নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বঙ্গভাষাপ্রেমী

হাসনাত ইবনে তারিক

সাংবাদিক, লেখক, সংস্কৃতিমনা

হাসনাত ইবনে তারিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

আরব বসন্তে পাওয়া, না পাওয়া

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:২৯

যে পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছিলো তিউনিসিয়ায়, সেই একই পরিবর্তনের ঢেউ মিশর, লিবিয়া, ইরাক, ওমান, ইয়েমেন, সুদান এবং সিরিয়া এমনকি সৌদি আরব পর্যন্তও আছড়ে পড়ে। বিশেষ করে আন্দোলনের নতুন এক ভাষা সম্পর্কে বিশ্ববাসী ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে পরিচিতি লাভ করতে থাকে। দীর্ঘদিনের একনায়কতান্ত্রিক শাসন, অসহায় মানবতার আর্তচিৎকার আর ক্ষুধা, দারিদ্র্য, হাহাকার, প্রবঞ্চনা-সব মিলিয়ে এ আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেও যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া যায় তা এই প্রথম বিশ্ববাসী সরাসরি দেখলো। এ প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হয়েছিলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ, ওয়ার্ডপ্রেস, মাইস্পেস, ইউটিউবসহ আরও বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে। তরুণ প্রজন্মের এমন প্রতিবাদী ভূমিকা, সাহসী মনোভাব ও লাগাতার প্রচারণায় বেরিয়ে আসতে থাকে একনায়কতান্ত্রিক সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা এবং নানা অপকর্মের রেকর্ড। এর পাশাপাশি বেরিয়ে আসে তাদের প্রশাসনের দূর্বলতা।

তিউনিসিয়া: বেকারত্বের জন্য মধ্যবিত্ত ঘরের একটি ছেলে তারেক আল তাইয়্যেব মোহাম্মদ বোউয়াজিজি। আত্মসম্মানের তোয়াক্কা না করেই দারিদ্র্যের করালগ্রাসেই ছেলেটি সিদি বওজিদে ফেরি করে বেড়াতো। হঠাৎ একদিন পুলিশ তার কাছে চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে না পারায় তাকে প্রহার করে পুলিশ। এ অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের গায়েই কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যা করে সে। ঘটনাটি ঘটে ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর। তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালে নেয়া হলেও বোউয়াজিজি ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি মারা যায়। তার এ আগুন মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে দেশটির সর্বত্র। অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো কম্পিত হয় স্বৈরশাসক বেন আলীর গদি। অবশেষে তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ১৪ জানুয়ারি পদত্যাগে বাধ্য হন বেন আলী।
মিশর: তিউনিসিয়ার পরেই আরব বিশ্বের অন্যান্য স্বৈরশাসককে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। বিশেষ করে মিশর ও লিবিয়াকে দিতে হয় চরম মূল্য। মিশরের কায়রোর তাহরির স্কয়ারে তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের মুখে ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন হোসনি মোবারক।
লিবিয়া: ধীরে ধীরে আরব বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশেই এ বসন্তের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে যে বিপ্লব করা সম্ভব আরব বিশ্বের একনায়কতান্ত্রিক সরকারের পদত্যাগই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। তরুণ প্রজন্মের ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

সিরিয়া: আরব বসন্তে সিরিয়ায় কেমন প্রভাব পড়লো সে আলোচনার শুরুতে ভূমিকা প্রয়োজন। কেননা ১৯৯১ সালে ইরাক যখন কুয়েত দখল করে নেয়, তখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম যুদ্ধ শুরু করে দেয়। এরপর ২৬ বছর পার হয়ে যায়। এর মধ্যেই ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ঘটে যায় ভয়াবহতম ঘটনা। নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বসে পড়লো নৃশংস এক বিমান হামলায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের দোহাই দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে ২০০৩ সালের ২০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালায়। আর এ হামলার ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু করে। সুদীর্ঘ ১৮ বছর ধরে এ যুদ্ধ এখনো চলছে এবং আফগানিস্তানের তালেবান প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা চলছে যুদ্ধবিরতির জন্য। এ দিকে ইরাকে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে যুদ্ধবন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১১ সালের ১৯ মার্চ ইঙ্গ-মার্কিন বিমান হামলায় জ্বলে ওঠে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি। এটা যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় যুদ্ধ। অবশ্য এবার যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের মতো সেনাবাহিনী পাঠায়নি। এসময় সাদ্দাম হোসেনের মতো মুয়াম্মার গাদ্দাফিও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। সেকারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেয়া হয়। এসময় নতুন করে একটি তত্ত্বের উদ্ভাবন ঘটায় তারা আর সেটি হলো- Humanitarian Intervention অর্থাৎ মানবিক কারণে সামরিক হস্তক্ষেপ। ২০০৩ সালে জাতিসংঘ যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের অনুমোদন না দিলেও ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের’ জন্য একটি বিল পাস করে। তবে এতে কোনোভাবেই যুদ্ধকে অনুমোদন করা হয়নি বলে দাবি করতে থাকে জাতিসংঘের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। একই ভাবে ২০১১ সালের লিবিয়া আক্রমণের সময়ও জাতিসংঘ জানায় তারা যুদ্ধের অনুমোদন দেয়নি। ১৯৯১ সালে ও ২০০৩ সালে ইরাকে প্রথম ও দ্বিতীয়, ২০১১ সালে লিবিয়ায় তৃতীয় এবং ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই সিরিয়ায় আরেকটি যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দেয় যাকে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকগণ চতুর্থ যুদ্ধ হিসেবেই দেখছেন। লিবিয়ার ক্ষেত্রে যেমন Humanitarian Intervention নামে নতুন একটি তত্ত্ব উদ্ভাবিত হয়েছিলো তেমনই সিরিয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি তত্ত্ব সামনে এলো আর তা হলো- Responsibility to protect অর্থাৎ মানবাধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্বের অংশ হিসেবেই দেশটিতে মিসাইল চালানোর উদ্যোগ নেয় যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ধীরে আরব বসন্তের প্রভাব থেকে সরে পড়তে থাকে সিরিয়া এবং বহুধাবিভক্ত হতে থাকে তারা। এমন অবস্থায় ২০১৩ সালে আল-কায়েদার উত্থান ঘটে এবং ২০১৪ সালে সিরিয়ার গ্র্যান্ড আল-নূরী মসজিদে কথিত খিলাফত ঘোষণা করেন ইসলামিক স্টেটস অব ইরাক অ্যান্ড শাম (আইএসআইএস) এর প্রধান নেতা আবু বকর আল বাগদাদি যিনি মাত্র একবারই দৃশ্যপটে আসেন।
এসময় সিরিয়ায় বিদ্রোহীরা বাশার-আল আসাদের পদত্যাগের দাবিতে থাকলেও মূলত আইএসকে সামনে এনে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্রব্যবসায়ের স্বার্থ হাসিল করতে থাকে। আর তাই সেখানে কুর্দিদের আইএসের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র এবং ২০ হাজার সেনা মোতায়েন করে। অবশ্য এখন যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করে নিলেও ইসরায়েলের অনুরোধে ৬ হাজার সেনা অব্যাহত রাখে এবং দেশটির কাছ থেকে তেলের ওপর পাওনা বিদ্যমান বলেও দাবি করে যুক্তরাষ্ট্র। এর কারণ হিসেবে অবশ্য তারা এখনো ৬ হাজার সেনা বিদ্যমান রাখার বিষয়টি জানায়। অপরদিকে কুর্দিরা আইএসকে দূর্বল করে দিলেও দেশটির বিদ্রোহীরা এখনও বাশার-আল আসাদের সরকারের পতন চায় এবং প্রেসিডেন্ট বাশার-আল আসাদও কোনোভাবেই পদত্যাগ করতে রাজি নন বলে জানান। ফলে সিরিয়ায় এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
সৌদি রাজনীতি এবং আরব বিশ্বের সংকট: সনাতন মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও বর্তমানে দেশটি প্রক্সি রাষ্ট্রের উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এর মূল কারণ মার্কিন স্বার্থ দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকা। দেশটির বাদশাহকে বলা হয়- Custodian of the two Holy Masjid অর্থাৎ দুটি পবিত্র মসজিদের (মসজিদ-আল-হারাম ও মসজিদে নববী) আমানতদার। এ দুটি মসজিতের মধ্যে মসজিদ-আল-হারাম মক্কা নগরীতে এবং মসজিদে নববী মদিনা নগরীতে অবস্থিত। মসজিদ-আল-হারাম বায়তুল্লাহ তথা কাবা শরিফ নামেও সবিশেষ পরিচিত। ২০১৮ সালে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিলো অর্থাৎ ১.৮ বিলিয়ন মানুষ এ ধর্মাবলম্বী ছিলো। এসময় বলা হতে থাকে বিশ্বের দ্বিতীয় বড় ধর্ম ইসলাম। মধ্যপ্রাচ্য তথা Mena অঞ্চলে ২৭.১ ভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠী থাকলেও দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকায় ৩০.৬ ভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠী বসবাস করে। এরপর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে সৌদি আরব বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আরব বসন্তের আগ পর্যন্ত সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়ে আসলেও ২০১৭ সালের ২১ জুন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে অভিষিক্ত হলে তখন থেকে বিতর্ক শুরু হয়। কেননা এ সময় থেকে ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি ও পরোক্ষ যোগাযোগ, কাতারের সঙ্গে যুদ্ধ, ইয়েমেনে সামরিক আগ্রাসন সালমানের ভূমিকাকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তেমনই এতে সৌদি আরবের ভূমিকাও সমালোচিত হয়েছে।
তবে সৌদি আরবের ইতিহাস বড়ই বিচিত্র। ১৭৪৪ সালে আদ্-দারিয়া নামে একটি ছোট শহর ছিলো যে শহরের প্রধান ছিলেন মোহাম্মদ ইবনে সউদ। তিনি ছিলেন বেদুইন গোত্র প্রধান। এ শহরটি বর্তমান রিয়াদ শহরের নিকটবর্তী ছিলো। সেসময় ওয়াহাবি আন্দোলন নামে এক ধর্মীয় আন্দোলনের প্রভাব সেখানে ছিলো। এ আন্দোলনের নেতা আবদ-আল-ওয়াহাব-এর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে আজকের সউদি আরব তথা সৌদি আরব রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেন। আজকের এই সৌদি আরব চারটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত- হেজাজ, নাজাদ, আল আহসা ও আসির। আজকের আধুনিক সৌদি আরব প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩২ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা ইবনে সউদ। ১৯০২ সালে এ চারটি অঞ্চলকে একত্রিত করার উদ্যোগ নিলে তিনি তাতে সফল হন। এছাড়া বর্তমান সৌদি আরব এক সময় তুর্কি-অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিলো। এ রাষ্ট্রটি একত্রিত হওয়ার আগে চারটি অঞ্চলে গোত্রীয় শাসন ছিলো। ১৯১৩ সালে ইখওয়ান নামে এক ওয়াহাবি মতাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত বেদুঈন সেনাবাহিনীর সাহায্যে তুর্কি-অটোমান সুলতানদের কাছ থেকে আল আহসা দখল করে নেন। ঠিক একই সময় মক্কার শরিফ হোসাইন বিন আলী তুর্কি-অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং এ বিদ্রোহ ১৯১৬ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিলো। পরবর্তীতে এ বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির জয়ের ফলে এবং আরাবিয়ায় তুর্কি-অটোমান সাম্রাজ্য উৎখাত হয়ে যাওয়ার ফলে এ বিদ্রোহও বন্ধ হয়ে যায়। (তারেক শামসুর রেহমান, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি)
একথা অস্বীকার করা যাবে না যে সুন্নী দেশগুলোর প্রধান দুই মেরুদণ্ড পাকিস্তান ও মিশরকে এক রকম ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে এবং তুরস্ককে রাখা হয়েছে বিচ্ছিন্ন। আর এর সুযোগে সৌদি আরব ও ইরানকে মুসলিম বিশ্বের ত্রাণকর্তা হিসেবে দেখানো হচ্ছে। বিষয়টা হলো সৌদি আরব সুন্নীদের প্রতিনিধিত্ব করে আর ইরান শিয়াদের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই শিয়া-সুন্নী বিভেদকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র রক্ষা করছে তাদের তেল স্বার্থ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম লক্ষ্য হলো প্রাথমিকভাবে ইরানের প্রভাব ইরাকে এবং পরবর্তীতে সিরিয়া, লেবানন, উপসাগরীয় অঞ্চল এবং ইয়েমেনে নিয়ে যাওয়া যা তারা করতে সমর্থ হয়েছে। দ্বিতীয় লক্ষ্য খুব অল্প সময়ের জন্য তুরস্ককে নিষ্ক্রিয় করে রাখা। মোদ্দা কথা, সমগ্র মুসলিম বিশ্বের ভাগ্য নির্ধারণে সৌদি আরব, তুরস্ক ও ইরান ভূমিকা পালন করলেও এ তিন দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের দ্বন্দ্ব ও দুরত্বে বেড়েই চলেছে আর ইহুদিবাদী ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সখ্যতা ক্রমশ বাড়ছে। যা সমগ্র মুসলিম বিশ্বের ভবিষ্যত রাজনীতি সম্পর্কে আভাস দিচ্ছে।
তবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে তুরস্ক একটি ফ্যাক্টর। তুরস্ক সিরিয়ায় সেনা অভিযান পরিচালনা করছে। মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের ভূমিকা নিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) জাহাঙ্গীর আলম (দৈনিক যুগান্তর, ০২ অক্টোবর ২০১৮) এক প্রবন্ধে লেখেন, ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ার বাথ পার্টির বাশার-আল আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত অনেকগুলো দল। বিশেষ করে বাশার-আল আসাদের একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে সুন্নী আরব, ফ্রি সিরিয়ান আর্মি, কুর্দি-সিরিয়ান গণতান্ত্রিক ফোর্স, সালাফি জিহাদি, ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভেন্ট (আইএসআইএল) ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি ফোর্স সরাসরি ও পরোক্ষভাবে জড়িত। রাশিয়া ২০১৫ সাল থেকে তাদের বিমান বাহিনী দিয়ে সিরিয়ার বাশার-আল আসাদের বাহিনীকে সহায়তা করে আসছে। অন্যদিকে মার্কিন সামরিক বাহিনী ২০১৪ সাল থেকে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী তথা বাশার-আল আসাদের বাহিনীর পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় আঘাত হেনে আসছে। ২০১৬ সাল থেকে তুরস্ক ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে ব্যাপক পরিসরে সহযোগিতা ছাড়াও দেশটির উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের একটি এলাকা দখলে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহল সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সব পক্ষের নেয়া ব্যবস্থায় ধ্বংস, হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ আছে।
অবশিষ্ট আরব বিশ্ব: ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহ নিহত হওয়ার পর যে প্রশ্নটি ওঠে যে ইয়েমেনের পরিস্থিতি কোনদিকে গড়াবে। ইয়েমেন সংকটকে কেন্দ্র করে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে চলছে এক ধরনের প্রক্সি-যুদ্ধ।
বেশ কয়েক বছর ধরে ইয়েমেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। কেননা ২০১৫ সাল থেকে সৌদি আরবের বিমান বাহিনী নিয়মিতভাবেই বিমান হামলা করে আসলেও হুথিদের দমন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ গৃহযুদ্ধ মূলত দেশটিকে একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠীর ভেতর বিভক্ত করে রেখেছে। বিশেষ করে দেশটির রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী কতৃক পরিচালিত সুপ্রীম পলিটিক্যাল কাউন্সিল। এর আবার আরেকটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির হাদি সরকার ও তার সমর্থকরা। হুথি ও হাদি সরকার চরমভাবে যুদ্ধে লিপ্ত। অবশ্য আল-কায়েদা সমর্থিত আনসার-আল শাহরিয়ার-এর নিয়ন্ত্রণেও কিছু অংশ রয়েছে। হুথিরা মূলত শিয়া সম্প্রদায়ের জায়েদি অংশের অন্তর্ভুক্ত। ২০১১ সালের আরব বসন্ত আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন আলী আবদেল সালেহ। তার স্থলাভিষিক্ত হন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদ রাব্বু মনসুর হাদি। পরবর্তী সময় ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। ইয়েমেনের বিভিন্ন দল ও গোত্রের সঙ্গে ন্যাশনাল ডায়লগ কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হলেও এখন সংবিধান প্রণয়নে স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি।
ইরান আরব বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত না হলেও ইরানে আরব বসন্তের প্রভাব কিছুটা হলেও পড়েছে। তুলনামূলক বিচারে সেখানকার সরকার অনেক শক্ত অবস্থানে থাকায় সেখানে এ বসন্ত দাঁড়াতে পারেনি। বিশেষ করে ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর ইরানের বেশ কয়েকটি শহরে সরকারবিরোধী যে বিক্ষোভ হয়, তা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা এনে দেয়। ট্রাম্প জেরুজালেম সংক্রান্ত বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিলেও ইরানে নতুন করে বেশ কয়েকবার বিক্ষোভ হয়। চলতি বছর ১৪ নভেম্বর দেশটিতে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি দশ হাজার থেকে ১৫ হাজার রিয়াল করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে দুই শতাধিক নিহত ও সাত সহস্রাধিক গ্রেপ্তার হয়।
একই সঙ্গে ইরাকে সরকারের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি ও সীমাহীন স্বজনপ্রীতি, স্ফীত বেকারত্ব এবং নিম্নমানের অর্থনৈতিক পরিষেবা ও অর্থনৈতিক মন্দার প্রতিবাদে চলতি বছর অক্টোবর থেকে শুরু হয় বিক্ষোভ। এতে চার শতাধিক নিহত এবং ২০ সহস্রাধিক আহত হয়। এমনকি লেবাননে হোয়াটসঅ্যাপের ওপর কর আরোপের প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং গণবিক্ষোভের মুখে দেশটির সরকার হোয়াটসঅ্যাপের ওপর থেকে কর প্রত্যাহার করে নেয়।
ফলে আরব বসন্ত আমাদের সামনে কিছুসংখ্যক দৃষ্টান্ত ছাড়া আর কিছু দিতে সক্ষম হয়নি। বরং একে কেন্দ্র করে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি হয়েছে। যার সুবিধা ভোগ করছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বসন্ত তিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়া, লেবানন, সৌদি আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরানে সাময়িকভাবে শান্তি এনে দিলেও পরবর্তীতে যেই লাউ সেই কদুতেই ফিরে গেছে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলো। যে কারণে মিশরের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হলো মোহম্মদ মুরসিকে। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। সিরিয়ায় যে কারণে আজ অবিশ্রান্ত রক্ত ঝরছে। এই বসন্তের কারণেই সৃষ্টি হয়েছে আইএস যারা বিভৎসভাবে মধ্যযুগীয় কায়দায় ধর্মের অপব্যাখ্যা করে মানুষ হত্যায় লিপ্ত হয়েছিলো।

তথ্যসূত্র :
১। Click This Link
২। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, তারেক শামসুর রেহমান
৩। Click This Link
৪। http://itibritto.com/arab-spring/
৫। Click This Link
৬। Click This Link

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.