![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
০১.
রাত হয় হয়। সরু একটা গলি ইচ্ছামত কোথাও চলে গেছে । দু 'ধারেই চায়ের দোকান । রাজা-উজীর মারা সান্ধ্যকালীন অশ্বারোহীরা জমিয়ে বসেছে । রিকশাচালকেরা ময়দাগলানো ঘনচিনির সিরাপ মিশ্রিত পাউরুটি খাচ্ছে । ওধারে দু'টা ফার্মেসি ...কার কি হয়েছে কে জানে একটি রুগ্ন মহিলা কাঁদছে । ফার্মেসি-কাম ডাক্তারখানার বারান্দায় বিরক্ত কিছু রুগী অপেক্ষারত ।
পরিপূর্ণ জীবন কোলাহলে আরেকটি রাত নগরীতে আসবে । সৌরভ একটি চায়ের দোকানে বসে নির্বিকার চা খাচ্ছে । সে সিগারেট খায়না । তার বন্ধু জালাল কড়া স্মোকার । স্মোকার নন-স্মোকার দের বন্ধুত্ব কোথায় যেন একটু আটকে থাকে । সৌরভ -জালালের বন্ধুত্ব আটকে নেই। নগরীর দিন রজনীর মতই প্রবাহমান।
সৌরভ বিরক্তমুখে আরেক'কাপ চায়ের কথা বলল ।
পাশে বসা লোকটি বলল
"আপনার বাড়ি নোয়াখালী ?"
-"কেন? "
"চায়ের কথা বললে তখন মনে হল।বলে ফেললাম।"
দ্রুত আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেছে । আজব তো ! সেদিন ফার্মগেটে এমন অপরিচিত একজন হঠাত আলাপ জুড়ে দিয়েছিল । সৌরভ হোটেল "স্বর্গপূরী" খুঁজছিল ; আগুন্তকও নাকি ওইদিকে যাবে । বেশ ভাল লেগেছিল লোকটাকে । হোটেলের সামনে এসে তাকে চা খাওয়ালো । লোকটা একটি নতুন "নেট" কোম্পানীর মার্কেটিং এ কাজ করে । কোম্পানীর নাম মনে আসছে না । সৌরভ তাকে বলল যথাসাধ্য সহায়তা করবে ,লোকটিও কিছু কমিশনের কথা বলেছিলো । ফিরে আসার সময় সৌরভ মানিব্যাগ খুঁজে পেলনা । বাংলামোটর থেকে হেঁটে হেঁটে হলে ফিরল। হলে ফিরে লোকটিকে ফোন করল ...
"আমার মানিব্যাগ পাচ্ছিনা । "
-"আমি নিয়েছি। টাকাও তো বেশী নাই।লাভ নাই । ফোন রাখেন। "
"ওখানে আমার কিছু দরকারী কাগজ আছে ।
-"কয়? খালিতো কয়টা প্রেমপত্র । মেয়েদের থেকে দূরে থাকেন ভাই,আখেরে লাভ হবে । গুড লাক।"
পাশে বসা লোকটি কেমন ?একটু আগে করা প্রশ্নের জবাব সৌরভ দেয়নি । লোকটার আচরণ দেখে মনেও হচ্ছেনা সে কোন জবাব প্রত্যাশা করেছিলো; কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে ...
-"ও কি গেছে ?"..."ও কি গেছে?"
এই লোক ফোনে অনেক জোরে জোরে কথা বলে । মানুষজন তাকিয়ে দেখছে ।
কে কোথায় যাবে কে জানে !যে যাবে সে এই লোকের কে ?কার সাথে কথা বলছে এই মানুষটি ?
তার স্ত্রী ?
অপরিচিত কোন মানুষ কার সাথে ফোনালাপ করছে তা বোঝার ভালো ক্ষমতা আছে সৌরভের ;অন্তত জালালের তাই ধারনা। এই নিয়ে জালাল একদিন বলেছিল তাকে ,"কিভাবে বুঝিস ?" সৌরভের খুবই হাসি এসেছিল ,বলেছিল "চিন্তা করলেই বোঝা যায়।"
জালালটা পাগল একটা । তুচ্ছ বিষয় বড় করে দেখে ।
চা শেষ করে সৌরভ বলল "আপনার বউ এর সাথে কথা বলছিলেন ?"
-"জ্বি ।"
ওর দিকে তাকিয়ে লোকটি বলতে থাকে
"এক ছোট ভাইকে চাকরী দিলাম কিছুদিন আগে । মানে ছেলেটা আমার শ্বশুরবাড়ির গ্রামের ছেলে । পৌছেছে নাকী জিজ্ঞেস করছিলাম। "
-"কি চাকরী দিলেন ?"
-"কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হল। বেক্সিমকোতে । "
সৌরভ হাসল । -"তা আপনি কি করেন ?"
-"ভাই করলে ,৮/১০ টা বাড়ি থাকত এই ঢাকা শহরে । নিজের জন্য কিছু করি নাই । এমনিই ছোট একটা চাকরি করি । গার্মেন্টসের ম্যানেজার । কিন্তু সম্পূর্ণ গার্মেন্টস ধরেন আমি একাই চালাই। "
-"তাই নাকি? "
-"আরে বলেন কী !মালিক তো নতুন ,সে কিছু বোঝে !এত কাজের চাপ । মাঝে মাঝে মনে হয় ফোন অফ করে বসে থাকি । ভাল্লাগেনা !"
-"করবেন । মাঝে মাঝে ফোন অফ করে দিবেন। আমিও করি । নাকি প্রব্লেম?"
-"না প্রব্লেম কীসের ?আমার চাকরি খাইলে এর কোম্পানী চলবে? দু'দিন আগে ফোন অফ করে দিছিলাম । অফিসের লোক পাঠাইসে বাসায়।"
-"তারপর? "
-"ডেকে নিয়ে বলে ,বাবু সাহেব আপনি এমন করলে কই যাব বলেন । আপনি বন্ধু মানুষ।"
-"মালিক আপনার বন্ধু নাকি ?"
-"হ্যাঁ একসাথে চা -সিগারেট খাই । হাই লেভেলে অনেক বন্ধু বান্ধব আমার আছে । অনেকের দুটা দশটা উপকার করতে পারি । কিন্তু ভাই মানুষ ভালো না । "
-"তা ঠিক ,মানুষ খারাপ।"
-"খারাপ না ,অকৃতজ্ঞ । এই ধরেন যে ছেলেটার কথা বলছিলাম ,চাকরী পাবার পর তো আর ফোন দিলোনা । আমিই ফোন দিয়ে খবর নিচ্ছি ...পৌছেছে কিনা। এখনই এই অবস্থা আর কিছুদিন পর দেখলেও চিনবে না । "
-"এরকম হয় । যত উপকারই করেন না কেন সব মানুষ মনে রাখবে না। "
-"ঠিক বলেছেন । এই ধরেন এই এলাকার যত বড়লোকের ছেলে সবাই আমাকে বস ডাকে । সেদিন জালালের গাড়ির ব্যাটারী নস্ট হয়ে গেল ,আমি ডাক্তারের গাড়ি নিয়ে গিয়ে,মেকানিক দিয়ে স্টার্ট করায়ে আসলাম। এখন জালালকে ফোন দেই ,বলবে ভাই পরীক্ষা আছে ,পড়ছি । আসবে না।"
জালাল ফোন দিয়েছে । সৌরভ বলল সে কোথায় আছে । জালালের আসতে ২/৩মিনিট লাগবে ।
সৌরভ লোকটির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল ,
"আমি জালালের সাথে পড়ি। আমার নাম সৌরভ ।"
লোকটি নির্বিকার চিত্তে হাত মিলিয়ে বলল "আমি বাবু।"
সৌরভ হাসল । বলল "ভাই আমার বাড়ি নোয়াখালী নয়। লক্ষীপুর । "
বাবু বলল "একই কথা।"
জালাল দোকানে ঢুকেই প্রাণবন্ত গলায় বলল "আরে বাবু ভাই এখানে দেখছি । কি অবস্থা ভাই ?"
-"ভালো অবস্থা । আমি অলটাইম ভালো । হাসিমুখে জানালেন বাবু ।
-"তোমার অসুখের খবর কী ?"
জালালের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তার সামান্য মানসিক সমস্যা আছে । কথায় কথা একদিন এই লোকটিকে বলে ফেলেছিল। নির্বোধের মত বাবু মিয়া সৌরভের সামনে কথাটা বলে দিল। এইজন্যই চাণক্য বলেছেন নিম্নশ্রেনীর মানুষ যতই আপন হোক না কেন এদের মনের কথা বলতে নাই। জালাল একটু আগেই একটি বই এ এটা পড়েছে । তত্ত্ব এবং বাস্তবের অপ্রত্যাশিত সম্মীলন ।
-"আছে মোটামূটি।"
-"ঔষধগুলো লাত্থি দিয়ে ফেলে দাও জালাল। তোমার আসলে কিছুই হয় নাই ,বুঝলা? তোমার অসুখ বিয়ের পরে ঠিক হয়ে যাবে। তবে সব মেয়ে পারবেনা। মেয়ে আমাকেই খুঁজতে হবে । আমি খুঁজতেছি।"
জালাল বিড়বিড় করে বলল "খুঁজতে থাক শালা।"
সৌরভ বলল-" তোর কি হয়েছে রে?"
জালাল কথা না বলে একরাশ ধোয়াঁ ছেড়ে দিলো । বাবুকে বলল "আপনার বন্ধুর চেম্বারে রুগী তো আর আঁটে না । যারে পান বন্ধুর চেম্বারে চালান করে দেন।"
-"তোমরা তো গেলানা একদিনও ।"
-"না ,আপনিই তো বলেন নি এখন আমার দোষ দেন । কমসমে দেখে দিবে ...আপনার বন্ধু... । "
সৌরভ শুনছে ওদের কথা চুপচাপ। জালাল হঠাত তার দিকে ফিরে বলল "কি ডিরেক্টর কই কাপ চা মারলি এতক্ষণে?
বাবু কথা বলেই যাচ্ছেন । ...।।"তোমরা তো আর এইসব ডাক্তার দেখাবা না ,এরাই বড় হাসপাতালে গেলে বেশি টাকা দিয়ে দেখাবা...। "
জালালের একটু বিরক্তি লাগে । একা একা বাবুভাইয়ের কথা শুনে সে মন দিয়ে ,পরামর্শ করে কিন্তু এখন সৌরভের সামনে উনি চাপাটা স্বাভাবিক গতিতে না চালালেও পারেন ।
সৌরভ বলল "ক্লাসে যাস না কেন?"
বাবু কথা শেষ করতে দিলেন না । "জালাল ক্লাস কামাই দিও না । পরীক্ষার সময় তো প্রায়ই দেখি বাইরে ঘোরাঘুরি কর । যাও 'তোমারা পড়। তোমাদের তো পরীক্ষা চলছে।"
আসলে কোন পরীক্ষা চলছে না । জালালের এমনিতেই বলতে ভাল লাগে পরীক্ষা চলছে ,পড়ার ভীষন চাপ। সে খুবই ব্যস্ত। এরকম মিথ্যা সে প্রায়ই বলে।
সৌরভের ঠোঁটে একটু হাসি এসে মিলিয়ে গেল ,বলল "চল ,উঠি । "
বাবুভাই কিছুতেই বিল দিতে দিলেন না। আরো দুটা সিগ্রেট জালালের পকেটে গুঁজে দেন," আরে চাকরি বাকরি করবা তখন খাওয়াবা । দেখব মনে থাকে কি না।"
সৌরভ আর জালাল পাশাপাশি হাঁটছে । সৌরভ বলল
"এই কুতুব কই পাইলি?"
-"কোথাও না । এই এলাকায় আসার পর পরিচয় হয়েছে।"
-"জানিস এই লোকটা একটি কথা শুনেই বুঝে ফেলেছে আমার বাড়ি লক্ষীপুর। "
-"তোর কথা শুনলেই বোঝা যায়। "
-"মোটেও যায় না । আমার কথায় আঞ্চলিক টান নাই। "
-"তুই মুখ হা করলেই বোঝা যায় ,তোর বাড়ি লক্ষীপুর। "
দু'জনে হল্লা করতে করতে গলি ছেড়ে মেইন রোডে উঠল । এখন তাদের তুচ্ছ কথায় হল্লা করার বয়স।
০২
সৌরভ পলাশীর মোড়ে বসে আছে। এখনো শুধুই চা খায় সে, নো সিগারেট। বন্ধুদের সাথে থাকলে খরচ না করেও সিগারেট ফোঁকা যায় ,কিন্তু সৌরভের ভালো লাগেনা। এখন অবশ্য সে শুধু চা খাচ্ছে না ,চায়ের সাথে ময়দা-জল আর ঘনচিনির সিরাপ মিশ্রিত রুটির সাথে চা।
দু'মাস থেকে বাড়ি থেকে টাকা আসছে না । তাদের দুটা সিএনজি আছে। লক্ষীপুর শহরে চলে। একটা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে চারমাস ধরে। টাকার জন্য বাবাকে ফোন দিলে উনি আর ফোন ধরেন না,সৌরভও ফোন করেনা বেশ কিছুদিন ধরে। অর্থাভাবে তার তেমন সমস্যা হচ্ছে না । তার তেমন কোন খরচ নাই। "আমজাদ বাকী বিল্লাহ "নামের এর ব্যক্তি অনেকদিন ধরে সিনেমা বানানোর চেষ্টা করছেন। সে কিছুদিন হল তার সাথে যোগ দিয়েছে । সারাদিন সিনেমা বানানোর তালে কেটে যায়।
অনেকক্ষণ বসে থাকার পর সে হাটতে শুরু করল। অন্যমনস্ক হয়ে হাটছে ,কিছুক্ষন পর সে দেখল গাউসিয়া চলে এসেছে। প্রচন্ডভীড়,গরম,কোলাহল... জনস্রোতে একবার ঢুকলে কোন একদিকে নিয়ে যায়। পূর্বে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে তার,ফার্মগেটে । যেতে চেয়েছিলো বিজ্ঞান কলেজের সামনে চলে গেছে তেজগাও কলেজ;একেবারেই উল্টা দিকে।
ঢাকা কলেজের সামনে এসে দেখল একটি লোক দর্শনীয় ভঙ্গিতে রুমাল বিক্রি করছে। প্রথমবার দেখেই সে চিনতে পারল। এগিয়ে গিয়ে বলল,
"বাবু ভাই রুমাল বিক্রি করছেন কেন?"
বাবু ভাই নির্বিকার গলায় বললেন,
-"এটা আমার এক ছোট ভাইয়ের দোকান। নতুন ছেলে এখনও ভালভাবে বিক্রি করতে শিখেনি। তাকে শিখাচ্ছি।"
-"সে কোথায়?"
"-নামাজ পড়তে গেছে ।"
-"তাহলে আর শিখবে কীভাবে ?পাশে দাঁড় করায়ে রাখতেন। "
এই কথায় তিনি খুব বিরক্ত হলেন। সৌরভের মজাই লাগল তার কথা শুনে,
গম্ভীর গলায় বললেন-" আল্লার কাজে গেছে।"
কিছুক্ষন পর বাবুভাইয়ের ছাত্র ফিরে এলে তিনি সৌরভকে নিয়ে সিটি কলেজের দিকে যেতে শুরু করলেন। সৌরভ আনমনে বলল,
"বাবু ভাই, এই যে রুমাল কাপড় -চোপড় বিক্রি করে কতটাকা আসে ,ধরেন দৈনিক?"
-"ঠিক নাই, ভালমত সেল করলে ১০০০৳ ও আসতে পারে। "
-"আমাকে একটি দোকান করে দিবেন?এই এলাকায় নয় অবশ্য।"
এই কথায় বাবু ভাই আরো বিরক্ত হলেন। জ্বলে উঠলেন একেবারে।
"তুমি শিক্ষিত ছেলে কেন এইসব করবে?টিউশনি কর!"
-"সৌরভ হাসিমুখে বলল দেন একটা টিউশনি।"
হাঁটতে হাঁটতে ওরা স্টার কাবাবের সামনে চলে এসেছে।বাবু ভাই সৌরভকে স্টার কাবাবে ভরপেট বিরিয়ানি খাওয়ালেন। এই রেস্টুরেন্টের নিচে একটি পানওয়ালা দুনিয়ার মশলা নিয়ে পান বিক্রির জন্য বসে। দু'জনে দু'খিলি পান পান নিল। একটা বেনসন ধরালেন বাবু ভাই।
তার চুল ব্যাকব্রাশ করা । গায়ের রঙ কালো । দাঁতে হলুদ দাগ। জুতাটা মলিন। শুধু চোখ দুটা উজ্জ্বল।
দুপুরের সুর্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সৌরভকে বললেন,
"শোন সৌরভ মিয়া । জালালের সাথে বেশি ঘুরাঘুরি করবে না। এইরকম বড়লোকের ছেলেদের থেকে দূরে থাকাই ভাল।"
সৌরভ হঠাত খেয়াল করল লোকটাকে বেশ সুদর্শন মনে হচ্ছে। আত্মবিশ্বাসে ভরা মধ্যবয়সী একজন মানুষ।
০৩
জালাল বেশ উদ্ভট সমস্যায় পড়ে গেছে । সমস্যায় সৌরভের একটা অবদান আছে। গত ভালোবাসা দিবসে মলি সত্য সতি ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিলো। যদিও জালাল বেশ প্রেমিক পুরুষ কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে ঘটনা কখনো এতদূর গড়ায় নি। বেশ নার্ভাসভাবে সৌরভকে বলে দিয়েছিলো সব। শুনে সৌরভ বলল,"ফার্মগেটের স্বর্গপূরীতে নিয়ে যা ।"
-"কীভাবে?"
-"ওটাতে আমার এক পরিচিত লোক আছে । ভালো জায়গা ,পরিবেশ ভালো। "
সত্যিই ভালো পরিবেশ ছিলও ...জালাল তখন বেশ ভাললেগেছিল। মধুযামিনী নয় ঠিক তবে মধুদিবসের অনুভব। এখন বিপন্ন বোধ করছে । মলি বলেছে সে নাকি কনসিভ করেছে অথচ এর কোনই সম্ভাবনা জালাল রাখেনি।
এখন এটা নিয়ে তর্ক করা যায়না। গার্লফ্রেন্ডদের সাথে এসব নিয়ে তর্ক করতে হয়না।
বাদাম চিবাতে চিবাতে বাবু ভাই বললেন, "কী ভাবছ? "
তারা পার্কে এসে বসেছে । সন্ধ্যা হয় হয়। কিছু স্বাস্থ্যবতী মহিলা কষ্ট করে দৌড়াচ্ছেন। দু'জন বৃদ্ধ হাঁটছেন। একজনের হাতে পোষা কুকুরের দড়ি ধরা। তিনি একটু পর পর বলছেন ,
"Cool down.cool down boy "
প্রচন্ড গরম পড়েছে । সুন্দর বাতাসেও কাজ হচ্ছে না। জালাল অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশি ঘামছে ।
-"জালাল সমস্যাটা কী"?
জালাল তার সমস্যা বলল।
-"আমি এই বাবু কত মানুষের সাথে প্রেম করেছি জান ?"
জালাল আরও বিপন্ন বোধ করল। বড় কোন গল্প শুরু হতে যাচ্ছে । অন্য সময় বাবু মিয়ার গল্প শুনতে ভালও লাগে।আজ কিছুই ভালও লাগছে না।
-"তারপর শোন ,সেই মেয়ে ...বিয়ে হয়েছে ,বাচ্চা-কাচ্চাও আছে। এখনও সময় দেয় আমাকে। পারলে মাথার চুল দিয়ে জুতা মুছিয়ে দেয়। মেয়ে জাত আমি ভালো করে চিনি । টেনশনের কিছু নাই। "
-"তা দিক, ভালো তো । "
জালাল সকালেই ফোন করে সৌরভকে জানিয়েছে । সৌরভ ব্যবস্থা করে দিবে বলেছে। এইমুহূর্তে বাবু ভাইকে বিষয়টি বলে সে বোকার মত একটা কাজ করল।
-"জালাল,টেনশন নিওনা । কাউকে বলেছ একথা ?সৌরভকে?"
-"কেন?"
-"এসব কথা কাউকে বলবে না। তোমার গার্লফ্রেন্ডের গ্রামের বাড়ি কোথায়?"
-"বরিশাল।"
বাবুভাই বিরক্ত হয়ে বললেন ,"কই পাও এদের জালাল? লক্ষীপুর।।বরিশাল... এসব এলাকার মানুষ থেকে সাবধান থাকবে।
-"আচ্ছা।"
-"আর এই সৌরভ ছেলেটিকে একেবারে লাই দিবে না। আমি তোমার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।"
-"ঠিক আছে ভাই ,থ্যাঙ্ক ইউ।"
শেষ পর্যন্ত বাবু ভাই ই সত্যি সত্যি ব্যবস্থা করে ফেললেন। তেমন কোন খরচও হলনা, ক্লিনিকের মালিকও নাকি বাবু ভাইয়ের বন্ধু।
০৪
সৌরভ আর্টিকেল বুঝাচ্ছে। কখন a বসবে ,কখন an বসবে, কখন the । তার ছাত্রীর নাম মৌমিতা। আজকে দ্বিতীয় দিন সে পড়াচ্ছে।
জালাল ফোন দিতে শুরু করল কিছুক্ষন পরেই। জালালকে আজ সৌরভ কিছু খাওয়াবে। বাড়ি থেকে টাকা এসেছে । জালাল খেতে ভালবাসে । প্রায়ই বন্ধুদের নিয়ে এখানে সেখানে খায়। সৌরভের কখনও জালালকে খাওয়ানো হয়নি।
জালালের খাওয়াটা ব্যতিক্রমধর্মী। প্রথমে কি খাওয়া হবে তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করবে । ডিরেকশন দিবে কীভাবে রান্না করতে হবে ...অনেকসময় রেস্টুরেন্টের কিচেন রুমে ঢুকে যায় জালাল। দেখে রান্না ঠিকমত হচ্ছে কি না।
পড়ানো শেষ করেছে সৌরভ । জালালকে নিয়ে হাঁটছে। জালাল জিজ্ঞেস করল,
-"টিউশনি পাইলি কবে?"
-"এইতো কিছুদিন আগে । স্টুডেন্টের বাবা ফরেন সেগ্রেটারী । "
আলাপ-চারীতার এই অংশে ছেদ পড়ল ,একটি মটোরবাইকে তিনজন ছেলে দ্রুতগতিতে এইদিকে আসছিলো। চালক অদক্ষ সম্ভবত,রিকশার উপর উঠিয়ে দিল । খালি রিকশা উল্টে গেল একটা চাকাও বাঁকা হয়ে গেল।
মোটরসাইকেলের ছেলে তিনটি নেমে রিকশাওয়ালাকে থাপ্পড় মেরে উত্তেজিত-স্বরে কিছু বলছে ;ওদের কথা শুনে এখন মনে হচ্ছে রিকশাওয়ালাই মনে হয় দায়ী।
ছেলেগুলো চলে যাওয়ার পর কী মনে হতে সৌরভ ফিরে গিয়ে দেখল রিকশাওয়ালার শরীরে জখম হয়েছে ,বেশ ব্লিডিং হচ্ছে। সৌরভ তাকে ডাক্তারখানায় নিতে চাইলে রিকশাওয়ালা রিকসা ছেড়ে যেতে রাজি হলনা। আশেপাশে ভীড় জমে গেছে । জালাল বক্তৃতা দিচ্ছে । সে দ্রুত উত্তেজিত হয়...
"কেউ রিকশার দায়িত্ত্ব নেন। মানুষ মানুষকে বিশ্বাস না করলে কীভাবে হবে?"
শেষপর্যন্ত কমিউনিটি পুলিশরা রিকশার দায়িত্ত্ব নিল। জালাল আর সৌরভ রিকশাচালককে নিয়ে ডাক্তারখানায় ঢুকেছে ,তখন একটু রাত হয়ে গেছে ...
সৌরভ শুধু বলল,
"এটা বাবুভাইয়ের সেই পরিচিত ডাক্তার না রে ..."
সৌরভ একরকম জোর করেই ডাক্তারের রুমে ঢুকল। ডাক্তার সাহেব ক্লান্ত;হয়তোবা একটু আয়েশী ভঙ্গীতে সিগারেট টানছেন, তার পায়ের কাছে টুলে বসে বাবু ভাই ডাক্তারের পদসেবা করছেন,মাঝে মাঝে চুল টেনে দিচ্ছেন।
রিকশাওয়ালাকে ব্যান্ডেজ স্টিচ দিতে হল,ডাক্তার ভদ্রলোকটি চমতকার মানুষ, বেশী টাকা রাখতেই চাইলেন না। জালাল কিছু বলার আগেই সৌরভ শ'খানেক টাকা বের করে ইতস্তত করছিল,বাবুভাই টাকাগুলো নিলেন।
ডাক্তার বেশ প্রশংশা করছিলেন জালালদের ,নিজের কথাও বললেন,
"আমি অনেক গরীব রুগী দেখিই তো ,প্রায় বিনা খরচায়। এই দেশে ...।।
এরপর দেশজাতির গুরুগম্ভীর আলোচনা চলল, জালাল আর ডাক্তার। জালাল রাজনীতির আলোচনা শুরু করলে থামতে চায়না। যুক্তি-পাল্টাযুক্তি চলতে চলতে হঠাত করে ,সমাধানহীন আলোচনার নির্মোঘ পরিসমাপ্তি ঘটলো।
রাত হয়েছে তো বেশ । আর কত?
সৌরভ রিকশাওয়ালাকে খুঁজে পেলনা। একা একাই চলে গিয়ে থাকবে... এইটুকুই কেউ করে নাকী ।
এই দেশে......।
দু'দিন পরে সৌরভ ফোন দিয়ে বলল বাবু ভাইয়ের ফোন বন্ধ । সেদিন সন্ধ্যায় তারা খুঁজে খুঁজে ওনার মেসে উপস্থিত। মেসওয়ালা বিরক্তমুখে তাকায়।
"আপনারা তার কে হন?"
সৌরভ দ্রুত বলল -"কেউ না।"
-"টাকা পান?পাওনাদার?"
সৌরভ বলল "হ্যাঁ" ,"কোথায় পাব ওকে?"
"-আর পাবেন না এই লোককে আর পাওয়া যাবে না।"
সারারাত দুই বন্ধু পাশাপাশি বসে থাকল জালালের রুমে। একটা সিনেমা দেখা হল। অপ্রাসঙ্গিক কিছু আলোচনাও হল,কিছুই জমছে না আজ।
খুব ভোরে নাস্তা না করে বের হয়ে গেল ওরা ,সৌরভ বাসে উঠবে । ভালো লাগছে না তার। ভালো লাগছে না জালালেরও ।
তারা দুজন কেউ কাউকে বলেনি তবু যেন জানে ;মনে মনে সারাজীবন তারা বাবুভাইকে খুঁজবে। তীব্র ব্যাকুল অনুসন্ধান নয় সাধারন পর্যবেক্ষন।
সৌরভ বাসে উঠে পড়েছে । জালাল রিকশা খুঁজছে । ঘুম ভেঙ্গে গেছে নগরীর। ভোর শেষ হয়েছে। সকাল হয় হয়।
©somewhere in net ltd.