নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সবার জন্য ভালোবাসা।

গেছো দাদা

গেছো দাদা › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতিহাসকথা : মহাবীর ভীষ্ম ,এক মহাকাব্যিক চরিত্র : ফিরে দেখা।

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:১০


নিশুতি রাত। দুরে দেখা যাচ্ছে মশালের আলো। ঝিল্লীর ডাক ছাপিয়ে জেগে উঠছে শক্ত চোয়ালে হাড় ভাঙার আওয়াজ। চাঁদের আলোয় হলদেটে চোখ ঝলসে উঠছে মাঝে মাঝে। সেখানেই শুয়ে আছেন বৃদ্ধ....
গঙ্গার দিক থেকে ভেসে এল এক ঝলক হাওয়া। বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাসের মত। চাপা নারীকন্ঠে বলল, "আর কত? এবার তো ফিরে এস পুত্র।"
চোখ খুললেন বৃদ্ধ। বললেন, "আমি পারি না মাতা।"
"কেন?" আকুল উদভ্রান্ত নারীকন্ঠ বলল, "কেন পারো না পুত্র? তোমার পিতা তোমাকে ইচ্ছামৃত্যুর বরদান দিয়েছিলেন। তুমি অবশ্যই পারো।"
"ইচ্ছামৃত্যু কি মাতা?" শান্তকন্ঠে বললেন বৃদ্ধ, "ইচ্ছামৃত্যুর ক্ষমতা আমাকে এই কারণে দেওয়া হয়নি যাতে আমি দ্রুত মৃত্যুবরণ করতে পারি। বরং তা আমাকে দেওয়া হয়েছিল যাতে মৃত্যু আমার প্রতিজ্ঞা পূরণের অন্তরায় না হয়। তোমার মনে হয় ইচ্ছামৃত্যু কোন বরদান?"
"বরদান নয়?" বিস্মিত নারীকন্ঠ বলে উঠল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন বৃদ্ধ। বললেন, "মাতা, ইচ্ছামৃত্যুর অধিকার পেতে ইচ্ছার মর্যাদা দিতে হয়। যে মর্যাদা রক্ষা করে চলেছি এতকাল। প্রচুর পাপ, প্রচুর যন্ত্রণা, প্রচুর হত্যার সঙ্গী হয়ে রক্ষা করে চলেছি পিতার ইচ্ছাকে। সেই মর্যাদা রক্ষাতেই নীলকন্ঠের মত ইচ্ছামৃত্যুর গরল পান করেছি আমি। এখন ফিরতে পারি না।"
"দেবাদিদেব নীলকন্ঠের সঙ্গিনী স্বয়ং মহামায়া ছিলেন, পুত্র। যিনি সুধা পান করিয়ে তাকে সুস্থ করেছিলেন। সর্প ছিল তাঁর, যে সেই বিষকে কন্ঠে আবদ্ধ রেখেছিল। কিন্তু তুমি তো একান্ত একাকী পুত্র। তোমার সারা শরীরই তো বিষে নীল হয়েছে।" আকুলা নারীকন্ঠের কাতরোক্তি শোনা গেল।
হাসলেন বৃদ্ধ। বললেন, "সে বিষ ধারণের শক্তি তোমার পুত্র রাখে বলেই নিশ্চয় মহাকালের নির্বন্ধে এরূপ সম্ভব হয়েছে মাতা।"
"আমাকে একবার অনুমতি দাও। আমি কুরুক্ষেত্র ভাসিয়ে এ যুদ্ধ এখনি শেষ করে দিচ্ছি।" উদ্ভ্রান্তের ফিসফিসানির মত শোনাল নারীকন্ঠ।
"তা হয় না মাতা। তাতে পিতাকে দেওয়া আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষিত হচ্ছে না। হস্তিনাপুরের সুরক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না। আমাকে তাহলেও অপেক্ষা করে যেতে হবে। হয়তো এই শরবিদ্ধ হাতেই আবারও তুলে নিতে হবে ধনুর্বান। তোমাকে আবদ্ধ করতে আমি ছাড়া আর কেউ পারবে কি?" শান্তভাবে বললেন বৃদ্ধ।
হাহাকারের মত গঙ্গাবক্ষোদ্ভুত বাতাস দিকভ্রান্তের মত যেন ছুটে বেড়াল কুরুক্ষেত্রের এপাশ থেকে ওপাশ, বলে উঠল, "তুমি হেরে যাওয়া যুদ্ধ করছ পুত্র।"
"জানি মাতা।" বৃদ্ধ বললেন, "আমি জীবনের শুরু থেকেই হেরে যাওয়া যুদ্ধ করছি। পিতার প্রতিজ্ঞারক্ষায় আমার পূর্বজদের নিরুদ্দেশ হতে হয়েছিল। যে প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হওয়ায় তাকে ছেড়ে আমাকে নিয়ে চলে গেছিলে তুমি। তারপর হঠাৎ একদিন ষোড়শবর্ষীয় কিশোর আবিষ্কার করেছিল মাতার প্রতিজ্ঞারক্ষায় তাকে ফিরে যেতে হবে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত এক মানুষের কাছে যে নাকি তার পিতা! হে মাতা, সেইদিন আমি ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম। ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম আপনার উপর, আমার না চেনা সেই পিতার উপর। আমাকে হস্তিনাপুরস্থ গঙ্গাতীরে উপস্থিত করে তুমি চলে যেতে চেয়েছিলে। আমি তোমাকে যেতে দিতে চাইনি। আমি ধনুর্বান তুলে নিয়েছিলাম। ইন্দ্রের ঐরাবত তোমার যে গতি রুদ্ধ করতে পারেনি, যে গতি রক্ষা করতে স্বয়ং রূদ্রের মস্তক প্রয়োজন হয়, তোমার পুত্র তোমার সেই গতি রূদ্ধ করে দিয়েছিল সেদিন। আমি জয়ের জন্যই যুদ্ধ করছিলাম সেদিন, তোমার সাথে। তারপর...."
একটু থামলেন বৃদ্ধ। তাঁঁর আত্মকথনে যেন থমকে গিয়েছিল বাতাস। শ্বাপদরাও যেন শব্দ হারিয়েছিল। বৃদ্ধ আবারও বলতে থাকলেন, "... তারপর আমি পিতাকে দেখলাম। দেখলাম একজন ভেঙে পড়া, দুর্বল মানুষকে। আমি মনে করেছিলাম এঁঁর জন্যই হয়তো আমাকে আমার মাতা ত্যাগ করতে চলেছেন। আমার মনে হয়েছিল আমি তাকে বধ করি। কিন্তু তার মায়াময় দুটি অসহায় চোখ আমাকে বাধা দিল। আর সেই হল আমার হারের শুরু। তুমি আমার বন্ধন ভেঙে তোমার প্রতিজ্ঞার ভার আমার উপর চাপিয়ে চলে গেলে। আর পিতার থেকে আমি জানলাম, কার জন্য আমি আমার ভাইদের মধ্যে একমাত্র জীবিত। উপলব্ধি করলাম আমার উপ‍র তার নিশ্চিন্ত নির্ভরতা। মাতা, আমার হেরে যাওয়া যুদ্ধের শুরু সেইদিন থেকেই। আমি পিতার সেই অবলম্বনকে তার থেকে কেড়ে নিতে পারিনি। হয়তো ব্যর্থতা। কিন্তু সে একমাত্র মানুষ, যে আমাকে চাইতে গিয়ে নিজ প্রতিজ্ঞাভঙ্গের জ্বালাও কাঁধে নিতে পিছপা হয়নি। এমনকি সে মহাবল দেবব্রতকে নয়, অসহায়, নির্বল শিশুটির জন্যই নিজের স্নেহপ্রকাশ করেছিল। কিভাবে ফেরাতাম তাকে? তারপর প্রতিদিন আমার সামনে জীবন নতুন করে আরেকটি পরাজয় সামনে রেখেছে, আমি লড়াই করেছি, অভ্যাসে, পিছিয়ে আসার স্বভাব আয়ত্ব করতে পারিনি বলে। আমার নিজের প্রতিজ্ঞার প্রথম বলি, কাশীরাজকুমারী অম্বা। আমি তার জন্য গুরুদেবের সাথে হেরে যাওয়া যুদ্ধেই অবতীর্ণ হয়েছিলাম। একটা মন চেয়েছিল, গুরুদেব আমাকে পরাস্ত করে অম্বাকেই বিজয়িনী করুন। কিন্তু আমার আরেকটা মন, আমার উদ্দেশ্যের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। সে পরাস্ত হতে চায়নি। আজ অম্বারই আত্মজার নিমিত্তে এই শরশয্যা আমার সেই লড়াইয়ের সাক্ষীমাত্র মাতা। শুধু আমার নয়, মহাভারতের সকলের সকল প্রতিজ্ঞার ভার আমি আমার উপর নিয়েছি। নাহলে বলো, তোমার পুত্র ছাড়া সে ভার বহনের আর কেউ ছিল?"
কেঁদে ওঠা বাতাস বলল, "যন্ত্রণা হয় না পুত্র?"
"আমার বাহু পরাস্ত হয়না মাতা। কারণ তাকে আমি পরাস্ত হতে শেখাইনি। কিন্তু সেই প্রতিটা আপাত-বিজয়ের আড়ালে আমাকে এক অদ্ভুত আত্মধর্ষী যজ্ঞ করে যেতে হয়েছে। যাতে হবিরূপে একটু একটু করে উৎসর্গ করতে হয়েছে আমার যন্ত্রণাবোধ। এখন আর বোধ করার মত যন্ত্রণা যে অবশিষ্ট নেই মাতা।" বললেন বৃদ্ধ।
"আসবে না তবে ফিরে? এ কি আমাকে দেওয়া শাস্তি, পুত্র?" মাতৃকন্ঠের আর্তি শোনা গেল বাতাসে।
"আসব মাতা। তোমার সন্তান যে অভিশাপের ভার নিয়েছে, সেই দায়িত্ব পালন শেষ হলেই আমি ফিরে যাব।"

অবুঝ সন্তানের যন্ত্রণা উপশম করবার কোন উপায় না পেয়ে উন্মাদিনী জননীর মত উদ্ভ্রান্ত বাতাস ঝড়ের মত ঝাপটা অবরূদ্ধ ক্রন্দনশব্দ ছড়িয়ে গেল চারপাশে। মাতা গঙ্গা যেন তার অক্ষম ক্ষোভের প্রকাশ করে ফিরে গেলেন।
আর মহাভারত সাক্ষী হল চির অপরাজেয় একজন একাকী যোদ্ধার যে মৃত্যুর সাথেও অনায়াস লড়াই করেছিল... যেমন সে করেছিল অস্ত্রহাতে...
তারপর...
....
তার অনেকদিন পর...
কোন এক উত্তরায়ণে... যখন সুরক্ষিত হস্তিনাপুর, সেই শুভক্ষণে...
নতমস্তকে এসে দাঁড়াবে মৃত্যু। বলবে, "হে মহাবাহু, আপনি আপনার ইচ্ছাবলে কালচক্রকে রূদ্ধ করে দিয়েছেন। আপনার অনুমতি ব্যাতিরেকে তার পুনঃসঞ্চালন অসম্ভব। স্বয়ং কাল আপনার কাছে নতমস্তকে তার বিজয় ভিক্ষা চাইছে।"
শান্তনুনন্দন মহাভীষ্মের লোলচর্ম মুখে ফুটে উঠবে পাতলা দুর্ভেদ্য হাসি। উপেক্ষার? কাকে উপেক্ষার? জীবনকে না মৃত্যুকে? নাকি ভালোবাসার? কাকে ভালোবাসার? জীবনকে না মৃত্যুকে?
চর্মচক্ষের অজ্ঞাতে নিজের নশ্বর দেহ ছেড়ে উঠে দাঁড়াবেন মহাভারতের একমাত্র যন্ত্রমানব। মৃত্যুর চোখে হাসিভরা চোখ রেখে বলবেন, "বেশ, তবে যাওয়া যাক... বিজয় হোক তোমার..."
.
(মহাভারত)

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:১৬

নজসু বলেছেন:



ও দাদা ও দাদা
খাবো আমি আদা।

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:২১

গেছো দাদা বলেছেন: ধন্যবাদ দাদা ।

২| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:২০

নজসু বলেছেন:



প্রিয় দাদাভাই।
মহাভারতে গল্প শুধু গল্প নয়।
শেখার যে থাকে অনেক কিছু।
হস্তিনাপুর শুধু রেষারেষির ক্ষেত্র ছিলো না, মায়া মমতা আর ভালোবাসায় ভরপুর ছিল।

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:২২

গেছো দাদা বলেছেন: ঠিক কথা বলেছেন ।

৩| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:২৭

সনেট কবি বলেছেন: বেশ

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৩৪

গেছো দাদা বলেছেন: ধন্যবাদ দাদা ।

৪| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৪১

রাজীব নুর বলেছেন: বেশ উপভোগ্য।

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৩০

গেছো দাদা বলেছেন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই পড়ার জন্য ।

৫| ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৬

আর্কিওপটেরিক্স বলেছেন: বেশ !

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৩০

গেছো দাদা বলেছেন: ধন্যবাদ ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.