নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আিক

মুক্তির দূর্বার সৈনিক জাগ্রত জনতা আমরা।।

আিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

জাহাজ ভাঙার দৈনিক মজুরি ঘন্টা ৮ থেকে ১০ টাকা মাত্র

২৯ শে জানুয়ারি, ২০০৯ দুপুর ১২:৩৩

জাহাজ ভাঙার দৈনিক মজুরি ঘন্টা ৮ থেকে ১০ টাকা মাত্র



সীতাকুণ্ড শিপ ইয়ার্ডে শ্রমিকদের মানবিক জীবন যাপন







‘মরা হাতির দাম লাখ টাকা’- এই প্রবচনটি জাহাজ ভাঙা শিল্পের বেলায় আক্ষরিক অর্থেই সত্য। ভাঙা জাহাজের কোন কিছুই ফেলনা নয়। সবকিছু বিক্রি হয়। মালিকরা পান বিশাল মুনাফা। সরকার পায় ফিবছর প্রায় ৯শ’ কোটি টাকার রাজস্ব।

এই শিল্পে যারা শ্রম দেন তারা কেমন আছেন ? অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সত্য, এখানকার শ্রমিকেরা দৈনিক মজুরি ঘন্টা ৮ থেকে ১০ টাকা মাত্র।

জাহাজ ভাঙা শ্রমিকরা যেন ক্রীতদাস। পান নাম মাত্র মজুরি। ৭দিন কাজ করলে ৫দিনের টাকা পান। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম। সাপ্তাহিক ছুটি নেই। সরকারি ছুটি ভোগ করার অধিকার তাদের নেই। ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশায় কাজ করতে গিয়ে আহত হলে বা মৃত্যু হলে এক পয়সাও ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় না।

জাহাজ ভাঙা এখনও পর্যন্ত শিল্প হিসেবে ঘোষিত হয়নি। এখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫০ হাজার মানুষ কাজ করছেন। চট্টগ্রাম বন্দরের পর জাহাজ ভাঙা কর্মকাণ্ডটি দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থানের মাধ্যম হয়ে আছে। এছাড়া গড়ে উঠেছে ২০টিরও বেশি ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প। দেশের ৯০শতাংশ ইস্পাত ও রি-রোলিং মিল এসব কাঁচামালের জন্য পুরোপুরি নির্ভর করে জাহাজ ভাঙা শিল্পের উপর। জাহাজ ভাঙা লোহার প্লেটগুলো প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করছে। জাহাজ ভাঙা থেকে পাওয়া গাডার ৫ইঞ্চি পুরু লোহা ছাড়াও বিভিন্ন আকারের লোহার প্লেট হচ্ছে বিভিন্ন গ্রেডের এমএস রড, এমএস বার, এঙ্গেল বার ও স্টিল শিট। যা চাহিদা মিটিয়ে এই খাতে কাঁচামাল আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার ৩০ ভাগ সাশ্রয় করেছে।

২০০৩ সালে বুয়েট ও চুয়েট জাহাজ ভাঙা স্ক্র্যাপ ও এ থেকে তৈরি এমএস রডের গুণগত মান পরীক্ষা করে। পরীক্ষায় দেখা গেছে,জাহাজের স্ক্র্যাপ থেকে তৈরি রড ও অন্যান্য সামগ্রী উচ্চমানের। পুরানো জাহাজ থেকে পাওয়া রাডার, ওয়াকিটকি, ওয়্যারলেস, এন্টেনা ইত্যাদি জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে নৌ-বাহিনী ব্যবহার করছে। ফলে এগুলো কেনার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে। জাহাজ থেকে পাওয়া লোহা ছাড়া বিভিন্ন ধাতব পদার্থের বিপুল চাহিদাও আন্তর্জাতিক বাজার রয়েছে।

এসব ধাতব রফতানি করে বছরে ১শ’কোটি টাকারও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি বিদেশে রফতানি হচ্ছে। কয়েক বর্গমাইল এলাকা গড়ে ওঠা জাহাজ ভাঙা শিল্পের কারণে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে আকরিক লোহা ও লৌহজাত দ্রব্য আমদানি করতে হচ্ছে না। এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ফার্নিচার শিল্প, কেবল শিল্প, ডাইস ও ব্রাস মেটাল শিল্প, ফাউন্ড্রি ও ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, স্যানিটারি সামগ্রী বিক্রির দোকান। সব মিলিয়ে লাখ দুয়েক পরিবারের আয়-রোজগার নির্ভর করছে জাহাজ ভাঙা শিল্পের ওপর।

১৯৮২ সালের মাঝামাঝি কয়েকজন উদ্যোক্তা অচল, পরিত্যক্ত জাহাজ বিদেশ থেকে কিনে আনেন। তারাই সীতাকুন্ডে সাগর তীরে জাহাজ ভাঙা ব্যবসার গোড়াপত্তন করেন। তারা দেখতে পান কম পুঁজি খাটিয়ে এই ব্যবসা থেকে লাভ হয় অনেক বেশি। এখানে আইনি জটিলতাও তেমন নেই। তখন থেকে সাগর সৈকতের যে অংশ জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়, ভাটার সময় ভেসে ওঠে, এমনস্থানে জাহাজ ভাঙার কাজ শুরু হয়। ১৯৮২ সালে বিদেশ থেকে ব্যাপকহারে পুরোনো জাহাজ সীতাকুন্ডে আনা হয়। তখন শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড ছিল ৬৮টি। লাভজনক ব্যবসা হিসেবে শিপ ব্রেকিং ব্যাপক পরিচিতি পায় ১৯৮৪ সালে। শুরু হয় জাহাজ ভাঙা ব্যবসা। এখন সীতাকুন্ডের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো বিশ্বের বড় বড় জাহাজ ভাঙা এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। সংখ্যার দিক দিয়ে ভারতে অধিক জাহাজ কাটা হলেও আয়তনের দিক দিয়ে পৃথিবীর বড় জাহাজগুলো কাটা হচ্ছে বাংলাদেশে।

এই বিশাল কর্মযজ্ঞ আর জাতীয় অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের অবস্থা খুবই নাজুক। মানবাধিকার, শ্রমাধিকার, ন্যূনতম পারিশ্রমিকের নিশ্চয়তা ইত্যাদি চাপা পড়ে আছে জাহাজ ভাঙার প্রচন্ড শব্দের নিচে। এই শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকরা আসে উওরাঞ্চলের অভাবী এলাকা বগুড়া, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নওগাঁর গ্রামগুলো থেকে। কর্মরত শ্রমিকদের বয়স ১৪ থেকে ৩৭ বছরের মধ্যে।

শ্রমিকদের কাজের ধরন অনুযায়ী কয়েকটি গ্র“পে বিভক্ত। এর মধ্যে রয়েছে ফিটার গ্র“প, কাটার গ্র“প, লোডিং গ্র“প, ওয়্যার গ্র“প ইত্যাদি। এদের পরিচালনার দায়িত্বে থাকে ফোরম্যান। ফোরম্যানসহ পুরো শ্রমিক দলের দন্ড-মুন্ড কর্তা হচ্ছে কন্ট্রাক্টর। এরাই শ্রমিক জোগান দেন। যে যত বেশি শ্রমিক আনতে পারে, সে পায় ওই দলের ফোরম্যানের দায়িত্ব। যার কারণে শ্রমিকরাও অনেক সময় দেশ থেকে লোক আনতে আগ্রহী হন।

যেসব শ্রমিক জাহাজের ভেতরে কাজ করেন, তারা কাজ শুরু করেন সকাল ৭টায়। যারা ইয়ার্ডে কাজ করেন তাদের কাজ শুরু হয় সকাল ৮টা থেকে। একেক গ্র“পের কাজের মজুরী একেক রকম। সাধারণভাবে একজন শ্রমিককে এক দিনের মজুরী বাবদ গড়ে ঘন্টা ৮ থেকে ১০ টাকা দেয়া হয়। প্রতি ১৫দিন পরপর মজুরী দেয়া হয়। তবে ১৫দিন কাজ করলে ১০ দিনের মজুরী পাওয়া যায়, ৫ দিনের মজুরী জমা থাকে। পরিশ্রম সহ্য করতে না পেরে কেউ যাতে পালিয়ে না যায় তার জন্য এই ‘নিরাপত্তা’ ব্যবস্থা। শ্রমিকরা দুপুরে ১ ঘন্টা বিরতি পান। এই সময়ের মধ্যে গোসল আর দুপুরের খাবার সেরে নিতে হয়। এরপর টানা কাজ চলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। তবে প্রত্যেক শ্রমিককে রাত ৮টা পর্যন্ত ওভারটাইম করতে হয়। সপ্তাহে একদিনও ছুটি নেই। শুক্রবার কাজ করতে হয় দিনের অর্ধেক সময় পর্যন্ত। সরকারি ছুটি তাদের জন্য নয়। জাহাজ ভাঙা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। প্রতিদিনই ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটছে। বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটলে প্রথমে স্থানীয় ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। বিফল হলে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অবশ্য শিপ ব্রেকিং এসোসিয়েশন শ্রমিকদের হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ভাটিয়ারীতে জমি নিয়েছে।

এখানে দুর্ঘটনায় শিকার শ্রমিকদের হাজিরার টাকা অর্থাৎ মজুরি দেয়া হয় না। যতদিন চিকিৎসাধীন থাকবে ততদিন ‘বিনা বেতনের ছুটি’। কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গেলে যেনতেনভাবে চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে অবশ্য দাফনের খরচ মিলে। ক্ষতিপূরণ মিলে না।

জাহাজ ভাঙা কর্মকান্ডটি প্রথম থেকেই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠে। উন্নত বিশ্বে যেখানে পরিবেশবান্ধব উপায়ে জাহাজ ভাঙা হচ্ছে, সেখানে এদেশে জাহাজ ভাঙা হচ্ছে সনাতনী বিচিং পদ্ধতিতে। এটি মারাতœক পরিবেশ দূষণকারী হিসেবে চিহ্নিত। তবে বিচিং পদ্ধতিতে জাহাজ ভাঙাতে খরচ হয় অনেক কম। এই পদ্ধতিতে জোয়ারের সময় জাহাজে থাকা দূষিত পদার্থ সহজেই সমুদ্রের পানিতে মিশে যায়। কিছু কিছু ইয়ার্ড মালিক বেশি লাভের লোভে কমদামে কিনে আনে ‘ডার্টি শিপ’ বা বিপজ্জনক জাহাজ। গ্যাস ফ্রি করা ছাড়া এসব জাহাজ কাটার ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা। এসব জাহাজ থেকে নির্গত বর্জ্য, সব ধরনের পেট্রোলিয়াম ও বিষাক্ত তেল বঙ্গোপসাগরের মৎস্য সম্পদের ক্ষতিসহ মারাতœক পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে। দুষেেণর কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে জাহাজ ভাঙা শ্রমিক ও স্থানীয় বাসিন্দারা।

কয়েকটি গবেষণা রিপোর্টে দেখা গেছে, জাহাজে থাকা বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ সিসা, পারদ , ক্রোমাইটস ইত্যাদি বায়ু ও পানি দূষণ করছে। এছাড়া জাহাজে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান এসবেস্টস নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা ৫০ ভাগ বেশি থাকে। এখানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জেলেরা। পানি দূষনে মাছ কমে গেছে। পানির তীব্র গন্ধে মাছেরা তাদের আবাস পরিবর্তন করেছে।

জাহাজ ভাঙার কারণে ধ্বংস হচ্ছে এখানকার জীববৈচিত্র্য। জাহাজগুলো যখন সমুদ্র থেকে বিচে প্রবেশ করে তখন পানির গভীরতা কম থাকায় ওই সময় প্রচুর পরিমান মাটি নিয়ে এসে সাগর পাড়ে জমা করে। আবার ক্রেন দিয়ে কাটা জাহাজের বড় টুকরোগুলো ইয়ার্ডে টেনে আনার সময় তা সাগর থেকে প্রচুর পরিমানে মাটি নিয়ে আসে। এর ফলে উপকুলে প্রচুর পরিমানে পলি জমছে এবং উপকুলভাগ ক্রমেই উঁচু হয়ে যাওয়ায় সাগরের পানি দূরে সরে যাচ্ছে। এভাবে জোয়ার-ভাটা প্রভাবিত অঞ্চল থেকে মাটি সরে আসায় ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।

জাহাজ ভাঙ্গার পরিবেশগত সংকটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শব্দদুষণ ও কম্পন। এ শিল্পের বৈশিষ্ট্য বা ধরনই বলে দেয় এখানে শব্দদুষণ ও কম্পন নিয়মিত ঘটনা। প্রতিনিয়ত লোহার প্লেটগুলো কাটা, লোড-আনলোড এবং জাহাজের কাটা অংশ তীরে টেনে আনার সময় শব্দদুষণ সৃষ্ট করে প্রতিনিয়ত। যা এ এলাকার বাসিন্দারদের জন্য নানা সমস্যার সৃষ্টি করছে। শব্দদুষনে শিশু ও বৃদ্ধরা প্রায়ই আতঙ্কিত হন। ব্যাহত করে স্কুল- কলেজের পাঠদান। শব্দ দুষনের আরেকটি বড় সমস্যা হল পর্দা (লোহার বিশাল আকৃতির পাত) পড়া। কম্পন ও বিষ্ফোরনজনিত কারনে এলাকা কেঁপে উঠে। প্রায়ই শিপ ইয়ার্ডে প্রচন্ড বিষ্ফোরনের শব্দ হয়। এ শব্দে ভূকম্পন সৃষ্টি হয় এবং সৃষ্টি করে আতঙ্ক। ২০০৪ সালে এমন একটি শব্দ ও কম্পনে শীতলপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দেয়ালের একাংশে ফাটল দেখা দেয়।

স্থানীয় সমাজ উন্নয়ন সংগঠন ইপসা এক জরিপ চালিয়ে দেখেছে, এখানে প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নেয়ার জন্য জাহাজ ভাঙার দুষণ বহুলাংশে দায়ী। ইপসার প্রধান নির্বাহী আরিফুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে শিপ ব্রেকিং গুরুত্ব ভূমিকা পালন করছে। তারপরও এটি এখনও পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্টানিক স্বীকৃতি পায়নি। নেই কোনো নীতিমালা। তিনি বলেন, আমরা শিপ ব্রেকিং চাই। কিন্তু তা কোনো অবস্থাতেই শ্রমিকদের অধিকার লংঘন ও পরিবেশ দুষণ করে নয়।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে জানুয়ারি, ২০০৯ দুপুর ১:৫৪

শিবলী বলেছেন: ওখানকার স্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা-ও তো কম
অনেক রিস্ক নিয়ে কাজ করে

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.