নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চিন্তা

লেখক

ফারুক আহমেদ ৬৭

নামঃ ফারুক অহমেদ পেশাঃ শিক্ষকতা সখঃ বই পড়া , চিন্তা করা , লেখা , বেড়ানো, বাগান করা , ছেলের সাথে গল্প করা।

ফারুক আহমেদ ৬৭ › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রিয়জনের মৃত্যু

২০ শে জানুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:১৮

প্রিয়জনের মৃত্যু

‘জন্মিলে মরতে হবে’,‘পৃথিবীতে কেউ চিরকাল বাঁচেনা’,‘তোমাকেও একদিন চলে যেতে হবে এই পৃথিবী ছেড়ে’-এ সবই কেউ মারা গেলে প্রিয়জনের কান্না থামানোর জন্য বহুল ব্যবহৃৎ ,বহুল উচ্চারিত সাধারণ কথা।যে আজ বাঁধ ভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ছে হয়তো সে নিজেও বহুবার অন্যকে এই কথাগুলো বলেছে ।একদিক দিয়ে এই কথাগুলো এতই সহজ যে,অবোধ শিশু ছাড়া পৃথিবীতে মনে হয় একটি মানুষও পাওয়া যাবে না যে এই কথাগুলো বুঝতে পারে না ।অপরদিকে এই কথাগুলো এতই কঠিন যে,অবোধ শিশু সহ একটি মানুষও পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে প্রিয়জনের মৃত্যুর বুঝ এই কথাগুলোর মধ্যদিয়ে পেতে পারে ।কান্না থামেনা ,কান্না থামতে চায় না ।

মৃত্যু মানুষকে কাঁদায়।যে মানুষ অভিব্যক্তিতে কত কিছু প্রকাশ করতো,যে মানুষ কত রকমের কথা বলতো,প্রতিনিয়ত নতুন-নতুন স্মৃতি তৈরী করতো-সেই মানুষ অভিব্যক্তিতে আর কোন দিন কোন কিছু প্রকাশ করবে না,কোন দিন আর একটি কথাও বলবে না ,আর একটিও নতুন স্মৃতি তৈরী করবে না- সেই মানুষ হারিয়ে গেছে!মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। মৃত্যু যতই অমোঘ সত্য হোক মানুষের মৃত্যুর বড় ভার ।সকল মানুষের মৃত্যুর ভার সমান নয় ।আবার একই মানুষের মৃত্যুর ভারও সবার কাছে সমান নয় ।একটি মৃত্যু কারো কাছে নিতান্তই কষ্টের । কারোর কষ্ট মনের মধ্যে শরতের মেঘের মত মেঘ জমিয়ে দুই এক পশলা বৃষ্টি ঝরায়।কারোর কষ্ট স্মৃতিগুলোকে বৈশাখী খররৌদ্রে বাষ্পাকুল করে তুলে আকাশ ফেড়ে বের করে আনে কালবৈশাখীর প্রচন্ডতায়।আর প্রিয়জনের কষ্ট?সে কষ্টের মেঘ বৃষ্টি ঝরিয়ে শেষ হয় না ।দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত স্মৃতির মেঘগুলোতে পূর্ণ হয় ।স্মৃতির মেঘেরা জানান দেয় আঘাঢ়ের গুরুগম্ভীর আওয়াজে ।আকাশ থেকে নেমে আসে শ্রাবণের অবিরত ধারায় ।এ স্মৃতির শেষ নেই, এ মেঘের শেষ নেই ,এ ধারার শেষ নেই ।

প্রিয়জন কে? কি ধরনের সম্পর্ক থাকে প্রিয়জনের সাথে?আপনজন আর প্রিয়জন কি সমার্থক?সব আপনজন কি প্রিয়জন হয় ?মানুষে-মানুষে সম্পর্কগুলো নিয়ে‌ সম্ভবতঃ সব মানুষেরই মনের মধ্যে এসব প্রশ্ন ভীঁড় করে ।প্রিয়জনের সঠিক সংজ্ঞা নিরূপণ করা কঠিন।ভিন্ন-ভিন্ন মানুষের কাছে কোন মানুষ ভিন্ন-ভিন্ন কারণে প্রিয় হতে পারে।আবার একই মানুষের কাছে কোন মানুষের প্রিয় হওয়ার শর্ত তার অবস্থা, সময়,চাহিদা,পরিপার্শ্ব ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে ।সমাজের অসামঞ্জস্যতার মধ্যদিয়ে উদ্ভুত নীতি বহির্ভুত অসংগত চাহিদাহেতু তাৎক্ষণিকভাবে কেউ প্রিয়জনরূপে আবির্ভুত হতে পারে ।এরকম প্রিয়জন সম্পূর্ণ বাহ্যিক , মনের মধ্যে কোন স্থায়ী আসন তৈরী করতে পরে না ।মনের মধ্যে যে প্রিয়জন স্থায়ী আসন বসায় সে কোন নীতিহীন চাহিদা পূরণের জন্য সৃষ্টি হয় না এবং তা করেও না ।সে প্রিয়জন জীবনের কোন না কোন ন্যায়সংগত সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আবির্ভুত হয় এবং জীবনের প্রতিটি সংগ্রামে,উল্থানে-পতনে,সুখে-দুঃখে,আনন্দে-বেদনায় সাথে থাকে।সে প্রিয়জন সব সময় কৃত্রিমভাবে কতকগুলো ফর্মাল মিষ্টি-মিষ্টি ,ভালো-ভালো কথা বলে না ।সে প্রিয়জন আদর করে যেমন ,স্নেহ করে যেমন ,ভালবাসে যেমন তেমনই আবার শাসনও করে।সে প্রিয়জন সবসময় শুধু মিষ্টি-মিষ্টি ভালো কথাই বলে না তিক্ত কথাও বলে ।জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর চড়াই-উৎরাইয়ের মাঝে কোন সময় তিক্ততার সৃষ্টি হলেও মনের মধ্যে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছে যে প্রিয়জন ,সে কখনো ছেড়ে যায় না ।সেই প্রিয়জন যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় তখন তার ভার অনেক বড় হয়ে বুকের মধ্যে অনড় পাথরের মত চেপে বসে ।

যাঁর মৃত্যুতে আমার এসব এলোমেলো অনুভুতি তিনি একজন অতি সাধারণ মানুষ;আমার শ্বাশুড়ী।গত ১৬ জানুয়ারি, সোমবার রাত সাড়ে ন’টার সময় এই অতি সাধারণ মানুষটি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ।চারদিকে বিশেষ মানুষ,বিশেষ হওয়ার প্রকল্পের মধ্যে ঢুকে পড়া মানুষ আর ঢুকে পড়ার জন্য লাইন দেওয়া মানুষের এতই ভীঁড় যে,আজকের দিনে সাধারণ মানুষকে খুঁজে পাওয়া কঠিন।সাধারণ মানুষ খুঁজতে যেখানে যেতে হয় তাঁদের কথা কেউ লেখে না ।চারদিকে বিশেষদের বন্দনা, মহত্ত্ব গাথা ।কেউ পদ-পদবীতে বিশেষ,কেউ বিত্ত-বৈভবে বিশেষ, কেউবা আবার সেসব বিত্ত্ব-বৈভবে মানুষের কর্মসংস্থানে বিশেষ;কেউ দান-খয়রাতে বিশেষ,কেউবা আবার মানুষের কষ্ট-দারিদ্র বিক্রির মাধ্যমে মুনাফা করে দেশের জন্য সন্মান(!)কেনায় বিশেষ ।এসব বিশেষদের সাফল্য সোপানের প্রস্তর একটি একটি করে সরালে বের হয়ে পড়বে তাদের সাফল্যে চাপা পড়া অসংখ্য মানুষের কষ্ট আর বঞ্চনার আহাজারি।সেখান থেকে বের হয়ে আসবে বিশেষদের বিত্ত-বৈভবের পুঁজির ইতিহাস।পুঁজির উৎস হিসেবে সেখানে দেখা যাবে হাড্ডিসার কংকাল সদৃশ মানুষ, বন্যা-জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত মানুষ আর প্রতিদিন দারিদ্রের সাথে লড়াই করা অসংখ্য মানুষের শুকিয়ে যাওয়া রক্ত, ঘাম আর কংকালের স্তুপ ।চুরি-জোচ্চুরি,দুর্নীতি-লুন্ঠন তথাকথিত মেধাবিদের যোগ্যতা হিসাবে এই বিশেষেরা সমাজে একটি ফিলোসফি দাঁড় করাতে চায় ।তারা আজ ব্যাপক অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফলও বটে।তাই বড় চুরির সাফল্য(!)কে সাধারণভাবে যোগ্যতা হিসাবেই দেখা হচ্ছে।এসব সফলেরা যে অতি সাধারণ এই মানুষটির চারপাশে ছিল না তা’ নয় । সাফল্যের চাবি তাঁর সামনে দিয়েও ঘুরানো হতো।তিনি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে কি এইসব সফলদের সাফল্যের চাবি তাঁর হাতেও উঠতো? দৃঢ়ভাবে ‘না’ বলা কঠিন ।অসংখ্য মানুষের আহাজারি জড়ানো এইসব সাফল্যের চাবি তাঁর মত সহজ সাধারণ মানুষের হাতে তুলে দিয়ে তাঁদের অজান্তেই এসবের অংশিদার বানানোর সংখ্যাতো নিতান্তই কম নয় ।

তিনি ছিলেন খুবই সাধারণ মানুষ । না, তাঁর নামের আশেপাশে কোন কিছু যুক্ত ছিল না ।এমনকি তাঁর নামটিও রোগের প্রেসক্রিপশনে অথবা জাতীয় পরিচয়পত্রের ওপর অথবা সন্তানদের কোন কাগজপত্রে ছাড়া সাধারণভাবে কখনো কোনদিন উচ্চারিত হয়েছে কিনা বলা মুশকিল।সকল সাধারণ নারীর মত মৃত্যুর সংবাদ ঘোষনার সময়ও তাঁর নাম উচ্চারিত হয়নি ।স্বামীর নাম আর সন্তানের নামেই এসব সাধারণ নারীর পরিচয় ।আজ খুবই মনে হচ্ছে আমাদের গ্রামের অতি পরিচিত প্রিয় চাচি-খালাদের নাম কি কখনো শুনেছি?মনে পড়ে না !ইসলামের মা , আলালের মা… … পরিচয়েই তাঁদের জেনে এসেছি!তিনি এমনই একজন মানুষ ছিলেন।অপরের বিপদে ছুটে যেতেন ।না, সম্পদ নিয়ে ছুটে যাওয়ার যোগ্যতা তাঁর ছিল না ।ভারি নামও তাঁর ছিল না ।তিনি ছুটে যেতেন তাঁর দিলদরাজ অন্তরখানা নিয়ে ।ভারি নামওয়ালা মানুষ তাঁর আশেপাশে ছিলেন ।তাঁর, তাঁর স্বামীর,তাঁর সন্তানদের আপনজন,নামের আশপাশ অনেক ভারি এমন মানুষের অন্তরের ভার অনেক কম ।এই সাধারণ মানুষটি যখন স্বামীর অসুস্থতায় একটিও রোজগারে সক্ষম নয় এমন সন্তানদের নিয়ে বিপর্যস্ত ,দিশেহারা তখন, এমন ভারি নামওয়ালা আপনজন সাহায্যের নামে ভবিষ্যৎ মুনাফাই দেখেছেন ।অসহায় অবস্থায় দেয়া টাকার বিনিময়ে চরম দুর্দিনে তাঁকে অসহায়-অসুস্থ স্বামী এবং সন্তানদের সহ ভিঁটে থেকে উচ্ছ্বেদ করেছেন।সেখানে প্রাচীর তুলে দিয়েছেন ।দালান তুলে ভাড়া দিয়েছেন।শেষ পর্যন্ত অতি উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে দিয়েছেন।যে মূল্যের কাছে অসহায় অবস্থায় মানুষটিকে দেয়া টাকা সমুদ্রের কাছে গোস্পদ ।নামওয়ালা মানুষের অনেক মুনাফা হয়েছে।মুনাফা অবশ্য নামওয়ালা মানুষদেরই হয় ।এর কোন প্রয়োজন ছিল না ।কিন্তু মুনাফা এমনই জিনিস যা’ প্রয়োজন অপ্রয়োজন মানে না ।আমার শ্বাশুঢ়ীকে এ নিয়ে কোনদিন একটি কথা বলতে শুনিনি বা আক্ষেপ করতে শুনিনি।তাঁর চোখের সামনের প্রাচীরের ওপর কি কোনদিন তাঁর দীর্ঘশ্বাস পড়েছে?নিজের অসহায়ত্বের যন্ত্রনায় চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে ? কোনদিন প্রকাশ করেননি।এজন্যই তিনি সাধারণ,তাঁর অন্তরের ওজন আমাদেরকে স্পর্শ করে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.