নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাচৌ

এক কথায় ভাবুক! বহুকথায় আমি একজন স্বাধীন মানুষ, রোবট নই! তাই কারো কথায় সহজে প্রভাবিত হই না,সবার কথা শুনি, সবার লিখা পড়ি, হৃদয় দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি , কেন তিনি এমন করে ভাবছেন!বুদ্ধিমান মানুষের সঙ্গ খুব উপভোগ করি,তাদের সাথে মতের মিল হলে ভাল, না হলে আরও ভাল, গলায় জড়াজড়ি করে বলি, আসেন আপনার কাছ থেকেই নতুন কিছু শেখা যাবে!

সাচৌ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অভিশাপ !

২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ২:৫৪



বৃটিশ আমলে বানানো হোস্টেলগুলো একটু কেমন যেন । অনেকটা মাটির ঘরের মত, কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে, গরমকালে ঠাণ্ডা কিন্তু শীতকালে বাইরের চেয়েও ভিতরে দুই-এক ডিগ্রী বেশী ঠাণ্ডা । রুমমেটরা সবাই ঘুম, লাইট নেভানো, টিক টিক করে ক্লান্ত দেয়াল ঘড়িটা চলছে, কাছেই কোথাও টং করে রাত একটার ঘণ্টা বাজল । কম্বলের নিচে শুয়ে মুঠোফোনের আলোতে একটা চিঠি পড়ছে অনয় । সামনে টেস্ট পরীক্ষা , রুমুর ফোন বন্ধ । পড়ালেখা করছে মনে হয় । অনয় মুঠোফোনটা বালিশের পাশে রেখে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে যায় প্রায়ই। রুমু ক্লাসেও আসে না বহুদিন, শেষ কবে দেখা হয়েছে মনে নেই অথচ দুরত্ব বলতে রাস্তার এপার আর ওপার । ইচ্ছে করলেই বিকেলে হোস্টেল থেকে বেরিয়ে রুমু অনয়ের সাথে দেখা করতে পারে । ছাত্রী হোস্টেল থেকে বের হয়ে ডানে একটু হাঁটলেই খাড়া পাহাড়ের শেষ প্রান্তে ওয়াসার পানির ট্যাঙ্ক । এর নিচে বসে কত বিকালে আড্ডা দিয়েছে দুজনে । রুমুটা একটু পাগলাটে, পানির ট্যাঙ্কের খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ঠিক উপরে উঠে যেত মাঝে মাঝে । অনয় দুরুদুরু বুকে নিচে দাঁড়িয়ে আল্লাহকে বলতঃ ও আমার খোদা ! শুধু এইবার ওকে সহি সালামতে নিচে নামিয়ে দাও! আর কক্ষনও এই আধা ছেলে নিয়ে আমি এখানে আসব না । তবে এই প্রতিজ্ঞা ভুলে যেতে দুই মিনিটের বেশী সময় লাগত না ।

মাঝে মাঝে রুমু এটা সেটা রান্না করে আনত হোস্টেল থেকে, একবার কি যেন নিয়ে এল ! আরাম করে খেয়ে দেয়ে অনয় জানতে চাইলঃ এগুলো কি ছিল ? বেশ ইয়ে হয়েছে ।

-ভূতের মাংস !

-অ্যাঁ !

-হ্যাঁ !

-যাহ ! অনয় কাঁদো কাঁদো ।

-যাহ কি ? যাহ কি ! ভূত ধরে জবাই করে কেটেকুটে রান্না করেছি নিজ হাতে ।

-বল না আসলে কি ছিল ? ঊফফ ! অনয় ভীত ।

-ঊফফ ! ভেংচি কাটে রুমু ।

-আমার কিন্তু ইয়ে আসছে ।

-মশা ভাজি !

-আমি কিন্তু দিলাম ইয়ে করে !

-কিয়ে ?

-ইয়ে আরে ইয়ে!

রুমুর মুচকি হাসি এবার বাঁধ ভেঙ্গে গেল ।

-তোমার নাম মিস্টার ইয়ে রেখে দেব ঠিক করেছি ।

-কেন কেন ?

-এই যে সবসময় ইয়ে ইয়ে কর ।

-আমি ইয়ে ইয়ে করি ?

-তবে কি বিয়ে বিয়ে কর ? প্রথমবার কথাবলার সময় এতবার তো ইয়ে ইয়েই করছিলে যে আমি তো ভেবেছিলাম ইয়ে ইয়ে নতুন কোন ভাষা ।

-আমি কিন্তু রেগে একদম ইয়ে হয়ে যাচ্ছি ।

-হ্যাঁ ! তাই তো হবে । আমি তোমাকে ইয়ে করি, ইয়ে ! এর বেশী কিছুতো আজো বলতে পারলেনা ।

অনয় রেগে মেগে আরও কিছু ভূতের মাংস মুখের ভিতরে চালান দিল । এই মেয়ের পক্ষে ভূতের মাংস রেঁধে আনাটাও অস্বাভাবিক কিছু না ।

কখনো রাগারাগি হলে দুজনে বিকালে রিকশা নিয়ে শহর ঘুরতে বের হত । মন ভাল করার এটা বিশেষ কার্যকরী উপায় । অনয় ডানপাশে বসত আর রুমু বামপাশে । যেই রিকশায় উঠত সেই রিকশাওয়ালার মাথার স্ক্রু দুই তিনটা খুলে রাস্তায় গড়াগড়ি খেত ওদের কথা শুনে ।

অনয় তার ডানপাশে তাকিয়ে অজানা কোন মেয়ের সাথে এমন ভাবে কথা বলত কেউ দেখলে মনে করবে সত্যিকারেই ওই পাশে কেউ আছে । একইভাবে রুমুও তার বামদিকে তাকিয়ে সেই কথার পাল্টা জবাব দিত ।

-আমার কিন্তু বেশ আত্মমর্যাদা, আমি কাউকে তেলাই না, হুহ ! অনয় ডানে তাকিয়ে ।

-তা মিস্টার আত্নমর্যাদা ! মর্যাদায় পেট ফুলানোর আগে দেখুন মানিব্যাগ এনেছেন তো ? আমি ধাক্কিয়ে রিকশা থেকে ফেলে দিলে আবার পায়ে হেঁটে হোস্টেলে ফিরতে হবে পরে ! বামে তাকিয়ে রুমুর জবাব ।

-আজ ফেলো না হ্যাঁ ! কাল ঠিক মানিব্যাগ নিয়ে আসব । পকেট হাতড়িয়ে আঁতকে উঠে অনয় ।

-যদি আজ রাত ১২টায় আমার হোস্টেলের সামনে এসে একমিনিট কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাক তাহলে মাফ ।

-এহ মস্করা ! আমার মান ইজ্জত নেই আরকি ! আমি ইয়ে...

বলতে না বলতেই অনয় নিজেকে রাস্তায় আবিস্কার করল । আর রুমু মুখ চাপা দিয়ে সে কি হাসি । অনয় উঠে আবার রিক্সার পিছনে দৌড় ।

-ও ভাই ! দাঁড়ান দাঁড়ান আপনার কি ঘরে ইয়ে টিয়ে নেই নাকি ।

দৌড়ে এসে অনয় রিকশায় বসত ।

-হয়েছে রাগ কমেছে ? গাল ফুলিয়ে বামে তাকিয়ে ।

-রাগ আবার করলাম কখন ? অবাক বিস্ময়ে ডানে তাকিয়ে ।

-অ্যাঁ ? অনয়ের কিশোর মস্তিষ্ক এই মানবীর মনের রহস্য বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ।

একবার পাশ দিয়ে যাওয়া এক চশমা পড়া রিকশার আরোহী এমন আজব ঘটনা দেখে, ফিরে তাকাতে গিয়ে উল্টে পড়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষন ।



সকালে ঘুম ভাংলেই অনয় রোজ ডায়াল করে পরিচিত সেই নাম্বারে । কোন মিষ্টি কণ্ঠের মেয়ে এত নিষ্ঠুর ভাবেঃ আপনার ডায়ালকৃত মুঠোফোনটি এই মুহূর্তে বন্ধ আছে বলতে পারে ভাবতেই কষ্ট হয় । বন্ধুরা এসে হাত ধরে নাস্তা করতে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে বিছানাতেই শুয়ে থাকে।

সুজনটা আবার বেশ রাগ করেঃ তোকে তো শতবার বলেছি ওই মেয়ে আর একজনের ! ও তোর হওয়ার ছিল না । মা বাবার কথা মনে পড়ে না ? আঙ্কেল শুনলে কি ভাববে? সামনে পরীক্ষা, গাধা পড়ালেখা কর !

-আচ্ছা ও আমকে না দেখে, কথা না বলে থাকে কি করে ?

-ঊফফ! তুই মরে গেলেও ওর কিছু আসে যায় না । গত তিন মাস ধরে এই একই প্রশ্ন করছিস !

-ওমা !এতদিন পার হয়ে গেল !

সুজনের বকবক ওর মাথায় ঢুকছে না । কোন এক দুপুরে রুমুর হঠাৎ তলবে শার্টের বোতাম উল্টাপাল্টা লাগিয়ে হন্তদন্ত হয়ে হাজির হয় অনয় সেই পানির ট্যাঙ্কের নিচে । শেষ বলা কথাগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খায় শুধু ।

-আমার কণ্ঠ না শুনে থাকতে পারবে?

-বেশ পারব ! নির্লিপ্ত ।

-আমি ?

-অন্য কারো কণ্ঠ শুনবে !

-রাতে সময়ের কাঁটা কি একটুও থমকে যাবে না ?

-হাসালে ! মৃদু তাচ্ছিল্য ।

-এতটুকুও অস্থির লাগবে না ?

-সবাইকে তোমার মত ভাব কেন ?

-তোমার রাগ ভাঙ্গাতে শেষরাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে কেউ ? আমার মত !

-প্রেমে পড়লে সব ছেলেই অমন করে !

-আমি সব ছেলের মত ?

-প্রেম করা, আর লিখালিখি ছাড়া বিশেষ কি গুন আছে তোমার শুনি ?

-আমি ফোন না করে ঘুমিয়ে গেলে কেঁদে বুক ভাসাবে নাতো ?

-আমি এমন করতাম ! মনে পড়ছে নাতো !

- কীভাবে বলছ তুমি এসব ? রাতে ঘুমাতে পারবে তো ?

-সস্তা প্রশ্ন ।

-ঘুম ভাঙ্গাবে কে?

-শহুরে কোলাহল ।

-তারপর, এই শহরে রাস্তা ভুলে গেলে কে তোমাকে হাত ধরে রাস্তা চেনাবে ?

-রাস্তা এখন আমি একাই চিনে নিতে পারি, পথ হারাবার ভয় নেই ।

-হঠাৎ বৃষ্টি নামলে কে ছাতা নিয়ে ক্লাসের বাহিরে অপেক্ষা করবে ? ভেজা চোখ ।

-এই শহরে হঠাৎ বৃষ্টি হয় না এখন । বলতেই ঝুম বৃষ্টি !

-একা বাঁচতে পারবে ?

-একা থাকব কে বলল ? নীরব হাসি !

-তাহলে ?

-একা থাকা যায় না !

-আমার সাথেই থাক না তাহলে ?

-না !

-অত সহজে বলে দিলে ?

কেঁপে ওঠা কণ্ঠ ! নিশ্চুপ দীর্ঘশ্বাস !

-কীভাবে পারলে ?

-পারতে হয় !

-আমি কেন পারিনা ?

-পারবে !

-কখন ?

-বাস্তবতা যখন বুঝবে !

-আমি বুঝতে চাইনা !

-এভাবে জীবন চলেনা !

-অত জটিল করে না ভাবলে হয় না ? প্রশান্ত নীরবতা ।

-আমি কীভাবে বাঁচব ? কি নিয়ে বাঁচব ?

-একদিন শিখে যাবে ।

-তুমি পারবে ?

-এভাবে সংসার হয় না !

-কীভাবে হয় ?

-তুমি বুঝবে না ।

-বুঝতে চাইনা , আমি অবুঝ ! শুধু আমার হয়েই থাক না । কণ্ঠে অনুনয় !

-এভাবে থাকা যায় না । চোখ আড়াল খুঁজছে ।

-পারবে অন্য কারো হাত ধরতে, বুকের ঘ্রাণ নিতে ? আবারো ভালবাসি বলতে অপরিচিত কাউকে ?

-শোন আমি যাই ! আর বিরক্ত কোরনা সন্ধ্যায় ভাইয়া আসবে আমাকে নিয়ে যেতে ।

-তোমার হবু জামাই কি করে ?

-জানিনা আমি !

-ও ! ওকে আমার মত ভালবাসতে পারবে ?

-হয়ত !

-আমাকে ভুলে থাকবে কীভাবে?

-তুমিও ভুলে যাবে ! অনেক সুখী হবে একদিন ।

-হা হা হা ! তাই ? হাসির খুব বাজে একটা অভিনয় হয়ে গেল, চোখ ভিজে গেলে কি হাসা যায় ?

-শোন ?

-বল !

-আমাকে অভিশাপ দিও না !

-ভালবাসার অভিশাপ দেয়া লাগে না ! রুহের অভিযোগ বিধাতা সহ্য করেন না !







উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে, টুং করে সতর্ক ঘণ্টা বাজল, দপ্তরী খাতা দিয়েছে মাত্র । ও-এম-আর পূরণ করছে সবাই । অনয় হঠাৎ উঠে দাঁড়াল । এক ছুটে বাইরে এসে এই হল থেকে ওই হলে ছুটোছুটি করছে । কয়েকজন শিক্ষক মিলে ওকে ধরে প্রিন্সিপাল স্যারের অফিসে নিয়ে গেল । সবার প্রশ্ন গুলো চুপচাপ শুনে কোন কথা না বলে অনয় সোজা কলেজের বাহিরে চলে আসল । শিক্ষকরা যে সার্টিফিকেট দিলেন তার সারমর্ম হল, এই ছেলে কোন পড়াশুনা করেনি, তাই মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে উল্টাপাল্টা কাজ করছে ।

এরপর প্রতিদিন অনয়কে পরীক্ষার হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত ,ভিড়ের মাঝে উদ্ভ্রান্তের মত কাকে যেন সে খুঁজত !

রেজাল্ট পাবলিশের ঠিক আগের দিন অনয় আত্নহত্যার ব্যর্থ চেস্টা করে ।







আজ রবিবার । মাহফুজ অনয়ের মাসিক ছুটির দিন । প্রতিমাসের এই দিনটার জন্য সে অপেক্ষা করে । জীবনটাকে চালিয়ে নেওয়ার জন্য ছোটখাট একটা বাড়িতে দারোয়ানের চাকরী খুব খারাপ কিছু না ।

পুরো শহরের রাস্তায় রাস্তায় অনয় লুঙ্গি পড়ে, প্লাস্টিকের জুতো পায়ে হাটছে , ঘামে চোখ জ্বালা করছে । হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরছে খুব পরিচিত কাউকে ।

বেশী ক্লান্ত হয়ে গেলে, বিলবোর্ডের ছায়ায় বসে নিজের লিখা শেষ গানটা গলা ছেড়ে গায় অনয় । লোকজন ভিড় করে দাঁড়ায় , কেউ কেউ আবার ফিরেও চায় না , ব্যস্ত শহুরে জীবন । বিলেত ফেরত সাহেবরা আবার দুই এক পয়সা ছুঁড়ে মারে । পয়সা ঝন্ন করে রাস্তায় গড়াগড়ি খেয়ে কিছুদূর গিয়ে একলা কাত হয়ে পড়ে থাকে অভিমানে ।



“কি দিয়া বানাইলা মায়া ?

বুঝে আসে না !

মায়ার জন্ম কোন জগতে ?

প্রশ্ন করতে মানা !

তার ছবি কোন খাঁচায় রাখছ চাবিতালা দিয়া ?

আন্ধারেও তার ছায়া পিছু ছাড়ে না ।

ঘৃণার মাঝেও রোজ সে আসে ভেজা নয়নে,

তারে আমি মায়া করি অসহায় নিরুপায়ে,

বেঈমান স্মৃতি ধোঁকার ফান্দে আমারে ফেলিয়া,

খুন করেছে নিঠুর ছলনার অমৃত নীল বিষে !



মায়া দিছো , কাইড়া নিছো !ও আমার খোদা !

হ্যাচকা টানে ছিঁড়া ফেলছ জানের কলিজা !

দুঃখ দিছো , জ্বালা দিছো অবুঝ পরানে,

সেই দুঃখ সইব আমি একলা কেমনে ?

ভালবাসার অভিশাপে জ্বলন্ত অঙ্গার,

ক্ষমতা নাই সহ্য করার, বান্দা তোমার !

মৃত লাশের জানাজায় চউক্ষের মায়াকান্না,

জিন্দালাশের চোখের ভাষা সংসার বুঝবেনা !”



স্থির সময় বয়ে চলে, অনয় যার খোঁজে শহরের অলিগলি চষে বেড়ায় সে কি এই অভিশপ্ত অনয়কে দেখলে চিনবে ? নাকি দেখেও না দেখার ভান করবে ? সে কি এই শহরেই থাকে ?

অভিশাপ কখনো বৃথা যায় না । কখনো কখনো অভিসম্পাতকারিই অভিশপ্ত হয়ে যায় !

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.