নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি খুব সাবলীল ভাষায় আমার গল্পগুলো লেখার চেস্টা করি এবং সেখানে সাহিত্য রসের মাধ্যমে বিভিন্ন চরিত্র সৃষ্টি করে মানুষের কাছে বার্তা দেয়ার চেস্টা করি।আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য মানুষ আনন্দের সাথে গল্প এবং লেখগুলো পরবে তারা যেন বিরক্ত না হয়।

গ্যাটলিন জুনিয়র

আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি।

গ্যাটলিন জুনিয়র › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডিপলুর আইসক্রিম " ছোট গল্প "

০৬ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১২:০১

ডিপলুর আইসক্রিম

দেরী হয়ে গেল,দেরী হয়ে গেল বলতে বলতে আর চোখটা মুছতে মুছতে সকালের ঘুম ভাঙলো ডিপলুর।চটজল্দী করে বিছানাটা ছেরে ঘরের দরজাটা খুলে দিল।দরজা খুলতেই গাছের পাতার ফাক দিয়ে এক খণ্ড মৃষ্টি রোদের আলো ডিপলুর ঠিক চোখে এসে লাগলো আর সাথে সাথেই ঘুমকাতর চেহারাটা জ্বল জ্বল করে উঠলো।
ডিপলু দ্রুতগতিতে ঘরের পিরা থেকে নেমে আঙিনার উপরে থাকা তার বন্ধী কবুতর গুলো মুক্ত করে দিয়েই চলে গেল রান্না ঘরে।কবুতর পালন করা তার ছোটো বেলা থেকেই একটা পেশাই বলা চলে।রান্না ঘরের মাটির চুলোর ভিতর থেকে এক কোষ ছাই নিয়ে চলে গেল সোজা পুকুরঘাটে,ঘাটের কাজটা সেরে আসলো। পৃথিবীতে তার আপন কেউ নেই বললেই চলে,খুব ছোটো থাকতেই মা,বাবা কে হারায় সে।বাবার রেখে যাওয়া বাড়ির ভিটাটা আর পেষাগতভাবে আইসক্রিমের গাড়িটা ছাড়া এতিম ডিপ্লুর কিছুই ছিল না।তার বাবা ছিলেন একজন আইসক্রিম বিক্রেতা।তাই বাবার উত্তরসূরী হিসেবে ছেলে আইসক্রিম বিক্রিটাই তখন থেকে বেছে নিয়েছিলো। প্রতিদিন সে সকাল বেলা তার আইসক্রিমের গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে যায় আবার সন্ধ্যা বেলা বাড়িতে ফিরে,আর রাতের খাবার টা নিজেই রান্না করে খায়। প্রতিদিনের মতো,গাড়িটা তালা মুক্ত করে গাড়িটাকে সাজাতে লাগলো।প্রতিদিন সকালে গাড়ি নিয়ে বের হবার আগে খুব আপন করে গাড়িটাকে সাজায়।আর দশ জনের মত না ডিপ্লুর আইস্ক্রিম বিক্রিটা একটু ভিন্ন।সে সবসময় নতুন নতুন গান বাজিয়ে একটু বিনোদনের মাধ্যমে আইস্ক্রিম বিক্রি করার চেস্টা করত।গাড়ির পিছনে একটা মাইক আর একটা ক্যাসেট সেট করে বাড়িতে তালা লাগিয়ে সোজা গঞ্জের উদ্দ্যেশে গাড়ির প্যাডেল মারতে মারতে চলে যায়।ভিন্ন ভাবে আইস্ক্রিম বিক্রেতা হিসেবে ডিপ্লুর দু চার গ্রামে ভালই নাম আছে।গঞ্জে যাওয়ার পথে ডিপ্লু মানুষের সাথে খুব সাবলিল ভাবেই কুশল বিনিময় টা সেরে নেয়।ডিপ্লু মানুষটা খুবই রসিক।গঞ্জে যাওয়ার দুই ঘণ্টা পথ এভাবে প্যাডেল মারতে মারতে কখন কেটে যায় সে টেরই পায় না।
ডিপলু গঞ্জে গিয়েই নাস্তা টা সেরে নেয়। তারপর আইস্ক্রিমের মিল থেকে সব ধরনের আইস্ক্রিম নিয়ে,গানের ক্যাসেটের দোকানে গিয়ে নতুন যে ক্যাসেট বের হয় অথবা নতুন সিনেমার গানের ফিতা নিয়ে গান বাজানোর মাধ্যমে নিজের জানান দেয় সে।মাইকের সাথে মুখে তাল মিলাতে মিলাতে আর প্যাডেলের ছন্দে ছন্দে মনে হয় দিনটা জমে উঠে ডিপলুর।ধীরে ধীরে সে তার চিরচেনা মুখের মানুষগুলো আর গ্রামের ভিতর প্রবেশ করতে থাকে।গ্রামের মানুষগুলো গানের শব্দ শুনা মাত্রই তাদের বুঝতে দেরী হয়না কার আগমন ঘটেছে। রাস্তার পাশেই ছোটো ছোটো ছেলেরা লাটিম খেলায় ব্যস্ত তখন গানের শব্দ পাওয়া মাত্রই তারা যে যেভাবে পারে সে সেভাবে গাড়ির দিকে দৌড় শুরু করে।কেউ পিছনে,কেউ সামনে এভাবে করে সবাই গাড়ি টাকে ঘিরে ধরে। ডিপ্লুর গাড়ি যেন আর চলছেনা,গাড়ি টা থামিয়ে তার সেই চিরচেনা ডাক আইস্ক্রিমমমমমমম আর তা কানে যেতেই মেয়ে,ছেলে,ছোট,বড় সবাই ভিড় জমায়। আইস্ক্রিম খেয়ে সবাই প্রশংসা করে আর তা শুনে রোদে পোড়া মুখটা হাসিতে জ্বল জ্বল করে ওঠে তার। নিজ গ্রাম আর আশে পাশের দুই তিন গ্রামের মানুষের আইস্ক্রিমের খোড়াক ডিপলুই মিটাতো।ছোটো,ছোটো ছেলেগুলি ডিপ্লুর বিদায়ের পর এক হাতে আইস্ক্রিম আর অন্য হাতে লাটিম নিয়ে আবার খেলায় মেতে উঠে,আর মুখে ডিপ্লুর মাইকের সেই গান। খেলার আসর টা পুরো জমজমাট,,মনে হয় খেলায় নতুন একটা মাত্রা যোগ হলো।আর সেখান থেকে মনে হচ্ছে ধীরে,ধীরে গাড়িটা যেন যাপসা হয়ে যাচ্ছে আর মাইকের আওয়াজটা শেষ হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে কানে লাগছে।গ্রাম টা মনে হয় কিছুক্ষনের জন্য নিজের স্বত্তাটাকে হারিয়ে ফেলে মেতে উঠেছিলো এক উৎসবে।সেটা বুঝতে বেশি দেরী হয়না কারন ডিপ্লুর আইস্ক্রিমের মাইকের শেষ শব্দটাও যখন হারিয়ে যায়,তখন সেটা আবার শান্ত গ্রাম হয়ে যায় যা লেখকের কাছে গ্রামের কথিত ভাষায় শিয়েলের বিয়ের সামিল।যখন প্রচন্ড রোদের ভিতর বৃষ্টিটা এসে একটু পরশ বুলিয়ে যায় আর কি!!!!

ডিপলুর,বই-খাতা বন্ধী করা কোনো রুটিন নেই, তারপরেও দৈনন্দিন কাজগুলো খুব সাবলীল ভাবেই সেরে নেয় সে।ডিপলু আইস্ক্রিম বিক্রেতা না হয়ে যদি ছাত্র হতো তাহলে কি যে হতো তা হয়তো ডিপলু নিজেই জানেনা।প্রতিদিন-ই সে প্রানপন চেস্টা করে গ্রামগুলোতে তার চিরচেনা গাড়িটা নিয়ে হাজির হতে,আর এটা একটা প্রথা হয়ে গেছে।বছর দুয়েক আগে,বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছিলো তার,সেদিন সে গাড়ি নিয়ে বের হতে পারেনি।শরীরের সব শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছিলো সেদিন।সারাক্ষন শুধু ছটফট করেছিলো।সোজা হয়ে,বালিশে মাথা রেখে,বিছানায় শুয়ে ছিলো সে।ঘরের টিনের চাঁল ভেদ করে,সূর্যর আলোটা ঠিক গোল হয়ে তার হাতের তালুতে এসে পড়ছিলো।সে হাতের তালুটা একবার বন্ধ করতে ছিলো আবার একবার খুলতে ছিলো।সে যেন একটা খেলায় মেতে উঠলো।আর সেই খেলার তালে হারিয়ে গেলো কল্পনার রাজ্যে।দেখতে পেলো, লাটিম খেলা বাদ দিয়ে ছোটো,ছোটো ছেলে-মেয়েরা তার গাড়িটাকে ঘিরে ধরছে,মোল্লার দোকানের সেই শুটকি ভর্তা,বেগুন ভর্তা দিয়ে ভাত খাচ্ছে,আরও কতো কি!!!!! ডিপলু তার পেশাটাকে কতটাই না ভালোবাসতো।কল্পনার ভিতরেও সে তার পেশাকে নিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলো। গ্রামগুলোতে, এখনও ঘাষ মিশ্রিত মাটির ধুলো ওড়ে,বাতাসটাও দূষনমুক্ত,হন ,হন,পন,পন,ভো,ভো,প্যা-পু কোনো কৃত্রিম যানবহনের আওয়াজ নেই বললেই চলে।গ্রামের সারা রাস্তার দুপাশটা সবুজ গাছের সারি দিয়ে ঘেরা।পাখিদের কোনো ভয় নেই,ওরা সারাদিন কিচির মিচির করতেই থাকে ।আর নির্জন সেই রাস্তা দিয়ে ডিপলু হেটে যাচ্ছে।আর তার গানের শব্দের সাথে,পাখির কিচির-মিচির আওয়াজ সৃষ্টি করে এক মনরোম সৌন্দর্য। মনে হয় তাদের ভিতর এক আত্বার সম্পর্ক । কারন তার যাত্রাপথে এরাই তো তার সঙ্গী।পথ চলতে চলতে হয়ত দুই কূলের ভিতর গভীর সম্পর্কের জাল ছড়িয়ে গেছে।তা লেখকের চেয়ে ডিপলু আর পাখিরাই ভালো বলতে পারবে।আর এই সবকিছু মিলিয়ে রাস্তাটা নিজেকে প্রকৃতির মাঝে পরম সৌন্দর্যের দ্বার হিসেবে মেলে ধরেছে।আর এর ভিতর দিয়ে ডিপলু কখন যে মোল্লার দোকানে চলে আসে তা সে নিজেই টের পায়না।দোকানের সামনে গাড়িটা রেখেই হাসি মুখে একটা চিরচেনা ডাক মোল্লা ভাআইইই।
মোল্লা ভাই ডিপলুর ডাকের আওয়াজ শুনেই কি যেন একটা অপেক্ষার চাহুনি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো।সে মনে হয় ডিপলুর জন্যই অপেক্ষা করতেছে, তার চাহুনির ভাষা সেটাই প্রকাশ করে দেয়।অতঃপর মোল্লা ভাইর গলা থেকে একটা নরম সুরে একটা আওয়াজ,ডিপলু আইছোস।ডিপলু গান টা বন্ধ করে দিয়ে ,ভাই শিগগীর ভাত বাড়ো এটা বলেই খালে হাত,মুখটা ধোয়ার জন্য চলে যায়।মোল্লা ভাইর দোকানটা আবার রাস্তার পাশে খালের কোল ঘেষা।দোকানের বেশির ভাগ অংশই খালের পানির উপর বাঁশ আর কাঠের পাটাতন দিয়ে দাড়ানো।পাটাতনের আর পানির সম্পর্কটা বেশ ছুই-ছুই।খালের ভিতর থেকে যখন ভট-ভট করে টলার যায় তখন পানির ঢেউটা বেশ সজোরেই এসে দোকানের নিচে ধাক্কা দেয়।মাঝে মাঝে যখন নিজের গ্রামেই কেউ কুটুম হয়ে আসে।অনেক টাকার মালিক, বড়ো শহরে থাকে।গ্রামে আসলে তারা স্প্রীড বোট নিয়ে শোঁ শোঁ করে এই খাল দিয়েই যায় আর তখন মনে হয় যেন পানির ঢেউতে পাটাতনের তক্তাগুলো খুলেই পরে যাবে।সে যাই হোক স্প্রীড বোটের শোঁ শোঁ শব্দ কানে পৌছতেই ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা সবাই দৌড়ে গিয়েই ভিড় জমায় খালের পারে।কুটুমদের আগমন ঘটার ফলেই হয়ত তারা টলার আর নৌকা ছাড়া অন্য কোনো নৌযান আছে তা জানতে পারে এবং দেখতে পারে।কিন্তু,স্প্রীড বোটের ঢেউ যখন মোল্লা ভাইর দোকানের পাটাতনে এসে ধাক্কা দেয় তা যেন তার ঠিক বুকের মাঝে লাগে।হাত ধোয়া শেষ করে আসার আগেই মোল্লা ভাই ভাত টা জুড়ে দেয় টেবিলে।ভাতের সাথে থাকে শুটকি আর বেগুন ভর্তা। ডিপলু এসে খেতে বসার মাত্রই বলে ভাই,ভাত আগুনের মতো গরম খামু ক্যামনে।তোমার বেটারির ফ্যানটা একটু দেও।মোল্লা ভাই একটু রসিকতার ছলে বলে ফ্যানের টাকা কিন্তু আলাদা দেয়া লাগবে আর ফ্যানটা ছেড়ে দেয়।ডিপলু চুপচাপ খেতে থাকে।খাওয়ার সময় কোনো কথা বলেনা সে। আর মোল্লার হাতের শুটকি আর বেগুন ভর্তা হলে তো কোনো কথাই নেই।কিভাবে যে প্রতিদিন একই খাবার এত মজা করে খায় তা ডিপলুই ভালো জানে।মোল্লার দোকানটা আর দশটা দোকানের মতোনা ।গ্রামের ভিতর ভাত খাওয়ার হোটেল এই একটাই।শুধু ভাতেরই হোটেল না এটা।একপাশে ভাত আর একপাশে অভিনব যন্ত্রপাতি,মাঝখান থেকে একটা পর্দা দেয়া আর সবকিছুই সে একাই নিয়ন্ত্রন করে।দোকানের কাস্টমার যারা তারা সবসমই বলে ভাই একটা ছোটো দেখে ছেলে রাখলে কি হয়।কে শুনে কার কথা, মোল্লা নিজের কাজ নিজে করতেই ভালোবাসে আর কাস্টমারদের বলে তোমাগো মোল্লা ভাইর শরীলে এখনও রত ফুরাইয়া যায়নায় যে লোক রাখতে হবে।ডিপলুর ভাত খাওয়া শেষ হয়ে গেছে।মুখটা ধোয়ার পর সে জ্বালে হো হো করতে লাগলো আর শ্বাষ করতে লাগলো।মোল্লা ভাই একগ্লাস পানি হাতে দিয়ে বলে নে পানি খা।কতবার বলছি জ্বাল একটু কম খা।

ডিপলু পানি দাড়িয়েই খাওয়া শুরু করে দিলে মোল্লা ভাই বলে উঠে পানিটা বইয়া খা নাইলে মগজে যাইবে।মোল্লা ভাইর কথামতো কোনোমতে বসে পানিটা খেয়ে দোকানের ক্যাসের পাশে কাঠের ভাঙ্গা চেয়ারটায় গিয়ে বসলো।চেয়ারটার পিঠের হেলান দেয়ার জায়গাটা ছিলো একটা ছিড়া লুঙ্গি দিয়ে বাধা।চেয়ারে হেলান দেওয়ামাত্রই পরে যাওয়ার উপক্রম হলে ক্যাসের টেবিলটার জন্যই বেচে গেলো সে।চেয়ার থেকে উঠেই বলতে লাগলো কত কইছি চেয়ারটা পাল্টাইতে।মোল্লা ভাইর উত্তর চৌখ নাই,দেইখ্যা বইতে পারোনা।ডিপলু জানে তাকে এসব বলে লাভ নেই তাই নিজেই দোষ স্বীকার বলে, ভাই ভুল অইয়া গ্যাছে।ডিপলু চেয়ারটা পরিবর্তন করে একটা টুল টান দিয়ে বসে।মোল্লা ভাই তড়িগড়ি করে বাকি কাস্টমারদের খাবার দিয়ে ডিপলুর কাছে এসে বলে আমারে এউক্কা ভালো দেইখখা আইসক্রিম খাওয়া দেহী। সব মালই ভালো।ভাত কয়ডা খাইয়া উঠছি,একটু ঝিরাইয়া লই,তুমি গাড়ির মধ্যেদ দা যেটা ভালোলাগে ওইডা খাও।মোল্লা ভাই দৌড়ে গিয়ে একটা মালাই আইস্ক্রিম নিয়ে চাটতে চাটতে বলে আইজগো নতুন কোন গান আনছো।ডিপলু উত্তর দেয়,ঐডাই ক্যাসেটের ভিতর আছে চালু কইরা দাও।মোল্লা ভাই গান চালু করে দিয়ে গানের তালে মুখ মিলাতে লাগলো তা যেন এক বৃথা প্রচেস্টা।ভাত খাওয়া শেষ করে সবাই একটা যে যার মতো একটা আইসক্রিম নিয়ে খেতে লাগলো।ডিপলুর সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই।যে যেটা নিচ্ছে,সে সেটার দাম দিয়ে যাচ্ছে।এ যেন এক অন্ধ বিশ্বাস!!গানের আওয়াজে মোল্লা ভাইর দোকান টা পুরো জমে গেলো।তার দোকানের কাস্টমার ছাড়া আরও অনেক মানুষ,ছোটো-বড়ো সবাই এসে ভিড় জমায় গাড়ির কাছে কারন মাইকের শব্দ শুনামাত্রই আশেপাশের সবাই ছুটে আসে।এই গ্রামে ডিপলুর জনপ্রিয়তা এতটাই বেশি যে “আইসক্রিম শেষ হয়ে যাবে”কে কার আগে গিয়ে ভালোটা খেতে পারে তার একধরনের প্রতিযোগীতা লেগে যায় আর কি।
মোল্লা ভাইর দোকানের সামনে থেকেই আইসক্রিমের গাড়িটা খালি হয়ে যায়।গ্রাম থেকে তার দোকানটা একটু আধুনিক বললেই চলে।তার দোকানের একপাশে অভিনব যন্ত্রপাতির ভিতর আছে একখানা টেলিভিশন,কিছু রেডিও, ক্যাসেট আর বেটারি চালিত কিছু ফ্যান আর লাইট।সারা গ্রামে যেখানে ল্যাম্প,হেড়িকেনের, প্রদীপ জ্বলে, সেখানে তার দোকানে এত আধুনিক যন্ত্রপাতি তা লেখকের কাছে অভিনব যন্ত্রপাতির চেয়েও বড়কিছু।সপ্তাহে একবার গঞ্জে গিয়ে বেটারী গুলোতে চার্জ দিয়ে নিয়ে আসে সে।গ্রামের কিছু মানুষ আছে যারা গ্রামে বসবাস করা স্বত্তেও শরীরে শহুরে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে।অল্পবিদ্যার গর্ব খুব বেশি।শুদ্ধ আর ভুল ইংরেজী বলার প্রবনতা তাদেরকে মোল্লা ভাইর দোকানের অভিনব যন্ত্রপাতির দিকে বেশি দেখা যায়।কেউ আছে কিছুক্ষন পর পর বিটিভির এন্টানিয়ার টা একটু নাড়া দেয় যদি চ্যানেলটা একটু ভাল দেখা যায় সেই চেষ্টায়।মোল্লা ভাই এই শ্রেনির মানুষের জন্যই অভিনব যন্ত্রপাতির অংশ খুলে বসেছে আর তা থেকে কামাই টাও ভালো হয় তার।মোল্লা ভাইর দোকানে ঘন্টা দুই কাটিয়ে খালি গাড়িটা নিয়ে যখন বের হয় তখন আসরের ওয়াক্ত হয়ে যায়।সূর্যের বড়াইটা কমে শান্ত হয় তখন,ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে ঢেলে পড়ে সূর্যটা।মোল্লা ভাই বিয়াল ওইয়া গ্যাছে এহন বাড়ির দিক আউগাই।আল্লায় বাচাইয়া রাখলে কাইলগো দ্যাহা অইবেয়ানে।মোল্লা ভাইর উত্তর আচ্ছা কাইলগো আইছ।আচ্ছা বলে ডিপলু গাড়ির প্যাডেল মেরে গানের তালে বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করে।মোল্লা ভাই ক্যাসের ভিতর থেকে দৌড়ে গিয়ে রস্তায় নেমে গলা ছেড়ে বলে কাইলগো আর এউক্কা নতুন গানের ফিতা লইয়া আইছ।ডিপলু গাড়ির প্যাডেল দিতে দিতে সামনে আগাতে লাগলো আর বাম হাতটা জাগিয়ে সম্মতি জানালো।
ডিপলুর প্যাডেলের গতিটা ধীরে ধীরে বেড়েই যাচ্ছে।কি যেন একটা তাড়াহুড়া তার!!সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত যে মানুষটা ছিলো শান্ত। সেই মানুষটাই পড়ন্ত বিকালে এসে অশান্ত হয়ে গেলো।মোল্লা ভাইর দোকানটা আর দেখা যাচ্ছেনা।দোকান ছাড়িয়ে সে এখন বহুদূর।প্যাডেলের গতি এমনভাবে বাড়তেছিলো যে কিছুক্ষনের জন্য মানুষচালিতো যান থেকে তা ইঞ্জিনচালিতো যানে পরিনতো হয়েছিলো।হঠাৎ, গাড়ির হ্যান্ডেলের সাথে ব্রেকটা চেপে ধরে গাড়িটাকে থামিয়ে দিলো।গাড়ির বেগটা এতটাই বেশি ছিলো যে তা থামাতে গিয়ে মাটিটা মনে হয় একটু বেশিই ব্যাথা পেলো।মাটির চল্টা ওঠা,রাস্তাতে চাকাগুলোর থেতলানো ছাপ সেই কথাই যেন বলে দেয়।
বিশাল একটা বট বৃক্ষ,আর তার শাখা-প্রশাখার বিস্তার বৃক্ষটিকে এক প্রকান্ড রূপে পরিনত করেছে।বট বৃক্ষটির পিছনে ছিলো এক সুবিশাল সরিষা ফুলের মাঠ।সরিষা ফুলগুলো সাঝের বাতাসে একই তালে দুলতেছিলো।হঠাৎ,দেখলে মনে হয় বৃক্ষটি সরিষার ফুলের মাঠটিকে আগলে রেখছে।এই বটবৃক্ষের সামনে এসে ব্রেকটা থামানোর পরই সে আকাশের দিকে তাকালো।সময়টা ঠিক আছে কিনা দেখে নেয়। কারন তার তো গড়ি নেই।পশ্চিম আকাশে সূর্যের লাল আভাটা যখন লেপ্টে যায় তখনি তার এখানে হাজিরা দেয়ার সময়।তাকিয়ে দেখলো ঠিক আছে।একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।
এই হাজিরা তার আইসক্রিম বিক্রির জন্য নয়।আজ থেকে বছর পাঁচ আগে ঠিক এই সাঝের বেলায় বিক্রি শেষে গানের তালে বাড়ি ফিরছিলো ডিপলু ।এই বটবৃক্ষটির নিচ থেকে তখন এলো কেশে, খালি পায়ে, কলসি কাখে যাচ্ছিলো গ্রামের এক রমনী।যার চেহারায় ছিলো একটা সরলতার ছাপ আর মুখটা ছিলো লাজুক হাসিতে রাঙ্গানো।ডিপলুর যেন তা দেখে আর চোখের পলকই পড়ছিলো না।শুধু হা করে গাড়িটার উপর হাত রেখে একপলকে চেয়ে ছিল তার দিকে।কিছুক্ষনের জন্য মনে হয়েছিলো তার চোখের পলক নেই।তখন থেকেই ভালোবাসা নামের একটা পবিত্র জিনিস তার হৃদয়ে গেথে গেলো।মেয়েটা বটবৃক্ষটি অতিক্রম করে,সরিষা মাঠের ভিতর দিয়ে তার বাড়ি দিকে যেতেছিলো।ডিপলু একটু আগ বাড়িয়ে দু-চোখ যতদূর যায় তা অপলক দেখতেছিলো। পরের দিন ঠিক একই সময়ে ডিপলু এখানে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো কিন্তু দেখা পায়নি।এভাবে অনেকদিন দাঁড়িয়ে ছিলো কিন্তু দেখা আর পায়নি।একদিন খোজ নিয়ে দেখলো তার বিয়ে হয়ে গেছে।বাল্য বিবাহের স্বীকার আর কি!!
ডিপলু কথাটা শুনে হতবাক হয়েগিয়েছিলো। আফসোস করতে লাগলো আর নিজে নিজে বলতে লাগলো ঐদিন ক্যান কইলাম না আরও কত কি।।
কষ্ট সহ্য না করতে পেরে,জীবনের প্রথম সেদিনই গিয়েছিলো গঞ্জে বাংলা মদ খেতে।সবাই কি সবকিছু পারে।সে কি বমি।জীবনে কোনোদিন বিড়িই খেলো না আর তো মদ।
তারপর মদবিক্রেতা বিমান কে গালমন্দ করে নিজের গায়ে নিজে থু থু মেরেছিলো সেদিন।আর তার ভালোবাসার কসম দিয়ে বলছিলো আর কোনোদিন খাবে না।সেই থেকে আজ অবধি আর কোনোদিন ছাই- পাশ মুখে নেয়নি সে।
ডিপলুর সেই একপলকের ভালোবাসাটাকে আজও সে একইভাবে আগলে ধরে রেখেছে।সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত সাঝবেলার আগ মুহূর্তে এখানে এসে অপলক চেয়ে দেখে সেই বটবৃক্ষটি আর সেই সরিষার মাঠ। যার সাক্ষী শুধু বটগাছ,সাঝবেলার বাতাস আর পশ্চিম আকাশের লেপ্টে যাওয়া আভা।ডিপলুর এই ভালোবাসা মাপার গভীরতা হয়তো লেখকেরও নেই।
সূর্যটা যখন পশ্চিম আকাশ পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে,মাগরীবের আযানের ধ্বনিটা কানে এসে লাগে তখন প্রতিদিনের মতো একটা হতাশার নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার প্যাডেল দেওয়া শুরু করে।আর মিনিট দশেক পথ বাকি আছে তারপরই তার বাড়ি।সন্ধ্যার আলোটা থাকতে থাকতেই সে পৌছে যাবে বাড়ি।
গ্রামের গৃহবধূরা বাড়িতে বাড়িতে সন্ধ্যার প্রদীপ টা জ্বেলে দেয়।
ডিপলুর প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবেই কাটে।
ডিপলু গান বাজিয়ে আইসক্রিম বিক্রি করে হয়ত তার বিক্রিটা ভালো হবে তার জন্য অথবা একলা পথে গানটাকেই সঙ্গী করে নিয়েছে তার।একটু গভীরভাবে ভাবলে দেখা যায় ডিপলু কিন্তু দিনের পর দিন,বছরের পর বছর ওই গ্রামগুলোতে তার নিজের অজান্তেই গানগুলো প্রচার করে যাচ্ছে।বিদ্যুৎহীন,সভ্যতার আলো এখনো পদার্পণ করেনি যে গ্রামগুলোতে,যেখানে লাইটের আলোই ঠিকমতো পৌছেনি সেখানের মানুষদের জন্য এরকম ডিপলুরাই প্রচার করে যায়।
দশ মিনিট শেষে, ডিপলু বাড়ি ফেরে,এখন আবার রাতের খাবার টা নিজের রান্না করে খেতে হবে।
এভাবে আর কতো দিন!!!
হয়ত,তার ভালোবাসার ঘোর কাটিয়ে ডিপলু একদিন বিয়ে করবে,তার একটা সুখের সংসার হবে।
ভালো থাকুক ডিপলু।।
ডিপলুর জন্য শুভকামনা রইল।।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৪:২৯

বিজন রয় বলেছেন: ব্লগে স্বাগতম।

শুভকামনা রইল।

২| ১১ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১১:২৭

গ্যাটলিন জুনিয়র বলেছেন: ধন্যবাদ#বিজন রয়

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.