![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানবসভ্যতার ইতিহাস সুদূর প্রাচীন। ক্রমবিকাশমান এ ধারাকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে সমগ্র মানবসমাজের সমান দায়িত্ব ও অংশীদারিত্ব রয়েছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও কোনো এক অজানা কারণে সমাজে মানবজাতির ইতিহাসে ভেদ সৃষ্টি হয়। এবং তা অনির্দিষ্টকাল পূর্বে। মানবজাতি বিভক্ত হলো দুটি জাতিত্তার ভিত্তিতে একটি তার নর, অপরটি নারী। এই বিভক্তির সুনির্দিষ্ট কারণ জানা না গেলেও একটি দিক পরিষ্কার যে পুরুষ স্বামী বা প্রভুত্বের দাপটকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে নারী নামক সত্ত্বাকে নিজের আজ্ঞাধীন, অনুচর, দাসীরূপে ক্ষমতার প্রতিফলনের ক্ষেত্র রচনা করা।
আমাদের বদ্ধমূল ধারণা এবং বিশ্বাস দুটোই সুদীর্ঘকাল ধরে চলে এসেছে যে, নারী অর্থ 'না'- স্বাধীন মত প্রকাশে 'না', নিজের দাবী প্রতিষ্ঠায় 'না', সৃষ্টিশীল পৃথিবীর দ্বার উন্মোচনে 'না', এবং নিজেকে আত্মপ্রত্যয়ী ভাবতে 'না', সর্বোপরি নেতিবাচক ধারণার মূর্তপ্রতীক এই নারী। এই যেনো জমে থাকা শুধু কোনো বদ্ধমূল ধারণা নয় যে বদ্ধমূল জলাশয়। বদ্ধ জলাশয়ে যেমন আমরা দেখি দীর্ঘকালের পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত জল, সেই সাথে নানা রোগ বালাই সৃষ্টির আকর। ঐ জলাশয়ের মাছের মধ্যে যেমন পঁচা ক্ষত দেখা যায় তেমনিভাবে সমাজের সমাজের সেই ঘৃণিত এবং রুগ্ন ধারাটিও সুস্পষ্ট। অর্থাৎ শোষণধর্মী সমাজই হলো পঁচনশীল সমাজের নামান্তর। এক্ষেত্রে সমাজের সব শ্রেণির নারী বন্ধ্যা এবং শোষিত আর শোষণের সব শ্রেনির পুরুষ অভিন্ন। পুরুষের অসুস্থ মানসিকতায় এর অনন্যা প্রমান। এ প্রসঙ্গে চীনের কিংবদন্তী নেতা মাওসেতুং এর উক্তি উল্লেখযোগ্য। বিপ্লবের আগে চীনের পুরুষদের বইতে হতো সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের তিনটি পর্বত। আর চীনের নারীদের বইতে হতো চারটি পর্বত- চতুর্থটি পুরুষতন্ত্র। এই পুরুষতন্ত্রই যেহেতু নারীর শোষক তাই সামাজিক বিপ্লবের ফলে পুরুষ মুক্তি পেলেও নারী মুক্তি পায় নি। তাই আমাদের এবার বদ্ধজলাশয় থেকে হয়ে বিশুদ্ধ চলমান নদীর সদৃশ ধ্যানধারণাকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে।
বিয়ে, স্বামী, সন্তান, গৃহ এগুলোতেই নারী মূলতঃ বন্দী। তার ক্ষুধা, মেধা এবং উদ্ভাবনী শক্তি সবকিছুই যেনো সে বিবাহ নামক প্রথাতেই তালাবদ্ধ করে রেখেছে। সে যেনো নিজে থেকেই
কর্মক্ষম বা প্রতিবন্ধীত্ব ধারণ করলো। রাস্তায় অনেক ভিখারী দেখা যায়। যাদের অবলম্বন একটি থালা। এই থালার উপর দয়াদাক্ষিণ্য বশতঃ কেউ কিছু দিয়ে থাকলে তাতেই ভিখারীগণের গগনচুম্বী আনন্দ। ঠিক নারীদের বর্তমান চরিত্র ভিখারীর সেই অসহায় চরিত্রকেস্মরণ করিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে ভিখারীর থালা এবং নারীর বিবাহ যেন সমার্থক শব্দ। এবং এটিকেই কেন্দ্র করে যেনো তার জীবনের স্বপ্ন, সাধনা, আনন্দ, ফুর্তি অর্থাৎ বিবাহই যেন নারীর শ্রেষ্ঠ পেশা। সমাজে এখন অনেকটা নারী উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে গেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে নারীর শিক্ষার যে ধারা শুরু হয় তার উদ্দেশ্য নারীকে স্বাধীন সায়ত্বশাসিত করা নয়। তার লক্ষ্য হলো উন্নত জাতের স্ত্রী বা শয্যাসঙ্গিনী রূপান্তর।
নারীশিক্ষাও প্রভু পুরুষদের সার্থে। স্বামী তার প্রভুত্বের ব্যক্তিত্বকে বলিষ্ঠরূপে প্রকাশ করার নিমিত্তে দামী ঘড়ি, দামী ড্রেস, মডানেট সুজ ইত্যাদি যেমন ব্যবহার করে ঠিক তেমনই তার বাহুলগ্না রূপসী উচ্চ শিক্ষিত স্রীকে তার পরম মুল্যাবান সম্পত্তি হিশেবে অপরের নিকট উপস্থাপন করে। শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত উভয় শ্রেণির নারী এখানে দাস্ত্বের শৃঙ্খলে বন্দী।
প্রকৃতিগতভাবে নারীর শারীরিক গঠন কিছুটা পুরুষের তুলনায় ভিন্ন। হয়তো সে কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। তাই বলে পুরুষ প্রভু হতে পারে না। যেমন আমরা যদি সামাজিক প্রেক্ষাপটে দৃষ্টিপাত করি তাহলে আমরা দেখতে পাই একজন ডাক্তার যেমন উকিলের প্রতি আইনগত কারণে সাহায্যপ্রার্থী তেমনি একজন উকিলও তার স্বাস্থ্যসেবায় ডাক্তারের শরণাপন্ন। তাহলে এখানে ডাক্তার ব্যারিস্টারের প্রভু/স্বামী? নাকি ব্যারিস্টার ডাক্তারের স্বামী/প্রভু? যদি এখানে কেউ কাউকে স্বামী বা প্রভু বলে স্বীকার না করে তবে নারী কেন পুরুষদের প্রভু বলে স্বীকার করবেন? বরং এক্ষেত্রে একে অন্যের পরিপূরক।
এবার আমরা সামাজিক প্রথাসমূহের মধ্যে অন্যতম 'বিবাহ' নিয়ে আলোচনায় আসতে পারি। বিবাহ হয় নারী এবং পুরুষকে কেন্দ্র করে। কিন্তু বিয়েতে তাদের ভূমিকা সমান নয়। পুরুষ বিয়ে করে আর নারীকে বিয়ে দেয়া হয়। অর্থাৎ পুরুষ সক্রিয় এবং নারী অক্রিয়। নারী বিয়ের আগে তার বাপের বাড়িতে আশ্রিত থাকে। বিয়ের পর হয় প্রভুর বদল। এই প্রভুত্ব বদলের সাথে সাথে নারীর বসন-ভূষণেরও পরিবর্তন আনা হয়, যা সমাজ রীতিসিদ্ধ। অর্থাৎ এখানে সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে শাখা, নাকে নোলক ইত্যাদি দেয়ার মাধ্যমে অন্যের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় যে, সে এখন অন্যের কেনা স্থায়ী দাসী। এভাবেই বিয়ের মধ্য দিয়ে ব্যবস্থা হয় জীবন ধারণের। কারণ বিয়ে ছাড়া তার অস্তিত্ব পিতৃতন্ত্রের কাছে আপত্তিকর। এবং বিয়ে-না-করা-নারী সমাজের চোখে তা অমার্জনীয় বেয়াদবী ও মারাত্মক সমাজ দ্রোহিতা। কিছুদিন পূর্বে আমার দেখা একটি জীবনসংগ্রামী আত্মপ্রত্যয়ী মেয়ের গল্প আমাকে ভাবায়- মেয়েটি সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় হতে সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ করে বিয়ের পিড়িতে না বসে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার লক্ষ্যে কিছু সুন্দর পদক্ষেপে নেয়। কিন্তু অপরপক্ষে সমাজ তার এই সুন্দর পদক্ষেপে উশৃঙ্খলতা, গাদ্দারী ব্যবহার দেখতে পায়। এখন যদি সে তার পছন্দমতো কোনো ছেলেকে বিয়ে করতো সেখানেও তাকে ছেড়ে কথা বলতো না। আবার সমাজের সব নিময়-নীতি মেনে নিয়ে যদি বিয়ে করে বিধবা হয় তাতেও সমাজ তাকে পাপী, অপয়া বলে নিন্দা করতে ছাড়তো না। অর্থাৎ নারী হলো এখানে মাটির তৈরি পুতুল। পুরুষ তাকে তার ইচ্ছামতো চটকাবে, ভাঙবে, গড়বে। কিন্তু মজার বিষয় হলো এই_ যে পুরুষগণ নারীদের উপর কর্তৃত্বের ছড়ি ঘুরায় সে পুরুষগণের জন্ম নারীর গর্ভ থেকে। এতে করে নারী যেমন লজ্জিত এরূপ পুরুষ জানোয়ারদের জন্ম দিয়ে, তেমনি এই ধরণীতে অনেক মহামানবের জন্ম দিয়েও আবার সে গর্বিত।
নারীমুক্তি
বিশ্বের সকল মতবাদই নারীমুক্তি বিরোধী, রক্ষণশীলও বটে। নারীমুক্তির মূল কথা হলো নারীর স্বাধীনতা বা পুরুষের সাথে সাম্যতা।
বেগম রোকেয়ার মতে "পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্যে আমাদিগকে যাহা করিতে হয় আমরা তাহাই করিব"। এই সূত্র ধরে নারী বিগত শতক থেকে শিক্ষালাভে অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু অতি দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, এউ উচ্চশিক্ষা নারীকে পূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ দিতে পারে নি, কেবল উচ্চশিক্ষিত এবংসম্ভ্রান্ত পরিবারের যোগ্য স্ত্রী, সুগৃহিণী, সুমাতা হিশেবে সৃষ্টি করেছে। উচ্চশিক্ষা লাভ করে যদি শুধুই সন্তান লালন-পালন ও ঘর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা হয় তাকে স্বাধীনতা নয় কেবলমাত্র শিক্ষার শোচনীয় অপব্যয় বলা যায়। বর্তমান আমাদের সমাজে নারী ডাক্তার, নারী ব্যারিস্টার, নারী ইঞ্জিনিয়ার এমনকি রাষ্ট্রপরিচালনায় নারী প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সৃষ্টি হয়েছে তদুপরি এটাকে নারী-স্বাধীনতার সূচকে খুব একটা বেশি অগ্রগতি বলা যায় না। কারণ এই অবস্থা এবং ব্যবস্থার পেছনেও পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাব সুদৃঢ়। এককথায় সমাজের প্রতিটা স্তর, প্রতিটা দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন এবং আত্মসচেতনতা, আত্ম-উপলব্ধি এবং আত্মপ্রতিষ্ঠাই নারীর স্বাধিকার আন্দোলনের মূল কথা। যতোদিন নারী তার চেতনার দৈন্যতাকে ঘুচিয়ে মনুষ্য চেতনায় ভরপুর হতে বনা-পারবে ততোদিন তার মুক্তি বা স্বাধীনতা কেউ দিতে পারবে না। কারণ কেউ কাউকে স্বাধীনতা দেয় না, স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হয়।
তাই স্বাধিকার আন্দোলনে সকল ভগিনীকে আহ্বান জানাই।
---------------------
ঋণস্বীকার:
১। নারী: হুমায়ুন আজাদ
২/ মতিচুর: বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত
লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যবসায় শিক্ষা
অনুষদ, মার্কেটিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
©somewhere in net ltd.