নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

হাসান ইকবাল-এর লেখালেখির অন্তর্জাল।

হাসান ইকবাল

.... ছেলেবেলার দুরন্ত শৈশব কেটেছে নেত্রকোনায়। আর সবচেয়ে মধুর সময় ছিল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলি। আর এখন কাজ করছি সুবিধাবন্চিত শিশুদের জন্য একটি স্পানিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায়।

হাসান ইকবাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভাটকবিতায় মুক্তিযুদ্ধ / হাসান ইকবাল

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ৭:৪৯

'ভাটকবিতায় মুক্তিযুদ্ধ' গ্রন্হের মূল উপজীব্য প্রসঙ্গ হলো ভাটকবিতায় মুক্তিযুদ্ধ। বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে ভাটকবিতা এখন দুষ্প্রাপ্য এবং বিলুপ্তির পথে। ভাটকবিতা এখন লেখাও হয়না এবং চর্চাও নেই। তাই স্বাভাবিক ভাবেই যে সময়ের ভাটকবিতা সংগ্রহ করা হয়েছে তা নিতান্তই অপ্রতুল। সংগ্রহের পাল্লায় শতাধিক বিষয়ভিত্তিক কবিতা সংযোজন হলেও বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ভাটকবিতা ছিল নগণ্য।

বাংলাদেশে যেসময়টাতে ভাটকবিতার বিকাশ ঘটেছিল সেসময়টাতে গ্রামের সাধারণ মানুষের বিনোদনের মাধ্যমও ছিল এটি। তাই ভাটকবিরা সে সময়টিকে তাদের লেখায় নিঁখুতভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। গ্রামের ভাটকবিগণ তাদের লেখনীতে যুদ্ধের সেই সময়কার ছবি একেছেন নিঁখুতভাবে। এ গ্রন্হে স্বল্প পরিসরে চৌদ্দটি ভাটকবিতা তুলে ধরার পাশাপাশি সংক্ষিপ্ত আলোচনা সন্নিবেশ করা হয়েছে- এতে করে নতুন প্রজন্মের পাঠকরা কিছুটা হলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে। ভাটকবিতায় যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র ফুটে উঠেছে- তা থেকে পাঠক, গবেষক মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাসই নিতে পারবে । ভাটকবিতায় সুষ্পষ্টভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। ভাটকবিরা তাদের আত্ম উপলব্ধি ও দেশপ্রেমের জায়গা থেকে কবিতার যে শব্দবুনন শুরু করেছিলেন তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক মূল্যবান দলিল।

প্রবন্ধের বই ‘ভাটকবিতায় মুক্তিযুদ্ধ’ কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরষ্কার-২০১৬ প্রাপ্ত একটি বই। বিচারকমণ্ডলী ২০১৬ সালের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা বিভাগে ‘ভাটকবিতায় মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থটিকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে নির্বাচন করেন। ১১২ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ১৬০ টাকা। বইটি প্রকাশ করেছে 'অয়ন প্রকাশন'।

বইয়ের নাম : ভাটকবিতায় মুক্তিযুদ্ধ
লেখকের নাম : হাসান ইকবাল
ধরণ : প্রবন্ধ
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৬
দ্বিতীয় সংস্করণ : ডিসেম্বর ২০১৭
প্রচ্ছদ শিল্পী : মো্স্তাফিজ কারিগর
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১১২
মূল্য : ১৬০ টাকা
আইএসবিএন : ৯৭৮-৯৮৪-৯১৮৩৪-২-৬
প্রকাশনীর নাম : অয়ন প্রকাশন

ভাটকবিতা প্রসঙ্গ:
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির অনেক জায়গা জুড়ে রয়েছে প্রাচীন লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্যের একটি উলে−খযোগ্য শাখা ভাটকবিতা। নিভৃত গ্রামীণ জনপদে বসবাস করলেও বাংলার ভাটকবি, চারণকবি, ছড়াকার, নাট্যকার, বাউল-কবিয়াল, জারিসারি গানের রচয়িতাগণ দেশের চলমান ঘটনাপ্রবাহ আন্দোলন সংক্রান্ত সংঘর্ষ, রক্তপাত, শোষন-নির্যাতন, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক উত্থান-পতন, গণআন্দোলন, নির্বাচন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা উত্তর দেশের অবস্থার প্রতি সজাগ ছিলেন- যা তাদের রচিত গান, ছড়াকবিতা, যাত্রা-নাটক, পালা, জারি সারি এবং ভাটকবিতায় ফুটে উঠে এবং এসবের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ দেশ ও মাটির চলমান নানা ঘটনাপ্রবাহ ও চালচিত্র সম্পর্কে অবহিত হয়ে উদ্দীপ্ত হয় এবং জাতীয় আন্দোলন সংগ্রামে এগিয়ে আসে।

দেশের জনগনকে সচেতন ও উদ্দীপ্ত করার লক্ষ্যে গ্রাম বাংলার লোককবি, পালাকার, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, জারি সারি, পল্লীকবি, লোকগান ও ভাটকবিতার রচয়িতাগণ বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলন, সংগ্রাম, সংঘর্ষ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-র নির্বাচন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, ছয় দফা, ১১ দফা, ৬৯-র গণ আন্দোলন, ৭০-র নির্বাচন ও নির্বাচন উত্তর ঘটনাপ্রবাহ, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য কবিতা ছড়া, যাত্রা পালা, ভাওয়াইয়া ও লোকগাঁথা। লোককবি ও লোকশিল্পীগণ তা যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে পরিবেশন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন।

ভাটকবিতা অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। রংপুরে শিকুলি, ঢাকা ময়মনসিংহ অঞ্চলে কবিতা, কোথাও শায়েরি নামেও প্রচলিত। স্বল্প শিক্ষিত এক শ্রেণীর কবি কোন বিশেষ ঘটনা বা কাহিনিকে উপজীব্য করে তার কল্পনার জগৎ প্রসারের মধ্য দিয়ে অনেকটা গীতিকবিতার আদলে ও পয়ার ছন্দে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘকবিতা রচনা করেন। পরে বিশেষ ভাঁজে একটি কাগজে ছাপিয়ে তা বিভিন্ন হাটবাজার, লঞ্চ-স্টিমার, ট্রেন, বাস বা কোনো জনবহুল স্থানে দাঁড়িয়ে অনেকটা পুথি পড়ার মতো সুর করে পড়েন। এভাবে ঘুরে ঘুরে আসর জমিয়ে ভাট বা হাটুরে কবিতা বিক্রি করে কবি বা বিক্রেতারা। ভাটকবিতার প্রচলন মধ্যযুগ থেকেই দেখা যায়। মূলত ভাটকবিতার বিষয়বস্তু হলো সমাজে ঘটে যাওয়া মুখরোচক এবং নর নারীর অসঙ্গতিপূর্ণ প্রেম, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দাঙ্গা, অগ্নিকান্ড, ভূমিকম্প, রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম ও যুদ্ধ বিগ্রহ। তাছাড়া রয়েছে অপরাধ, শাস্তি, খুনখারাবি, ফাঁসি, শোকগীতি, কিংবদন্তী, লোকবিশ্বাস, ঐতিহাসিক কাহিনি, ব্যক্তিবন্দনা, সমাজ ও অধ্যবসায়মূলক কবিতা।

তবে বিদ্ধৎসমাজে ভাটকবিতার নামকরণে ভিন্নমত রয়েছে। শামসুজ্জামান খান ও মোমেন চৌধুরী এবং অধ্যাপক আলী আহম্মদ এ কবিতাকে বলেছেন- পথুয়া কবিতা, আতোয়ার রহমান- পথের সাহিত্য, আবুল আহসান চ্যেধুরী- পথের কবিতা। গবেষকদের এসব নামের প্রতিটিই ব্যাপক অর্থজ্ঞাপক। অধ্যাপক যতীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ভাটকবিতাকে ভট্ট সঙ্গীত বলেছেন। শ্রী নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার দ্বাদশভাগে ১৩১২ সংখ্যায় মোক্ষদাচরণ ভট্টাচার্য ভাটকবিতাকে বলেছেন গ্রাম্যকবিতা ।

অজ্ঞাতনামা অনেক লোককবিদের রচিত কবিতা গানে ও ছড়ায় পলাশী যুদ্ধের স্মৃতি, নীল বিদ্রোহের কথা, গণআন্দোলনের চিত্র অম্লান হয়ে আছে। টিপু পাগলার বিদ্রোহ, তিতুমীরের সংগ্রাম, ক্ষুদিরামের আত্মবলিদান, স্বদেশী আন্দোলন ভাষা আন্দোলন, ১১ দফা ও ৬ দফা আন্দোলন, এমনকি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ স্বতঃস্ফুর্ত আবেগের প্রেরণায় ভাটকবিদের কাছে ধরা দেয়।

ভাট সাধারণ অর্থে ঘুরে ঘুরে গান বা নিজের লেখা পালা পরিবেশনের মাধ্যমে বিশেষ কোন ভাবধারার প্রচারকারীকেই চারণ বলা হয়। সাধারণত এ ধরনের চারণ কবি বা লেখকের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকেনা। তবে বাংলাদেশে ভাটকবিতা রচনা এবং সুরাশ্রিত আবৃত্তির মাধ্যমে প্রচারের ধারাটি যে অত্যন্ত প্রাচীন তাতে কোন সন্দেহ নেই।

গ্রামের অল্পশিক্ষিত বা নিরক্ষর কবিগন কোন ঘটনা দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রেম বা কোন আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিষয় ইত্যাদি নিয়ে সহজ ভাষায় লিখিত কবিতা যেগুলোর শ্রোতা সমঝদার গ্রামের অর্ধশিক্ষিত ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর জনগন। প্রাচীনকাল থেকে এ ধরনের কবিতা রচিত হয়ে লোকের মুখে মুখে আবৃত্তি হতো। মুদ্রণ যন্ত্র প্রসারের ফলে এদেশে উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ভাটকবিতাগুলো মুদ্রিত হতে থাকে। ভাটকবিতাগুলো ডাবল ডিমাই সাইজের কাগজে মুদ্রিত, অধিকাংশই নিউজপ্রিন্ট বা নিু মানের কাগজে সেলাই বাঁধাইহীন ভাঁজ করা কাগজ। অনেক ভাটকবিতা দেখা গেছে যেগুলো লেটার প্রেসে মুদ্রিত। এই পুস্তিকাগুলোর উপরিভাগে আল−াহ আকবর, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, ইত্যাদি স্তুতিবাচক শব্দ লেখা থাকে। এর নিচে শিরোনাম ও কবির নাম ঠিকানা। কবিগণ তাদের নামের প্রথমে স্বঘোষিত উদাস কবি, কবি সম্রাট, কবিরত্ন, চারন কবি, বয়াতী ইত্যাদি অভিধা ব্যবহার করেন। এর নিচে লাইসেন্স নাম্বার এবং পুস্তিকার মূল্য লেখা থাকে। পুস্তিকার প্রচ্ছদচিত্রের বিবরণ লেখা থাকে এভাবে কবি আব্দুল করিম খান এর ‘নারীর আচরণ’ এর চিত্রে ধানভর্তি কুলো হাতে বধূ, আব্দুর রাজ্জাক মিঞ্চার ‘ছায়াদেবীর প্রেমকাহিনীতে’ মালা হাতে ডানাওয়ালা পরী। কিছু পুস্তিকায় লেখকের নিজের ছবি ছাপিয়ে থাকেন। কোন কোন পুস্তিকার প্রচ্ছদ চিত্রের নিচে কোন ঔষধের বিজ্ঞপ্তি, অত্র কবিতা নকলকারীর প্রতি হুঁশিয়ারি, মামলা, ক্ষতিপূরণ, জেলজুলুমের ভয় অথবা ‘আল্লাহর কাছে দায়ী থাকিবেন’ ইত্যাদি বক্তব্য লেখা থাকে। কবিতা শুরুর আগে পুথির আদলে পয়ার ছন্দে বন্দনা এবং কবিতা শুরু, কবিতা আরম্ভ লেখা থাকে। ভাটকবিতা পালাগানের সমগোত্রীয় হলেও এগুলো ততটা দীর্ঘ নয়। মানুষ দীর্ঘক্ষণ একটি বিষয় ধৈর্য সহকারে শুনতে পারেনা সম্ভবত এ জন্যই ভাটকবিরা তাদের রচনার পরিসরটি সংক্ষিপ্ত করেছেন।

আলোচনার বিষয় ‘ভাটকবিতায় মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনাম হলেও সম্মানিত পাঠকের সুবিধার্থে ভাটকবিতা সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য জেনে নেয়া জরুরী।

ভাটকবিতাগুলো যদিও কবিতা, তবু এগুলো কবিতার মতো গুরুগম্ভীর স্বরে পঠিত হয়না। এগুলো একটি স্বতন্ত্র সুরের মাধ্যমে পঠিত হয় যা ফোকলোরের অন্যান্য সঙ্গীতের মধ্যে দুর্লভ ফলে ভাটকবিতা ফোকলোরের একটি আলাদা দিক উন্মোচন করছে এর সুর দ্বারাও একটি পৃথক জগতের সৃষ্টি হয়েছে। সুরের বৈচিত্র বেশি না থাকলেও মাঝে মাঝে ধুয়া ও অন্যান্য সুর পরিলক্ষিত হয়। পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দেই অধিকাংশ ভাটকবিতা রচিত। সুরাশ্রয়ে কবিতাগুলো পঠনের স্টাইল শ্রোতাকে সহজেই আকর্ষণ করে। যেমন-
প্রথম আল্লা নবী ই মনে ভাবি কলম নিলাম হাতে
কবিতা লিখিতে বাসনা হইল মনেতে। পরে লিখে যাই

কবিতার শুরু থেকে প্রতি বেজোড় সংখ্যক পংক্তির তিন মাত্রাবৃত্তের প্রথম পদটি দুবার পঠিত হয় যার ফলে এটি একটি ভিন্ন মাত্রা পায় এবং বক্তব্যটি একটি আকর্ষণীয় ধ্বনিব্যঞ্চনায় শ্রোতাকে মোহবিষ্ট করে তোলে। খুব সম্ভবত দিত্ব উচ্চারণের এই রীতিটি মধ্যযুগের পুথি থেকে অনুসৃত।

ভাটকবিরা শুধুমাত্র একঘেয়ে প্রেমকাহিনি বর্ণনার মধ্যে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তারা বিচিত্রধর্মী বিষয়াদি নিয়ে কবিতা রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। প্রেমকাহিনিমূলক কবিতায় যেমন রগরগে বর্ণনা রয়েছে তেমনি ভাষা ও শব্দচয়নেও যৌনগন্ধি বিষয় লক্ষ্যণীয়। যেমন- শিউলী বাদলের প্রেমের খেলা, গৌরীবালা ও সুবোধের মধুর মিলন কবিতা, বউ বদলের কবিতা, সাহেদ আলী ও জরিনার হালকা প্রেমের কবিতা, কবিতা রসের ভান্ডার, বজলু মিয়া ও কমলা সুন্দরীর কবিতা, রিক্সাওয়ালা জলিল মিয়া ও ফুলমালার প্রেমের কবিতা, পদ্মার গাঙে প্রেমের খেলা কবিতা, হক ও লতার প্রেমের কবিতা। লিপিরানী ও আনোয়ারের প্রেমের কবিতা, নোয়ার আলী ও প্রিয় বালার প্রেমের কবিতা, বকুল মিয়া ও চান মিয়ার পীরিতের তুফান কবিতা উল্লেখযোগ্য।

এছাড়া অসম প্রেমের সম্পর্ক বিষয়ক অনেক ভাটকবিতা রচিত হয়েছে, যেগুলোর শিরোনাম দেখলেই সহজে অনুমেয়। যেমন-লাং ধইরাছে স্ত্রী তাই-স্বামী করছে স্ত্রী জবাই, নাতী করে দাদী বিয়া-দশ লাখ টাকা মহর দিয়া, বেতিন গাঁয়ের গফুর হাজী - ভ্যাস্তাবউকে করছে রাজী, চাচা-ভাস্তির প্রেম-কাহিনী কবিতা, শ্যালীদের প্রেমে দুলাভাই- সাত বোনের এক জামাই, খালা বোনপুতের প্রেম কাহিনী, শ্বাশুড়ীর প্রেমে জামাই খুন, মামা শ্বশুড় ও ভাগ্না বউয়ের কবিতা, শোনেন আমার পাঠকগণ-বউ কাটিছে স্বামীর ধুন, খোদার গজব দারুন কড়া - জামাই শ্বাশুড়ী লাগছে জোড়া এ ধরনের কবিতা উল্লেখযোগ্য।

ভাটকবিতাগুলো প্রাচীনকাল থেকে রচিত হয়ে লোকমুখে চলে আসছে। এর প্রচলন কখন শুরু হয়েছিল তার সঠিক কাল এখনো নিরূপিত হয়নি। মুদ্রিত আকারে এ ধরনের কবিতার প্রচার- প্রসার ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে। মুন্সি আবদুর রহমান প্রণীত ‘১২৮০ সালের দুর্ভিক্ষের পুঁথি’ ১৮৭৫ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত ‘আকালের পুঁথি’ এবং একই বৎসরে মুদ্রিত ‘তিরিক্ষা জ্বরের পুঁথি’ ওয়াইজদ্দিন-এর ‘গরকির বচন’ ১৮৭৬ সালের ঘুর্নিঝড়ের ওপর ভিত্তি করে কোরবান উল্লাহর ‘খন্ড প্রলয়’ (১৮৭৭) প্রভৃতি মুদ্রিত আকারে ভাটকবিতার প্রাচীন নমুনা। বিশ শতকে বাংলাদেশে অসংখ্য ভাটকবিতা প্রকাশিত হয়েছিল এগুলো আনন্দ- উত্তেজনার বিষয় হিসেবে সমকালে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করলেও পরবর্তীকালে সে সব হারিয়ে যায়। মুদ্রিত ভাটকবিতাগুলো ‘একমাত্র ব্যবহারের সামগ্রী’ হওয়ায় কেউই এগুলো সযত্নে রক্ষার প্রয়োজন অনুভব করেননি।

জাতীয় আর্কাইভস, গণ-গ্রন্থাগার এসব জায়গার এ গুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এ ধরনের কবিতা উচ্চাঙ্গ সাহিত্য পদবাচ্য না হওয়ায় বিদগ্ধজনের দৃষ্টিতে বরাবরই এগুলো অপাঙ্তেয় থেকে গেছে। কোন কোন কবি তার জীবদ্দশায় নিজের প্রকাশিত কবিতা পুস্তিকাগুলো সযত্নে রক্ষা করলেও তার মৃত্যুর পর সেগুলো আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে আমার ছেলেবেলায় আমার নিজ গ্রামেও যেসব ভাটকবিতা দেখেছি তার কোন অস্থিত্ব এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। নেত্রকোনার কোর্ট স্টেশন, বড় স্টেশন, বাংলা স্টেশন, ঠাকুরোকোনা, বারহাট্টা, অতিথপুর ও মোহনগঞ্জ রেলস্টেশনের বুক স্টলগুলোতে প্রচুর ভাটকবিতা বিক্রি হতো। গৌরীপুর রেলস্টেশনেও পাওয়া যেত বিচিত্র বিষয়ের ভাটকবিতা। এগুলো এখন হারিয়ে গেছে। এখন এ্রসব বুকস্টলের মালিকও বদল হয়েছে, তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ভাটকবিতা, পথ কবিতা, হাটুরে কবিতা নামটিই তারা প্রথম শুনেছেন। অথচ, এই গত শতকেও এগুলো গ্রামের নিরক্ষর বা অল্প শিক্ষিত জনসাধারণের কাছে রাতের অবসরে, কর্মব্যস্ত চাষীর ক্ষেত খামারে বা মোড়লের বৈঠকখানায় এক আনন্দ-ভান্ডাররূপে বিবেচিত হতো এই ভাট কবিতা। ভাটকবিতা রচনায় মুসলিম কবিগণ একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছেন। এক্ষেত্রে হিন্দু কবিদের রচনা একেবারেই নগন্য। হিন্দু কবিদের স্বল্প সংখ্যক রচনা পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ, মুসলিম ভাটকবিগণ জাগতিক নানা বিষয় প্রেম, ভালোবাসা, দ্বন্দ্ব সংঘাত, ঘটনা দুর্ঘটনা, জনমানুষের সুখদুখ নিয়ে প্রচুর কবিতা রচনা করেছেন। হিন্দু কবিরা যেখানে দেব নির্ভর এবং ধর্ম-গণ্ডিতে বিচরণকারী সেখানে মুসলিম কবিদের চিন্তাচেতনা একান্তই মৃত্তিকা সংলগ্ন।

মাসিক মোহাম্মদীর চৈত্র ১৩৩৫ সংখ্যায় ‘বঙ্গভাষার উপর মুসলমানদের প্রভাব’ শীর্ষক প্রবন্ধে দীনেশচন্দ্র সেন মন্তব্য করেন-
‘বঙ্গভাষা বঙ্গের পল্লীতে মুসলমানদের মধ্যে কিরূপ দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল হইয়াছে তাহা পূর্ববঙ্গের শত শত ছোট মুসলমানি কবিতা-গানে প্রকাশিত হইয়াছে। আমি অতি অল্প আয়াসে ১৮৮ খানি সেইরূপ মুদ্রিত পুস্তিকা সংগ্রহ করিয়াছি। তাহার অধিকাংশই মুসলমানের লেখা। স্থানীয় এমন কোন ঘটনা নাই যাহাদের সম্বন্ধে কৃষক কবিগণ পালাগন রচনা না করিয়াছেন। আরও শত শত পুস্তক ইচ্ছা করিলে সংগ্রহ করা যাইতে পারে।
বৎসর বৎসর এই ভাবের বহু সংখ্যক পুস্তিকা রচিত হইতেছে। মুসলমানদিগের ঐতিহাসিক বুদ্ধি ও রুচি স্বত:সিদ্ধ। এমন কোন ক্ষুদ্র কৌতুহলোদ্দীপক ঘটনা নাই, যাহা পল্লী কৃষকদের দৃষ্টি এড়াইয়াছে, তাহারা বঙ্গদেশে যখন যা ঘটিয়াছে তখনই সে সম্বন্ধে পালাগান রচনা করিয়া তাহা স্মরণীয় করিয়া রাখিয়াছে। বন্যা, ভূমিকম্প, অগ্নিদাহ, নৌকাডুবি যাহা কিছু হয় মুসলমান কৃষকগণ তখনই তাহা লইয়া বাঙ্গলায় পালাগান রচনা করিয়া থাকে।
...এই সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুস্তিকায় কামাল পাশা, ব্রহ্মদেশের লড়াই, থিবোর কথা ও মণিপুরের যুদ্ধ হইতে আরম্ভ করিয়া সামান্য মাঝির নৌকাডুবির বৃত্তান্ত পর্যন্ত সকল কথাই কবিতার ছন্দে লিখিত হইয়াছে। ঐ সকল পুস্তিকা পাড়াগাঁয়ে খবরের কাগজের কাজ করিয়া থাকে। উহা দ্বারা এই কথা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয় যে, বাঙ্গালা ভাষা পল্লীর নিরক্ষর মুসলমানদের হাতে আধুনিক সময় পর্যন্ত বিশেষভাবে গড়িয়া উঠিতেছে।’

ভাটকবিগণ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কবি। এদের অনেকেই নিরক্ষর কেউবা স্বল্প শিক্ষিত। তারা কবিতার ‘গ্রামার ব্যাকরণ’ জানেন না- সে বিবেচনায় সাধারণ মানুষের জন্য সহজবোধ্য ভাষায় কবিতা লেখার প্রয়াস পান। তারা এই কবিতা বিক্রির অর্থেই জীবিকা-নির্বাহ করেন। কবি-মন কল্পনাবিলাসী হলেও- তারা বাস্তব জগতেরই বাসিন্দা, তারা সমাজের মানুষের আনন্দ বেদনার সমঅংশীদার। কবির হৃদয়ের অনিবার্য আকুলতা থেকেই কবিতার জন্ম হয়। যে সমাজের দুর্দশা নিরসনে কবিরা সব সময় ব্যাকুলচিত্ত থাকেন সেই সমাজের মানুষের কাছ থেকে তারা সামান্য মর্যাদাতো দূরের কথা কখনো নিদারুণভাবে উপেক্ষিতও হন। দারিদ্রক্লিষ্ট জীবনের এক বিষাদময় আত্মজৈবনিক চিত্র ভাটকবি মফিজ উদ্দিন-এর কবিতায় অকপট সারল্যে বিধৃত হয়েছে।
মনের কল্পনায় ছন্দ যোগায় তাই তো কলম ধরি,
কল্পনা-সখির পিছে করি দৌড়াদৌড়ি।
জানি না লেখাপড়া মন-মরা শক্তিবল নাই,
কবিতা লিখিতে তবু কলম চালাই।
কবিতা লিখি তাই গ্রামার-নাই সে ব্যাকরণ,
গ্রাম্য ভাষায় কাহিনীর সব দিয়ে যাই বর্ণন।
লিখলে শুদ্ধ ভাষায় দেখা যায় গ্রামে তাকে যারা,
কঠিন ভাষায় লিখলে আবার পড়তে চায় না তারা।
তাই আদিঅন্তে ভেবে চিন্তে গ্রাম্য ভাষা দিয়া,
জীবিকা নির্বাহ করি কবিতা বেচিয়া।
তবে আমার মত লিখকগণ পল্লীগ্রামে থাকে,
দারিদ্রতার জ্বালায় মরি সমাজ কী তা ভাবে।
[মফিজ উদ্দিন-শিক্ষা সভ্যতা গেল মারা। বৌয়াকুড়। নরসিংদী। ১৯৭৯]

১. ভট্টাচার্য, মোক্ষদাচরন, নিরক্ষর কবি ও গ্রাম্য কবিতা (প্রবন্ধ), ত্রৈমাসিক সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা (দ্বাদশ ভাগ), শ্রী নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত, ১৩১২, কলিকাতা।
২. মাসিক মোহাম্মদী, চৈত্র ১৩৩৫।
৩. পাঠান, মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, বাংলাদেশের ভাটকবি ও কবিতা, ২০১২, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা।
৪. দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত- মৈমনসিংহ গীতিকা, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭৩, পৃষ্ঠা-২৬৫
৫. কবীর, বিলু, হাটুরে কবিতায় সমাজ, ২০১২, শোভা প্রকাশ, ঢাকা।

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ৮:২৯

অপ্‌সরা বলেছেন: ভাইয়া এই বইটা আমার লাগবেই লাগবে!

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:০৯

হাসান ইকবাল বলেছেন: আপনি রকমারি ডট কম থেকে অনলাইলে সংগ্রহ করতে পারেন। অথবা সরাসরি প্রকাশকের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।

অয়ন প্রকাশন
মিঠু কবির
01818-005219

২| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ৯:১৭

মলাসইলমুইনা বলেছেন: খুব ভালো একটা বই হয়েছে কন্টেনট আলোচনা থেকেই বুঝলাম | এই গবেষণাগুলো আমাদের এখন মনে হয় কমে গেছে অনেক | পড়ার ইচ্ছে রইলো কখনো কালেক্ট করতে পারলে | নইলে অপ্সরা, ধার দেবার জন্য রেডি থাকতে হবে |

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:১০

হাসান ইকবাল বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ।

৩| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ৯:৫৭

অপ্‌সরা বলেছেন: ধার না, আমি পেলে তোমাকেই পাঠায় দেবো মলা ভাইয়া! তবে তার আগে তোমার আকাশের ঠিকানাটা জানিও।

৪| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:০১

রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দরভাবে লিখেছেন।
এই বইটা অবশ্যই কিনব।

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:১০

হাসান ইকবাল বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.