![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হেফাজতের আবির্ভাব এবং তাদের ১৩ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে নিজ নিজ রুচি ও হিংসার মাত্রা অনুযায়ী রাজনীতির বিভিন্ন পক্ষ বিভিন্ন ভাষায় প্রতিপক্ষকে আক্রমণ এবং নিজ নিজ শ্রেণির পক্ষে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এর দ্বারা সমাজে শ্রেণি ও শক্তির চরিত্র আমরা কিছুটা শনাক্ত করতে পারছি। এর মধ্য দিয়ে সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক স্তর সম্পর্কেও ধারণা করা যায়। আসলে বাংলাদেশে কী ঘটছে তা বুঝবার জন্য সঠিক তথ্যের চেয়ে প্রচার ও প্রপাগান্ডার দিকে অতি মাত্রায় ঝোঁক এবং বিশ্লেষণের চেয়েও নিজের বদ্ধমূল অনুমান ও মতের গোঁড়ামি নির্বিচারে উগরে দেবার মানসিকতাই প্রকট হয়ে আছে।
যথেষ্ট না হলেও বিভিন্ন শ্রেণিগুলোকে চেনার জন্য তাদের দাবিদাওয়াগুলো হলো প্রাথমিক উপাদান। দাবিদাওয়া কেন্দ্র করে তারা পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি সমাজে তাদের মতাদর্শিক লড়াই চালায়। হেফাজতের ১৩ দফাকে কেন্দ্র করে সমাজে পক্ষে-বিপক্ষে যে তর্ক তৈরি হয়েছে তার গুরুত্ব অনেক, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। তা ছাড়া হেফাজতে ইসলামই শুধু ইসলাম নিয়ে কথা বলছে তা নয়। বাংলাদেশে ধর্ম, রাজনীতি, সংস্কৃতি, দর্শন ইত্যাদি নানান বিষয়ে ইসলামচর্চার শক্তিশালী ধারা রয়েছে। বিভিন্ন ইসলামপন্থি প্রবণতা ও ধারা এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সংঘাতও রয়েছে। যদিও বাংলাদেশে এই সকল বিষয়ে গবেষণা কিম্বা পর্যালোচনা নাই বললেই চলে। হেফাজতে ইসলামের শক্তিশালী আবির্ভাবের পর তাদের বিরোধী আরো কয়েকটি দলকেও আমরা মাঠে নামতে দেখছি। এই প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। যদিও বাংলাদেশের জনগণের ধর্মানুভূতিকে আহত করার কারণে তারাও তাদের ভাষায় ‘নাস্তিক মুরতাদ ব্লগারদের’ শাস্তি দাবি করছে। তবে একই সঙ্গে তারা হেফাজতে ইসলামের বিরোধিতা করছে। ফলে তাদের অবস্থান সরকার পক্ষে বলে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হচ্ছে। সে কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রমতাকে কেন্দ্র করে যে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত চলছে তার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দাবি বিশেষ কোন রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে না। তাদের দাবিদাওয়ার বিশেষ কোন প্রতিবাদ ও সমালোচনাও দেখা যাচ্ছে না, যেমন দেখা যাচ্ছে হেফাজতে ইসলামের ক্ষেত্রে। এখানে শুধু শিক্ষণীয় দিকটি হোল- ইসলামপন্থি সামাজিক সংগঠন বা রাজনৈতিক দলগুলোকে একাট্টা একই রকম ভাববার কোন কারণ নাই। তাদের মধ্যে মতাদর্শিক বিরোধ যেমন আছে, তেমনি স্বার্থের সংঘাতও রয়েছে। ফলে শুধু তাদের দাবিদাওয়া দেখে শ্রেণি ও শক্তির লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তাদের চরিত্র বুঝতে যাওয়া ভুল হবে।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ধর্মীয় সংগঠন। ঐতিহাসিক ভাবে তাদের সঙ্গে উত্তর ভারতের দেওবন্দের বিখ্যাত দার-উল-উলাম মাদ্রাসার সম্পর্ক আছে। সাধারণ ভাবে ইসলাম ও বিশেষভাবে শিক্ষার প্রতি কওমি মাদ্রাসার সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সে কারণে এই ধারার নৈতিক বল বা তাঁদের ভাষায় ‘ঈমান-আকিদার’ শক্তির তাৎপর্য ইসলাম ধর্মের অন্যান্য ধারা থেকে ভিন্ন। একই কারণে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো থেকে তাদের আলাদা করে বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে।
এই ধারার নৈতিক বল বা তাঁদের ভাষায় ‘ঈমান-আকিদার’ শক্তির বিশেষ দার্শনিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যও রয়েছে। একে নিছকই ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে ভুল হবে। এ বিষয়ে এখানে বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ হবে না। তবে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিচালিত কওমি মাদ্রাসার তালিম পদ্ধতির ওপর সম্প্রতি তরুণ গবেষক নূরুল মোমেন ভুঁইয়ার একট পিএইচডি অভিসন্দর্ভ আমার হাতে এসেছে। সামাজিক নৃতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে সরেজমিনে একটি কওমি মাদ্রাসায় থেকে তিনি বুঝতে চেয়েছেন এই মাদ্রাসাগুলো ‘সাচ্চা মুসলমান’ তৈরির যে তালিম দিয়ে থাকে সেই তালিমের অনুমানগুলো কী এবং কিভাবে সম্পর্কে কওমি আলেম-ওলামাদের ধারণা মাদ্রাসার কাজের পদ্ধতি ও দৈনন্দিন চর্চার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হয়।
ধর্ম সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপার নয়। এই গবেষণাটির গুরুত্ব হচ্ছে ইসলামের সঙ্গে স্থানিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক জনসাধারণের ওপর কী ধরণের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করে তার সমাজতাত্ত্বিক বিচার। ইসলামের সুনির্দিষ্ট সামাজিক রূপ পরিগ্রহণ খুবই স্বাভাবিক। ধর্ম পরকালের কথা বলে বটে, তবে একান্তই এটা একটা ইহলৌকিক ব্যাপার। গবেষক সেই সব ইহলৌকিক উপাদানগুলোকেও গভীর পর্যবেক্ষণের অধীনে এনেছেন যার ফলে বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে কওমি মাদ্রাসার গুরুত্বকে নিছকই ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়, বরং আরো বড় পরিসরে সামাজিক-নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বোঝা ও বিশ্লেষণের একটি ঈর্ষণীয় দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন। যত দূর জানি বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা নিয়ে এথনোগ্রাফিক গবেষণার এটাই একমাত্র নজির। এই ধরণের কাজ যত বেশি আমরা করব, ততই ধর্ম সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা কাটবে। আতঙ্কও দূর হবে।
নূরুল মোমেন ভুঁইয়ার গবেষণাপত্রটির একটি সিদ্ধান্ত হচ্ছে “কওমি মাদ্রাসায় একজন মুসলমানের ধর্মীয় চিন্তাজগৎ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে গোঁড়ামির তুলনায় ইসলামি নৈতিকতার বিষয়টিই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে…কওমি মাদ্রাসা-ব্যবস্থা ইসলামের মৌলিক বিষয় এবং ধর্মীয় গ্রন্থ বর্ণিত অনুশাসনের প্রতি দৃঢ় আস্থাশীল বলে বাংলাদেশে এই ব্যবস্থাকে একটি ‘মৌলবাদী’ ব্যবস্থা হিশাবে চিহ্নিত করবার প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু গবেষক বলছেন, ‘এমন পরিপ্রেক্ষিতে আমার গবেষণায় দেখা গেছে, বাস্তবে এই ব্যবস্থা লোকায়ত অনেক আকাঙ্খাকে ধারণ করেছে, সময়-বাস্তবতায় এর অবস্থানগত পরিবর্তনও হয়েছে অনেক’।
শিক্ষা মানুষের জন্য। মানুষ সম্পর্কে প্রাথমিক কোন অনুমান ছাড়া কোন ব্যবস্থা গড়ে তোলা অসম্ভব। কওমি মাদ্রাসার অনুমান হচ্ছে মানুষ জীবজন্তু নয়। অতএব জীবের বৃত্তিসম্পন্ন ভোগী মানুষ তৈরি শিক্ষার লক্ষ্য হতে পারে না। ইসলাম যেহেতু মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’বা সৃষ্টির সেরা জীব গণ্য করে এবং মানুষ আল্লাহর খলিফা হিশাবেই ইহলৌকিক জগতে হাজির, অতএব প্রতিটি মানুষের এমন কিছু আধ্যাত্মিক বা দিব্যগুণ রয়েছে যার বিকাশ ঘটানোই শিক্ষার কাজ। এটা অনস্বীকার্য যে সমাজে বৃত্তিমূলক দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজন আছে, যাকে আমরা সাধারণ ভাবে বলি- সমাজে কিছু একটা করে খাবার । কওমি মাদ্রাসা সামাজিক মানুষের এই চাহিদাকে মোটেও অস্বীকার করে না, কিন্তু মাদ্রাসার দায়িত্ব নয় কলকারখানা অফিস আদালতের জন্য শিক্ষার নামে শ্রমিক সরবরাহ করবার কারখানা চালানো। অথচ আধুনিক বা পুঁজিবাদী শিক্ষার এটাই প্রধান উদ্দেশ্য। ইসলামি তালিমের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাচ্চা মানুষ তৈরি করা যার মধ্যে সর্বোচ্চ নৈতিক গুণাবলির সন্নিবেশ ঘটবে। এই নৈতিকতার আদর্শ হচ্ছে নবীজীর অনুসৃত সুন্নাহ। এই দিক থেকে মাদ্রাসা কে আধুনিকীকরণ কথাটার কোন অর্থ হয় না। কারণ আধুনিক শিক্ষার ধারণা ও উদ্দেশ্য আর সম্পর্কে কওমি মাদ্রাসার ধারণা ও উদ্দেশ্যের মধ্যে ফারাক আকাশ আর পাতালের মতো। আধুনিক মানুষকে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার গোলামে পরিণত করে। শুধু শ্রমিক তৈরি হবার দিক থেকে নয়, মানুষকে নীতিনৈতিকতাবর্জিত ভোগী হিশাবে তৈরি না করলে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না। নীতিনৈতিকতার চর্চা ও র্থীর মধ্যে তার বিকাশের প্রতি সবিশেষ মনোযোগ না দিলে কওমি মাদ্রাসা র বৈশিষ্ট্য কিছুই বোঝা যাবে না। কেন মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে ‘আনুগত্য’,‘আদব’ ও অন্যান্য সামাজিক-পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যবহারিক গুরুত্ব, তার মর্মও বোঝা যাবে না।
এই হলো কওমি মাদ্রাসার ‘’ ধারণার মৌলিক ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য। কিছু করে খাবার জন্য শিক্ষার দরকার আছে। ঠিক। কিন্তু বর্তমানে এটাকেই শিক্ষার একমাত্র আদর্শ হিশাবে পর্যবসিত করবার চেষ্টা আছে। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের ব্যবস্থার যা প্রধান বৈশিষ্ট্য। শিক্ষার অর্থ ‘কিছু করে খাবার জন্য ’ কওমি মাদ্রাসা তা মানতে অস্বীকার করে এবং তাকে ও চ্যালেঞ্জ করেই এই কওমি মাদ্রাসা টিকে থাকে। কেননা মানুষ জীবমাত্র নয়। মানুষের এমন কিছু আধ্যাত্মিক বা দিব্যগুণ রয়েছে যার বিকাশ ঘটানোই শিক্ষার কাজ।
তবে যেহেতু ধর্মতত্ত্বের পরিসরের মধ্যেই এই শিক্ষার সংজ্ঞা ও সীমা, সে কারণে শিক্ষামাত্রই মানুষের দিব্য সম্ভাবনার চর্চা ও তার বিকাশ- কওমি মাদ্রাসা এই প্রস্তাবটির মর্ম সার্বজনীন প্রস্তাব হিশাবে নয়, হাজির হয় একটি ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রস্তাব হিশাবে। সে জন্য বলা হয়েছে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘সাচ্চা মুসলমান’ তৈরি করা। কওমি মাদ্রাসার গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাতত্ত্ব তখন সার্বজনীন না হয়ে মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সীমিত থেকে যায়। এখন কাজ হচ্ছে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার এই ধারণাকে ধর্মতত্ত্বের খোলস ভেঙে আমাদের বের করে আনতে হবে এবং সার্বজনীন প্রস্তাব আকারে সমাজে হাজির করতে হবে। যাতে পুঁজিতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থার বিপরীতে নতুন শিক্ষার ধারণা আমরা গড়ে তুলতে পারি।
ধর্মীয় সংগঠন হিশাবে হেফাজতে ইসলামের এই সীমাবদ্ধতা থাকা খুবই স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে উচিত হচ্ছে শুধু একটি ইসলামি মতাদর্শ হিশাবে হেফাজতে ইসলামকে বিচার না করে ধর্মীয় সংগঠন ও ধর্মীয় মতাদর্শ কিভাবে দেশকালপাত্র ভেদে সুনির্দিষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো তোলে, সেই দিকগুলো ধরতে পারার চেষ্টা করা। ধর্মের পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়িয়ে সমাজকে আদর্শগতভাবে এমন কোন বিভক্তির দিকে ঠেলে না দেওয়া যা থেকে কোন প্রকার শিক্ষা গ্রহণ বা অভিজ্ঞতা অর্জন কঠিন হয়ে পড়ে। কোন চিন্তা বা আদর্শ তা ধর্মীয় মোড়কে হাজির হোক বা না হোক তার সম্ভাবনা ও সীমা সম্পর্কে ধারণা সমাজে স্পষ্ট করে তোলাই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কাজ। এর পাশাপাশি দরকার কওমি মাদ্রাসা স্থাপনের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস, তার সঙ্গে সারা দেশে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে বাংলাদেশের মসজিদের সঙ্গে কওমি মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসা থেকে উত্তীর্ণ আলেম-ওলামাদের সম্পর্ক এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক সম্পর্কের ধরণ সুনির্দিষ্ট ভাবে পর্যালোচনা করা।
সাম্প্রতিক কালে কওমি মাদ্রাসার গুরুত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে দারুল উলুম মইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) চেয়ারম্যান আল্লামা আহমদ শফীর সুনাম এবং মান্যতা। তাঁকে ঘিরে অতি সহজেই বাংলাদেশের আলেম-ওলেমারা অতি অল্প সময়ের মধ্যে একটি ব্যাপক ও শক্তিশালী ধর্মীয় সংগঠন হিশাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছেন। তার মানে সমাজে যে শ্রেণিগুলোর একাধিপত্য আমরা দেখে আসছি, সেখানে বেশ ক্ষয় ঘটেছে এবং অন্যান্য নিপীড়িত শ্রেণি তাদের আকুতি ও আকাঙ্খা সরবে হাজির করতে আগের চেয়েও এখন আরো অনেক বেশি সক্ষম। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেই ধর্মীয় সংগঠনটি এখন সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিশাবে হাজির হয়েছে। সাধারণ মানুষের প্রতি ঘৃণা এবং ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও আতঙ্কের কারণে শহুরে সেকুলার মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণি যত সহজে এখন এই শক্তিকে উপেক্ষা করতে চাইছে, বাস্তবতা অত সহজ বা সরল নয়। মাওলানা-মাশায়েখদের প্রতি তাদের বদ্ধমূল শ্রেণিঘৃণা উগরে দিয়েই তারা ভাবছে এই শক্তিকে মোকাবিলা করা যাবে। আসলে তা হবে না। উচিত বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তব অনুধাবন ও সঠিক বিশ্লেষণ।
দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা নিয়ে বিশেষ গবেষণা হয়নি। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গরিব এলাকাগুলোতে কেন এই মাদ্রাসা গড়ে ওঠে এবং বাংলাদেশ গরিব মজলুম মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ধরণটা আসলে কী সে বিষয়ে অর্থনৈতিক বা সামাজিক গবেষণা না-ই বললেই চলে। কওমি মাদ্রাসাকে ‘আধুনিক’করবার তাগিদই বেশি, যাতে শিক্ষা সম্পর্কে তার বৈপ্লবিক দিক আড়াল করে বিদ্যমান ব্যবস্থার অধীনে এই শিক্ষাকেন্দ্রগুলোকে অধীনস্থ করা সম্ভব হয়। সেপ্টেম্বর এগারোয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে হামলার পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে অনন্তযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে সেই সময়ের মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কন্ডোলিসা রাইস পাকিস্তানের কওমি মাদ্রাসাগুলোকে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের টার্গেট বানিয়েছিলেন। কওমি মাদ্রাসার বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্বেগ ও ঘৃণার প্রধান উৎস এখানেই নিহিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন যুদ্ধনীতি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ইকোনমিক টাইমস [১] তাদের অনলাইন একটি লেখায় বলছে, মার্কিনিরা সামরিক ঘাঁটি থেকে যুদ্ধ পরিচালনাকে এখন সম্প্রসারিত করেছে কওমি মাদ্রাসার ওপর। তাদের বিশেষ ল্ক্ষ্য কওমি মাদ্রাসার কারিকুলাম বা পাঠ্যসূচি। মাদ্রাসায় যা পড়ানো হয় তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বদলে দিতে চায়।
বাংলাদেশের আলেমওলেমারা কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার চান না তা নয়। চান। প্রয়োজনে নানান সময়ে সংস্কার হয়েছে। সেটা হয়েছে ইসলামি তালিম সম্পর্কে তাদের ধারণা ও আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রেখে। কিন্তু ‘আধুনিক’ বা ‘যুগোপযোগী করার নামে মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম বদলে দেওয়া এবং কওমি মাদ্রাসার আদর্শের পরিপন্থি শিক্ষাসূচি চাপিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মার্কিন যুদ্ধনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্যসূচি বদলে দেবার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ভূমিকা রাখতে চায় সেটাও কন্ডোলিসা রাইস রীতিমতো ঘোষণা করেই জানিয়েছেন। তাঁর বয়ান হচ্ছে, “যে নৈরাশ্য থেকে সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয় সেই সন্ত্রাস টেকে না যদি জগতে আশার সঞ্চার করা যায়। সেই আশার সঞ্চার করতেই মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রম বদলাতে হবে। সেই কারণে মাদ্রাসার ছাত্রদের কেবল করে খাওয়ার ব্যবহারিক জ্ঞান শিক্ষা দিতে হবে।” কন্ডোলিসার দাবি হচ্ছে, কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ঘৃণা করতে শেখে। ব্যবহারিক বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা দরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তারা যেন আর ঘৃণা না করে। ‘ঘৃণা শিক্ষা’র পরিবর্তে তাদের শেখানো হবে বৃত্তিমূলক শিক্ষা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দতা অর্জন। যেন তারা পুঁজিবাদের গোলাম হয়ে সাম্রাজ্যবাদের সেবা করে যেতে পারে।
তথ্য সূত্র : ইকনোমিক টাইমস।
©somewhere in net ltd.