![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ফিরে দেখা৩১
৩২
সকালে সুপ্রভার ঘুম ভাঙ্গতে একটু দেরিই হলো। নিয়তি আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। বারান্দায় বসে আছে একা। রবীন্দ্রবাবু বাড়িতে নেই। বোধ হয় পুকুর পাড়ের দিকে গেছেন। সকালের প্রথম কাজই হলো ভাত বসিয়ে দেয়া। আজ একটু দেরি হলো। বাচ্চাগুলো সব কটা এখনও ওঠেনি। উঠলেইতো খাওয়ার চিন্তা। সকালে একসময় দিবাকরকে দেখা গেল ঘাট থেকে ফিরছে। এখন আর তাকে চেনা যায় না। না-কাটা চুল দাড়িতে কী চেহারা হয়েছে ! যদিও এসব নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় বা মন এখন কারোর নেই। রবীন্দ্রবাবু বেশ বেলা করে বাড়ি ফিরলেন। গিয়েছিলেন আমিত্তিপুর। মনসুরকে বলে আসতে যে তাদের যেতে যেতে আরো কটা দিন পর। মনসুরের নৌকাতেই তাদের যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মনসুরকে পাওয়া যায় নি। সে কোথায় বেরিয়ে গেছে। ফেরার পথে সালাউদ্দিনের সঙ্গে দেখা। সালাউদ্দিনও বললো –হ আর কয়ডা দিন দেইখ্যা যাও। যা খবর সবর হুনতাছি তাতে কহন কী অয় বলা মুষ্কিল।
বাড়িতে ফিরে খাওয়া দাওয়ার পর রবীন্দ্রবাবু নিয়তিকে নিয়ে বসলেন। শোনালেন তাদের যাওয়ার পরিকল্পনার কথা । মনে দ্বিধা ছিল, কিন্তু দেখা গেল নিয়তি খুব খুশি মনেই সায় দিল। যে কাজটা করার জন্য নিয়তি আগে তার বাবাকে কতবার বলেছে—এমনকি সাধু জেডা, সালাউদ্দিন চাচা—সবাইকে দিয়ে বাবাকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছে---কিন্তু বাবা রাজি হননি। এখন ক’দিনের ব্যবধানে বাবার মুখেই সেই একই কথা! মনের ভেতরের কাঁটাটা যেন সরে গেল।---তবু বললো—দেরি করুইন্নাযে।
রবীন্দ্রবাবুর মাথায় এখন অন্যচিন্তা। বাড়িতে কাজের লোক কই—কয়দিন পর থেকেত নিয়তি আর তেমন কাজও করতে পারবেনা। বেঁচে থাকলে এই জনশূন্য পুরীতে কীভাবে কী করবে—। সংসার নিয়ে কোনকালে এসব খুঁটিনাটি বিষয়ে ভাবতে রবীন্দ্রবাবুকে দেখা যায় নি। কিন্তু এখন এই আসন্নপ্রসবা মেয়েকে রেখে যেতে তিনি সব চিন্তাই করছেন। এসবের আভাস পেয়ে সুপ্রভা মনে মনে দুঃখের মধ্যেও হাসলেন। কারণ তিনি এসব নিয়ে অনেক আগেই ভেবে রেখেছিলেন এবং সাবিত্রীর মাকে বলেও রেখেছিলেন। যদিও সে বৃদ্ধা তবু অনেক কাজের। এখন একবার তাকে শুধু নতুন ব্যবস্থাটা জানাতে হবে।
পরদিন সকালে একটা খবরই আশেপাশের সমস্ত গ্রামের ঘুম ভাঙালো। গতরাতে মুক্তিযোদ্ধারা মোহনগঞ্জ থানা আক্রমণ করে। কত মারা গেছে, কারা মারা গেছে—এখনও তার কিছু পাকা খবর নাই। তবে মোহনগঞ্জের বাজার বন্ধ। মানুষজন এলাকা ছেড়ে যে যার মত যে দিকে পারছে পালাচ্ছে। এই ঘটনায় মিলিটারিদের দোসররা গা ঢাকা দিয়েছে, কেউ কেউ মারা পড়েছে। মোহনগঞ্জ থেকে বেরিয়ে তাদের দিকে আসার যতটুকু রাস্তা জলের উপর ভেসেছিল তা কয়েক জায়গায় কেটে দেয়া হয়েছে। নষ্ট করে দেয়া হয়েছে নেত্রকোনার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র রাস্তাটাও। খবরাখবরের আশায় মানুষ বেরিয়ে পড়েছে। এদিক ওদিক থেকে গ্রামের সব মানুষ এখন রাস্তায়।
একটু বেলার দিকে সালাউদ্দিন এলো রবীন্দ্রবাবুর বাড়িতে। অনেক মাস পরে তার মুখে সামান্য হাসি দেখা গেল। দুই বন্ধুতে কিছু শলা পরামর্শও হলো। যুদ্ধের ফল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা যাচ্ছে না। গেলে এই সময় চলে যাওয়াই ভাল। পাল্টা আঘাত এত দ্রুত করতে পারবেনা মিলিটারিরা। তাদের এখন নতুন করে আসতে হবে সেই নেত্রকোণা থেকে। সময় লাগবে। গেলে রবীন্দ্রবাবুরা কালকে রাতের দিকেই রওনা হয়ে যাক। এই অঞ্চলের জলপথের দখল এখন মুক্তিবাহিনির হাতেই।
সালাউদ্দিন অনেক খবর রাখে। তার খবর জানার উৎসটা কী, রবীন্দ্রবাবু জানেন না। সালাউদ্দিনও কখনো বলেন না। বলার কথাও নয়। তবে আজ সকালের দিকে আমিত্তিপুর থেকে অনেকেই তাদের অল্পবয়সী ছেলে মেয়ে বউদের আরো ভাটির দিকে আত্মীয়স্বজনের বাড়ির দিকে নৌকা করে পাঠিয়ে দেয়া শুরু করেছে । মনসুর নৌকা নিয়ে সকালে এই কাজেই গেছে। সন্ধ্যে নাগাদ ফিরলে সালাউদ্দিনই তাকে আগামীকালের জন্য খবর দিয়ে দেবে । এই সময় চারদিকেই মুক্তিযোদ্ধারা ছড়িয়ে আছে। এইসময় ডিঙ্গাপোতা হাওর হয়ে তার বন্ধুর পরিবার এই এলাকা পার হয়ে বর্ডারের দিকে চলে যেতে পারবে। ধরমপাশা পার হয়ে যত উত্তরের দিকে যেতে পারবে ততই নিরাপদ থাকতে পারবে। প্রয়োজনে নিয়তিদের জন্য আমিত্তিপুরে সালাউদ্দিনের বাড়িতে রাতে শোয়ার ব্যবস্থা করা হবে। অথবা রবীন্দ্রর অবর্তমানে তাদের বাইরের ঘরে কয়েকজনকে রাতে থাকার ব্যবস্থা করা যাবে। সালাউদ্দিনের বিশ্বাস জলঘেরা এই দিকটায় চট করে কেউ আক্রমনের সাহস করবে না। তার আশ্বাস আর পরিকল্পনার পর রবীন্দ্রবাবুর আর দ্বিমত করার কোন জায়গা নেই।
৩৩
একটানা অনৈতিকতার সঙ্গে দীর্ঘ সহবাসের কিছু খারাপ প্রভাব মিলিটারিদের উপর পড়তে শুরু করেছে। একটানা একটা বিরুদ্ধ প্রাকৃতিক অবস্থানে সময় কাটানোর ফলে সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে আত্মরক্ষার ভাবনাটা অনেক বেশি পরিমানে চেপে বসেছে। মোহনগঞ্জের ঘটনা থেকে এটা বেশ আন্দাজ করা যাচ্ছে। জল-জঙ্গলের ভয়ে ভীত সৈন্যরা ঘাঁটি ছেড়ে বেরোনোর সাহস দেখাতে পারে নি। গুটিকয় শহর এবং তৎসংলগ্ন কিছু গঞ্জ ছাড়া তাদের আস্ফালনের পরিধি খুব বেশি নয়। উপরন্তু নির্জীব শান্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষেরা যতদিন যাচ্ছে ততই একটা মরিয়া প্রতিরোধের কথা ভাবতে শুরু করেছে। মিলিটারিদের প্রথম টার্গেট ছিল হিন্দু জনমানুষ, যা এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দ্বিতীয় টার্গেট ছিল নেতা রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কর্মী। যাদের এখন আর প্রকাশ্যে খুঁজে পাওয়া দায়। তৃতীয় টার্গেট এখন তাদের বানাতে হচ্ছে। সচরাচর যাদের চোখে দেখা যায় না। ইন্ডিয়া থেকে ট্রেনিং প্রাপ্ত অনুপ্রবেশকারী গেরিলা বাহিনি।যাদের নামেই আতঙ্ক। এই সুসংগঠিত তৃতীয় টার্গেটের কাছে যেতে তারা হিমশিম খাচ্ছে। একসময় তাদের ক্ষয় ক্ষতি বলতে কিছুই হতো না। সৈন্যদের জ্যান্তব উল্লাস ছিল দেশ জুড়ে। এখন উল্লাসের বদলে মাঝে মাঝে তাদের জীবনও দিতে হচ্ছে।
তথা কথিত মালাউনের দেশ ইন্ডিয়া তিন দিক থেকে ঘিরে আছে। একই সঙ্গে বর্ডার সামাল দেয়া এবং দেশের মধ্যে কাফের বা শত্রু নিধন নির্বিঘ্নে আর কতদিন চলে। রাজাকার জাতীয় দোসর বাহিনিগুলোকে দিয়ে যতটা পারা যাচ্ছে দেশের ভেতরে নিধন যজ্ঞ চালানো হচ্ছে। কিন্তু তাতে দেশ কতদিন চালানো যায়। বলা হচ্ছে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। কীসের স্বাভাবিক অবস্থা-- বিষয়টা যত দীর্ঘ হচ্ছে তত জটিল হচ্ছে। শত্রুর খোঁজে হন্যে হয়ে একই ধর্মের মানুষের উপর হাত পড়াতে বাজে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। খাঁটি মুসলমান প্রজন্মের স্বপ্ন দানা বাঁধতে পারছে না। মুসলমান ত মুসলমানই হয়-- ব্লাডি বাঙালি কী করে হয় সামরিক কর্তারা বুঝে উঠতে পারছে না। আকাশে বাতাসে গোপন কথার মত উড়ে বেড়ায় জয় বাংলা,বাঙালি,বাংলাদেশ—একটা সেনাবাহিনির পক্ষে যা খুব অস্বস্তিকর। বিগত কয়েকমাসে চিরুনি অভিযানের নামে যা করা হয়েছে তাতেতো এতদিনে আভ্যন্তরীণ যুদ্ধটা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ কী আশ্চর্য!-- ঢাকার মত রাজধানী শহরে এখন গেরিলারা যা খুশি তাই করে বেড়াচ্ছে। কত আর মারা যায়—মাদারচোদ—এদেরত মেরেও শেষ করা যায় না। রক্তবীজের ঝাড় সব!
আর একটা বড় সমস্যা হলো আন্তর্জাতিক মিডিয়া । সব হারামখোর এন্টি পাকিস্তানী হয়ে গেছে। এদেশ থেকে ইন্ডিয়ায় পালিয়ে যাওয়া কোটিখানেক মানুষের কভারেজ দিচ্ছে। ইন্ডিয়া তাদের নানান ক্যাম্পে রাখা এইসব শরণার্থীদের মিডিয়ার সামনে ঠেলে দিচ্ছে। এক মাস দু মাস এসব চলতে পারে, তাই বলে এত দীর্ঘ সময়---উপরওলারা কেন বুঝতে পারছেনা, লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হলে আমাদেরই ক্ষতি! না না উচ্চতর কর্তৃপক্ষের বিষয়টা নিয়ে ভাবা উচিত। গুলি করে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ মারার কাজ আর কতদিন চলবে! যতই রাজাকার শান্তি বাহিনি আলবদর আলসামস তৈরি করিনা কেন এদেশে বিশাল সংখ্যক মানুষ আমদের ঘৃণা করে। ফলে আমরা ঘৃণাবেষ্টিত। এখানকার প্রকৃতিও আমাদের ঘৃণা করে---তাই ঘৃণার জল দিয়ে আমাদের এই ভাটি অঞ্চলে ঘিরে রেখেছে। আমরা কিছু করতে পারছি না। গেরিলারা সেই সুযোগ নিচ্ছে। ওরা জলে জল-চরের মতো চলে। সাপ-খোপ, জোঁক-ফোকের ভয় পায় না।
মোহনগঞ্জে মিলিটারি প্রশাসন পুনর্বহাল করা এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পয়সা দিয়ে পোষা দোসররাও শোনা যাচ্ছে কিছু কছু গদ্দারি করছে। তবু মিলিটারি মিলিটারিই। দুষ্মনের বিরুদ্ধে শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়ার শপথ রয়েছে তাদের। রেলপথ বাদ দিয়ে এখন স্থলপথ পুনরুদ্ধার এখন খুবই গুরুত্বপুর্ণ। সেখানেই এখন সর্ব শক্তি নিয়োগ করতে হচ্ছে। সালাউদ্দিন সে জন্যই বলেছিল, গেলে জলপথে যাওয়ার এটাই ভাল সুযোগ। আগামীকাল রাতে রবীন্দ্র বাবু রওনা হয়ে যাবেন। শ্রীমন্তপুর থেকে চলে যাওয়ার মত এটাই শেষ পরিবার। আগাগোড়া সালাউদ্দিন বিষয়টার সঙ্গে যুক্ত। দেখা শোনা তিনিই করছেন। আজ রাতেই খুব গোপনে একবার লতিফের সঙ্গে তার দেখা হবে। সাক্ষাতের স্থল সরিষার বিল। পৌঁছে দিতে হবে খাবার। প্রায় পনের জনের খাবার। আমিত্তিপুরে সেই খাবার তৈরি হবে। তবে তিন জনের বেশি মানুষ ছাড়া কেউ জানবে না সে সব।
এই অঞ্চলে রবীন্দ্র একজন পরিচিত হিন্দু। এখনও সে ধুতি পরে। গলায় তুলসীর মালা থাকে। খালি গা’য় থাকলে একটা পৈতাও দেখা যায়। সরকারী প্রচারে হিন্দু তথা মালাউনদের জন্যই দেশটার এই অবস্থা শুনে শুনে অনেক শান্তি প্রিয় সাধারণ মুসলমানের মনও এখন খুব তিক্ত। যাওয়ার পথে তেমন কারো চোখে পড়লে রবীন্দ্র’র বিপদ হতে পারে ভেবে সালাউদ্দিন বন্ধুকে তার বেশবাস পরিবর্তন করার জন্য বলেছেন। দীর্ঘকাল চাপে থাকতে থাকতে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান নষ্ট হওয়া বিচিত্র নয়। রবীন্দ্র তাতে রাজি হওয়াতে সালাউদ্দিন খুশি। সালাউদ্দিনের কথা, বর্ডারের ওপারে গিয়ে যত খুশি তুমি ধুতি পর, তুলসীর মালা পর---। নিজের বাড়ির থেকে একটা বোরখাও এনে দিয়েছে সে ভাবীর জন্য।
(চলবে)
©somewhere in net ltd.