নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুঃখের কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা। ভালোবাসা হলো দুঃখ, এক ঘরে কবিতা ও নারী।
অনেক অনেক বড়ো পোস্ট
কার্তিকে নবান্নের উৎসবের সাথে আরো কিছু উদ্যোগের খুব ধুম পড়ে যায়। যাত্রাপালা, জারি-সারি-বয়াতি গান, ইত্যাদি আয়োজনে সমগ্র পল্লীগাঁও উৎসবের আমেজে মেতে ওঠে।
যাত্রাপালার প্রতিও কুটিমিয়ার অদম্য উৎসাহ ও নেশা ছিল শৈশব থেকেই। ঘুড়ি উড়ানো আর পাখি শিকারের বয়স থেকে বাবার সাথে সে রাত্রে যাত্রাপালা দেখতে যেতো। বাবার কোলে চেপে কিংবা পাশ ঘেঁষে বসে থেকে সে দেখেছে সয়ফলমূলক বদিউজ্জামান, রহিম বাদশাহ্ ও রূববান কন্যা, গুনাই বিবি, আলোমতি-প্রেমকুমার নামের মনমাতানো যাত্রাপালা।
যাত্রার মরসুমে বিকেলবেলা স্কুলমাঠে পাট শুরু হয়ে মধ্যরাত পার হয়ে যেতো। কুটিমিয়া প্রতি বিকেলে পাট দেখতে যেতো, সন্ধ্যা হবার আগ দিয়ে আবার ঘরে ফিরে আসতো।
এসব যাত্রাপালায় মেয়ের পাটগুলোও ছেলেরাই করে থাকে। অবিকল মেয়েদের মতো লতানো কোমর দুলিয়ে শাড়ি পরা ছেলেরা যখন অভিনয় করতো, তা দেখে কিশোর কুটিমিয়া আশ্চর্য ও অভিভূত হতো।
ছোটোবেলার একটা কথা কুটিমিয়ার মনের ভিতর আজো গেঁথে আছে। বাবার কোলে চেপে আঁটসাঁট হয়ে রহিম বাদশাহ্ ও রূপবান কন্যার যাত্রা দেখছিল সে। কুটিমিয়ার দেখা প্রথম যাত্রাপালা সেটা ছিল না, কিন্তু ঐদিনই প্রথম সে যাত্রার প্রকৃত স্বাদ উপভোগ করেছিল। যা সে দেখে তাতেই মুগ্ধ হয়। গম্ভীর চলনে মঞ্চে প্রবেশ করলো বাদশাহ্, উজির; তাদের পোশাকের ঝলকানি আর শানশৌকত দেখে কুটিমিয়া পুলক ধরে রাখতে পারে না। সুমিষ্ট বাচন, অঙ্গভঙ্গি, তলোয়ারের ঝনঝনানি, বাদ্যযন্ত্র ও বাঁশির ঐকতান— কুটিমিয়ার অন্তরে অনির্বচনীয় আনন্দের ঢেউ তোলে। কয়েক দৃশ্য পরই মঞ্চ আলো করে প্রবেশিত হয় পরীর মতো অতিশয় সুন্দরী রাজকন্যা— যেমন তার রূপের ঝিলিক, তেমন তার সাজসজ্জার বাহার; রাজকুমারীর মুখের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলো কুটিমিয়া— কী করে এত রূপবতী হয় রাজকন্যারা! এমন রূপবতী সে জীবনেও দেখে নি। দু চোখ বিস্ফারিত করে সে বাবার কোলের সাথে লেপটে থেকে রূপসী নায়িকার দিকে তাকিয়েছিল— এমন সময় বাবা তার কানের কাছে মুখ এনে মৃদু শব্দে বলেন, ‘তুমার নছর মামুরে চিনছাও বাজান?’ ধ্যানভঙ্গ কুটিমিয়া জিজ্ঞাসু চোখে বাবার দিকে ফিরে তাকায়। মঞ্চে উপবিষ্ট রূপবান কন্যাকে দেখিয়ে বাবা নরম স্বরে বলেন, ‘তুমার নছর মামু রূপবান কন্যা অইছে। দেখছাও?’
সেদিন কুটিমিয়ার আশ্চর্যের সীমা ছিল না। নছর মামাকে সে তার নানা-বাড়িতে কত্ত দেখেছে! গরীবের ছেলে সে, সারা বছর নানা-বাড়িতে রাখাল খেটে খায়। অথচ সেই নছর মামাই রূপবান কন্যার পাটে মেয়ে সেজেছে; তার একপিঠ লম্বা চুল, চুলের খোঁপায় রঙিন ফিতা ও ফুল, চকচকে সোনার হার তার গলায়, মাথায় পরেছে ঝলমলে রুপালি তাজ, নছর মামাকে কী যে রূপবতী লাগছিল! বাবা বলে না দিলে কস্মিন কালেও সে জানতে পারতো না অপূর্ব সুন্দরী রূপবান কন্যাটা আসলে তার নানা-বাড়ির রাখাল ছেলে— তার নছর মামা।
সয়ফলমূলক বদিউজ্জামান-এর যাত্রা দেখে কুটিমিয়া সবচাইতে বেশি অভিভূত হয়েছিল। সুপ্তোত্থিত রাজকুমার সয়ফলমূলক একদা রাত্রে জামান-জামান চিৎকারে চারদিক সচকিত করে তোলে। প্রহরী-সহচরগণ ত্রস্তে সমবেত হয়। স্বপ্নাহত রাজকুমার চারদিকে তাকিয়ে কী যেন খোঁজে। তারপর বেদনার্ত স্বরে জানায়, গভীর রাত্রে কোনো এক অরণ্য-চূড়ায় অপূর্ব সুন্দরী জনৈকা রাজকুমারীর সাথে তার মিলন হয়েছিল। বদিউজ্জামান রাজকুমারীর নাম। সোনার পালঙ্কের কোনা ধরে ঝলমলে পরীরা অরণ্য-চূড়ায় আনন্দ-নৃত্যরত ছিল, রাজকুমার আর রাজকুমারী সেই পালঙ্ক-মাঝে প্রেমালিঙ্গন করেছিল। এ কথা শুনে সবাই মুখ টিপে হাসে; সবিনয়ে বলে, ‘ওটা সত্যি নয়, স্বপ্ন।’ রাজকুমার তার হাতের অঙ্গুরি দেখায় যা সে রাজকুমারীর সাথে গভীর প্রেমের সাক্ষী স্বরূপ বদল করেছিল। সত্যি না হলে কী করে আংটি বদল হলো? বদিউজ্জামানের প্রেমে দিওয়ানা রাজকুমার অবশেষে গৃহত্যাগী হয়, সৈন্যসামন্ত-প্রহরী-পেয়াদা সঙ্গে নিয়ে সে যাত্রা শুরু করে; কত ঝড়ঝঞ্ঝা, বৃষ্টিবাদল, রৌদ্রখরতাপ মাথায় নিয়ে তারা ছুটে চলে— শ্বাপদসংকুল অরণ্যপাহাড়, তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তারা ছুটে চলে— অবশেষে এক পরীর রাজ্যে গিয়ে তারা পৌঁছে। পরীরাজ্যের রাজকন্যার নামই বদিউজ্জামান। রাজপরীকন্যার সাক্ষাৎ পাওয়ার পর সয়ফুলমূলক যে উচ্ছ্বাস আর উৎফুল্লতা প্রকাশ করেছিল, তার রেশ বহুদিন অব্দি কুটিমিয়ার মন জুড়ে বাজছিল— একটা ঘোরের মধ্যে সর্বদা তার মনে হতো— সে আদতে দরিদ্র কৃষকপুত্র কুটিমিয়া নয়, সে-ই রাজকুমার সয়ফলমূলক— তার কোলে বসে রাজকুমারী বদিউজ্জামান সুরেলা কণ্ঠে গান ধরে :
ও রসের নাগরও
কোলে বসিয়া মধু পান করো...
গুনাই বিবি কুটিমিয়ার কখনো দেখা হয় নি। অবশ্য একবার এটা দেখার জন্য সে খুব অস্থির হয়েছিল। সেবার তাদের গ্রামে গুনাই বিবির যাত্রা হয়েছিল। যেদিন যাত্রা মঞ্চস্থ হবে সেদিন সকালবেলা থেকেই তার মন খুব চঞ্চল হয়ে উঠলো। স্কুলের মাঠের এক ধারে দিনভর যাত্রামঞ্চ তৈরি করা হলো— বর্গাকার ক্ষেত্রের চার কোনায় চারটি বৃহৎ ও লম্বা কলাগাছ পোঁতা হলো, মাঝখানে পাতা হলো সমান আকৃতির গোটা চারেক বড়ো চৌকি, সামিয়ানা টাঙ্গানো হলো মঞ্চ ছাপিয়ে অনেক জায়গা জুড়ে। স্কুলের জানালা দিয়ে কুটিমিয়া কেবলই মাঠের কোনায় যাত্রামঞ্চের দিকে অস্থির চোখে তাকিয়ে রইলো। স্কুল ছুটির পর বহুক্ষণ পর্যন্ত মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে দেখলো— যারা প্রতিদিন পাট করে, তারাই গরমে ঘেমে-নেয়ে নিজ হাতে মঞ্চ সাজানোর কাজ করছে। বাড়ি ফিরে কুটিমিয়া ঘাস কাটতে চকে গেলো না, মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে পুনরায় মাঠে এসে মঞ্চ তৈরি দেখতে লাগলো। একবার হঠাৎ করে অনেক ছেলেমেয়ে একযোগে মাঠের কোনায় একটা বাড়ির দিকে ছুটলো, তাদের সাথে কুটিমিয়াও; সেখানে গিয়ে সে শোনে ‘বাইয়ালি’ এসেছে। বাইয়ালির নাচ সে বহুত দেখেছে, না-সাজা বাইয়ালিকে একদম কাছ থেকে দেখার অনেক দিনের সাধ। ভিড় ঠেলে বাইয়ালিকে একনজর দেখতেই তার মন মরে গেলো। যা ভেবেছিল— ধবধবে সাদা, অসম্ভব রূপসী— এসব কিছুই না— বাইয়ালিটা দেখতে বেজায় খাটো, গায়ের রং হাঁড়ির পিঠের মতো কালো, কেবল চুলগুলো মেয়েদের মতো লম্বা; তবে সে কথা বলছে মেয়েদের মতোই নরম ও চিকন স্বরে। কুটিমিয়া ভাবে, এই লোকটা বাইয়ালি সেজে নাচলে খুব অদ্ভুত আর বিশ্রী দেখাবে।
সন্ধ্যায় মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে কুটিমিয়া মায়ের কঠিন ভর্ৎসনা খেলো, দু চার ঘা কিলও তার পিঠে পড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু দাদির জন্য সে রক্ষা পেলো। আজ সে ঘাস কাটে নি, গরু আজ অনাহারে থাকবে, কুটিমিয়াকেও আজ রাতে তেমনি অনাহারে থাকতে হবে; এমন কঠিন হুকুম জারি করে কুটিমিয়ার মা তাকে আপাতত নিস্তার দিল।
দাদির ঘরে দাদি নিজে ভাত এনে কুটিমিয়াকে খাওয়ালো। তার খিদে নিবারণ হলো সত্য, কিন্তু যাত্রা দেখতে যাওয়ার সম্ভাবনা কেবলই অনিশ্চয়তায় ভরে উঠতে থাকলো।
২
কুটিমিয়ার মা ও চাচি গুনাই বিবি দেখবার জন্য পাগলিনীপ্রায়। পাট শুরু হয়েছে শোনার পর থেকেই দু সখী চঞ্চল হয়ে দিন গুনছিল। কিন্তু হায়, যাত্রার দিন কুটিমিয়ার বাবা বাড়িতে নেই।
কুটিমিয়াকে বুকে চেপে দাদিমা শুয়ে আছেন। যথাসময়ে বৃদ্ধা ঘুমিয়ে পড়েন, রাত বাড়তে থাকে, চাচির ঘরে এতক্ষণ হাসিঠাট্টা আর খুশির কোলাহল ছিল, তা-ও ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে থাকলো; তার মা-ও হয়তো আর জেগে নেই। কুটিমিয়ার চোখ দিয়ে দরদর বেগে অশ্রু ছোটে। সে দাদিমাকে ঠেলা দেয়, ঘুমের ঘোরে দাদিমা কেঁকিয়ে ওঠেন। কুটিমিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে ছোটো ছোটো শব্দে বলে, দাদি, কাকারে ওঠবার কও না? যাত্রা শেষ অইয়া যাইবো তো।
বৃদ্ধা ঘুমের ঘোরে কী বলেন কুটিমিয়া কিছুই বুঝতে পারে না। সে গুনগুন করে কান্না জুড়ে দেয়, মিহি সুরের কান্না বহুদূর ভেসে গেলেও অন্য ঘরের কেউ শুনতে পায় কিনা তা বোঝা যায় না।
সকালবেলা একবুক অভিমান আর বেদনা নিয়ে কুটিমিয়ার ঘুম ভাঙ্গে। মায়ের বেড়ে দেয়া পান্তা ভাত কাঁচা মরিচ ভেঙ্গে মাখিয়ে খায়, আর অন্তর্ক্ষুব্ধ চোখে মায়ের চোখের পানে তাকায়। মা বোঝে না ছেলের অন্তরে কী ঝড় বহমান।
আড়িয়াল বিলে ঘাস কাটতে যাওয়ার পথে চাচাতো ভাই আলামিয়া বলে, বাইয়ালিডা যা চমক্কার নাচ দেহাইলো!
শাঁ করে কথাটা কুটিমিয়ার কানে গিয়ে লাগে। সে চকিতে আলামিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে, তুই যাত্রা দ্যাকতে গেছিলি?
হ।
কার সাতে গেছিলি?
বাবার সাতে। মায় গেছিলো। আম্মায় গেছিলো।
আমার মায়ও গেছিলো?
হ, সব্বাই গেছিলাম। তুই গেলি না ক্যান?
মুহূর্তে কুটিমিয়ার মাথায় খুন চেপে যায়— তাকে ফেলে তার মা যাত্রা দেখতে যাবে এ কথা ভাবতেই তার অন্তর ফেটে ফালি ফালি হতে থাকে। কী করে মা এতখানি নিষ্ঠুর হতে পারলো?
শুকনো আড়িয়াল বিলের বোরো চকে সে ঘাস কাটতে থাকলো, কিন্তু ক্ষোভে আর অভিমানে তার বুকে ঝড় বইতে লাগলো। বরাবর এ দুজনে ঘাস কাটতে কাটতে টুকটাক অনেক কথা বলে, গান গায়; আজ তার মনে সেই প্রফুল্লতা নেই। কচাকচ কচাকচ সে ঘাস কাটতে থাকে।
হঠাৎ কুটিমিয়া ‘ওরে বাবারে’ বলে গগনভেদী চিৎকার দিয়ে ওঠে। অদূরে আলামিয়া ঘাস কাটছিল, হাতের কাঁচি ফেলে সে দৌড়ে কাছে এসে দেখে রক্তে কুটিমিয়ার হাত বর্ষা হয়ে গেছে। ডান হাতে কাটা ক্ষত চেপে ধরে সে ছটফট করছে, হাত বেয়ে অনর্গল রক্ত ঝরছে।
কুটিমিয়ার আর্ত চিৎকারে বোরো চক আন্দোলিত হতে থাকে। আজকের মতো এত দ্রুত সে কোনোদিন ঘাস কাটে নি এবং আজকের চেয়ে এত অমনোযোগীও সে আগে কখনো হয় নি। তার মনের ভিতরে ছিল ঝড়, ঘাস কাটতে কাটতে অসাবধানে অকস্মাৎ তার হাতে কাঁচি লেগে যায় আর অমনি ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে আসে।
আলামিয়া ওর কান্না থামাবার চেষ্টা করে। অনুনয় করে সে কুটিমিয়ার হাতের রক্ত গামছা দিয়ে মুছে দেয়, সবুজ দূর্বাঘাসের ডগা চিবিয়ে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেয়, তাতে রক্ত জমাট বাঁধবে ও ব্যথা কমবে। তারপর কুটিমিয়ার ছড়ানোছিটানো ঘাসের স্তূপ জড়ো করে অর্ধেক ঘাস আলামিয়া তার নিজের বোঝার সাথে বাঁধে, বাকি অর্ধেকে কুটিমিয়ার জন্য বাঁধে ছোটো একটা বোঝা। দু ভাই দু বোঝা ঘাস মাথায় করে বাড়ির দিকে রওনা হয়।
বার বাড়ির কাছাকাছি আসতে না আসতেই সখেদে মাথার বোঝা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে উচ্চস্বরে চিৎকার জুড়ে দেয় কুটিমিয়া। সে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় না, রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে সক্রন্দন আক্রোশে ফেটে পড়ে। কান্নার শব্দে ত্রস্তে রহিমন বিবি বাইরে ছুটে আসে।
কান্দছ ক্যানরে বাজান? বিচলিতভাবে জিজ্ঞাসা করে কুটিমিয়ার মা, তর কী অইছে?
কুটিমিয়ার ক্ষুব্ধ কান্নার স্বর সপ্তমে চড়ে যায়। সে মায়ের কাছে ছুটে আসার বদলে উলটো দিকে হাঁটতে থাকে, আর মাটিতে পা আছড়ে আক্রোশ ঝাড়তে থাকে।
রহিমন বিবি প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। মাথার বোঝা নামিয়েই আলামিয়া চাচির কাছে ছুটে এসে খবর দেয়, সর্বনাশ অইছে আম্মা। কুডির আত কাইড্যা ফালা ফালা অইয়া গেছে...
অস্থির রহিমন বিবির মাথায় চক্বর লাগে। ছেলের দিকে এগিয়ে যায়— সে এক পা সামনে এগিয়ে কুটিমিয়াকে ছুঁতে যায়, অমনি কুটিমিয়া ছুটে পালায়।
আমারে দ্যাহা, কত্থানি কাটছে দেহি। বিচলিতভাবে রহিমন বিবি বলে।
দেহামু না। কুটিমিয়া ঝংকার তোলে।
দেহাবি না ক্যান, কী অইছে?
জীবনে প্রথম বারের মতো একটা কুৎসিত অশ্লীল গালি দিয়ে ওঠে কুটিমিয়া, তারপর বলে, আমারে থুইয়া তুই যাত্রা দ্যাকপার গেলি ক্যান? ক্যান গেলি...? আবারো সেই গালি।
রহিমন বিবির চোখে পানি চলে আসে। যাত্রা দেখার আহ্লাদ তার জীবনে খুব একটা ছিল না। কুটিমিয়ার বাবা নালমিয়া বহুবার তাকে যাত্রা দেখাতে চেয়েছেন, সে শরমে রাজি হয় নি। কিন্তু গুনাই বিবির যাত্রাটা খুবই দুঃখের। পাট শুরু হওয়া থেকেই আপন-পড়শি জা-দের কাছে সে এর খোশগল্প শুনে আসছিল। তাদের সাথে অনেক বুদ্ধিপরামর্শও করেছে যাত্রা দেখতে যাবে বলে। কিন্তু যাত্রার দিন নালমিয়া বাড়িতে নেই। স্বামী ছাড়া আর কারো সাথে কি যাত্রা দেখতে যাওয়া যায়? রহিমন বিবির গোপন খায়েসের কথাটা নালমিয়া জানতেন। তিনি বাড়িতে থাকবেন না বলে বউয়ের সাধ মিটবে না তা হয় না। তাই বাড়ি থেকে বের হবার আগে ছোটোভাইকে বলে গিয়েছিলেন, সে যেন তার ভাবীজানকে যাত্রা দেখাতে ভুল না করে। নালমিয়ার অনুমতি যদিও ছিল, রহিমনের মনের ভিতর যদিও প্রবল বাসনা ছিল, কিন্তু নানা কথা ভেবে যাত্রা দেখতে যাবে না বলেই সে স্থির করেছিল। কিন্তু জা ও দেবর এমনভাবে ধরলো যে শেষ পর্যন্ত তাদের সাথে না গিয়ে পারে নি। একটা মস্ত বড়ো ভুল করে ফেলেছে রহিমন বিবি, যা যাত্রা শুরু হওয়ার অল্পকাল পরেই সে বুঝতে পেরেছিল। বাড়ি ফিরে আসার জন্য সে অস্থির হয়ে ওঠে, তার দেখাদেখি আলামিয়ার মা-ও— কী একটা বেটে লোক অত্যন্ত কুৎসিত ভাবে একটা শাড়ি পরেছে, নাচছেও বিশ্রী ঢঙ্গে, মহিলারা লজ্জায় মাথা নত করে আছে, কেউ কেউ উঠে চলে যাচ্ছে।
কুটিমিয়ার চাচাজানের কিন্তু ভালোই লাগছিল। তাই স্ত্রী ও ভাবীজানকে বাড়িতে রেখে সে পুনরায় যাত্রা দেখতে চলে যায়, সঙ্গে অবশ্য আলামিয়াও।
নিজের ওপর রহিমন বিবির খুব রাগ চাপলো। রাত্রে যাত্রা দেখার ব্যাপারটা সে ছেলের কাছে গোপন রাখতে চেয়েছিল। নারীর কাছে স্বামী ছাড়া সবাই পর-পুরুষ। রাতে সে স্বামীর অবর্তমানে পর-পুরুষ দেবরের সাথে যাত্রা দেখেছে— পড়শিরা জানতে পারলে এককোটি লানৎ দিবে। কুটিমিয়া খুব অবুঝ। তাকে সঙ্গে করে যাত্রা দেখলে সকাল হবার আগেই তার মুখ থেকে চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে যাবে চাচা-চাচির সঙ্গে তার মা-ও রাতে যাত্রায় গিয়েছিল। পড়শিরা যা ঠোঁটকাটা— ‘ঠোঁট বাঁকা করে বলতো, ছিঃ, মইরা যাই লো, মইরা যাই, ভাতার গেছে দেশের বাইরে, দেওরের সাতে যায় যাত্রা দ্যাকতে। এমন ছিনাল তুমরা কই দ্যাকছাও? কলির কাল আইলো লো দ্যাশে...।’ কিন্তু রহিমন বিবির সামান্য ভুল হয়েছিল বুঝবার— তাদের সঙ্গে আরেকটি অবুঝ ছেলে ছিল— আলামিয়া— তার কথা তার মনেই পড়ে নি।
আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে কুটিমিয়ার মা বলে, পাগল, আমি কি যাত্রা দেকছি?
দেহছ নাই তয় গেছিলি ক্যান? কুটিমিয়া ক্ষুব্ধ স্বরে ঝামটা দিয়ে ওঠে।
বাজান না বালো, কাছে আয়। দেহি কত্থানি কাটছে?
কুটিমিয়া আর ছুটে পালায় না। মায়ের কাছে ধরা দিয়ে সে সবেগে কেঁদে ওঠে। তার মা গামছা খুলে কাটা দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠে, তর এত বড়ো সর্বনাশ কেমনে অইলো রে বাজান— কেমনে অইলো?
কুটিমিয়ার হাতের কাটা ঘা সেরেছিল, কিন্তু সেই রাত্রে যাত্রা দেখতে না পাওয়ার দুঃখ নয়, তাকে ফেলে তার নিষ্ঠুর মা যাত্রা দেখতে গিয়েছিল, সেই দুঃখ তার অন্তরের গহিনে কাঁটার মতো বিঁধে থাকলো।
এরপর গুনাই বিবি সে বাবার সাথে বার কয়েক দেখেছে। অতি শৈশবে বাবার কোলে বসে যাত্রায় নর্তকীদের নাচ দেখতে সে প্রচুর মজা পেতো, কিন্তু বয়স একটু বেড়ে গেলো যখন, যখন বাবার কোলে বসার বয়স তার গত হলো, মেয়েঘটিত ব্যাপার-স্যাপারে তার মনের মধ্যে সামান্য পরিণতি ফুটতে থাকলো, বাবার পাশে বসে যাত্রা দেখতে তার লজ্জাবোধ হতে থাকলো। পুরুষ-নর্তকীরা কোমর দুলিয়ে খেমটা নাচন নাচে, ছোটোবেলায় বাবার কোলে বসে এসব দেখে সে খুব পুলকিত হতো। আজকাল লজ্জায় তার মাথা নুয়ে আসে, অথচ বন্ধুদের সাথে একত্রে বসলে এই নাচ তার মনে ঝড় তোলে।
৩
অকস্মাৎ একদিন দারুণ খবর চাউর হলো— দোহারপুরীতে ‘গুনাই বিবি’ হবে। তবে যাত্রার খবরের চেয়ে আরেকটি খবর সবচেয়ে বেশি চমক ছড়ালো— তা হলো, এই তল্লাটে প্রথমবারের মতো যাত্রায় মেয়ে-নর্তকী নাচবে, যাকে সুদূর ময়মনসিংহ থেকে অনেক টাকার নজরানায় আনা হচ্ছে। গ্রামে গ্রামে ঢোল পিটিয়ে, মাইকে গলা ফাটিয়ে সেই নর্তকী আসার খবর জানানো হলো। জবর চমকপ্রদ তার নাম— প্রিন্সেস নূরজাহান। তার রূপের আগুনে চারপাশের সবকিছু জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এমন রূপসীকে একনজর দেখলেই জীবন ধন্য।
একা কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে রাতের বেলা যাত্রা দেখার বয়স তখনো কুটিমিয়ার হয় নি। এই সেদিনও বাবার কাছ ঘেঁষে বসে বাইয়ালির নাচ দেখেছে, কিন্তু এখন আর সেভাবে নর্তকীর নাচ দেখা সম্ভব নয়। অথচ প্রিন্সেস নূরজাহান নামটা তার মনের মধ্যে তীব্র আগুন জ্বেলে দিল। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সহজাত কামবোধ নয়, কেবল লোকমুখে শুনে কখনো-না-দেখা নারী-নর্তকীর উথালপাথাল রঙ্গনৃত্য উপভোগের লোভই ভিতরে ভিতরে তাকে খেপিয়ে তুললো। মেয়েটা যখন সারা মঞ্চ জুড়ে দুলে দুলে নাচবে, কী হবে তার মুখের ভাষা, গানের সুর, চোখের চাহনি? তার চুলের খোঁপায় কৃত্রিম পরচুলা থাকবে না, তার বুক কিংবা পিঠের জমিন পুরুষ-নর্তকীর মতো বেঢপ ও সমতল নয়— আছে পাহাড়ের উঁচুনীচু ঢেউ— যা দেখলেই ঝিলিক দিয়ে যৌবন জেগে ওঠে। তবে পুরুষ বাইয়ালিরা খুব বিশ্রী আর অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে, মেয়ে-নর্তকীটা নিশ্চয়ই অতোখানি যাবে না। এসব কল্পনা করতে করতে কুটিমিয়ার মনে হতে লাগলো— ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে বাউরি বাতাস ঢেউ খেলে যায়— সুন্দরী নর্তকীটা সেই ঢেউয়ের তালে তালে নাচছে, উত্তুরে হাওয়ায় বাঁশঝাড়, কলার ঝোপ ঝমঝম-পতপত করে বাজে, গাছপালা-বনবাদাড়ে মটমট করে ডালে ডালে ঘর্ষণ হয়, কী এক আনন্দ-হিল্লোলে কুটিমিয়ার মন দুলে ওঠে। তার অশান্ত-উৎসুক-আঁতিউঁতি-চোরা চোখ চারদিকে তাকে খুঁজে ফিরে— যার পায়ের ঘুঙুর বাজে বাতাসে বাতাসে, পাতার মর্মরে।
চাচাতো ভাই আলামিয়ার সাথে মাঝে একবার সলা-পরামর্শ করলো কী করা যায়। আলামিয়াও নূরজাহানের ঘোরের মধ্যে আছে। যদিও তারও কৈশোর কাল বটে, মেয়েদের দিকে সে-ও তাকায়, কিন্তু সেই চাহনিতে যৌবনাগমনের কোনো চিহ্ন থাকে না, অজানা অদেখাকে জানার এবং দেখার তীব্র বাসনা ও কৌতূহল আছে তাতে।
কুটিমিয়া পড়েছে প্রিন্সেস অর্থ রাজকুমারী। রাজার দুলালী। রাজদুলারি। রাজকন্যারা ভীষণ রূপসী হয়। সে বোঝে, প্রিন্সেস নূরজাহান কোনো রাজার কন্যা নয়, তবু সে ভেবে ভেবে খুব আকুল হয় নূরজাহানকে ‘প্রিন্সেস’ ডাকা হয় বলে। যাত্রার সব নর্তকীকেই কি তাহলে প্রিন্সেস ডাকা হয়? অবোধ কার কন্যা এ প্রিন্সেস নূরজাহান? কোনো রাজকন্যা কি কোনোদিন কোনো যাত্রামঞ্চে নৃত্য দেখিয়েছিল? কুটিমিয়া ধ্যানমগ্ন হয়ে এসব ভাবে।
তীব্র আবেগ আর উচ্ছ্বাস চেপে রাখা ভীষণ দায় হলো। একবার সে মনে মনে এ-ও ভাবলো, শেষ পর্যন্ত বাবা কিংবা চাচার সাথে হলেও সে যাত্রা দেখতে যাবে। তাঁদের সামনে সে হয়তো প্রকৃত রসভোগ করতে পারবে না, কিন্তু তার দু নয়ন তো জুড়াবে, সে একদিন বুক উঁচু করে বলতে পারবে, প্রিন্সেস নূরজাহানের নাচ সে-ও দেখেছে।
দারুণ এক মওকা জুটে গেলো। যেদিন যাত্রা মঞ্চস্থ হবে সেদিন তার বাবাও বাড়িতে নেই, চাচাও নেই। মায়ের খুব একটা অবাধ্য সে নয়, বাবার অনুপস্থিতিতে মায়ের নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করার সাধ্য তার নেই, কিন্তু মায়ের সাথে সে তর্ক করতে পারে নির্বিঘ্নে ও অসংকোচে, তার মনের মতো কিছু না হলে বা না পেলে সে মাটিতে দড়াম দড়াম পা আছড়ায়, মুখে দু চারটি কটু কথা বলে মনের ঝাল মিটায়।
সকালবেলা বড়ো একবোঝা ঘাস কেটে এনে খালের পানিতে গরু গোসল করালো কুটিমিয়া। পান্তা খেতে বসে মাকে বলে বসলো, রাইত্রে আমি যাত্রা দ্যাকতে যামু।
পাগল পুলা কয় কী, আইজকা আবার যাত্রা অইবো কুতায়? ছেলের কথায় অবিশ্বাসের সুরে রহিমন বলে।
আল্লা, তুই জানস না মা? পুরীতে আইজ গুনাই বিবি অইবো। হেইহানে একটা ম্যায়া বাইয়ালি নাচবো, জানছ?
নাউজুবিল্লা— নাউজুবিল্লা। কুটিমিয়ার মা দু চোখ কপালে তুলে বলে, এত মাইনষের সামনে ম্যায়াডা নাচবো? কুন্ গেরামের ছিনাল?
কী যে তুই কছ মা, ছিনাল অইবো ক্যান? মায়ের সম্মতি পাবার আশায় কুটিমিয়া বানিয়ে একটা মিথ্যা কথা বলে, ...প্রিন্সেস। রাজার ম্যায়া। রাজার ম্যায়ার নাচ না দেকতে পারলে একদুম মইরা যামু।
অবদ্র পুলার কতা হুনো তো। রহিমন কুটিমিয়ার কথায় অসন্তুষ্ট হয়। আরো বলে, রাজার ম্যায়া আইফো কই গনে? রাজার ম্যায়ারা কি নাচে?
তুই কিছুই জানছ নারে মা। গেরাম ভইরা নাম ছড়াইয়া গেছে প্রিন্সেস নূরজাহানের, যেমন তার রূপ, তেমনই তার নাচ— না দ্যাকলে কেওই বিশ্বাসই করবো না।
এইসব যাত্রাফাত্রা দ্যাকপার পারবি না। রাইত-বিরাইতে কত আফদ-বিফদ আছে। দোহারপুরী কি এইহানে?
না, আমি যামু।
চুপ কর ব্যাশিজিল পুলা। যাত্রা দ্যাহে কে রে, জানছ? যাত্রা দ্যাহে ফাত্রায়। তুই কি ফাত্রা?
কিন্তু কুটিমিয়া নাকি সুরে বলতে থাকে, আমি যামুই।
পাশের বাড়ির আবুল, রহিমুদ্দিন, নুরু— ওরাও যাবে। ওরা অবশ্য কোনো বারই যাত্রা দেখা বাদ দেয় না। রাতের বেলা ওরা কোথায় যায় বা না যায় ওদের মা-বাবারা সে খবর রাখে না; অসংখ্য ভাইবোনের মধ্যে ওদের খবরাখবর রাখা ওদের মা-বাবাদের পক্ষে কখনো সম্ভবও হয় না; ওরা তাই দিনে দিনে ‘বাদাইরা’ হয়ে গেছে, বড্ড স্বাধীন ওদের জীবনযাপন। যত বাধানিষেধ যেন কুটিমিয়ার জন্য। সন্ধ্যা হলেই ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ে কুপির কাছে বসে বই পড়া, খাওয়া-দাওয়া সেরে কাঁথার নীচে মাথা গুঁজে শুয়ে পড়া। এভাবে ঘরের কোণে বন্দি করে রাখলে তার কি চোখ ফুটবে? তার বয়স হবার পর লোকজন দেখবে, কুটিমিয়া তখনো মায়ের আঁচলের তলে ভীরুর মতো মুখ লুকিয়ে আছে।
সন্ধ্যা হবার সাথে সাথে অত্যন্ত সুবোধ বালকের মতো পা ধুয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো কুটিমিয়া। কুপির কাছে বসে বই পড়তে লাগলো একমনে। সে শব্দ করে পড়ে, কিন্তু তার স্মৃতির কোঠায় আজ কিছুই লেগে থাকে না, সব ঝরে যায়। তার মন আর ঘরে নেই।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সে নিজেই বাঁশের ঝাঁপ আটকে দিল। একেবারে বেড়ার কাছ ঘেঁষে কাত হয়ে শুয়ে ছোটো ভাই কালামিয়াকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে তার মা, মাঝখানে দাদি। বাবা বাড়িতে না থাকলে মাঝে মাঝে দাদি এ ঘরে থাকে। আরো ছোটোকালে সে দাদির গলা ধরে ঘুমাতো। এখন গলা ধরে ঘুমাতে ওর লজ্জা হয়। তাছাড়া সে কারো মুখের নিশ্বাস সহ্য করতে পারে না।
দাদির পিঠের কাছে সে শুয়ে পড়ে গুটিপোকার মতো নির্জীব হয়ে পড়ে রইলো। তার মাথার কাছে কুপিটা জ্বলছে। মাঝে মাঝে মাথা সামান্য উঁচু করে দেখে মা ঘুমিয়েছে কিনা। কিছু বোঝা যায় না। অপেক্ষা করতে করতে কুটিমিয়া অধৈর্য হয়ে পড়লো। একবার ইচ্ছে হলো এগিয়ে মাথা উঁচু করে লম্বা ফুঁ দিয়ে বাতিটা নিভিয়ে দেয়। মনে মনে সে কামনা করে— যদি একটা দমকা হাওয়া এসে বাতিটা নিভিয়ে দিত, খুব ভালো হতো। সে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়, তার ইচ্ছে হয় এক ঝটকায় গাছা শুদ্ধ কুপিটা কাত করে ফেলে দিতে।
মাথা উঁচু করে মায়ের দিকে তাকালো। তার মা এ দিকে কাত হয়ে আছে, দু চোখ বন্ধ, ঘুমিয়ে গেছে বোঝা যায়, কিন্তু ইঁদুর হাঁটার শব্দেও সে চমকে জেগে ওঠে। অন্যদিকে কাত হয়ে শুলে অবশ্য ঝুঁকি নেয়াটা সহজ হতো।
ঝুঁকি ছাড়া জীবনে কিছুই করা যায় না। মুহূর্তে কুটিমিয়া সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়, যা ঘটে কপালে ঘটুক, চেষ্টা তাকে করতেই হবে। সে আলগোছে হাত বাড়িয়ে গাছার ওপর থেকে বাতিটা নামিয়ে আনে, শিথান বরাবর বিছানায় নামায়, ফুঁ দিয়ে নেভালে ফুঁ-এর শব্দে কারো ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে। দু আঙ্গুলের ফাঁকে সলতে চেপে ধরতেই দপ করে কুপিবাতি নিভে যায়। মুহূর্তে পুরো ঘর অন্ধকার— ইচ্ছে করলেই অভিযানে উদ্যত হতে পারে, কিন্তু সামান্যক্ষণ অপেক্ষা করে দেখতে চায়, এরই মাঝে যদি মায়ের ঘুম ভাঙ্গে, মা যদি দেখে ঘরের বাতি নিভে গেছে, তার সমস্ত ইচ্ছের জলাঞ্জলি হবে।
রহিমুদ্দিন আর নুরুর ছোটো ছোটো কথার শব্দ শুনেই কুটিমিয়া উঠে দাঁড়ায়। অতি সন্তর্পণে ঝাঁপ খোলে, ঝাঁপের কানও সেই শব্দ শুনতে পায় না। নরম পা ফেলে বাইরে এসে পুনরায় ঝাঁপ লাগিয়ে দেয়, তারপর লম্বা কয়েক কদমে সে বাড়ির বাইরে রাস্তায় চলে আসে। তখন রহিমুদ্দিন আর নুরুও ঠিক সেই জায়গায় এসে পৌঁছে গেছে। এমন মুক্তির আনন্দ জীবনে কুটিমিয়া প্রথম উপভোগ করলো। ওদের সাথে দ্রুতপায়ে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছেই মনের আনন্দে সমস্বরে গুনাই বিবির গান জুড়ে দিল :
দাদা আর যাবো না ঐ ইশকুলে পড়তে।
ঐ ইশকুলে পড়তে গেলে দাদা গো
ও দাদা সম্মান বাঁচবো না
দাদা আর যাবো না ঐ ইশকুলে পড়তে...
গান গায় আর কুটিমিয়া মনে মনে ভাবে, যাত্রাগানের চেয়ে নূরজাহানের নাচের আসর হলেই সবচাইতে বেশি মজা হতো।
আকাশে চাঁদ নেই। রাতের শেষ প্রহরে সরু একফালি চাঁদ পুব দিকে যখন উঠবে, তখন যাত্রার করুণ গানের মতোই সেই চাঁদখানি অতিশয় ম্লান ও বিরহকাতর দেখাবে।
৪
দু গাঁয়ের মাঝখানে আধমাইল দীর্ঘ চক। চক পার হয়ে গ্রামের শুরুতে রাস্তার উত্তর ধারে প্রকাণ্ড এক বটগাছ— অসংখ্য শেকড়-বাকড় আর নোয়ানো শাখা-প্রশাখায় ঢাকা তলাভূমি তার উত্তরে বহুদূর অব্দি বিস্তৃত, তারও উত্তরে যে বিশাল ও গভীর এক দিঘি, তার নাম চৈতিবিবির দিঘি।
বটগাছটি দিনের বেলায় রাখাল ছেলেদের, ক্লান্ত কৃষকগণের ও শ্রান্ত পথিকদের মনোরম বিশ্রামস্থল। রাত্রিবেলায় দূর থেকে আবছা অন্ধকারে এটিকে আকাশছোঁয়া এক পাহাড়ের মতো মনে হয়— বুকের ভিতর কেমন এক ভয় জাগে। তাই সাঁঝের পর সচরাচর এ গাছের নীচ দিয়ে কেউ হাঁটে না।
রাত-বিরাতে এ বটগাছের কাছে আসতেই গা ছমছম করে ওঠে। রাতের বটগাছকে তো মানুষ এমনিতেই ভয় পায়— কিন্তু এ গাছটিকে ভয় পাবার পেছনে গভীর রহস্য আছে। এ গাছের কাছে এলেই বহু যুগ ধরে শুনে আসা এক ভয়ঙ্কর কাহিনি সবার মনে পড়ে যায়।
চৈতিবিবির দিঘির পাড়ে এ বটগাছটা দাঁড়িয়ে, এজন্য মানুষের মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে এর নাম চৈতিবিবির বটগাছ হয়ে গেছে। এর পশ্চিমে জঙ্গল-ছাওয়া যে বিশাল পোড়ো ভিটেটি রয়েছে, ওটি বহু যুগ আগে এক জমিদার বাড়ি ছিল।
প্রায় একশত বছর আগে জমিদার হারান শেখ এই দিঘি খনন করেছিলেন। আশ্বিনে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর দিঘি খনন শুরু হয়; প্রতিদিন শত শত কোদালি উদয়াস্ত মাটি কেটে সেই দিঘি খনন করতে লাগলো। দিঘির তলদেশ গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। কিন্তু আশ্চর্য, দিঘির তলায় কোনো পানির আভাস নেই। এখানে-সেখানে অল্প কয়েক হাত কূয়া খনন করলেই ডগডগিয়ে পানি উঠতে থাকে, অথচ এ দিঘির তলদেশ যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। জমিদার হারান শেখ খুব চিন্তিত হলেন। রহস্য কী? এ কোনো গভীর বিপদের আলামত নয় তো!
জমিদারের একমাত্র পুত্র মরন শেখের তিনটি বিয়ে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু কারো গর্ভেই কোনো সন্তানাদি জন্মালো না। বংশ রক্ষার্থে অগত্যা জমিদারপুত্রের চতুর্থ বিয়ে দেয়া হয় চৈতিবিবির সাথে এবং আল্লাহ্র অসীম ফজিলতে বিয়ের প্রথম রাতেই চৈতিবিবি গর্ভবতী হয়। এই শুভ সংবাদে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে জমিদার মহোদয় মহা ধুমধামে সাত গ্রামের মানুষজনকে দাওয়াত করে খাওয়ান।
চৈতিবিবির একটি লুলা পুত্রসন্তান হয়। জমিদার পরিবারে দুঃখের অন্ত থাকে না, তাঁদের দুঃখের সাথে গ্রামবাসীরাও কেঁদে আকুল হয়— বিধাতার কী নিষ্ঠুর বিধান!
দিনে দিনে লুলা পুত্র বড়ো হতে থাকে। টেনে টেনে হামাগুড়ি দেয়— তা দেখে চৈতিবিবি অঝোর ধারায় চোখের পানি ফেলে। আস্তে আস্তে আরো বড়ো হয়— ভাঙ্গা পায়ে অতি কষ্টে লুলা ছেলে হাঁটে।
একদিন রাতে জমিদার হারান শেখ স্বপ্ন দেখলেন— তাঁর একমাত্র পুত্রবধূ ধান-দূর্বা দিয়ে দিঘিতে সাতপাঁক ঘুরে বর দান করলেই পাতাল থেকে দরদর বেগে পানি উঠে দিঘি ভরে যাবে। জমিদারের চিন্তার শেষ নেই। পুত্রবধূর গর্ভে আবারো যদি কোনো বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্ম হয়, এই আশঙ্কায় তিনি বর দানে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন।
স্বপ্নের কথা চৈতিবিবিকে বলতেই সে বর দানে রাজি হয়ে গেলো।
একদিন নিরালা দুপুরে পুত্রবধূ ধান ও দূর্বার বর নিয়ে শুকনো দিঘিতে নামলো। দিঘির চারকোনায় ঘুরে সাতপাঁক পুরো করতেই প্রবলবেগে পাতাল থেকে পানি উঠতে থাকলো, এবং চোখের পলকে সুবিশাল দিঘি কানায় কানায় ভরে উঠলো। কিন্তু হায়, পুত্রবধূ দিঘির গভীর তলদেশে হারিয়ে গেলো।
সারা গাঁয়ে কান্নার রোল উঠলো। সেই কান্না থামে না।
এরপর বহু আশ্চর্য ঘটনা ঘটতে লাগলো। প্রায় দুপুরেই দেখা যায় লুলা শিশুটি পাকা ঘাটের কিনারে বসে পা দুলিয়ে খিলখিল করে হাসছে— একদম একাকী। কেউ তাকে ওখানে নিয়ে যায়, নাকি সে একা একা যায়, কেউ তা জানে না, বুঝতেও পারে না।
দুপুরে ঘাটে পানি আনতে গিয়ে জমিদার বাড়ির এক চাকরানি একদিন ‘ও-মাগো’ বলে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালো। জ্ঞান ফিরলে সে জানালো, সে নাকি ঘাটের কিনারে চৈতিবিবিকে লুলাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে দেখেছে। খুশিতে ডগমগ লুলা পা দুলিয়ে মায়ের বুকে দুধ খাচ্ছিল আর মাঝে মাঝেই খিলখিল করে হেসে উঠছিল।
এটা তার দেখার ভুল। চৈতিবিবি মারা গেছে মাস ছয়েক আগে— সে কোথা থেকে আসবে?
এরূপ আরো অনেকে চৈতিবিবিকে দেখতে লাগলো, সে সাঁতার কেটে দিঘির এ পাড় থেকে ও পাড়ে যায়, মাঝখানে চিৎ হয়ে ভেসে থাকে। ঘাটে বসে লুলাকে গোসল করায়। এসব কথা জমিদারের কানে যায়, কিন্তু তিনি তা শুনে বিরক্ত হোন— এ কখনো হয়? শিরকি কথা। অবশ্য এ-ও তিনি ভাবেন— চৈতিবিবিকে গাঁয়ের মানুষ খুব ভালোবাসতো, তার অস্বাভাবিক মৃত্যু তার প্রতি মানুষের সহানুভূতি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। দিঘির কাছে এলেই চৈতিবিবির কথা তাদের খুব করে মনে পড়ে যায়, ফলে দৃষ্টিভ্রম হয়। জমিদার অবশ্য এ-ও জানেন, তিনি তাঁর এই পুত্রবধূটিকে অসম্ভব ভালোবাসতেন এই কথাটি সবারই জানা। চৈতিবিবির কথা পেড়ে জমিদার মহোদয়ের সুনজর পাওয়ারও একটা প্রয়াস থাকতে পারে।
এর মাস খানেক পরই অত্যাশ্চর্য ঘটনাটি ঘটলো। জমিদার মহোদয় দুপুরে পুকুরের পাড়ে বটের ছায়ায় পায়চারি করছিলেন। হঠাৎ তাঁর কানে এক শিশুর খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসে। উৎসুক হয়ে সামনে এগিয়ে যান— ঘাটের পাড়ে দাঁড়াতেই তিনি বিস্ময়ে রুদ্ধবাক হয়ে যান— তাঁর দু চোখ বিশাল বিস্ফারিত হয়ে ঘাটের কিনারে স্থির হয়— বেণি খোলা, এলোচুল তার, পানিতে দুই পা ডুবিয়ে পাড়ে বসা, কোলের ওপর লুলাকে বসিয়ে স্তন্যপান করাচ্ছে চৈতিবিবি। ঘাড়খানি বাম দিকে ঘোরানো, তার ভীষণ হাস্যোজ্জ্বল মুখটি ঈষৎ দেখা যায়। মাঝে মাঝে লুলার গালে সে টুসি মারে, খিলখিল হাসিতে সে ফেটে পড়ে— এ কী অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন জমিদার মহোদয়! অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!
বউ! বউমা!
ঘোরের মধ্যেই তিনি অস্ফুট স্বরে ডেকে উঠলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় চৈতিবিবি, তার হাসিমুখ স্তিমিত হয়, সন্তর্পণে লুলাকে কোল হতে নামিয়ে পাথরের সিঁড়িতে তাকে বসায়, তারপর ধীরে ধীরে সাঁতরে দিঘির মাঝখানে চলে যায়— জমিদার একদৃষ্টিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকেন— চেয়ে চেয়ে দেখেন, দিঘির মাঝখানে গিয়ে চৈতিবিবি থামলো, আবার তার দিকে ফিরে তাকালো, তারপর টুপ করে একটা ডুব দিল, মাথার চুল পানিতে ভেসে থাকতে দেখা গেলো কিছুক্ষণ, শাড়ির আঁচলখানিও আরো কিছুক্ষণ দেখা গেলো, তারপর আর কিছুই দেখা গেলো না।
জমিদারের ঘোর কাটে, কিন্তু তাঁর হতবিহ্বল কণ্ঠে বাক ফোটে না। এ কী অবিশ্বাস্য ঘটনা! তিনি দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসেন। মায়ের জায়গায় বসে লুলা মায়ের চলে যাওয়ার পথের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। জমিদার তাকে কোলে তুলে নেন, হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ফিরে আসেন, কিন্তু কাউকে কিছুই খুলে বলেন না। এ ছেলে কীভাবে দিঘির ঘাটে যায়? সারা বাড়ি ভর্তি কত মানুষ, এ ছেলে কখন কীভাবে পানির এত কাছে গিয়ে বসে? কেউ কি দেখে না? তিনি আশ্চর্য হয়ে ভাবেন, আর এক নিদারুণ ভয়ে তাঁর বুক কেঁপে উঠতে থাকে।
এ ঘটনার পর জমিদার হারান শেখ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাকরুদ্ধই ছিলেন। তাঁর মুখে যেমন ভাষা ফোটে নি, চৈতিবিবিকেও আর কোনোদিন ঘাটে বসে লুলাকে দুধ খাওয়াতে দেখা যায় নি।
কিন্তু চৈতিবিবিকে দেখার বাসনা মানুষের তীব্র হতে থাকে। তারা ভিড় করে দিঘির পাড়ে এসে বসতো, ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো। অনেক দূরের মানুষও অনেক সময় এসে পাড়ে দাঁড়িয়ে একধ্যানে অপেক্ষা করতো, যদিই বা চৈতিবিবিকে একবারের জন্য দেখতে পায়।
চৈতিবিবিকে দেখার বাসনা আর কখনোই মানুষের পূরণ হলো না এবং কালক্রমে মানুষের মুখে মুখে ফিরতে ফিরতে এক সময় দিঘির নামটি হয়ে যায় চৈতিবিবির দিঘি। দিঘির পাড়ের বটগাছটির বয়স দিঘির বয়সের চেয়ে বছর কুড়ি কমই হবে এবং এটাকেও মানুষ একদা চৈতিবিবির বটগাছ নামে ডাকতে থাকে।
৫
নুরু, রহিমুদ্দিন ও কুটিমিয়ার মনে আজ কোনো ভূতের ভয় নেই। কিন্তু তবুও বটগাছের কাছে আসা মাত্রই ওদের তিনজনেরই গা ছমছম করে উঠলো। তবে মুখে কেউ কিছু প্রকাশ করলো না— যদিও ওদের সবার বুকই এখন ভয়ে দুরুদুরু করছে। নুরু সবার আগে, গাছতলায় আসা মাত্রই সে দ্রুত কদম ফেলতে লাগলো, দেখাদেখি তার পেছনে রহিমুদ্দিন, এবং বলা বাহুল্য, কুটিমিয়াও।
যাত্রাস্থলের কয়েক শ গজ দূর থেকেই তুমুল শোরগোল শুনতে পেলো ওরা। সেই শোরগোলে ওদের প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠলো।
গভীর জঙ্গল, বাঁশঝাড় আর ঘন গাছপালায় ছাওয়া পুরী গাঁয়ের মাঝখানে উঠোনের মতো ছোট্ট একটি অসমতল মাঠ। বৃষ্টি হলেই এখানে-ওখানে পানি জমে, কাদা হয়; সেই পানি আর কাদায় গড়াগড়ি করে হাডুডু, দাঁড়িয়াবাঁধা আর কাঁচা জাম্বুরায় বালকদের ফুটবল খেলা চলে প্রায় বারোমাস। মাঠের একপাশ দিয়ে পায়ে-চলা পথ চলে গেছে, সেখানে ছোটো একটা মুদি দোকান, পান থেকে কেরোসিন এবং চা থেকে চানাচুর— সবই বেচাকেনা হয়।
মাঠের এককোণে যাত্রামঞ্চ। মঞ্চের এক ধারে বাঁশের ঘের করে মহিলাদের জন্যও করা হয়েছে সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত স্থান।
যাত্রামঞ্চের চার কোনায় চারটি হ্যাজাক বাতি ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। হ্যাজাকের আলো চারদিকে ঠিকরে পড়ছে। ছোটো মাঠখানি দিনের আলোর মতো ফরসা হয়ে উঠেছে। মঞ্চের চারপাশে উপচে পড়া দর্শকগণ মাঝেমধ্যেই জোরে হট্টগোল করে উঠছে, কেননা, রাত বাড়ছে কিন্তু যাত্রা শুরু হবার কোনো আলামতই নেই।
রাত গভীর না হলে যাত্রা শুরু হবে না— এটাই সাধারণ রীতি। যাত্রা চলতে চলতে ভোর হয়ে আসবে, বিদায়বেদনার মতো যাত্রা সমাপ্তির বেদনায় মানুষের মন ভারী হয়ে উঠবে— সেই বেদনার ভিতর থেকেই সারা দেহমনে এক অনির্বচনীয় আনন্দানুভূতি ছড়িয়ে পড়বে।
কিন্তু দর্শকগণ ক্রমেই অধৈর্য হয়ে পড়ছে— অযথা কালক্ষেপণ তাদেরকে অসহ্য যন্ত্রণায় পুড়িয়ে মারছে।
অশান্ত দর্শকেরা যখন ধৈর্যের শেষ সীমান্তে, ঠিক সেই সময়ে বাদকদলের প্রবেশ। সাথে সাথে একদফা উল্লাসধ্বনি ওঠে, কারণ, বাদকদলের প্রবেশের অর্থ যাত্রা শুরু হতে আর দেরি নেই।
প্রবেশপথের কাছে মঞ্চের এক ধারে বসে বাদকদল বাজনা ধরলো। মধুর বাদ্যযন্ত্রে সবাই আরেক বার উতলা হয়ে উঠলো। সবার মনেপ্রাণে আজ একটাই আকাঙ্ক্ষা— প্রিন্সেস নূরজাহানের জ্বালাময়ী নৃত্য। কিন্তু কখন সে মঞ্চে আসবে? মনে হয় এখনো ঢের বাকি। ক্ষণে ক্ষণে দর্শকদের একাংশ থেকে ঠেলাঠেলি, শোরগোল শুরু হয়, আয়োজক কর্তৃপক্ষের ব্যক্তিরা মঞ্চে এসে সবিনয়ে শান্ত হতে অনুরোধ জানান, তাতেও মানুষ খেপে যায়। শেষ পর্যন্ত মানুষের মুখে ধুয়া উঠলো— প্রিন্সেস নূরজাহান! প্রিন্সেস নুরজাহান! সুর করে তারা এই নাম জপতে লাগলো।
হঠাৎ ঘোষণা— ভাইসব, আপনারা শান্ত হোন, এখনই আমাদের যাত্রাপালা শুরু হতে যাচ্ছে।
মানুষ শান্ত হলেও উঁকিঝুঁকি দিয়ে, ঘাড় উঁচু করে প্রবেশদ্বারের দিকে অধীর ভাবে তাকায়, কিন্তু কেউ নেই। মানুষ আবারও ক্ষিপ্ত ও বিচলিত হয়ে ওঠে।
অবশেষে প্রবেশদ্বারের ধূলি কপালে ছুঁইয়ে মঞ্চে প্রবেশ করলো ছয়জন বন্দনাকারী। তাদের কণ্ঠস্বরে অপূর্ব মাধুর্য আছে, বাদ্যের তালে তালে তাদের গানের সুর এক অজাগতিক ছন্দোময়তার সৃষ্টি করে। কিন্তু এসবে আজ মানুষের প্রাণ ভরছে না, আজকের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু প্রিন্সেস নূরজাহানের খেমটা নৃত্য না দেখা অব্দি তাদের অন্তরের জ্বালা মিটবে না।
বন্দনাগীতের মাঝামাঝি সময়ে দর্শকদের মাঝে গুঞ্জন উঠলো, তাদের কান ঝালাপালা করছে।
ভীষণ চেঁচামেচির মধ্য দিয়ে বন্দনা শেষ হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে বাদকদলের উদ্দাম বাজনা বেজে উঠলো। ধুমধাড়াক্কা তালে সেই বাজনা বেজে চলছে— প্রবেশপথের দিকে ব্যাকুল চোখে মানুষ তাকিয়ে— দূরে, আড়ালে, ঝিকিমিকি ঝিকিমিকি ক্ষুদ্র আলোর বিচ্ছুরণ— ছনাৎ ছনাৎ ঝুমঝুম বেজে ওঠে— মৃদু শোনা যায়— দর্শক ছটফট করতে থাকে— বাদ্যযন্ত্রের সুর আরো উত্তাল হলো, তখনই একদৌড়ে মঞ্চে প্রবেশ করলো আকুল-প্রতীক্ষিতা প্রিন্সেস নূরজাহান। বাজছে বাদ্যযন্ত্র, জরির ওড়নায় মুখমণ্ডল মৃদু আবৃত, ডান হাত উঁচিয়ে বাঁকা করে কপাল ঢেকে উদ্দাম তালে মঞ্চের চারদিকে ঘুরছে নূরজাহান, যেমন তার লতার মতো শরীর, ঘাগরা পরেছে, গায়ে একটা জরিমাখানো ঝলমলে ব্লাউজ— কোনোদিন-না-দেখা গ্রামবাসীগণ বাইয়ালির ব্লাউজচেরা বুক আর যৌবনখোলা নাভি দর্শনেই মূর্ছা যেতে পারতো, কিন্তু প্রিন্সেস নূরজাহান সকলের অদেখা ভুবনের রহস্য আরো বহুগুণ উন্মোচন করে দিল। নূরজাহান ভীষণ বেগে চারদিকে ঘুরছে, ঢং শব্দে বাদ্যযন্ত্রের তাল থামলো— সেই তালের সঙ্গে বিপুল দর্শকের দিকে মুখ করে চারদিকে ঘাগরা উড়িয়ে, একটি হাঁটু গেড়ে, আরেক হাঁটু সামনে ছড়িয়ে বসে পড়লো নূরজাহান— দু হাতের অবগুণ্ঠনে তার মুখ ঢাকা, বাদ্যযন্ত্রে এবার সুর উঠছে— খুব ধীরে ধীরে—
রূপে আমার আগুন জ্বলে...
সেই সুরে সুরে সে খুলছে অবগুণ্ঠন— দু হাত ধীরে ধীরে প্রসারিত হতেই তার মুখশ্রী দেখে তামাম পুরুষ পাগল হয়ে গেলো।
রূপে আমার আগুন জ্বলে— হায় রে হায় রে হায়...
ধীরে ধীরে এক হাতে প্রিন্সেস নূরজাহান ঘাগরা টেনে আস্তে আস্তে হাঁটু পর্যন্ত তোলে— পুরুষেরা উন্মত্ত উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে— এক ঝংকারে উঠে দাঁড়িয়ে নূরজাহান চরকির মতো পাক খায়, আবার এক পা সামনে ছড়িয়ে কাপড় তুলতে তুলতে সে গান গায়—
যৌবন ভরা অঙ্গে...
সঙ্গে সঙ্গে আরেক পাক ঘূর্ণি— তারপর কোমর দুলিয়ে দু হাতে দর্শকগণকে আহ্বান করে সে গায়—
প্রেমের সুধা পান করে নাও
হায়রে আমার দিওয়ানা...
মঞ্চের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের দিকে ছুটে যায়— খটাখট শব্দে মঞ্চের ওপর তার কদম আছড়ে পড়ে, ঝনঝন শব্দে বাজে ঘুঙুর, আর দু হাতে দর্শকগণকে নিজের দিকে আহ্বান করতে থাকে, গাইতে থাকে—
রূপে আমার আগুন জ্বলে
যৌবন ভরা অঙ্গে...
এ এক আশ্চর্য উদ্দাম নৃত্য। বাদ্যমূর্ছনার তালে তালে দর্শকহৃদয়ে ঢেউ খেলে যেতে লাগলো। পুরুষরা সবচেয়ে উন্মত্ত হয়ে ওঠে যখন নূরজাহান ব্লাউজের নীচে পনিরের মতো ধবধবে অংশটুকু অপূর্ব কৌশলে ঢেউ খেলাতে থাকে, প্রস্ফুটিত নাভিখানিকে খাবলে খেয়ে ফেলার জন্য তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে— যখন সে এক স্থানে থমকে দাঁড়িয়ে বক্ষ দোলাতে থাকে, তার সেই বক্ষ দুলুনিতে পুরুষহৃদয়ে ঝড় বয়ে যায়।
কী থাকে জীবনে যদি কেউ প্রিন্সেস নূরজাহানের এই নাচই না দেখলো? পুরুষ-যুবাদের জীবন আজ ধন্য হলো। নূরজাহানের নৃত্য দেখে, যা আগে কখনো কেউ দেখে নি, ভবিষ্যতেও কোনোদিন দেখার সুযোগ হবে কিনা কেউ জানে না— পুরুষরা জ্বলে উঠলো। কিন্তু মেয়েমহল একেবারে নিস্তব্ধ, তারা অতিশয় লজ্জাবনত, মাথা নীচু করে নীরবে বসে, দু একজন অত্যুৎসাহিনী নারী বাঁকা চোখে তা দেখছে যদিও, অনেকেই বিব্রতভাবে উঠে চলে যেতে থাকলো।
নূরজাহান নেচেই চলছে অবিশ্রান্ত। হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়; তামাম পুরুষকে লক্ষ্য করে সে তার ভারী নিতম্ব ও কোমর দোলাতে থাকে— এমন সময় এক দুষ্টু যুবক নূরজাহানের বুক বরাবর এক রুমাল ছুঁড়ে মারে। খপ করে তা ধরে ফেলে নূরজাহান। প্রচণ্ড উল্লাসে মানুষ ফেটে পড়ে। নূরজাহান আরো চমক দেখালো— রুমালটি বুকের ব্লাউজ গলিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে রাখলো। পুরুষরা সজোরে উল্লাস করে উঠলো। তখনই মেয়েদের সারিতে গুঞ্জরন তীব্রতর হলো। একফাঁকে বুকের ভিতর থেকে রুমাল বের করে আনে নূরজাহান, তারপর ছুঁড়ে মারে সেই যুবকের দিকে— উপর্যুপরি সরব উল্লাস। দেখাদেখি আরেকজনের আরেকটা রুমাল প্রক্ষেপণ— নূরজাহান এবার সবচাইতে বড়ো চমকটি দেখালো— সে দু পা ঈষৎ ফাঁক করে দাঁড়ালো, বাম হাতে ঘাগরার কোনা উঁচু করে ধরলো, ডান হাতে রুমালটি ঘাগরার ভিতর দিয়ে ঢুকিয়ে কিছুক্ষণ ঘষলো, তারপর বের করে এনে দর্শকদের বরাবর ছুঁড়ে মারলো, ওটা ধরার জন্য মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়লো, নূরজাহান আবার বাদ্যের তালে তালে নেচে উঠলো— তার কণ্ঠে সেই স্ফুলিঙ্গ-গান :
রূপে আমার আগুন জ্বলে
যৌবন ভরা অঙ্গে
প্রেমের সুধা পান করে নাও
হায়রে আমার দিওয়ানা।
ও আমার দিওয়ানা...
ও আমার মাস্তানা...
রূপে আমার আগুন জ্বলে...
মহিলা সারিতে ভীষণ জটলা আর হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে। এতক্ষণ একজন দুজন করে স্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, এবার সকল মহিলা একযোগে উঠে দাঁড়ালো। আয়োজকগণ তাদেরকে থামাতে চেষ্টা করছে, কিন্তু মহিলারা তা শুনছে না। তারা এই বেশ্যা মাগির নাচ দেখবে না, ঘেন্নায় তাদের পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে।
শোরগোল আর হট্টগোলের মধ্য দিয়ে মহিলাদের বসার সারি শূন্য হয়ে গেলে পুরুষরা দ্রুত সে-স্থান দখল করে নিল এবং এর মধ্য দিয়েই প্রিন্সেস নূরজাহানের প্রথম দফা নৃত্য শেষ হলো।
৬
নুরু ও রহিমুদ্দিনের সাথে কুটিমিয়া তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়টুকু উপভোগ করছে। তিনজনে মাঝখানের একটা জায়গায় একত্রে বসেছে, তাদের চোখেমুখে উত্তেজনা, অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা, তারা পরস্পর বাইয়ালি বিষয়ক কানাঘুষা করে। নুরু ও রহিমুদ্দিনের বয়স কুটিমিয়ার চেয়ে পাঁচ-সাত বছর বেশিই হবে। রহিমুদ্দিন আবার সবচাইতে সেয়ানা, বিশেষ করে নারী রহস্য সম্পর্কে তার জ্ঞান সবচাইতে বেশি।
রহিমুদ্দিন বলে, ‘বাইয়ালিডা’ দোস্ত একটা খাসা মাল। চুমুক দিতে ইচ্ছা করবার লাগছে। নুরু এ কথা বলে আর জিহ্বায় ওপর-নীচ ঠোঁট ভিজায়। কুটিমিয়া ঠিক ঠাওর করতে পারে না কোন জিনিসটায় চুমুক দেয়ার প্রতি নুরুমিয়ার এত সাধ। তবে সে নিশ্চিত এটা অবশ্যই বাইয়ালির শরীরঘটিত ব্যাপার-স্যাপারই হবে। সে লক্ষ করে, নুরুমিয়া আর রহিমুদ্দিনের চোখ কী এক অদৃশ্য বস্তুর আকাঙ্ক্ষায় চিকচিক করে জ্বলছে।
রহিমুদ্দিন ফিসফিস করে বলে, ওরা আইজক্যা নূরজাহানের অবস্থা টাইট কইরা ছাড়বো রে।
নু যাই, দেইক্যা আহি। যাবি? নুরু জিজ্ঞাসা করে।
ধূর পাগল, আমরা কি ধারে কাছে ভিড়বার পারুম?
বাইয়ালি কাইলক্যাও এইহানে থাকবো নি রে?
আরো অন্তত এক সাপ্তা পর্যন্ত এইহানে থাকবো। পুরা খরচ উসুল কইরা ছাড়বো না?
মানুষের মধ্যে আবার অস্বস্তি দানা বাঁধে, ওঠে গুঞ্জন। অভিনয় শুরু হয়েছে, কিন্তু অভিনয়ের প্রতি কারো একবিন্দু আগ্রহ নেই। প্রিন্সেস নূরজাহানকে চাই, তার নাভি নাচানো, বক্ষ দোলানো, ছুঁড়ে দেয়া রুমালের স্নায়ু-উত্তেজক গোপনাঙ্গ ঘর্ষণ— এসবের জন্য দর্শকগণ যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলো।
হঠাৎ মানুষ একটু চাঙ্গা হয়ে উঠলো। যাত্রার কাহিনি জমে উঠেছে।
বটবৃক্ষের ছায়াতলে মেঝেতে মাদুরবিছানো এক পাঠশালা। বহু ছাত্রছাত্রীর মাঝে সুন্দরী, লাজুকলতা, কাজী বাড়ির রফিক মিয়ার অতি আদরের একমাত্র ভগ্নি গুনাই বিবিও একজনা। দুষ্টুমতি ছাত্রছাত্রীদের ঠাট্টা-রসিকতায় পাঠশালাটি একেবারে সরগরম। সুশীতল বায়ুর পরশে পণ্ডিত মহাশয় নিদ্রা-সংবরণ করতে না পেরে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছন্ন হয়ে গভীরভাবে নাক ডাকছিলেন। এমন সময় মরহুম লালমিয়া জমিদারের পুত্র তোতামিয়াকে সঙ্গে করে জমিদারভ্রাতা দুলুমিয়া পাঠশালায় প্রবেশ করেন। দুলুমিয়ার ডাকে পণ্ডিত মহাশয়ের ত্বরিত ঘুম ভাঙলে হট্টগোল নিবারণে তিনি তৎপর হোন। তাঁর ধমাধম বেত্রাঘাতে কয়েকজন দুষ্টু ছাত্রের পৃষ্ঠদেশ স্ফীত হলো। সবাই শান্ত হয়ে উঠলে তোতামিয়াকে পাঠশালায় ভর্তি করিয়ে দুলুমিয়া প্রস্থান করেন।
এরপর পাঠশালার পাঠ্যদান শুরু হলো।
সম্রাট আকবরের পিতার নাম জানো কি, হে ফজরুল্লাহ্? গুরুগম্ভীর স্বরে পণ্ডিত মহাশয় ফজরুল্লাহ্কে জিজ্ঞাসা করেন।
দুষ্টু ফজরুল্লাহ্র উত্তর জানা নেই। সে বলে, পণ্ডিতজি, কাইল আমার বাবার বিয়া আছিল বইলা পড়তে পারি নাই। উত্তর জানুম ক্যামনে?
ফজরুল্লাহ্র জবাব শুনে দর্শককুল হেসে ওঠে। পণ্ডিত মহাশয় খেপে গিয়ে ফজরুল্লাহকে বেত্রাঘাত করতে উদ্যত হোন। পাগলা ফজরুল্লাহ্ লুকোবার জন্য ছুটতে থাকে, গুনাই বিবির দু পায়ের ফাঁক গলে ভিতরে ঢুকতে যায়— আবারো দর্শকগণের গলাফাটানো হাসি। গুনাই বিবি এই অসভ্যটাকে পণ্ডিতজির হাতে তুলে দেয়। তিনি অনবরত বেত্রাঘাত করতে থাকেন। ফজরুল্লাহ্ লাফাতে লাফাতে সচিৎকারে পাঠশালা ত্যাগ করে; দর্শকগণ অবিরাম হাততালি দিতে থাকে।
অপর ছাত্র আল্লাদ চানের ওপর এবার পণ্ডিতজির দৃষ্টিপাত হয়।
আল্লাদ চান কাঁপতে কাঁপতে জানায়, তারও পড়া হয় নি। কারণ, আগের দিন তার মায়ের জন্ম হয়েছে। সারারাত শিশু মায়ের শুশ্রূষায় তার পড়া বন্ধ ছিল। আবারো হাসির রোল। যথারীতি দুষ্টুমির অপরাধে পণ্ডিতজির বেত্রাঘাত ও আল্লাদ চানের সলম্ফ প্রস্থান ঘটে।
আসন্ন বিপদাশংকায় তোতামিয়ার শরীর কাঁপছে। তারও উত্তর জানা নেই। পালাক্রমে তাকেও নির্ঘাত এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে, এটা সে দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছে।
তোতামিয়ার ভাবনা সত্যি হলো।
হে জমিদারপুত্র, পণ্ডিত মহাশয় বলেন, আশা করি এ প্রশ্নের জবাব তোমার জানা আছে।
তোতামিয়া লজ্জিত মুখে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
কী হে, জানা নেই? পণ্ডিতজি মৃদু ধমকে ওঠেন।
জি না, পণ্ডিতজি। অনুচ্চ কণ্ঠে তোতামিয়ার সলজ্জ উত্তর।
তা থাকবে কেন? তিনি গম্ভীর স্বরে গর্জন করে ওঠেন, তুমি তো জমিদারপুত্র! ভবিষ্যৎ জমিদার! বিদ্যাশিক্ষার কী-ই বা দরকার! তবে শুনে রাখো হে অবোধ বালক, আমার পাঠশালায় পড়তে হলে কঠিন অধ্যয়নের মাধ্যমে নিজেকে যথাযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য সর্বদাই প্রস্তুত থাকতে হবে। অন্যথায়, এ পাঠশালা তোমার জন্য নয়।
লজ্জায় তোতামিয়ার মাথা হেঁট হয়ে আসে।
পণ্ডিত মহাশয় এবার গুনাই বিবির দিকে ফিরে তাকান। গুনাই বিবি ভাব-অভিব্যক্তিহীন ভাবে পণ্ডিত মহাশয়ের দিকে তাকায়— দর্শকগণ তখন নড়েচড়ে বসে, একটা জমজমাট সংঘাত প্রত্যক্ষ করার জন্য।
তুমি কি উত্তরটা জানো, গুনাই বিবি? খুব নরম ও বিগলিত স্বরে পণ্ডিত মহাশয় জিজ্ঞাসা করেন।
জানি পণ্ডিতজি।
জানো...! পণ্ডিত মহাশয়ের আশ্চর্যবোধক প্রশ্নের সাথে সাথে গুনাই বিবির দিকে ফিরে তাকায় তোতামিয়া।
তাহলে গুনাই বিবি, জমিদারপুত্রধনকে সদর্পে জানিয়ে দাও সম্রাট আকবরের পিতা কে ছিলেন।
অত্যন্ত মিষ্ট স্বরে গুনাই বিবি জানায়, সম্রাট আকবরের পিতার নাম ছিল সম্রাট হুমায়ুন।
অতি উত্তম জবাব! মারহাবা! মারহাবা! পণ্ডিত মহাশয় ছাত্রীর পারদর্শিতায় খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। তোতামিয়াকে লক্ষ্য করে বলতে থাকেন, দেখেছো বৎস, অতি সহজ একটা প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আজ তুমি গুনাই বিবির কাছে পরাজিত হলে! তুমি জমিদারের পুত্র, গুনাই বিবি এক সাধারণ কাজীবাড়ির কন্যা। অথচ বিদ্যাশিক্ষায় কতই না তফাৎ!
পাঠশালা ছুটি হলো। কিন্তু গুনাই বিবির রক্ষা হলো না। যন্ত্রণায় তোতামিয়া ছটফট করছে। এক নারীর কাছে পরাজয়? গুনাই বিবিকে লক্ষ্য করে ক্ষিপ্ত স্বরে অপমানিত তোতামিয়া বলে উঠলো, গুনাই বিবি...সামান্য এক নারী তুমি, তোমার কাছে এই পরাজয় আমি কোনোদিন ভুলবো না হে নারী! আজ হোক, কাল হোক, এই পরাজয়ের প্রতিশোধ আমি নিবই নিব...। বলে সে দ্রুত মঞ্চ থেকে প্রস্থান করে। দর্শকদের প্রচণ্ড করতালি।
দর্শকদের মধ্যে আবারো উত্তেজনা। গুনাই বিবি আর ভালো লাগছে না। নূরজাহানকে চাই। চাই প্রিন্সেস নূরজাহানের খেমটা নৃত্য চাই।
প্রত্যেক অংক শেষ হলেই যথারীতি প্রিন্সেস নূরজাহান দৌড়ে মঞ্চে প্রবেশ করে নানান ঢঙে নানান রঙের নৃত্য নাচে। একবার সেই নৃত্য শুরু হলে দর্শকদের আগ্রহ-উত্তেজনার মুখে তা বহুক্ষণ ধরে চলতে থাকে।
যাত্রার শেষ অংক। গল্পের কাহিনি মর্মান্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গুনাই বিবির সাথে তোতামিয়ার বিয়ে হয়। তোতামিয়ার আপন চাচা দুলুমিয়া নিজেই গুনাই বিবিকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। গুনাই বিবির উপর থেকে তার কুদৃষ্টি দূর হয় না, বরং তার দেহ ভোগের জন্য দুলুমিয়া নানান ফন্দি রচনা করে ও ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে।
তোতামিয়ার পুকুরপাড়ে প্রকাণ্ড এক আম্রবৃক্ষ। সেই বৃক্ষের আড়ালে দাঁড়িয়ে তোতামিয়ার লোভী চাচা দুলুমিয়া সখীগণের সাথে স্নানরত গুনাই বিবির যৌবন দর্শন করছিল। কিন্তু গুনাই বিবি তা দেখে ফেলে। নিস্ফলাপ্রাপ্ত এবং মৃত্যু-আসন্ন সেই আড়াল দানকারী বৃক্ষটি উৎপাটনের জন্য গাঁয়ের দরিদ্র যুবক মানিককে ডাকা হয়। কুঠার দিয়ে গাছের গোড়া কাটার পর শেষ বিকেলের দিকে মটমট শব্দে বৃক্ষের পতন হলো। কিন্তু হায়, অসাবধানতা বশত বিধবা মায়ের যক্ষের ধন স্বল্পবুদ্ধি মানিক পতিত বৃক্ষের নীচে চাপা পড়ে। ঐ সময় দুলুমিয়া এবং তার সহচর রহমান খাঁ পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। মৃত্যুপথযাত্রীকে গাছের চাপা থেকে বের না করে দুলুমিয়া কুঠার দিয়ে মানিকের মাথা দ্বিখণ্ড করে তার প্রাণ সংহার করে। দুলুমিয়া নিজেই পুলিশ ডেকে আনে এবং সাক্ষ্য দেয় যে মানিক গাছের চাপায় পড়ে মারা যায় নি, বরং তোতামিয়া তাকে কুঠারের আঘাতে হত্যা করেছে। দুলুমিয়ার ভয়ে গ্রামের কোনো মানুষ তোতামিয়ার পক্ষে সত্য সাক্ষ্য দিতে পারলো না; ফলে তোতামিয়ার হাজতবাস হয়।
এমন নিদারুণ দুঃসংবাদে শোকে পাথর হয়ে যাওয়া গুনাই বিবি কেরাই নৌকা যোগে বাড়ি থেকে গঞ্জের হাজতে বন্দি তোতামিয়াকে দেখতে যাচ্ছে। নৌকার মাঝি বছির উদ্দিন এক দুষ্টুমতি উঠতি যুবক। গুনাই বিবির অসামান্য রূপলাবণ্যে মাঝির পাগল মন। মাঝ নদীতে যাওয়ার পর মাঝি বলে, ও গুনাই বিবি, গঞ্জে যাইয়া আর কাম কী? তোতামিয়ার তো ফাঁসির আদেশ হইছে। তার ফাঁসি হইয়া যাইবো গা। হায় হায়রে, এই সোনার যইবন তুমি কেমনে ধইরা রাখবা? তুমি ফিরা চলো, বাইত্তে যাই। আমি তুমারে বিয়া করুম গুনাই বিবি।
গুনাই বিবি অনেক আরতি-মিনতি সহকারে করুণ সুরে গান ধরেছে :
ও দাদা বছির রে...বছির রে
তুই যে আমার ধরমের ভাই।
ধরমের বোনরে বিয়া করবি
তোর কি লজ্জা শরম নাই?
অজস্র মিনতির পর বছির উদ্দিনের মন বিগলিত হয়। সে গুনাই বিবিকে নিয়ে গঞ্জের ঘাটে ভিড়ে।
৭
নৃত্যে ভরপুর যাত্রানুষ্ঠান যখন সমাপ্তির পথে, তখন দর্শকদের একাংশ থেকে দাবি উঠলো, তারা আরেকবার নূরজাহানের দামাল নৃত্য দেখবে। কিন্তু কাহিনি তখন দারুণ জমে উঠেছে। দর্শকদের কিছু অংশ সেই কাহিনিতে মজে গিয়েছিল। নূরজাহানের জন্য পাগলপ্রায় দর্শকদেরকে তারা হট্টগোল করতে নিষেধ করামাত্রই দু পক্ষে ভীষণ বিতণ্ডা শুরু হলো। মুহূর্তে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো, ক্রোধোন্মত্ত দর্শকদের মধ্যে ধর রে, মার রে শোরগোল উঠলো। কেউ সেই ঝগড়ায় সক্রিয় ঝাঁপিয়ে পড়ে, কেউ কেউ প্রাণের ভয়ে দিগ্বিদিক দৌড়ে পালাতে লাগলো।
যখন যাত্রানুষ্ঠান শুরু হয়, তখন সবার মনে ফুর্তির বন্যা বয়ে যায়। রাত্রি শেষে সেই অনুষ্ঠান সাঙ্গ হলে করুণ বিষণ্নতায় হৃদয় ছেয়ে যেতে থাকে, মন বলে, যদি আরো একটুখানি দীর্ঘ হতো— আরো একটুখানি দীর্ঘ হলে কত ভালো হতো!
কিন্তু আজকের অনুষ্ঠানে ওরা তিনজন প্রাণের মায়ায় যাত্রাস্থল থেকে ছুটে পালিয়েছে। তিনজন এক জায়গাতেই ছিল, হট্টগোলে মারপিট করার মতো দুঃসাহস ওদের কারোই নেই। গণ্ডগোল শুরু হওয়ামাত্রই তিনজনে একসাথে উঠে পড়ে ছুট দিয়েছিল। আবছা অন্ধকারে দৌড়ে পালাতে গিয়ে বার বার হোঁচট খেলো, উপুড় হয়ে পড়ে গেলো, হাঁটুতে ব্যথা পেলো, পা মচকালো, এত মানুষের ভিড়ে ওরা পরস্পরকে হারিয়ে ফেললো। কিন্তু ওরা কোথাও থামলো না, বরং ছুটন্ত মানুষদের সাথে ওরাও বেদম দৌড়াতে লাগলো। পেছন থেকে মাঝে মাঝেই ধর-ধর শোর উঠতে থাকে, মনে হয় কারা যেন তেড়ে আসছে, দৌড়ের গতি তখন দ্রুততর হয়।
কিছুদূর আসার পর যখন মনে হলো বিপদ কেটে গেছে, তখন কুটিমিয়া থামলো। তার সামনে-পিছনে মানুষের দৌড়ানোর আওয়াজ, কিংবা হাঁটা ও ছোটো ছোটো কথাবার্তা শোনা যায়। রহিমুদ্দিন আর নুরুমিয়া কি তার সামনে, নাকি এখনো পেছনে পড়ে আছে? কুটিমিয়া ভেবে স্থির করতে পারে না। কয়েক দণ্ড সে দাঁড়ালো, পেছন থেকে বেশ কয়েকজন মানুষ তাকে অতিক্রম করে চলে গেলো, কিন্তু রহিমুদ্দিন আর নুরুমিয়া সেই দলে নেই। গায়ের শক্তি ও চাতুর্যে ওরা দুজন কুটিমিয়ার চেয়ে অধিক পরিণত। ওদের পিছে পড়ে থাকবার কোনো কারণ নেই। কুটিমিয়া দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে, ওরা সামনেই আছে, ওদেরকে ধরতে হবে। ওদেরকে ছাড়া একা এই বিরান চক সে পাড়ি দিতে পারবে না।
একটু অগ্রসর হয়েই দুজন লোকের দেখা পায়, তাদেরকে সে চিনে, যদিও তারা তাকে চিনে না। তারা কুটিমিয়াদের গ্রামের পাশ দিয়ে তাদের নিজ গ্রামে যাবে। কুটিমিয়া সেই দলে ভিড়ে যায়।
এ দুজন লোক বড়ো আমুদে। তারা এখন হেলেদুলে গলায় মধু ঢেলে প্রিন্সেস নূরজাহানের গান ধরেছে...রূপে আমার আগুন জ্বলে, যৌবন ভরা অঙ্গে...। নুরু আর রহিমুদ্দিন এ দলে থাকলে সে-ও এখন গলা ছেড়ে এই গান গেয়ে উঠতো। কিন্তু অল্পচেনা মানুষের সাথে গানের তাল ধরাটা বিষম লজ্জাকর।
চৈতিবিবির বটগাছের তলায় আসতেই কুটিমিয়া শুনতে পেলো, পেছনে দূর থেকে কারা যেন ওর নাম ধরে ডাকছে, ও কুডি, কুডি রে...
কুটিমিয়া থমকে দাঁড়ায়। কান খাড়া করে শোনে নুরু আর রহিমুদ্দিন ওকে ডাকতে ডাকতে এদিকে এগিয়ে আসছে। কুটিমিয়ার মনে হলো সে যেন কোনো এক দূরদেশে অচেনা রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ সে চেনা মানুষের দেখা পেলো। সে আনন্দে চিৎকার দিয়ে ওঠে, আমি এই যে এইহানে রে, ও নুরু, আমি বটগাছের তলায়...
নুরুও চিৎকার করে বলতে থাকে, খাড়া...আমরা আইফার লাগছি। তরে কত খুঁজলাম...
কুটিমিয়ার গলায়ও এবার গান আসে। সে গাইতে থাকে, রূপে আমার আগুন জ্বলে...
সে হঠাৎ অনুভব করে তার বেশ প্রস্রাবের বেগ পেয়েছে, এতক্ষণ মোটেও টের পায় নি। গান গাইতে গাইতেই সে বটতলায় খালের পাড় ঘেঁষে প্রস্রাব করতে বসে পড়ে।
প্রস্রাব করতে বসেই তার শরীরে জাড়কাটা দিয়ে ওঠে ভয়ে। দিনের বেলায়ও এই বটগাছের নীচে একাকী দাঁড়িয়ে থাকার সাহস তার কখনো হতো না। কাছের মানুষ দুজন ওর জন্য থামে নি, থামার প্রয়োজনও মনে করে নি। একাকী এই অন্ধকারে সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো; ওর চিৎকার দিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ভয়ে চিৎকার দিতে নেই, তাহলে ভয় আরো বহুগুণ বেড়ে যায়, সে জানে। নুরু আর রহিমুদ্দিন কতদূর?
ভয় পাওয়ার উপক্রম হলে জোরে কথা বলতে হয়, মুখে শব্দ করতে হয়, ভয় কেটে যায়।
প্রস্রাব সেরে ঘন ঘন কয়েকবার কেশে সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। এমন সময়ে সে অনুভব করলো তার দু ঘাড়ে আলগোছে দু পা ফেলে কে একজন এসে দাঁড়ালো। চকিতে দু দিকে দু হাত তুলে ঘাড় স্পর্শ করতেই কার শক্ত দু পায়ের ওপর হাত পড়ে, অমনি সে ও-বাবারে বলে গগণভেদী চিৎকারে দৌড়ে পেছন দিকে ছুটতে থাকে, কাঁধে ভর করে দাঁড়ানো জন্তুটাও মনে হলে তাকে ধরবার জন্য লম্বা কদম ফেলে ধেয়ে আসছে, কুটিমিয়া প্রাণপণে দৌড়াতে গিয়ে বার বার হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়, তার গলার আওয়াজ শুকিয়ে যেতে থাকে, দৌড়াতে দৌড়াতে নুরু আর রহিমুদ্দিনের পায়ের কাছে এসে যখন দড়াম খেয়ে পড়ে গেলো তখন সে পুরোপুরি অজ্ঞান।
নুরুমিয়া ও রহিমুদ্দিনও বিষম ভয়ে কী অইছে রে, কী দেখছা তুই বলে প্রায় চিৎকার দিয়ে ওঠে। তখন পেছন থেকে আসা আরো কয়েকজন লোক ওদের সাথে জড়ো হয়, পোড়ো জমিদার বাড়ির ভিতর থেকে দু-তিনজন মানুষ দৌড়ে আসে। কুটিমিয়ার মুখ হতে মৃগী রুগীদের মতো অনর্গল ফেনা বের হতে থাকে। ধরাধরি করে ওকে পোড়ো বাড়ির এক ঘরে নিয়ে যায়। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়ার পর কুটিমিয়ার জ্ঞান ফিরতে থাকে, কিন্তু তার চোখে বিপুল ভয়। ঘন ঘন তার শরীর ঝাঁকি দিয়ে ওঠে।
কতা ক কুডি। কী দেখছিলি? ভূত? নুরু আর রহিমুদ্দিন জিজ্ঞাসা করে।
জানি না কী দেকছি। পেশাব কইরা খাড়াইবার লাগছি, অমনি কান্দের ওপরে আইয়া খাড়াইলো। আমি নড়তেও পারি না, সরতেও পারি না। দইড় দিলাম, খালি আছাড় খাইয়া পইড়া যাই। দেহি কী আমারে ধরবার লিগা পাছে পাছে ধাওয়া করবার লাগছে। তারপর আর জানি না।
পুবের আকাশে অরুণোদয়ের ঈষৎ রক্তিমাভা ফুটতে শুরু করেছে। দূর থেকে ভেসে আসছে আজানের সুমধুর ধ্বনি। আজানের সেই সুর শুনেই কুটিমিয়া বলে ওঠে, ও নুরু, জলদি নু। মায় তো অহনেই নামাজ পড়বার উইড্যা পড়বো। ভূতের ভয়ের চেয়ে মায়ের বকুনির ভয়ে সহসা কুটিমিয়ার মন শঙ্কাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রতিদিনই ভোরবেলা আজানের শব্দে তার মা ঘুম থেকে জাগে। শাশুড়ি ডেকে তোলেন। সুর করে কালিমা তৈয়ব পড়তে পড়তে ঘরের ঝাঁপ খুলে বউ-শাশুড়ি বাইরে বেরোন, প্রাতঃক্রিয়াদি শেষে ওজু করে ঘরে ঢুকে জায়নামাজে বসেন। জায়নামাজের পেছনেই কুটিমিয়া শোয়। মা তাকে অন্তত একবার হলেও বলবেই, বাজান, ওড্, নামাজ পড়বি না? নামাজ পড়্। অহনে তুই বড়ো অইছা না? বড়ো অইয়া নামাজ না পড়লে আল্লায় গুনা লিগবো। কুটিমিয়ার খুব আলসেমি লাগে। মায়ের কথায় সে মাঝেসাঝে নামাজ পড়েও। তবে তার বাবা এ ব্যাপারে খুব কড়া গলায় আদেশ করেন। সেই আদেশে সে ঠিকই বাধ্যগতের মতো বাবার পাশ ঘেঁষে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিছু কিছু সুরা সে মা ও দাদির কাছ থেকে মুখস্থ করেছে। অন্যান্য তরিকাও কিছুটা তার রপ্ত হয়েছে। শুধু আলসেমি ছাড়তে পারছে না বলে নামাজটা তার ঠিকমতো আদায় হচ্ছে না। এজন্য তার কিশোর মনও মাঝে মাঝে বিবেকদংশিত হয়; তখন সে মনকে সান্ত্বনা দেয়, সামনে কত্ত সময় পইড়া আছে! একদিন শুরু অইবোই।
কুটিমিয়ার মনে ভয় জাগে, তার মা যখন তাকে নামাজের জন্য ডাকবে, কিংবা তার শোয়ার জায়গার সামনে জায়নামাজ বিছাবে, তার দাদির পেছনে তাকে দেখতে পাবে না; দেখতে না পেয়ে মা ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠবে, পাড়া-পড়শি জড়ো হবে, ঘর হতে তরতাজা কুটিমিয়া কোথায় হারিয়ে গেলো এই তরাসে তখন সারা গাঁয়ে শোর উঠবে। কুটিমিয়া অবশ্য সামান্য সাহসও পেলো মনে। মা নিশ্চয়ই জানবে সে নুরুমিয়া আর রহিমুদ্দিনের সাথে আজ যাত্রা দেখতে না গিয়ে পারে না। আরেকটা বিষয়ও তার মাথায় ঢুকলো। মায়ের অবাধ্য হয়ে ঘরের বাহির হওয়া তার জন্য অমার্জনীয় অপরাধ। সেই অপরাধের শাস্তিদানের কথা না ভেবে মা যখন দেখবে ভোর হয়ে গেছে, অথচ একরত্তি কুটিমিয়া এখনো ঘরে ফিরে নি, ঘোর অমঙ্গলের আশংকায় তার মন তখন বিষম উতলা হয়ে উঠবে।
কুটিমিয়া শরীর ঝাঁকি দিয়ে ত্বরিত উঠে দাঁড়ায়। বলে, জলদি নু। বলেই নুরু কিংবা রহিমুদ্দিনের উত্তরের অপেক্ষা না করে হনহন করে হাঁটতে থাকে কুটিমিয়া।
ও কুডি, খাড়া। খাড়া...অহনতুরি অনেক রাইত। আবারো বটতলা দিয়া মরবার যাবি? কুটিমিয়ার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে নুরুমিয়া বলে। রহিমুদ্দিনও হাঁটতে থাকে।
বটতলা দিয়া যামু ক্যান? ঘুইরা আইল দিয়া যামু। হাঁটতে হাঁটতে কুটিমিয়া জবাব দেয়।
ওরা বটতলা দিয়ে গেলো না। রাস্তা থেকে নেমে তিন-চারটি ক্ষেত পার হয়ে আইল ধরে হেঁটে ঘুরে আবার রাস্তায় উঠলো। ওরা খুব দ্রুত হাঁটছে। কুটিমিয়ার মনে এখন একটুও ভূতের ভয় নেই, শুধু মায়ের ভয়। কিন্তু নুরুমিয়া আর রহিমুদ্দিনের কাছে মনে হতে লাগলো ওদের পেছনে কেউ একজন লম্বা কদম ফেলে ধেয়ে আসছে, সেই ভয়ঙ্কর জন্তুটা, যেটা পা ফেলে কুটিমিয়ার কাঁধে ভর করে দাঁড়িয়েছিল। ওরা দুজন আরো জোরে, আরো জোরে, প্রায় দৌড়ে ছুটতে চায়। নুরুমিয়া একবার ভাবলো সে কুটিমিয়াকে পাশ কেটে আগে চলে গিয়ে লম্বা এক ছুট দেয়। আবার ভাবে ওর পিঠে ধাক্কা দিয়ে বলে, চালাইয়া আটতে পারস না? আরো জোরে পা চালা। কিন্তু বললো না, কারণ সে জানে, তার এ কথায় সে শুদ্ধ তিনজনেই একযোগে দৌড় লাগাবে, কিংবা বাড়ির কাছে এসেও ভয়ে নিজেদের চিৎকারে নিজেরাই আন্ধাকুন্ধা জ্ঞান হারাবে।
দরজার কাছে এসে কুটিমিয়া মুহূর্তকাল দাঁড়ায়, তারপর খুব আস্তে ঝাঁপ খুলে ভিতরে ঢোকে। পা টিপে নিজের শোবার জায়গায় যায়, আলগোছে শুয়ে পড়ে। শুয়ে পড়ে সে মনে মনে খুব শঙ্কামুক্ত হয়, আবার আশ্চর্যও হয়, ব্যাপারডা কী, মায় কি আহনের আগেই ফজরের নামাজ পইড়া শুইয়া পড়ছে নিকি?
৮
বালক কুটিমিয়া নিশ্চিন্তে স্বস্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিন্তু যাত্রা-নৃত্যোপভোগে নির্ঘুম রাত্রিজাগরণের ফলে দিবাভাগে বিলম্বিত নিদ্রাটুকু স্বপ্নের ঘোরে প্রিন্সেস নূরজাহানের কামোত্তেজক তুমুল নৃত্যঝঙ্কারময় হলো; ঘরের পেছনে রাস্তায় মানুষ ও গো-পশুর চলাচলে বার বার তার ঘুম ভাঙলো, যন্ত্রণায় তার দু চোখ জ্বলে যেতে থাকলো। এমনি আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে সে শুনতে পেলো, রাস্তায় বহু মানুষ ছোটাছুটি করছে আর বলাবলি করছে, আহহারে, এমন সুন্দর বউডা গলায় দড়ি দিল? চমকে লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায় কুটিমিয়া। ভীষণ একটা চিৎকার সে দিবে কী দিবে না, তার চাঁদের মতো রূপবতী মায়ের মনে কোনো দুঃখ নেই, মা কেন আজ নামাজ পড়তে ওঠে নি? আমার মায় কি গলায় দড়ি দিছে? ও মা লো...। বিকট চিৎকারে ঘর থেকে বের হতে উদ্যত হতেই তার আতঙ্কিত মা দৌড়ে সামনে আসে, কী রে বাজান? চিক্কর দিলি ক্যান? মা-ও সচিৎকারে ছেলেকে বুকে জাপটে ধরে। মায়ের বুকে মাথা গুঁজে বালক ঘন ঘন শ্বাস ফেলে, ভয়ার্ত জননীরও সর্বাঙ্গ থরোথরো কাঁপে।
কী অইছে, আমার জাদু সুনামণি?
কুটিমিয়া মাথা তুলে দাঁড়ায়। তার বুকের ধড়পড়ানি ধীরে ধীরে স্তিমিত হচ্ছে। বলে, তুই আইজ নামাজ পড়স নাই?
মা এ কথার জবাব না দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কিছু স্বপ্নে দেখছা বাজান?
হ। দেহি কি তুই গলায় দড়ি দিছা।
মা তার মৃদু ম্লান হাসে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, যা দেকছা বালোই দেকছা রে বাজান। পুরীর মোল্লা বাড়ির সুন্দরী বউডা আইজক্যা ফাঁসি দিয়া মইরা গেলো। বাছছে।
এবার কুটিমিয়া বুঝতে পারে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মানুষ যে-কথাগুলো বলাবলি করছিল, ঘুমের ঘোরে সে সেই কথাগুলোই শুনছিল।
চঞ্চল ভাবে কুটিমিয়া বলে, মা, আমি গেলাম। দেইক্যা আহি। আর দেরি করে না। দ্রুত রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। অনেক মানুষ, মহিলা-পুরুষ, তরুণ-বৃদ্ধ, যেন সামনেই কোনো উৎসবে তারা যোগ দিতে যাচ্ছে, দ্রুত হেঁটে চলছে দোহার পুরীর দিকে। রাত্রে তারা তিনজন এই রাস্তা ধরেই যাত্রা দেখতে গিয়েছিল। এত মানুষ— সে তাদের দলে মিশে যায়— কত আফসোস তাদের—
গরীব ঘরের ম্যায়া বইল্যাই তো ঐ লোচ্ছাটার কাছে বিয়া অইছিল— নাইলে কি পরীর মতোন এই রাজকন্যা ওর কফালে জুটতো?
এমন সুন্দর বউ থুইয়া কেউই বাইয়ালির লগে আকাম করে?
এইগুনি অইলো মিয়া হস্তিপুরুষ। ঘরের মাইয়া মানুষে তাগো অয় না।
মাদবরের পুলা তো।
পাষণ্ড। দেইক্কো, কাইলই আরেকটা বিয়া কইরা ফালাইবো।
ছুডো ছুডো ম্যায়া দুইডার অহনে কী অইবো কউ দেহি?
চকের মাঝামাঝি আসতেই কুটিমিয়া দেখে, চৈতিবিবির বটতলায় মানুষ থৈথৈ করছে। বটগাছের তলায় এত মানুষ কেন? বউডা কি বটগাছে ফাঁসি দিল?
ফাঁসিতে ঝুলে থাকা কোনো মানুষ কুটিমিয়া কখনো দেখে নি এর আগে। একটা দীর্ঘ চঙ্গ, এই চঙ্গ বেয়ে এই দুঃখিনী রূপবতী বউটি বটের শাখায় উঠেছিল। আসমানী রঙের একটা শাড়ি তার পরনে, এ রকম শাড়ি কুটিমিয়ার মা-ও পরে; মুখখানি দারুণ ফ্যাকাশে, ঘাড় কাত করে ঝুলে আছে, মুখের বামপাশ ঘেঁষে জিহ্বার কিছু অংশ বেরিয়ে...কুটিমিয়ার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। বউটার পা বরাবর নীচের কিছু জায়গা ঘের দিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে কেউ মৃতকে স্পর্শ করতে না পারে। থানা থেকে পুলিশ আসবে, তারাই মৃতদেহ প্রথম স্পর্শ করবে।
হঠাৎ কুটিমিয়ার আবছা আবছা খেয়াল হয়, রাতে যাত্রা থেকে ফেরার পথে সে ঠিক ঐখানটাতে দাঁড়িয়েছিল, যেখানে এখন বেড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। আহ্হারে, বউটার পায়ের তলাই তার ঘাড়ের কাছে লেগেছিল, এখন তা স্পষ্ট মনে হয়। এমনও তো হতে পারে, তখনও সে মরে নি, মরার আগের অবস্থায় সে ছটফট করছিল। না, তা হয় না। তা হলে তার খিচুনির শব্দটুকু অন্তত সে শুনতে পেতো। সে ভাবে, যদি সে বুঝতে পেতো ওটা ফাঁসিতে ঝুলে থাকা একটা মানুষ, কী করতো সে? সে জানে, সেটা জিন বা প্রেতের ভয়ের চেয়েও ভয়াবহ হতো।
ই-বুক (উপন্যাস) : লৌকিক রহস্য; অথবা অলৌকিক
ক্ষমাপ্রার্থনা :
আমার আগের একজন অসূয়াবতী, অহংকারই যার সৌন্দর্য অথবা সম্পদ শীর্ষক কবিতাপোস্টে এখনো ১৯টি কমেন্টের উত্তর দিই নি। আমি অত্যন্ত লজ্জিত ও দুঃখিত। বিশেষ ব্যস্ততার কারণে এমনটা হচ্ছে। ব্লগে সক্রিয়তা বজায় রাখার স্বার্থে এবং নিজেকে সান্ত্বনা দিতেই এই পুরোনো পোস্ট। এই পোস্টটি যদি কেউ পড়েন এবং কমেন্ট করেন, তার উত্তর দিতে দেরি হতে পারে। তবে, অতি শীঘ্রই আগের পোস্টের কমেন্টের রিপ্লাই দিব আশা করি। ধন্যবাদ সবাইকে।
২৯ শে নভেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:৫১
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: প্লাস দেয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রিয় বিজন রয়। শুভেচ্ছা রইল।
২| ২৫ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ১১:৩৬
আফলাতুন হায়দার চৌধুরী বলেছেন: শুরু টা ভালো লেগেছে। পুরোটা পড়ে কমেন্ট করবো আশা রাখি।
২৯ শে নভেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:৫৭
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: শুরুটা ভালো লেগেজে জেনে খুবই আনন্দিত হলাম। ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা রইল।
৩| ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৩ ভোর ৫:৩২
কামাল১৮ বলেছেন: অনেক অনেক বড় ধন্যবাদ।
২৯ শে নভেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:৫৯
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: পোস্ট কত বড়ো হতে পারে, তার একটা সাধারণ উদাহরণ দিলাম আর কী
পোস্টে আসার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রিয় কামাল ভাই। শুভেচ্ছা।
৪| ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:৩৪
রাজীব নুর বলেছেন: বড় লেখাকে আমি ভয় পাই না।
ভালো লেখা হলে, আমার বড় লেখা কোনো সমস্যা না।
আপনার কুটি মিয়াকে নিয়ে সব গুলো লেখা আমি আগ্রহ নিয়ে পড়েছি।
©somewhere in net ltd.
১| ২৫ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ১১:০৯
বিজন রয় বলেছেন: অনেক বড় পোস্ট তাই প্রথম প্লাস দিয়ে চলে গেলাম।
সময়-সুযোগ হলে কথা হবে।
মার্জনা করবেন।