নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইল্লু

ইল্লু › বিস্তারিত পোস্টঃ

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:১৪

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখ
(৪৫)

‘পারসী আর তুরানীদের যুদ্ধের তৃতীয় দিন,সৈন্যরা সবাই অস্ত্র আর বর্ম গায়ে,হামারান পাহাড়ের নীচে।তুরানীদের দক্ষ গুপ্তচর সেঙ্গিলের কাজ ছিল অজানা পারসী বীরদের নাম বের করা যাদের হাতে বেশ কজন নামকরা পারসী যোদ্ধা মারা গেছে’,আমি বলা আরম্ভ করলাম, ‘সেঙ্গিল এক পারসী যোদ্ধাকে দ্বন্দযুদ্ধে আহ্বান করলো,পারসী বীর সেই প্রতিযোগীতা উপেক্ষা করতে পারেনি।দুপাশে দুদলের সৈন্যরা দাড়িয়ে,গায়ের বর্মে সূর্যের আলো ঝলমল করছে,অবাক হয়ে সবাই দেখছিল দুজনের দ্বন্দযুদ্ধ।ছুটে যাচ্ছে তারা ঘোড়ায়,বল্লমের সাথে বল্লমের,
তলোয়ারের সাথে তলোয়ারের আঘাতে আগুনের ফুল্কি ছুটছিল চারপাশে।আর সময় ছুটছে তার আপন ঘোড়ায়,যুদ্ধ চলছে আপন মনে।এক সময় তুরানী যোদ্ধা আচমকা একটা তীর ছুড়লো পারসী যোদ্ধার দিকে,তবে প্রস্তত ছিল পারসী যোদ্ধাও,ঘোড়াকে একপাশে নিয়ে তলোয়ার দিয়ে এড়িয়ে গেল তীরটা।শেষে পার্সীয়ান যোদ্ধার হাতে তুরানী যোদ্ধার ঘোড়ার লেজের টানে,ঘোড়ার সাথে সাথে সেঙ্গিলও মাটিতে পড়ে গেল।ছুটে পালানোর চেষ্টা করেও পার পায়নি সেঙ্গিল,তার গলায় তলোয়ার ধরে দাঁড়িয়েছিল পার্সীয়ান।যদিও হেরে গেছে তুরানী কিন্ত হারায়নি তার কৌতুহল,সে জিজ্ঞাসা করলো, “কে তুমি”?উত্তর দিল পার্সীয়ান, “তোমার কাছে আমি মৃত্যু”।এখন তোমরাই বলো,কে সেই পারসী যোদ্ধা’?
কেলেবেক বললো, ‘ওটা কে না জানে,আর কেউ না,কিংবদন্তীর বীর যোদ্ধা রুস্তম’।
আমি তার ঘাড়ে চুমু খেয়ে বললাম, ‘এক সময় আমরা সবাই ওস্তাদ ওসমানকে ঠকাতে দ্বিধা বোধ করিনি।ওস্তাদ তো আমাদেরকেই দোষী করে শাস্তি দেয়ার জন্যে অস্থির হয়ে আছে।তার আগেই আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে জেইতিনকে,আর শরীর থেকে নামাতে হবে ঐ ছড়ানো বিষ।আমাদের মধ্যে একটা সমঝোতা হওয়া দরকার যাতে ছবি আঁকার শিল্পি,কালিগ্রাফারদের চক্রান্ত করে শেষ করার দুষ্ট মানুষদের আক্রমন থামানো সম্ভব হয়।
এমনও হতে পারে জেইতিনের দরবেশের বাড়ীতে গিয়ে দেখা যাবে,খুনী শিল্পীদের মধ্যে কেউ না,হয়তো বাইরের একজন’।
কেলেবেক কোন কথা না বলে চুপ করে ছিল,যতই প্রতিভাবান হউক না কেন,শিল্পীরা একে অন্যকে ঈর্ষা করলেও,খোঁজে একে অন্যের সঙ্গ।ফানার গেটের হলুদ-সবুজ রংটা স্রোতের মত ছুটে আসছিল,চাঁদের আলো না,কেমন জানি একটা গা শিউরানো পরিবেশ।ঐ আলোতে ইস্তাম্বুলের বয়সী পাইন গাছ,পাথরের দেয়াল,গম্বুজ,কাঠের ঘর দেখে মনে হচ্ছিল অভেদ্য একটা দূর্গ,রাস্তা দিয়ে উপরে উঠছিলাম,আর দূরের বায়েজিদ মসিদের আগুনের ছোঁয়া ভেসে আসছিল।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে ময়দার বস্তার ঘোড়া গাড়ী ছুটছিল শহরের দিকে,দুটো রুপার মোহর দিয়ে আমরাও উঠে পড়লাম গাড়ীতে।সিয়াহর কাছে সব ছবিগুলো ছিল,ও তাই সর্তক হয়ে এপাশ ওপাশ করছিল।আমি আয়েশ করে নীচে ভেসে আসা মেঘের দিকে তাকিয়ে ছিলাম,দু এক ফোঁটা মেঘ বৃষ্টি হয়ে আমার হেলমেটে নেমে আসছিল।
বেশ কিছু দূরে যাওয়ার পর আমরা যখন দরবেশের আস্থানা খোঁজা আরম্ভ করলাম,নেড়ী কুত্তা্রা তখন ঘুম ভেঙ্গে সব চীৎকার করছিল।কিছুক্ষন খোঁজাখুঁজি করার দেখলাম পাথরের বাড়ীর আলোর ছটা দেখা যাছে,ঐ এলাকার গোটা তিনেক বাড়ী খোঁজার পর চতুর্থ বাড়ীটায় মাথায় টুপি দিয়ে কেউ একজন আমাদের সামনে বাতি নিয়ে আসলো।
আমাদেরকে দেখে তার মুখ একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তখন,বোঝা গেল ওটাই দরবেশের বাড়ী।বাড়ীর বাগানের পাইন গাছ,বৃষ্টিতে ভেজা পচা পাতা আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল।
দরবেশ বাড়ীর কাঠের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে ছূটে আসা আলোয় পাশের জানালায় আমার চোখে পড়লো,কেউ একজন নামাজ পড়ায় ব্যাস্ত,হয়তো এমনও হতে পারে নামাজ পড়ার ভান করছিল লোকটা।

আমাকে সবাই ডাকে জেইতিন বলে

ভাবছিলাম কি করবো,নামাজ থামিয়ে ওদেরকে দরজা খুলে দেব,নাকি বৃষ্টিতে ওদেরকে বাইরে অপেক্ষা করতে দেয়াটা আপাত্তঃ ঠিকই আছে?মনে হচ্ছিল ওরা আমাকেই খুঁজছে,নামাজ পড়তে পড়তে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছি তখন।দরজা খুলে দেখি,কেলেবেক,সিয়াহ আর লেইলেক,আনন্দে কেলেবেককে জড়িয়ে ধরলাম।
‘হায়,এখন কত কষ্ট আর যন্ত্রণায় সময় কাটছে আমাদের’,কেলেবেকের কাঁধে মাথা রেখে বললাম।‘ওরা আমাদের কাছে কি চায়?ওরা কেন আমাদেরকে খুন করে যাচ্ছে’?
সকলের চোখে মুখে ছিল একটা অদ্ভুত একটা ভয়,শিল্পীদের চেহারায় যা খুব একটা দেখিনি কখনও।এমন কি দরবেশের বাড়ীতে এখন ওরা একসাথেও হয়েও একা।
‘দরকার হলে এখানে আমরা সবাই বেশ কিছুদিনের জন্যে লুকাতে পারি’।
সিয়াহ বললো, ‘তুমি হয়তো বুঝতে পারছো না,ভঁয় এটাই যে খুনী হয়তো আমাদেরই একজন’।
‘এ গুজবটা আমার কানে যে আসেনি তা না,তবে এটা কি সম্ভব’।
নানান গুজব ছড়াচ্ছিল সুলতানের পাহারাদারদের থেকে শুরু করে শিল্পীদের মধ্যেও,এনিষ্টে এফেন্দী আর সিফ এফেন্দীর খুনের রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে।ও আমাদের একজন শিল্পী যে এনিষ্টে এফেন্দীর বইএ কাজ করার সময় বেশ দোটানায় ছিল।
সিয়াহ জানতে চাইলো এনিষ্টে এফেন্দীর বই এর কটা ছবি আমার আঁকা।
‘আমার প্রথম ছবিটা শয়তানের,ছবিটা অনেকটা ওস্তাদ বেইয়াজ কোয়ুনের পাতালের শয়তানের ছবির পদ্ধতি দেখে।গল্পকার আর আমি,আমরা দুজনে একই পীরের শিষ্য,সে জন্যেই আমি দুজন দরবেশকেও আঁকলাম।আমি এনিষ্টেকে রাজী করালাম,ওটোমান সাম্রাজ্যের গল্পে দুজন দরবেশের জায়গা দিতে নিশ্চয় কষ্ট হবে না’।
‘ব্যাস,ঐ একটাই ছবি’?সিয়াহ বললো।
আমি যখন বললাম, ‘ঐ একটাই ছবি’,সিয়াহের মুখে তখন এমন একটা ভাব ছিল যেন এক ওস্তাদের কাছে শিষ্যের চুরিটা ধরা পড়ে গেছে।সিয়াহর হাতে ছিল একটা ছবি যাতে বৃষ্টির কোন ছোঁয়া লাগেনি,সেটা সে আমাদের তিন শিল্পীর মাঝখানে খুলে ধরলো।
ছবিটা যখন ওর বগলে ছিল তখন ওটা চিনতে আমার কষ্ট হয়নি,কফির দোকানে হৈচৈ এর ফাঁকে ছবিটা আমারই উদ্ধার করা।আমি জিজ্ঞাসা করিনি,আমার বাড়ীর ছবিটা তাদের হাতে গেল কেমন করে?ছবিটা গল্পকারের জন্যে কেলেবেক,লেইলেক আর আমার হাতে আঁকা,আল্লাহ যেন গল্পকারকে বেহেশত নসীব করে।একটা ঘোড়ার ছবি,অভাবনীয় সুন্দর একটা ঘোড়ার ছবি পড়ে ছিল একপাশে।বিশ্বাস কর,আমার জানা ছিল না একটা ঘোড়ার ছবি ছিল সেখানে।
‘তুমি এই ঘোড়ার ছবিটা আঁকনি’?একজন ওস্তাদের মত সিয়াহ জিজ্ঞাসা করলো আমাকে।
‘না,আমি আঁকিনি’,আমি আবার বললাম।
‘এনিষ্টের বই এর ঘোড়ার ছবিটা কার আঁকা’?
‘ওটাও আমার আঁকার না’।
‘যাকগে,ছবি আঁকার কায়দা দেখে সকলের ধারণা,ঘোড়ার ছবিটা তোমার হাতেই আঁকা।
স্বয়ং ওস্তাদ ওসমানের ধারণা সেটাই’।
‘কিন্ত বিশেষ কায়দা,ধরণ বলতে আমার তো তেমন কিছু নাই’,আমি বললাম।
‘আমি এইসব নতুন পদ্ধতির জন্যে গর্ব করে কিছু বলছি না,আর নিজেকে র্নিদোষ প্রমান করার জন্যেও বলছি না।কেন না আমার জন্যে বিশেষ কোন পদ্ধতিতে ছবি আঁকা হবে খুন করার থেকেও খারাপ’।
‘তোমার ছবি আঁকায় এমন বিশেষ একটা ছোঁয়া আছে,যা তোমাকে পুরোনো ওস্তাদদের কাছে নিয়ে যায় আর অন্যান্য শিল্পীদের থেকে একেবারে আলাদা করে দেয়’,সিয়াহ বললো।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলাম,সিয়াহ সবকিছুর মধ্যে একটা যোগাযোগ খোঁজার চেষ্টা করছিল,আমার মনে হয় সেটা এখন অনেকেই জানে।আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম যে আমাদের মহামান্য সুলতান,প্রঘান খাজাঞ্চীর সাথে পরামর্শ করে ওস্তাদ ওসমানকে খুনীকে খুঁজে বের করার জন্যে তিনদিন সময় দেয়,এই জন্যে মহামান্য সুলতানের সিয়াহ আর ওস্তাদ ওসমানকে তার ব্যাক্তিগত বইপত্র ছবি দেখার অনুমতি দেয়।আমাদের সকলের জীবনেই এমন অনেক সময় থাকে যা সময়ের চাকা ছেড়ে অনেকদূর ছুটে গেলেও ভোলা যায় না,বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছিল তখন।
বৃষ্টির দাপটে কেলেবেক তার চাকুর হাতলটা যেন আরও জোর করে জড়িয়ে ধরলো, জেইতিন সাদা ময়দা মাখানো বর্মে,বাতি নিয়ে সাহসের সাথে দরবেশের আস্থানা খুঁজে খুঁজে দেখছিল।
এই সব নিপুন শিল্পীরা,যাদের ছায়া দেয়াল থেকে দেয়ালে ভেসে বেড়াচ্ছে ভুতের মত,ওরা আমাদেরই একজন,দুঃখ হয়,আমি কি ওসেরকে কত না ভালবাসতাম,ক্ত সম্মান করতাম
অথচ ওদেরই একজন খুনী!শিল্পী হিসাবে আমার গর্বও খুব একটা কম না!
সিয়াহকে বললাম, ‘ওস্তাদ ওসমানের সাথে পুরোনো ঐতিহ্যবাহী শিল্পীদের ছবি দেখার সৌভাগ্য হলো তোমার,তোমার অভাবনীয় সূযোগের কথা ভেবে আমার হিংসাই লাগছে!ওস্তাদ ওসমান কি তোমাকে আদর করছিল?তোমাকে কি চুমু খাচ্ছিল মাঝে মাঝে?তোমার হাত ধরে ছিল সবসময়?ওস্তাদের জ্ঞান আর প্রতিভা দেখে তুমি অবাক হওনি’?
‘পুরোনো ওস্তাদদের ছবির ব্যাখা করার সময় ওস্তাদ ওসমান তোমার ছবি আর তোমার আঁকার বিশেষ সৌন্দর্যের কথাই বার বার বলছিল’,সিয়াহ বললো,
‘ওস্তাদের কাছে এটা জানলাম ছবিতে যে খুঁতগুলো দেখা যায় সেটা শিল্পির অজান্তেই আসে তার স্মৃতির পুরোনো পাতা থেকে,পুরোনো অভ্যাসের নতুন প্রতিফলন।বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ম আমরা পুরোনো ওস্তাদদের খুঁতগুলোকে সম্মান করে বিশেষত্ব হিসেবে তুলে ধরি।ইউরোপীয়ান ওস্তাদদের তুলির আঁচড়ে চারপাশে ছড়ানো ছবি দেখে বোকা শিল্পীরা খুঁতগুলোকে বিশেষত্ব ভেবে এঁকে যাচ্ছে সবসময়’।
এটূকু বুঝলাম সিয়াহ ওস্তাদ ওসমানের কথাগুলো সম্পুর্নই বিশ্বাস করে,ওর মত বোকার আর কে আছে?
‘ওস্তাদ ওসমান আমার আঁকা অন্যান্য বইগুলোতে বিশেষ ধরণের ঘোড়া নিয়ে কিছু ব্যাখা দিল নাকি’?আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘আদর আর মার দিয়ে ছোটবেলা থেকে ওস্তাদ ওসমান তোমাদেরকে ছবি আঁকা,কালিগ্রাফী শেখায়।তোমাদেরকে কাছে ওস্তাদ ছিল বাবার মত,ভালবাসার মানুষ,ওস্তাদ নিজেকে তোমাদের কাছাকাছি মনে করে না,আবার তোমাদের একে অন্যকে একই রকম ভাবে না।ওস্তাদ ওসমানের কোন সময়ই ইচ্ছা ছিল না তোমাদের একেক জনের ছবি আঁকার ধরণটা একেক রকম হয়,বরং তার ইচ্ছা ছিল মহামান্য সুলতানের শিল্পীদের সকলের হবে একটা বিশেষ কায়দা।তার প্রভাব এতই বেশী ছিল যে,তোমরা সবাই ভুলে গেলে অন্তরের দৃষ্টির কথা,ছবি আঁকার জগতের বাইরের রুপটা।তবে অন্যান্য বই এর ছবি যখন তুমি আঁকলে যা ওস্তাদ ওসমানের দেখার সূযোগ হয়নি,তখন তুমি তুলে ধরলে তোমার মনের খাতায় সাজানো ঘোড়াটা’।
‘আমার মা,আল্লাহ তাকে যেন বেহেশতবাসী করে,বাবার চেয়ে অনেক বেশী চালাক চতুর ছিল,’,আমি বললাম, ‘একদিন রাতে বাসায় ফিরে কাঁদতে কাঁদতে প্রতিজ্ঞা করলাম,আর ছবি আঁকার ওস্তাদের স্কুলে ফিরে যাব না।ওখানে শুধু ওস্তাদ ওসমানের মারধর ছিল না,সাথে ছিল অন্যান্য ওস্তাদদেরও রুলার দিয়ে মারধর অত্যাচার।আমার মা আমাকে বুঝিয়ে বললো,
ওস্তাদদের ঐ মারধরের দুটো দিক আছে,একটা হতে পারে সেটা তোমার ভেতরের লুকানো শয়তানকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে,আরেকটা সেটা তোমাকে শেখায় লুকোনো ঐ শয়তানকে কি ভাবে আয়ত্বে আনা যায়।দ্বিতীয়ত কেউ কখনও ভোলে না তাদের ছেলেবেলার যন্ত্রনা আর শেখে বন্ধু,শত্রুর চেহারার পার্থক্যটা।গাছের পাতা ভালভাবে আঁকতে পারিনি বলে ওস্তাদ ওসমানের প্রচন্ড থাপ্পড়ের কথা আমি আজও ভুলিনি,একটা জঙ্গলের ছবি আমার মনে এখনও জীবন্ত হয়ে আছে।মারধর করার পর ওস্তাদ ওসমান আদর করে ছবিটাতে একটা আয়না ধরে দেখালো আমার ভুলটা।তারপর আমার গালটা গালে ধরে ওস্তাদ ওসমান আমাকে সবকিছু যে ভাবে বোঝালো,কোনদিন ভুলিনি,না তার ভালবাসা,না ঐ মারধর।তখনই আমি জানতাম,একদিন একজন নামকরা শিল্পী হবো,তবে হ্যা,ঐ ঘোড়ার ছবিটা আমি আঁকিনি’।
‘আমরা’,সিয়াহ,লেইলেক আর তার কথা বলছিল, ‘দরবেশের বাড়ী একটু খুঁজে দেখবো,কেননা খুনী আমার এনিষ্টেকে মারার পর ছবিটা নিয়ে গেছে।তুমি কি জান এনিষ্টের ঘরের ঐ শেষ ছবিটা কোথায়’?
‘আমরা যাই বলি না কেন,কোন কথাই সুলতানের কাছে গ্রহনযোগ্য হবে না।আমরা শিল্পীরা কৃতজ্ঞ পুরোনো ওস্তাদের কাছে,মুসলমান আমরা বিশ্বাস আমাদের আল্লাহতে’,বলে আমি চুপ হয়ে গেলাম।
আমার কথা শুনে সিয়াহর কৌতুহল আরও বেড়ে গেল।লেইলেক তখন বাড়ীর সবকিছু তছনছ করে খুঁজে বেড়াচ্ছিল কিছু একটা।মাঝে মাঝে তাদেরকে সাহায্য করার জন্যে আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম।দরবেশের একটা ঘরে ছাঁদ থেকে পানি পড়ছিল,ঐ ঘরের মেঝেতে একটা গর্তও ছিল,সেটা তাদেরকে দেখালাম।দূরের ছোট্ট ঘরের চাবিটা ওদের হাতে তুলে দিলাম,নতুন ঘর হওয়ার আগে দরবেশ ওখানেই থাকতো।বেশ উৎসাহ নিয়ে ওরা ঘরটাতে ঢুকলো,অবশ্য ভাঙ্গা দেয়াল আর বৃষ্টিতে ভেজা ঘর দেখে ওদের উৎসাহ একেবারেই কমে গেল।
কেলেবেককে ওদের সাথে না দেখে যদিও কিছুটা খুশী হলাম,তবে এটা জানা ছিল আমার আমাকে অভিযুক্ত করে কোন কিছুর খোঁজ পেলে ও নিঃসন্দেহে ওদের দলে যোগ দিবে।
লেইলেক আর সিয়াহ দুজনের একই চিন্তা,হয়তো ওস্তাদ ওসমান আমাদেরকে নির্যাতনের জন্যে পাহারাদারদের হাতে তুলে দিবে।ওদের একই মন্তব্য আমরা সবাই যেন এক হয়ে থাকি আর দরকার হলে প্রধান খাজাঞ্চীকে ঠিকমত ভাবে বোঝাতে পারি।আমার মনে হলো সেকুরেকে বিয়ের উপহার দিচ্ছে সিয়াহ সেকুরের বাবা এনিষ্টের খুনীকে খুঁজে দিয়ে,শুধু তাই না তার ভাব দেখে মনে হলো এনিষ্টের সুলতানের ওটোমান সাম্রাজ্যের বইটা ইউরোপীয়ান শিল্পীদের দিয়েই শেষ করবে,আর সেটা হবে সুলতানের মোহর খরচ করেই।আমার কোন সন্দেহ ছিল না এই চক্রান্তের মুলে আছে লেইলেক যাতে সে আমাদের সবাইকে নির্বাসনে পাঠাতে পারে,এমন কি ওস্তাদ ওসমানকেও(সবাই তো জানেই ওস্তাদ পচ্ছন্দ করে কেলেবেককে,
উত্তরাধিকারী হিসাবে)।
বাইরের বৃষ্টির শব্দে অন্যমনস্ক হয়ে,আপন মনে বাদানুবাদ করছিলাম,আমি অনেকটা রাস্তার ধারে লোকের ভিড়ের অভিযোগ হাতে দাঁড়ানো একজন যে ঘোড়ায় সুলতান আর উজিরের সামনে ছুটে যায়,আমার প্রশ্ন ছিল সিয়াহ আর লেইলেকের কাছে।ছোট্ট একটা হল ঘর দিয়ে আমি ওদের দুজনকে একটা ভয়াবহ ঘরে নিয়ে গেলাম যেটা একসময় ছিল রান্নাঘর।
একসময়ে ওদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম,কিছু খুঁজে পেল কি না,অবশ্য জানাই ছিল ওখানে কিছু খুঁজে পাওয়ার কথা না।রান্নাঘরের পুরোনো থালাবাসন যা গরীবদের খাবার তৈরী করার জন্যে ব্যাবহার করা হতো,তা ছাড়া কিছুই ছিল না ওখানে।আমি অবশ্য ঐ ঘরটা কোন সময় পরিষ্কার করার চেষ্টা করিনি,চারপাশে ছিল মাকড়শার জাল,ময়লা,কুকুর বিড়ালের পায়খানা।বাইরের জোরালো বাতাসে বাতিটা নিভে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেছে তখন।
‘তোমরা খুঁজেই যাচ্ছ,অথচ আমার লুকানো রহস্যটা বের করতে পারছো না’,একটু কৌতুকের সুরে বললাম।
অভ্যাসমত হাত দিয়ে লুকানো ছাইগুলো একপাশে সরালাম,পুরোনো আমলের নিচের চুলাটা দেখা যাচ্ছিল তখন।হাতের বাতিটা দিয়ে চুলার লোহার ঢাকনিটা খুলে দেখছিলাম,দৃশ্যটা ভোলার মত না সিয়াহর বোঝার আগেই যে ভাবে লেইলেক ছুটে ভেতরের চামড়া ব্যাগটা নিয়ে গেল।চুলার ওপরেই লেইলেক ব্যাগটা খুলবে ঠিক সে সময় আমি আর সিয়াহ চুলার কাছাকাছি হেঁটে গেলাম।
ব্যাগটা খুলে দেখা গেল আছে শুধু আমার মোজা,রাতের পায়জামা,আন্ডারওয়ার,ওদের অবাক হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।আরেকটা ব্যাগ খুলে ওরা পেল ৫৩টা ভেনিসের সোনার মোহর,কটা সোনার পাতা সুলতানের ছবি আঁকার দপ্তর থেকে আমার চুরি করে আনা,আমার কিছু অশ্লীল স্কেচ যা অন্য কারও জানা ছিল না।আমার মায়ের কটা সাদা চুল,মায়ের দেয়া কিছু স্মৃতি।
‘আমি যদি খুনী হতাম’,বোকার মত বললাম,’তা হলে এই লুকানো জিনিষের মধ্যেই থাকতো শেষ ছবিটা,এ সব আজে বাজে জিনিষ না’।
‘এই জিনিষগুলো কেন ছিল এখানে’?লেইলেক জজ্ঞাসা করলো।
‘সুলতানের পাহারাদাররা যখন আমার বাড়ী তল্লাসী করছিল,তোমার বাড়ীর মতই,আমার সারা জীবনের সঞ্চয় থেকে ওরা চুরি করে নিয়ে গেছে দুটা সোনার মোহর।ভাবছিলাম ঐ নরাধম খুনীর কারণে আমরা সবাই অস্থির হয়ে গেছি,তছনছ করে খুঁজে বেড়াচ্ছি সব শিল্পীদের বাড়ী,আমি খুনী হলে ঐ শেষ ছবিটা এখানেই থাকতো’।ঐ শেষ কথাটা বলাটা বোধহয় ঠিক হয়নি,তখন সিয়াহ আর লেইলেক বুখতে পারলো,আর যাই হোক আমি ওদের কোন ক্ষতি করছি না।ওরা কি এখন আমাকে বিশ্বাস করছে?
একটা অস্থিরতা আমার মনে ছোটাছুটি করছিল,জানি না সেটা শিল্পী বন্ধুদের আমার লোভী চেহারাটা দেখায়,না আমার অশ্লীল ছবিগুলো দেখায়।হয়তো বা ভেবে ভয়ে কেন যে তাদের সামনে আমার সব রহস্য তুলে ধরলাম,আমার লোভ লালসার চেহারাটা কেন যে দেখালাম।
‘যাই হোক’,সিয়াহ বললো, ‘আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ওস্তাদ যদি আমাদেরকে পাহারদারদের হাতে তুলে দেয়,তা হলে কি বলবো,কি করবো আমরা’?
শূন্যতা,হতাশায় ছেয়ে ছিল আমাদের চিন্তার আকাশ।বাতির হাল্কা আলোয় সিয়াহ আর
কেলেবেক আমার নোংরা ছবির স্কেচগুলো পরখ করে দেখছিল।তাদের চেহারায় কোন পরিবর্তন দেখলাম না,বরং মনে হলো ছবিগুলো দেখে ওরা কেন জানি বেশ খুশীই হলো,এক সময় আমিও ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছবিগুলো দেখছিলাম,যে কারণেই হোক আমাদের চারজনের একসাথে ছবি দেখাটা আমাকে বেশ উৎসাহিত করছিল।
‘অন্ধ আর দেখার মানুষ কি কোন সময় এক হতে পারে’?লেইলেক জিজ্ঞাসা করলো।লেইলেক কি বলতে চাচ্ছিল,আমার আঁকা ছবিগুলো যদিও অশ্লীল তবু আল্লাহর দেয়া চোখে দেখার সৌভাগ্যটা কম কি?যাক,লেইলেকের বুদ্ধি আর কতটুকু?ও তো কোরআন শরীফ পড়েনি।
আমি জানি হেরাতের পুরোনো ওস্তাদেরা কোরান শরীফ থেকে প্রায়ই আবৃত্তি করতো।পুরোনো ওস্তাদেরা ছবি আঁকার বিরোধীদের বলতো,যাদের বক্তব্যে ওটা ধর্মবিরোধী কাজ,তারা অন্দধ ওদের চোখ থেকেও চোখ নেই।
এর আগে আমি কোনদিন কেলেবেকের মুখে এটা শুনিনি,‘আমি বোঝাতে পারি,অন্ধ আর দেখার চোখ দুটো এক না’।
‘অন্ধ সে তো অন্ধই,তবে দেখার চোখ থাকার পরেও অন্ধ কেউ আছে নাকি’?সিয়াহ অনেকটা বোকার মত জিজ্ঞাসা করলো।
‘অন্ধ আর দেখার চোখ এক না,এটাই বলে, “ভে মা ইয়েস্তিভিল ভে লা বাসিরু”,কথাটার মানে’,কেলেবেক বললো,তারপর না থেমে বললো,
‘…আলো আর অন্ধকারও এক না।
শীতল বাতাস আর গ্রীষ্মের প্রতাপ কি এক?
যেমন এক না জীবিত আর মৃত’।
আমি কেন জানি ভঁয়ে একটু কেঁপে উঠলাম,সিক এফেন্দী,এনিষ্টে আর আমাদের নিহত রাতের গল্পকারের কথা ভেবে।জানি না অন্যান্যরাও কি আমার মত ভঁয় পাচ্ছিলো?হয়তো না তবে সবাই চুপচাপ দাড়িয়েছিল,লেইলেকের হাতে খোলা একটা বই, আঁকা আমার অশ্লীল ছবিগুলো।
‘কেয়ামত দিনের দৃশ্যটা ছবিতে তুলে ধরার খুবই ইচ্ছা আমার’,লেইলেক বললো, ‘লাশগুলো কবর থেকে উঠে আসছে,পাপী আর বিশ্বাসীদের ভাগ হয়ে গেছে।বিচার হচ্ছে ন্যায় অন্যায়ের,
নামাজীরা হেঁটে যাচ্ছে আলো ছড়ানো চোখেমুখে,কাফেরদের কান্না,আমরা কেন আমাদের ধর্মের বিশ্বাসের ছবিটা তুলে ধরতে পারবো না’?

০০০০০০০০০০০

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:২০

সৈয়দ কুতুব বলেছেন: সুন্দর কাহিনী!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.