নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাচৌ

এক কথায় ভাবুক! বহুকথায় আমি একজন স্বাধীন মানুষ, রোবট নই! তাই কারো কথায় সহজে প্রভাবিত হই না,সবার কথা শুনি, সবার লিখা পড়ি, হৃদয় দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি , কেন তিনি এমন করে ভাবছেন!বুদ্ধিমান মানুষের সঙ্গ খুব উপভোগ করি,তাদের সাথে মতের মিল হলে ভাল, না হলে আরও ভাল, গলায় জড়াজড়ি করে বলি, আসেন আপনার কাছ থেকেই নতুন কিছু শেখা যাবে!

সাচৌ › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্বীকারোক্তি !

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১:৪২



রকিং চেয়ারে চুপচাপ বসে হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস পড়ার অভ্যাসটা মিসেস তানজিলা কবির সম্ভবত তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন। তার বাবা মাসের প্রথমে বেতন পেলেই একটা হুমায়ুনের বই কিনে ঘরে ফিরতেন। মধ্যবিত্তের বিলাসিতাই বলা চলে এক কথায়। বাবার অবশ্য রকিং চেয়ার ছিল না, সরকারী বাসার ছোট বারান্দার কাঠের চেয়ারটাই ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় আসবাব।মাসের শুরুতে কেনা বইটা তিনি পুরো মাস ধরে এতবার পড়তেন যেন প্রাইমারী স্কুলের কোন বালক তার পড়া মুখস্থ করছে।

বাবার মৃত্যুর পর এইদেশের কোন মেয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু না পেলেও সে এই বইগুলো নিয়ে এসেছে । অবশ্য অন্য কোন সম্পদের প্রয়োজন ও নেই তার। ইউনিভার্সিটিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়ে যায় শাহারিয়াত কবির সাহেবের সাথে।এক জীবনে বহু মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, কিন্তু কবির সাহেবের মত হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুষ তিনি দেখেন নি।যখন তার চুল একটু একটু সাদা হতে শুরু করে,তখন থেকে কবির সাহেব তাকে বুড়ি ডাকা শুরু করেন ঠাট্টা করে।

প্রতিদিন দুপুরে সংসারের টুকিটাকি কাজ সেরে এইভাবে বই পড়া তার অভ্যেস, তবে আজ তার একটু একটু অস্থির লাগছে। আর একটু পরই তার ছোট মেয়ে সুহার রেজাল্ট দিবে এসএসসির।অথচ অস্থির হওয়ার কোন কারণই নেই। শহরের নামকরা গার্লস স্কুলের থার্ড গার্ল ছিল তার মেয়ে। টেস্টেও এ+ পেয়েছে।বাবা মেয়ে দুইজন মিলে রেজাল্ট আনতে স্কুলে গিয়েছে, মেয়েটাও ঠিক তার মত বাবা ঘেঁষা হয়েছে।

ইচ্ছে করলেই ইন্টারনেটে রেজাল্ট দেখা যায় আজকাল ,কিন্তু কবির সাহেবের মতে এতে পাশ করার আনন্দটা ঠিক বোঝা যায় না। স্কুলের নোটিশ বোর্ডের দেয়ালে দপ্তরী আঠা দিয়ে রেজাল্ট টানানোর আগেই মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে,রেজাল্ট দেখে আনন্দে লাফালাফি করবে তবেই না বোঝা যাবে কিছু একটা হয়েছে।মিসেস তানজিলা জানেন কেন কবির সাহেব আসলে মেয়ের সাথে রওনা দিয়েছেন। বহুদিন পর মেয়েকে ছোট বেলার মত বুকে জড়িয়ে ধরবেন , মেয়েও কাঁদবে মেয়ের বাবাও খুশিতে চোখ মুছবেন।বড় ছেলে পাপনের রেজাল্ট দেওয়ার দিনেও একই ঘটনা হয়েছিল।

যতই সময় গড়াতে থাকে মিসেস তানজিলার অস্থিরতা ততই বাড়তে থাকে,স্মৃতি তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ১৯৯২ সালের মে মাসের ২৯ তারিখে ।সেই দিন তানজিলান নূরের মেট্রিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল, সবাই আশা করে ছিল সে স্ট্যান্ড না করলেও এই জাতীয় কিছু একটা করবে, বিশেষ করে তার বাবা।







ক্লাস নাইনের বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিল সে,ভাল ছাত্রী হিসেবে সব শিক্ষকই তাকে আদর করতেন। পঞ্চম পিরিয়ডে সুমন্ত দা কে একটা ফিজিক্সের বই হাতে নিয়ে ক্লাসে ঢুকতে দেখে প্রায় লাফিয়ে উঠল সে।সুমন্ত দা তো তার বড় ভাইয়ার বন্ধু,ভাইয়া আর উনি প্রায় একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিলেন। শুধু নামটা ভিন্ন ভাইয়া জাতীয় আর উনি চট্টগ্রাম!

ক্লাসে এসেই সুমন্ত দা বোর্ডে লিখালিখি শুরু করে দিলেন, কথা নেই বার্তা নেই হুট করে পড়ান শুরু করে দিলেই হল? ফিজিক্সের মত কাটখোট্টা বিষয়কে ম্যাজিকের মত করে পান্তা ভাত বানিয়ে ফেলে ক্লাসের প্রায় শেষ পর্যায়ে বলেলনঃ আমি তোমাদের ফিজিক্স ক্লাস নিব আজ থেকে, তবে পার্ট টাইম শিক্ষক হিসেবে, তোমাদের নতুন শিক্ষক এসে পড়লেই আমার দ্বায়িত্ব শেষ!প্রতিদিন তিনজন করে নাম ঠিকানা বলে আমার সাথে পরিচিত হবে।সবার নাম একসাথে বললে কিছুই মনে থাকবে না আমার !

ওমা সুমন্ত দা তাহলে আজ থেকে আমাদের শিক্ষক? তাকে তো তাহলে স্যার ডাকতে হবে, কিন্তু তাকে স্যার ডাকবে কিভাবে? সুমন্ত দা তো ভাই মানুষ, ভাই মানুষকে কি শিক্ষক ডাকা যায়? শিক্ষক হতে হলে পান খেতে হয়, চিবিয়ে চিবিয়ে কোলা ব্যাঙের মত পেটের ভিতর থেকে কথা বলতে হয়,পিচ করে ক্লাসের জানালা দিয়ে পিক ফেলতে হয়, চশমার ফাঁকের ভিতর দিয়ে তাকিয়ে পড়া ধরতে হয়,পড়া শিখুক আর না শিখুক যেই কোন অজুহাতে মাঝে মধ্যে ছাত্রদেরকে কঠিন ধোলাই লাগাতে হয়! এই সমস্ত যোগ্যতার কোনটাই সুমন্ত দাদার নাই! শিক্ষক হিসেবে সুমন্ত দার ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ হল সে!

:এই ছেলে তোমার নাম কি?বলেই তিনি ইংগিত করলেন তাদের স্কুলে আসা নতুন ছেলেটার দিকে।

: আশরাফ! নতুন এসেছি স্যার এই স্কুলে!

: আগের স্কুলের নাম কি?

: ইস্পাহানী পাবলিক স্কুল, স্যার!

:ও, ভাল স্কুল, খুব ভাল স্কুল!

সুমন্ত দা কে সে অন্য শিক্ষকের চেয়ে আলাদা ভেবেছিল, কিন্তু দেখা গেল তিনিও সেই কাতারেই পড়েন। শহর থেকে নতুন কোন ছাত্র এলেই শিক্ষকরা তাকে নিয়ে এমন মাতামাতি শুরু করে দেয়,যেন মহামান্য আইনস্টাইন এসেছেন কোথাও থেকে! অথচ বিখ্যাত সব ব্যক্তিরাই মফস্বল বা গ্রামের স্কুল থেকে পড়াশোনা করেছে। সে শিওর এই আব্দুল আশরাফ এইবার হায়ার ম্যাথে ০০০০০০৫ পাবে!







ত্রিশা আশা করেছিল সুমন্ত দা তাকে নাম ধরে ডাকবেন, কিন্তু তিনি তার দিকে ফিরেও তাকাল না।মনে হয় চিনতে পারেন নি। অনেক দিন পরে দেখেছে তো তাই!ভাইয়া বাসায় আসুক এই নিয়ে নালিশ জানাতে হবে।

তারপর দিনই ক্লাসের শেষ পর্যায়ে তিনি ত্রিশার দিকে তাকিয়ে বললেন,

:এই যে মিস পিচ্চি, বলত নিউটনের তৃতীয় সূত্রটা কি ?

ত্রিশার অপমানে,রাগে,দুঃখে চোখে পানি চলে এলো, তাকে সুমন্ত দা নাম ধরে ডাকে নি তার উপর আবার পিচ্চি বলেছে! নিউটনের তৃতীয় সূত্র জানে না, এমন গাধা আল্লাহর দুনিয়ার আছে নাকি?সে উত্তর না দিয়ে চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করল প্রাণপণে!

:এত সহজ জিনিস জান না? ফার্স্ট হয়েছ কিভাবে? দেখি কে পারবে বল।

আব্দুল আশরাফ ৩২টা দাঁত বের করে হাত তুলল, এমন হলুদ দাঁত মনে হয় দুই সপ্তাহ ব্রাশ করে নি!

:Every action has an equal and opposite reaction!

: অসাধারণ!তুমি বস, আর অ্যাই যে মিস পিচ্চি তুমি দুই মিনিট দাঁড়িয়ে থাক নিশ্বাস বন্ধ করে, এইটা তোমার শাস্তি।

বেটা আব্দুল আশরাফ মাতব্বরি ফলানোর জন্য ইংরেজিতে উত্তর দিয়েছে, যেন আমরা কেউ ইংরেজি জানি না!তোর ইংরেজিতে দৌড় I go,You go পর্যন্ত আমরা জানি না মনে হয়। তার উপর go তুই ঠিক মত উচ্চারণ করতেও পারিস না শুনতে মনে হয় I গু, You গু!

প্রায় বিশ মিনিট ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সুমন্ত দার কোন খেয়ালই নেই। তিনি এক মনে ক্লাস নিয়ে , পড়া দিয়ে বের হয়ে গেলেন। একঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর ত্রিশা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার সময় বেঞ্চের কোনার সাথে বাড়ি খেয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলল !







পর পর দুইদিন ক্লাস মিস দেওয়ার পর ত্রিশা স্কুলে এলো, প্রথম ক্লাসটাই সুমন্ত দার।

:এইযে মিস মাথা ফাটা পিচ্চি তোমার মাথা ফাটল কিভাবে? নিউটনের তৃতীয় সূত্র মুখস্থ করতে বলেছিলাম আমি মাথা ফাটিয়ে প্রাকটিক্যাল তো করতে বলি নি, তোমার নাম কি?

উত্তর দিবে না ভাবতে ভাবতেই বলে ফেলল,

:তানজিলান নূর!

:বাহ, ভালো নাম তো। অর্থ জান এই নামের ?

:জানি,নূর মানে আলো! উফফ আবারো উত্তর দিয়ে ,সে নিজের উপর খানিকটা বিরক্ত।

:পুরো নামের মানে কি?

: অবতীর্ণ আলো! বাবা রেখেছেন ,আমার যেইদিন জন্ম হয়েছিল সেই দিন ফকফকা চাঁদের আলো ছিল তাই!

:হুম্ম , তোমার বাবা তো সাংঘাতিক সাহিত্যিক!

আপনাকে বলতে হবে না আমি জানি,আপন মনে বিড়বিড় করে বলল সে। মানুষের নাম নিয়ে এত গবেষণা কেন, নিজের নামটা পারলে পাল্টে ঘুমন্ত রাখেন। বেশ মানাবে চেহারার সাথে , সুমন্ত-ঘুমন্ত। পুরো চেহারার অর্ধেকটা জুড়েই নাকের দখল,দূর থেকে কেউ হঠাৎ তাকালে মনে করতে পারে একটা মোটাতাজা নাক হেটে হেটে আসছে!







ফিজিক্স বিষয়টা নিয়ে এত মাতামাতি করার কি আছে তা ত্রিশা বুঝতে পারে না।অথচ সুমন্ত দা এমনভাবে ফিজিক্স পড়ান যেন তিনি হৈমন্তীর বিরহ বেদনার গল্প বলছেন।ক্লাসের মধ্যখানে কখনও কখনও তিনি অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবেন!বিশেষ করে যেদিন তিনি ক্লাস টেস্ট নেন সেদিন ব্লাকবোর্ডে প্রশ্ন লিখে ভাবুক কবির মত জানালা দিয়ে রাস্তার মানুষের আনাগোনা দেখেন। ভাবালু চোখের সুমন্ত দা কে বরং বাংলার শিক্ষক হিসেবেই ভালো মানাবে!



একদিন ক্লাসে এসে মাত্র সুমন্ত দা প্রায় আছাড় দিয়ে বই টেবিলে রাখলেন , ত্রিশা ভয়ে ভয়ে কারন জানতে চেয়েও চায়নি। সেদিন তিনি প্রায় কিছুই পড়ান নি। পরদিন ক্লাসে এসেই তিনি বললেনঃ গতকাল মনটা খুব খারাপ ছিল রে !

ত্রিশা ভেবেছিল কারনটা জানতে চাইবে, কিন্তু এর আগেই বেটা উজবুক আশরাফ আবারো মাতব্বরি ফলালো।

:কেন স্যার?

এই বেটাকে ধরে নাকে মুখে খাঁটি সরিষার তেল মাখান উচিত, ত্রিশা বিড়বিড় করল।

:বুঝলি জীবনেও টিউশনি করবি না তোরা, স্বাধীন ভাবে পড়াশোনা করবি। পরীক্ষা ছিল আমার, স্টুডেন্টের মাকে বললাম যে দুইদিন আসতে পারব না । শুনে মহিলার সে কি ঢং ! স্যার আপনি না আসলে ও তো একদম পড়তে চায় না, প্লীজ স্যার আধাঘণ্টার জন্য হলেও আসেন। যেন আমি আসলেই উনার ছেলের ক্লাস রোল-১ হয়ে যাবে। আরে বলিস না আর ,বড়লোকের ছেলেপুলে পড়ানোর যন্ত্রনাই আলাদা । সারা বছর মা শপিং করে বেড়াবে আর ছেলের রেজাল্ট খারাপ হলে সব দোষ মাস্টারের! যেন আমি কোন ম্যাজিক জানি!

শুনে ত্রিশার রাগ হল ওই মহিলার উপর, সে বললঃ টিউশানিটা ছেড়ে দিতেন !

শুনে সুমন্তদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেনঃ একটা ছেড়ে দিয়েছিলাম একবার , বাবা মারা যাওয়ার মাত্র তিন দিন পার হয়েছে, এর মাঝেই এক স্টুডেন্টের মা আমাদের ল্যান্ডফোনে তার ছেলেকে দিয়ে কল করিয়ে জানতে চাইলঃTeacher, mom wants to know when are you coming? বলে দিলামঃ I will not come any more। এরপর সেই মহিলার খালি পায়ে ধরতে বাকি ছিল হা হা!

হাসলে সুমন্ত দা কে অসাধারন লাগে!

ক্লাস টেস্টে আব্দুল আশরাফ একবার ও ত্রিশার চেয়ে বেশী নাম্বার পায় নি, শুধু সেইদিন ত্রিশা খাতাই জমা দিতে পারেনি । সুমন্ত দার জন্য তার বুকের মাঝে খুব খুব খারাপ লাগছিল । বাবা মারা যাওয়ার পর এই কলোনি ছেড়ে ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া করে থাকেন উনারা ! আচ্ছা মানুষের বাবা-মা না মারা গেলে কি খুব বেশী ক্ষতি হত এই পৃথিবীর কঠিন নিয়ম-শৃংখলার?







বড় ভাইয়াকে দিয়ে খুব করে বলানোর পর সুমন্ত দা ত্রিশাকে পড়ানোর জন্য রাজি হয়েছিল। সেই দিনগুলো ছিল একেবারেই অন্যরকম, তার জীবনে এত বর্ণিল রহস্যময় সময় কখনও আসে নি আর । যেই তিন দিন সুমন্ত দা পড়াতে আসতেন, তিনি না আসা পর্যন্ত ত্রিশার কেমন যেন অস্থির লাগত। পড়ানোর সময় সুমন্ত দা কখনও ত্রিশার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেন না , বই এর দিকে তাকিয়ে থাকতেন সারাক্ষন । যেন তার দিকে তাকান ভয়ানক কোন পাপ !পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে নিজের চুল টানতেন মাঝেমধ্যে কেন যেন! মাথা কি খুব ব্যাথা করত কি না কে জানে? নিজের রেডলীফ কলম ছাড়া অন্য কোন কলম দিয়ে ভুলেও লিখতেন না । যেদিন ত্রিশা কলম লুকিয়ে ফেলত , সেইদিন উনি আর কিছু লিখেতেনই না। খালি বকবক করে পড়িয়ে যান, যেন ত্রিশার আঙুলের স্পর্শে উনি কিং মিদাসের স্ট্যাচু হয়ে যাবেন! ত্রিশার সব চেয়ে ভালো লাগত তিনি যখন শাসনের স্বরে বলতেনঃ কি ব্যাপার তানজিলান নূর? হোমওয়ার্ক কর নি কেন! একমাত্র বাবাই তাকে এত সুন্দর করে তানজিলান নূর বলেন ডাকত, সবচেয়ে বিশ্রী ভাবে ডাকত বান্ধবীরাঃ টিসা!



ত্রিশা একরকম নিশ্চিতই ছিল সে টেস্টে ফিজিক্সে স্টার মার্ক পাবে,অথচ সবাইকে অবাক করে দিয়ে যেই তিনজন স্টার মার্ক পেল তার মাঝে ত্রিশার নাম ছিল না ।সে পেয়েছিল ৬৯ । শুধু মাত্র এই বিষয়ে কম মার্কস পাওয়ার কারনে সে সেকেন্ড হয়ে গেল আর আব্দুল আশরাফ ফার্স্ট!

সেইদিন বিকেলে সুমন্ত দা ত্রিশাকে পড়াতে আসলেন , কিন্তু ত্রিশা জানাল সে পড়বে না আজ তার খুব মাথা ব্যাথা।পরদিন সুমন্ত স্যার এলে সে জানতে চাইলঃআপনি জানতেন আমি ফিজিক্সে ৬৯ পেয়েছি?

:হ্যা!

:আমাকে বলেন নি কেন?

:বললে কি তুমি আশরাফের মত ৯৬ পেতে?

:না কিন্তু আমি রেজাল্ট আনতে স্কুলে যেতাম না!

:এতটা ছেলেমানুষী করলে হয় না, আর তোমাকে আগেভাগে রেজাল্ট জানালে স্কুলের রুলস ভাঙা হত!

:তাই বলে আপনি আমাকে কিছুই জানাবেন না? আমার কি ভুল হয়েছিল পরীক্ষায়?

:তুমি সময়ের প্রসারনের অংকে ও থিওরীতে ছোট্ট একটা ভুল করেছিলে, অন্য শিক্ষক হলে তোমাকে ঠিকই নাম্বার দিতেন কিন্তু একজন বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমার পক্ষে দেওয়া অসম্ভব ছিল!

:ঠিক আছে ! আপনি ভালো করেছেন ,আপনি আপনার বিজ্ঞানের ছাত্রত্ব অটুট রাখুন আমাকে আর পড়াতে আসবেন না !

সুমন্ত দা কে এতটা আহত করার ক্ষমতা তার যে আছে সে নিজেও জানত না!

:তাহলে কি আমি আর আসব না?

:না!

:তোমার বাবা শুনলে কি ভাববেন ?

:তা নিয়ে আপনার ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই! আমি আপনার কাছে পড়তে পারব না আর ।

সুমন্ত দা ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন।ত্রিশার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তার হাত ধরে বলে, প্লিজ আপনি যাবেন না ।ত্রিশার চোখের দিকে তাকালেও হয়ত তিনি কিছু একটা বুঝতে পারতেন।চোখের ভাষা ছাড়া একজন কিশোরী আর কি ই বা বলার ক্ষমতা রাখে?





মেট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট পাবলিশ হওয়ার দিন সবাই স্কুলে গেল রেজাল্ট আনতে কিন্তু ত্রিশা তার বাবাকে পাঠাল ! রেজাল্ট বোর্ডে টাঙান রেজাল্ট দেখে তার বাবার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হল,খুব ঠাণ্ডা পানি পান করতে ইচ্ছে করছিল তার! সব ছেলে মেয়েরা বৃষ্টিতে ভিজছিল, তারও খুব ইচ্ছা ছিল মেয়েকে কোলে করে এমন একদিনে বৃষ্টিতে ভিজবেন!

এরপর সুমন্ত স্যারকে আর কোনদিন স্কুলে আসতে দেখা যায় নি, অবশ্য মিসেস তানজিলা কবির তার শিক্ষকতা পেশার ভবিষ্যত নিয়ে আগেও সন্দিহান ছিলেন!







গাড়ির হর্ন, বাসার গেট খোলার শব্দ শোনা যাচ্ছে।

এখন তিনি সময় প্রসারন, থিওরী অফ রিলেটিভিটি খুব ভালই বোঝেন, ফিজিক্সে একটা পিএইচডি ও আছে তার।যদি সম্ভব হত সময়কে পিছিয়ে তিনি ফিরে যেতেন ১৯৯২ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারীতে। সেদিন কোন এক কিশোরী মেট্রিকের ফিজিক্স পরীক্ষার দিন সুমন্ত দার উপর অভিমান করে খাতার সাদা পাতাগুলো জমা দিয়েছিল ।শেষ পাতায় ছোট্ট করে লিখা ছিল “প্রতিশোধ”। তাকে বলতেনঃ এমন প্রতিশোধ নিয়ে কি লাভ যেখানে উভয় পক্ষ হেরে যায়?



জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালেন তিনি, সুহা আর তার বাবা ফিরে এসেছে, বাবা মেয়েকে কোলে নিয়ে গ্যারেজের সামনের ছোট্ট বাগানে ভিজছে!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.