নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সহজ চিন্তা , জটিল সমীকরণ

ফরহাদ ৪৬

আমি মেজবাউল খাঁন ফরহাদ । পেশায় একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী । বিষয় সাইকিয়াট্রি ।ভাল লাগে ভাবতে আর বিশ্লেষণ করতে ।

ফরহাদ ৪৬ › বিস্তারিত পোস্টঃ

"শেখসাব ও আমার পূর্ব পুরুষেরা"

১৬ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ২:৫০



শেখসাব কে নিয়ে প্রথম লেখায় বলেছি, আমাদের গ্রামের বয়স্করা বঙ্গবন্ধুকে "শেখসাব" নামে ডাকতেন। আমাদের বাড়ি থেকে পূর্বদিকে উত্তাল পদ্মা, পশ্চিমে তার প্রধান শাখা আড়িয়াঁল খাঁ নদী এবং এই দুই নদী থেকে অসংখ্য ছোট ছোট নদী ও খাল পুরো শিবচর থানা জুড়েই রয়েছে। এটা মূলত চড়াঞ্চল এবং ভৌগলিক কারনেই এখানকার প্রধান পেশা হচ্ছে কৃষি। আমার বাপ-চাচারা, মামা নানারা সবাই মূলত কৃষক। এদের বেশিরভাগেরই বলার মত তেমন শিক্ষাদীক্ষা নেই। তথাকথিত দেশপ্রেমও হয়ত তাদের ছিলোনা, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক জ্ঞান খুবই প্রখর ছিলো, তারা ভাল মন্দের পার্থক্য খুব সহজভাবে করতে পারতেন, দেশের জন্য, দশের জন্য কোনটা মঙ্গল আর কোনটা অমঙ্গল তা সহজেই বুঝতে পারতেন।

শেখ মুজিবের আগমের আগে তারা মূলত তাদের জমি জিরাত নিয়েই থাকতেন, কখন সখনো মাছ ধরতেন , কাজের ফাঁকে ধর্মীয় কাজ করতেন আবার গান বাজনাও করতেন। রাজনীতি তখন ছিল মূলত খান সাহেব আর উঁচু শ্রেণীর মুসলীম লীগের । তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ , কাজ কর্ম ছিলো জমিদার স্বরূপ । তাদের সাথে কৃষক শ্রেণীর ছিলো বিস্তর ফারাক । রাজনীতিকে মনে হতো দূর্বোধ্য আর উঁচু তলার জমিদারী । কিন্তু আস্তে আস্তে তারা শেখ মুজিবের নাম শুনতে থাকেন । সবাই যে তাকে দেখেছে এমন না , তবে যারা তাকে দেখেছে , তাদের থেকে তারা শেখ মুজিবের গল্প শুনেন । কিভাবে তিনি কথা বলেন, কোন ভাষায় বলেন, কর্মীদের কি উপদেশ দেন , দেশ নিয়ে তার ভাবনা কি, ইত্যাদি তারা শুনেন । তাদের থেকে শুনে তাদের ছেলেমেয়ে আর বউঝিরা । এই শুনে শুনেই কখন যে তাদের মনে মুজিবের জন্য আলাদা এক স্থান তৈরি হয়, তা তারা নিজেরাও হয়ত বলতে পারেন না । তবে, তারা বুঝতে পারেন, বিশাল আকৃতির শেখ মুজিবই তাদের নেতা, তার ভাষাই তাদের ভাষা , তার চাওয়া হয়ত তাদেরই চাওয়া ।

তারা আরো শুনতে পায়, শেখ মুজিবকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে, কখনো গোপালগঞ্জ, কখনো মাদারীপুর, আবার কখনো খুলনা । এত জেল জুলুম করে, এত অত্যাচার করেও যখন মুজিবকে দাবানো যায় না । আস্তে আস্তে শেখ মুজিবের নাম সারা দেশে ছড়িয়ে পরে, সারা দেশেই তার নেতৃত্বে রাজনৈতিক সংগঠন পরিচালিত হয়, ছাত্র জনতা তাকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে, এই সব খবরই তারা পায় । তখন তারা শেখ মুজিবকে নিয়ে গর্ব করে , নিজের দেশের ছেলে হওয়ায় তার বিশাল বুকের পাটায় যেন তাদেরও বুকটাও ফুলে উঠে । এর পর, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করা হলে, তারা আতংকিত বোধ করে, কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারে, শেখ মুজিবকে কেউ আটকিয়ে রাখতে পারবে না । অবশেষে, ছাত্র জনতার বিক্ষোপের মুখে শেখ মুজিব মুক্তি পেলে তারা স্বস্তি পান ।

এরপর আসলো, ৭০ এর নির্বাচন । আগে কখনো নির্বাচন নিয়ে এতটা উত্তেজিত বোধ করে নি তারা, মনে হচ্ছিলো যেন , শেখ মুজিব তাদের সবার সন্তান । তাইতো আগে কখনো নারী আর বৃদ্ধরা এতোটা ভোট দিতে না গেলেও, এবার বাদ গেলনা কেউ । বৃদ্ধদের কোলে করে নেয়া হলো, আর অসুস্থরা গেলেন অসুস্থ শরীর নিয়েই । ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো , হাতে গোনা কয়েকটি ভোট ছাড়া সবই নৌকায় ভোট । শেখ মুজিব একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করেন । খাঁন সাহেবদের টক্কর দিয়ে , মুজিবের এই জয়েই শেখ মুজিব তাদের মাঝে মূলত "শেখসাব" হয়ে উঠেন । যদিও তারা ঠিক মনে করতে পারেন না , ঠিক কখন থেকে , শেখ মুজিব "শেখসাব" হয়ে গেছেন । শেখসাবের হাতে যাবে পাকিস্থানের ক্ষমতা, উত্তেজনায় যেন, আমার বাব চাচাদের ঘুমই আসতে চায় না । আগে কখনো এতোটা আড্ডা না দিলেও এখন তারা দেয়, আর বুক ফুলিয়ে , উচ্চ স্বরে শেখসাবের মহিমা বর্ননা করে । গ্রামে গ্রামে , বাড়িতে বাড়িতে গানের আসর বসে । গামলা , হাড়ি, বাসন কাসন ইত্যাদি দিয়েই তারা গান গেয়ে , গভীর রাতে সিন্নি খায় ।

কিন্তু তাদের এই আনন্দ বেশিদিন থাকে না । তারা শুনতে পায়, শেখসাব জেতার পরও , খাঁন সাহেবরা ক্ষমতা ছাড়ছে না । আস্তে আস্তে পরিস্থিতি ঘোলাটে হলে, তারা আবারো উত্তেজিত বোধ করে । তারা রেডিওর মাধ্যমে আর গুটি কয়েক ঢাকা ফেরত মানুষের থেকে খবরা খবর নিতে থাকে । তারা বুঝতে পারে , শেখসাব ছাড়বার পাত্র না , লড়াই করে হলেও তিনি ক্ষমতা নিবেন । এরপর, ৭ই মার্চের ভাষণের দিন , অনেকেই রেডিও নিয়ে অপেক্ষা করেন, শেখসাব কী ঘোষণা দেন , তা শোনার জন্য । যারা সরাসরি শুনতে পারেন না , তারা জমির কাজ শেষে অন্যদের থেকে শুনে নেন এবং নিজেরা তর্ক বিতর্ক করে এটা বুঝতে পারেন , যুদ্ধ হবেই । এবং এখন ক্ষমতা নয়, শেখসাব পুরো স্বাধীনতাই ছিনিয়ে আনবেন ।

তারা শুনতে পায় , ঢাকায় অনেক গেঞ্জাম হয়েছে, অনেককেই গুলি করে মারা হয়েছে, লোকজন ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ছুটছে । তারা বুঝতে পারে , যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে । শেখসাবকে নিয়ে প্রথমে আতংকিত থাকলেও, পরে তার স্বাধীনতার ঘোষণায় তারা আস্বস্থ হয় । আমাদের এলাকার রাজাকাররা বেশিরভাগ ছিলো পীরের বংশ ধরেরা । তারা অন্য রাজাকারদের থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলো । এরা কোন মিলিটারি বাহিনীকে গ্রামে তাণ্ডব চালাতে দেয় নি , তবে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ছাড় ছিলো না । তারা হয় পালিয়েছেন, নতুবা রাজাকারদের হাতে ধরা খাইছেন । শুনেছি, আমার বাবাকে খুঁজতে প্রায় রাতেই রাজাকাররা বাড়িতে উঁকিঝুঁকি মারতো । যদিও তিনি প্রথমেই আমার মা আর আমার বড় তিন ভাই বোন কে রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে , গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সয়ায়তা করেন , আর এর ওর থেকে পরিবারের খবর নেন । আমার চাচাত ভাই আবুল বাশার, ভাগ্নে সিদ্দিক দুজনকেই বাবা ট্রেনিং নেয়ার জন্য গোপনে ভারতে পাঠান । এরকম, অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন । তবে যারা যুদ্ধে যায় নি , তারা স্বাভাবিক ক্ষেত খামারি করলেও , গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতো। রাতের বেলা , গোল হয়ে বসে রেডিও শুনে যুদ্ধের গতি প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করতো ।

অবশেষে দেশ স্বাধীন হয় । দেশের সচেতন নাগরিকরা দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখলেও, আমার বাপ চাচাদের মনে ঠিক সেরকম কিছু ছিলো না । তাদের শেখসাব দেশ স্বাধীন করছে, তিনি দেশ চালাবেন , এতেই তাদের প্রশান্তি । তারা তাদের স্বাভাবিক ক্ষেত খামারিতেই আবার মনোযোগ দেয় । আর আমার বাবার মত কেউ কেউ গ্রাম্য রাজনীতিতে যুক্ত থাকেন । আর তাদের রাজনীতির আদর্শ হল, তাদের প্রিয় শেখসাব । তারা গ্রামের মদবরি করতেন ঠিকই, কিন্তু কারো ক্ষতি করতেন না , বিচার সালিসে কখনো অন্যায়কে প্রশয় দিতেন না , সারাক্ষণ অন্যের জন্য দৌড়ে বেড়াতেন , প্রয়োজনে নিজের জায়গা জমি বিক্রি করে অন্যকে সাহায্য করতেন । শুনেছি আমার বাবার অনেক সম্পপ্তি এভাবে শেষ করছেন , এবং তার বেশিরভাগই অন্যের জন্য করতে গিয়ে ।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ নতুন করে গড়ার জন্য , শেখসাবের ডাকে আমার বাবার মত অনেকে সারা দিলেও সারাদেশ ব্যাপী অনেকেই আবার লুটতারাজ শুরু করে । সুবিধাবাদীদের বেপরোয়া কর্মকান্ডে দেশের অবস্থা নাজুক হলেও, বিশ্বাস রেখেছিলেন শেখসাবের প্রকৃত অনুসারীরা । কিন্তু আচমকাই তারা শুনতে পেলেন , তাদের শেখসাব আর নেই । পুরো পরিবারসহ তাকে মেরে ফেলা হয়েছে । এ খবরে তারা যেন , দিশেহারা হয়ে গেলেন , তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না , এই কষ্ট তারা কিভাবে সহ্য করবেন । তাদের নিজেদের সন্তান মারা গেলেও এতটা কষ্ট পেতেন কিনা, কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করেন । শেখসাবের মত এরকম নেতা আর এই বাঙ্গলায় যে আসবেনা , তা তারা ঠিকই বুঝে যান । তাইতো , একযুগ পর তার মেয়ে শেখ হাসিনার দেশে আসার খবরে তারা, আবারো আবেগ আপ্লুত হয়ে পরেন । শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানার জন্য তাদের মায়া হয়, কিন্তু শেখ সাবের অভাব কি আর মেয়ে দিয়ে হবে ? এই প্রশ্ন মনের মধ্যে থাকলেও , তারা শুনতে পান , শেখ হাসিনা দল গুছিয়ে আবারো নির্বাচনে যাচ্ছেন । তখন তারা সেখ হাসিনাকে "শেখের বেটি" বলা শুরু করলেন । নির্বাচনে কে দাড়াইলো এটা বিবেচ্য বিষয় নয় , শেখসাবের জন্যই শেখের বেটিকে নৌকায় ভোট দিতে আবারো দল বেঁধে যায় । আর এভাবেই তারা শেখসাবের ভালবাসার প্রতিদান , সারা জীবন দিয়ে যেতে চায় ।

আমার বঙ্গবন্ধু, আমার জাতির পিতা, আমার হৃদয়ের গহিনে "শেখসাব" হিসেবেই বহমান এবং তা পারিবারিকভাবেই প্রাপ্ত ।

- এম.কে ফরহাদ

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.