নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইল্লু

ইল্লু › বিস্তারিত পোস্টঃ

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

২৮ শে জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ৩:৫১

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা


(৩৮)

যদিও আল্লাহর কৃপায় আমিও একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী,একজন নামকরা ওস্তাদ,অন্ধ হয়ে যাব হয়তো সময়ে,তবে সেটাই কি আমার চাওয়া?আমি সেই মহাশক্তিমানের উপস্থিতি অনুভব করলাম খাজাঞ্চীখানার ঐ অন্ধকার ঘরে,ফাঁসির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মৃত্যুপথযাত্রীর মত অনুরোধ জানালাম, ‘আল্লাহ,আমাকে সুযোগ দাও ছবিগুলো মনের শান্তিতে দেখার’।

মহান আল্লাহর দেয়া জ্ঞানের ছোঁয়ায় পাতাগুলো উল্টাচ্ছিলাম,ঘনঘন মনের পাতায় ভাসছিল শিল্পীর অন্ধত্ব আর তুলির যোগাযোগের কথা।ভাবছিলাম বাগানের গাছে হুসরেভের ছবি দেখে শিরিনের ভালবাসার কথা,নামকরা ছবিটা,শেখ আলী রেজার তুলিতে আঁকা,একটা একটা করে তুলে ধরা গাছের পাতায় ঢেকে আছে সারা আকাশ।এক সমজদার সমালোচকের কথায় গাছটা ছবির একটা আনুষাঙ্গিক অঙ্গ,ওস্তাদ শেখ আলী তাব্রিজের কথায় ছবির প্রধান চরিত্র শিরিনও না,শিল্পীর আবেগে,আর এটা প্রমান করার জন্যে একটা চালের কনায় সর্ম্পুন গাছটা পাতাসহ আঁকলো ওস্তাদ।যদি শিরিনের সঙ্গিনীদের পায়ের নীচে লুকানো সইটা দেখে হতাশ না হতাম,দেখতাম ওস্তাদের বই এর পাতায় আঁকা অর্ধেক ছবি আরম্ভ করার সাত বছরের মধ্যেই অন্ধত্ব তার চোখের আলো কেঁড়ে নেয়।আরেকটা ছবিতে রুস্তম তীর দিয়ে অন্ধ করছে আলেকজান্ডারকে,ভারতীয় শিল্পীদের কায়দায় আঁকা ছবিটা,রং এর প্রাচুর্যতায় এতই মন জুড়ানো,যে অন্ধ,দুঃখে ভঁরা মানুষ ছাড়া অন্যান্যদের কাছে মনে হবে আনন্দে ভঁরা অনুষ্ঠানের প্রারম্ভ মাত্র।

ছবির সেই খ্যাতনামা শিল্পীরা যাদের কথা আর ছবির চমক সারা জীবন ধরে অবাক হয়ে শুনে গেছি,ভাবিনি কোনদিন ঐ ছবিগুলো দেখার সূযোগ হবে,সেই ছবিগুলো এখন বসে বসে দেখছি,সত্যিই ভাগ্যবান আমি।খাজাঞ্চীখানার আলো আধারী খেলায় ছবিগুলো দেখতে দেখতে অজান্তেই কাঁদছিলাম মাঝে মাঝে,কান্না শুনে বামনটা ছুটে এসে আমার পাশে বসে অবাক হয়ে দেখা আরম্ভ করলো ছবিগুলো,বললাম,‘লাল রংটা তাব্রিজের মির্জা বাবা ইমামীর তুলির,ঐ কায়দাটা তার সাথে কবরে চলে গেছে।ওস্তাদ লাল রংটার ব্যাবহার ছিল কার্পেটের কিনারে,
পারস্যের শাহের পাগড়ীর একটা অংশে,আর এই দেখ সিংহের পেটের এই জায়গাটায়,আর ঐ কমবয়সী ছেলেটার জামার হাতে।মহান আল্লাহর এই বিশেষ লাল রং যা দেখা যায় শুধু মানুষের শরীরের রক্তে,তা ছাড়া আছে এই লাল রং দেখা যায় মহান শিল্পীদের ছবির মানুষের কাপড়চোপড়ে।এখন হয়তো পাথরের নীচে লুকানো কটা পোকামাকড় জানে ঐ লাল রং এর রহস্য আর এখন সেটা দেখার সূযোগ হলো আমার’।

‘এদিকে দেখ’,কিছুক্ষন পর আমি বললাম, ‘এই ছবিগুলো হয়তো কোন গজলের অংশ ছিল,যেখানে ছিল ভালবাসা,বসন্ত আর বন্ধুত্বের কথা।বসন্তের গাছে ছড়ানো নানান রং এর প্রাচুর্যতা,বাগানের বিশাল গাছ ছড়ানো বেহেশতী রুপ,আর প্রেমিক গাছে হেলান দিয়ে মদের চুমুকে কবিতা আবৃত্তি করছে।স্যাতস্যাতে গন্ধ,ধুলায় ভঁরা খাজাঞ্চীখানায় বসন্তের রং এ আনন্দে মত্ত যুবক যুবতীদের পাশেই আমরা বসে ছিলাম।একই শিল্পী যার তুলির ছোঁয়ায় আঁকা প্রেমিকদের কবিতা ছোঁয়া হাত,ঝকঝকে খালি পা,ছন্দময় দাঁড়ানোর ভঙ্গী,আলসে উড়ে যাওয়া পাখী,তার হাতেই আঁকা বিদঘুটে চেহারার গাছটাও’।

‘এটা বোখারার লুখির তুলির কাজ,যার রাগ,অসহিষ্ণুতার কারণে তার কোন ছবিই ঠিকমত শেষ হয়নি।সব খান,শাহদের বিরুদ্ধে তার অভিযোগ ছিল শিল্পকলা সমন্ধে তাদের কোন ধারণাই নেই,তাই কোন শহরেই খুব বেশিদিন থাকতে পারেনি,ওস্তাদ লুখি।এই নাম করা ওস্তাদ শহর থেকে শহরে শুধু ঝগড়াঝাটি করে কাজ শেষ না করে ছেড়ে গেছে,শহরটা।
কোনদিন খুঁজে পায়নি এমন কোন খান বা শাহকে যাকে তার হিসেবে মনে হতো প্রতিভার সমঝদার।শেষে পাহাড়ী এলাকার ছোট্ট এক খানের এলাকায় তার জীবনের শেষ পচিশটা বছর কাটায় ওস্তাদ লুখি,তবে ওস্তাদের মতে সেই খান নিঃসন্দেহে ছিল সমঝদার।অনেকের মতে সেই খান ছিল অন্ধ,অবশ্য সেটা আজও বির্তকের বিষয়’।

রাতের অন্ধকারে ধীরে ধীরে ঢেকে গেছে সারা পৃথিবী,আমি বললাম,‘এই পাতাটা দেখছো’,এবার সিয়াহ,খাজাঞ্চী বাম্ন দুজনেই মোমবাতি নিয়ে ছুটে আসলো,‘তৈমুর লং এর নাতিদের কাছ থেকে আজ পর্যন্ত এই বইটা প্রায় দশ হাতে ঘোরাঘুরি করে এখন এই খাজাঞ্চীখানায়,সব মিলিয়ে হেরাত থেকে এখানে আসার সময় প্রায় ১৫০ বছর’।
আতশ কাঁচ দিয়ে আমি পরখ করলাম সই,ঐতিহাসিক তথ্য, ,উৎর্সগ করা নাম,শেষের পাতায় ঠাসাঠাসি করে একের উপরে এক অন্য ভাবে লেখা।
‘আল্লাহর কৃপায় কালিগ্রাফার হেরাতের মুজ্জাফর জুকির ছেলে, সুলতান ভেলির হাতে,৮৪৯ হিজরী সালে বায়াসুনগরের শাসন কর্তা বিজয়ী সুলতানের ভাই মোহাম্মদ জুকির বৌ এর অনুপ্রেরনায় বইটা শেষ হয় হেরাতে।পরে খ্যাতনামা সুলতান হালিলের কাছ থেকে বইটা গেল তার ছেলে ইয়াকুব বের হাতে,সেখান উজবেক সুলতানের হাতে,এর মধ্যে সবাই বইটায় নিজেদের মত করে দু একটা ছবি যোগ দিল,তাদের সুন্দরী বৌদের ছবি,এমন কি শেষ পাতায় নাম দেয়া কোনটাই বাদ পড়েনি।শেষে বইটা গেল শাম মির্জার হাতে,হেরাতের পতনের পরে সে বইটা উপহার দিল তার বড় ভাই শাহ ইসমাইলকে।শাহ ইসমাইল বইটা নিয়ে গেল তাব্রিজে,আর বইটা সর্ম্পূন বদলে দেয় কাউকে উপহার দেয়ার জন্যে।দুর্ধষ সুলতান সেলিমের কাছে শাহ ইসমাইল যুদ্ধে পরাজয়ের পর বইটার জায়গা হলো,পাহাড় পর্বত,মরুভুমি পার হয়ে সুলতানের জয়ী সৈন্যদের সাথে ইস্তাম্বুলের খাজাঞ্চীখানায়।

ঠিক বুঝতে পারিনি,এই বুড়ো ওস্তাদের সাথে সিয়াহ,আর ঐ বামনের কতটুকু আগ্রহ ছিল সবকিছু জানার?নতুন বইগুলোতে ছিল,নিষ্ঠুর,দয়ালু শাহ,খানদের পৃষ্ঠপোষকতায় আঁকা ছোট বড় নানান শহরের শিল্পীদের দুঃখ কান্নায় ছোঁয়া ছবিগুলো,প্রত্যেকটা ছবিতে ছিল শিল্পীদের বিশেষত্ব,সময়ে হয়তো যারা সবাই অন্ধ হয়ে গেছে।শেখার সময় ওস্তাদদের হাতে শিষ্যদের যন্ত্রনার ছবি,ছড়ির মারে লাল হয়ে যাওয়া গাল,বইগুলো উল্টাতে উল্টাতে যখন দেখলাম পুরোনো দিনের অত্যাচারের নানান ছবি,কেন যে মানুষের অত্যাচারের চেহারার বইটা ওটোমান সাম্রাজ্যের খাজাঞ্চীখানায় রাখা আছে ঠিক বুঝতে পারলাম না।

অপরাধীদের উপরে কখনও কখনও অত্যাচার করা হতো হাকিমের সামনে সত্যি জানার জন্যে,তবে বিদেশী লোকজন আমাদের জাতির উপর অযথাই আরোপ করে গেছে,যেন অত্যাচার করে ইচ্ছামত রায় দেয়াটাই ছিল আমাদের বিচার পদ্ধতি,আর কয়েকজন শিল্পী কটা সোনার মোহরের লোভে এঁকে গেছে ছবিগুলো।ছবিগুলো দেখে আমার নিজেরই লজ্জা হচ্ছিল,ক্রুশবিদ্ধ মানুষ,ফাসিতে ঝোলানো মানুষ,কামানে বেঁধে মারার দৃশ্য,যন্ত্রনার চরম দৃশ্যগুলো।যারা শিল্পের মর্যাদা বোঝে,তারা ওস্তাদের হাতের মার খাওয়া মন নিয়ে কোনদিন এ ধরণের ছবি আঁকবে না,ওটা তো বাচ্চাদের ঘুড়ি ওড়ানোর গল্প না।

কয়েক শ বছর ধরে মানুষ এই ছবিগুলোম,রং দেখে ইতিহাস খুঁজছে,আমার মত হয়তো কোন শিল্পীর সূযোগ হয়নি এভাবে ছবিগুলো দেখার,আমি যে ভাবে খাজাঞ্চীখানায় বসে আমি দেখছি।
ঠান্ডায় জমে যাওয়া বুড়ো আঙ্গুলে বই এর পাতা উল্টাতে উল্টাতে দেখছিলাম ছবিগুলো,আমার আরেক হাতে ছিল মুক্তায় সাজানো আতস কাচ,আমি যেন একটা যে বাজপাখী আকাশ থেকে দেখছে তার শিকারকে শেষ আঘাত করার আগে।কিংবদন্তীর এই বইগুলো যা আমাদের দেখার সূযোগ হয়নি কখনও,দেখে হয়তো জানার সূযোগ হবে অনেককিছুই।কোন ওস্তাদের নির্দেশে কোন শিল্পীর নকল করা কোন ছবিটা,কোন শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় আঁকা,আরও এটা ওটা।চীনা পদ্ধতিতে আঁকা মেঘ,পারস্য হয়ে পৌঁছায় হেরাতে,চীনা শিল্পীদের প্রভাব ছিল কাজভিনেও।মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে, ‘আহ,আহ’,করছিলাম,কিন্ত একটা দুঃখ আমার মনের মাঝে সোচ্চার হয়ে ছিল,যেটা হয়তো অন্য কাউকে বোঝানো সম্ভব না,ঐ সব শিল্পীদের কথা যারা ঢুলু ঢুলু চোখে,হাজারো দুঃখ হতাশায়,এমন কি ওস্তাদদের অত্যাচারেও এঁকে গেছে ছবিগুলো,তবুও হারায়নি উৎসাহ,সময়ে ওস্তাদ আর শিষ্যদের মধ্যে অদ্ভুত একটা যোগাযোগও হয় ছবি আর তুলির আনন্দে,এক সময় সবকিছুই হারাবে অজানার খাতায়।

জানি ঐ হতাশার দেশটা আমার দেশ,একসময় আমিও ছিলাম ঐ হতাশার রাজ্যে,আবেগ আর অনুভুতির জোয়ারে,আমাদের সুলতানের যুদ্ধ আর জয়ের ছবি আঁকতে আঁকতে এখন অনেকটা ভুলে গেছি ঐ হতাশ দিনের কথাগুলো।একটা ছবিতে বেশ সুন্দর চেহারার কমবয়সী একটা ছেলে কোলে বই নিয়ে দেখছিল,ঠিক আমি যে ভাবে বইটা ধরে আছি,শাহরা তাদের ক্ষমতা আর ঐর্শ্বযে ভুলে এই চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য যা আল্লাহর দেয়া।
ইস্পাহানের আরেক ওস্তাদের ছবিতে ছিল যুবক যুবতীর প্রেমের ছবি,তাদের চোখ মুখের অনুভুতি দেখে আমার চোখ তখন কান্নায় ভঁরে গেছে,ভালবাসার মুখ দুটোয় ছিল কমবয়সী শিল্পীদের অনুভুতি প্রকাশ করার আগ্রহ।ছোট ছোট পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল বেশ সুন্দ্র চেহারার একজন কিশোর,অবাক হয়ে দেখছিল হরিনী চোখের বাদামী চামড়ার ফুলের মত এক কিশোরীকে,যদিও তার মনের ভালবাসার ঝড় তাকে তছনছ করে দিচ্ছিল একটু একটু করে।

মনে পড়লো ষাট বছর আগে শিষ্য হিসাবে ছবি আঁকার কাজ আরম্ভ করি,কেন জানি সামনের শরীর খেলায় মত্ত কিশোর কিশোরীর তাব্রিজের কালিকলমে আঁকা কিছু অশোভনীয় ছবি,আমার দেখে হ্রদয়ও তখন ছোটাছুটি করছিল ঘোড়ার মত,কপালে কণায় কণায় জমে গেছে ঘামের মালা।মনে পড়লো,ছবি আঁকা শেখার পরে হলো বিয়ে,ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতার সিড়ি আমাকে নিয়ে গেল ওস্তাদদের স্তরে।কিছুক্ষনের জন্যে মনে হলো ছবি আঁকা কোন হতাশা আর অনুশোচনার গল্প না,বরং শিল্পীর প্রতিভা,মনের আবেগকে ক্যানভাস আর তুলি দিয়ে তুলে ধরার একটা অধ্যায়।শিল্পীর ঈশ্বর প্রেম,আল্লাহর দেয়া,আর দেয়া ঐ অনুভুতিতে শিল্পী দেখতে পায় অনন্য এক রুপে।ঐ অনুভুতিতে ক্যানভাসে ছবি এঁকে গেলাম বছরের পর বছর,কোমরের ব্যাথায় অক্ষম না হওয়া পর্যন্ত।

শিল্পের ভালবাসা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধত্বে আর ছবি আঁকার অন্যান্য যন্ত্রনায় আমি আজও ভুদি আমার আগের আরও হাজারো শিল্পীর।ছবিগুলো দেখছিলাম শিল্পীর তুলির চোখ দিয়ে,আনন্দে,অজান্তেই ক ফোঁটা কান্না নেমে যাচ্ছিল গাল দিয়ে।একটা বাতি আমার দিকে এগিয়ে আসছিল,বইটা বন্ধ করে বামনের দেয়া বইটার পাতা উল্টানো আরম্ভ করলাম।এটা শাহদের জন্যে বিশেষ ভাবে তৈরী করা একটা ছবির সংগ্রহ,দুটো হরিন একটা ঝোপের পাশে একে অন্যেকে কামনায় মাতাল হয়ে দেখছে,এক পাশে একটা শেয়াল দাঁড়িয়ে আছে শিকারের আশায়।পাতা উল্টানোর পরে দেখলাম চোখ জুড়ানো বাদামী রং এর ঘোড়া যা নিঃসন্দেহে হেরাতের ওস্তাদের হাতের কাজ।পরের পাতার ৭০ বছরের পুরোনো ছবিটা থেকে একজন সরকারী কর্মচারী আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছিল,বোঝার উপায় নাই কে লোকটা,তবে ওখানে যে কাউকে বসালেও বেমানান হবে না,তবুও ছবির মানুষটার দাঁড়ি,অন্যান্য বিশেষত্ব মন দোলানো।আমার অজান্তেই অস্থির হয়ে গেলাম,মহামান্য ওস্তাদ বিহজাদের আঁকা ছবি দেখে,যেন আলো ছুটে বেরোচ্ছিল আমার চোখে মুখে।

এটাই ওস্তাদ বিহজাদের আঁকা ছবি আমার প্রথম বারের মত দেখা না,তবে এ ভাবে একা দেখার সূযোগ হয়নি কোন সময়।বেশীর ভাগ সময়ই আমরা ওস্তাদেরা একসাথে বসে ছবিগুলো দেখতাম আর তর্ক বি্তর্ক করতাম,সন্দেহ ছিল আমাদের,আসলেই ওগুলো ওস্তাদ বিহজাদের তুলির ছোঁয়ায় আঁকা কি না??খাজাঞ্চীখানার স্যাতস্যাতে ঘরটা আলোয় ভঁরপুর হয়ে গেছে তখন,ঐ সুন্দর তুলির ছোঁয়ায় ভালবাসার আবেগ দেখার সূযোগ হলো আমার।
মহান আল্লাহর কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ অন্ধ হওয়ার আগে আমাকে ঐ ছবিটা দেখার সূযোগ করে দেয়ার জন্যে।কি সব আজেবাজে ভাবছি,আমি কি ভাবে জানি যে আমি অন্ধ হয়ে যাব?আমি তো জানি না,অযথাই অস্থির হচ্ছি কেন!আমার মনের কথা সিয়াহর সাথে আলোচনা করতে পারি,ও একটা মোমবাতি হাতে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।
‘ঐ তুলির ছোয়া,ঐ মহান শিল্পীর কথা হয়তো তুমি জানই,,ওস্তাদ বিহজাদ’,সিয়াহকে বললাম।
সিয়াহর হাতটা তখন আমার হাতে,আমার পুরোনো শিষ্য সিয়াহর ধবধবে শক্ত হাতটা,
উষ্ণতায় ভঁরা,নিটোল এক শিল্পীর হাত,আনন্দে মনটা উচ্ছল হয়ে গেল।সেই পুরোনো দিনগুলো,যখন শিষ্যদের হাত হাতে নিয়ে বলতাম ছবি আঁকার নিয়মগুলো,ওদের মিষ্টি চোখের ভঁয়ের ছায়া,ঠিক সে ভাবেই দেখছিলাম সিয়াহর চোখের মনিতে মোমবাতির ছায়া।
‘শিল্পীরা আমরা একে অন্যের সাথে আত্মিক ভাবে জড়িত,তবে এখন সব কিছুই যেন শেষ হয়ে আসছে’।
‘কেন,কি বলতে চাচ্ছেন’?
‘সবকিছুই শেষ হয়ে যাচ্ছে,অনেকটা শিল্পীদের অন্ধত্বের মত যা শেষ জীবনে তাদের সবকিছু কেঁড়ে নেয়,সারাটা জীবন যার কেটে গেছে কোন শাহ বা শাসনকর্তার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাসাদে একের পর এক মন জুড়ানো ছবি ছবি এঁকে,নিজের তুলির ছোঁয়ার নতুন একটা জগত তৈরী করে গেছে,তার আর কি থাকে তখন করার,অর্থব একটা মানুষ যার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে’।
জানতাম যুদ্ধে হেরে গেলে হেরে যাওয়া শাহের সাথে হারায় ওস্তাদদের ছবি আঁকার ধরন,
সূযোগ,নতুন শাহের সায়হে বদলে যেত সবকিছু।নিজেদের সন্তানের চেয়েও শিল্পীরা ভালবাসতো তাদের তুলিতে ধরা ছবিগুলোর জন্যে,কিন্ত এই কথাগুলো সিয়াহকে বোঝাবো কি ভাবে?

‘এটা নামকরা কবি আবদুল্লাহ হাতিফি’,আমি বললাম,‘এতই খ্যাতনামা আর গর্বিত ছিল হাতিফি যে শাহ ইসমাইলের হেরাত দখলের পরে শিল্পী,কবিরা সবাই যখন ছুটে গেল তার সাথে দেখা করতে,তবে হাতিফি কারও সাথে দেখা করেনি,বাসায় আত্মমগ্ন হয়ে ছিল তার চিন্তাধারায়।শেষে শাহ ইসমাইল নিজেই গেল শহরের বাইরের তার বাসায় দেখা করতে,আমরা জানি এটা বিহজাদের তুলির হাতিফি না,তবে সেটা বোঝা যাচ্ছে ছবি দেখে না,বরং ছবির নীচের লেখায়’।

সিয়াহ বড় বড় সুন্দর চোখ দুটো দিয়ে বললো, ‘হ্যা’।আমি বললাম,‘কবির ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে,অন্য কোন কারও ছবি।আল্লাহ কবি হাতিফিকে বেহেশতবাসী করবেন,তবে এই ছবিটা দেখে তাকে চেনার কোন উপায় নাই,তবে তাকে চেনা যায় ছবির নীচের লেখাগুলো দিয়ে।
ওস্তাদের ছবি আঁকার কায়দা,রং এর চমক বলে দেয় ওটা একজন কবির ছবি,ছবিকে সব সময় কথা দিয়ে বোঝানোর দরকার হয় না,তবুও অনেক সময় শিল্পীরা শাহদের কথামত করতে বাধ্য হতো।সুলতান যে তোমার এনিষ্টেকে বইটা তৈরী করার দায়িত্ব দিলেন ভেনিসের শিল্পীদের অনুকরণে,তাতে ছবি আঁকার একটা নিয়ম শেষ হলো আর আরম্ভ নতুন আরেক ছবি আঁকার পদ্ধতি।যদিও ভেনিসের ছবি আঁকার পদ্ধতি…’।
‘আমার এনিষ্টে,আল্লাহ তাকে বেহেশতবাসী করবেন।কেন যে কেউ তাকে খুন করলো,এটা এখনও অবিশ্বাস্য মনে হয়ে আমার কাছে।’,বললো সিয়াহ।
সিয়াহ এর হাতটা নিয়ে আদর করছিলাম,ছোট ছোট হাত দুটো হয়তো কোন একদিন তুলির ছোঁয়ায় তুলে ধরবে অভাবনীয় ছবি,দুজনে হাত ধরে দেখছিলাম বিহজাদের অভাবনীয় তুলির ছোয়া,কোন এক সময় সিয়াহ হাতটা টেনে নিল।

‘এর আগের পাতার বাদামী ঘোড়ার নাকটা পরখ না করেই,আমরা পাতাটা উলটে ফেললাম কেন’?সিয়াহ জিজ্ঞাসা করলো।
‘ঐ ছবিতে দেখার মত কিছু নাই’,বলে আমি আগের পাতায় ফিরে গেলাম,যাতে সিয়াহ নিজেই দেখতে পারে,কোন বিশেষত্ব ছিল না ঐ ছবির ঘোড়াটার।
বাচ্চা ছেলের মত সিয়াহ জিজ্ঞাসা করলো, ‘কখন যে খুঁজে পাব আমরা ঐ নাকের ঘোড়া’?
তখন প্রায় মাঝরাত্রি,খুঁজে পেলাম,অনেক সিল্কের কাপড় চোপড়ের নিচে শাহ তামাসপের ‘শাহনামা’,বইটা।সিয়াহ তখন মুক্তোয় কাজ করা একটা বালিশে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে,আর ঐতিহাসিক শাহ তামাসপের বইটা জানান দিল,আমার কাজ আরম্ভ হলো মাত্র।

বছর পচিশ আগে যখন আমি আর জেজমী আগা প্রথম বইটা যখন দেখি,এত ভারী বইটা যে তুলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল,বই এর বাঁধন নেড়ে বুঝলাম ওটাতে কাঠ দেয়া আছে।পচিশ বছর আগে খ্যাতনামা বীর শাহ সুলায়মান বেহেশতবাসী হলো যখন,আনন্দে শাহ তামাসপ শাহ সুলায়মানের উত্তরাধীকারী সুলতান সেলিমকে উটে ভর্তি অনেক উপহার পাঠায়,তার মধ্যে ছিল অদ্ভুত সুন্দর একটা কোরআন শরীফ আর এই বইটা।শাহ সুলায়মানের হাতে তিনবার অপদস্ত হয়ে পরাজিত হয় শাহ তামাসপ,সুলতান শাহ সুলায়মানের মৃত্যু তার কাছে ছিল আনন্দের খবর,সেই শক্তিশালী মানুষটা আর পৃথিবীতে নাই,আর তাকে ও ভাবে অপদস্থ হতে হবে না,এটা তার কাছে ছিল বেশ আনন্দের খবর।পারস্যের দূত তার তিনশ জন সাঙ্গপাঙ্গের সাথে বিরাট বইটা অন্যান্য উপহারের সাথে এডির্নেতে নিয়ে যায়,নতুন সুলতানের শিকারের সময়ের নিবাস।

ঘোড়া আর খচ্চরের পিঠে পরে উপহারগুলো আসে ইস্তাম্বুলে,ওস্তাদ শিল্পী সিয়াহ মেমির সাথে আমরা তিনজন কমবয়সী শিল্পী খাজাঞ্চীখানার তালায় ঢোকার আগে বইটা দেখার সূযোগ পাই,অনেকটা ইস্তাম্বুলের লোকজনের হিন্দুস্তানের হাতী বা আফ্রিকার জিরাফ দেখার উৎসাহ ছিল আমাদের মনে তখন।কথায় কথায় ওস্তাদ সিয়াহ মেমি বললো,ওস্তাদ বিহজাদের আঁকা কোন ছবি নাই বইটাতে,কেননা ওস্তাদ বিহজাদ অন্ধ হয়ে হিরাত ছেড়ে গেছে তখন।

ওটোমান সাম্রাজে আমাদের মত শিল্পীরা যারা সাধারণ কোন একটা বই এর সাত কি আটটা ছবি দেখলে অবাক হয়ে যেত,তাদের কাছে এই বই এর ২৫০টা ছবি দেখে মনে হচ্ছিল, বিশাল প্রাসাদের ঘরে ঘরে ঘোরা যেখানে সবাই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে আছে।অবাক হয়ে দেখছিলাম ছবির রং এর জৌলুষ যেন হঠাৎ করে কটা মূহুর্তের জন্যে আমার হাতের বেহেশতের বাগানের ছবি,তার পরের পচিশটা বছর আমরা শুধু আলাপ আলোচনা করে গেছি বইটাকে নিয়ে,দেখার সূযোগ হয়নি আর।

আস্তে আস্তে যখন ‘শাহনামা’,র মলাট খুললাম,খুলে গেল যেন বিরাট এক প্রাসাদের দরজা,প্রতিটা পাতা আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল নতুন এক আঙ্গিনায়,অবাক না হতবাক আমি।

১) এটা তো সবাই জানে ইস্তাম্বুলের সব নামকরা ওস্তাদেরা কমবেশী এই বইটার ছবি নকল করে গেছে।
২)ওস্তাদ বিহজাদের ছবি হয়তো কোন এক ফাঁকে আমার সামনে আসতে পারে ভেবে,পাঁচ ছয় পাতার পর আর ছবিগুলোতে খুব একটা মনোযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না।
(কত সহজে,দক্ষতায় তাহমারুসের তলোয়ার শেষ করে যাচ্ছিল দৈত্য,রাক্ষসদের,যারা পরে তার আনুগত্য মেনে নিয়ে তাকে গ্রীক আর অন্যান্য ভাষাগুলো শেখায়)।
৩)ঘোড়ার নাক,খাজাঞ্চীখানার বামন আর সিয়াহর উপস্থিতিও আমাকে বেশ বিচলিত করছিল।

কিছুটা হতাশ আর ক্লান্ত তখন,ছবিগুলো দেখছিলাম তবে ভালভাবে পরখ করার নেশাটা থাকলেও,ছিল না হ্রদয়ের আবেগ,যদিও আল্লাহর কৃপায় এই অভাবনীয় বইটা ভেলভেটের পর্দার অন্ধকারে রাখা ছিল আমার সামনে।সকালের আলোটা যখন খাজাঞ্চীখানায় পৌছালো,
মনে হলো বরফে ঢাকা কবরের উপরে আলোর ছটা,ঐ নামকরা বইটার ২৫৯টা ছবি দেখা হয়ে গেছে আমার।যেহেতু ছবিগুলো দেখলাম শুধু বিশ্লেষন করার জন্যে,এক আরব বিশেষজ্ঞের মত,তাই বর্ননা করাটাই ভাল।

১)কোথাও একটা ঘোড়া খুঁজে পেলাম না,যা দেখতে খুনীর তুলিতে আঁকা ঘোড়ার ছবির মত।না তুরানের ঘোড়ার চোরদের পেছনে ছুটে যাওয়ার সময় রুস্তমের দেখা নানান রং এর ঘোড়াদের মধ্যে,এমন কি ফেরদৌস শাহের অসাধারণ ঘোড়াগুলো যারা টাইগ্রিস নদী সাঁতার কেটে পার হচ্ছে,ধুসর রং এর ঘোড়ারা যারা করুন চোখে দেখছিল তুর এর ছলনা করে নিজের ভাই তাজকে হত্যা করার দৃশ্য।তুর এর বাবা সাম্রাজ্য ভাগ করে দেয়ার সময় পারস্য থেকে চীন পর্যন্ত এলাকার দায়িত্ব দেয় তুর এর ভাই তাজের হাতে,সেটা অসহ্য আর অপমানজনক ছিল তুরের কাছে।পৃথিবী জয়ী আলেকজান্দারের মিশরের,আরবের ঘোড়াদের মধ্যে ছিল খানজার ঘোড়া।এমন কি সেই দুর্ধষ ঘোড়াটা যার হাতে শাহ ইয়াজগ্রিডের মৃত্যু হয়,আল্লাহর ক্ষমতা আর কৃপাকে অবজ্ঞা করার শাস্তি হিসেবে ঘোড়ার পা দলিত হয়ে মৃত্যু।এমন কি পাঁচ ছয়টা বিভিন্ন শিল্পীর হাতে আঁকা ছবির মধ্যেও না,আমার হাতে হয়তো আরেকটা দিন আছে অন্যান্য বইগুলো দেখার জন্যে।

২)প্রায় পচিশ বছর ধরে ওস্তাদ শিল্পীদের মধ্যে একটা কানাঘুষা শোনা যেতঃসুলতানের অনুমতিতে তাড়াহুড়া করে একজন ওস্তাদ শিল্পী এই নিষিদ্ধ খাজাঞ্চীখানায় ঢুকে এই বইটা থেকে ছবি আঁকার খাতায় ঘোড়া,মেঘ,ফুল,পাখী,বাগান,যুদ্ধের দৃশ্য নকল করে নিয়ে গেছে ব্যাবহারের জন্যে…।যখনই কোন শিল্পী অভাবনীয় একটা ছবি আঁকতো তখনই কানাঘুষা হতো ঐ ছবিটা আর কিছু না পারস্যের তাব্রিজের কোন এক ছবির নকল,তাব্রিজ তখনও ওটোমান সাম্রাজ্যের এলাকা হয়নি।এ ধরণের অপবাদ যখন আমাকে দেয়া হলে,যদিও আমি রেগে যেতাম,তবুও কেমন জানি একটা গর্বে ভঁরে যেত মন,তাব্রিজের ওস্তাদদের সাথে আমার নাম,এটা অবশ্যই গর্বের কথা,তবে অন্য কাউকে অপবাদ দিলে আবার খুব সহজেই বিশ্বাস করতাম।
এখন বুঝতে পারি আমরা চারজন শিল্পী যাদের পচিশ বছর আগে ঐ বইটা দেখার সূযোগ হয়েছিল,তাদের স্মৃতিতে এখনও জীবন্ত হয়ে আছে ছবিগুলো,সময়ে সময়ে বদলে নিজের কায়াদায় আমরা ছবি আঁকতাম সুলতানের নতুন বই এর জন্যে।কখনও হতাশ হয়নি ভেবে সুলতান খাজাঞ্চীখানার বইগুলো দেখার সূযোগ দিত না কাউকে,বরং দুঃখ হতো শিল্পীদের কুপমণ্ডূকতার কথা ভেবে,তারা নিজেদের কল্পনার আকাশ তৈরী না করে আটকে ছিল পুরোনো ওস্তাদদের কল্পনার রাজ্যে।হেরাতের শিল্পী হোক,বা তাব্রিজের শিল্পীই তাদের তুলির ছোঁয়ার ছবিগুলো ওটোমান সাম্রাজ্যের শিল্পীদের চেয়ে অনেক বেশী প্রানবন্ত।


০০০০০০০০০০০

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০২৪ সকাল ৯:০৮

রাজীব নুর বলেছেন: পামুক একজন ভালো লেখক। তার লেখার ভক্ত আমি।

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ১২:২৬

ইল্লু বলেছেন: একমত,বলার ভঙ্গীতে চমক আছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.