান থেকেই।
দাদুর কাছে প্রতিদিন সকালে আরবি পড়তাম। ফোর ফাইভে থাকতেই কোরআন খতম করেছিলাম। কোরআন পড়া শুরুর আগে অর্থাৎ আমপারা শেষ করে যেদিন কোরআন শরীফ দাদু পড়ানো শুরু করতেন সেদিন ছোট একটা মিলাদ পড়াতেন। গ্রামের অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা দাদুর কাছে আরবি শিখতে আসতো। দাদু সম্পুর্ন ফ্রি পড়াতেন। আমাদের গ্রামে সে সময় কোন মক্তব ছিল না!
এক সময় দাদু প্যারালাইজড হন। দশ বছরভর অনেক কষ্টে কাটিয়েছেন! দাদুর বাম সাইড প্রথম প্যারালাইজড হয়! তখন দাদু লাঠি ভর দিয়ে চলতেন! নিজের কাজ নিজে করতেন। নামাজ কখনো ক্বাজা পড়তে দেখিনি! তখনো একটু আধটু স্বাভাবিক ছিলেন! তার কয়েকবছর পর আরেকদফা প্যারালাইজড হন! এরপরে তিনি বাকশক্তি হারান। প্রায় সময়ই আম্মা, ছোট চাচীমা বা আমি ও আমার ভাই বোনেরা অথবা ছোট চাচাতো ভাই বোনেরা দাদুর ওজু করিয়ে দিতাম! একসময় পানি ঢেলে দিতাম দাদু নিজে মুখ হাত পা ধুতেন! যখন আরো অচল হয়ে পড়লেন তখন হাত পা বিশেষ করে ডান হাত পা ধুয়ে দিতাম। সে সময় শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতা মনে পড়ত!
এরপরে আরো একদফা দাদু প্যারালাইজড হলেন। খুব বেশি হাটতে পারতেন না! একটু হাটতেই হাপিয়ে উঠতেন। শেষের দিকে দাদু অনেক কষ্টে কাটিয়েছেন! মৃত্যুর দুদিন আগে আম্মা বলেছিলেন ফোন করে দু চারদিন বেড়িয়ে যা তোর দাদু খুব অসুস্থ! আম্মার কথামত বাড়িতে গেছিলাম আর ঠিক তৃতীয় দিনের দিন দাদু শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। খুব কাছ থেকে দাদুর মৃত্যু দেখেছিলাম! আম্মাকে দাদু খুব ভালোবাসতেন। কারণ আম্মা নি:স্বার্থ ভাবে দাদুকে সেবা করতেন। যৌথ পরিবারে অনেক কাজ আম্মা করতেন। আর আম্মা পরহেজগার ছিলেন।
এখনো দাদুর মৃত্যু মনে পড়ে! আমি পাশে বসে সুরা ইয়াছিন পড়ছিলাম, সম্ভবত তিনবার শেষ করার আগেই দাদু শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। শেষের দিকে দাদু আম্মাকে খুব জোরে আঁকড়ে ধরেছিলেন! কোরআনের তেলোয়াতের সাথে ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ সহসা গলা কেঁপে কেঁপে উঠছিল আমার! এখন লিখতে গিয়ে চোখের কোনে পানি জমেছে। দাদুও আমাকে অনেক ভালোবাসতেন অন্যান্য ভাইবোন দের থেকেও! কারন আমি নামাজ পড়ার চেষ্টা করতাম, নিয়মিত কোরআন পড়তাম আর বাইরের খারাপ ছেলেদের সাথে কম মিশতাম।
মৃত্যুর আগে দাদু আমাকে কিছু দুয়া আর দুরুদ উনার কবরের পাশে পড়তে বলেছিলেন। শুধুমাত্র আমার উপর দাদু আস্থা রেখেই এই গুরু দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং আল্লাহর রহমতে আমি সেটা পালন করতে পেরেছি। দাদুর স্নেহের ঋণ অপরিশোধ যোগ্য। কোন সেবা বা উপযোগ কখনোই পরিশোধ যোগ্য নয়ই!
একটা কথা উল্লেখ্য যে আমার জন্মের পরপরই আম্মা কঠিন টাইফয়েড এ আক্রান্ত হন। উদভ্রান্ত আর মানসিক ভাবে অপ্রকৃতস্থ ছিলেন। তাই আমি মায়ের স্তন কম পান করেছি। অনেকদিন গিয়েছে আমি খাটের নিচে কখনো বা খেলতে খেলতে প্রসাব করে কাদামাটি করে ঘুমিয়ে গিয়েছি! আম্মা সেদিক ভ্রুক্ষেপ করতে পারতেন না। দাদু এসে আমাকে গোসল করিয়ে শোয়ায়ে দিতেন। আমার আর মায়ের এসব দুর্দশা দেখে দাদা আমাকে দুখোমিয়া বলে ডাকতেন!
এই হল আমার মানুষ হিসেবে পরিচিত হবার, গড়ে উঠার ভিত। ছোট থেকেই কোন এক নীতি আর আদর্শে আমি চলি! যে নীতির কারণে আমি আমার পরিচিতদের কাছে অনেক সময় পাগল আখ্যায়িত হই! তবুও আজন্ম এই নীতি আমি ধরেই রাখব। এ এক অন্য তৃপ্তি।
কতক দিন ধরে লেখাটা লিখব ভাবছিলাম! এই লেখার আসল উদ্দেশ্য ছিল আজকালকার মায়েদের নিয়ে লেখা! আমার আম্মা যতটুকু শিক্ষিতা ছিলেন তাতে হয়ত গর্ব বোধের জায়গা ছিল না। কিন্তু আশৈশব আমাদের যেটুকু সময় দিয়েছেন সেই সময়টুকু আমার তার ছেড়া মাথায় অনেক ইলেক্ট্রোপ্লেটিং এর যোগান দিয়েছেন। কিন্তু এখনকার মায়েরা শিক্ষিতা হউক আর নাই বা হউক তারা সারাদিন কাজ করুক বা না করুক , জব করুক আর না করুক সন্ধ্যা হোক আর বিকাল হোক হাতে তাসবিহ না নিয়ে রিমোর্ট নিয়ে বসে! এরপরে চলে গভীর রাত অবধি সিরিয়াল। কূটনামী শিখবে, শ্বাশুড়ীকে দেখবে না। প্রেম পরোকীয়া দেখবে, শিখবে মেয়েদের সাথে নিয়ে অথচ মেয়ে বাইরে কিছু করলে মেয়ের দোষের শেষ নেই।
বলবৃদ্ধিকরণ নীতিতে সামান্য বল প্রয়োগে বেশি বল পেয়ে অনেক যন্ত্রের উপযোগ আমরা নেই। কিন্তু সন্তানের কাছ থেকে ভালো উপযোগ নিতে হলে বল বৃদ্ধিকরণ নীতির উল্টো নীতি নিতে হবে! কারন এক্ষেত্রে ইনপুট এর সাথে আউট পুট পুরাই ব্যস্তানুপাতিক। এবং এই ব্যস্তানুপাতিক এর আবার একটা শর্ত আছে! সেটা হল ইনপুট খুব বেশি এবং নিখুঁত হতে হবে তাতে কিছুটা হলেও আউটপুট পাওয়া যাবে! কারন মানুষ স্বভাবগত ভাবে খারাপ কাজে বেশি আগ্রহী। একটা প্রচলিত কথা আছে আটা ভালো হলে রুটি ভালো হবে যদি রাঁধুনি দক্ষ হয়!
সবশেষে এটাই বলব, আমার_মা_সেরা_মা!
০১ লা জুন, ২০১৫ দুপুর ১২:৩২
দুখোমিয়া বলেছেন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ কষ্ট করে পড়ার জন্য! +গৃহীত হল!
©somewhere in net ltd.
১|
০১ লা জুন, ২০১৫ সকাল ৯:১৩
শামছুল ইসলাম বলেছেন: চমৎকার হয়েছে পুরো লেখাটা।
দুখোমিয়ার বেড়ে উঠাটা যেন দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে।
//এই হল আমার মানুষ হিসেবে পরিচিত হবার, গড়ে উঠার ভিত। ছোট থেকেই কোন এক নীতি আর আদর্শে আমি চলি! যে নীতির কারণে আমি আমার পরিচিতদের কাছে অনেক সময় পাগল আখ্যায়িত হই! তবুও আজন্ম এই নীতি আমি ধরেই রাখব। এ এক অন্য তৃপ্তি।//
+++ ভাল লাগা।